Search

Monday, August 22, 2022

ধন্যবাদ নিজেকে ‘দালাল’ বলা বিদেশমন্ত্রী!

— রুমিন ফারহানা



মানুষের কখনো কখনো সময় খারাপ যায়। আমরা বলি ‘চোরাবালিতে’ পড়া। এই চোরাবালিতে পড়লে নাকি দাপাদাপি করতে হয়না, চুপ থাকতে হয়। বিদেশমন্ত্রী যেদিন বললেন আমরা বেহেশতে আছি সেদিনই নিজের জন্য যথেষ্ট বিপদ ডেকে এনেছিলেন তিনি। ‘চোরাবালি’ না হলেও বিপদ খুব ছোট ছিল না। শেষমেশ সাংবাদিকদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেকে কিছুটা হলেও রক্ষার চেষ্টা করেন।


বলেন, ‘আমি তো ট্রু সেন্সে বেহেশত বলিনি। কথার কথা। কিন্তু আপনারা সবাই আমারে খায়া ফেললেন।’ কে কাকে খায়া ফেলছে সেই আলোচনায় না গিয়েই বলি করোনার ধাক্কায় মানুষ যখন বিপর্যস্ত, টিসিবি’র ট্রাকের পেছনে মানুষের সারি প্রতিদিনই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, কাজ হারিয়ে, বেতন কমে মানুষ যখন হিসাব কষছে সন্তানের জন্য দুধ নাকি মায়ের জন্য ওষুধ কিনবে, ঠিক তখনই হঠাৎ করে জ্বালানির দাম বাড়া যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। আর সেই ঘায়ের ক্ষততে লবনের ছিটার মতো আসলো বেহেশত প্রসঙ্গ। সেটাও এক রকম সামলে ফেলেছিলেন মন্ত্রী। কিন্তু শেষ রক্ষা  হলো না। এইবার আর বিপদ না, হাত পা মেলে চোরাবালিতে ঝাঁপ দিলেন তিনি। এখন দেখার বিষয় একা ডোবেন নাকি দলবলসহ।    

গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম শহরের জেএম সেন হলে জন্মাষ্টমী উৎসবের এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দারুণ এক আবদার কিংবা কারও কারও মতে মিনতি করেন ভারত সরকারের কাছে। সেই আবদার মেটানোর জন্য যা যা করা দরকার তাও করতে হবে ভারতকেই। তিনি খোলাখুলি বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা আমাদের আদর্শ। তাকে টিকিয়ে রাখতে পারলে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে যাবে এবং সত্যিকারের সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, অসাম্প্র্রদায়িক একটা দেশ হবে। শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারতবর্ষের সরকারকে সেটা করতে অনুরোধ করেছি।’  এই সেদিন পর্যন্ত সরকারি দলের মুখে আমরা শুনেছি তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ দলটি নাকি কথায় কথায় বিদেশিদের কাছে ধরনা দেয়, তাদের কাছে নালিশ জানায়, সরকারের সমালোচনা করে তাদের কাছে সমাধান চায়। আর সরকারি দল নাকি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে দেশের মানুষই তাদের একমাত্র শক্তি, ক্ষমতার উৎস। অথচ ২০০৩-২০০৪ সালে বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিদেশে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগের কথা যদি ছেড়েও দেই ২০১৪ সালের পর থেকে এই সরকারের বিদেশ নির্ভরতার কথা একটা শিশুও জানে। এমনকি রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন  কথাও প্রচলিত আছে যে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল ১/১১ সরকারের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তারা নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মধ্যদিয়েই ক্ষমতায় যেতে পেরেছিল। 


ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস’ বইয়ে লিখেছেন, ২০০৮ সালে তৎকালীন বাংলাদেশের ডি-ফ্যাক্টো শাসক সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ ভারত সফরে যান এবং তিনি নির্বাচনের পর নতুন সরকারের অধীনে চাকরি হারানোর ভয়ের কথা জানান প্রণব মুখার্জীকে। জনাব প্রণব মইন ইউ আহমেদকে আশ্বস্ত করেন যে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে তার কোনো সমস্যা হবে না।   বাংলাদেশে নির্বাচনহীনভাবে ক্ষমতায় থাকা না থাকা নিয়ে কোন কোন দেশের কেমন নেপথ্য ভূমিকা আছে, সেসব নিয়ে মানুষের মধ্যে নানা অনুমান, ফিসফাঁস, আলোচনা আছে। কিন্তু এটা একেবারে প্রকাশ্যে চলে আসে ২০১৪ সালের তথাকথিত নির্বাচনের আগে। ভারতে তখন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার। তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং দেশে আসেন নির্বাচনের আগে। বিএনপিসহ প্রায় সকল দল নির্বাচনে না থাকায় জাতীয় পার্টিকে যে কোনো মূল্যে নির্বাচনে এনে সেটাকে কিছুটা হলেও জায়েজ করার চেষ্টা করা হয়। মিস সুজাতা এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করে তাকে শক্ত চাপ দেন নির্বাচনে অংশ নিতে, যা বৈঠকের পর এরশাদ মিডিয়ার কাছে ফাঁস করে দেন। এটা যে তৎকালীন ভারতীয় কংগ্রেস সরকারের সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার অংশ ছিল, সেটা প্রমাণিত হয়েছে আরও পরে।      বাংলদেশের ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সালমান খুরশীদ। ২০১৫ সালে প্রকাশিত তার ‘দ্য আদার সাইড অব দ্য মাউন্টেইন’ বইয়ে তিনি যা বলেছিলেন, সেটা খুব স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে তার দল কংগ্রেসের সরকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কতটা হস্তক্ষেপ করেছিল। 


সে বইয়ে তার একটা উদ্ধৃতি এ রকম- “বাংলাদেশে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে রাজপথে একদিকে সরকার সমর্থক ও তরুণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী জাতীয়তাবাদী (গণজাগরণ মঞ্চ) এবং অন্যদিকে কট্টর জামায়াতে ইসলামীর কদর্য সংঘাতের ঘটনায় প্রাথমিক সেসব ইতিবাচক লক্ষণগুলো গুলিয়ে যায়। আর সে সময় আমাদেরকে প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ শিবিরের দিকে ঝুঁকতে হয়। ভারতের এটি বেছে নিতেই হয়েছে। এক্ষেত্রে অবস্থান নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া এবং সেজন্য সুযোগ হারানোটা সত্যিই বিপজ্জনক ছিল।” ভারতের সঙ্গে বর্তমান সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলটি কী করছে সেটার চমৎকার এক প্রদর্শনী ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সেই বক্তব্য। তিনি বলেন, ‘আমি বলেছি, আমার দেশে কিছু দুষ্ট লোক আছে, কিছু উগ্রবাদী আছে। আমার দেশ সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন না, আপনার দেশেও যেমন দুষ্ট লোক আছে, আমাদের দেশেও আছে। কিছুদিন আগে আপনাদের দেশেও এক ভদ্রমহিলা কিছু কথা বলেছিলেন, আমরা সরকারের পক্ষ থেকে একটি কথাও বলিনি। বিভিন্ন দেশ কথা বলেছে, আমরা বলিনি। এ ধরনের প্রটেকশন আমরা আপনাদের দিয়ে যাচ্ছি। সেটা আপনাদের মঙ্গলের জন্য, আমাদের মঙ্গলের জন্য। আমরা যদি একটু বলি, তখন উগ্রবাদীরা আরও সোচ্চার হয়ে আরও বেশি বেশি কথা বলবে। তাতে আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন হবে। 


আমাদের স্থিতিশীলতা বিঘ্ন হবে।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা এমন কাজ করবো না, ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এমন কোনো উস্কানি দেবো না, যাতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশে কিছু মসজিদ পুড়েছে। আমরা কোনোভাবে সেটা প্রচার করতে দেইনি। এর কারণ হচ্ছে কিছু দুষ্ট লোক আছে, কিছু জঙ্গি আছে যারা এটার বাহানায় আরও অপকর্ম করবে। আমরা এটা নিয়ন্ত্রণ করেছি। অনেকে আমাকে ভারতের দালাল বলে, কারণ অনেক কিছুই হয়, আমি স্ট্রং কোনো স্টেটমেন্ট দেই না।’ চারিদিকে যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে ভীষণ তোলপাড় তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সেটার ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, ‘ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ভারতকে অনুরোধ আওয়ামী লীগ করে না, করেনি। শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষ থেকেও কাউকে এমন দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। যিনি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) এ কথা বলেছেন, সেটা তার ব্যক্তিগত অভিমত হতে পারে। সেটা আমাদের সরকারের বক্তব্য না, দলেরও না।’  বোঝাই যাচ্ছে, জনাব কাদের ড্যামেজ কন্ট্রোল করার চেষ্টায় নেমেছেন। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে এটা তার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পর গতকাল রাতে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বসে অনেক আলোচনা-পরামর্শ করে ঠিক করেছে, এই ইস্যুতে কী বক্তব্য দেয়া হবে। কিন্তু শেষমেশ জনাব কাদের যে বক্তব্য দিলেন, এতে ড্যামেজ কন্ট্রোল তো হয়ইনি তিনি ড্যামেজ আরও বাড়ালেন, এটা বলছি কারণ, বিদেশ মন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তিনি নতুন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিলেন।  


আমরা কি এটা বিশ্বাস করি, সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত ছাড়াই একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা মনে আসে, সেটাই বলে আসবেন? যেকোনো মূল্যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার জন্য যা যা করার দরকার সেটা করতে ভারতকে অনুরোধ জানাতে কী তিনি পারেন একেবারে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে? আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী যদি সত্যিই সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্ত ছাড়াই এমন অনুরোধ ভারতকে করে থাকেন, তাহলে সেটা কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে তার ভয়ঙ্করতম অপরাধ নয়? তার এই ‘ব্যক্তিগত’ বক্তব্য কি তার দলের গত কয়েক বছরের কার্যক্রম ও চিন্তাধারা থেকে ভিন্ন কিছু? যদি ভিন্ন কিছুই হয়ে থাকে (যা আমি মনে করিনা) প্রতিক্রিয়ায় কি তাকে বক্তব্যের পর মুহূর্তেই পদচ্যুত করা উচিত ছিল না কিংবা অন্তত পক্ষে একটা ব্যাখ্যা তলব?    একটা সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য কোনো না কোনো ভিত্তি লাগবেই। একটা অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে যে সরকারটি ক্ষমতায় আসে, তার ভিত্তি হয় জনগণ। কিন্তু এদেশের মানুষ তাদের সকল ধরনের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা হারিয়েছে এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই।  ২০১৪ সাল থেকে জনগণের ম্যান্ডেটহীন এই সরকারকে ক্ষমতায় এনেছে এবং টিকিয়ে রেখেছে তাদের আন্তর্জাতিক কিছু মিত্র এবং দেশের ভেতর আমলা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিরোধী দলকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যা, নির্বিচারে মামলা দেয়া থেকে শুরু করে হেন কোনো নির্যাতন নাই যা এই সরকারের সময় করা হয়নি। শুধু নিজের দেশের মানুষকে চাপে রাখা নয় সেই সঙ্গে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে নানা ক্ষেত্রে কী ধরনের আচরণ এই সরকার করেছে সেটাও খুব স্পষ্ট বিদেশ মন্ত্রীর বক্তব্য থেকেই। 


তবে যে যাই বলুক আমি মনে প্রাণে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাই বিদেশ মন্ত্রীর সততাকে। দেশের মানুষ যেমন জানে তেমনি জানে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী এমপি থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরের নেতাকর্মীরা কি করে তারা ১৪ সালের পর থেকে ক্ষমতায় এসেছে এবং এখনো টিকে আছে। কিন্তু বিদেশ মন্ত্রীর মতো এত খোলামেলা প্রাঞ্জল ভাষায় কেউ একথা স্বীকার করেনি। সামনে নির্বাচন। সেই নির্বাচনে জনগণের ভোটে বিজয়ী হওয়া দূরেই থাকুক, মোটামুটি সুষ্ঠু ভোট হলেও অল্প কয়েকটি আসন ছাড়া অন্যগুলোতে জেতা সরকারি দলের জন্য অসম্ভব। বিদেশ মন্ত্রীর কথায় এটি স্পষ্ট যে দেশের পুলিশ, প্রশাসন বা নির্বাচন কমিশনের অকুণ্ঠ আনুগত্যও যে তাদের আবার ক্ষমতায় আনতে বা রাখতে পারবে সেটি তারাও এখন আর বিশ্বাস করে না। সুতরাং তারই ভাষায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যে দেশের সঙ্গে আছে তাদের সরাসরি সহযোগিতা ছাড়া উপায় কি? বিদেশ মন্ত্রীকে আমি আরও ধন্যবাদ জানাই নানা আলোচনা সমালোচনা সত্ত্বেও নিজ বক্তব্যে অটল থাকার জন্য। তার এ বক্তব্য সরল মনে বা মুখ ফস্কে দেয়া হয়েছে নাকি তিনি দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন-এমন প্রশ্নে আব্দুল মোমেন ঢাকা টাইমসকে বলেন “আমি জেনে বুঝেই বলেছি। আমি আমার বক্তব্য থেকে সরছি না। আমি ভুল কিছু বলিনি।” সঙ্গে তিনি আরও যুক্ত করেন “আমি আরও বলবো। 


তাদের সহযোগিতা আমাদের দরকার।” আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কোনো চ্যারিটি নয়। এখানে প্রতিটি দেশ যার যার স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করবে, যার যার লাভ ক্ষতি হিসাব করবে সেটাই স্বাভাবিক। নিজ নিজ লাভ ক্ষতির সেই চুলচেরা হিসাবে সে কারণেই দেখা যায় আজ যারা পরম মিত্র কালই হয়তো তারা চরম শত্রুতে পরিণত হয়। ভারতের কাছ থেকে অন্যায্য সুবিধা নেবার বদলে এদেশের সরকারকে যদি ভারতকে বাংলাদেশের স্বার্থের বিপক্ষে গিয়ে কিছু দিতে হয় তার দায় ভারতের নয় বরং রাষ্ট্র বিরোধী, দেশ বিরোধী, জনস্বার্থ বিরোধী সেই সরকারের। বেশ কয়েকটি অতি আলোচিত কিন্তু অনিষ্পন্ন বিষয়ে বাংলাদেশ ভারতের চোখে চোখ রেখে কেন কথা বলতে বা নিজের স্বার্থ বুঝে নিতে পারে না, সেটি বোঝা গেলতো এবার? ধন্যবাদ জনাব মোমেন; সবার জানা কিন্তু লুকিয়ে রাখা বিষয়টি খোলাসা করে স্পষ্টভাবে বলার জন্য, স্বীকার করার জন্য। সবার নিজেকে উন্মোচিত করার এই সৎ সাহস থাকে না।


কার্টসি - মানবজমিন/ আগস্ট ২২,২০২২ 

দুর্নীতি জ্বালানি সঙ্কট-এর উৎস

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

সেমিনার পেপার - “দুর্নীতি জ্বালানি সঙ্কট-এর উৎস”

 


তারিখঃ ২২ আগস্ট, ২০২২। স্থানঃ আব্দুস সালাম হল, জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা।

প্রবন্ধ উপস্থাপন  ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন

সদস্য, জাতীয় স্থায়ী কমিটি, বিএনপি এবং সাবেক মন্ত্রী।


আসসালামু আলাইকুম। 

ভূমিকাঃ

বাংলাদেশের মানুষ গত এক দশক ধরে ভয়ংকর এক সময় অতিক্রম করছে। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা থেকে শুরু করে, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এমনকি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাও হুমকির সম্মুখীন। সমগ্র বাংলাদেশ আজ এক ভয়ংকর শকুনের ছোবলে বাকরুদ্ধ। জনগণের মাঝে ভয়ানক এক ভয়ের সংস্কৃতি ছড়িয়ে বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকার একে একে গণবিরোধী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে চলেছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত ০৫ আগস্ট মধ্যরাতে ডিজেল, অকটেন, পেট্রল ও কেরোসিনের দাম দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেকর্ড পরিমাণ বাড়ানোর নজিরবিহীন গণবিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার। ২০১৮ সনের মধ্যরাতের ভোট ডাকাত সরকার ৫ আগস্ট মধ্যরাতে সংশ্লিষ্ট সকলকে পাশ কাটিয়ে, এমনকি BERC এর অনুমোদন গ্রহণের আইনগত বাধ্যবাধকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ৮০ থেকে বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, অকটেনের দাম ৮৯ থেকে বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা ও পেট্রলের দাম লিটারপ্রতি ৮৬ থেকে বাড়িয়ে ১৩০ টাকা করেছে। তেলের মূল্য ৪২.৫% থেকে ৫১.৬% বৃদ্ধি করা হয়েছে। এক লাফে এত বেশি মূল্যবৃদ্ধি নজিরবিহীন এবং অভূতপুর্ব। 


গত নভেম্বর ২০২১ সালেও সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়েছিল। ২০২১ সনের নভেম্বরে ২৩ শতাংশ, এখন আরও ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে কৃষিসেচ, গণপরিবহন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানি ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে সাড়ে ৬৫ শতাংশ। অথচ এই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে গড় বৃদ্ধি সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ, যা এখন দ্রুতই কমে আসছে। অতএব এ পর্যায়ে তেলের  মূল্য  মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি ভয়াবহ, অযৌক্তিক ও গণবিরোধী সিদ্ধান্ত।  


প্রভাবঃ 

দুই অঙ্কের অনিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতি, বৈশ্বিক মহামারী করোনার প্রভাব, আর দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতির এ সময়ে জ্বালানি তেলের এহেন অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি  বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে গণশাস্তি দেয়ার শামিল। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে গণপরিবহন, দৈনন্দিন দ্রব্যের মূল্য, শিল্প ও কৃষিসহ সব খাতেই ভয়াবহ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।  রাজধানীর কাঁচাবাজারে প্রায় সব ধরনের সবজি, চালসহ বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেড়েছে। পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে এসব প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়েছে ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশের কৃষি, গণপরিবহন ও প্রান্তিক অর্থনীতির প্রধান তিন স্তম্ভ হচ্ছে সার, ডিজেল ও কেরোসিন তেল ।  এই তিন খাতেই  মূল্যবৃদ্ধি হওয়ায় দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে কর্মহীনতা, চাকরিচ্যুতি, অর্থকষ্ট ও ক্ষুধার বিভীষিকা শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে নতুন ধারার “জ্বালানি দারিদ্র্যের” আতংকগ্রস্ততা।


জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে গণপরিবহন খাতে যেমন, বাস, ট্রাক, কভার্ড ভ্যান, লঞ্চ- সব ক্ষেত্রেই ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। রেলওয়েও ভাড়া বৃদ্ধির ইংগিত দিয়েছে। তাছাড়া কৃষি উৎপাদন, শিল্প উৎপাদন এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সামগ্রিক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য- চাল, ডাল, শাকসব্জি, মাছ, ডিম, তেল, ভোজ্যতেলসহ সব পণ্যে। নিম্নবিত্ত ও গরিব জনসাধারণ বিশেষ করে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় নাভিশ্বাস উঠেছে। বাজারে মূল্যস্ফীতি দুই ডিজিটের ওপর চলে গেছে এবং তা দিনে দিনে আরো খারাপ হচ্ছে। 


যে সকল যুক্তি দেখিয়ে তেলের মূল্যবৃদ্ধি করেছে সরকারঃ 

বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে ভারতসহ অনেক দেশই নিজ দেশে তেলের মূল্যবৃদ্ধি করেছে। 

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিপিসির লোকসান কাটিয়ে উঠা। 

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে জ্বালানি তেল চোরাচালান প্রতিরোধ করা।


বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে ভারতসহ অনেক দেশই নিজ দেশে তেলের মূল্যবৃদ্ধি করেছেঃ  

বিশ্ববাজারের মূল্যবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে এ মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে বলা হলেও গত ০৪ আগস্ট আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বরং কমে প্রতি ব্যারেল ৯৪.১২ ডলারে নেমে এসেছে। আগস্ট মাসের ৩ তারিখ থেকেই বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম আগের তুলনায় কমতে থাকে। ৩ আগস্ট ছিল ৯৬.৮ ডলার, ৪ আগস্ট ছিল ৯৪.১ ডলার, ৫ আগস্ট ছিল ৯৪.৯ ডলার এবং ৮ আগস্ট তা নেমে আসে ৯৩.৯ ডলারে। বর্তমানে এ দাম ক্রমান্বয়ে কমছে। প্রজেকশন হচ্ছে বছরের শেষ নাগাদ ব্যারেল প্রতি দাম ৮০ ডলারের নিচে নেমে আসবে। 

বিপিসি’র লোকসান কাটিয়ে উঠাঃ 

সরকার বলছে, গত কয়েক মাসে তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা লোকসান করেছে। গত ৮ বছর ধরে সরকারের একমাত্র লাভজনক সংস্থা হিসেবে গ্রাহকদের কাছে বিশ্ববাজারের চেয়ে বেশি দামে তেল বিক্রি করে প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে বিপিসি। অতএব বিপিসির লোকসান দেখিয়ে মূল্যবৃদ্ধির যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। এক নজরে বিপিসি’র বছরওয়ারি লাভের হিসাবঃ 

২০১৫ সালে ৪ হাজার ১২৬ কোটি টাকা, 

২০১৬ সালে ৯ হাজার ৪০ কোটি টাকা টাকা , 

২০১৭ সালে ৮ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা টাকা ,

২০১৮ সালে ৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা

২০১৯ সালে ৪ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা, 

২০২০ সালে ৫ হাজার ৬৭ কোটি টাকা এবং ২০২১ সালে ৯ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা।  


বাংলাদেশ ইকোনমিক রিভিউ ২০২২’র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকার তেল আমদানিতে কোনোরকম ভর্তুকি দেয়নি, বরং শুল্ক থেকে আয় ছাড়াও বিপুল পরিমাণ মুনাফা করেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২৩ মে, ২০২২ পর্যন্ত সরকারের এ মুনাফার পরিমাণ মোট ৪৮ হাজার ১২২ কোটি ১১ পয়সা।  


এমনকি চলতি বছরে তেল বিক্রি করে ১ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা লাভ করলেও ৮ হাজার ১৫ কোটি টাকা লোকসানের কথা বলছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনে (বিপিসি)। যা জনগণের সাথে প্রতারণার শামিল। 


আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকায় বিপিসি এই বিপুল পরিমান মুনাফা করেছে। এসময়কালে বিশ্ববাজারে মূল্য অস্থিতিশীল হলে সরকার দেশেও মূল্য বাড়িয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যহ্রাসের সুবিধা থেকে সাধারণ ভোক্তাদের বঞ্চিত করেছে সরকার। 


২০১৮ অর্থবছর থেকে বিপিসি শুল্ক, কর ও লভ্যাংশ বাবদ সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে প্রায় ৫৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। নিয়মিত পরিচালন খরচ এবং অন্যান্য কর দেওয়ার পরও বিভিন্ন ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট হিসাবে বিপিসির রয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। তিনটি তেল বিতরণকারী কোম্পানির ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যাংক আমানত রয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশনের তথ্য। আগামী অর্থবছরে বিপিসি সরকারকে ট্যারিফ, ট্যাক্স এবং মুনাফা (dividend) হিসেবে ৯,২৫১ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। উল্লেখযোগ্য যে ২০১৭ থেকে আর্থিক বছর ২০২২ পর্যন্ত বিপিসি সরকারকে ৬৫,৬৫৪ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। তন্মধ্যে ২০২০ ও ২০২১ সালে দুই কিস্তিতে বিপিসি সরকারকে তথাকথিত উদ্বৃত্ত তহবিল থেকে প্রতিবছর ৫ হাজার কোটি টাকা করে মোট ১০ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। ডিজেল এবং কেরোসিনে শুল্ক, ভ্যাট, এআইটি এবং অগ্রিম কর বাবত প্রায় ৩৪% বিপিসি সরকারকে পরিশোধ করে থাকে। জ্বালানি সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিপিসি’র আমানতে থাকা এই বিপুল পরিমান অর্থ দিয়ে সরকার চাইলেই দাম না বাড়িয়েও মুনাফার টাকায় আরও প্রায় ২১ মাস জ্বালানি সরবরাহ করতে পারত।


সরকার দাবী করছে যে, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় দেশেও জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। কিন্তু ৪ আগস্ট থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য ৯৫ ডলারে নেমে এসেছে এবং প্রতিদিনই কমে আসছে। বর্তমানে যখন আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমতে শুরু করেছে তখন দেশের বাজারে সে অনুসারে কমিয়ে সমন্বয় করা হয়নি। বরঞ্চ অযৌক্তিকভাবে মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। অতএব বিশ্ববাজারের মূল্যের সাথে দেশে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে বলে সরকারের বক্তব্য সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য এবং জনগণের সাথে এক ভয়াবহ প্রতারণা মাত্র।


মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে কথা বলতে গিয়ে সরকারের মন্ত্রী-সাংসদরা বিশ্বের অন্যান্য দেশে তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসে। কিন্তু নেপাল ও শ্রীলঙ্কা ছাড়া কোথাও তেলের দাম বাংলাদেশের চেয়ে বেশী নেই। সরকারের তরফে মূল্যবৃদ্ধির এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ভিয়েতনামে ডিজেলের প্রতি লিটার দাম ৯৭.৯ টাকা। সরকারের তরফে বলা হচ্ছে,  হংকংয়ের  জ্বালানি তেলের মূল্য বাংলাদেশের চেয়ে বেশী। কিন্তু  হংকংয়ের  মাথাপিছু আয়  ৪৯ হাজার ৬৬০ ডলার। আর আমাদের মাথাপিছু আয় বিবিএস এর ভুল তথ্যের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েও মাত্র  ২ হাজার ৫০৩ মার্কিন ডলার। যা ইতোমধ্যে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান হারানোর ফলে আরও কমে গেছে। কোনো দেশের সঙ্গে তুলনা করতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশের  মাথাপিছু আয়ের সাথে মিলিয়ে দেখাটাও জরুরি। 


