Search

Wednesday, November 4, 2020

গণতন্ত্রহীনতা ও চরমপন্থা — আপন দুই ভাই


—  সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া 

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে মূলত সরকারি-নীতি নিয়ে বিতর্কই মূল কেন্দ্রবিন্দু। উন্নত দেশগুলোতে জনগণ দেখে কোন দল আমার আয়-রোজগার, ব্যবসার জন্য ভালো, আমার ট্যাক্স কম নিবে বা এফিশিয়েন্টলি খরচ করবে, দুর্নীতি কম করবে। আবার অনুন্নত দেশের জনগণ দেখে কারা আমার রাস্তা-ঘাট, সেতু-কালভার্ট বানায়, স্কুল ভবন করে দেয়, টিআর-কাবিখা দেয়, দুর্নীতি কম করে। অর্থাৎ এসবই জাগতিক বিষয়-আশয়। উন্নত বা অনুন্নত যেকোনো দেশেই গণতন্ত্রে দলগুলোকে ডেলিভার করতে হয়, পারফরমেন্স দেখাতে হয়। সুতরাং সরকারি-নীতি-নির্ভর মধ্যপন্থী দলগুলো তুলনামূলক বাস্তববাদী সমাধান হাজির করে এবং দিনশেষে র‌্যাডিক্যাল দলগুলোর চেয়ে এগিয়ে থাকে। অর্থনীতি খুব খারাপ করলে বা প্রতিষ্ঠিত মূলধারার দলগুলো সবাই ব্যর্থ হলে র‌্যাডিক্যাল/চরমপন্থীরা ফাঁকতলে ক্ষমতায় চলে আসতে পারে, কিন্তু ডেলিভার করতে না পারলে মানুষই আবার তাদের খেদিয়ে দেয়।

অগণতান্ত্রিক দেশে বা স্বৈরতান্ত্রিক দেশে (পড়ুন বাংলাদেশের মতো) সরকারকে লেজিটিমেসি ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য মূলত দুইটা কাজ করতে হয়: ১) উন্নয়ন/ভয় বিক্রি করতে হয়, ২) চরম দমন-পীড়ন চালাতে হয় যেহেতু জোর-জবরদস্তি করে ক্ষমতায় টিকে থাকা লাগে। [চীনকে যেকোনো উদাহরণের বাইরে রাখবেন – কারণ চীনে এমন একটি ব্যবস্থা চালু আছে যা পৃথিবীতে চূড়ান্ত ব্যতিক্রম – লম্বা আলাপ, পরে সময়-সুযোগে বলবো]

যেহেতু স্বৈরশাসক ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে দমন-পীড়ন করতে হয়, তো এর প্রথম ধাক্কাটা লাগে প্রতিষ্ঠিত মধ্যপন্থী দলগুলোতে। কারণ স্বৈরশাসনের প্রথম শর্ত হলো বিদ্যমান অর্থোডক্স রাজনৈতিক বিকল্প শক্তিটিকে নির্মূল করা। একাজটি তারা সহজেই করে। কারণ এই মধ্যপন্থী দলগুলো যেহেতু সরকারি নীতি, উন্নয়ন এসব স্লোগান নিয়ে রাজনীতি করে, এবং রেন্ট-সিকিং-এর উপর ভিত্তি করে একটা পেট্রন-ক্লায়েন্ট রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে এদের রাজনৈতিক র‌্যাঙ্ক-এন্ড-ফাইল পরিচালিত হয়, সেহেতু এদের কর্মীদের আনুগত্য ও রেজিমেন্টেশন র‌্যাডিক্যাল/চরমপন্থী (আইডিওলজি বা আইডেন্টিটি-নির্ভর) দলগুলোর চেয়ে কম। এবং যেকোনো চরম নিপীড়ন, নির্যাতনের ‍মুখে মধ্যপন্থী, অর্থোডক্স এসব দল হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে। এই ফাঁকা স্পেসটিই র‌্যাডিক্যাল/চরমপন্থী প্রান্তিক দলগুলোর বিকাশের উত্তম সময়। এদের কর্মীদের আনুগত্য ও রেজিমেন্টেশন যেহেতু শক্ত, এবং এমনকি নির্যাতনের মুখেও তারা দলত্যাগ করে না বা সহজে হাল ছেড়ে দেয় না, তখন স্বৈরশাসনের প্রচণ্ড দমন-পীড়নের মুখে দীর্ঘমেয়াদে এরাই প্রধান, প্রবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে আবির্ভূত হয়। স্বৈরশাসন ম্যাচিউর হওয়ার কিংবা এই র‌্যাডিক্যাল/চরমপন্থী ফ্রিঞ্জদের মূলধারায় অধিষ্ঠিত হওয়ার এই টাইমফ্রেম কতদিন? নানা ফ্যাক্টর বিবেচনায় এটি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তবে আমার বিবেচনায় ১০-১৫ বছর একটি আদর্শ সময়।

