এম এ বাকী খলীলী
বেশ কিছুদিন ধরে ব্যাংক খাত নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। কারণও সংগত। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি, নতুন কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় আয়ের থেকে বেশি, দুটি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ব্যাপক পরিবর্তন, আরও নতুন তিন ব্যাংকের লাইসেন্স পাওয়ার খবর, কিছু ব্যাংকের একীভূত হওয়ার সম্ভাবনা এবং সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকেও পুঁজির ঘাটতি।
কয়েক দশক ধরে সরকারি ব্যাংক খাতে যে ঋণখেলাপি সংস্কৃতি চালু আছে, তা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তার বাইরে আছে কেলেঙ্কারি। কয়েক বছর আগে থেকে বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক এবং জনতা ব্যাংকের কেলেঙ্কারির পর ফের খবরের শিরোনাম হয়েছে জনতা ব্যাংক। সোনালী, জনতা ও অগ্রণীকে তাহলে ‘লিমিটেড কোম্পানি’ করে কী লাভ হলো? চার ব্যাংকের যে ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনা, সেগুলোর মোট পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। আবার ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকার বেশি। যদিও বহুলাংশে পুনঃ অর্থায়নের কারণে প্রতিবছর ঋণস্থিতি কম দেখানো হচ্ছে।
কিন্তু কী কারণে এই ঋণখেলাপির সংস্কৃতি? কেন সরকারি খাতে ব্যাংকগুলো দক্ষ হয় না? সরকার কেন ব্যাংক নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়? রাজনৈতিক অর্থনীতির দৃষ্টিতে এর সাধারণ কতগুলো কারণ আছে।
প্রথম কারণ, অর্থনৈতিক লক্ষ্য সামনে রেখে সরকার অগ্রাধিকার খাতে ঋণ দেয় এবং বাজেট ঘাটতি পূরণে ঋণ নেয়। অন্য কারণটি হচ্ছে রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ে থাকা লোকদের চাকরি অথবা আর্থিক সুবিধা (যেমন ঋণ দেওয়া, ঋণের পুনঃ অর্থায়ন করা, পর্ষদের মাধ্যমে সুদ এবং ঋণ মওকুফ) দেওয়া। এতে ব্যাংকের দক্ষতা মার খায়। আমাদের সংস্কৃতি ও আচরণ অনুসারে সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা সরকারের বা সরকারি রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারেন না।
দ্বিতীয়ত, বলতে গেলে ব্যাংকগুলোর মালিকানার কাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে। সরকারি ব্যাংকের পর্ষদ সদস্যরা সরকারেরই নিয়োগ করা লোক। নিয়োগ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেয় রাজনৈতিক বলয়ের লোকদের। সরকারি ব্যাংকগুলোতে গত কয়েক দশকে যাঁরা পর্ষদ সদস্য ছিলেন, তাঁদের অনেকেই অনভিজ্ঞ। চেয়ারম্যানদের অনেকেও আবার ব্যাংক ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক ছিলেন না। পর্ষদের অনুমোদন নিয়ে সমস্যাজড়িত বিশাল ঋণ দেওয়া হয়েছে ক্রমাগত। এত বড় বড় ঘটনা ঘটল অথচ পর্ষদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তাকে ধরা হয়। পর্ষদের প্রধান ভূমিকা তাহলে কী? সরকারি ব্যাংকের পর্ষদ সদস্যরা মালিকপক্ষের প্রতিনিধিত্ব করেন। পর্ষদের সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতা এবং সুশাসনের জন্য ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার জন্য স্বাধীন পরিচালকদের বড় ভূমিকা আছে, যা পুরোপুরি অনুপস্থিত। এখানেই হলো সরকারি ব্যাংকের মালিকানার কাঠামোগত বড় দুর্বলতা।
তৃতীয়ত, ব্যাংকের প্রশাসনে দক্ষতা বৃদ্ধি, ব্যাংকিং সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিতে দরকার ব্যাংকারদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারা। কিন্তু বাস্তবতা ঠিক উল্টো। ব্যবস্থাপনার উপরিকাঠামোতে পরিবেশ ভালো না থাকলে অনেক ক্ষেত্রে তা দুর্নীতি ও অদক্ষতার জন্ম দেয়।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থাও খুব ভালো নয়। কয়টা নতুন ব্যাংককে লাইসেন্স দেওয়া হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। যে কটি ব্যাংক লাইসেন্স পেয়েছে, তাদের উদ্যোক্তাদের অনেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সম্প্রতি সংসদে ব্যাংক আইন সংশোধিত হয়েছে। সে অনুযায়ী একই পরিবার থেকে সর্বোচ্চ চারজন পরিচালনা পর্ষদে থাকতে পারবেন। এখন ব্যাংক চালানো আরও কঠিন করা হলো। প্রত্যেক স্পনসর-শেয়ারহোল্ডার মনে করেন, তাঁরাই ব্যাংকের মালিক। এখন তা আরও প্রতিষ্ঠিত হলো।
