Search

Sunday, April 15, 2018

মুক্তিযোদ্ধা কোটায় জাল সনদে ৪৪৩ পুলিশ!

এ পর্যন্ত করা সব প্রত্যয়নের পুনঃতদন্ত চেয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় * নেপথ্যে শক্তিশালী সিন্ডিকেট


উবায়দুল্লাহ বাদল

জাল মুক্তিযোদ্ধা সনদে পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল পদে চাকরি করছেন ৪৪৩ জন। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট একাধিক ভুয়া স্মারকের মাধ্যমে এসব ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে প্রত্যয়ন করেছে বলে অভিযোগ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বিষয়টি জানার পর স্মারক জালিয়াতি ও পুলিশ নিয়োগ সংক্রান্ত এ পর্যন্ত করা সব প্রত্যয়নের পুনঃতদন্ত চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি তদন্ত করতে মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখাকে (ডিবি) দায়িত্ব দিয়েছে জননিরাপত্তা বিভাগ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

জাল মুক্তিযোদ্ধা সনদে পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি পাওয়া প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সোমবার যুগান্তরকে বলেন, একটি চক্র জালিয়াতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের প্রত্যয়ন করছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মামলা ও গ্রেফতার হয়েছেন। জালিয়াত চক্রকে ধরতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তদন্ত করার অনুরোধ জানিয়ে আমরা চিঠি দিয়েছি। আশা করি তদন্তে সব বেরিয়ে আসবে।

জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে পুলিশে প্রায় ৫০ হাজার কনস্টেবল নিয়োগ করা হয়েছে। যাদের অনেকের বিরুদ্ধে ভুয়া সনদ ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় অভিযোগ করেছে, ৪৪৩ জন ভুয়া সনদ ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েছেন। 

এছাড়া জাল মুক্তিযোদ্ধা সনদে পুলিশে চাকরি নেয়ার অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় গত বছরের আগস্টে পুলিশ কনস্টেবল জাহাঙ্গীর আলম ও নাসিমা খাতুনকে কারাগারে পাঠায় চুয়াডাঙ্গার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। এর আগে একই অপরাধে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের দাঙ্গা বিভাগের কনস্টেবল শাহিদুজ্জামান ও কবিরুল ইসলামকে গ্রেফতার করে জয়পুরহাট থানা পুলিশ। এ ধরনের ঘটনায় আরও অনেকে চাকরি হারিয়ে কারাগারের ঘানি টানছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।

নিয়ামনুসারে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পেতে হলে আগে সনদ যাচাই করে নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগের ক্ষেত্রে সেই শর্ত শিথিল করা হয়। নিয়োগের পর সনদ ভুয়া প্রমাণিত হলে চাকরিচ্যুত এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের শর্তে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। চাকরি পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্টদের নথি পাঠানো হয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। যাচাই-বাছাই শেষে মুক্তিযোদ্ধার সনদ প্রত্যয়ন করে চিঠি পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে প্রত্যয়ন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো স্মারক জাল করেই জালিয়াত চক্র ওই ৪৪৩ জন কনস্টেবলকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের ১১ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগে ইস্যুকৃত প্রত্যয়নপত্র জালিয়াতির প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। চিঠিতে বলা হয়, ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর ১২৮৪নং স্মারকে ১৬০ জন মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যয়নের বিষয়ে পত্র জারি করা হয়। এতে ১-৪৭ পর্যন্ত ৪৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রত্যয়ন করা হয়। ৪৮-৮৪ পর্যন্ত ৩৭ জনকে পরামর্শসহ প্রত্যয়ন করা হয়। ৮৫-৮৯ পর্যন্ত ৫ জনকে পরামর্শসহ সাময়িক প্রত্যয়ন করা হয়। ৯০-১১০ পর্যন্ত ২১ জনকে জামুকার শর্তে সাময়িক প্রত্যয়ন করা হয়। ১১০-১৫০ পর্যন্ত ৪০ জনকে কাগজপত্রাদির অভাবে প্রত্যয়ন করা হয়নি। আর ১৫০-১৬০ পর্যন্ত ১০ জনকে মিথ্যা তথ্য ও ভুয়া প্রমাণপত্র দাখিল করা তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের পর তা অবহিত করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়। কিন্তু জালিয়াত চক্র এ প্রত্যয়নপত্রটি জাল করে।

জালিয়াতির বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠিতে বলা হয়, পরিবর্তনকৃত জালপত্রটিতে ১ থেকে ৪৭ জন প্রত্যয়নের স্থলে ১ থেকে ৫৬ জনকে প্রত্যয়ন দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ ৯ জনকে বেশি দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে ৭ জন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, যাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছিল। একজনের সাময়িক সনদ ছাড়া কিছু নেই। অন্য একজন যার জন্ম প্রমাণপত্র নেই।

উভয় মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত পত্রের ফটোকপি সংযুক্ত করে গরমিল পাওয়ার বিষয়টিও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া বিষয়টি তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থার পাশাপাশি পুলিশ নিয়োগ সংক্রান্ত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এ পর্যন্ত ইস্যুকৃত সব প্রত্যয়নপত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার মাধ্যমে পুনঃতদন্ত চাওয়া হয় চিঠিতে।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ওই চিঠি দেয়ার দেড় মাস পরও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ বিষয়টি উল্লেখ করে ২৮ জানুয়ারি একই বিষয়ে আবারও চিঠি দেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, যাতে আগের ১০ জনের বিষয় ছাড়া আরও চারটি স্মারকের মাধ্যমে ৪৩৩ জনের মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির বিষয় উল্লেখ করা হয়। ২৮ জানুয়ারির এই চিঠিতে বলা হয়, জননিরাপত্তা বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত প্রত্যয়নের সঠিকতা যাচাইয়ে ৯টি পত্র প্রেরণ করা হয়। এসব পত্র যাচাইকালে স্মারক নং যথাক্রমে ১৩৩০, ১৩৩১, ১৩৯১ এবং ১৪০৪ জাল ও ভুয়া মর্মে প্রতীয়মান হয়। ১৩৩০নং স্মারকে ১৯৩ জন, ১৩৩১ স্মারকে ১০০ জন, ১৩৯১নং স্মারকে ৯৫ জন এবং ১৪০৪নং স্মারকে ৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধার (মোট ৪৩৩ জন) প্রত্যয়নের সিদ্ধান্ত রয়েছে, যাদের প্রত্যয়ন করা হয়নি। এসব প্রত্যয়নপ্রত্র জাল বলে প্রমাণিত হয়েছে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া উল্লিখিত ৪টি স্মারকের জালিয়াতির বিষয়টি তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্যও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়।

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব অপরূপ চৌধুরী সোমবার নিজ দফতরে যুগান্তরকে বলেন, সম্প্রতি এ জাতীয় বেশ কিছু জালিয়াতির ঘটনা আমাদের নজরে এসেছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের দেয়া সনদ যাচাই-বাছাই শেষে বেশ কিছু ব্যক্তির সনদ ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। আমরা প্রত্যয়ন না করলেও একটি চক্র জালিয়াতির মাধ্যমে তাদের প্রত্যয়ন করেছে বলে জানা গেছে। এমনকি প্রত্যয়ন সংক্রান্ত পত্রের স্মারক নম্বরটিও জাল; যা আমাদের স্মারক নম্বরের সঙ্গে মিল নেই। বিষয়টি তদন্ত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে তারা আমাদের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট নথিপত্রও নিয়ে গেছে।

এ চিঠি পাওয়ার পর তোলপাড় শুরু হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরবের বিষয়। আর এই মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে যারা জালিয়াতি করেছে তাদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না। ইতিমধ্যে বিষয়টি তদন্ত করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’

জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পুলিশ ও এনটিএমসি) নুরুল ইসলাম সোমবার নিজ দফতরে এ বিষয়ে বলেন, ‘এ ধরনের একটি বিষয় তদন্তের জন্য ডিবি পুলিশের কাছে পাঠানো হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর জানা যাবে কারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’

তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তার দাবি, বিষয়টির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং জননিরাপত্তা বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। পাশাপাশি এর সঙ্গে পুলিশ সদর দফতরের একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত থাকতে পারে। যারা সিন্ডিকেট করে বিপুল অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এতবড় ঘটনা একজনের পক্ষে ঘটানো সম্ভব নয়। এ কারণে চিঠি পাওয়ার পরও মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিষয়টির তদন্ত হচ্ছে না। পুরো বিষয়টি ডিবি পুলিশকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।


  • যুগান্তর/ এপ্রিল ১৪,২০১৮ 

ঢাবিতে হলে হলে আতঙ্ক


নানা চাপ। হুমকি। আতঙ্কে কোটা সংস্কার আন্দোলনে জড়িত সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী এরই মধ্যে হল ছেড়েছেন। এই যখন অবস্থা তখন কবি সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রী নির্যাতনে অভিযুক্ত হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইফফাত জাহান ইশাকে স্বপদে ফিরিয়েছে ছাত্রলীগ। গতকাল সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মো. সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

এরপর দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান ছাত্রলীগ নেত্রী ইশাকে ছাত্রত্ব ফিরে দেয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে একাধিকবার ভিসির মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও প্রতিবারই তার প্রটোকল অফিসার ধরে জানিয়েছেন ‘ভিসি স্যার ব্যস্ত আছেন।’ এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে ছাত্রলীগ নেত্রী ইশা হলে ফিরছেন এমন আতঙ্কে রাতেই হল ছেড়েছেন প্রায় দেড় ডজন সাধারণ ছাত্রী। গতকালও সকাল থেকে বেশ কিছু ছাত্রী হল ছেড়েছেন বলে জানা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলেও কোটা সংস্কার আন্দোলনে যাওয়া শিক্ষার্থীদের হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

বিভিন্ন ধরনের হুমকি, হয়রানি ও ব্লেমগেইম চলছে আন্দোলনকারীদের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের বিরুদ্ধেও। অন্যদিকে আন্দোলনকারী কোনো শিক্ষার্থী বা কেন্দ্রীয় কমিটির কাউকে কোনো ধরনের হয়রানি হলে দাঁতভাঙা জবাব দেয়ার হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। হয়রানি না করতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরর সঙ্গে। 


