শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে ব্যাপক অংশগ্রহণ
শফিকুল ইসলাম ঢাকা ও সরকার মাজহারুল মান্নান রংপুর
বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৮ ফেব্রুয়ারির রায়ের দিনকে কেন্দ্র করে তার সপ্তাহখানেক আগ থেকেই দেশজুড়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর অশঙ্কা বিরাজ করছিল। অবস্থা এমন ছিল যেন কারফিউ জারি হয়েছে। মানুষের ধারণা ছিল খালেদা জিয়াকে সাজা দিলে বড় ধরনের আন্দোলন-সংগ্রাম দানা বেঁধে উঠবে। একই ধারণা নিয়ে সরকারও হার্ডলাইনে ছিল। কিন্তু রায়ের আগের দিন রাতে বিএনপি চেয়ারপারসনের নির্দেশনায় রায়-পরবর্তী এক সপ্তাহ ধরে যে আন্দোলন চলছে তা ব্যতিক্রমী। খালেদা জিয়ার দণ্ডাদেশ সঠিক হয়নি উল্লেখ করে বিএনপি নেতাকর্মীরা এখন কৌশলে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন দুর্নীতি, অনিয়ম ও ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরছেন সাধারণ মানুষের কাছে। নেতাকর্মীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন, টেলিভিশন টকশো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভিন্ন আলাপচারিতায় এমন কথাই উঠে আসছে।
বেগম খালেদা জিয়ার রায়-পরবর্তী সময়ে এ পর্যন্ত বিক্ষোভ, মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘট, অনশন, রোজাপালনসহ বিভিন্ন ধরনের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলছে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে। কেন্দ্রীয় বিএনপি ইতোমধ্যে আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপ শেষে তৃতীয় ধাপ অতিক্রম করছে। এসব আন্দোলন-সংগ্রাম পুলিশ বেষ্টনীতে হলেও নেতারা খুব পরিপক্ব ও কৌশলী বক্তব্য দিচ্ছেন। তাদের বক্তব্যের মূল বিষয় হচ্ছে খালেদা জিয়ার দণ্ডাদেশ রাজনৈতিক। তারা এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামেও একই ধরনের মামলা থাকা সত্ত্বেও তা প্রত্যাহার প্রমাণ হিসেবে দেখাচ্ছেন।
বিএনপি নেতারা বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বলছেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এ রায় দিয়ে তাকে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে এক খণ্ড জমি ক্রয় ছাড়া বাকি এক টাকাও কোথাও খরচ করা হয়নি। সেই ২ কোটি টাকা এখন সুদে-আসলে ৬ কোটি হয়ে ট্রাস্টের নামেই প্রাইম ব্যাংকে জমা আছে। কিন্তু সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের করা ওই মামলায় খালেদা জিয়াকে দণ্ড দেয়া হলেও ওই সময়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা একই ধরনের সব মামলা বাতিল করা হয়েছে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা ছিল। তবে কোনো মামলায় তাকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি; বরং প্রধানমন্ত্রী পদের ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি সব মামলা প্রত্যাহার করিয়ে নেন। তার বিরুদ্ধে আলোচিত মামলাগুলো হচ্ছে- ৪৪৭ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় ক্ষতির ফ্রিগেট (যুদ্ধজাহাজ) ক্রয় দুর্নীতি মামলা, ১৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ক্ষতির মেঘনা ঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্র দুর্নীতি মামলা, ১৩ হাজার ৬৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতির নাইকো দুর্নীতি মামলা, ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্র দুর্নীতি মামলা এবং ২ কোটি ১০ লাখ ১ হাজার ৬৮৮ টাকা রাষ্ট্রীয় ক্ষতিসাধনের মাধ্যমে বেপজায় পরামর্শক নিয়োগের মামলা।
বিভিন্ন কর্মসূচি পালনকালে এসব মামলার বিষয়ে বিএনপি নেতারা তাদের বক্তব্য তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছে তুলে ধরছেন। এর বাইরে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন ব্যর্থতা ও কর্মকাণ্ড তুলে ধরে বিএনপি নেত্রীর প্রতি যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত দণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে তা জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন বিএনপি নেতারা।
তারা তৃণমূলের কর্মসূচিতে বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকার প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রতিরোধে ব্যর্থ, ব্যাংকিং খাতে লুটপাট, বিডিআর বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ, কুইক রেন্টাল দুর্নীতি করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট, রানা প্লাজা ধসে পোশাক খাতে নেমে আসা বিপর্যয় প্রতিরোধে ব্যর্থ, শেয়ারবাজার থেকে লাখো কোটি টাকা লুটপাট, শেয়ারবাজারে প্রায় ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীকে নিঃস্ব করে এক লাখ কোটি টাকা লুটপাট, রেলওয়ের কালোবিড়াল কেলেঙ্কারি, মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের নামে ডেসটিনি, এমএলএম ও ইউনিপে টু ইউ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে দেশের লাখ লাখ যুবককে নিঃস্ব করে দেয়া, সরকারি ব্যাংকগুলো শূন্য করে হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীসহ বিরোধী দল ও সাধারণ মানুষকে গুম করা হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, সরকার সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত রিপোর্ট দিতে ব্যর্থ, রাষ্ট্র ও সমাজ চিন্তক ফরহাদ মজহারকে নিয়ে নাটক, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা দিয়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণসহ মুক্তবুদ্ধি চর্চার পথ বন্ধ করা। অপহরণ এবং এ নিয়ে নানা ঘটনা গ্রামীণ ব্যাংককে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ, গার্মেন্ট শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও তাজরীন ফ্যাশন ট্র্যাজেডি সামাল দিতে ব্যর্থতা, দফায় দফায় জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, ১০ টাকা দরে চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে এখন ৫০ টাকায় মোটা চাল। ডাল, তেল লবণসহ অন্যান্য দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সীমান্ত হত্যা বন্ধে ব্যর্থতা, তিতাসসহ বাংলাদেশের নদী ও খালে বাঁধ দিয়ে ভারতকে করিডোর দেয়া, বিএসএফ ফেলানীকে হত্যা করে কাঁটাতারে লাশ ঝুলিয়ে রাখা এবং এ ক্ষেত্রে সরকারের নীরবতা রাজধানী ঢাকাকে দ্বিখণ্ডিত করা, মধ্যপ্রাচ্য থেকে জনশক্তি ফিরে আসার মাধ্যমে শ্রমবাজারে ধস রোধে ব্যর্থতা সড়ক, নৌ ও স্থল দুর্ঘটনা রোধে ব্যর্থতার কারণে দেশে রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
এ ছাড়া বিএনপি নেতাকর্মীদের বক্তব্যে স্থান পাচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের রায়-পরবর্তী সময়ে সারা দেশে সরকারি দল বিজিবি ও পুলিশের গণহত্যা, গণগ্রেফতার, গণনির্যাতন, মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আলেম-ওলামাদের ‘নির্বিচারে হত্যা’, নারী নির্যাতন, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতির কারণে বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়া, ব্লগে ইসলাম ও হজরত মুহাম্মদ সা:-কে অবমাননা এবং প্রতিবাদকারীদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যাসহ বিভিন্ন ইস্যু।
জানা গেছে, শুধু কর্মসূচিতেই নয়, বিএনপি সমর্থকেরা এ ধরনের অনেক বিষয় নিয়ে টেলিভিশন টক শো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, চায়ের দোকান, আড্ডা, সাধারণ আলাপচারিতায় এসব বিষয়ে আলোচনা করছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পবিষয়ক সম্পাদক এবং রংপুর মহানগর বিএনপির সভাপতি মোজাফফর হোসেন নয়া দিগন্তকে জানান, নেত্রীর নির্দেশে আমরা প্রশাসনের বাধা এবং গ্রেফতারের আতঙ্ক নিয়েই কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি পালন করছি। এসব কর্মসূচিতে আমরা বর্তমান সরকারের অনিয়ম দুর্নীতি ও ব্যর্থতা তুলে ধরছি। জনগণ আমাদের বক্তব্য সাদরে গ্রহণ করছে। বিশেষ করে যে আমলের মামলায় আমাদের নেত্রীকে দণ্ড দেয়া হয়েছে সেই একই সময়ের মামলা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে থাকলেও তা বাতিল করা হয়েছে। আমাদের কথা সাধারণ মানুষ ইতিবাচকভাবেই নিচ্ছেন। বেগম জিয়ার সাজা যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সে বিষয়ে তারা স্বচ্ছ ধারণা পাচ্ছে।
বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু জানান, কেন্দ্রঘোষিত কর্মসূচি আমরা শান্তিপূর্ণভাবে পালন করছি। যদিও নজিরবিহীন পুলিশি বাধার কারণে আমরা অনেক জায়গায় তা রাস্তায় করতে পারছি না। আমরা তথ্য ও যুক্তি দিয়ে বলার চেষ্টা করছি ম্যাডাম জিয়ার বিরুদ্ধে যে দণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ ছাড়া এ সরকার বিএনপি এবং খালেদা জিয়াকে ভয় পায় বলেই তাকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে আদালতকে ব্যবহার করে এই দণ্ডাদেশ দিয়েছে। কিন্তু আমরা আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, ব্যর্থতা দলিল প্রমাণের মাধ্যমে তুলে ধরছি। মানুষ এসব মনোযোগ দিয়ে শুনছে। তারা এ সরকারের কীর্তিকলাপ জানছে। এতে বিএনপির প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছে।
নেত্রকোনা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা: আনোয়ারুল হক বলেন, বাংলাদেশের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে সরকার অন্যায়ভাবে সাজা দিয়েছে। বিএনপিকে দুর্বল করার হীন চক্রান্তে মেতেছে সরকার। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন পূরণতো হবেই না; বরং এর মাধ্যমে বিএনপির জনপ্রিয়তা আরো বেড়েছে। কারণ বিএনপি সবসময় গণতন্ত্র ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন-সংগ্রামে বিশ্বাস করে।
মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ইয়াজ্জেম হোসেন রোমান বলেন, খালেদা জিয়াকে জেল দিয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ভাঙার ষড়যন্ত্র করছে, জনগণের কাছে তা স্পষ্ট। কিন্তু তা সফল হয়নি, হবে না। এ জন্য তারা জনগণ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। আগামীতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই মানুষের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবে। এ দেশের মানুষ আবারো সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বেগম জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী বানাবে। কেননা বন্দী খালেদা জিয়া আরো বেশি শক্তিশালী। আওয়ামী লীগ যত চেষ্টাই করুক বিএনপিকে ভাঙতে পারবে না ইনশাআল্লাহ।
Courtesy: Daly nayadiganta Feb 18, 2019