চোরাচালান প্রতিরোধকল্পে মূল্যবৃদ্ধিঃ

সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তেলের দামের ব্যবধান থাকায় দেশ থেকে জ্বালানি তেল পাচার হয়। তাই ভারতের সঙ্গে সমন্বয় করতে দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু গত নভেম্বর ২০২১ এর আগে পর্যন্ত প্রায় পাঁচ-ছয় বছর যাবৎ বাংলাদেশে ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ৬৫ টাকা ছিল। অন্যদিকে আমাদের সীমান্ত লাগোয়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তখন ডিজেলের মূল্য আরো বেশি ছিল। কিন্তু পাচারের কোনো তথ্য শোনা যায়নি। এদিকে বিজিবি বলছে, দেশের কোনো সীমান্ত দিয়ে জ্বালানি তেল পাচার হয় না। ২০২১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত মাত্র ৭১১ লিটার তেল পাচারের চেষ্টা করা হয়েছে এবং সবগুলো আটক করা হয়েছে। ৭১১ লিটার পাচার হয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে এদেশে জ্বালানির দাম বেড়ে যাবে, এটাও অগ্রহণযোগ্য। আর সত্যি যদি পাচার হয় (আমার মনে হয় সেটা dismiss করা যায় না) তাহলে তা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিয়ে দেশে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করে দায় জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া গ্রহণযোগ্য নয়।


অতিরিক্ত লাভ করছে বিপিসিঃ 

তেলের মূল আমদানি ব্যয় ও শোধনকৃত মূল্যের চেয়ে এবার জ্বালানির মূল্য অনেক বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেলের বাজারে ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম সর্বোচ্চ ৯২ ডলার। অর্থাৎ লিটারপ্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম টাকার অংকে মাত্র ৫৬ থেকে ৫৭ টাকা। তেল শোধনে লিটারে খরচ পড়ে দেড় টাকা। শোধন, পরিবহন ও কিছু সিস্টেম-লস মিলে লিটারে খরচ সর্বোচ্চ ৬২ টাকা। কিন্তু সরকার লভ্যাংশ, সরকারের কর, শুল্ক, ভ্যাট এই চার স্তরের মুনাফার পরে লিটারপ্রতি ডিজেল ও কেরোসিন ১১৪ টাকা, পেট্রোল ১৩০ এবং অকটেন ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। অর্থাৎ ১ ব্যারেল অপরিশোধিত তেলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা খরচ করে সেটা বিক্রি করা হচ্ছে ২৫ হাজার টাকার কাছাকাছি(সূত্রঃ প্রথম আলো, ১২ আগস্ট, ২০২২)।এর অর্থ হচ্ছে, বিপিসি প্রতি ০১ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল বিক্রি করে প্রায় ১৫ হাজার টাকা লাভ করে। সরকার এক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিতে কাজ করেছে, জনকল্যাণে নয়। 


BERC কে পাশ কাটিয়ে মূল্যবৃদ্ধি আইনের ব্যত্যয়ঃ 

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন অ্যাক্টের ২২ ধারা অনুযায়ী সব ধরনের জ্বালানি মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব কমিশনের (বিইআরসি)। গত ৫ আগস্ট  জারিকৃত  প্রজ্ঞাপনে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়িয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এটি আইনের সুস্পষ্ট  লঙ্ঘন এবং বিইআরসি আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অপরাধী কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। সরকার যেভাবে মূল্যবৃদ্ধি করল, এটা লুণ্ঠনমূলক (প্রিডিয়েটরি) বৃদ্ধি। প্রতিযোগিতা আইনের আওতায় এই মূল্যবৃদ্ধিটাকে লুণ্ঠনমূলক বৃদ্ধি বলা হয়। BERC কে পাশ কাটিয়ে এভাবে মূল্যবৃদ্ধি একটি ফৌজদারি অপরাধ। মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী হিসেবে এ দায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রীর। প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার অনুমোদন ব্যতিত এধরনের জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ অসম্ভব। অতএব,আইনের এ ব্যত্যয়-এর দায় সুস্পষ্টভাবে প্রধানমন্ত্রীর উপর বর্তায়।  


জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাব্য কারণসমূহঃ

কিছু বিশ্লেষক মনে করে সম্প্রতি সরকার আইএমএফ’র কাছ থেকে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে। ঋণ প্রদানের শর্ত হিসেবে আইএমএফ ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিয়েছে। তাই আইএমএফ প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসার আগেই ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি হ্রাসের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সরকার আইএমএফকে দেখাতে চায় শর্ত পালনে ঢাকা কতটা আন্তরিক। 


কিন্তু আবার অনেকে মনে করেন বৈশ্বিক সংকট, আই এমএফ’র শর্তপূরণ কিংবা বিপিসি’র লোকসান মেইক-আপ, কিংবা ভারতে পাচার রোধ- এসবই অজুহাত মাত্র। গণমাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের বরাতে উল্লেখ করা হয়েছে জ্বালানি তেল বা খাদ্য আমদানির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে চাপ পড়েনি। ২০২১-২২ অর্থবছরে জ্বালানি তেল আমদানি ব্যয় কমেছে ১১ শতাংশ আর খাদ্যে কমেছে ৪ শতাংশ। কিন্তু এ সময় আমদানি ব্যয় বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণ ৮৯ বিলিয়ন ডলার। ৫ আগস্ট পূর্ব পর্যন্ত আমদানি ব্যয় আরো অনেক গুন বেড়ে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট একাউন্টে চাপ পড়েছে। মূলত অস্বাভাবিক আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি বাণিজ্যের ভারসাম্যকে ধ্বসিয়ে দিয়েছে। এদিকে যে পরিমাণ আমদানির কথা বলা হচ্ছে, দেশের শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানসহ সার্বিক অর্থনীতির সূচকে তার প্রতিফলন নেই। এ সকল ঋণপত্রের বিপরীতে আমদানিকৃত পণ্য বাস্তবেই দেশে এসেছে কিনা তাতেও সন্দেহ রয়েছে। তাছাড়া মেগা প্রজেক্টসহ নানা খাতে দুর্নীতি ও অপখরচ করা হয়েছে। এক বিদ্যুৎ খাতেই ৯০ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ নামে লুট করা হয়েছে। বেসরকারি অনেক ব্যাংক পথে বসে যাচ্ছে অর্থনৈতিক অনিয়মের কারণে। কয়েক লক্ষ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আসলে কোথায়?  দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পাচার, আমদানির নামে অর্থ পাচার, বিনা উৎপাদনে বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে অর্থ লোপাট, খেলাপি ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার এবং সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও লুটপাটের দায় এখন জ্বালানি তেল, পরিবহন সেবা ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হ’ল সরকারের এই হরিলুট সাগরচুরির খেসারত জনগণকে দিতে হবে কেন?


আবার কিছু অর্থনীতিবিদদের মতে সরকার অর্থনীতিকে কন্ট্রাক্ট বা সংকোচন করার উদ্দেশ্যে তেলের দাম এক লাফে ৪২% থেক ৫১% করেছে যাতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা স্থবির হয়ে আসবে এবং এর ফলে এগ্রেগেট ডিমান্ড হ্রাস পাবে। এগ্রেগেট ডিমান্ড কমলে চাহিদাও কমবে এবং আমদানি ও রিজার্ভের ওপর চাপও কমবে। পত্রিকা রিপোর্ট করবে অর্থনীতিতে সুবাতাস ফিরে এসেছে। এলসি ওপেনিং ৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অনেকে মনে করেন তেলের দাম এক লাফে ৫১% বৃদ্ধির এটাই কারণ। 


অনেকে মনে করেন- সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আমদানির জন্য ডলারে টান পড়েছে। সরকার সেই টান থেকে বাঁচতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর টেকনিক অবলম্বন করছে। তাছাড়া চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের জন্য অর্থ প্রয়োজন। জ্বালানি খাত থেকে রাজস্ব বাড়ানোও সরকারের একটি টার্গেট। এতে বিপিসি যে বাড়তি মুনাফা করবে সেখান থেকে সরকারেরও বাড়তি রাজস্ব আদায় হবে। জ্বালানি থেকে সরকার ৩৫% কর পেয়ে থাকে। এখন পেট্রল ও অকটেনের দাম যে আরও বাড়ান হয়েছে তাতে বিপিসি’র ৪৫ টাকার বেশি মুনাফা থাকবে। 


জ্বালানি তেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণে বহির্বিশ্বের উদাহরণঃ  

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেলে  স্থানীয় বাজারে বৃদ্ধি করা, আবার আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমলে স্থানীয় বাজারেও কমানো- এই পদ্ধতি অনুসরণ করে ভারত গত মার্চে জ্বালানি মূল্য  ১১বার  সমন্বয় করেছে। ভারত প্রতি লিটারে ৫ টাকা আবগারি শুল্ক কমিয়ে দিয়েছে। তারপর আরও ৬ টাকা কমিয়ে দিয়েছে, যাতে জনগণের  ওপর চাপ কম পড়ে। উল্লেখ্য, ভারত এখন আর তেলে ভর্তুকি দিচ্ছে না, একই সাথে তারা জ্বালানি তেলে উচ্চ মুনাফাও করছে না। ভারত এই পদ্ধতি অনুসরণ করে  বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানি তেলের উচ্চমুল্যের মাঝেও জ্বালানির মূল্য মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ জ্বালানি তেলের অতিরিক্ত  মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে  আমাদের সামগ্রিক জীবনকেই  চরম বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। সমগ্রদেশে লোডশেডিংয়ের তীব্র প্রভাবে সাধারণ মানুষের জীবন এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। শিল্প উৎপাদন খাত ও রপ্তানি খাতে সুনামির সতর্ক সংকেতে  জনজীবনে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। এখন ১১৪ টাকার প্রতিলিটার ডিজেল থেকে ৩৪ টাকা কর আদায় করছে সরকার। সরকার যদি এই মুহূর্তে থেকে সব রকমের কর প্রত্যাহার করে, তাহলে এই মুহূর্ত থেকে প্রতিলিটার ডিজেলের মূল্য ৩৪ টাকা কমবে। প্রতিবেশী  ভারত অনেকটাই এই পদ্ধতি অনুসরণ  করেছে। 


প্রতিবেশী ভারতে জ্বালানি তেলের দাম ডাইনামিক ডেইলি প্রাইসিং মেথডে (DDPM) প্রতিনিয়ত বাজারমূল্যের সাথে সমন্বয় করা হয়। আফগানিস্তানও এ পদ্ধতি অনুসরণ করে। 


বাংলাদেশে তেলের দাম নির্ধারণ হয় সরকারি নির্বাহী আদেশে ফিক্সড প্রাইস মেথডে (FPM)। এর ফলে বিশ্ববাজারে আচমকা দাম বেড়ে গেলে ভর্তুকি দিতে হয়। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অনেক কমে গেলেও দেশের বাজারে কমানো হয় না। ফলে তেলের মূল্য কম থাকার যে সুবিধা সেটি থেকে ভোক্তারা বঞ্চিত হয়।  বর্তমানে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লে বা কমলে দেশের বাজারে খুব বেশি সমন্বয় করা হয় না। গত ২০ বছরে দেশে ১৭ বার ডিজেলের দাম সমন্বয় করা হয়। এর মধ্যে ১৩ বার বেড়েছে এবং কমেছে মাত্র ৪ বার। 


গ্যাসভিত্তিক জ্বালানির চিত্র ও দেশীয় সম্পদ আহরণে মধ্যসত্ত্বভোগী সরকারের অনীহাঃ  

বাংলাদেশের শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন পরিকল্পনার অনেকটাই দাঁড়িয়ে আছে প্রাকৃতিক গ্যাসকে কেন্দ্র করে। প্রতি বছরই দেশের আবাসিক, শিল্পোৎপাদন ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাড়ে ৭ বছরের আগেই মজুদ ফুরিয়ে আসবে। এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে নতুন গ্যাস ফিল্ড আবিস্কার এবং জ্বালানির বিকল্প উৎসের সংস্থান করা না গেলে সামনের দিনগুলোয় জ্বালানি খাতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।


গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম কার্যত বন্ধঃ 

বঙ্গোপসাগরের গভীর-অগভীর অংশে ব্লকগুলোয় দুই দশক ধরে কোনো ধরনের অনুসন্ধান কার্যক্রম নেই বললেই চলে। দেশে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বঙ্গোপসাগরের অফশোর ও অনশোরে (গভীর ও অগভীর) অংশকে মোট ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছিল। এর মধ্যে গভীর সমুদ্রে ১৫টি ও অগভীর সমুদ্রে ১১টি ব্লক। দেশে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। আন্তর্জাতিক আদালতে জয়ী হয়ে মিয়ানমার ও ভারত এরিমধ্যে বঙ্গোপসাগরে নিজ নিজ এলাকায় অনেক খনিজ পদার্থ আবিষ্কারে সমর্থ হলেও বর্তমান সরকার এক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। মূলত নিজস্ব ব্যবসায়ীদের স্বার্থে জ্বালানিতে আমদানিনির্ভরতার কারণে দেশে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অকার্যকর রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্সও দীর্ঘদিন অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। যদিও দেশের জ্বালানি ব্যবস্থাপনার বৃহদংশ ঘুরপাক খেয়েছে পুরনো গ্যাসক্ষেত্রের উত্তোলনকে কেন্দ্র করে। নতুন করে গ্যাস অনুসন্ধান চালানো হয়নি। 