ইশার ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে ওই টেলিভিশন চ্যানেলকে ভিসি বলেন, ‘শুধু ছাত্রত্ব ফিরে পাবে না, বরং সম্মানিত হবে এবং সেটি উচিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও সেটি হবে। কারণ আমরা তো কোনো শিক্ষার্থীর প্রতি অবিচার করতে পারি না। ওই মেয়েটির কাছ থেকে আমরা যেটি শুনেছি যে ওই মেয়ে একটি দরজায় পা দিয়ে আঘাত হানার কারণে তার পা কেটে গেছে।’ এদিকে ইশাকে ছাত্রত্ব ফিরে দেয়ার বিষয়ে ভিসির দেয়া বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, ‘এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত আমি জানি না। ছাত্রত্ব ফিরে দেয়ার বিষয়ে কেউ আমার সঙ্গে আলোচনাও করেনি। আমি জানিও না। তবে ভিসি স্যার যদি বলে থাকেন, তাহলে তো তিনি তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে কথা বলবেন।’ 

এদিকে ইশার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারে ছাত্রলীগের দেয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, সংগঠটির চার সদস্যের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন ইশা। তাই তাকে স্বপদে বহাল করা হলো। এর আগে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করার পর থেকেই ছাত্রলীগের একটি অংশ ইশাকে নির্দোষ প্রমাণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দেন। যাদের অনেকে ওইদিনের সংঘটিত ঘটনার পর ইশার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। ইশার বাসায় গিয়ে তাকে ফুলের মালা পরিয়েছেন সাবেক ও বর্তমান ছাত্রলীগের নেতা-নেত্রীরা। অন্যদিকে ইশা হলে ফিরছেন এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে রাতেই হল ছেড়েছেন সুফিয়া কামাল হলের প্রায় দেড় ডজন ছাত্রী। আতঙ্ক বিরাজ করছে হলটির সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। যারা কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। 

হলটির একাধিক ছাত্রী জানান, ইশা হলটির নেতৃত্বে আসার পর থেকে সাধারণ ছাত্রীদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন করে থাকেন। বিভিন্ন সময় মারধরও করা হয়েছে অনেককে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে যারা সক্রিয় তাদের নানা ধরনের হুমকি দিয়েছেন তিনি। কিন্তু এত দিন কেউ ভয়ে মুখ খুলেননি। সর্বশেষ গত সোমবারের ঘটনার পর অনেকে ইশার নানা ধরনের অনিয়মের বিষয়ে মুখ খুলেছেন, তাই এখন ইশা হলে ফিরলে আগের চেয়েও বেশি নির্যাতন শুরু হবে সাধারণ ছাত্রীদের ওপর। তাই আমরা হলে এখন অনিরাপদ বোধ করছি। 

গতকাল সন্ধ্যায় হল ছাড়ার সময় এক ছাত্রী বলেন, ‘হলের সভাপতি হলে আসছেন শুনে আমরা হল ছাড়ছি। তিনি আমাদের মারধর করেন। সেদিন এক ছাত্রীর পা কেটে দেয়ায় আমরা তার প্রতিবাদ করি। তিনি হলে আসলে আমরা আবারো নির্যাতিত হবো। তাই চলে যাচ্ছি।’ 

অন্য এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘তিনি আমাকে মারধর করেছেন। গেস্টরুমে নির্যাতন করতেন। তিনি হলে আসলে আবারো এই কাজ করবেন বলে আমি হল ছাড়ছি।’ তবে হলটির প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সাবিতা রেজওয়ানা রহমান বলেন, ‘সে বহিষ্কৃত। তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত হলে উঠতে পারবে না। আর যেসব মেয়েরা হল ছাড়ছে তাদের বিষয়ে আমি অবগত নই।’

এদিকে গত বৃহস্পতিবার রাতে হলটির প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাবিতা রেজওয়ানা রহমান হলের ছাত্রীদের নিয়ে এক সাধারণ সভার আয়োজন করেন। যেখানে শিক্ষার্থীরা ইশার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করে। 

সাধারণ সভায় হলটির এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ম্যাম আমরা সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক হল চাই। সেখানে কেন সিট বাণিজ্য থাকবে? কেন পলিটিক্যাল ফ্লোর এবং নন পলিটিক্যাল ফ্লোর থাকবে। আমরা এখানে সিটের আশায় উঠেছি, রাজনীতি করার জন্য উঠি নাই। একজন পদত্যাগ করেছে। আরো একজন হলে আছে। তারা আমাদের সমস্যা করবে। আমাদের দায়ভার কে নেবে।’ 

আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা রাজনীতি মুক্ত হল চাই। মেয়েরা যেটার জন্য এত ভয় পায় সেটা হলো নোংরা সিট পলিটিক্স। যার হুমকি দিয়ে মেয়েদের নির্যাতন করা হয়। পলিটিক্যাল মেয়েদের দায়িত্বও প্রশাসন নিক। অন্য কেউ অভিভাবক নয়।’ 

এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় থাকা অন্যান্য হলের ছাত্রছাত্রীদেরও নানা ধরনের হুমকি দিচ্ছে ছাত্রলীগ- এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে দাবি করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে। ফেসবুকে ছড়ানো হচ্ছে বিভিন্ন ‘অপপ্রচার’। ইতিমধ্যে হল ছেড়েছে অনেকে। 

গতকাল দুপুরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অপপ্রচার চালানোর প্রতিবাদ ও হয়রানি অভিযোগ করে আন্দোলনকারীদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফেসবুক গ্রুপ থেকে লাইভে বক্তব্য রাখেন।এসময় রাশেদ তার বক্তব্যে নিজের ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা তুলে ধরেন। 

তিনি বলেন, ভাইয়েরা আমাকে এখন বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ও ভিসি স্যারের বাসায় হামলা করেছি বলে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। আমি বলতে চাই, আমি এসবের কিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত নই। যদি সম্পৃক্ত থাকতাম তাহলে গত দুই মাস যাবৎ গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা আমার পরিবার ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব খোঁজাখুঁজি করেও কিছু পায়নি কেন? আপনারা কী গোয়েন্দা সংস্থা থেকেও বেশি এক্সপার্ট ও আইটি বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছেন? এসময় রাশেদ বলেন, যারা এখন অপপ্রচার চালাচ্ছেন, তারা চাচ্ছেন জননেত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তকে বানচাল করতে। আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে সত্যের পক্ষে ছিলাম। এখনো আছি। আর আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটি ও আন্দোলনকারীদের ওপর যদি কোনো ধরনের হয়রানি না হয় সে বিষয়ে সবাই সজাগ থাকবেন। 

রাশেদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হাসান ওই গ্রুপে লেখেন, ‘আমরা কেন্দ্রীয় কমিটি এক আছি। আমাদের ওপর ভরসা রাখুন। যে কোনো অন্যায়ের দাঁত ভাঙা জবাব দেয়া হবে।’ আর যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নুর বলেন, ‘নতুন নাটক তৈরি করে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বোকা বানাতে চেষ্টা করবেন না। শিক্ষার্থীরা আবার রাজপথে নামলে কিন্তু পালাবার পথ পাবেন না।’ 

এদিকে আন্দোলকারীদের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তারা ভিসির বাসভবনে হামলার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি চেয়েছেন। দাবি করেছেন হলে যেন আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা নিরাপদে থাকতে পারে। কাউকে যেন হয়রানি না করা হয়। ভিসি তখন তাদের কোনো সংগঠন কর্তৃক কাউকে হয়রানি যেন না করা হয় সে বিষয়ে প্রশাসনের সজাগ থাকার বিষয়ে আশ্বস্ত করেন। এছাড়াও আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকেও অবহিত করেছেন যেন কাউকে সারা দেশের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের হয়রানি না করা হয়। মন্ত্রীও তাদের আশ্বস্ত করেছেন বলে জানিয়েছেন যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হাসান। 

জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সারা দেশে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের যেন কোনো ধরনের হয়রানি না করা হয়, সে বিষয়ে আমরা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও আমাদের ভিসি স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে কাউকে কোনো ধরনের হয়রানি করা হবে না।’ 

তিনি বলেন, ‘এরপরও যদি কাউকে হয়রানি করা হয়, তাহলে আমরা কেন্দ্রীয় কমিটি ব্যবস্থা নিবো।’ অন্যদিক ছাত্রলীগ নেত্রীর ইশার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের বিষয়ে ফারুক হাসান বলেন, ‘এ বিষয়টি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। এই ইস্যুতে এখনো আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো বক্তব্য নেই। যদি কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত থাকে তাহলে গণমাধ্যমকে জানানো হবে।’

