অব্যাহত গুপ্তহত্যা নিয়ে দেশবাসী যখন চরম আতঙ্কে ঠিক তখনই মাদারীপুরের কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তী হত্যাচেষ্টার সময় গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিমকে হাতেনাতে ধরে ফেলে জনতা। জনতা ফাহিমকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার সংবাদে দেশবাসী ভেবেছিল এবার গুপ্তহত্যার ক্লু উদ্ধারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু মানুষের সেই ভাবনা বেশী সময় স্থায়ী হয়নি। গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম পুলিশের ‘কথিত বন্ধুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার পর গুপ্তহত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে সরকারের সদিচ্ছা নিয়েই এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বিদেশি নাগরিক তাবেলা সিজার, হোসি কুনিও থেকে শুরু করে মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, মন্দিরের পুরোহিত, খ্রিষ্টানদের ধর্মগুরু হত্যার শিকার হয়েছে বিগত মাসগুলোতে। প্রকাশ্যে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী নিরীহ নাগরিক, কুমিল্লার কলেজ ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু, বন্ধুসহ মার্কিন কর্মকর্তা জুলহাস মান্নান ও এসপি’র স্ত্রী হত্যার ঘটনা- এগুলো ধারাবাহিকভাবে ঘটে চললেও পুলিশ এসবের কোন ক্লু উদ্ধার করতে পারেনি। ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত কাউকে এ পর্যন্ত কাউকে হাতেনাতে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় মাদারীপুরের কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তী হত্যাচেষ্টার সময় ফাহিমকে জনতাই হাতেনাতে ধরে ফেলে। ঘটনার সঙ্গে আরও কারা জড়িত তা জানার আগেই তাকে ‘ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে‘ বলে অভিযোগ দেশবাসীর। শুধু সরকার বিরোধীরাই নন, ক্ষমতাসীন জোটের পক্ষ থেকেও এ ঘটনার তীব্র সমালোচনা করা হয়। ক্রসফায়ারে ফাহিম হত্যার খবর প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এ ‘মৃত্যু’র মাধ্যমে সরকার কাকে আড়াল করতে চায় সেই প্রশ্ন তোলেন সচেতন মানুষ। ফাহিম নিহতের পর কেউ কেউ সরকারের বিরুদ্ধে জঙ্গি ইস্যু সচল রাখার অভিযোগ তুলেছেন। সরকার গুপ্ত হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আড়াল করতে চায় অথবা এ বিষয়ে দেশবাসীকে অন্ধকারে রাখতে চায় বলেও মন্তব্য করেন কেউ কেউ। আর ক্রসফায়ারের প্রকৃতচিত্র দেশবাসীর জানা রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা।
ক্রসফায়ারের কিচ্ছা এখন কেউ বিশ্বাস করে না বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, বাংলাদেশে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী রিমান্ডের সময় আইনজীবী বা পরিচিত কারো উপস্থিতির বিধান থাকলেও সেই নিয়মটি ‘মোটেও মানা হচ্ছে না'।
গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম পুলিশের রিমান্ডে থাকা অবস্থায় কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হবার পর এই অভিযোগ করেন আইনজীবী শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, ‘আমারতো মনে হয় দেশে কারো কোন সন্দেহ নাই যে পুলিশ তাদের ইচ্ছাকৃতভাবে মেরে ফেলছে’।
