Search

Saturday, October 14, 2017

বাংলাদেশের চাল-বেচাল কথকতা

কালাম আজাদ

বোধ হয় দেড় দশক আগে একজন লেখকের একটা লেখা পড়েছিলাম। খুবই লেখাটির শিরোনাম অতি আটপৌরে -  ‘ একদিন ভাত খেয়েছিলাম’। লেখাটা ঐ সময়ে পাঠকের মনে বেশ দাগ কেটেছিল। ক’দিন আগে ‌যোগাযোগ মাধ্যমে দেখলাম বলা হচ্ছে ‘আজ ‌থেকে তোর ভাত বন্ধ’। অাজকে সদ্য প্রকা‌শিত এক সংবাদ দেখলাম কে নাকি ২৩ বছর ধরে ভাত খায় না। মন পড়ে গেলে ভাষাতত্ত্বের শব্দের উৎপত্তি বা বুৎপত্তি তত্ত্ব। আলোচনাটা একটু অশ্লীল আমি পাঠকবর্গের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। কিন্ত কথাটা বলতেই হবে। নইলে গুরুত্বটা কলিজায় গিয়ে ঠিক ঠেকবে না। সারস্বত সমাজের কথায় আছে অন্ন চিন্তা চমৎকারা! অর্থাৎ কিনা ভাতের চিন্তাটা বড়োই কঠিন। ভাত বাংলাদেশে মানুষের জীবনে কতো কঠিন সেটা বোঝা যাবে। একটি মাত্র অশ্লীল শব্দে সেটা হলো ‘ভাতার’ । শব্দটা আসলে কিন্ত অশ্লীল মোটেও নয়। নারীর স্বামীর অপর নাম! অর্থ স্বামী তার স্ত্রীর ভাত বা ভরণপোষণ যোগাতে অন্তত ধর্মের দিক থেকে হলেও বাধ্য। তাই বলা হয় ভাত দেবার ভাতার নয় কিল দেবার গোঁসাই। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেব এমনি মোটামাপের তথা সরল ভাষায় ধর্মের তত্ত্ব দিয়েই তিনি হয়েছেন পরমহংস দেব। অর্থাৎ তিনি আজকের আধুনিকতায়  ইফেকটিভ কমিউনিকেটর। তিনি হয়েছেন বিবেকানন্দের গুরু। বিবেকানন্দ যা বলেছেন ও লিখেছেন তা  অতি উচ্চস্তরের সাহিত্য। কিন্ত তাঁর নামটি যতো না জেগে আছে তার চেয়ে ঢের ‌ বেশি বেঁচে আছেন রামকৃষ্ণ । 




সে যাক, কাজের কথায় ফিরে আসি।  ‘৪৭ এর পর  বা তা‌রও আগে অখণ্ড  বাংলায় হয়েছে ভাতকেন্দ্রিক রাজনী‌তি। পশ্চিম পাকিস্তানি শোষণের মুখে বাংলাদেশের মানুষ যে রাজন‌ীতিতে‌ আকৃষ্ট হয়েছে তা হলো মোটাভাত কাপড়ের রাজনীতি। শেরে বাংলা ভাতের রাজন‌ীতি করেছেন, ক‌রেছেন মওলানা ভাসানী। তিনি বলেছিলেন, ওহে সোহরাওয়‌র্দি  বিমানে করে কি ভাত নিয়ে এস‌েছো আমাদের জন্য । তিনি আরও কিছু বলেছিলেন সেটা বলাবাহুল্য শ্রীরামকৃষ্ণের মতোই আদিরসাত্মক ভাষা।তিনি এমনকি শেষটায় ভোটের আগে যার কথা বলেছিলেন তাহলো ভাত। মাঝখানে কিছুটা ছাড় দিয়ে আমরা বলতে পারি বেগম খালেদা জিয়ার ডালভাত-এর কথা। কিন্ত এবার ভাতের রাজন‌ীতি তে দেখা গেলো স্ট্রাটেজি বদল হয়েছে। ভাত মারা শুরু হলো।  বলা হলো ‘ ‘খালেদা জিয়ার ডালভাত, গরিবের মাথায় হাত!’ বেশ তাহলে দেখা যাক, পরের ঘটনা‌। দেশের শাসকশক্তি সেই ডালভাতের, এমনকি লবণ তেলের ব্যবস্থাপনা তুলে দিলেন তাদের হাতে যাদের ফরজ কাজটি ছিল সীমান্ত রক্ষা। অবস্থা পোঁছে গেল চরম সীমান্তে। কয়েক ডজন জেনারেল প্রাণ দিলেন। হাজারো বিডিআর সদস্য বলি হলেন। তবু ভাতের প্রশ্নের মীমাংসা আর হলো না।

