সাবির মুস্তাফা / বিবিসি বাংলা
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ঢাকা এবং লন্ডনে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিবিসি বাংলার সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। মেন্দি সাফাদি নামে ইসরায়েলের একজন নাগরিকের সাথে একটি সাক্ষাৎকার বিবিসি বাংলা অনলাইনে প্রকাশ করার কারণেই এই সমালোচনা এবং প্রতিবাদ ।
সাক্ষাৎকারে মি.সাফাদি এমন এক দাবী করেছেন যেটাকে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা ‘মিথ্যা’ এবং ‘কল্পনাপ্রসূত’ বলে মনে করছেন।
সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলি সরকারের প্রাক্তন উপদেষ্টা এবং ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিপ্লোম্যাসি এন্ড পাবলিক রিলেশনস্-এর কর্ণধার মেন্দি সাফাদি বলেন, তিনি চার-পাঁচ মাস আগে বাংলাদেশের একজন ‘গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার’ সাথে ওয়াশিংটনে বৈঠক করেছেন।
ঢাকার সরকারী মহলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করার জন্য এই তথ্যই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মি. সাফাদি যখন দাবী করেন সেই ‘গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা’ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র এবং বাংলাদেশের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নেতা সজীব ওয়াজেদ, তখন সেই সাক্ষাৎকারটির গুরুত্বে নতুন মাত্রা যোগ হয়।
মি. ওয়াজেদ এবং মি. সাফাদির মধ্যে ‘বৈঠকের’ খবর দুটো কারণে গুরুত্ব সহকারে দেখা যায়।
প্রথমত, ইসরায়েলের সাথে বাংলাদেশের কোন কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই এবং বাংলাদেশী পাসপোর্টধারীদের ইসরায়েল যাওয়া নিষেধ।
দ্বিতীয়ত, সম্প্রতি ভারতে এক সম্মেলনে বাংলাদেশের সব চেয়ে বড় বিরোধী দল বিএনপি-র একজন সিনিয়র নেতা, আসলাম চৌধুরীর দেখা হয় মি. সাফাদির সাথে। সেই ছবি ঢাকার স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পর মি. চৌধুরীকে গ্রেফতার করে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহ মামলা দায়ের করা হয়।
মি. সাফাদিকে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ-এর একজন ‘গুপ্তচর’ হিসেবে আখ্যায়িত করে মি. চৌধুরীর বিরুদ্ধে মোসাদ-এর সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার উৎখাতে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ আনা হয়। কাজেই, যদি একথা প্রমাণিত হয় যে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে – যিনি তাঁর তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টাও – সেই মি. সাফাদির সাথে দেখা করেছেন, তাহলে সরকারের ‘মোসাদ ষড়যন্ত্র’ গল্প দুর্বল হয়ে পড়বে।
বিবিসি বাংলা প্রথমবার মি. সাফাদির সাক্ষাৎকার নেয় মে মাসের ১৬ তারিখে, যখন আসলাম চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়।মি. চৌধুরীর বিরুদ্ধে সরকারী অভিযোগের পাশাপাশি গল্পের ‘অন্য দিক’ তুলে ধরার জন্যই মি. সাফাদির সাক্ষাৎকার নেয়া হয়।
আসলাম চৌধুরীকে গ্রেফতারের কারণে মেন্দি সাফাদিকে ঘিরে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে জনমনে প্রবল আগ্রহ ছিল, যার ফলে এই ইসরায়েলি নাগরিক রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন।
সেই প্রেক্ষাপটে যখন মে মাসের ২৭ তারিখে সোশাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায় মি. সাফাদি নিউ ইয়র্কের একটি টেলিভিশন (টাইম টিভি) সাক্ষাৎকারে বলছেন তাঁর সাথে সজীব ওয়াজেদের দেখা হয়েছে, তখন সাংবাদিকদের মনে কৌতূহল জাগাটাই স্বাভাবিক ছিল।
এই ভিডিও ফেসবুকে নজরে আসার পর বিবিসি বাংলার সাংবাদিকরা বিষয়টি খতিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করেন । বিবিসি বাংলার সাংবাদিকদের কাছে মি. সাফাদির কথাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল – যদি তার কথার সত্যতা যাচাই করা যায়।
এই যাচাই প্রক্রিয়ার প্রথম পদক্ষেপ ছিল সরাসরি মেন্দি সাফাদির সাক্ষাৎকার নেয়া, তার বক্তব্য নিশ্চিত করা এবং বাড়তি কিছু প্রশ্ন করা। দ্বিতীয় পদক্ষেপ হবার কথা ছিল সজীব ওয়াজেদের সাথে যোগাযোগ করে মি. সাফাদির দাবী সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য নেয়া।
যদি মি. ওয়াজেদ মেন্দি সাফাদির সাথে সাক্ষাতের কথা অস্বীকার করেন, তাহলে পুনরায় মি. সাফাদির কাছে ফিরে যেতে হতো, অথবা দ্বিতীয় কোন সূত্র দিয়ে দু’জনের সাক্ষাতের তথ্য যাচাই বা নাকচ করার প্রয়োজন হতো।
কিন্তু সেসব হয়ে উঠে নাই – শুধু মাত্র মি. সাফাদির সাথে সাক্ষাৎকারটি শুক্রবার (মে ২৭) করা হয়। বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি নতুন কোন তথ্য প্রকাশ করেন নি। তবে সাক্ষাৎকার শুরুর আগে তিনি বলেছিলেন, ওয়াশিংটনে যে বন্ধুর আমন্ত্রণে তিনি মি. ওয়াজেদের সাথে দেখা করেছিলেন, তার পরিচয় তিনি প্রকাশ করতে পারবেন না।
মি. সাফাদির সাথে যোগাযোগের আগেই মি.ওয়াজেদের সাথে যোগাযোগের প্রথম চেষ্টা করা হয়। তাঁর মোবাইলে মেসেজ রাখা হয়। এর পর মি. সাফাদির সাক্ষাৎকার নেয়া হয়, এবং দ্বিতীয়বার মি. ওয়াজেদের মোবাইলে মেসেজ রাখা হয়।
মি. ওয়াজেদ যেহেতু ফেসবুকে বেশ সক্রিয়, তাই তাঁর ইন বক্সে মেসেজ করা হয়, বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বিবিসি বাংলার টেলিফোন নাম্বার দেয়া হয়। কিন্তু সজীব ওয়াজেদ আমাদের অনুরোধে সাড়া দেননি।
তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর মি. সাফাদির সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি রিপোর্ট লন্ডন সময় বিকেল চারটার পর পরই অনলাইনে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিকেল সাড়ে পাঁচটায়, অর্থাৎ বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে দশটার রেডিও অনুষ্ঠানে সেই সাক্ষাৎকারের মূল কথা গুলো প্রচার করা হয়।
দুই ক্ষেত্রেই পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, যে অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও মি. ওয়াজেদের বক্তব্য পাওয়া যায় নি।
সজীব ওয়াজেদের বক্তব্য ছাড়া রিপোর্ট প্রকাশ করার পেছনে দুটি কারণ ছিল : প্রথমত, মি. সাফাদির দাবীর গুরুত্ব, এবং এই কাহিনী নিয়ে জনমনে আগ্রহ। তাছাড়া, মি. ওয়াজেদকে যোগাযোগ করার চেষ্টার ক্ষেত্রে কোন ত্রুটি ছিল না।
মে মাসের ২৯ তারিখ রোববার সজীব ওয়াজেদ তাঁর ফেসবুক পাতায় একটি স্টেটাস দেন, যেখানে তিনি মি. সাফাদির সাথে বৈঠকের কথা অস্বীকার করেন।