মনে করা হচ্ছিল, তার কাছ থেকে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড ও জঙ্গিবাদ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরুর চব্বিশ ঘণ্টার মাথায় সে কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হবার পর এ নিয়ে ইতিমধ্যে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, রিমান্ডে থাকা অভিযুক্তকে নিয়ে অভিযানে যাওয়া প্রসঙ্গে। তবে ঘটনার পর মাদারীপুরের পুলিশ প্রধান সরোয়ার হোসেন বলেছিলেন, ফাহিম তার সহযোগিদের নাম এবং আড্ডাস্থল বলেছিল এবং তাদের ধরতে ফাহিমকে নিয়েই পুলিশ অভিযানে গিয়েছিল। এসময় ফাহিমের ‘সহযোগিদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে’ আহত হয়ে সে মারা যায়। এ প্রসঙ্গে শাহদীন মালিক বলেন, "২০০৪-০৫ সালে হয়তো কেউ কেউ ক্রসফায়ারের কিচ্ছা বিশ্বাস করতো, এখন কেউ এটা বিশ্বাস করে না"।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, গুরুত্বপূর্ণ মামলার আসামিরা এভাবে (ক্রসফায়ারে) মারা গেলে অনেক সত্য অপ্রকাশিত থাকবে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেছেন, রাষ্ট্র আইন হাতে তুলে নিচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে একের পর অভিযুক্ত ব্যক্তি নিহত হওয়ার ঘটনার তীব্র সমালোচনা করেছেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ও ব্লগার ইমরান এইচ সরকার। তিনি বলেছেন, সন্ত্রাসী, জঙ্গি বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যারাই খুন করুক না কেনো খুনকে খুনই বলা হবে। তিনি চান দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক এবং অপরাধী তার অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি পাক। তবে তিনি বলেন, “কিন্তু কোনোভাবেই চাই না এই অপরাধীর দায়-দায়িত্ব আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নিজেরাই তুলে নেবে।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ১৮ জুন সন্ধ্যায় সাংবাদিকরা জানতে চান ‘গায়ে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট, মাথায় হেলমেট থাকার পরও ফাহিম কীভাবে গুলিতে নিহত হলো? এমন প্রশ্নের সঠিক কোনো জবাব দিতে পারেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। একইদিন জাতীয় প্রেসক্লাবে বিএফইউজে ও ডিইউজে’র একাংশ আয়োজিত ইফতার মাহফিলে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক গুপ্তহত্যার প্রসঙ্গ তুলে বক্তৃতা করেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গুপ্তহত্যা চলছে। আমি বলেছিলাম তথ্য আছে। মাদারীপুরে শিক্ষককে হত্যাচেষ্টা থেকে এখন প্রমাণ হয়েছে। সেখানে জনগণ হাতেনাতে ধরেছে। এ ঘটনার পর কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। এরপর এভাবেই মানুষ ধরবে।’ কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ফাহিম নিহতের প্রসঙ্গ আসেনি।
‘বন্দুকযুদ্ধে’ ফাহিম নিহত হওয়ার পর ফেসবুকে এ ঘটনাটি নিয়ে মন্তব্য করেছেন সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা। তিনি লিখেছেন, “রাজনৈতিক বক্তৃতায় যে কাউকে অভিযুক্ত করা যায়। নিজেরা ধরতে পারি না, জনগণ ধরে দেয়। তাদের ক্রসফায়ারে বা বন্দুক যুদ্ধে হত্যা করা হয়। এমন একটি হত্যাকাণ্ড যে ঘটতে যাচ্ছে, অভিযানের ধরণে তা প্রত্যাশিতই ছিল।”
“তিনি আরো লিখেছেন- কারা জঙ্গি, কারা তৈরি করে, কারা পৃষ্ঠপোষক, কারা জঙ্গি-গুপ্তহত্যা টিকিয়ে রেখে সুবিধা পেতে চায়- সব প্রশ্নের উত্তর আছে এই একটি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে।”
ফাহিমের ‘রহস্যেঘেরা’ এই মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিপুলসংখ্যক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী। সমালোচনার ঝড় উঠেছে, তার হাত হ্যান্ডকাফে বাঁধা ছিল, তা নিয়েও। ফাহিমকে যখন ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয় ওই সময় তার বুকে গুলির চিহ্ন দেখা যায়। তার পরনে প্যান্ট ও একটি সাদা রংয়ের গেঞ্জি রয়েছে। হাত হ্যান্ডকাফে আটকানো।