এর আগে ভাতের রাজন‌ীতির প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে দেশ দে‌খলো আইয়ুব খানের ভুট্টা খাওয়ানো ও লোক মারার  প্রতিবাদে ভূখামিছিল। গমও প্রথমবারের মতো এলো গম বা আটা হয়ে। উত্তেজিত কথাবার্তা ছড়িয়ে পড়লো সবখানে। ওরা আমাদের ‘‌রেকর্ড’ (গ্রামোফোন রেকর্ডের আকারের রুটি যা খেলে নাকি আমাশা হয়ে যায়) খাইয়ে আমাদের পেট ভরাতে চায়। ভয়ানক চক্রান্ত। পরে আমরা কি দেখলাম সে কথা পরে । ১৯৬০ থেকে ১৯৭৪-এর এই মেয়াদে ঘটে সবুজ বিপ্লব। ইরি আমাদের খাদ্যের জগতে বিপ্লব নিয়ে আসে। ৬৯-এর যখন গণঅভ্যুত্থান ঘটে তখন সবুজ বিপ্লবের মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে কালের স্বাভাবিক নিয়মে। নতুন চক্রের শুরু সম্ভবত ১৯৭৫-র পরে যখন দেশ কৃত্রিম আকাল কাটিয়ে উঠেছে হাজারো বুভুক্ষু প্রাণের বলি দামে। এদেশে আনা হয়েছিল নে‌ডেকোকে - যার পুরো নাম ন‌েদারল্যান্ড ইন্জ‌িনিয়ারিং  কোম্পানি। পৃথিবীসেরা প্রযুক্তি ছিল  ডাচদের কাছেই। তাদের  পরিকল্পনায় উপকূলীয় অঞ্চলে ধানের অভাবিত ফলন হয়। তবে এর উপযুক্ত ফলোআপ না থাকার কী পরিণতি হতে পারে তা আমরা দেখছি ভবদহ ও বিল ডাকাতিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। ওদিকে ৭০ দশকের মাঝামাঝি দেশের অন্যতম সেরা ও নিরাপদ ভূ-উপরি সেচ প্রকল্প গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্প  এলাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবার ফলে ওখানে প্রচুর ধান ‌তো উৎপন্ন হয়, আর সেই যে নতুন ফসল আসে তার পপুলার নাম হলো আটার চাকতি বা গম। দেশের মাটির গম পেতে থাকে পরম আগ্র‌হে বাংলাদেশের মানুষ।এটি আসলে ছিল এক বিশাল খাল কাটা প্রকল্প। যে সব খালে পদ্মা থেকে মিঠে পানি তু‌লে খালে প্রবাহিত করা হয়। আসতে থাকে সোনালী ফসলের প্রবাহ। এটি ছিল আসলেই খাল কাটা প্রকল্প যা কুমির ডেকে অনেনি। সম্ভবত দেশ গড়ার যোগ্য দাবিদার জিয়া এখান থেকেই আইডিয়া পেয়েছি‌লেন। আর সেখালে কুমির আসবে কি, নেতার অবর্তমানে শোকেই হয়তো বা শুকিয়ে গিয়েছিল। এই প্রকল্পটি রক্ষা করছিল দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে এক তৃতীয়াংকে লবণাক্ততার হাত থেকে। ভারত ‌গঙ্গা থেকে পা‌নিপ্রবাহ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর করে দিল । জিকে প্রকল্পের অকালমৃত্যু ঘটল।