তিনি ঐ খবরকে বিএনপির নাটক বলে বর্ণনা করেন, এবং সাফাদির দাবীর ‘সত্যতা যাচাই না করে’ বিবিসি বাংলায় খবর প্রকাশ করাকে তিনি ‘লজ্জাজনক’ বলে অভিহিত করেন।
একই দিন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে একটি প্রতিবাদ লিপি আমাকে পাঠানো হয়, এবং সেটা বিবিসি বাংলার ওয়েব সাইটে গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করার অনুরোধ করা হয়। ঘটনাচক্রে আমি তার আগের দিন ঢাকায় পৌঁছেছিলাম।
মি. ওয়াজেদের ফেসবুক স্টেটাস এবং আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ লিপি দুটিই গুরুত্বের সাথে বিবিসি বাংলার অনলাইন এবং রেডিওতে প্রচার করা হয়।
তবে আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ লিপির একটি বিভ্রান্তিমূলক তথ্য খণ্ডন করা খুবই জরুরী ছিল। সেখানে নিউ ইয়র্কের টাইম টিভি-র প্রসঙ্গ এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার প্রাক্তন উপদেষ্টা জাহিদ সরদার সাদ্দির নাম উল্লেখ করা হয়।
আমার উত্তরে পরিষ্কার করে দেই যে, বিবিসির প্রতিবেদনের সাথে টাইম টিভি বা সরদার সাদ্দির কোন সম্পর্ক নেই।
একই সপ্তাহে ঢাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফের সাথে এক বৈঠকের সময় আমি বিষয়টি আবারো পরিষ্কার করি – টাইম টিভির ভিডিও-র সাথে বিবিসি বাংলার রিপোর্টের কোন সম্পর্ক নেই।
কিন্তু তারপরও দুই-একটি মহল টাইম টিভির উপস্থাপক জেকব মিলটন আর মি. সাদ্দির নামের সাথে বিবিসি বাংলার নাম যুক্ত করে এক ধরনের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন, যেটা যে শুধু অসত্য তাই নয়, হাস্যকরও বটে!
তবে, একটি জিনিস আমার কাছে পরিষ্কার হয় যে আমরা খবরটা যথেষ্ট যত্নের সাথে তৈরি করি নাই।
মেন্দি সাফাদির সাক্ষাৎকার নেয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল, তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। খবর হিসেবে মি. সাফাদির দাবীর যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল, সেটাও অনস্বীকার্য।
কিন্তু, মি. সাফাদির দাবীর অপর পক্ষ, সজীব ওয়াজেদের বক্তব্য ছাড়া – অথবা দ্বিতীয় কোন সূত্র দিয়ে খবরটি যাচাই না করার ফলে খবরটি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।
অন্য এক ব্যক্তি সম্পর্কে একজনের দাবী অপর পক্ষের বক্তব্য ছাড়া প্রচার করার মানে রিপোর্টে প্রয়োজনীয় ভারসাম্য ছিল না।
বিবিসি বাংলার ৭৫ বছর ইতিহাসে এখানে কর্মরত সাংবাদিকরা সব সময় নিরপেক্ষতা এবং ভারসাম্যের দিকে মনোযোগ দিয়েই কাজ করেছেন। বিশেষ করে, দু’পক্ষের বক্তব্য ছাড়া শুধু এক পক্ষের দাবীর ওপর নির্ভর করে খবর করা থেকে বিরত থেকেছেন। এক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হয়েছে।
ঘটনার সার্বিক পর্যালোচনা করে বলা যায় যে, সজীব ওয়াজেদের বক্তব্য ছাড়া খবর প্রকাশ এবং প্রচার বিবিসির নিজস্ব সম্পাদকীয় নীতিমালার পরিপন্থী ছিল, যেটা দু:খজনক।
এ বিষয়ে বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ সমর্থক চিঠি এবং ইমেইলে প্রতিবাদ করেছেন, যাদের সবাইকে বিবিসির নিয়মে বেধে দেয়া নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জবাব দেয়া হয়েছে যেখানে খবরের এই দুর্বলতা বা অসম্পূর্ণতার জন্য দু:খ প্রকাশ করা হয়।
No comments:
Post a Comment