অতএব ভবিষ্যতে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে বঙ্গোপসাগরসহ সারাদেশে বাপেক্স ও অন্যান্য সরকারি সংস্থার মাধ্যমে গ্যাস উত্তোলন এবং নতুন করে গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কারের কার্যক্রম/মহা অভিযান পরিচালনা করতে হবে। 


এক নজরে গ্যাস ভিত্তিক জ্বালানিব্যবস্থাপনার চিত্র (Annexure-1) এবং পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যান অনুযায়ী কিছু তথ্য (Annexure-2) আকারে সংযোজিত। 


গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ)-এর অর্থ এলএনজি আমদানিতে হস্তান্তরঃ 

নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান, উন্নয়ন, উত্তোলন ও সংস্কার কার্যক্রমের জন্য ২০০৯ সালে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) গঠিত হয় । গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রতি ঘনমিটারে ৪৬ পয়সা করে কেটে রেখে দেশের জ্বালানি সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে ব্যয়ই এ তহবিল গঠনের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। অথচ, গত ০৮ মে ২০২২ এলএনজি আমদানির জন্য পেট্রোবাংলাকে এ তহবিলের ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের অনুমোদন দিয়েছে অর্থ বিভাগ। এর আগেও ২০২১ সালে পেট্রোবাংলা গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের তিন হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত আয় দেখিয়ে অর্থ বিভাগকে দিয়েছিল।  জনগণের অর্থে গঠিত “গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের টাকা” এলএনজি কেনার কাজে ব্যবহারের কোনো ন্যূনতম সুযোগ নেই। এটি কার্যত বেআইনি।  কারণ, এ অর্থ জনগণের।  যা কেবল দেশের খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও উন্নয়নকাজে ব্যবহার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েই জনগণের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। জিডিএফ তহবিলের টাকা দিয়ে এলএনজি আমদানি করার কোন প্রভিশন নেই। 


জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে অর্থনৈতিক সাপ্লাই  চেইনে বিপর্যয়: 

এককালীন জ্বালানি তেল (পেট্রল, ডিজেল, অকটেন, কেরোসিনের) মূল্য গড়ে ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি “মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা” বললেও কম বলা হবে।  এমনিতেই  প্রচণ্ড দাবদাহ চলছে সমগ্র দেশজুড়ে, নিত্যপণ্যের মূল্য আকাশছোঁয়া। বিদ্যুতের লোডশেডিং চলছে দেশজুড়ে। এরই মাঝে বিশাল মাত্রায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে বিশাল বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ মন্ত্রী গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিরও ইঙ্গিত দিয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাতে পিষ্ট নিম্নবিত্তের জীবনে এ মূল্যবৃদ্ধি অভিশাপ হয়ে এসেছে। একমাত্র ভবিষ্যৎই বলতে পারবে সামনে এর প্রতিঘাত কী হবে। মানুষের জীবনযাত্রায় এর নেতিবাচক প্রভাব সহজেই অনুমেয়। মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ছে সে তুলনায় মানুষের আয় কিংবা বেতন বৃদ্ধি হচ্ছে না।  কোনো কোনো পন্যের মূল্যস্ফীতি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। ফলে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। জ্বালানি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এরই মধ্যে ডমিনো ইফেক্ট হিসাবে যানবাহনের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। বাড়বে নিত্যপণ্যের দাম আরেক দফা। কৃষি, শিল্প সব ক্ষেত্রেই চতুর্মুখী সংকট সৃষ্টি করবে। এমনিতেই সারের দাম বেড়েছে, এর মধ্যে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি সেচ মৌসুমে কৃষিক্ষেত্রে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি করবে। লোডশেডিংয়ের সময় অজস্র ডিজেলচালিত জেনারেটর ব্যবহার প্রকৃতপক্ষে ডিজেলের চাহিদা বাড়িয়েছে। পরিস্থিতি ইতোমধ্যেই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রথম আলোর ১৪ আগস্টের বিশেষ প্রতিবেদনের হেডলাইনের দিকে চোখ বোলালেই যে কেউ আঁতকে উঠবে। শিরোনামটি ছিল ‘বাংলাদেশে জ্বালানির দাম: আমি হয়তো রাস্তায় ভিক্ষা করতে শুরু করব’। এতে মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম নামে একজন পরিবহন শ্রমিকের বয়ান তুলে ধরা হয়েছে। এতে তিনি বলেন,  ‘ভয় পাচ্ছেন যে, তাঁকে শিগগিরই ভিক্ষা করতে হয় কি না’।  নুরুল আরও বলেন, ‘আমি যদি আমার চাকরি হারাই, তাহলে আমাকে রাস্তায় ভিক্ষা করা শুরু করতে হতে পারে’। নুরুলের মতো কোটি কোটি নুরুল আজকে বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে এক অনিশ্চিত জীবন যাপন করছে। যার জন্য গণবিচ্ছিন্ন এই সরকারের লুটেরা নীতিই দায়ী।   


সংকট সমাধানে করণীয়ঃ

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সমগ্র রাষ্ট্রীয়  অর্থনীতিতে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে এথেকে মুক্তি পেতে হলে অতিসত্ত্বর কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন: 

স্বল্প-মেয়াদী

জ্বালানি আমদানিতে বর্তমানে শুল্ক, কর বাবত যে ৩৪% ব্যয় করা হয় তা অনতিবিলম্বে মওকুফ করে আমদানি ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে আনা। 

জ্বালানি তেলের মূল্য ৫ আগস্টের পূর্বাবস্থায় পুনঃনির্ধারণ। 

বিশ্ববাজার থেকে কম দামে তেল ক্রয় করে জনগণের কাছে উচ্চমূল্যে তা বিক্রির মাধ্যমে এত দিন বিপিসি যে মুনাফা করেছে, তার সঙ্গে গত কয় মাসের বা সম্ভাব্য লোকসানকে সমন্বয় করা। 

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, গ্যাস উত্তোলনের সময় by-product হিসেবে উৎপাদন হয় বলে দেশেই অকটেন ও পেট্রলের মজুদ রয়েছে এবং তা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি আছে। সেক্ষেত্রে বৈশ্বিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির যুক্তি দিয়ে এগুলোর দাম বাড়ান কোনোভাবেই সমীচীন হয়নি।  তাছাড়া উপজাত হিসেবে উৎপাদিত বিধায় এই পণ্যের উৎপাদন খরচ প্রায় শূন্য, সেক্ষেত্রে এগুলোর দাম অবশ্যই কমানো সম্ভব। 

দিন আনে দিন খায়- এই শ্রেণির হতদরিদ্র নিম্ন আয় ও নির্ধারিত আয়ের গরিব মানুষের জন্য cash incentive দেয়া। 

ওএমএস’র আওতায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের আইটেম ও পরিমাণ বৃদ্ধি। 

বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে রেশন-কার্ডের বিপরীতে খাদ্য সরবরাহ। 

এসব বিতরণে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ। 

ছোটো ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা প্রদান। 

জ্বালানি ক্ষেত্রে  সরকার দুভাবে মুনাফা করছে। একদিকে বিপিসি যেন কোনোভাবেই লোকসান না করে, সে জন্য বিশ্ববাজারের সঙ্গে দাম সমন্বয়ের নামে জ্বালানির মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে, জ্বালানির ওপর কর আরোপ করে সরকার বর্ধিত রাজস্ব আদায় করছে। এই দ্বৈত নীতি পরিহার করা।  


মধ্য-মেয়াদী

মূল্য চাপিয়ে দেয়ার পরিবর্তে Stakeholder সাথে আলোচনাক্রমে নির্ধারণ পদ্ধতিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ। 

জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের  ক্ষেত্রে একটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা।  সেই প্রক্রিয়ায় বৈশ্বিক  বাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেলে  স্বচ্ছ  প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই প্রয়োজনীয় মূল্য সমন্বয় করার দাম বৃদ্ধি, এবং বৈশ্বিক  বাজারে মূল কমার সাথে সাথে দ্রুততার সাথে মূল্য সমন্বয় করে দাম হ্রাস করা।  যেমনটা ভারত সহ  দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। 

আমদানি নির্ভরতা পরিহার করে প্রাইমারী এনার্জি পলিসি রিভিউকরন। 

নতুন গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা। 

নবায়নযোগ্য জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন পলিসি গ্রহণ করা। 

বিপিসিকে সুশাসন, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহির আওতায় এনে একটি দক্ষ সংস্থায় রূপান্তর। 

শেষ কথাঃ

সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়। জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকলে জনকল্যাণের প্রতি তাদের একটা দায়িত্ববোধ থাকতো। সরকার এক লাফে জ্বালানির মূল্য ৫১% বৃদ্ধি না করে বিকল্প পথে বিষয়টির সমাধান করতে চেষ্টা করতো। সরকারের ভেতরে অসাধু এক ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি কাজ করেছে যা আতংকের কারণ।


সরকারের নিশিরাতের সিদ্ধান্তে জ্বালানি তেলের আস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। দুর্নীতিবাজ ও লুটেরা এই সরকারের পক্ষে দেশের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয় কেননা এদের জনগণের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা নেই। সরকার জনকল্যাণের চেয়ে তাদের নিজস্ব দলীয় ব্যবসায়ি ও সিন্ডিকেটের স্বার্থকে অতিমাত্রায় প্রাধান্য দেয়ায় সাধারণ জনগণের কাঁধে সমস্ত আর্থিক বোঝা চেপে বসেছে। এমতাবস্থায় অবিলম্বে প্রবল গণ আন্দোলন গড়ে তুলে এই অবৈধ লুটেরা সরকারকে বিতাড়িত করতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যার অধীনে রাতে নয়, নির্বিঘ্নে, নির্ভয়ে, সকলের অংশগ্রহণে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে সত্যিকারের অর্থে একটি জনগণের সরকার। তাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে জনগণের অধিকার আদায়ে সর্বাত্মকভাবে গণ-আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার কোন বিকল্প নেই।


সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আল্লাহ্ হাফেজ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। 


Annexure- 1 

এক নজরে গ্যাস ভিত্তিক জ্বালানিব্যবস্থাপনার চিত্রঃ 

দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৩৭০ কোটি ঘনফুট। 

এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হতো। 

দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে আসে ২২০-২৩০ কোটি ঘনফুট।  

৭০ থেকে ৮০ কোটি ঘনফুট আমদানি করা হয় এলএনজি হিসেবে। 

কিন্তু বর্তমানে ২৭০ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুটের বেশি সরকার দিতে পারছে না। এই গ্যাস আবার শিল্প খাত ও বিদ্যুৎ খাতে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে হয়।

বিশ্ববাজারে এখন প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৪১ ডলারের কাছাকাছি। যা কোভিড-১৯ এর পূর্বে ছিল ৪ ডলার।

২০১০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশীয় গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ, যা কিনা ২০২২ সালে কমে প্রায় ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। 

এদিকে গত ১০ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে ৯০ হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। 

দেশে নিজস্ব গ্যাস উৎপাদনের হার কমে গেছে। আর এর ফলে দেশীয় জ্বালানি তথা গ্যাসের পরিবর্তে ব্যবহার বাড়ছে আমদানি করা অতি উচ্চমূল্যের এলএনজির ব্যবহার। 

প্রতি ইউনিট দেশীয় গ্যাসের মূল্য যেখানে ২ থেকে ৩ ডলার, সেখানে প্রতি ইউনিট আমদানি করা গ্যাসের (এলএনজি) জন্য ব্যয় হয় ১২ ডলার (দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি) থেকে ৩৫ ডলার (স্পট মার্কেট) পর্যন্ত। 

দেশে বর্তমানে মোট গ্যাস সরবরাহের কেবল ২৫ শতাংশ আমদানি করা এলএনজি দ্বারা মেটানো হয়। এর বেশী এলএনজি আমদানি করার জন্য দেশে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই।

প্রশ্ন হচ্ছে, এরকম একটি পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশকে কেন নিয়ে যাওয়া হ’ল! জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ ভৌগোলিক ও ভূতাত্ত্বিকভাবে একটি ওঠা বদ্বীপ অঞ্চল এবং বাংলাদেশ গ্যাসসম্পদে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত গ্যাস জরিপ প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্যায়নেও একই মত প্রকাশিত হয়েছে। 

২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসজিএস পেট্রোবাংলার সঙ্গে যৌথ জরিপে দেখায় যে বাংলাদেশে অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদের গড় পরিমাণ ৩২ টিসিএফ। 