এলো হাইব্রিড এইচওয়াইভি। দেশ প্রায় খাদ্যে স্বয়ম্ভর হয়ে উঠলো। কথার খৈ ফুটতে লাগলো । রহমত আছে না। আছে অবশ্যই তবে তাও অফুরন্ত বলে দেখা গেল না। ঝড়-বন্যা জলোচ্ছ্বাস প্রায় হয়নি বলা চলে দীর্ঘকাল । ক্ষীণকায় সাত উটের স্বপ্ন কী দেখেছেন ইউসুফ! আজ কী আমরা দেখছি,জ্যামিতিক হারে ধানচাল, সবকিছুর দাম বাড়ছে। ১০/১২ কে‌জি দুরে থাক  ৫৫ টাকা কেজি ছেড়ে ওটা  আসমানে চড়ার অপেক্ষায় রয়েছে। চা‌ল‌ের ঘাটতি হয়েছে ৫০/৬০ লাখ টন!  আসামী পাকড়াও করা হচ্ছে ভারতসহ চালরপ্তান‌িকারক হাতে গোনা কযেকটি দেশকে। চাল রপ্তানি করার আত্মম্ভরিতার দিন খতম। তাদের দোষ কী। তারা বিক্রেতা। সুযোগ পেলে তো বেশি চাইবেই। ‌সোজা কথা ফেল কড়ি , মাখো তেল তুমি কি, আমার পর! আজ থেকে কয়েক দশক আগে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী দুর্গাবাবু বলেছিলেন , বাংলাদেশের অর্থনীতি ভারতের অর্থনীতির সম্পুরক। কথাটা মোশতাকের পছন্দ হয়নি। কিন্ত আজ। পেঁয়াজটার জন্য পর্যন্ত আমরা একান্তই ভারত নির্ভর।  বাংলাদেশের সাধারণ ব্যবসায়ী বলছেন, চলের দাম বাড়ন্ত হওয়ার নেপথ্যে নাকি ভারত।

আমাদের ন‌ীতি নির্ধারকদের বক্তব্য কী। ভারতের ভরসায় যদি তাঁরা আঁখি মুদে থাকেন কী হবে।যদি তারা কৃষি ইনপুট ‌নিয়ে আকণ্ঠ দুর্নীতিতে লিপ্ত থাকেন বাস্তবতা কি মোহন স্বপ্নের ঘোমটা দিয়েই থাকবে। সর্বশেষ সর্বনাশা খবর এসেছে  -  রশীদকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ নির্দেশ দিয়েছেন  মন্ত্রিসভার অন্যতম ঝানু মন্ত্রী বলে খ্যাত বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমদ। আমাদের দেশে ‘খনির’ চোরদের ঠেলায় বহুকাল আগেই রেশনিং ব্যবস্থা উঠে গেছে। শাস্ত্র আউড়ে ফতোয়া দেওয়া হয়েছে রেশনিং-এ কালোবাজারের জোয়ার বাড়ে। অতএব বাকি থাকে কি। অতএব ধরো শালাকে। খাতিরের বৈঠকের পরপরই সেই বার্তা গেল। কিন্ত সেই বার্তা রটে যাবার আগেই হয়তো  বাতাসী চোপাবাকসে খবর  আগাম পৌঁছে গেল যেখানে যাবার। ‌টাস্ক ফোর্স -এর মর্দরা সবিক্রমে গিয়ে দেখতে পে্লেন চিড়িয়া উড়ে গে‌ছে। অত‌এব কারও কারও মতে কেষ্টা ঐ হানিফ বেটাই চোর।

‌এর মাঝে পদ্মা দিয়ে গড়িয়েছে অনেক জল। ভাতের ওপর গমের জায়গা করে নেবার অবিশ্বাস্য অথচ সত্য কাহিনী ফাঁস হয়েছে। কিছুকাল আগে চালের দাম যখন গমের চেয়ে কম ছিল পথিকৃত জিয়া প্রবর্তিত কাবিখার ‌মেয়েরা নাকি চালের বদলে গম পাওয়ার জন্য খাবি খেতে বাধ্য হয়েছে। আর চেয়ারম্যান সাহেবেরা চালে‌র চেয়ে দামি গম কালোবাজারে বেচে চেহারা নুরানি করেছেন। আর হানিফ  সঙ্কেতের কল্যাণে নিজেরা গমচোর নামে কিংবদন্তী হয়ে গেছেন।

এ কাহিনী অ‌নেক লম্বা সুতোয় বাঁধা। সুতো বেয়ে গোড়া ২য় ‌বিশ্বযুদ্ধে অনেক দানবীর পর্যন্ত  গিয়ে ঠেকবে একই চাল চাল-বেচাল , বেতাল কাহিনী। আর এ কারণে দেশরক্ষা কমিটির অন্যতম বিপ্লবী  ও মুক্তিযোদ্ধা কবি রফিক আজাদ ক্ষিপ্ত বিদ্রোহেই বোধকরি লিখেছিলেন  --


‘চাই না মন্ত্রীর গাড়ি, চাই না নিতম্ব প্রধান নারী
চাই লাল লাল ভাত , ভাত দে হারামজাদা
নইলে মানচিত্রটাই খেয়ে ফেলব’

No comments:

Post a Comment