পর্যবেক্ষক
দেশ মাঝারি আয়ে পৌঁছাইয়া গিয়াছে। ইহা লইয়া বগল বাজানো হইয়াছে প্রচুর। বলা হইতেছে, দুশমনের মুখে ছাই দিয়া পদ্মা সেতু আকার নিতেছে চর্মচক্ষুর সামনে। সেজন্য কাহারও কাহারও চোখে আনন্দের অশ্রু ঝরার মেটিরিয়া মেডিকার কাব্যকথাও শুনিতেছি ।সবই তো অাপাত সত্যি। তাইলে আসল ঘটনাখান কি?
কোঁচার এই বাহারি পত্তনের ভেতরে ছুঁচোর কেত্তন বোধ হয় কাহারও কর্ণরোগ থাকিলে পশিবে না। সবজি, চাল-ডাল-তেল, লইয়া বাঁচা মরার লড়াইয়ের এক জীবন্ত ছবি আঁকা হইয়াছে এক পত্রিকার রিপোর্টে। তবে উহার আগে জানা দরকার দেশের হাল নাগাদ হালটি কি?দেশের মালপানি সম্পর্কিত সিনিয়র মন্ত্রী মহোদয় বলিয়াছেন, ডিসএগ্রিগেটসদের কী হইল বুঝি না।এগ্রিগেটসই আমার নয়নমণি। আয় বাড়িতেছে - একথা বিশ্বব্যাংকও তো স্বীকার করিয়াছে। অতএব।
ইহা আসিল কোথা হইতে? এই প্রশ্নটির মতো প্রশ্ন পাইয়াছিলাম আমাদের ছোটবেলার আদর্শ পাঠ্য হইতে ।‘নদী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ? মহাদেবের জটা হইতে।’ কিন্ত আয় লইয়া নানান প্রশ্নে সাধারণের মাথায় সত্যি সত্যিই জটাজুট বাঁধিযা গিয়াছে। নদী আসিয়াছে হিমালয়ের স্বর্গ হইতে। ইহা নয় বোঝা গেল। কিন্ত আয় আসে কেথা হইতে বাংলাদেশে? আয় আসে বাংলাদেশের আধা-শিক্ষিত , মুর্খ কচি, ডাগর ও প্রায় বৃদ্ধ নারীর ৮০ লাখ হাতের ঘাম পায়ে ফেলা হইতে। আয় আসে যাহারা বিদেশে কুকুর বনিয়াহার্ড কারেন্সি জোগাইতেছেন সরকারকে তাহাদের শ্রম হইতে। নাটকের সংলাপেও তাহাদের তিক্তমধুর ব্যঙ্গবচন নিশ্চয়ই আমরা অনেকেই শুনিয়াছি। কিন্তু দুর্বার উন্নয়নের আফিম মৌতাতে যাহারা বুঁদ হইয়া আছেন, তাহারা কিভাবে বুঝিবেন - কী যাতনা বিষে বুঝিবে কীসে আশি বিষে দংশেনি যারে।’ ঘৃণার কথা ইহাদের লইয়াই সরকারের বড়াই।
আরএমজি সেক্টরের জন্মই দিয়াছেন শহীদ জিয়া। শ্রীলঙ্কার পোশাক শিল্পে যখন লঙ্কাকাণ্ডে সোনার লঙ্কা নতুনা হনুমানের লেজে ধরানো আগুনে পড়িয়া ছারখার হয়। সুযোগ তৈরি হয় বাংলাদেশের। জিয়া ঐ সময় শিল্পকে সত্যিকার অর্থে বেসরকারি খাতে ফলদায়কভাবে কাজে লাগান। তিনি বেসরকারি খাতের অর্থনীতি তথা মুক্ত অর্থনীতির দরজা খুলিয়া দেন। কিন্তু আমাদের ফার্স্টক্লাস পাওয়া জাঁদরেল পাকিস্তানী বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের মেধাবী মন্ত্রী মুজিববাদীমোহে যখন দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে সরকার একটি বেসরকারি খাত প্রকল্পের জন্য চুক্তি সম্পাদন করে, তিনি সরকারকে হুঁশিয়ার করিয়া দিয়াছিলেন, "আমাদের রাষ্ট্রীয় কমান্ড অর্থনীতির কথা ভুলিবেন না। আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতির অন্যতম স্তম্ভ সমাজতন্ত্র।" এখন কোথায় গিয়াছে সমাজতন্ত্র। অার কোথায়ই বা গিয়াছে জোট নিরপেক্ষ নীতি। কাহারা মজমা জমাইতেছে ন্যাম ফ্ল্যাট আর কারগুলিতে? কোন আকাশের ঠিকানায় রওনা হইয়াছে আমাদের রাষ্ট্রীয় শিল্প উদ্যোগগুলি? সাবেক সমাজতন্ত্রীরা এমন কেমন গোগ্রাসে গিলিছেন পুঁজিবাদী রক্ত আর পুঁজ।