একই সময় নরওয়ের জাতীয় তেল–গ্যাস কোম্পানি এনডিপি বাংলাদেশ সরকারি এজেন্সির সঙ্গে সম্পাদিত জরিপে দেখায় যে দেশে অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদের গড় পরিমাণ ৪২ টিসিএফ। 

২০১৮ সালে ডেনমার্কের গ্যাস পরামর্শক র্যামবোল তাদের জরিপে দেখায় যে এর পরিমাণ ৩৪ টিসিএফ। 

সবাই যে বিষয়ে একমত তা হলো, বাংলাদেশে যথেষ্ট মাত্রায় গ্যাস অনুসন্ধান না হওয়ার কারণে গ্যাস সংকট তৈরি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে গ্যাসসম্পদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বাপেক্ষা কম অনুসন্ধানকৃত দেশগুলোর একটি। যথেষ্ট অনুসন্ধানের মাধ্যমে ভূগর্ভে লুক্কায়িত গ্যাস উত্তোলন করলে বর্তমানে যে দেশে গ্যাস সংকট তা তৈরি হতো না ।


Annexure- 2 

পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যান অনুযায়ী কিছু তথ্যঃ 

দেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের বার্ষিক চাহিদা ১ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট)।

দেশের ২৭টি গ্যাসক্ষেত্রে মজুদ ৯ হাজার ৯০১ বিলিয়ন ঘনফুট বা ৯ দশমিক ৯ টিসিএফের কিছু বেশি। 

এর মধ্যে উৎপাদনে থাকা ২০ গ্যাসক্ষেত্রে মজুদ রয়েছে ৮ দশমিক ৭৫ টিসিএফ গ্যাস। 

বাকি গ্যাসের মজুদ রয়েছে উৎপাদনে না থাকা সাত গ্যাসক্ষেত্রে, যার পরিমাণ এক টিসিএফের কিছু বেশি।

ভূতাত্ত্বিক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি গ্যাসকূপ থেকে সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন করা যায়। 

বাংলাদেশের গ্যাসকূপগুলো অনেক পুরনো হবার ফলে অঞ্চলভেদে এসব কূপ থেকে সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। 

সে হিসাব অনুযায়ী দেশে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে সাড়ে ৭ টিসিএফের বেশি গ্যাস উত্তোলন করা প্রায় অসম্ভব।

সে অনুযায়ী দেশে এখন উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ টিসিএফ। বার্ষিক চাহিদা বিবেচনায় এ মজুদ দিয়ে স্থানীয় চাহিদা পূরণ করা যাবে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত বছর পর্যন্ত।

পাঁচ বছর আগেও দেশে গ্যাসের দৈনিক উত্তোলন ছিল ২৮০ কোটি ঘনফুট। 

পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, দেশীয় কূপগুলো থেকে বর্তমানে প্রতিদিন ২৩০ কোটি ঘনফুট জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। 

এলএনজি সরবরাহ হচ্ছে আরো ৭৮ কোটি ঘনফুট ।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, 

দেশীয় কোম্পানিগুলোর আওতায় থাকা গ্যাসক্ষেত্রগুলোর বেশির ভাগই ষাট দশকের। উৎপাদনে থাকা এসব গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন কমে গেলেও সঠিক সময়ে কম্প্রেসার বসানো হয়নি। যে কারণে উৎপাদন ঠিক রাখা যায়নি। 

অন্যদিকে বিদেশী কোম্পানিগুলোর (আইওসি) আওতাধীন গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় কম্প্রেসার বসিয়ে উত্তোলন ঠিক রাখা হয়েছে। 

বর্তমানে দেশে মোট উত্তোলনের ৬৯ শতাংশই এসেছে আইওসিগুলো থেকে। এসব কোম্পানির অধীন গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে চারটি। গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে প্রতিদিন ১৬১ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। 


প্রবন্ধটি রচনায় যেসকল তথ্যসূত্র ব্যবহার করা হয়েছে: 

1. বাংলাদেশ ইকোনমিক রিভিউ ২০২২ (জুন ২০২২-এ প্রকাশিত)

2. সেন্টার পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) প্রতিবেদন।

3. Bangladesh Energy Sector | PDF | Asian Development Bank

4. A Review of Energy Sector of Bangladesh

5. Energy Sector in Bangladesh: An agenda for reforms

6. পলিসি রিসার্চ ইন্সটিউট অব বাংলাদেশ। 

7. যুগান্তর, ০৬ আগস্ট ২০২২।

8. দৈনিক সমকাল ০৬ আগস্ট ২০২২,

9. বণিক বার্তা, ০৬ আগস্ট ২০২২।

10. টিবিএস, ০৭ আগস্ট,২০২২।

11. বণিক বার্তা, ০৭ আগস্ট, ২০২২। 

12. দি ডেইলি স্টার, ০৮ আগস্ট ২০২২।

13. দৈনিক নয়া দিগন্ত, ০৮ আগস্ট ২০২২।

14. মানব জমিন, ০৮ আগস্ট ২০২২।

15. প্রথম আলো, ১২ আগস্ট ২০২২।

16. দি ডেইলি স্টার, ১২ আগস্ট ২০২২।

17. প্রথম আলো, ১৪ আগস্ট ২০২২।

18. বণিক বার্তা,  নভেম্বর ২৭, ২০২১

19. বিবিসি বাংলা, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ 

20. বণিক বার্তা, ০৫ মার্চ ২০২২। 

21. বণিক বার্তা ১৬ অক্টোবর ২০২২। 

22. প্রথম আলো, ১০ আগস্ট ২০২১

23. বণিক বার্তা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২১। 

Sunday, August 14, 2022

জ্বালানির ‘জ্বালা’ জনভোগান্তির রেকর্ড

— শুভ কিবরিয়া

 

জ্বালানি তেলের অভাবনীয় মূল্যবৃদ্ধি করে এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে ফেলেছে সরকার। বাংলাদেশে অতীতে একবারে এতবেশি পরিমাণে জ্বালানির মূল্য কখনই বাড়ে নাই। হালে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশেও এই হারে জ্বালানির মূল্য বেড়েছে কিনা সন্দেহ আছে। দেউলিয়া হতে বসা শ্রীলঙ্কার মতো দেশেও জ্বালানির মূল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে এ রকম সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নাই। ৫ই আগস্ট ২০২২ শুক্রবার মধ্যরাতে সরকারের ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি লিটার ডিজেল ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা (৪২.৫% দাম বৃদ্ধি), কেরোসিন ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা (৪২.৫% দাম বৃদ্ধি), পেট্রোল ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ টাকা (৫১.১% দাম বৃদ্ধি), অকটেন ৮৯ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা (৫১.৭% দাম বৃদ্ধি) করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত ছিল এতটাই আচানক যে এটা বুঝে উঠতেও মানুষের কিছুটা সময় লেগেছে। অবশ্য পরেরদিন রাস্তায় বেরিয়েই গণপরিবহনের তুঘলকি কাণ্ড দেখে মানুষ টের পেয়েছে দেশে কিছু একটা ঘটে গেছে! মাত্র একদিনের মধ্যেই খুব দ্রুত সরকার পরিবহন সংগঠনের সঙ্গে বসে জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে পরিবহন ভাড়ার সমন্বয়ও করে ফেলেছে।

এই কাজে অবশ্য সরকার সব সময়ই খুব পারঙ্গমতা দেখিয়েছে। সরকারের তৎপরতায় বিআরটিএ দূরপাল্লার বাসে কিলোমিটার প্রতি ৪০ পয়সা (২২.২%) ভাড়া বাড়িয়েছে। নগর পরিবহনে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে কিলোমিটার প্রতি ৩৫ পয়সা (১৬.২৭%)। এখন বাজারেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। দ্রুতই সব গণ্য ও সেবার দাম হু হু করে অনিয়ন্ত্রিত বেগেই বেড়ে যাবে। 

সরকারের নীতি অনুযায়ী জ্বালানির ক্ষেত্রে যতো রকম ঘাটতি আছে, তার দায় ভোক্তার ঘাড়েই চাপিয়ে দিয়েছে সরকার। সরকারের সকল উন্নয়নের যে চাপ, যে দায়, পরিকল্পনার যে খেসারত তার ব্যয় উচ্চমূল্যেই এখন আমজনতাকে বইতে হবে নিদারুণ কষ্টে, অসহ্য যন্ত্রণায়।

এর কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই ইউরিয়া সারের দাম সরকার বাড়িয়েছে কেজি প্রতি ৬ টাকা। এর কারণ হিসাবে প্রকাশ্যে সরকার যা বলেছে তা হলো, কৃষকরা না বুঝে কৃষিজমিতে প্রয়োজনের চাইতে বেশি বেশি ইউরিয়া সার ব্যবহার করে। ইউরিয়া সারের এই অতি ব্যবহার জমি, প্রকৃতি, পরিবেশ কারও জন্যই ভালো নয়। সে কারণেই সরকার চায় কৃষক জমিতে পরিমাণ মতো ইউরিয়া ব্যবহার করুক। তাহলে সেটার উপায় কি? সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মনে হয়েছে, দাম বাড়ালেই কৃষক কম কম ইউরিয়া কিনবে। কম কম ব্যবহার করবে। সরকারের এই উদ্দেশ্য ফলপ্রসু হবে কিনা কে জানে? তবে, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

 প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, গত ৫০ বছর ধরে কৃষি বিভাগ কি কাজ করলো যে কৃষককে এখনো বোঝাতেই পারলো না, ইউরিয়া কতটুকু ব্যবহার করা দরকার। এই ব্যর্থতার দায় কার? কৃষকের না কৃষি বিভাগের? যদি কৃষি বিভাগের হয়, তাহলে সেই দায়ভারের শাস্তি কি? দ্বিতীয়ত, দেশে যখন জ্বালানির সংকট তৈরি হলো, গ্যাস রেশনিং শুরু হলো, তখন প্রথমেই সরকারি মালিকানাধীন ইউরিয়া সার কারখানা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে পুরো ফ্যাক্টরিকেই বসিয়ে রাখা হয়েছে। সরকারের নিজস্ব ইউরিয়া সার উৎপাদন পুরো বন্ধ করে তার পর পরই বাড়ানো হলো ইউরিয়ার দাম। এর মধ্যে মতলবটাই বা কী! অনেকে বলছেন, আইএমএফ’র লোন পাবার তাড়নায় সার খাতে সরকারি ভর্তুকি কমাবার তাগিদে সরকার এই কাজটা করেছে। কৃষকের ঘাড়ে এবার ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ স্বরূপ হাজির হয়েছে মধ্যরাতে জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি। শুধু তাই নয় এবার অচিরেই বাড়তে চলেছে বিদ্যুতের দামও।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে সরকার জ্বালানির মূল্য এভাবে বাড়ালো কেন? প্রথমত, সরকার নিশ্চিত যে, সরকার যাই করুক না কেন তার কোনো বড় জনপ্রতিক্রিয়ার মুখে পড়বে না। দু-চারদিন ছোটখাট দু’একটা মিছিল, কিছু বিবৃতি, কিছু টকশো’র আলোচনা ছাড়া এর বড় কোনো রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া  নেই। জনগণের বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষদের কষ্ট বাড়বে, তবে তার সামষ্টিক এমন কোনো চাপ তৈরি হবে না যে সেটা সরকারকে ঘাবড়ে দিতে পারে। আর যদি কোনো ধরনের চাপ তৈরি হয়ও, তা শক্ত হাতে মোকাবিলা করার মত প্রাতিষ্ঠানিক-আর্থিক-প্রশাসনিক-রাজনৈতিক ক্ষমতা সরকারের আছে। ফলে, এক ধরনের ডোন্ট কেয়ার অবস্থা সরকারকে এ রকম জনবিরুপ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে। এটা একটা দিক। অন্যদিকে সরকারের অর্থিক খাতে বিশেষ করে ডলারের টানাটানি বেড়েছে। ফলে আইএমএফ’র সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছুতে হলে তাকে বিভিন্ন খাতে দেয়া ভর্তুকি তুলে নেবার শর্ত পূরণ করেই আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। আইএমএফ কোনো কারণে বিরাগ হলে সেই চাপ সরকারের মোকাবিলা করার সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ আছে। 

ফলে, আইএমএফকে তুষ্ট করার বড় বিপদ এড়ানোর অভিপ্রায়ে জনঅসন্তুষ্টির ছোট ঝামেলা, যা মোকাবিলাযোগ্য, সেটাকেই সরকার অগ্রাধিকার দিয়েছে। অন্যদিকে সরকারের রাজনীতি ও উন্নয়ন ম্যানেজ করতে আমলাতান্ত্রিক যে কাঠামোর ওপর নির্ভর করতে হয়েছে এবং হচ্ছে, তার বাইরে যাবার রাজনৈতিক পথ সরকারের সামনে খোলা নাই। ফলে, শক্তিমান আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় যে অস্বচ্ছতা, অদক্ষতা, দুর্নীতি চলমান আছে, বহু জায়গায় যে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় অব্যাহত আছে, তাকে মেনে নিয়েই সরকারকে এগুতে হচ্ছে। সে জায়গায় সংস্কার করার কোনো সুযোগও সরকারের হাতে নাই। ফলে তুলনামূলক দুর্বল এবং প্রতিরোধ করার ক্ষমতাহীন অংশ ‘আমজনতা’ কিংবা ‘সাধারণ জনগণ’কে চাপ দিয়ে সরকার পরিস্থিতি সামলাতে চাইছে।