অর্থাৎ আপনি গণতন্ত্রের মুখ বন্ধ করে দিলে এর স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে র‌্যাডিক্যাল/চরমপন্থী রাজনীতিরই উত্থান ঘটবে। সেটি আপনি ঠেকাতে পারবেন না। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দীর্ঘ স্বৈরশাসনে এটিই ঘটেছে। সেখানে মধ্যপন্থী দলগুলো স্বৈরশাসকদের দমন-পীড়নের মুখে হাওয়া মিলিয়ে গিয়েছে। কেবল মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো ধর্মীয় আদর্শ-ভিত্তিক সংগঠন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থেকেছে। এবং যার ফলে স্বৈরশাসন-উত্তর রাজনীতিতে ইসলামপন্থী দলগুলোই চালকের আসনে আসীন। যেমনটি আগে বলেছি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও মধ্যপন্থী দলগুলোর সীমাহীন ব্যর্থতা র‌্যাডিক্যাল দল বা গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে পারে, তবে সেটি ব্যতিক্রম, সাধারণ নিয়ম নয়। অন্যদিকে স্বৈরশাসনের ফল আউট র‌্যাডিক্যাল/চরমপন্থী রাজনীতি প্রতিষ্ঠা, সেটিই স্বাভাবিক পরিণতি, সামান্য কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও।

বাংলাদেশেও শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্র আরো কয়েক বছর টিকে থাকলে এমনটিই ঘটবে বাজী ধরতে পারেন। শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্রের পরিণতিতে প্রথাগত মধ্যপন্থী দল বিএনপি মামলা-হামলা-নিপীড়নে ইতোমধ্যেই প্রায় নিষ্ক্রিয়, নির্জীব একটি শক্তি হয়ে পড়েছে (এর কারণটি উপরে বলেছি যে এই ধরনের দমনপীড়নের মুখে সরকারি-নীতি/উন্নয়ন-সর্বস্ব রাজনৈতিক শক্তি ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ে)। যেহেতু সৃষ্ট এই শূন্যতা স্বাভাবিক নিয়মেই শূন্য থাকবে না, সে স্থানটি তারাই পূরণ করবে যারা এই পরাক্রমশালী স্বৈরশাসনের বেঁধে দেওয়া সীমারেখা ডিঙিয়ে রাজনীতির স্পেসটি রিক্লেইম করতে পারবে। সে কাজটির জন্য প্রয়োজন প্রচণ্ড অনুগত, ও রেজিমেন্টেড কর্মীবাহিনী। এর পাশাপাশি সমাজের মূলধারার সেন্টিমেন্ট যোগ হলে তা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলাম একটি সুপ্ত কিন্তু ডমিনেন্ট শক্তি। একে আগ্রাহ্য, উপেক্ষা করে এমনকি মধ্যপন্থী দলগুলোও রাজনীতি করতে পারেনি বা করতে চায় না। বাংলাদেশে এই স্বৈরতন্ত্রের যাঁতাকলে প্রাকৃতিক নিয়মেই ইসলামীক রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে উল্লিখিত তিনটি কারণে: ১) নিপীড়নের মুখে টিকে থাকা অনুগত রাজনৈতিক কর্মী, ২) নিপীড়নের মুখে ভেঙে না যাওয়া দলীয় শৃঙ্খলা (রেজিমেন্টেড ফোর্স), এবং ৩) সামাজিক লেজিটিমেসি (ইসলাম)।

বাংলাদেশ নিয়ে আমি মাঝে-মাঝে পাশ্চাত্যের কিছু পণ্ডিত ও নীতি-নির্ধারকের সাথে কথা বলি। প্রায়শই দেখেছি বাংলাদেশ নিয়ে তাদের মধ্যে সাধারণ কিছু উদ্বেগ রয়েছে এবং সেটি র‌্যাডিক্যাল/চরমপন্থী রাজনীতি নিয়ে। তাদের কাছে বর্তমান সরকার একটি জিনিস সফলভাবে বিক্রি করেছে: সেটি হলো ইসলাম ও চরমপন্থা। সরকার পশ্চিমাদের ভয় দেখায় যে, গণতন্ত্র দিলে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় আসবে এবং বিএনপি’র সাথে জামায়াত এবং অন্য ইসলামী দলগুলোর নির্বাচনী জোট দেখিয়ে তারা এ কাজটি করে।

আমার সামনে যতবারই সুযোগ এসেছে আমি তাদের উদ্বেগটি জানার চেষ্টা করেছি এবং সুযোগ পেলে তাদের বুঝাপড়ার ফাঁক নিয়ে আলোচনা করেছি। তাদেরকে বলতে চেষ্টা করেছি যে বাংলাদেশে ইসলাম একটা ডমিনেন্ট ডিসকোর্স হলেও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ইসলামী দলগুলো বরাবরই ছিলো ফ্রিঞ্জ বা প্রান্তিক শক্তি। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ইসলাম প্রশ্নে সংরক্ষণবাদী এটি সত্য হলেও ইসলামী দলগুলোকে ভোট দিয়ে তারা ক্ষমতায় আনে না। তাদেরকে জানাতে হয় যে বাংলাদেশের গত ৫০ বছরের ভোটের পরিসংখ্যানে ইসলামী দলগুলোর সম্মিলিত ভোটের পরিমাণ কখনো ১০ শতাংশ অতিক্রম করেনি। বহু পশ্চিমা বিশ্লেষক এ কথা শুনে আশ্চর্য হয়েছে যখন আমি বলেছি যে বাংলাদেশে বর্তমানে ইসলামী চরমপন্থার নামে যা বিক্রি হচ্ছে তার উর্বর ক্ষেত্র হচ্ছে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা। এটিই চরমপন্থী রাজনীতির সবচেয়ে বড় এনেবলারের কাজ করছে ও ভবিষ্যতেও করবে। তাদের সামনে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর উদাহরণ দিতে হয়েছে, আবার পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক, বাংলাদেশের সামরিক শাসকদের আমলকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হয়েছে। অনেকে উত্তরণ কী জানতে চায়। আমার উত্তর হচ্ছে: বাংলাদেশে চরমপন্থা মোকাবেলার অন্যতম প্রধান উপায় (একমাত্র উপায় নয়) হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে যাওয়া।

গণতন্ত্র নিজেই চরমপন্থার ফিল্টার। কিছু লোকের কুযুক্তির প্রতি সতর্ক থাকুন যারা মোদি, ট্রাম্পের মতো ব্যতিক্রমী উদাহরণগুলোকে দেখিয়ে বলে এটাই গণতন্ত্র – তাদের যুক্তি আংশিক সত্য, কারণ কিছু বাজে লোক গণতন্ত্রের ফাঁক গলে ঠিকই ক্ষমতায় চলে আসে, কিন্তু কুযুক্তি দেওয়া ওই দুষ্টু লোকগুলো যেটা আপনাকে কখনোই বলে না সেটি হলো: এই গণতন্ত্রই আবার মোদি ও ট্রাম্পের মতো ব্যক্তিদের ছুড়ে ফেলে দিয়ে তার কোর্স কারেকশন করে। আর এই কোর্স কারেকশনের সক্ষমতাই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শক্তি।

সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া 
গবেষক









কার্টসি — https://rb.gy/seohq8

No comments:

Post a Comment