মধ্যযুগের শেষভাগে এই উপমহাদেশে ইসলামের প্রভা উজ্বলতর হযে ওঠার মুখে ধর্মসমন্বয়ের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। এদের মধ্যে নানক, মহাবীর ও কবিরের নাম উল্লেখযোগ্য। কবিরের বাস ছিল কাশী বা বেনারসের সনাতন ধর্মের মর্মস্থলে। তিনি ‘মুসলিম ও ‘হিন্দু ঐক্যের অমর বাণী’ শোনালেন হিন্দুস্তানবাসীকে। মূলত তাঁর মর্মবাণীই প্রচার করে গেছেন, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। তিনি মহাত্মা। তিনি ছিলেন রামভক্ত। তাঁর এই রামরাজ্যভক্তির বিষয়ে কবিরের বিখ্যত দোঁহাটির পুনরুল্লেখ খুবই প্রাসঙ্গিক । কবিরের উক্তি ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম, পতিত পাবন সীতারাম, ঈশ্বর আল্লাহ তেরে নাম সবকো সুমতি দে ভগওয়ান’। তিনি হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রীতির বীজ বুনতে চেয়েছিলেন। কিন্ত সত্যিকারের কোনো সমাধান না পাওয়া গেলেও একধরনের সমাধান হয়েছিল কিংবদন্তী অনুযায়ী 'ফুলে'। কবিরের দেহরক্ষার পর স্থানীয় হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায় যখন কলহে ব্যস্ত তখন তাদেরই একজন একপর্যায়ে কবিরের চাদরে ঢাকা মরদেহ বিবেকবান কেউ চাদর তুলে দেখার চেষ্টা করলো। দেরি হয়ে গেছে! মরদেহের এতোক্ষণে কী হাল! না, সেখানে কবিরের কোনো দেহ নেই। অবাক কাণ্ড। ওখানে জড়ো হয়ে আছে কিছু ফুলের স্তুপ। কবির এসেছিলেন ধর্মীয় সম্প্রীতি জন্য । সম্ভবত যাদের মানসিকতা ছিল ‘রথ ভাবে আমি দেব, পথভাবে আমি, মূর্তিভাবে আমি দেব’ তাদের জন্য হেসেছিলেন সবার অন্তর্যামী। কবির ফুলেল সম্প্রীতির পথরেখা দেখিয়ে চলে গেলেন অনন্তের উদ্দেশে। পাশাপাশি রয়ে গেলো পাশাপাশি মসজিদ ও মন্দির। তাতে আজও হাত দিতে পারেনি কোনো হীন মানস। গান্ধীর রামরাজ্য দর্শনের সাথে কবীরের দর্শনের অদ্ভুত মিল ছিল। আর সে কারণেই তাকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। প্রাণবায়ূ বেরিয়ে যাবার আগে তার মুখ দিয়ে বেরিয়েছিল, ‘হা! রাম! হ্যাঁ!' তারা যাঁকে হত্যা করেছে নিয়তির নিশ্ঠুর পরিহাস তারাই আজ রামমন্দির বানাচ্ছে । আর আদতে সেই শক্তিই প্রয়াত গান্ধীকে ভগবতীর মৃতবৎস হিসেবে, একজন প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবীর ভাষায় তার চামড়া-ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে তাতে বিচালি পুরে ডামি বানিয়ে মাতা গাভিকে সামনে রেখে তার সাথে প্রতারণা করে তার দুধ দোহন করে নেওয়ার মতো কৃত্রিম সম্মান দেখাতে তাঁকে দেওয়ালে টানিয়ে দিয়েছে। তিনি হযেছেন জাতির পিতা। অমাদের দেশেও এধরনের দেবতা বানানোর ধুন্ধুমার প্রয়াস চলেছে তখনই চলে গেলেন ধ্রুব সত্যের কথক সঞ্জীব চৌধুরী।
উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে সর্বত্র সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে আছে। এ এক চরম নিঠুর বাস্তবতা। ফজলুক হক ছিলেন, হিন্দু মহাসভার সদস্য বিজ্ঞানী আচার্য্য প্রভুল্ল চন্দ্র রায়ের কথায়, ‘ফজলুল হক তাঁর কেশ থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত বাঙালি ও মুসলমান।’ এহেন মৌলভী ফজলুল হককেও নদীয়ায় নির্বাচনী প্রচারণায় গিয়ে বলতে হয়েছে ‘আমি রামদা-রহিমদা কাউকেই ভয় পাই না।’ বলা দরকার নির্বাচনী প্রচারের ময়দানে যাবার আগে ফজলুল হকের বিরোধীরা রামদা দিয়ে নারকেল গাছের ডাল কেটে তাঁর ওপর ফেলেছিল। সে যাই হোক রাম-রহিম সমস্যার ফয়সালা আজ অবধি ভারত ও বাংলাদেশের কথিত লোকায়ত ও সারস্বত সমাজ করতে পারেনি। তবে গুরু রাম-রহিম সিং এতোদিন যা প্রচার করে পাঁচকোটি ভক্ত জুটিয়েছেন তার পরিণাম দেখে ভাবতে পারা যায় না উপমহাদেশের জনসাধারণ এই ভয়ানক নামাবলির ভেতর থেকে সহজে কেনোদিন বেরিয়ে আসতে পারবে।
বেরিয়ে এসেছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী। আজ তাঁর প্রয়াণে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধায় লেখা এই শোকলিপি লিখতে গিয়ে এই পটভুমি এসে গেল এর একটা প্রেক্ষিত দিতে অগত্যা। হঠাৎ সঞ্জীব চৌধুরীর জীবন দীপ নেভার খবরে আমি হতচকিত, কিংকর্তব্যবিমুঢ়, স্তব্ধ। ভাষা প্রাণ পেতে চায় না। মনে হয়েছিল রচনা করি এলিজি শোকগীতি, ওড না হয় অগত্য তাঁর সমাধিলিপি - এপিটাফ। না হলো না, লিখি তার শোকলিপি।
কে কি জানেন আমি জানি না সে সম্পর্কে। তবে মাঝেমাঝেই তার কথার বলিষ্ঠ বিদ্যুতের ঝলকানিতে আমরা অবশ্যই চমৎকৃত হয়েছি। আধমরা আধাজাগর বিবেককে ঘা মেরে বাঁচাতে তাঁর নম্র , দীপ্র অথচ ধ্রুব সত্যের রুদ্র উচচ্চারণ মৃত্প্রায় বিবেকে প্রাণ ফিরেছে নতুন করে! তিনি একজন অমুসলিম। অথচ তিনি দেশের গোটা মানুষের মনের কথাকে ভাষা দেবার ‘বিশ্বকর্মার’ সামর্থ অর্জন করেছিলেন। তিনি নিজেকে তাঁর সম্প্রদায়ের সঙ্কীর্ণতায় আবদ্ধ রাখতে দেননি। তিনি নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বৃহত্তর সমাজে সাবলীল অবলীলায়। সেজন্যই তিনি আজ আমাদের সকলের।
এ দেশে যারা ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যবসা করেন টুপি দাড়ি পরে হজ্জ থেকে ফিরে খুরমার তোহফা দিয়ে ঠুনকো ইসলামী কায়দায় রাজনীতির ভোট ভিক্ষা করেন, যারা সারাটা দিনমান প্রয়াত হবার কথা বলেন আর রাজনৈতিক প্রয়োজন দেখা দিলেই তাদের ইসলামী জোশের জোয়ার বয়। শাহাদাৎ ,শহীদানের শোকে বিরিয়ানি খান কাঙালিদের নামে তিনি তাঁদের কেউ নন বলেই তাঁকে প্রায় অলক্ষ্যেই চলে যেতে হলো। আরেকজন প্রখ্যাত সাংবাদিক কিছুকাল আগে মৃত বিবেকের উদ্দেশে শোকপ্রস্তাব এনেছিলেন। বিবেক অমর হলেও সমাজের বিবেকহীনতায় ত্যক্তবিরক্ত আরেক সহযোগীর এ ভাবনা অবশ্যই তাৎপর্য়ের দাবিদার। দেহধারী সঞ্জীব দেহ মৃত্তিকায় হয়তো মিলিয়ে যাচ্ছে। তবে স্পর্ধিত বিবেক তিনি রেখে গেছেন অামাদের জন্য উত্তরাধিকার হিসেবে। সঞ্জীব চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন সকল বিবেকবান হৃদয়ের কন্দরে কন্দরে।
- আফতাব হোসেইন, সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক।