- শেয়ারবাজারে বিমান কোম্পানি
- সাধারণ বিনিয়োগকারী ও ব্যাংকের ১ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা আটকে আছে
- সম্পদ বিক্রি করে টাকা আদায়ের পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের
মনির হোসেন
চরম দুরবস্থায় পড়েছে শেয়ারবাজারে আসা দুই বিমান কোম্পানি। এর মধ্যে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে ৩শ’ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন জিএমজি এয়ারলাইন্স।
এছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় ২৩০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। অন্যদিকে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। প্রতিষ্ঠানটি এখন নামেই টিকে আছে। ১০ টাকার শেয়ার ৪ টাকায় নেমে এলেও বিনিয়োগকারীরা প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার কিনছে না। আর এই দুই কোম্পানিতে সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং ব্যাংকের ১ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা আটকে আছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি ঠেকাতে কোম্পানির সম্পদ বিক্রি করে টাকা আদায় করতে হবে। এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) ব্যবস্থা নিতে হবে।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, কোম্পানির অবস্থা ভালো নয়। আইনি পদক্ষেপ নেয়া উচিত। তিনি বলেন, সিকিউরিটিজ আইনে অধিগ্রহণের সুযোগ থাকলে কোম্পানির সম্পদ বিক্রি করে বিএসইসিকে বিনিয়োগকারীদের টাকা পরিশোধ করতে হবে। তার মতে, বর্তমান আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে কোম্পানি আইনে তার দেউলিয়াত্ব প্রমাণ হলে বিনিয়োগকারীরা আদালতে যেতে পারে।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে জিএমজি। এতে ১০ টাকার প্রতিটি শেয়ার ৪০ টাকা প্রিমিয়ামসহ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৫০ টাকা নেয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় বাজার থেকে ৩০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর ১৬৬ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের এ প্রতিষ্ঠানটি আইপিওর (প্রাথমিক শেয়ার) মাধ্যমে প্রিমিয়ামসহ আরও ৩০০ কোটি টাকা সংগ্রহের আবেদন করে।
কিন্তু কোম্পানির আর্থিক রিপোর্টে জালিয়াতি ধরা পড়ায় ২০১২ সালে আইপিও আবেদনটি বাতিল করে বিএসইসি। নিয়ম অনুসারে আইপিও আবেদন বাতিল করার পর প্লেসমেন্টের টাকা বিনিয়োগকারীদের ফেরত দিতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে টাকা আটকে রেখেছে জিএমজি।
কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জিএমজি এয়ারলাইন্স। পরের বছর থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী পরিবহন শুরু করে। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত টানা ৭ বছর প্রতিষ্ঠানটি লোকসানি ছিল। এ সময়ে মোট লোকসানের পরিমাণ ৪২ কোটি টাকা।
২০০৬ এবং ২০০৭ সালে ১ কোটি টাকা মুনাফা দেখায়। কিন্তু ২০১০ সালে অলৌকিকভাবে বেড়ে যায় প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা। ওই বছরের প্রথম ৯ মাসে প্রতিষ্ঠানটি ৭৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা মুনাফা দেখায়। তিন বছর পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। শেয়ারবাজারে কারসাজি নিয়ে গঠিত খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ২০০৮ সালের স্থিতিপত্রে হঠাৎ করে ৩৩ কোটি টাকার পুনর্মূল্যায়ন উদ্বৃত্ত দেখানো হয়।
এর ব্যাখ্যায় জিএমজি বলেছে, তাদের দুটি বিমানের সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে। তবে বিমান দুটি বেশ পুরনো। স্বাভাবিক নিয়মে পুরনো বিমানের সম্পদের দাম আরও কমার কথা। কিন্তু আলাদিনের জাদুর চেরাগের মতো দাম বাড়িয়ে দেখিয়েছে জিএমজি। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে জিএমজির ২৩০ কোটি খেলাপি ঋণ রয়েছে। এই টাকা আদায়ে ২০১৬ সালে সালমান এফ রহমানের বাড়ির নিলাম ডাকা হয়েছিল। কিন্তু অদৃশ্য ইশারায় শেষ পর্যন্ত তা আটকে যায়।
অন্যদিকে ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ইউনাইটেড এয়ার। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধন ৮২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ৭০ দশমিক ৪৩ শতাংশ বা ৫৮৪ কোটি টাকা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ১৩ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং উদ্যোক্তাদের ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ। কিন্তু বিএসইসির নিয়ম অনুসারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তাদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এছাড়া এককভাবে প্রত্যেক পরিচালকের ২ শতাংশ শেয়ার ধারণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
গত ৬ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। পুরনো উড়োজাহাজ ব্যবহারের কারণে জ্বালানি খরচ বেশি। বিলম্বিত কর আমলে নেয়ার পর থেকেই মুনাফা কমে গেছে প্রতিষ্ঠানটির। এর আগে শেয়ারবাজার থেকে রাইট শেয়ার ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করে উড়োজাহাজ কেনা হলেও প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। বরং বেশি দামে উড়োজাহাজ কেনার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। এরপর আর্থিক সংকট কাটাতে নতুন করে রাইট শেয়ার ছাড়তে চেয়েছিল তারা।
কিন্তু উদ্যোক্তাদের ৩০ শতাংশ শেয়ার না থাকায় অনুমতি দেয়নি বিএসইসি। এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কাছেও ইউনাইটেড এয়ারের শত কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। বর্তমানে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ার টাকায় ৪ টাকায়ও কেউ কিনছে না। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে।
- যুগান্তর/২০-৩-১৮