Search

Tuesday, June 15, 2021

রাজনীতিতে উত্তর-আধুনিকতার প্রভাব

------------------------------------

মোহাম্মদ আবুল হাসান

------------------------------------


১৯৪৪ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ফ্রাংকফ্রুর্ট স্কুল চিন্তক অ্যাডর্নো এবং হকহেইমার ‘ডায়ালেক্টিক অব এনলাইটেনমেন্ট’ নামক পুস্তকে আধুনিকতাকে গণপ্রতারণা হিসাবে চিহ্নিত করার পর চিন্তারাজ্যে সীমাহীন নৈরাজ্য দেখা দেয়। ধর্মীয় মহা-আখ্যানগুলোর পাশাপাশি পুঁজিবাদ, মার্কসবাদ, উদারনৈতিকতাবাদ, উপযোগবাদসহ চিরায়ত প্রতিষ্ঠিত কাঠামোগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেই ক্ষান্ত থাকেনি উত্তর-কাঠামোবাদীরা, খোদ ইউরোপীয় সাদা সভ্যতাসহ পুরো আধুনিকতাকে বিতর্কিত করে তুলেছে আধুনিকতার এ অধিপাঠ। শিল্পবিপ্লব যদি আধুনিকতার ভিত্তিভূমি হয়, তবে তথ্যপ্রযুক্তি হলো উত্তর-আধুনিকতার উর্বর জমিন। সিগমন্ড ফ্রয়েডের আনকনশাসে চিন্তাজগতের সীমাহীন স্বাধীনতার কারণে মনের কথার সন্ধানে লিপ্ত হয়েছে মানুষ। সন্দেহের বাতাবর্তে পরাবাস্তববাদী প্রভাব শিল্প, সাহিত্যের পাশাপাশি রাজনীতিতেও সত্যের সুলুক সন্ধানে ব্যাপৃত হয়। অধুনা তথ্যপ্রযুক্তি এ আগুনে ঘি ঢেলে দিয়ে রাজনীতিকে নিয়ত বিচলিত ও বিভ্রান্ত করে চলেছে।

জাঁক দেরিদা তার ডিকনস্ট্রাকশনে কোনো কিছুর সুনির্দিষ্ট অর্থবোধকতাকে নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘কোনো টেক্সট লেখা হলে তা নিজে একটা মিনিং ধারণ করার পাশাপাশি একটা বিপরীত মিনিংও ধারণ করে।’ কোনো লেখক লেখার মাধ্যমে কোনো কিছু প্রকাশ করতে চাইলে তার মনে হয়, আমি যা কিছুই বুঝাতে চাই না কেন; পাঠক তার নিজের মতো করেই বুঝে নেবে। তাই লিখে কোনো কিছু প্রকাশের চেষ্টা নিরর্থক। লেখক ও পাঠকের রক্তপাতহীন বোঝাপড়ার সংঘাতে সীমাহীন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের ঔদ্ধত্য পাঠককে নিরীহ থাকতে দেয় না। লেখককে তার অধিপতি মানতে নারাজ সে। প্রযুক্তির ব্যবহারে ফেসবুক ও টুইটারে লাইক, কমেন্টস ও শেয়ার স্বল্প পরিশ্রমে রাতারাতি তাকে তারকাখ্যাতির আত্মঅহমিকায় ভোগাচ্ছে। এমন আত্মঅহমিকায় সিক্ত রাজনীতিবিদ বুঝে না বুঝে, নিজ পরিধির বাইরে গিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের নীতিগত সিদ্ধান্তসহ নানাবিধ কর্মের চ্যালেঞ্জ করছেন। এহেন সাহসী কর্মে স্বদলীয় বৈরি শক্তির প্রশংসায় ভাসছেন তিনি। পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির এমন প্রকাশ্য বচসা নিজদলীয় ঐক্যে ভয়াবহ ফাটল ধরাচ্ছে।