গার্মেন্টস শিল্পে মাদবরী লইয়া সরকার এই শিল্পের সমস্যার তুলনাহীন ধন্বন্তরী সমাধান দিয়েছেন। খুন হওয়া আমিনুলের প্রসঙ্গ ফেলিয়া উল্টা বলিলেন, সরকার নির্ধারিত বেতন পছন্দ না হলে গাঁওগেরামে ফেরত যাও। আরও বিপ্লবী ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হইল । বলাহইল, শিল্প শ্রমিক নেতাদের পকেটে কিছু গুঁজিয়া দাও। ল্যাঠা চুকে যাউক! ঠিকই সরকার দূরদর্শী প্রমাণিত হইলেন। শিল্পবিরোধ মিটিয়া গেল। আর মিশুরা মাটিতে মিশিয়া গেলেন। এই যাদু আর কারই বা আছে?
এখন আমরা আসি পত্রিকায় প্রকাশিত পোশাক শিল্পে শ্রমজীবী এক নারীর কাহিনীতে । তিনি সংবাদদাতাকে জানাইলেন, ওভারটাইম মিলাইয়া তিনি মাসে ১০ হাজার টাকা আয় করেন। তাঁকে পরিবারের পাঁচ সদস্যের ভরণ-পোষণ করিতে হয়। চাল থেকে শুরু করে জরুরি নিত্যপণ্য কেনা আর সাধ্যে কুলাইতে চাহিতেছে না। অাগে তিনি চাল কিনিতেন ৩০-৪০ টাকা কেজি দরে, এই বছরেরই গোড়ায়। মাত্র কয়েকমাস পার না হইতে উহা কিনিতে হইতেছে ৫০ টাকায় ।তাও মোটা চাল। রূপকল্পে চালের রূপকথার নটে গাছটি মুড়াইয়াছে। সবজির দর চড়া। কেনা যাইত ২০/৩০ টাকায়। এখন উহা আকাশপানে ছুটিয়াছে। নাগাল পাওয়া যায় না।
চালের দামের অজুহাত হিসাবে দোহাই পাড়া হইতেছে বন্যা, ঢলের । তবে মজুতদার, মিলারদের প্রশ্নে সরকারি কর্মকর্তারা মেকুড় বনিয়াছেন। একদিকে মন্ত্রী নির্দেশ দিতেছেন রশীদকে পাকড়াও।শরতচন্দ্রের পিশে মশায়ের মতো, বন্দুক লাও, সড়কি লাও। লাও তো বটে অানিবে কে। অথচ রশীদ মাত্র কিছু আগেও তাঁহার সথে বৈঠকেই ছিল কিন্ত উড়ো বার্তায় তার মিলের সব চাল উধাও হইয়া গেল। আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু রাহা খরচ ছাড়া কিছুই মিলিল না। অার সেই ফাঁকে যে কোটি কোটি টাকার কারবার হইয়া গেল, দেশের মানুষের পকেট কাটা হইল তাহা কেহ জানিল না। একটি সুসমাচার মিলিল। এক ঘড়েল দাদাবাবু কহিলেন, সরকারের চেয়ে কম মূল্যে চাল ভারত হইতেই তিনিই আনিয়া দিতে পারিতেন। শুধু তাদেরকে হুকুম করিলেই পারিতেন। তাদের নাকি ওখানে চেনা মহল রহিয়াছে। যাহা হউক মন্ত্রী আবার ব্যবসায়ীদের সহিত বৈঠক বসিলেন আর ব্যবসায়ীরাই জয়ী হইলেন। তাহারা যে কমদামের প্রস্তাব দিলেন সেই লাভের টাকাটা পাইকারের হাত অর্থাৎ তাহাদের গাঁটেই জমা হইল। আর অম জনতা উৎকৃষ্ট আতপ ট্রাক হইতে নামিতে দেখিযা সভয়ে মুখ ফিরাইল। ইহার মন্ত্রী নাম দিলেন চালবাজি। আর খবরের কাগজে বলা হইল হানিফ সাহেব নাকি কাম বানাইয়া লইয়াছেন। মোটা চালের দাম দুটাকা কমিয়াছে। দারুণ কম বলিতেই হয়।
গার্মেন্টস শ্রমিক রূপালি আক্তারের মতো বাঁধা আয়ের লাখো মানুষ আগুন লাগা নিত্যপণ্যের আগুনের মাঝে অস্তিত্ব রক্ষার সংগামে পুড়িতেই থাকিলেন ও থাকিবেন। কোনো দমকল বাহিনী ডাকে সাড়া দিবে না।
বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় মাসের যে জরুরি পণ্যগুলি এ বছরের জানুয়ারিতে ৬,২৫৫ টাকায় কেনা যাইত তাহা কিনিতে এখন লাগে ১১,০০০ টাকার বেশি। আর এই অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হইলে উহা হইবে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। জ্বালানি তেলের দাম ইহাতে না বাড়ুক জিনিসপত্রের উৎপাদন ব্যয় বাড়িবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিবে, জীবনমান নামিবে। আর পুষ্টিকর পণ্য কেনার সাধ্য মানুষের থাকিবে না যদি পরিবারকে পুষ্টি জোগানকে জাতীয় বিনিয়োগ ধরা হয়। ইহা না থাকিলে মানুষের উৎপাদন ক্ষমতা কমে। অর্থনীতির দুষ্টচক্র তেজি হয়। আজ দুর্বার গতির উন্নয়নের কথা বলা হইতেছে। কিন্তু কী মূল্যে। শ্বেত দরবেশের নেওয়া ঋণের টাকা আদায় করিয়া লইলে, ঐ মানুষটি যেমন দেউলিয়া হইয়া দেউলে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকিবে না, দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা তদনূরূপ না হইয়া পারিবে না।
সাইফুল ইসমাম নামে এক ব্যক্তি রাজধানীতে একটি প্রাইভেট ফার্মে কাজ করেন। তার সাকুল্য আয় মাসে ৪১ হাজার টাকা। ব্যয়খাতগুলি হইল বাড়িভাড়া ২০ হাজার, বাচ্চাদের টিতউশন ফি ৭০০০। থাকিল কি। তিনি জানান, আগে প্রতিমাসেই তাঁর কিছু না কিছু টাকা বাঁচিত, এখন আদৌ কিছু থাকে না।
ক্যাব কর্তা গোলাম রহমান বলিতেছেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম উপায়ে জিনিসপত্রের দাম বাড়াইতেছেন। কিন্তু সরকার তাহাদের ছুঁইতে পারিবেন না। খুবই প্রকাশ্য ব্যাপার।এখন জাতীয় সংসদও ব্যবসায়ীতে ভরিয়া গিয়াছে। তাহারা আইনপ্রণেতা হইবার কথা থাকিলেও উন্নয়নে তাহাদের কী থাকিতে পারে উহা লইয়াই কেবল ছোঁক ছোঁক করিতে ব্যতিব্যস্ত থাকেন আর কনস্টিটুয়েন্সি না থাকিলেও, বিনা ভোটে পাশ পাইলেও তাঁহারাই কিনা দাবি করিতেছেন বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ তাহাদের মতো সার্বভৗমদের হাতে থাকিতে হইবে। কিসের সার্বভৌমত্ব তাঁহাদের। তাঁহারা জনগণের সার্বভৌমত্বের এজেন্ট মাত্র।
সরকার চালের বাফার স্টক রক্ষার কাজটি অযথা বিলম্বিত করার কারণে খাদ্য বিপর্যয় ঘটিয়া গিয়াছে যাহা স্বীকার করিয়াছেন খাদ্যবিভাগের একজন সম্ভবত এক সৎ, দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। সরকার গাফিলতি করিতে পারেন, খাদ্য গুদাম সিসেম ফাঁক করিতে পারেন। পারেন চুরির টাকা পূরণ করিতে নিরাপরাধ জনগণের ঘাড়ে অবৈধ করভার চাপাইতে আর তারপর উন্নয়নের জয়গান গাহিতে। তাই উন্নয়ন বলিতে যদি দাম চড়াইবার উন্নয়নই হয় তাহা হইলে উহাতে জনগণের কাম কি। ক্যাব বলিয়াছে ইহার জন্য জনপ্রতিরোধ গড়িতে হইবে। ম্যাও ধরিবে কে?