এখন দেখা দরকার এই পরিস্থিতির সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কী প্রভাব পড়তে পারে। মানুষের কষ্ট বাড়বে ভীষণভাবে। গ্যাস, বিদ্যুত, পানির বর্ধিত দামে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর যে চাপ পড়বে, তাতে জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পণ্য ও সেবার দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আমাদের পুরো রাষ্ট্রনৈতিক কাঠামো যেহেতু জনবান্ধব না, ফলে সকল পণ্য ও সেবা বেশি দাম দিয়ে কিনেও মানুষ আশানরুপ সার্ভিস পাবে না।

 জ্বালানির এই ভয়াবহ দাম মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। সেটা জনজীবনকে আরও ভোগাবে। লুটপাটের বাইরে যারা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ব্যবসা করে আমাদের অর্থনীতি সচল রাখে তারাও ভীষণ চাপে পড়বে। তাদের সকল পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারে বিশেষ করে রপ্তানিকারকরা অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে পারে। এমনও হতে পারে উৎপাদনের চাইতে আমদানি লাভজনক বলে বিবেচিত হবে। ফলে, স্থানীয় ব্যবসা, উৎপাদন, বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়তে পারে। আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সুবিধাও মানুষকে শেষাবধি চড়া দামে ক্রয় করতে হবে। ফলে সামাজিক বৈষম্য প্রকট হবে। সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়বে। জননিরাপত্তা কমতে থাকবে। জনঅসন্তুষ্টির প্রভাব পড়বে সামাজিক পুঁজির ওপরে। সেটা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও আরও প্রতিহিংসাপ্রবণ ও সহিংস করে তুলতে পারে।

জ্বালানির এই বর্ধিত চাপ মেটাতে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানোর মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে সরকার। কেন না জনগণের এই অংশকে একটা ন্যূনতম আর্থিক সন্তুষ্টির মধ্যে রাখাকে কৌশলগতভাবে সরকারের জন্য লাভজনক বলেই ইতিপূর্বে বিবেচিত হয়েছে। সেই বিবেচনা থেকে পেছন ফেরার মতো কোনো কারণ  যেহেতু ঘটে নাই, ফলে সরকার এ রকম সিদ্ধান্ত নিলে অবাক হবার মতো কিছু থাকবে না। 

কৃষিতে একটা বড় বিপদ ঘটবে। সারের দাম, ডিজেলের দাম, বিদ্যুতের দাম প্রান্তিক ক্ষেত্রে কৃষি উৎপাদনকে হুমকির মধ্যে ফেলতে পারে। ছোট কৃষক বিনিয়োগের অভাবে কৃষি পেশা থেকে অব্যাহতি নিতে পারে। এ জায়গায় করপোরেট কৃষি ক্ষুদ্র-প্রান্তিক কৃষকের জায়গায় প্রতিস্থাপিত হবে। বড় বিনিয়োগে, বড় বিপণন ব্যবস্থায় করপোরেট কৃষি কৃষি বাজারকে নিজের হাতে নিয়ে নিতে পারে। ভোজ্য তেলের সরবরাহ ও নিয়ন্ত্রণ যেমন কতিপয় বড় ব্যবসায়ীর  হাতে থাকে, জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি তেমনি পুরো কৃষিকে কতিপয় করপোরেটের তালুবন্দি করার ব্যবস্থা তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখবে।

আমজনতা তার সকল রকম ব্যয় কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করবে। তার সকল রকমের ইনটেক কমবে। সে খাবে কম, পরবে কম, ঘুরবে কম। ফলে তার জীবনমান, পুষ্টিমান, বিনোদনমান, জীবনের স্বপ্নমান সব কমতে থাকবে। বাসাভাড়া ব্যয়, চিকিৎসা ব্যয়, গ্যাস-বিদ্যুত-পানি খাতে ব্যয়, পরিবহন ব্যয়, সন্তানদের শিক্ষা ব্যয় মিটিয়ে তার আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের যে ফারাক ঘটবে তা জীবন নিয়ে তাকে এক দুঃখী মানুষে পরিণত করবে। তার ধর্মপ্রীতি বাড়বে, রাষ্ট্রপ্রীতি কমবে। মানুষের প্রতি ভালোবাসা-মমতাও সে হারিয়ে ফেলবে। এক বিষণ্নতর জীবন তাকে হতাশার দিকে ঠেলে দেবে। সবচেয়ে বড় কথা বড় বড় প্রকল্প, অবকাঠামো তৈরি করে সরকার বা রাষ্ট্র তাকে যে সুখী করতে চেয়েছিল সেগুলোকেই সে তার দুর্ভোগের কারণ বলে বিবেচনা করতে থাকবে। সরকারের রাজনৈতিক দলকে সে অবিশ্বাস করতে শুরু করবে। এটাই আমাদের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় দুঃখদিন আনার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। কেন না, জনগণ যদি রাজনৈতিক দলকে অবিশ্বাস করতে শুরু করে, নিজের জীবনের দুঃখ-কষ্টের জন্য রাজনৈতিক দলের কাজকেই দোষারোপ করতে থাকে, তবে সে রাষ্ট্র বা জাতির জন্য এর চাইতে দুর্ভাগ্যের আর কিছু নেই। 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক 

বিশ্লেষক, kibria34@gmail.com

সূত্র — মানবজমিন/ আগস্ট ৮, ২০২২

জনগণকে হাত-পা বেঁধে যেন মাঝনদীতে ফেলে দেওয়া হলো

— শাহানা হুদা রঞ্জনা



বড় ধরনের একটা ঝড় আসবে আসবে বলে আশংকা করছিলাম। ঝড়টা এসেই গেল মনে হচ্ছে। এই ঝড় প্রতিহত করার ক্ষমতা আমাদের নেই সত্যি। কিন্তু ঝড়ের প্রভাব থেকে আমরা কিভাবে বাঁচবো এরও কোন নির্দেশনা নেই, নেই অগ্রিম সতর্কবার্তা ও আপদকালীন পরামর্শ। ফলত যা হওয়ার তাই হবে। অর্থনীতির এই ঝড়ের ধাক্কায় ছিটকে পড়বে সাধারণ মানুষ। বিপর্যস্ত হবে তাদের জীবনব্যবস্থা।

প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী, যারা শক্তিশালী তারা টিকে থাকবে। কিন্তু আর্থিকভাবে এই শক্তিশালী মানুষ আসলে কতজন। একটি দেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে টেনেটুনে হয়তোবা শতকরা ১০ জন। বাকি ৯০ শতাংশ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এই অর্থনৈতিক ঝড়টা শুরু হয়েছিল ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর। যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর, যেদিন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম সর্বনিম্ন হলো, ঠিক সেদিনই জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলে বসলেন, "আামি প্রাইস বাড়াচ্ছি কারণ আমার দেউলিয়াত্ব থেকে আমি বাঁচতে চাই।"

দাম বাড়িয়ে উনি না হয় বাঁচলেন কিন্তু জনগণের কি হবে? সবার মনে এখন একই প্রশ্ন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন কমতির দিকে, তখন বাংলাদেশে দাম এতটা বৃদ্ধি করা হলো কেন? জনগণ কি পারবে এই ভার বহন করতে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম এ প্রসঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, "মানুষের প্রতি অবজ্ঞা থেকেই জ্বালানি তেলের দাম এতটা বাড়ানো হলো। মানুষের প্রতি সংবেদনশীলতা থাকলে জ্বালানি তেলের মূল্য এতটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব ছিল না।"

তিনি আরো বলেছেন, "বিশ্ববাজারে তেলের দাম এখন নিম্নমুখী। আর এই যে সমন্বয়ের কথা ওনারা বারবার বলেন, কিন্তু তেলের দাম যখন দীর্ঘদিন ধরে অনেক কম ছিল আমরা তো কম দামে তেল কিনিনি। ওই টাকা যদি হিসাব করা হয়, তাহলে লাভের কত টাকা জমা আছে বিপিসির কাছে। এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে সেই টাকাটা কি সমন্বয় করা যায় না?"

গত ২৭ জুলাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছিলেন, "অকটেন এবং পেট্রল কিন্তু আমাদের কিনতে হয় না। এটা আমরা যে গ্যাস উত্তোলন করি, সেখান থেকে বাই প্রডাক্ট হিসেবে পেট্রল ও অকটেন পাই। বরং আমাদের যতটুকু চাহিদা তার চেয়ে অনেক বেশি পেট্রল ও অকটেন আমাদের আছে। আমরা অনেক সময় বাইরে বিক্রিও করি", তখন দারুণ একটা স্বস্তিবোধ করেছিলাম। তাহলে গোলটা বাঁধলো কোথায়? সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা জানতে চাইছি এই কয়দিনে কী এমন ঘটলো যে প্রধানমন্ত্রীর কথাও রাখা গেল না?

সাধারণ মানুষ এত হিসাব-নিকাশ বুঝে না। শুধু দু'বেলা ডাল ভাত খেয়ে, পরিবার নিয়ে নিরাপত্তার মধ্যে বাঁচতে চায়। কিন্তু হঠাৎ করে যখন অস্বাভাবিকহারে বাড়ানো হলো তেলের দাম, তখন মানুষের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। মূল্যবৃদ্ধির জন্য কোনো প্রস্তুতি নেই, নেই কোন আলোচনা বা আগাম সতর্কতা।

সরকার কি জানেনা নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষের অবস্থা আর্থিকভাবে কতটা সংকটপূর্ণ, সেটা তো সরকারের বিবেচনায় থাকা দরকার ছিল। কিন্তু, তেলের দাম বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে তাতে মনে হয় না যে তাদের এই বিবেচনাটা খুব একটা আছে। বলা যায়, জনগণকে হাত-পা বেঁধে মাঝ নদীতে ফেলে দেয়ার মতো অবস্থা হলো। এটা কোনো বিবেচনাতেই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং হঠকারি সিদ্ধান্ত বলা যায়।

এই আপদকালীন সময়ে সরকারের সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এমপি বললেন, "আইএমএফের শর্ত মেনে সরকার বিষ গিললো।" কথা যদি সত্য হয়, তাহলে তো বুঝতে হবে এই বিষ দেশের জনগণ গিললো। আইএমএফ এর লোন কেন দরকার, কোথায় খরচ হবে, কিভাবে খরচ করবে, সুদ কত, সরকার কিভাবে-কতদিনে সুদ মেটাবে, জনগণকে কতটা বহন করতে হবে--- এই বিষয়গুলো স্পষ্ট করা দরকার সরকারকেই, কারণ তা না হলে মেনন সাহেবের বিষ গেলার কথাটাই সত্য বলে ধরে নিতে পারে বিপদগ্রস্ত জনগণ।

এমনিতেই বাংলাদেশ কি শ্রীলংকা হবে, নাকি ইউক্রেন হবে এসব চিন্তাভাবনা, হাস্যরস, আশংকা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিলই। সরকার নানাভাবে জনগণকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছে। কখনো কখনো প্রকৃত পরিস্থিতি গোপন করে হলেও তারা ভেবেছে জনগণকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। কিন্তু বিশ্বব্যাংক যখন বলে বিদেশি ঋণ পরিশোধ নিয়ে জটিলতা এবং দ্রুত খালি হয়ে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ শ্রীলংকাকে দ্রুত অস্থির করে তুলছে, তখন তো আইএমএফ লোন নিয়ে সাধারণ মানুষ ভয় পাবেই।

মুদ্রাস্ফীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, শিশুখাদ্যের অস্বাভাবিক দাম সবকিছুকে এড়ানো সম্ভব হলেও ডলারের অনিয়ন্ত্রিত বাজার, গ্যাস সংকট, বিদ্যুতের লোডশেডিং এবং সর্বশেষ জ্বালানির প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে একেবারে পেরেশান করে তুলেছে। এরমধ্যে সরকারের মন্ত্রী, এমপি মহোদয়রা এতটাই অপ্রাসঙ্গিক বাণী দিয়ে চলেছেন, যা মানুষকে বিরক্ত করছে বহুগুণ।

আমি নিশ্চিত যে শুক্রবার রাতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সংবাদ শোনার পর অনেক মানুষ নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে কাটাতে বাধ্য হবেন। যাদের উপর পরিবার পরিচালনার দায়িত্ব, তারা রাত জেগে খামোখাই আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানোর চেষ্টা করে গেছেন, যে হিসাব আসলে আর মিলবে না।

তারা জানেন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে তেল, নুন, পেঁয়াজ থেকে শুরু করে বাস-রিকশা, বাড়িভাড়া সব বেড়ে যাবে। বেড়েছে এবং আরো বাড়বে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসের বিল। শিক্ষা ব্যয় বাড়লেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবেনা। আমাদের মতো নির্ধারিত আয়ের মানুষের মূল চ্যালেঞ্জটা হলো বাজারে সবকিছুর দাম হু হু করে বাড়বে, আমার আয় বাড়বে না কিন্তু আমাকে খরচ কমাতে হবে।

আমরা অনেকেই ১৯৭৪ সালের পর অর্থনীতির এত বিপর্যয় দেখিনি। এবার যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারের মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যবৃদ্ধি। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এরকম বড় আরো একটি ধাক্কা দেশের অর্থনীতিকে একেবারে পঙ্গু করে দিতে পারে বলে অনেকেই আশংকা করছেন।

মানুষের চোখের সামনে শ্রীলংকা ও পাকিস্তান মন্দ অর্থনীতির উদাহরণ হিসেবে খাড়া হয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলংকা, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আইএমএফ-এর কাছে ঋণ সহায়তা চেয়েছে। এতবড় একটা ঋণের বোঝা কিভাবে বাংলাদেশ শোধ করবে, সেটা নিয়েও মানুষ চিন্তিত।

একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারের সংকোচন ও মূল্যবৃদ্ধি, অন্যদিকে সরকারের অপরিমিত ব্যয়, দুর্বল ব্যাংকিং নীতি, অর্থনীতিবিদদের কথা অবজ্ঞা করা, কালো টাকা হালালীকরণ, সরকারি কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত বিলাসব্যসন, ভর্তুকি ব্যবস্থা, বিদেশ ভ্রমণ, অ-দরকারি উন্নয়ন পরিকল্পনা, দুর্নীতি, পরিকল্পনাহীন আমদানি নীতি, করোনাকালীন ক্ষয়ক্ষতি এবং জনগণের আয়-ব্যয় এর কথা না ভাবা সব বিরূপ প্রভাব ফেলেছে অর্থনীতির উপর।

করোনার পর অর্থনীতিতে এত বড় ঝড় দেখে সবারই একটা আশংকা তৈরি হয়েছে যে আবার কি আমাদের কাজের জায়গা ছেড়ে, বাচ্চাদের স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিয়ে, শহরের পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে গ্রামে ফিরে যেতে হবে আশ্রয়ের জন্য? সংসার খরচ, সন্তানের পড়াশোনা, বাড়িভাড়া, বিল, গাড়িভাড়া, ওষুধ, বাবা-মায়ের খরচ সব নির্ভর করে চাকরির বেতনের উপর বা নির্ধারিত আয়ের উপর। আয়ের পথ রুদ্ধ হলে, স্থানীয় বাজারে মূল্যবৃদ্ধি হলে, কীভাবে চলবে সংসার?

সাম্প্রতিক গণশুমারি অনুযায়ী ঢাকাতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা সাড়ে চার কোটি। অনেকের ধারণা তা পাঁচ কোটি হবে। সে যাই হোক, এই মানুষগুলোর অর্ধেকও যদি বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে না পেরে আবার গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়, তখন বিপর্যয়টা কতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে, তা সহজেই অনুমেয়।

আবার যে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হচ্ছে, এর মধ্যে সাধারণ মানুষ বাঁচবে কেমন করে? শুধু যে দরিদ্র মানুষের গায়ে এই মন্দার তাপ লাগবে, তা নয়। তাপ লাগবে মধ্যবিত্তর জীবনে। শুধু আর্থিক বিপর্যয় নয়, মানসিক বিপর্যয়ও সমাজ ও দেশকে অস্থির করে তুলবে।

কৃষকরা প্রথম ধাক্কা খেয়েছেন সেচের জন্য বিদ্যুৎ না পেয়ে, অনাবৃষ্টিতে ক্ষতি হচ্ছে ফসলের। কিছুদিন আগে কয়েকটি জেলায় হয়ে গেল বন্যা, বেড়েছে সারের দাম। এখন আরো বাড়বে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ। ডিজেলের দামের সাথে অনেককিছুর মূল্যবৃদ্ধি জড়িত। এই মূল্যবৃদ্ধি গ্রাম ও শহরের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছিল সেই করোনাকাল থেকেই, এবার মনে হয় সত্যি গিলে ফেলবে।

আমরা শুধু অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে ভাবছি কিন্তু সমাজের উপর এর প্রভাব হবে আরো অনেক ভয়াবহ। অর্থকষ্ট, শিক্ষার সুযোগ কমে যাওয়া, জীবন চালাতে না পারা, চাকরি হারানো, উপার্জনের সুযোগ না থাকার মতো বিষয়গুলো সমাজে বাড়াবে খুন, জখম, আত্মহত্যা, চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি, হতাশা, মাদক গ্রহণ এবং শারীরিক অসুস্থতা।

সামাজিক অস্থিরতা ও মানবিক হতাশা এমন বিষয় যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ফিরে এলেও শান্তি ফিরিয়ে আনাটা কঠিন হয়ে পড়ে। সময়ে যে লাগামটা আমাদের টেনে ধরার দরকার ছিল, তা আমরা টেনে ধরতে পারিনি। তাই আন্তর্জাতিক অচলাবস্থা আমাদের যতোটা না ঘায়েল করবে, এর চেয়েও আমরা নিজেদের বেশি ক্ষতি করবো হঠকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে।

লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

Friday, June 3, 2022

জিয়ার অর্থনৈতিক চিন্তা ও অবদানের পথ ধরেই আধুনিক ও স্বনির্ভর বাংলাদেশের শুভযাত্রা

— ফারহান আরিফ




বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পর নতুন সংবিধান সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণের কথা বলা হয়। কিন্তু এই পদ্ধতি কার্যকরের উপযোগী কোনো ধারণা তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারে কারোও মাথায় ছিল না। এমনকি এ বিষয়ক কোনো প্রস্তুতিও সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রটির ছিল না। গণপরিষদে যখন এ বিষয়ক বিতর্ক হয় তখন সমাজতন্ত্রকে ‘মুজিববাদ’ বলে উল্লেখ করা হয়। বস্তুত মুজিব নিজে সমাজতন্ত্রের ঘোষণা দিলেও এর ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। তিনি স্বাধীনতার পরপরই সকল পাট ও বস্ত্র কলসমূহ জাতীয়করণের ঘোষণা দিলেন। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু কোনোরূপ পূর্বপ্রস্তুতি এবং স্বচ্ছ ধারণা ব্যতিরেকেই তার এই পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল। বস্তুতঃ জাতীয়করণ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে উত্তরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও এর সফল বাস্তবায়নের জন্য কয়েকটি শর্ত পূরণের প্রয়োজন ছিল। অর্থাৎ একটি সৎ রাজনৈতিক দল, নিষ্ঠাবান ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনী এবং বিশ্বস্ত প্রশাসন, এই তিনের সমন্বয় ব্যতিত একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে উত্তরণ ছিল অসম্ভব। কিন্তু মুজিবীয় আমলে রাষ্ট্র ও রাজনীতির এই প্রধান নিয়ামকসমূহ গড়ে উঠতে পারেনি। উপরন্তু যারা বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির স্বপ্ন দেখছিলেন তাদের এ সংক্রান্ত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানও ছিল না। ফলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ একটি ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হল। জাতীয়করণের সুযোগে প্রভাবশালী মহল লুটপাটের সুযোগ পেয়ে গেল এবং অতি দ্রুত বাংলাদেশ একটি ভয়াবহ দূর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা লাভ করলো। এসব কারণে স্বাধীনতার মাত্র কয়েক বছরেই বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবার উপক্রম হলো। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ ‘বটমলেস বাস্কেট’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করলো।

রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির এই দুর্যোগে রাজনীতিতেও সংক্রমিত হলো। একটি ঘটনাবহুল রাজনৈতিক পালাবদলের মধ্যে দিয়ে ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার বিপ্লব ঘটলো। সাধারণ সৈনিক এবং জনগণই জিয়াকে কাঁধে করে ক্ষমতার দোড়গোড়ায় নিয়ে এলেন। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে জিয়া উপসামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর তার সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল, বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় কাটিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা।  

জিয়ার অর্থনৈতিক ভাবনা ও উন্নয়ন নীতি 

জিয়া ব্যক্তিখাতের প্রাধান্যসহ মিশ্র অর্থনীতিতে বিশ্বাস করতেন। তার লক্ষ্য ছিল, জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার উন্নত করা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন। এ দুইটিকে তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব মনে করতেন। উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর লক্ষ্যে তিনি কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেনঃ ১) সরকারি ও বেসরকারি খাতে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সম্পদের ভিত্তিতে উন্নয়ন ব্যয় বাড়ানো, ২) বিনিয়োগমূলক ব্যয়ের পরিমাণ বাড়ানো, ৩) জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তি তথা কৃষি ও শিল্প খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পদের বরাদ্দ বাড়ানো।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান গ্রামমুখী অর্থনীতির উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, ‘বাংলাদেশ অর্থ গ্রাম। বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য আমাদের গ্রাম ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন করতে হবে।’ গ্রামীণ জনজীবনের সার্বিক উন্নতির প্রতি গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘গ্রামের নিরক্ষর ও দরিদ্র মানুষের দ্বারে আমাদের সভ্যতার বাণী নিয়ে যেতে হবে। তাহলেই বলতে পারবো যে, বাংলাদেশের উন্নতির জন্য আমরা কাজ করেছি।’

১৯৭৬ সালের ৬ ডিসেম্বর পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যবৃন্দ ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে আলাপকালে জিয়া তার উন্নয়ন নীতির রূপরেখা তুলে ধরেনঃ ১) উন্নয়ন প্রকল্প পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, ২) গ্রামকে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের চাহিদা পূরণে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তুলতে হবে, ৩) গ্রামভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে এবং ৪) পলিমাটিতে ভরাট হওয়া নদী ও খাল খননের কাজে জনগণকে কাজে লাগাতে হবে। এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে তিনি বিভিন্ন স্তরে কমিটি গঠনের রূপরেখাও দিয়ে গিয়েছেন।

দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনা 

মুজিব সরকারের ভ্রান্ত নীতি ও সীমাহীন লুটপাট এবং পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সুফল বয়ে আনতে পারেনি। তাই দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের আগে জিয়া একটু দম নিতে চাইলেন। তাই তিনি একটি দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এই পরিকল্পনায় জিয়ার ১৯ দফা রাজনৈতিক কর্মসূচীর প্রতিফলন ঘটানো হয়। পরিকল্পনা প্রণয়নের খসড়া নিয়ে তিনি ১৯৭৮ সালের ১৬ জুন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অর্থনীতি সমিতির একটি তিন দিনের বিশেষ অধিবেশনে যোগ দেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘জনগণের জন্য স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার লক্ষ্যে দেশে আর্থ-সামাজিক ন্যয়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যকে অব্যহতভাবে অনুসরণ করতে হবে। দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য জনশক্তির কার্যকর ব্যবহার এবং উর্বর জমি, পানি, গ্যাস ইত্যাদির মত অবিকশিত ও অব্যবহৃত প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগানোর উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।’

দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য ছিল, উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং এ কারণে কৃষি উন্নয়ন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার লাভ করে। এ পরিকল্পনায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা এবং বাণীজ্যিক জ্বালানি উন্নয়নের উপর জোর দেয়া হয়। দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রায় ৮৩ শতাংশ পরিকল্পিত ব্যয়ভারসহ বহুসংখ্যক চলমান প্রকল্পকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কারণ সে সময় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে ছিল।

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা 

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য ছিল কৃষিখাতের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রাম উন্নয়ন। এ লক্ষ্যে কৃষিপদ্ধতির দ্রুত রূপান্তরের জন্যে আধুনিক প্রযুক্তির ভিত্তি প্রসারিত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনকে একটি মূলধনভিত্তিক কাজ বিবেচনায় নিয়ে সৌর ও বায়ু শক্তির মতো প্রাকৃতিক শক্তির উৎসসমূহের উন্নয়নের প্রস্তাব করা হয়। দেশের স্বাস্থ্যসেবাকে নিরাময়মুখী থেকে প্রতিরোধমুখী করার উদ্যোগও এই পরিকল্পনার মেয়াদেই গৃহীত হয়।

১৯৮০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বক্তৃতাকালে জিয়া দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার নয়টি অগ্রাধিকারমূলক উদ্দেশ্যের কথা ব্যক্ত করেনঃ ১) খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করা, ২) শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি করা, ৩) জনশক্তি উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, ৪) সর্বজনীন অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু, ৫) গণস্বাক্ষরতা কার্যক্রম প্রবর্তন, ৬) কারিগরি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণকে উৎসাহিত করা, ৭) গ্রামাঞ্চলে মৌলিক চিকিৎসা সুবিধা সম্প্রসারিত করা, ৮) উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করা এবং ৯) সমবায় পদ্ধতীর সম্প্রসারণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত উন্নয়ন।

ভূমি ও কৃষি সংস্কার প্রস্তাব



খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর গভীর আন্তরিকতা থেকেই জিয়া ভূমি সংস্কারে আগ্রহী হন। তিনি মনে করতেন, উত্তরাধিকার আইনের অধীনে ক্রমাগতভাবে জমি খণ্ড-বিখণ্ড হওয়া, নিরক্ষরতা ও সার ব্যবহারে অনভিজ্ঞতা, যান্ত্রিক চাষাবাদ সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব ঋণ প্রদানকারি মহাজনদের শোষণ ইত্যাদির ফলেই কৃষকরা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। জিয়া সীমানা হিসেবে ব্যবহৃত আইল প্রথার সমালোচনা করতেন। তৎকালীন এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, দেশে জমির যত আইল আছে তা একত্র করলে একটি জেলার সমপরিমাণ জায়গা বের হয়ে আসবে।

১৯৮০ সালে জিয়ার শাসনামলে জাতীয় সংসদে এক বৈঠকে ভূমি ও কৃষি সংস্কার প্রস্তাব পেশ করা হয়। এ প্রস্তাবের প্রথম সুপারিশ ছিল, গ্রামাঞ্চলে পরিবার প্রতি কৃষিজমির ঊর্ধসীমা ১০০ বিঘা রাখা যেতে পারে; কিংবা মাথাপিছু ১০ বিঘা করা যেতে পারে। শহরাঞ্চলে কোনো ব্যক্তি একটির বেশি প্লট বা আধা বিঘার বেশি জমি রাখতে পারবে না। এর বেশি রাখলে তা অধিগ্রহণ করে প্রকৃত শহরবাসীদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া যেতে পারে। প্রস্তাবে একটি বর্গাচাষ আইন প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়। এছাড়াও খাস জমির ব্যবস্থাপনা, নদী সিকস্তি ও নদী পয়ন্তি জমির জন্য আইন প্রণয়ন এবং ভূমিকরের জাতীয় হার নির্ধারণের সুনির্দিষ্ট বিধান সুপারিশ করা হয়।

বেসরকারি বিনিয়োগ 

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক। তিনি ব্যক্তিখাত ও বৈদেশিক বিনিয়োগকে উৎসাহিত করেছেন। ব্যক্তিখাতকে ব্রিজ ফাইন্যান্সিং ও আন্ডাররাইটিং সুবিধা প্রদান এবং দেশীয় বেসরকারি শিল্প ও সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের মধ্যে সহযোগীতার ওপর থাকা সকল বাঁধা-নিষেধ বিলোপে তিনি ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) প্রতিষ্ঠা করেন। বেসরকারি খাতকে চাঙ্গা করার জন্য তার সরকার ১৯৭৬ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ পুনঃসক্রিয় করার ঘোষণা দেয়। ১৯৭৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর জিয়া সরকার জাতীয়করণ করা ২৯টি চা বাগান ব্যক্তিখাতে ফিরিয়ে দেয়ার ঘোষণা দেয়। ১৯৭৮ সালের মধ্যে সরকার ১১৬টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বেসরকারি মালিকদের কাছে বিক্রি করে। বেসরকারি নিনিয়োগ নীতিতে জিয়া সরকার দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহারকারি রপ্তানীমুখী শিল্প, গ্রাম ও অনুন্নত এলাকায় শিল্প স্থাপন, আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প, দেশীয় কাঁচামাল নির্ভর কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন এবং টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিল্প স্থাপনকে স্বাগত জানায়।

নারী উন্নয়ন



শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান খুব ভালভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন যে, দেশের উন্নয়নের স্বার্থে নারী উন্নয়নের বিকল্প নেই। মোট জনসমষ্টির এই বিরাট অংশকে পিছিয়ে রেখে জাতীয় মুক্তি অসম্ভব। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেই জিয়া নারী উন্নয়নের জন্য বিশেষ কিছু পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। এই পরিকল্পনায় নারীকে উদ্যোক্তা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। নারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালের ১১ ডিসেম্বর মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। দেশের নারীদের ঐক্যবদ্ধ করা এবং তাদের মাধ্যমে সৃজনশীল কর্মকাণ্ড ত্বরান্বিত করতে ১৯৭৬ সালের ১৬ এপ্রিল জাতীয় মহিলা সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর এক বছরের মধ্যেই ১৯৭৭ সালের ১৫ জানুয়ারি জাতীয় মহিলা একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়। জিয়া পুলিশ বাহিনীতে নারীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করেন। ১৯৭৬ সালের ৮ মার্চ সর্বপ্রথম পুলিশে নারীদেরকে নিয়োগ দেয়া শুরু হয়। তার আমলেই আনসার ও ভিডিপিতেও নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে নারিদের জন্য সংসদীয় আসনের সংখ্যা ১৫ থেকে বাড়িয়ে ৩০ করা হয় জিয়ার আমলে।

জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়ে এই ধারা দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও অব্যহত থাকে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নারীদের জন্য পদ সংরক্ষণ সহ ১৯৭৬ সালের ৮ এপ্রিল সরকারি চাকুরিসমূহে নারীদের জন্য কোটা সংরক্ষণের ঘোষণা দেয়া হয়। এছাড়াও চাকুরিতে প্রবেশের জন্য মেয়েদের বয়সসীমা ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৩০ করা হয় ১৯৭৮ সালের ৩ নভেম্বর তারিখে।

ব্লু ইকোনমি

উন্নত বিশ্বের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পেছনে ব্লু ইকোনমির ভূমিকা অপরিসীম। ব্লু ইকোনমি হচ্ছে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমুদ্রের উপযোগীতা বৃদ্ধি। খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে, খনিজ সম্পদ আহরণ, বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যম হিসেবে সমুদ্রের যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের দেশসমূহ অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধিশালী হয়েছে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে সমুদ্রকেন্দ্রিক এই ব্লু ইকোনমির পথিকৃৎ। তার উদ্যোগে ১৯৮১ সালের ১৯ থেকে ২১ জানুয়ারি দেশ সেরা একদল মেধাবী শিক্ষার্থী এবং বিজ্ঞানীদেরকে নিয়ে ‘সামুদ্রিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি’ একটি শিক্ষা সফর আয়োজন করে। সমুদ্রগামী যাত্রীবাহী জাহাজ ‘হিজবুল বাহার’-এ চড়ে বঙ্গোপসাগরে এই ব্যতিক্রমধর্মী সফরে জিয়া অংশগ্রহণকারীদের সাথে মত বিনিময় করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বঙ্গোপসাগরের বিশাল সম্পদ ও সম্ভাবনার সাথে তাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়া।

খালখনন কর্মসূচি 



১৯৭৬ সালের নভেম্বরের এক শীতের সকালে জড়ো হওয়া স্বেচ্ছাসেবকদের কোলাহলে ঘুমন্ত গ্রাম উলশী জেগে উঠে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সেই স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে মিলে সর্বপ্রথম মাটিতে কোদালের কোপ বসান। তাকে অনসরণ করেন গ্রামেরই ৭০ বছর বয়সী আবদুর রহমান বাদ্যকর। এই বৃদ্ধ তার নিজের এক একর জমি খালের জন্য দান করেন। বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির বৈপ্লবিক অগ্রগতি সাধনের উপযোগী জিয়ার খালখনন কর্মসূচীর সূচনা এভাবেই। জিয়া উলশী-যদুনাথপুর এলাকাকে ‘সারথী স্বনির্ভর এলাকা’ নাম দিয়েছিলেন।

গ্রাম সরকার 

সরকারের উন্নয়নকে গ্রাম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা থেকে জিয়াউর রহমান গ্রাম সরকার ব্যবস্তার প্রবর্তন করেন। গ্রাম সরকারের লক্ষ্য কেবল উন্নয়ন ব্যাবস্থানাই ছিল না; বরং নিম্নতম স্তর পর্যন্ত প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের জন্যেও গ্রাম সরকার অপরিহার্য ছিল। গ্রাম সরকার পরিকল্পনার অধীনেই বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) ১৯৭৭ সাল থেকে ভূমিহীন নারী ও পুরুষদের সংগঠিত করতে শুরু করে। ১৯৮০ সালের ৩০ মে সাভারের জিরাবো গ্রামে প্রেসিডেন্ট জিয়া সর্বপ্রথম গ্রাম সরকারের উদ্বোধন করেন। ১৯৮১ সালে ৭ জানুয়ারি ঢাকায় স্বনির্ভর গ্রাম সরকার প্রধানদের নিয়ে তিনি একটি কনভেনশনের আয়োজন করেন। কনভেনশনে তিনি বলেন, ‘গ্রাম সরকারদের দিয়েই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।’ এই কনভেনশনে তিনি গ্রাম সরকারগুলোর জন্য পঞ্চবার্ষিক পল্লী উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন, সরকারি খাস জমিতে ফলের গাছ রোপণ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ সহ বিশটি কাজের একটি তালিকা দেন।

তৈরি পোশাক শিল্প খাত 

বাংলাদেশের জিডিপিতে দীর্ঘকাল ধরে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে তৈরি পোশাক শিল্প খাত। এ শিল্পের ভীত এবং মূল মানবসম্পদের ভীত গড়ে দিয়েছেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৮ সালের ৪ জুলাই অধুনালুপ্ত দক্ষিণ কোরীয় শিল্প গ্রুপ দেইউ-এর সাথে যৌথ উদ্যোগে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে দেশ গার্মেন্টস স্থাপনের চুক্তি করা হয়। এরপর ১৩০ জন তরুণ-তরুণিকে তৈরি পোশাক প্রস্তুতের উপর হাতেকলমে প্রশিক্ষণের জন্যে দক্ষিণ কোরীয়ার পুসানে পাঠানো হয়। এর মাধ্যমেই বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের অগ্রযাত্রা সূচিত হয়। তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশের জন্য স্পেশাল বন্ডেড ওয়্যারহাউজের প্রয়োজন ছিল। ১৯৭৮ সালে জিয়ার শাসনামলেই এই স্কিম চালু হয়। এটি চালু করার ফলে রফতানিকারকেরা সরাসরি শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সুযোগ পায়।

জনশক্তি রফতানি 

বাংলাদেশের জিডিপিতে অবদান রেখে চলেছে এরকম আরেওটি বড় খাত হচ্ছে রেমিট্যান্স। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার হাত ধরেই এর শুভ সূচনা ঘটে। দেশের কর্মক্ষম যুবকদের চাহিদা পূরণের জন্য তিনি দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ থেকে মোট ৬০৭৮ জন বিদেশে চাকরির উদ্দেশ্যে গমন করে। সেই থেকে এই ধারা ক্রমবর্ধমান আকারে অব্যহত রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপি এই খাতের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল।

ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পে প্রণোদনা 

দারিদ্র্য বিমোচনে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প এখন বাংলাদেশ ছাড়িয়ে সমগ্র বিশ্বেই সমাদৃত। এ প্রকল্পের কারণে ড. ইউনুস এবং গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পুরস্কার অর্জনে করেছেন, যা আন্তর্জাতিক দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার পেছনে চাপা পড়ে আছে জিয়ার অবদান। ১৯৭৬ সালে হাঠাজারির জোবরা গ্রামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অধ্যাপক ড. ইউনুস পল্লী ব্যাংকিংয়ের একটি মাঠ পর্যায়ের গবেষণা করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল, প্রান্তিক জনগণের মাঝে জামানতবিহীন ঋণ সুবিধা প্রণয়নের সম্ভাব্যতা যাচাই করা। পাইলট প্রকল্পটি সফল হবার পর বৃহৎ পরিসরে চালু করার ক্ষেত্রে বড় ফান্ডের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ সমস্যা নিরসনে তখন এগিয়ে আসেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তার নির্দেশনায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফান্ডের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। প্রাপ্ত ফান্ড ব্যবহার করে ড. ইউনুস চট্টগ্রাম ও টাঙ্গাইলে সফলভাবে প্রকল্প সম্পন্ন করেন। এরপরে আর তাকে পেছনে তাকাতে হয় নি। সে সময়ে উদ্যোক্তাদেরকে সরকারি ফান্ড থেকে টাকা দেয়ার ক্ষেত্রে অনেকের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সম্ভাবনা বিচারে জিয়া ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন।

নোবেল পুরষ্কার জয়ী অর্থনীতিবিদ জন ক্যানেথ গ্যালব্রেইথ (১৯০৮-২০০৬) বলেন, ‘In economics, hope and faith coexist with great scientific pretension and also a desire for responsibility.’ বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে জিয়াউর রহমানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন চিন্তায় এর প্রতিফলন সুস্পষ্ট। জিয়া তার যুগান্তকারি ১৯-দফা কর্মসূচীতে বাংলাদেশ নিয়ে তার যে চিন্তা ও চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন, আজ অবধি বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার মূলে তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। একটি তলাবিহীন ঝুড়ি উপাধি পাওয়া দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে দৃঢ় প্রত্যয়ের প্রয়োজন ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়া তা ধারণ করতেন। তারই দেখিয়ে যাওয়া পথ ধরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতিতে জোর দিয়ে এসেছে এবং আগামীতেও এ ধারা অব্যহত রাখবে বলেই জাতি প্রত্যাশা করে।

 

লেখক —  সদস্য, আহ্বায়ক কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।