অনিল চট্টোপাধ্যায়
নতুন দিল্লি/dw.com
ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে তাঁদের স্বভূমি মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে মোদী সরকার যেভাবে চেষ্টা শুরু করেছে, তা রদ করার করার জন্য রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে মোহাম্মদ সলিমুল্লা এবং মোহাম্মদ শাকির সুপ্রিম কোর্টে জরুরি আর্জি জানালে আদালত তা বিবেচনার জন্য গ্রহণ করেন৷ তাঁদের পক্ষের আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ সওয়াল করেন যে, সরকার তাঁদের জোর করে ফেরত পাঠাতে পারেন না৷ তা করলে সেটা হবে ভারতের নাগরিক বা অন্য দেশের নাগরিক, অর্থাৎ প্রতিটি মানুষের জীবনের এবং বেঁচে থাকার অধিকারের সাংবিধানিক গ্যারান্টির পরিপন্থি৷ কারণ, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠালে মিয়ানমার সরকারের হাতে তাঁদের প্রাণ সংশয়ে থাকবে৷
পাশাপাশি ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও এই ফেরত পাঠানোর ইস্যুতে সরকারকে অনুরূপ নোটিস দিয়েছে৷ বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক আইন এবং সাংবিধানিক দায়দায়িত্বের কথা মাথায় রেখে সরকারের উচিত তাঁদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা৷ ভারতের কাছে এটা মানবাধিকার রক্ষার এক বড় চ্যালেঞ্জ৷ মিয়ামারের রাখাইন প্রদেশের বাসিন্দা রোহিঙ্গারা চরম অত্যাচারের বলি৷ দলে দলে পালিয়ে তাঁরা আশ্রয় নিচ্ছে বাংলাদেশে৷ সেখানেও তাঁদের দরজা বন্ধ করা হয়েছে৷ বংলাদেশ সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডে রোহিঙ্গা শরনার্থীরা তাঁবুতে জীবন কাটাচ্ছে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে, প্রতিকূল পরিবেশে রোগ-জ্বালা সহ্য করে৷
শুনানিকালে সরকার পক্ষে সওয়াল করেন অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা৷ তিনি সরকারের তরফে কোনো আশ্বাস দেননি৷ শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি রোহিঙ্গাদের পিটিশনের একটি কপি প্রথমে সরকারকে দিতে বলেন৷ কাজেই এই মূহুর্তে আদালত কোনো রায় দিতে অপারগ৷ পরবর্তী শুনানি ১১ই সেপ্টেম্বর৷
মিয়ামারের রোহিঙ্গারা এমনই একটি হতভাগ্য সম্প্রদায় যাদের নিজবাসে বা পরবাসে কোথাও ঠাঁই হচ্ছে না৷ একটা ভেসে বেড়ানো মুসলিম গোষ্ঠী৷ এই প্রসঙ্গে ভারতের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির প্রেসিডেন্ট ধীরাজ সেনগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বললেন, ভারত প্রথম মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকারী দেশগুলির অন্যতম৷
কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে যেভাবে দেখছেন, তা সত্যিই উদ্বেগজনক, কারণ, সরকার বিষয়টিকে জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত করে দেখছে৷ উচিত ছিল জাতিসংঘের রিফিউজি কনভেনশনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করা৷ রোহিঙ্গা শরনার্থীরা যদি জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিপদের কারণ হয়, তাহলে আগেও তো ভারত শরনার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে৷ যেমন, দলাই লামা৷ তিব্বতি শরনার্থীরা ব্যাপক সংখ্যায় ভারতে আশ্রয় নিয়েছে৷ সেটা নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার কারণ না হয়ে থাকলে চালচুলোহীন এক মুসলিম জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিলে তা জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক হবে?
গণতান্ত্রিক সুরক্ষা সমিতির সভাপতির মতে, রিফিউজি কনভেনশনে সই করা একটি দেশ হিসেবে ভারতের উচিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পরিচয়পত্র এবং রিফিউজি কার্ড দেওয়া৷ জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে সহমত তৈরি করতে পারলে জাতিসংঘ আর্থিক সাহায্যও পাওয়া যেতে পারে৷ ভারত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাড়িয়ে দিলে ঘাটে ঘাটে মার খেতে খেতে তাঁরা একদিন মরিয়া হয়ে নিজের হাতেই অস্ত্র তুলে নেবে বাঁচার জন্য৷ ...মিয়ানমারের মানবাধিকার কর্মী নোবেল পুরস্কার বিজেতা অং সান সু চি প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলের কাছে ক্ষোভ উগরে দিয়ে তিনি বললেন, তাঁর বর্তমান নীরব দর্শকের ভূমিকা দেখে মনে হচ্ছে তিনিও বুঝি সামরিক জান্তার শরিক৷ তাঁর পারিবারিক পরিচয়টাই তাঁর কাছে এখন বড়৷
ভারতে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা অভিবাসীর মধ্যে একটা বড় অংশ রয়েছে দিল্লিতে এবং আরেকটা অংশ রয়েছে জম্মুতে আর কিছু পশ্চিমবঙ্গে৷ পশ্চিমবঙ্গে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা জেলবন্দি৷ বাচ্চারা রয়েছে হোমে৷ তবে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার রোহিঙ্গাদের মাঝে শরণার্থী সংক্রান্ত জাতিসংঘের দেওয়া পরিচয়পত্র বিতরণ করতে চলেছে৷ ভারতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ১৬ হাজার ৫০০ জনের নাম জাতিসংঘের শরণার্থী তালিকাভুক্ত৷ বছর দুয়েক ধরে থাকতে থাকতে নিজেদের বস্তিতে তাঁরা নিজেরদের মতো জীবিকার সংস্থান করে নিয়েছে৷ ছোটখাটো দোকান দিয়েছে, শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে, বাচ্চারা পড়াশুনার সুযোগও পাচ্ছে৷ হিন্দিও শিখে নিচ্ছে৷ এই সুযোগ তাঁরা হারাতে চায় না৷ ফেরত পাঠাবার কথা শুনতেই তাঁদের মনে আবার সেই উদ্বেগ, আতঙ্ক৷ এবছর ভারতে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ঈদ উত্সবেও ছিল মনমরা৷
No comments:
Post a Comment