সে রাতে ঢাবির ছাত্রী হলে যা ঘটেছে  
"রাত সাড়ে ৯টায় হলে আসি। এ সময় অনেকে সর্তক করছিল, তোমাদের ওপর হামলা হতে পারে। যারা আন্দোলনে গেছো তাদের ওপর গোপন হামলা হতে পারে। সবাই সাবধানে থেকো। পরে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করে দরজা আটকে শুয়ে পড়েছি। হঠাৎ করে শুনি চিৎকার। অনেক জোরে চিৎকার। একটা আপু দরজা ধাক্কা দিয়ে বললো হলের নিচে নামো। কাউকে মারছে মনে হয়। আমরা দৌড়ে নিচে নামলাম। পরে কয়েকজন ইশার রুমের সামনে গেলাম। সেখান থেকেই চিৎকার এসেছিল। রুমের সামনে গিয়ে দেখি কয়েকটা পলিটিক্যাল মেয়ে দাঁড়ানো। তারা নিজেদের মধ্যে ফান করছে। আমরা তাদের জিজ্ঞেস করলাম এত জোরে চিৎকার করলো কে? তখন তারা বললো গায়ের ওপর একটা পোকা পড়েছিল তাই চিৎকার দিচ্ছে। এ কথা শুনে আমরা চলে আসছিলাম। পরে বড় আপুরা বলতেছে, পোকার কারণে এত জোরে চিৎকার করবে কেন? এসময় আমরা ইশার রুম থেকে সিঁড়ি পর্যন্ত রক্তের ছোপ ছোপ দাগ দেখি।
কয়েকজন বললো বেসিনেও দাগ দেখেছে তারা। এরপর মেয়েরা একত্রিত হয়ে ইশার রুমের সামনে যায় এবং দরজা খোলার জন্য বলে। একপর্যায়ে ইশা দরজা খুলে। একসঙ্গে এত মেয়েকে দেখে সে ভয় পেয়ে যায়। কান্না করে দেয়। তাকে মারধর যাতে না করে সেজন্য অনুরোধ করতে থাকে। মেয়েরা জানতে পারে ৫-৬ জনকে মারধর করেছে ইশা। এর মধ্যে দুজনের পা কেটে যায়। ছাত্রীরা ইশাকে নিচে নামিয়ে আনতে চাইলে সে দৌঁড় দেয়। একপর্যায় উত্তেজিত হয়ে কিছু মেয়ে তাকে নিচে নামিয়ে আনে। খবর পেয়ে প্রক্টর ও হল কর্তৃপক্ষ আসে। তাদের সামনে ইশা নিজের দোষ স্বীকার করে। সবার কাছে ক্ষমা চায়। কিন্তু মেয়েরা তাকে গ্রেপ্তার ও বহিষ্কারের দাবি জানায়। জুতোর মালা পরিয়ে দেয়। টেলিভিশনে দেখি তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে তারপর রুমে চলে আসি।"

গত ১০ই এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলে সংঘটিত ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী। বর্ণনারত ওই ছাত্রী বলেন, হলের মেয়েরা ইশার ওপর আগে থেকেই ক্ষুব্ধ ছিল। কারণ, ইশা মেয়েদের নানাভাবে কষ্ট দিতো। তাদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করতো। আগে থেকেই মেয়েরা তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল। কিছু হলেই মেয়েদের মারধর করতো। হুমকি দিতো।  

ওই রাতে হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইফফাত জাহান ইশা কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেয়ায় বেশ কয়েকজন ছাত্রীকে মারধর করে। এদের মধ্যে একজন ছাত্রীর পায়ের গোড়ালির ওপরের অংশ কেটে যায়। খবরটি জানাজানি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সুফিয়া কামাল হলের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। মেয়েরা হলের ভেতরে অবস্থান করে।

ছাত্রীরা দাবি জানায়, ইশাকে হল, ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করতে হবে। তাৎক্ষণিকভাবে বহিষ্কারও করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান ও প্রক্টর অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানী ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে ইশাকে বহিষ্কার করেন। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও এই বহিষ্কারাদেশকে স্বাগত জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা পদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা দেন। এরপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই আবার ইশার বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহারের জন্য আন্দোলনে নামেন। 

গতকাল রাজু ভাস্কর্যে মানববন্ধন করেন। আগের দিন ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা বিবৃতিতে দেন এবং রাতে ইশাকে ফুলের মালা পরিয়ে দেন। ছাত্রলীগ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তাদের প্রতিবেদনে ইশা সম্পূর্ণভাবে নির্দোষ প্রমাণিত হয়। যার ওপর ভিত্তি করে ইশার বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করে ছাত্রলীগ। এদিকে ওই দিন রাতে ইশার রুমের ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি অডিও ছড়িয়ে পড়ে। অডিওতে আন্দোলনে যাওয়া মেয়েদের সঙ্গে ইশার কথোপকথন শোনা যায়। সেখানে ইশা মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলেন,  

ইশার কথোপকথনঃ 
“এত কুরকুরানি না। যারা যারা প্রোগ্রামে গেছে কাল এবং আজ তারা ছাড়া সবাই চলে যা। অথবা পেছন থেকে সামনে আয়। এক মেয়েকে ইঙ্গিত করে ইশা বলেন, এই তুই সামনে আয়। মোবাইল দে। আমি কি বলছি। নাটক... (প্রকাশের অযোগ্য)। হুম। ওরা কি খুব সংস্কার করে দিছে। হলের মধ্যে তোমার ভাইয়েরা এসে ঠেকাবে না। বুজছো। ওই পাওয়ারগিরি দেখাতে আসবা না। পিছনে কে আছে দেখা যাচ্ছে না, সর। আরেক মেয়েকে বলে, তুইও গেছিলি। আমি তোকে নিজে নিষেধ করছিলাম। পাশের জনকে উদ্দেশ্য করে ইশা বলেন, জিজ্ঞেস কর। আমি নিজে নিষেধ করেছি। কেন গেছিলি? আমি নিষেধ করার পরও কেন গেছিলি? মুন আপু (খালেদা হোসাইন মুন, ওই হলের ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি) তোকে গালি দিসিলো না। বেয়াদব বলেছিল না। তুই আসলেই একটা বেয়াদব। সোজা হয়ে দাঁড়া। তোদের চেহারাগুলো দেখি। তোদের মধ্যে গডফাদার পল? এই তুই, তুই। তুই তো যাবি। তুই তো হাড়েহাড়ে শয়তান। মিনমিনে শয়তান। চেহারাটা দেখ কি সুন্দর করে রাখে। মনে হয় পৃথিবীর একটা ইনোসেন্ট। আর ভিতরে ভিতরে এত রস। তুই গণরুমে চলে যাবি। রুমে থাকতে পারবি না। সব গোছাইছিস। গোছাইসনি কেন? আমি এখন চারটা মেয়ে পাঠাবো। তোরা গণরুমে চলে যাবি। তিনজনের জন্য এই শাস্তি। তোরা সবাইরে নিয়ে গেছিলি। তোদের পদে পদে কঠিন শাস্তি দিতে হবে। আন্দোলনে যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে কথা বলিসনি কেন? এখন থেকে হলে থাকতে হলে প্রতিদিন আমার সঙ্গে কথা বলবি। তুই, তুই আর তুই। এই তিনজন। আর কেউ না। এক মেয়েকে ইঙ্গিত করে ইশা আরো বলেন, এই তুই তোর আব্বুকে কল দে। মেয়েটি দিতে অস্বীকৃতি জানালে ইশা বলে না হলে আমি কল দিবো। তখন অনেক খারাপ হবে। তুই কল দে। আমি যেটা বলি সেটা করেই ছাড়ি। হলের গেট ভেঙে তোরা আন্দোলনে যাস। এটা তোর আব্বুকে বলে দিবো। তখন তোর পরিবারের সবাই বিষয়টি জানবে। কাল থেকে কেউ আমাকে না বলে কোথাও বের হবি না।’

এদিকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কারাদাশে প্রত্যাহার করায় হলে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ১২ই এপ্রিল রাতেই হল থেকে ১৫/২০ জন ছাত্রী বাড়ি চলে যায়। হলে অবস্থানরতদের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। এদিকে ইশার ওপর থেকে বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ভিসি ড. আখতারুজ্জামান বলেন, শুধু ছাত্রত্ব ফিরে পাবে না। বরং সম্মানিত হবে। সেটি উচিত হবে। কারণ, আমরা তো কোনো শিক্ষার্থীর প্রতি অবিচার করতে পারি না। যদিও ঘটনার দিন রাতেই ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি। ওই দিন তিনি বলেন, তাকে শারীরিকভাবে আহত করেছে। এটা জানার পর আমি দুই দিক থেকে ভেরিফাই করলাম। প্রক্টর এবং হল প্রশাসন বললো। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যেহেতু ওই মেয়ে আরেকজনকে আঘাত করেছে তাই তাকে বহিষ্কার করলাম।”


  • মানবজমিন/ এপ্রিল ১৪,২০১৮ 

Saturday, April 14, 2018

Government succumb to students’ movement for quota reform


Abdur Rahman Khan



In the wake of a country-wide demonstration and clashes with the students the government finally succumbed to the pressure of general students and the job seeking youths. 

Expressing apparent anger at the quota reform movement, Prime Minister Sheikh Hasina on Wednesday announced that there will be no quota system in government jobs anymore.

“The quota system is cancelled for stopping repeated sufferings (of common people due to movements) and avoiding repeated movements and disturbances. This is a clear word,” she said while responding to a supplementary question during the question-answer session in Parliament.

The Prime Minister said, “If we go for reform (of the quota system now), another one (group) will come up after a few days and say we want further reform.”

She said the question of reform will come if the quota system exists and there will be no problem of reform if it does not exist.

“So, there’s no need for having the quota system,” she said.

The Prime Minister, however, asked the students to find out who carried out the attack at the residence of Dhaka University Vice-Chancellor Md Akhtaruzzaman on April 8, where those looted goods are, and who is currently holding them’

She warned that “Detective agencies have already started investigating the matter and everyone involved with the incident will be held accountable.”

A people‘s victory
In an instant reaction to PM’s announcement, , BNP senior leader Moudud Ahmed on Wednesday described the Prime Minister’s announcement to abolish the quota system in public service in the face of a students’ movement as ‘people’s victory’.

“The Prime Minister has announced that there’ll be no quota system in country as she could finally realise the intensity of the movement. They (govt) could also understand it’ll be difficult for them to stay in power if the movement continues,” he said.

Speaking at a discussion, Moudud further said, “I would like to say it’s a victory of people while the government has suffered a defeat.”

A faction of Labour Party (Iran) arranged the programme at the Jatiya Press Club demanding deployment of army in the next general election.

Moudud, a BNP standing committee member, urged his party colleagues to get inspiration from the students’ movement to realise their rights. “We’ll also establish our rights the same way. We’ll also free Khaleda Zia through a mass movement.”

Terming justified the students’ demand for reform of the quota system in public service, he said the movement has reflected the outburst of pent-up anger of people and common students across the country. “The students also voiced their resentment against the way the country is run now.”

BCL swoops on agitators

For the past two months, Bangladesh Sadharan Chhatra Odhikar Sangrakkhan Parishad has been spearheading the nationwide movement demanding change in the quota system, claiming it excludes a large number of qualified candidates at a time of rising unemployment in the broader economy.

The quota reform movement received a major boost this week after violent tripartite clashes between police, Bangladesh Chhatra League and the demonstrators in Dhaka University (DU) campus between Sunday evening and early Monday injured more than 100 protesters.

On Wednesday, activists of pro-government Bangladesh Chhatra League (BCL) allegedly attacked the quota reform protesters at Jahangirnagar University injuring at least 15 people, including some female students. 

Witnesses said around 30-40 BCL men, led by JU unit president Jewel Rana and general secretary Abu Sufian Chanchal, carrying sticks swooped on the demonstrators at the main entrance of the university while they were talking to JU VC Prof Farzana Islam and teachers’ representatives.

The agitating students alleged that BCL men Rafa, Mahbubur Rahman, Nahid, Nayem, Bayezid Rana, Apon and Riju attacked them during their peaceful agitation.

They claimed that 15 people, including two journalists and some female students, were injured in the attack.

Meanwhile, the demonstrators brought out a protest procession on the campus around 6:30 pm when they demanded expulsion of the attackers from the university.

JU Proctor Sikder Md Zulkarnine described the attack as unexpected.

According to an announcement from Bangladesh Chhatra League, the president of Dhaka University’s Kabi Sufia Kamal Hall unit of Chhatra League Iffat Jahan Isha had been expelled from the organization after it was revealed that she assaulted several quota reform protesters in the female hall.

Govt wesite hacked

Earlier, Some important government websites including President’s office, Prime Minister’s Office, Jatiya Sangsad were hacked yesterday night. The defaced pages showed several messages demanding reformation of quota system.

After the hacking, post has been given by ‘Bangladesh Black Hack Hackers’ with links of these on facebook page. It has been said that the websites have been hacked as part of the 360 degree movement for making reforms to the quota system.

The outage has hit websites of most of the ministries, including those of home, agriculture, finance, foreign affairs, housing and public works, land, planning, local government, commerce, road transport and bridges, and defence.State Minister for ICT Zunaid Ahmed Palak told last night that they were working to restore the hacked websites.

He claimed they have proof that the assault was carried out from a foreign country, but did not name any. “Some group did this premeditatedly,” he said, “We are trying to retrieve these sites,” he said. Palak also said there have been attempts to hack the National Portal for quite a few days.

The message posted on the hacked websites also showed a photo, believed to be of a lone quota reform protester waving the national flag amid teargas.

The protesters fought running battles with police and the ruling Awami League’s student affiliate Bangladesh Chhatra League on the Dhaka University campus overnight after being chased away from the busy Shahbagh intersection on Sunday evening. Clashes also took place in other universities as the protests spread.

During the early hours of Monday, while protesting in favour of quota reform, protesting students broke into the Vice-Chancellor’s residence and vandalized it. They had rods, hockey sticks, and bamboo sticks with them. The attackers broke almost every window in house and set surrounding vehicles on fire. However, no casualty was reported.

After a meeting with the government on Monday, the demonstrators said they postponed the programs until May 7. But hours before the cyber-attack on Tuesday, they said they would press on with the demonstrations when many of them did not agree with the decision to halt the programs.

Quota system collides with constitutional rights of citizens

REPRESSION AGAINSTB PROTESTING STUDENT ILLEGITIMATE


Shahid Islam


Bangladesh is an uneven playing field for those seeking to survive and thrive under justice, equity and fair play. The brutal police attack on demonstrating students seeking reform to the existing quota system in selecting public servants is a vivid example of how the state willfully deprives talents to favour partisan candidates under a variety of pretexts; as it does in choosing public representatives to govern and lead the nation by derailing democracy through a slew of authoritarian mechanisms.

Image crisis

Now, only months before the next general election, the dictatorial governing mechanism is creating a serious image crisis at home and abroad for the incumbent regime and the nation alike.

Curiously, the style and the tactic to blunt any form of dissent are the same. In the summer of 2013, when thousands of students gathered at the University of Dhaka Campus demanding reform to the quota system, police used the same technique of repressions; as it did this week (on 9th April 2018).

Authentic media reports say police not only attacked with batons and tear gas the protesters and injured hundreds, they also raided the university dormitories that night and swooped on sleeping students with tear gas. And, like in the past, media was barred from broadcasting to the public what happened after the police raid.
But the social media did its part to tell the world what exactly happened. A number of global media reported on April 10 that “Bangladesh government has attacked the peaceful student protesters on April 9 with armed police and hired terrorists named as “Bangladesh Chatro League. More than 500 students have been injured. Government also ordered blackout and cut out supply in the university area.”

Constitutional invalidity

The movement of the aspiring public service students are lawful, and the system against which they have been fighting is an unconstitutional one that had survived for decades under the political patronage of successive regimes.

Under the existing system of choosing candidates for the Bangladesh Civil Service (BCS) cadre to lead public administrations, parts of the judiciary, and many other important government jobs,barely 45 percent candidates are recruited on merit while the remaining 55 percent are chosen on quotas that preserve a staggering 30 percent for freedom fighters’ children, 10 percent for women, 10 percent for district quotas, and 5 percent for tribal people.

Through this biased, unjust, faulty system, competitive, able and eligible candidates are deprived of deserved jobs and fulfilment of their desires to serve the nation as distinctive civil servants. No wonder the civil service of today is a mere skeleton of its former self in terms of merit, efficiency, eloquence, personality and leadership.

Antic executive order

This ‘whimsically-devised’ system came into effect through an executive order on September 5, 1972, during a constitutional interregnum and transition from Pakistan to newly independent Bangladesh.  The new constitution that came into effect on December 16, 1972 enshrined the principle of non-discrimination in the public services; articles 27 and 28 stipulating that ‘there shall be no discrimination in the recruitment of the people to the public service irrespective of caste, religion and sex.’

As such, the antic provisional measures for proportional representation should have been scrapped long ago due to their biased allocation of 56% civil service appointments to the quota holders.

That aside, according to clause 1 of Article 29 of the amended constitution, “there shall be equality of opportunity for all citizens in respect of employment or office in service of the republic.” And, clause 2 of Article 29 states: “no citizen shall, on grounds only of religion, race, caste, sex or place of birth, be eligible for, or discriminated against in respect of, any employment or office in the service of the republic.” Based on such constitutional and legal guidelines, existing quota system is not only discriminatory, it’s blatantly unconstitutional.

The only defense such a discriminatory policy has in its favour is article 29(3) that ordains of “making special provision in favour of any backward section of citizens for the purpose of securing their adequate representation in the service of the republic.”

Bogus claims

Given that all pedigrees of freedom fighters, many of them carrying ‘false freedom fighter certificates’ of ancestors, are not ‘backward citizenry’ per se, the system is being misused to induct partisan loyalists and their children into vital services of the republic; violating enshrined constitutional rights of other deserving candidates.

For instance, in 2017, when the Liberation War Affairs Ministry was making a new list of freedom fighters, about 150,000 people applied to be included in the list of existing freedom fighters, who were later found to be fake. AKM Mozammel Haq, incumbent Liberation War Affairs Minister, said: “Not even five percent of them were freedom fighters (Prothom Alo, June 23, 2017). Moreover, irregularities in the process of listing freedom fighters are well documented, the list changing under every successive government.

There have also been allegations that members of the committee in charge of making the list often abused their power to include fake names in exchange for money, sometimes excluding real freedom fighters.

Bogus certificates

Bengali language daily The Prothom Alo reported on August 10, 2016 that “one former freedom fighter commander provided fake freedom fighters’ certificate to 19 people of his village in exchange for a large sum of money so that they could get jobs in the police force.  More ominously, in 2014, five high-ranking government officials’ freedom fighters’ certificates were revoked because they had obtained the certificates using fake documents.

Who are those fake freedom fighters? Three of them were secretaries, one a joint secretary,and the other one none less than the chairman of the country’s Privatisation Commission. Moreover, thousands of vacant posts earmarked as ‘reserved for freedom fighters’ children’ cannot be replenished due to the 1972 executive order relating to the reserved quotas.

Audacious agro minister

Yet, the negotiations between the government and a 20 member delegates from the protesting students did yield a positive outcome on April 9 to defer the movement momentarily; only to be rekindled by the defamatory, libelous, insulting verbiage in the parliament of the quintessential bad-mouthed agriculture minister, Matia Chowdhury, who, along with some other ruling party leaders and lawmakers, termed the protesters as ‘Rajakars.’

The reaction from the protesters were erupting and instantaneous. Syed Zobaer Uddin, a representative of the protesters, who’s a Masters student at Dhaka University, said in front of the Raju Sculpture the same evening: “We are the children of Bangabandhu, not Rajakars, and we have no faith in the government that gives assurance of a month and then labels us as Rajakars,” and then, reneging on the promise they made to defer the movement for a month, they urged all to continue the movement until the PM herself assures them of a decision to reform the quota system and bury this illegitimate process of biased selection procedure that had deprived the nation for decades of the services of the most deserved and the talented leaders of tomorrow. And, due to this quota system of selection, the civil service today has in its rank and file a ‘politicized segment’ that is ignorant, arrogant and indecorous of the posts they hold.

  • Courtesy  —  weeklyholiday.net/April 13, 2018

চাকরিতে কোটা — বাতিল নয়, সংস্কারেই সমাধান



আলী রীয়াজ


কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সম্পূর্ণ অবসানের যে ঘোষণা দিয়েছেন, তার যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, সেটাই স্বাভাবিক। কয়েক মাস ধরে যে তরুণেরা এই আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন এবং গত কয়েক দিনে পুলিশের নির্যাতনের শিকার ও সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা তাঁদের অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলেছে। সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতারা আন্দোলন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকেরা প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে যথাযথ বলে বর্ণনা করছেন।

রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর এই পদক্ষেপকে তাঁরাই আগ বাড়িয়ে প্রশংসা করছেন, যাঁরা এই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগেও যেকোনো ধরনের পরিবর্তনের দাবির মধ্যে ষড়যন্ত্রের জাল দেখতে পেয়েছিলেন এবং এ ধরনের সংস্কারকে রাষ্ট্রবিরোধী ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অবমাননাকর বলে বর্ণনা করেছেন। সামান্য পরিবর্তনকেও অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে, কিন্তু কোনো রকম কারণ ছাড়াই এখন পুরো কোটাব্যবস্থা বাতিলকে অভিনন্দন জানানোর মধ্যে যে স্ববিরোধিতা আছে, তা ওই সব ব্যক্তির না বোঝার কোনো কারণ নেই। কিন্তু এখন তাঁদের প্রতিক্রিয়ার মূল সুর হচ্ছে, এই সিদ্ধান্তের সব দায় আন্দোলনকারীদের। তাঁরা জানেন যে আন্দোলনকারীদের দাবি বাতিলের দাবি ছিল না। প্রধানমন্ত্রীও তা জানেন।

যাঁরা এখন সরকারি সিদ্ধান্ত সমর্থনে অকুণ্ঠিত, তাঁদের বক্তব্যে এটা তাঁরা স্বীকার করেই নিচ্ছেন যে এই সিদ্ধান্তের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক নয়; কিন্তু যেহেতু এর দায় অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাচ্ছে, তাতে করে তাঁরা এখন এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। তার কারণও সুস্পষ্ট-এটি ভালো রাজনৈতিক কৌশল এবং তাতে করে আন্দোলনকারীরা বিপদগ্রস্ত হয়েছেন। ছাত্রলীগের ‘আনন্দ মিছিল’ এবং সরকার-সমর্থকদের এই প্রতিক্রিয়া একই সূত্রে বাঁধা-এর থেকে রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া গেলে, এমনকি তা যদি সাময়িকও হয়, তাতে যদি দীর্ঘ মেয়াদে দেশের ক্ষতির আশঙ্কাও থাকে, তাতেও তাঁরা বিব্রত নন। আন্দোলনকারী ও তাঁদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে গোপন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে, অথচ এই সিদ্ধান্ত যে রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত, সেটা সরকার-সমর্থকেরা অস্বীকার করছেন না।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে বহুভাবে চিত্রিত করার চেষ্টা হয়েছে। ২০১৩ সালে যখন প্রথম এ বিষয়ে ক্ষোভ আন্দোলনে রূপ নেয়, তখন থেকেই সেই চেষ্টা হয়েছে। ২০১৩ সালে এ ধরনের প্রচেষ্টা সফলও হয়েছে। এই দফায় একে কোটা বাতিলের আন্দোলন বলে অভিহিত করার চেষ্টা যখন সফল হয়নি, তখন প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত একে সেই জায়গায় নিয়েই দাঁড় করাল। শেষ পর্যন্ত সব ধরনের কোটা বাতিলের জন্য সরকারি পদক্ষেপ নেওয়া হোক অথবা না হোক, যে তরুণেরা এই আন্দোলনে যুক্ত, ভবিষ্যতে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের ব্যত্যয়ের জন্য তাঁদের দায়ী করার পথ উন্মুক্ত করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের কারণে নারীরা বঞ্চিত হবেন-এই ভবিষ্যদ্বাণী করে তার জন্য আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি কেউ কেউ ইতিমধ্যে শ্লেষাত্মক বাক্য ছুড়ে দিতে কুণ্ঠিত হচ্ছেন না।

সংস্কারের দাবির বিরোধিতা করতে গিয়ে একে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, তাঁদের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা বলে সরকার-সমর্থকেরা বলে এসেছেন। আন্দোলনকারীরা সব সময় বলেছেন যে তাঁরা কখনোই মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে নন। বিরাজমান ব্যবস্থায় সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য যে ৩০ শতাংশ কোটা রয়েছে, স্বাধীনতাযুদ্ধের ৪৭ বছর পরে এই কোটার সুবিধা যে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা পাচ্ছেন না তা বোধগম্য; এর সুবিধা পাচ্ছেন তাঁদের উত্তরসূরিরা। মনে রাখা দরকার, ‘সরকারি কর্ম কমিশনের তথ্য অনুযায়ী ১৯৮২ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা লক্ষণীয় মাত্রায় কমতে শুরু করে। ১৯৮৯-৯০ সাল নাগাদ এটি ১ শতাংশে নেমে আসে, বাকি ২৯ শতাংশ কোটা অপূর্ণ থেকে যায়।’ (‘রাজাকারের বাচ্চা’ বনাম মুক্তিযোদ্ধা কোটা’, শাখাওয়াত লিটন, ডেইলি স্টার, ১১ এপ্রিল ২০১৮)।

১৯৯৬ সালে কোটাব্যবস্থায় সংস্কার করে ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে অপূর্ণ কোটায় মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের অগ্রাধিকার দেওয়ার বিধান চালু করা হয়’। যে ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রহণযোগ্য তালিকা তৈরি করা যায়নি, সেখানে তাঁদের উত্তরসূরি নির্ধারণের উপায় এবং তার সম্ভাব্য অপপ্রয়োগের বিষয়কে অস্বীকারের উপায় নেই।

কোটাব্যবস্থায় পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোর জন্য ১০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা রয়েছে। যেকোনো ধরনের সংস্কার প্রতিটি ক্যাটাগরির ক্ষেত্রেই প্রযুক্ত হবে। কিন্তু এর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রসঙ্গকে এককভাবে যুক্ত করার মধ্য দিয়ে সংস্কার প্রস্তাবকেই এমনভাবে চিত্রিত করা হলো এবং তা বাতিলের মধ্য দিয়ে সংস্কারের দাবিদার তরুণদের এমন জায়গায় নিয়ে দাঁড় করানো হলো, যেন মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরি ও তরুণেরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। অথচ এই তরুণদের মধ্যেই যে মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরিরা আছেন, তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি।

১৯৮৭ সাল থেকে এক দশক ধরে সরকারি কর্ম কমিশন সামগ্রিক কোটাব্যবস্থায় সংস্কারের কথা বলে এসেছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব সরকারি কর্ম কমিশনের পক্ষ থেকেই প্রথম দেওয়া হয়েছিল। ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, তাঁদের অন্যভাবে চাকরির ব্যবস্থা’ করে দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন, তাতে এমন ধারণাই প্রতিষ্ঠিত হলো যেন আন্দোলনকারীরা কেবল একটি ক্যাটাগরির ব্যাপারেই সংস্কার দাবি করছিলেন।

একবার সংস্কার করলেই বারবার সংস্কারের দাবি উঠবে বলে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এমন ধারণা দেয় যে এই কোটাব্যবস্থা আগে কখনোই সংস্কার করা হয়নি। অথচ গত ৪৭ বছরে একাধিকবার সংস্কারের ঘটনা ঘটেছে, সেটা তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন-‘১৯৭২ সাল থেকে এই কোটা পদ্ধতি চলছে। সময়-সময় সংস্কার করা হয়েছে।’ সেটাই স্বাভাবিক। এখন রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়ে যেভাবে সংস্কারের দাবিকে মোকাবিলা করা হলো, তাতে করে ভবিষ্যতে এ নিয়ে আরও অসন্তোষের পথকেই উন্মুক্ত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বিভক্ত দেশে আরও একধরনের বিভক্তির সুযোগ থেকে ক্ষমতাসীনেরা হয়তো লাভবান হবেন বলেই মনে করছেন; কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে দেশের জন্য তা যে ইতিবাচক হবে না, সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

অনেকেই প্রশ্ন করবেন, সরকার কী করতে পারত? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে সরকার সময় চেয়েছিল, কিন্তু আন্দোলনকারীরা তা দিতে রাজি হননি। পেছনে ফেরার পথ নেই, কিন্তু এই প্রশ্ন তো করাই যায় যে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ ও সরকার-সমর্থকদের হামলার আগে কি এই আলোচনা শুরু করা যেত না?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি এবং পুরো পরিস্থিতির সুযোগে উপাচার্যের বাসভবনে তাঁর ভাষায় ‘প্রশিক্ষিত দুষ্কৃতকারী’দের হামলার আগে কেন এ বিষয়ে আলোচনার তাগিদ ছিল না, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানো যদি প্রধান লক্ষ্য হয়, যদি কোটা প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য সমাধান উদ্দেশ্য হয়, তবে রাজনৈতিক কৌশলে শিক্ষার্থীদের পরাস্ত করার ধারণা থেকে সরে আসতে হবে। সে জন্য কোটা বাতিলের ঘোষণা পরিহার করে সংস্কারের জন্য কার্যকর সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার দিকেই সরকারের মনোযোগ দেওয়া দরকার।

মনে রাখতে হবে, অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপরই বর্তায় এবং বাংলাদেশের সংবিধানে সরকারের ওপর সেই দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। সরকারি দল রাজনৈতিক কৌশলে পারদর্শিতা দেখাতে গিয়ে সেই দায়িত্ব এড়াতে পারে না। আর এই সিদ্ধান্তের দায় আন্দোলনকারী তরুণদের ওপর চাপিয়ে দিতে যাঁরা ইতিমধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠছেন, তাঁরা আশা করি ভেবে দেখবেন যে এই তরুণেরাই দেশের ভবিষ্যৎ।

আলী রীয়াজ  — যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর। 

কার্টেসি  —  প্রথম আলো/এপ্রিল ১৩, ২০১৮ ।



Friday, April 13, 2018

সেই রাতের ঘটনা কারা ঘটিয়েছিল?



সোহরাব হাসান


গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আরেকটি ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ তৈরি হয়েছিল। সকাল ১০টার দিকে বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের দিকে আসছিলেন। শাহবাগ মোড়ে দাঁড়াতেই দেখি হাজার হাজার শিক্ষার্থীর কাফেলা। যেকোনো ছাত্রসংগঠনের মিছিলে সামনে কয়েকজন ছাত্রী থাকেন, বাকি সবাই ছাত্র। কিন্তু এই মিছিলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় সমান। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্ব পাশের সড়ক দিয়ে আসা মিছিলটি শাহবাগ মোড় ঘুরে দক্ষিণ দিকে রাজু ভাস্কর্য অভিমুখে যাচ্ছে। মিছিলকারীদের কারও হাতে ফেস্টুন, কারও মুখে স্লোগান, ‘কোটা প্রথার সংস্কার চাই’। কোনো হট্টগোল নেই।

ওদিকে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর হেলমেটধারী সদস্যরাও ছিলেন শান্ত, ধীরস্থির। কেউ মিছিলে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেননি। মিছিলের পুরোভাগে যাঁরা, সজাগ ছিলেন কোনো অঘটন যেন না ঘটে। এরই মধ্যে মিছিল থেকে একজন পানির একটি খালি বোতল ছুড়ে মারলেন পুলিশের দিকে। নেতারা সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিলেন।

নব্বইয়ের পর এত বড় মিছিল ঢাকা শহরে আর দেখা যায়নি।

সঙ্গে থাকা একজন সাংবাদিক বন্ধু, যিনি নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন কভার করেছেন, বললেন, নব্বইয়ের পর এত বড় মিছিল ঢাকা শহরে আর দেখা যায়নি। তখনো মিছিল আসছিল। সবার গন্তব্য রাজু ভাস্কর্য। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী একজনকে জিজ্ঞেস করি, শহরের আর কোথায় কোথায় সমাবেশ হচ্ছে? তিনি বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই এখানে এসেছেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আলাদা সমাবেশ করছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও নিজ নিজ ক্যাম্পাসে ও পাশের সড়কে মিছিল-সমাবেশ করছেন। আমরা যখন কারওয়ান বাজার পার হচ্ছিলাম, দেখি পান্থপথে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিছিল করছিলেন। আসলে গতকাল সত্যিকারভাবেই ঢাকা ছিল মিছিলের নগরী। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের কষ্টেরও।

রাজু ভাস্কর্যের চারদিকে ঘিরে বলতে গেলে মহাসমাবেশ। সাংবাদিকদের ব্যস্ততা, টিভি ক্যামেরার ছোটাছুটি। অস্থায়ী মঞ্চ থেকে নেতারা কী বলছেন, শোরগোলে সবটা বোঝা গেল না। তবে যেটুকু শুনলাম, কোটা সংস্কারের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।

ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকবে। তখনো শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে মুহুর্মুহু স্লোগান, ‘সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’। তাঁরা একজন মন্ত্রীর নাম ধরেও স্লোগান দিচ্ছিলেন।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ-রোষ
গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লাউঞ্জ ছিল অনেকটা সরগরম। সবার মুখে কোটা আন্দোলনের প্রসঙ্গ। কেউ কেউ আবার সরকারের লাভ-ক্ষতির হিসাব কষছেন। নীল দলের সমর্থক একজন শিক্ষক বললেন, ‘বুঝতে পারছি না সরকার কেন ছাত্রদের ন্যায্য দাবি মানছে না। তারা তো সরকারের পতনের দাবিতে আন্দোলন করছে না।’ অপর একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক, যিনি একসময় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, খেদের সঙ্গে বলেন, ‘এই যে বাইরে বিপুল জনস্রোত দেখছেন, শত শত শিক্ষার্থী হল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে, এটি শুধু কোটা সংস্কারের জন্য নয়; দীর্ঘদিন ধরে তাদের ভেতরে যে চাপা ক্ষোভ ছিল, এই আন্দোলনে তারই বিস্ফোরণ ঘটেছে।’ তিনি আরও বলেন, প্রতিটি হলে প্রায় প্রতিদিন ছাত্রলীগের মিছিল হয়। আর সেই মিছিলে বাধ্যতামূলকভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের যোগ দিতে হয়। মিছিলে না গেলে কেউ হলে থাকতে পারে না।


তাঁর কথায় আগের রাতে কবি সুফিয়া কামাল হলের ঘটনা মনে পড়ল। সেখানে কোটা সংস্কারের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার ‘অপরাধে’ তিন শিক্ষার্থীকে মারধর করেন হল ছাত্রলীগের নেত্রী ইফফাত জাহান। এতে আরেক শিক্ষার্থী প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে জানালার কাচে তাঁর পা কেটে যায়। এতে হলের শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হন। পরে ইফফাতকে হল ও ছাত্রলীগের পদ থেকে বহিষ্কার করে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করা হয়। হলের সাধারণ ছাত্রীদের দাবি, তাঁকে শুধু বহিষ্কার করলে চলবে না, বিচারও করতে হবে।

সেই রাতের ঘটনা কারা ঘটিয়েছিল?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আন্দোলনের পাশাপাশি গতকাল সরগরম আলোচনা ছিল উপাচার্যের বাসভবনে হামলার বিষয়টি। আগের দিন শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ এস এম মাকসুদ কামাল টেলিফোনে সাংবাদিকদের ঘটনাস্থল সরেজমিন দেখার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু আমরা সেখানে গিয়ে দেখি, উপাচার্যের বাসভবনের কয়েকজন কর্মী ছাড়া কেউ নেই। শিক্ষকেরা এসে চলে গেছেন। তাঁদের জরুরি বৈঠক ছিল। টিভির খবরে দেখলাম, শিক্ষক সমিতি কোটা সংস্কারের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়েছে, সংহতি জানিয়েছেন উপাচার্য আখতারুজ্জামানও। কিন্তু তাঁরা কাজটি আগে করলে অনেক অঘটনই এড়ানো যেত।

সেদিন রাতে উপাচার্যের বাসায় কারা হামলা করেছে, এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারেননি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিএনপি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আন্দোলনকারীদের ব্যবহার করে থাকতে পারে। বিএনপি বলেছে, আন্দোলন ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য ‘সরকারের এজেন্টরা’ এই কাজ করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, উপাচার্যের ভবনে যারা হামলা করেছে, তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। ফেসবুকে যারা ওই রাতে একজন ছাত্র নিহত হয়েছে বলে গুজব ছড়িয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা করা হবে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেছেন, সেদিন রাতে পুলিশ বিনা উসকানিতে নির্বিচারে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে শতাধিক শিক্ষার্থীকে আহত ও রক্তাক্ত করলে তাঁরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। এরই মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে একজন শিক্ষার্থী মারা গেছেন। এরপর শিক্ষার্থীরা তাঁদের ক্ষোভের কথা জানাতে উপাচার্যের বাসভবনে গিয়েছিলেন, এ কথা ঠিক। কিন্তু সেখানে মুখে কাপড় পরে যারা তাণ্ডব চালিয়েছে, তাদের তাঁরা চেনেন না। আন্দোলনেও তারা ছিল না। উপাচার্যের বাসভবনে দায়িত্ব পালনকারী একজন কর্মী জানান, হামলার সময় ভেতরে দুজন কর্মী, তিনজন প্রহরী ও বাইরে পাঁচজন পুলিশ সদস্য ছিলেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ছিল হাজারের বেশি। এই ঘটনা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ঘটনার পরপর আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এগিয়ে এলেও কেন পুলিশকে খবর দেওয়া হলো না?

আন্দোলনকারীরা বলেছেন, উপাচার্যের বাসভবনে যারা হামলা করেছে, সরকার তাদের ধরুক। কিন্তু নিরীহ ও নিরপরাধ শিক্ষার্থীরা যেন নিগৃহীত না হন। বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে গেলেও আন্দোলনকারীদের মনে ভয় আছে। কয়েকজন আমাকে বললেন, ‘ভাই, আমাদের কথা লিখুন, তবে নাম প্রকাশ করবেন না। বিপদ হবে।’

নীল ও সাদা দলের বাইরের একজন শিক্ষক বললেন, এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে যতবার সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিগৃহীত হয়েছেন, প্রশাসনের কাছে প্রতিকার চেয়েও তাঁরা পাননি। ফলে প্রশাসনের প্রতি তাঁদের ক্ষোভ থাকা অস্বাভাবিক নয়।

শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের ক্ষতি
এ কলাম লেখা পর্যন্ত কোটা সংস্কারের বিষয়ে সরকারের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘তারা চায় না, তাহলে দরকার কী? কোটা পদ্ধতিরই দরকার নাই।’ তাঁর এ বক্তব্যের পর আজ সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে বলে ধারণা করি।

আন্দোলনকারীরাও বলেছেন, আজ সিদ্ধান্ত জানাবেন। আমরা চাই অবিলম্বে বিষয়টির সুরাহা হোক।


  • সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি  (sohrabhassan55@gmail.com)


  • কার্টেসি — প্রথম আলো/ এপ্রিল ১২, ২০১৮। 


ঢাবির রগ কাটার ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বললেন


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী এক ছাত্রীর পায়ের রগ কেটে দিয়েছে ওই হলের ছাত্রলীগের সভাপতি ইফফাত জাহান এশা।

মঙ্গলবার গভীর রাতে এ ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর অগ্নিগর্ভে পরিণত হয় গোটা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। বিভিন্ন আবাসিক হলের ছাত্ররা জড়ো হন কবি সুফিয়া কামাল হলের সামনে। রাত পৌনে তিনটায় বিজয় একাত্তর হলের গেট ভেঙ্গে প্রায় সব সাধারণ ছাত্ররা মিছিল করে ছুটে যেতে থাকেন সুফিয়া কামাল হলের দিকে। ওদিকে সুফিয়া কামাল হলেরও সব সাধরণ ছাত্রীরা রুম ও ফ্লোর থেকে বের হয়ে হলের সামনে নেমে আসেন। ভেতরে ছাত্রীরা আর বাইরে অবস্থান নেন বিভিন্ন হলের ছাত্ররা। এমন অবস্থায় রগ কাটা ছাত্রলীগ নেত্রীর গলায় জুতার মালা পড়ায় সুফিয়া কামাল হলের সাধারণ ছাত্রীরা। এরপর শিক্ষার্থীদের আল্টিমেটাম অনুযায়ী তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ছাত্রলীগও তাকে বহিষ্কার করেছে সংগঠন থেকে।

ছাত্রীরা জানায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগদানকারী অনেক ছাত্রীদেরই কয়েক দিন ধরে নির্যাতন করে আসছিল এশা। যে ছাত্রীর পায়ের রগ কাটা হয়েছে তার নাম মোরশেদা আক্তার। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। এশা কর্তৃক মারধরের শিকার হওয়া অন্য ছাত্রীরা হলেন ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শারমিন সুলতানা তমা, তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের আফিফা আক্তার রিভু, ভূতত্ত্ব বিভাগের ঋতু ও স্বর্ণা।



ঘটনার পর থেকে মোরশেদার কাটা পায়ের ছবিসহ ঘটনার অনেক ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে ওয়েবসাইটে। ইশার গলায় জুতার মালা পড়ানো, বিজয় একাত্তর হলের গেট ভেঙ্গে ছাত্রদের দল বেধে বেরিয়ে যাওয়া, সুফিয়া কামাল হলের সামনে অবস্থান, সুফিয়া কামাল হলের সিঁড়ি ও রুমের মেঝেতে রক্তের ছবি এবং ভিডিও ছাড়া হয়েছে ইন্টারনেটে।

সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রীর রগ কাটা এবং পরবর্তী ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড এ কে এম গোলাম রব্বানী এবং হলের আবাসিক শিক্ষকরা ।

ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বিজয় একাত্তর হলের প্রায় সব ছাত্ররা রাত দুইটার পর থেকে বের হয়ে আসেন। কিন্তু হলের গেট বন্ধ থাকায় তারা বাইরে বের হতে পারছিলেন না। এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের বাঁধা উপেক্ষা করে হলের গেট ভেঙ্গে তারা বের হয়ে যান এবং সুফিয়া কামাল হলের সামনে গিয়ে ঘটনার বিচার দাবি করেন।

প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ

সুফিয়া কামাল হলের আবাসিক ছাত্রী সাফিয়া শারমিন হলের রাতের ঘটনা সামনে থেকে দেখেছেন। তিনি এ বিষয়ে তার ফসেবুকে স্ট্যাটাস দয়িছেনে। তার ওই স্ট্যাটাস এখানে তুলে ধরা হলো — 

সুফিয়া কামাল হল থেকে বলছি...

ঘটনার সূত্রপাত আনুমানিক ১২ টার দিকে, সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে গেছিলাম। এক ফ্রেন্ডের ফোনে ঘুম ভাঙ্গছে, লাফিয়ে উঠে নিচে দৌড় দিলাম। ৯ তলা থেকে নামতে নামতে দেখলাম ৩-৪ তলায় সিড়িতে রক্ত, ফ্লোরে রক্ত। ভিড় ঠেলে নিচে নামলাম, আপুদের কাছে জিজ্ঞাসা করার বলল তিনদিন ধরেই অত্যাচার চলতেছিল নিরবে, যারা পলিটিকালি হলে উঠেছে তাদের উপর, এখন এক মেয়ের পা কেটে দিয়েছে। কেউ ভয়ে মুখ খুলে নাই।

প্রত্যয় প্রদীপ্ত দুটো মুখোমুখি ভবন। এশা প্রত্যয়ে মেয়েদের মারার সময় কিছু মেয়ে দেখে চিৎকার করছে। কিছু মেয়ে নিচে নেমে আসলে তাদেরকে বলছে ‘ত্যাঁলাপোকা দেখে চিৎকার দিছে, কিছু হয় নাই।’ কিন্তু ফ্লোরে সিড়িতে রক্ত দেখে হলের মেয়েরা একত্রিত হইছে।

এর মধ্যে এশা ওই মেয়েদেরকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিছে। তারপর হলের হাউজ টিউটর ম্যামরা এসে মেয়েটাকে হাসপাতালে পাঠাইছে, এবং হলের মাঠে সব মেয়েরা তখন ক্ষ্যাঁপা। এশার বহিষ্কার স্লোগান দিচ্ছিল, এর মধ্যে এশাকে কিছু মেয়ে মাঠে নিয়ে আসছে, তখন কিছু মাইরও খাইছে।

এর মধ্যে ভাইয়ারাও চলে আসছে হলের সামনে। ম্যামরা জানতে চাইলো আমরা কি চাই? বললাম এশাকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার, ওকে জুতার মালা পরাবো আমরা। যেহেতু কোটা সংস্কার আন্দোলন অহিংস আন্দোলন, তাই মারবো না । এর মধ্যে ভাইয়ারাও চলে আসলো উদ্ধার করতে। সামনের দিকেই ছিলাম, আস্তে করে বললাম ‘ভুয়া’ সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল প্রক্টর তুই দুর হ, ভুয়া।

অনেক কথাবার্তার পর এশাকে নিয়ে আসা হলো সবার সামনে মাফ চাওয়ার জন্য, জুতার মালা পড়ানোর জন্য। কিন্তু প্রক্টর এশাকে জুতার মালা পরাতে দিবেন না। মেয়েরা ক্ষেপে গেল, তারপর শুরু হল ধাক্কাধাক্কি। এদিকে গোলাম ও তার সাথের লোকজন এশাকে ঘিরে বাঁচাতে চাইছেন প্রাণপণে। এ সময় রগকাটা নেত্রী সহ অনেকে মাইর খেলেন।

এদিকে দুই ভবনের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ায় আমরা ক্যান্টিনের পিছনের গেট দিয়ে হলে মেইন গেটে চলে আসলাম, যাতে কেউ পালাতে না পারে। ভাইয়ারা তখন বাইরে অবস্থান করছেন, স্লোগান দিচ্ছেন। এদিকে ধ্বস্তাধ্বস্তির এক পর্যায়ে এশাকে জুতার মালা পড়ানো হলো, হাউস টিউটর কাছ থেকে মৌখিক বিবৃতি নেওয়া হলো।

এরপর ম্যামরা ধ্বস্তাধ্বস্তির এক পর্যায়ে প্রক্টর এবং এশাকে হাউস টিউটর ভবনের ভিতরে ঢুকিয়ে কলাপসিপল গেট বন্ধ করে দিল। তখন মেয়েরা হাউস টিউটর ভবনের সামনে অবস্থান নিল, তারপর আমরা আমাদের দাবি এবং স্লোগান সমানতালে চলতে থাকলো। ভিতরে আমরা বাইরে ভাইয়ারা। সুফিয়া কামাল হল থেকে তিনটি দাবি দেওয়া হয়েছে যে হলে কোন আনুষ্ঠানিক রাজনীতি থাকবে না, ছাত্রীদের উপর অত্যাচারের বিচার এবং আমাদের ভাইবোনদের উপর অত্যাচারের বিচার করতে হবে। রাত ৪ টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে, ভাইয়ারা ফিরে গেছেন। মেয়েরা তাদের দাবি আদায়ে গণস্বাক্ষর করছে।


সুফিয়া কামাল হলের ঘটনা সম্পর্কে ঢাবি ভিসি


কবি সুফিয়া কামাল হলের ঘটনার পর উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেছেন ঢাবি ভিসি মো. আখতারুজ্জামান। তিনি রাতে এই ব্রিফিং করেন।

ভিসি বলেন, ‘দুঃখজনক। এটা একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। আমি তাৎক্ষণিক প্রক্টরের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রক্টরের টিমকে ওখানে পাঠিয়েছি। হল প্রশাসনকে বলেছি, মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। তারপর আমি বিস্তারিত জেনেছি। আমি অবহিত হয়েছি — হলের ইফাত জাহান এশা আরেকটি মেয়েকে মেরেছে। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে। যার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। হল প্রশাসনকে বলেছি, দোষী মেয়েটিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করতে। আগামীকাল এর আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হবে। প্রকৃত ঘটনা জানতে একটি তদন্ত কমিটিও করে দেবো। কেউ যেন সীমালঙ্ঘন না করে। আইনহীনতা, বিচারহীনতা চলতে পারে না। সে যেই হোক, বিচার হবে।

ইফাত জাহান এশাকে এর আগেও বহিষ্কার করা হয়েছিল এবং পুনরায় বহিষ্কারাদেশ প্রতাহ্যার করা হয়। এবারও কি সেরকম হবে কিনা সাংবাদিকরা জানতে চাইলে ভিসি বলেন, ‘আমরা সজাগ থাকবো, সেরকম যাতে না হয়। রাজনৈতিক পরিচয় যাই থাকুক, কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

  • কার্টেসি - dailynayadiganta.com/April 11, 2018 


Thursday, April 12, 2018

জার্মানির কাছ থেকে যে রাজনীতি শিখতে পারে বাংলাদেশ

আরাফাতুল ইসলাম/ডয়চে ভেলে



দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি দেশ আবার বিশ্বের বুকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ দেশটির আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছেন রাজনীতবিদরা৷ বলছি জার্মানির কথা৷ 

একথা সত্য, জার্মানির এক ভয়াবহ অতীত রয়েছে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কয়েক কোটি মানুষের মৃত্যুর জন্য অনেকটাই দায়ী এই দেশ৷ সে সময় ইহুদি ধর্মের মানুষদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিলেন জার্মানির তৎকালীন শাসক এডল্ফ হিটলার, যিনি যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে আগে জার্মানির রাজধানী বার্লিনে আত্মহত্যা করেছিলেন৷ 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার অপরাধের কথা অস্বীকার করে না জার্মানি৷ বরং অকপটে সেই অন্ধকার অতীতকে স্বীকার করে, প্রয়োজনের জায়গায় ক্ষতিপূরণ দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে দেশটি৷ ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মূলত দুইভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া জার্মানি আবারো নিজেদের গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে, একত্রিত হয়েছে৷ ধ্বংসস্তুপ থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতে বড় ভুমিকা রেখেছেন যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশটির দায়িত্ব নেয়া জার্মান রাজনীতিবিদরা৷ 

জার্মানিতে আসার পর গত এক দশকে তিনটি জাতীয় নির্বাচন দেখার সুযোগ হয়েছে আমার৷ বাংলাদেশ থেকে আসা একজন সাংবাদিক হিসেবে জার্মান রাজনীতির যে তিনটি দিক আমার ভালো লেগেছে, সেগুলো তুলে ধরছি এখানে৷  

ব্যক্তি নয়, দেশ আগে 


জার্মানির রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে পরিবারতন্ত্র কিংবা ব্যক্তিস্বার্থের ছায়া দেখেনি আমি৷ বরং দেশের প্রয়োজনে, দলের প্রয়োজনে দলগুলোর শীর্ষ পদে পরিবর্তন আসতে দেখেছি৷ জার্মানির সবচেয়ে পুরাতন দল এসপিডি’র কথাই ধরুন৷ জার্মানির গত তিন সরকারের দু’টিতে মহাজোট সরকারের জুনিয়র পার্টনার হিসেবে রয়েছে দলটি৷ ২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে এসপিডি’র চ্যান্সেলর পদপ্রার্থী হন পেয়ার স্টাইনব্রুক৷ 

দক্ষ এই রাজনীতিবিদ নির্বাচনের আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন ভবিষ্যতে ম্যার্কেলের অধীনে মন্ত্রিসভায় আর কাজ করবেন না তিনি৷ অর্থাৎ চ্যান্সেলর হবেন, অথবা থাকবেন না মন্ত্রিসভায়৷ কিন্তু সেবছর নির্বাচনের ভোটাভুটির পর দেখা গেলো, এককভাবে বা সিনিয়র পার্টনার হিসেবে সরকার গঠনের মতো ভোট পায়নি এসপিডি৷ বরং সিডিইউ’র সঙ্গে সরকার গঠনই দল ও দেশের স্বার্থে মঙ্গলজনক৷

স্টাইনব্রুক তাঁর কথা রেখেছেন৷ তিনি জোট সরকার গঠনের পথে এসপিডিকে সহায়তা করেছেন বটে, তবে যোগ দেননি ম্যার্কেলের মন্ত্রিসভায়৷ 

২০১৭ সালের নির্বাচনের আগে এসপিডি’র চ্যান্সেলর প্রার্থী হলেন মার্টিন শ্যুলৎস৷ এই নির্বাচনে এসপিডি আগেরে চেয়েও কম ভোট পেলো৷ অন্যদিকে আশাতীতভাবে তৃতীয় অবস্থানে চলে গেলো অভিবাসী ও মুসলমনাবিরোধী উগ্র ডানপন্থি দল এএফডি৷ সেই নির্বাচনের পরপরই এসপিডি ঘোষণা দেয় যে, সিডিইউ’র সঙ্গে জোট গড়বে না তারা৷ বরং সংসদের বিরোধী দল হিসেবে থাকবে দলটি, যাতে এএফডি প্রধান বিরোধী দলের অবস্থানে যেতে না পারে৷ 

সেই ঘোষণার পর ম্যার্কেলও চেষ্টা করেছিলেন এসপিডিকে ছাড়া সবুজ দল এবং এফডিপিকে নিয়ে জোট গড়তে৷ কিন্তু কয়েকমাস চেষ্টার পরও সেটা সম্ভব হয়নি৷ ফলে, সরকার গঠন নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হয়৷ আলোচনা তখন নতুন আরেকটি নির্বাচনের দিকে যেতে থাকে৷ এমনকি কেউ কেউ ম্যার্কেলের পদত্যাগের সময় ঘনিয়ে এসেছে বলেও মনে করতে থাকেন৷ কিন্তু শেষমেষ এসপিডিকেই এগিয়ে আসতো হলো সিডিইউ’কে রক্ষায়৷ আবারো তৈরি হলো জার্মানির বড় দুই দলের মিলনে জোট সরকার৷ 

সেসময় দেশের, দলের স্বার্থে নিজের স্বার্থত্যাগ করেছেন মার্টিন শ্যুলৎস৷ জোট সরকারের মন্ত্রিসভাতে বড় পদ পেতে পারতেন, কিন্তু নেননি৷ এমনকি এসপিডি দলের শীর্ষপদটিও ছেড়ে দিয়েছেন তিনি৷ জার্মান রাজনীতিবিদদের কাছে দেশ, দলই যে সবসময় প্রাধান্য পায়, শ্যুলৎস তা আবারো প্রমাণ করেছেন শুধু৷ 


জনগণই শেষ কথা 

জার্মানির বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে রাজনীতির যে ফাঁকফোকড় গলিয়ে হিটলার দেশটির শাসক হয়েছিলেন, সেসব ফাঁকফোকড় এখন আর নেই৷ বরং রাজ্য এবং জাতীয় নির্বাচন থেকে চ্যান্সেলর পদে নির্বাচন অবধি পুরো প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল করা হয়েছে, যেখানে জনগণের আকাঙ্খার বাস্তবায়ন কয়েক ধাপে করা হয়৷ আর বলাই বাহুল্য, এদেশের নির্বাচন কমিশন, বিচারব্যবস্থা পুরোপুরি স্বাধীন৷ সেগুলোর উপর সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ নেই৷ 

এই দেশে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগের কথা আমি কখনো শুনিনি৷ বরং নির্বাচনের ফলাফল যা হয় তাই মেনে নিয়েই পরবর্তী পরিকল্পনা সাজায় দলগুলো৷ সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে ম্যার্কেলের শরণার্থী নীতি জার্মান সমাজের একাংশকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল৷ প্রায় দশলাখের মতো শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়াকে মেনে নিতে পারেননি তারা৷ নির্বাচনের ফলাফলে সেটার প্রতিফলন ঘটে৷ এএফডি নামের দলটি আশাতীত ভালো ফলাফল করে৷ 

নির্বাচনের পর নড়েচড়ে বসেন ম্যার্কেল৷ নতুন সরকার গঠনের উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি শরণার্থীদের প্রতি থাকা তাঁর উদার মানসিকতা থেকে কিছুটা সরে আসেন তিনি৷ রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন বাতিল হওয়া শরণার্থীদের ধরে ধরে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়৷ নতুন করে শরণার্থী নেয়ার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াও জটিল করা হয়েছে৷ এমনকি, ম্যার্কেল এমন একজনকে নতুন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছেন, যিনি শরণার্থী এবং মুসলমানদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর মানসিকতার রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত৷ সর্বোপরি ম্যার্কেল এই ঘোষণাও দিয়েছেন যে, যেসব মধ্য ডানপন্থি ভোটার গত নির্বাচনে তাঁর দলকে ভোট দেয়নি আগামী চার বছর তাদের মন জয়ের চেষ্টা করবেন তিনি৷ 

এখানে জার্মানির সংসদের আরেকটি ইতিবাচক দিক উল্লেখ না করলেই নয়৷ সেটা হচ্ছে, সাংসদদের ‘ফ্লোর ক্রসিংয়ের’ সুযোগ৷ অর্থাৎ সংসদে কোন বিষয়ে ভোটাভুটি হলে সেক্ষেত্রে দলীয় অবস্থানের বাইরে গিয়েও একজন সংসদ নিজের পছন্দমত ভোট দিতে পারেন৷ ফলে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলটি চাইলেই যে কোনো কিছু সংসদে অনুমোদন করিয়ে নিতে বা যে কোনো কিছু বাতিল করতে পারে না৷ এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেই৷ 

অনেক পশ্চিমা দেশে সমকামীদের মধ্যে বিয়ে বৈধ হলেও জার্মানিতে সেটা বৈধ ছিল না৷ গত বছর নির্বাচনের আগে এই নিয়ে ম্যার্কেলের উপরে চাপ সৃষ্টি করা হয়৷ ম্যার্কেল তখন এক পর্যায়ে ঘোষণা দেন যে, সংসদে এই বিষয়ে ভোটাভুটি হবে৷ সেই ভোটাভুটিতে সমকামীদের বিয়ে বৈধ করার বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন ম্যার্কেল৷ কিন্তু তাঁর দলের অনেক সংসদ পক্ষে ভোট দিয়েছেন৷ অর্থাৎ চ্যান্সেলর হয়েও সমকামীদের বিয়ে সংক্রান্ত প্রস্তাব ঠেকাতে পারলেন না ম্যার্কেল৷
জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দেয়ায় জার্মান রাজনীতিবিদদের মধ্যে প্রতিহিংসার রাজনীতি চর্চাও দেখা যায়না৷ যুক্তিহীনভাবে শুধুমাত্র খামখেয়ালিপনা থেকে আগের সরকারের কোন সিদ্ধান্ত পরের সরকার পরিবর্তন করেছে এমনটা আমি দেখিনি৷ বরং সরকার পরিবর্তনের প্রভাব উন্নয়নের ধারায় যাতে না পরে সেটার দিকে খেয়াল রাখেন রাজনীতিবিদরা৷ 

দেশবান্ধব পররাষ্ট্রনীতি

বাঙালি লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর চাচাকাহিনীতে লিখেছিলেন এক জার্মান সেনা কর্মকর্তার কথা যিনি নিজের মেয়েকে ত্যাজ্য করেছিলেন শুধুমাত্র সে এক ফরাসি যুবককে বিয়ে করেছিল বলে৷ ফ্রান্সের সঙ্গে জার্মানির অনেক পুরনো শত্রুতা ছিল৷ কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেই শত্রুতাকে ঝেড়ে ফেলে দুই দেশ বরং বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছে৷ এক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রেখেছেন দুই দেশের রাজনীতিবিদরা৷ আর সেই বন্ধুত্বের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক শক্তিশালী ইউনিয়নে পরিনত হয়েছে৷ 

জার্মানি এমন একটি দেশ যার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন এমনকি ইরানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে৷ অথচ এই দেশগুলোর একে অপরের মধ্যে কিন্তু বিরোধ চরমে৷ বিদেশি বিভিন্ন দেশ বা শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে জার্মান রাজনীতিবিদরা, কূটনীতিকরা নিজের দেশের স্বার্থকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন৷ আর দেশটির রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিদেশি নির্দিষ্ট কোন দেশ বা শক্তির দ্বারস্থ হয় না৷ ফলে দেশটির রাজনীতিতে বিদেশিদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নেই৷

আবার এমনও নয় যে, জার্মানির সব রাজনীতিবিদ ধোয়া তুলশি পাতা৷ তবে, জনগণের প্রতি তাদের জবাবদিহিতা তুঙ্গে৷ তাই, কোন রাজনীতিবিদ যদি বড় ধরনের অপকর্মে জড়ান, তাহলে তার রাজনীতি থেকে সরে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না৷ গত দশবছরে একাধিক রাজনীতিবিদকে আমি দেখেছি, যাদের অনেক বড় কিছু করার সুযোগ থাকলেও অপকর্মের দায় নিয়ে সরে যেতে হয়েছে৷