ব্যাংকের সিদ্ধান্তে সুশাসন এবং জবাবদিহির জন্য কতকগুলো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়।
প্রথমত, সুশাসনের নীতি অনুসারে সরকারি ব্যাংকে স্বাধীন পরিচালক নিয়োগ করা। অর্থ মন্ত্রণালয় যাঁদের দেয় তা হলো তাদের প্রতিনিধি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীন পরিচালক নিয়োগ দেবে, যাঁদের অর্থনীতি এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা আছে এবং যাঁদের সঙ্গে স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকবে না।
দ্বিতীয়ত, সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য, যেকোনো পর্যায় থেকে যেকোনো মৌখিক সুপারিশ আসুক না কেন, তা লিখিত হতে হবে, না হলে কর্মকর্তা দায়বদ্ধ হবেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এই নির্দেশনা আসতে হবে।
তৃতীয়ত, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্ত হতে হবে। ব্যাংক খাতে কিছুদিন ধরে যা ঘটেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেও সে জন্য দায়ী। এত শাখা নিরীক্ষা করতে যান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা, তাতে আসলে কী ধরা পড়ে? ঋণখেলাপিদের দিকে বেশি নজর দেওয়া উচিত তাঁদের। বর্তমান অবস্থাকে জরুরি অবস্থা ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পুরো ব্যবস্থাপনা কাঠামো, নীতিমালা ও ব্যাংক কোম্পানি আইন পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের সূচনা করতে হবে। বর্তমান কাঠামো ও চর্চার মধ্যে যে সমস্যা আছে, তা মানতে হবে।
চতুর্থত, নিয়ম হওয়া উচিত, কোনো ঋণী তাঁদের আগের ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত নতুন ঋণ পাবেন না। একটার পর একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে শুধু ঋণের দ্বারা, আর একসময় ব্যাংককে এর বড় দায় নিতে হবে। এই চর্চা বন্ধ হওয়া উচিত।
পঞ্চমত, অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে আর্থিক বাজার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পুরোপুরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ছেড়ে দেওয়া। সরকারি ব্যাংকের ব্যাপারেও একই ভূমিকা থাকা উচিত। অর্থ মন্ত্রণালয় নিশ্চিতভাবে বোঝে যে ব্যাংক খাতের বর্তমান অবস্থার জন্য সরকারি ব্যাংকগুলো বড় দায়ী।
অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে স্থিতিশীল ব্যাংক ব্যবস্থা খুবই জরুরি। আর তাই বর্তমান অবস্থা থেকে ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী করতে দরকার একটি স্বাধীন এবং শক্তিশালী ব্যাংক কমিশন গঠন করা। একজন স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদের নেতৃত্বে অর্থনীতিবিদ, অভিজ্ঞ ব্যাংকার, ফিন্যান্সিয়াল অর্থনীতিবিদ, আর্থিক বিশ্লেষক, ব্যাংক খাত-সম্পর্কীয় বিশেষজ্ঞ আইনজীবী, নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতিনিধি, পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ এবং আর্থিক খাত-সম্পর্কীয়ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞকে নিয়ে এই কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এখনই সময়। ব্যাংক খাতের পুনর্গঠনে এবং সর্বোপরি জনগণের আস্থা অর্জনেও এই কমিশন গঠন ভালো প্রভাব ফেলবে। কিছু ব্যাংকের একত্রীকরণ হয়তো প্রয়োজন পড়বে, সেটি এই কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে করলে জনগণের আস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।
- এম এ বাকী খলীলী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের সাবেক অধ্যাপক
- Courtesy: Prothom Alo /May 09, 2018