জার্মান তাত্ত্বিক ওয়াল্টার বেনিয়ামিন তার ‘The work of art in the age of mechanical reproduction-1936’ নামক প্রবন্ধে বলেন, ‘যথাযথ শিল্প নিজেকে শুধু প্রকাশই করে না, গোপনও করে।’ বিপরীত লিঙ্গের কৌতূহল হেতু ইসলামের পর্দা প্রথা নারীর সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়। প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বগুলোর ঐশ্বরিক ইলিউশন ও শৈল্পিক সৌন্দর্য প্রযুক্তির অতিব্যবহারে হাতে হাতে পৌঁছে যাওয়ায় নেতাদের প্রতি কর্মীদের আগ্রহে ভাটা পড়ছে। উপরন্তু নেতাদের বিশেষ গুণগুলোর দোষ-ত্রুটি বিশ্লেষণ করে পরিকল্পিত অপপ্রচার তাকে বিতর্কিত করে তুলছে। প্রযুক্তির সহায়তায় নিজদলীয় এমন অপরাজনীতি দলের অভ্যন্তরীণ শক্তিকে বিনষ্ট করছে। উত্তর-আধুনিকতা High art I Low art-এর ধারণাকে খারিজ করে দেয়। তর্কের খাতিরে রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমকে high art এবং কায়িক শ্রমকে low art ধরে নিলে কায়িক শ্রম নিয়ত দেখা গেলেও বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম দেওয়া হয় পর্দার অন্তরালে। রাজনীতিতে যাদের কম দেখা যায় বা আদৌ দেখা যায় না, দলীয় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হয়তো সেই বেশি করছে। দলীয় সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামকে জানিয়েই কাজগুলো করছে সে, যা টেকনিক্যাল কারণে সর্বসাধারণে জানানো হয়তো সম্ভবপর নয়। পক্ষান্তরে নিয়মিত সদম্ভে বিচরণ করা কোনো কর্মী হয়তো স্বল্প লোভে বিপক্ষ শক্তির এজেন্ট হিসাবে কাজ করছেন। নানা শ্রম ও উপাদানের সুসন্বিত রূপে নেতৃত্ব নির্বাচিত হলেও নেতাকর্মীদের প্রায় অসন্তুষ্ট হয়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্কের ঝড় তুলতে দেখা যায়। একদল অপর দলকে গাধাভিত্তিক শ্রমিক ও এসি রুমের বাসিন্দা বা আয়েশি নেতা হিসাবে কটাক্ষ করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে টিপ্পনি কাটতেও কসুর করেন না। দলের পক্ষ থেকে গোপনীয়তার স্বার্থে যথোপযুক্ত প্রমাণসহ নেতৃত্ব নির্বাচনের যৌক্তিক কারণগুলো তুলে ধরাও হয়তো সম্ভব হয়ে ওঠে না। কথা-কর্ম ও প্রকাশে সরাসরি এমন বৈরিতা আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে সাধিত হয়েছে, আগের দিনে তা ছিল কল্পনাতীত।

ফরাসি পণ্ডিত মিশেল ফুকোর বায়োপলিটিক্সের ধারণায় জ্ঞান ও ক্ষমতার সম্পর্ক বিচারে ক্ষমতা জ্ঞানকে স্বীকৃতি দেয় আর জ্ঞান ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখে। রাজনৈতিক ক্ষমতা, পুঁজিবাদী করপোরেট সংস্থা ও নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম ফরমাইশি বুদ্ধিজীবি তৈরি করে থাকে। এমন বুদ্ধিজীবীদের বয়ান ও কর্মপরিকল্পনার সন্দেহ মিশ্রিত অনুপরীক্ষণ দলের অভ্যন্তরে অবিরত চলতে থাকে। গৃহীত সিদ্ধান্তের সফলতা-ব্যর্থতার চুলচেরা বিশ্লেষণে বুদ্ধিভিত্তিক সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। উত্তর-আধুনিক টেক্সট যেমন ব্যাখ্যা তৈরির কারখানা, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক কোনো দৃশ্যপটও অসীম ব্যাখ্যা তৈরি করছে। কেউ কারাগারে গেলে ইচ্ছা করেই কারাগারে গিয়েছেন, আবার মুক্তি পেলে সরকারের যোগসাজশে মুক্তি পেয়েছেন। মামলা হলে ইচ্ছা করেই মামলা নিয়েছেন, আর মামলায় নাম না থাকলে তাকে সরকারের এজেন্ট বলছেন খোদ নিজদলের লোকজন। বিরোধীদলীয় মিটিং-মিছিলকে সরকারি দলের ছত্রছায়ায় ও পুলিশকে উৎকোচ প্রদান করা হয়েছে বলে অভিযোগ করছে স্বদলীয় বিপক্ষশক্তি। মিটিং-মিছিলকারীরা আবার নিজেদের সুসংহত শক্তি হিসাবে দলীয় ফোরামে জানান দিচ্ছেন। একই ঘটনাকে সরকার দলীয় বিপক্ষ শক্তি হাইকমান্ডকে অবহিত করছেন স্থানীয় রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা নেতাদের বিতর্কিত করার লক্ষ্য নিয়ে। পাড়া-মহল্লায় সামাজিক অনুষ্ঠানে দু’দলের দু’জন নেতার মিলিত ছবি স্ব-স্ব দলীয় বিপক্ষশক্তি ফেসবুক-টুইটারে ভাইরাল করছেন অভিযোগের সুরে। এমন নানা তৎপরতা ও অপতৎপরতায় রাজনীতির প্রকৃত অবস্থা প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে দেয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কার্ল স্মিট তার ‘The concept of political-1926’ নামক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘Sense of enmity’ থেকে রাজনীতির উৎপত্তি, যা দুটো বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির পাশাপাশি নিজ দলেও আছড়ে পড়ছে। রাজনৈতিক উঁচু মহলের গাণিতিক সমীকরণ ও যোগ-বিয়োগের খেলায় বড় নেতার অবস্থানচ্যুতির কারণে তার অনুসারী নির্দোষ ও কঠোর পরিশ্রমীদের প্রায়ই অন্যায়ের শিকার হতে দেখা যায়। ঐতিহাসিক বা পদ্ধতিগত প্রেক্ষাপটে স্ব-ইচ্ছায় বা মনের অজান্তেই উপদলে নাম লেখানো কর্মীটি নিয়তিকে মেনে না নিয়ে উত্তেজনায় ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিপক্ষ বড় কোনো শক্তির অপপ্রচারে লিপ্ত হয়ে পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তুলছেন। অধিকন্তু রনজিত গুহের নেতৃত্বে গড়ে উঠা সাবলটার্ন স্টাডিজের নিুবর্গের ইতিহাস চর্চায় অনুপ্রাণিত হয়ে অনুসংগ্রামের নায়করা নিজেদের কেন্দ্রীয় চরিত্রে দেখতে চান। নেতৃত্ব নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড না থাকায় সবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আকাশ স্পর্শ করছে। উপরন্তু দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামে দলে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বগুলোর শৈল্পিক ‘অঁরা’ ১/১১ সরকার অনেকটাই ভেঙে দিয়েছে। দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থাকা সরকারি নির্যাতনে পিষ্ট প্রত্যেক নেতাকর্মী নিজেকে অনুসংগ্রামের নায়ক ভাবছেন; কিন্তু পুরোনো প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্ব তা মানতে নারাজ। পক্ষান্তরে প্রায় এক যুগ ক্ষমতায় থাকা সরকারি দলে কালো টাকার দৌরাত্ম্যে গড়ে উঠেছে এক নতুন শ্রেণি। এ জায়মান শ্রেণি সরকারি দলের অপেক্ষাকৃত সৎ ও প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বকে চ্যলেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে অর্থের বিনিময়ে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে। এ যেন অহিংস, সহিংস ও রক্তপাতহীন যুদ্ধে সবাই সবার টার্গেট। তথ্যপ্রযুক্তির অবারিত দ্বার যেমন নেতাকর্মীদের মাঝে অফুরান যোগসূত্র স্থাপন করেছে, ঠিক তেমনি শুধু লবিংয়ের জোরে নেতা বানানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিক লেনদেনে নেতৃত্ব নির্বাচনের অভিযোগ আসছে প্রকটভাবে। সন্দেহ ও অবিশ্বাসের দোলাচলে রাজনীতিকে আর সুতায় বাঁধা যাচ্ছে না।

২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে ক্ষমতাসীনরা বিরোধীদের কোণঠাসা করে রাখার কারণে প্রকৃত রাজনৈতিক চর্চার পাশাপাশি বিরোধীরা পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। পক্ষান্তরে পুলিশ ও প্রশাসননির্ভর সরকারি দলের নেতাকর্মীরাও শুধু অর্থনৈতিক চাহিদা ও ক্ষমতা চর্চায় ব্যাপৃত হয়েছেন। ফলে নিজেদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ ও রাজনৈতিক চর্চার অভাব হেতু বোঝাপড়া দিনকে দিন কমছে। ঐক্যের পরিবর্তে রাজনীতি হয়ে উঠছে পার্থক্যনির্ভর। চিন্তার নৈরাজ্য, প্রযুক্তির অপব্যবহার, সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বাতাবরণে রাজনীতিতে উত্তর-আধুনিকতার ভয়াবহ প্রভাব চিরায়ত রাজনীতির শৈল্পিক সৌন্দর্যকে ম্লান করে দিচ্ছে। নোয়াম চমস্কি যেমন করে বলেন, ‘সব মানুষই দার্শনিক, কারণ মানুষ এমন বাক্য বলতে পারে; যেটা আগে কখনো সে শোনেনি। আবার আগে অকথিত বাক্যের অর্থ যথাযথভাবে উদ্ধার করতে পারে সে।’ রাজনীতিবিদরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। অধিকন্তু উচ্চাভিলাষ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার স্বভাবজাত। এহেন রাজনীতিবিদদের জন্য নিজেকে লাগামহীন করতে চমস্কির ভাষামালার চেয়ে জুতসই বয়ান আর কিই বা হতে পারে! তবে উত্তর-আধুনিকতার ভয়াবহ আবিষ্টতা তরুণ রাজনীতিকদের সবচেয়ে বেশি বেচাইন করে তুলছে। এর কারণ, যার কেবল দাঁত গজিয়েছে; সে সবকিছুই কামড়াতে চায়।



  • লেখক সাবেক যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ।
         লেখাটি প্রথম দৈনিক যুগান্তরে সম্পাদকীয় পাতায়  প্রকাশিত              হয়েছে। লিঙ্ক https://bit.ly/3glfj4O

No comments:

Post a Comment