একের পর এক হত্যাকাণ্ডের যখন সুরাহা করা যাচ্ছিল না, তখন ফাহিম গ্রেফতার হওয়ায় বেশকিছু তথ্য পাওয়া যাবে এমন আশা ছিল দেশবাসীর। এ প্রসঙ্গে নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ‘বন্দুক, তুমি যুদ্ধ বোঝো, তদন্ত বোঝো না’ শিরোনামে ফেসবুকে লিখেছেন, “মাদারীপুরে কলেজ শিক্ষক হত্যাচেষ্টার আসামি ফাহিম রিমান্ডে থাকাকালীন ১৮ জুন শনিবার ভোররাতে ‘বন্ধুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। মৃত্যুর পর তার হাতে হাতকড়া দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।” মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। ১৮ জুন সকালে নিজের ফেসবুকে ‘বন্দুক, তুমি যুদ্ধ বোঝো, তদন্ত বোঝো না?’ শিরোনামে লেখা ওই পোস্টে আরো উল্লেখ করেন, “যেখানে এই আক্রমণের হাত থেকে আস্তিক নাস্তিক, সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু, নারী পুরুষ, সিভিলিয়ান, পুলিশ কেউই ছাড় পাচ্ছিলো না, যেখানে এটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তেছিলো এবং আমরা কোনো বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের আলামত দেখছিলাম না, সেখানে মাদারীপুরের মানুষ এক আসামি হাতে নাতে ধরে ফেলার পর আশা করছিলাম ভেতরের কলকাঠির সুলুক সন্ধান করা হবে। সেই স্থলে এই বন্দুকযুদ্ধের কি মানে?'’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মাদ লিখেছেন, “এই আশংকাটাই করছিলাম। শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলাকারী ফাহিমকে রিমান্ডে নিয়ে বন্দুকযুদ্ধের নামে খুন করা হলো। এখন আর কোনো প্রমাণ নেই সুতরাং নানা কাহিনী চালিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। কেউ ধরা না পড়লে যথারীতি অনেক গল্প শুনতাম, কিন্তু গোল বাঁধিয়েছে এলাকার মানুষ ফাহিমকে হাতে নাতে ধরে। পুরোটা না পারলেও ফাহিম কিছুটা সূত্র দিতে পারতো নিশ্চয়ই।”
ক্ষমতাসীন ১৪ দলের শরিক নুরুল আম্বিয়া ও নাজমুল হক প্রধানের নেতৃত্বাধীন জাসদ দাবি করেছে, পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ গোলাম ফয়জুল্লাহ ফাহিম নিহতের ঘটনা ‘রহস্যজনক’।
জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের আসল ঘটনা আড়াল করতেই মাদারীপুরের কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তী হত্যাচেষ্টা মামলায় রিমান্ডে থাকা গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিমকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। ১৮ জুন বিএনপি এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করে। দলের পক্ষে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘ওখানে উচিৎ ছিল আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আরো কারা জড়িত সেটা উদঘাটন করা। তাকে আইনি প্রক্রিয়া নেওয়া যেত। তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেয়া যেত। যাচাই-বাছাই করে জানা যেতে এরা প্রকৃত জঙ্গি কী না, জানা যেতো আর কারা কারা জড়িত। এটা জনসন্মুখে উদ্ভাসিত হতো, তাদের নামগুলো জানা যেত।’ তিনি বলেন, ‘সরকার তাকে (ফাহিম) ক্রসফায়ারে হত্যা করল, হত্যা করা মানে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করা। এটাকে সামনে আসতে দিল না। আমরা আগেই বলেছি প্রতিটি সন্ত্রাসের সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা সম্পর্ক আছে। আমাদের দলের চেয়ারপারসন বলেছেন উগ্রবাদী চক্রের সঙ্গে সরকার জড়িত। এ ঘটনাটিতে যে ঘনকুয়াশা তৈরি করেছে সরকার। এর সঙ্গে সরকার জড়িত।’ একইদিন দলটির চেয়ারপারসন ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ক্রসফায়ারে হত্যার সমালোচনা করেছেন। প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতেই ক্রসফায়ারে হত্যা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
শীর্ষ নিউজ
No comments:
Post a Comment