Search

Wednesday, May 9, 2018

‘বন্দুকযুদ্ধ’ কি চলতেই থাকবে?

আইনানুগ পন্থার বিকল্প নেই

গত রোববার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার দৌলতপুর-পিপুলবাড়িয়া সড়কের পিপুলবাড়িয়া মাঠে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আলতাব হোসেন (৩৮) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন বলে পুলিশ-সমর্থিত সূত্রেই খবর পাওয়া গেছে। খবরটি জাতীয় সংবাদমাধ্যমে বিশেষ গুরুত্ব পায়নি সম্ভবত এই কারণে যে বন্দুকযুদ্ধে লোকজনের প্রাণ হারানো এখন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। রোববার বিকেলেই ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) হেফাজতে থাকা অবস্থায় আসলাম নামের এক ব্যক্তির মৃত্যুর খবরও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এভাবে বছরের পর বছর বন্দুকযুদ্ধে কিংবা নিরাপত্তা হেফাজতে মানুষের মৃত্যু ঘটে চলেছে, কিন্তু এ নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের তেমন কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।

একটা সময় ছিল, যখন বন্দুকযুদ্ধে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে জনসাধারণ জানার চেষ্টা করত, সেই ব্যক্তির চরিত্র কেমন ছিল; তিনি সন্ত্রাসী, ডাকাত, মাদক ব্যবসায়ী ইত্যাদি ছিলেন কি না; বা অন্য কোনো ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কি না। তারা যদি জানতে পারত যে নিহত ব্যক্তিটি অপরাধী ছিলেন, তাহলে তাঁর বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর ঘটনাকে অন্যায় বলে মনে করা হতো না। ওই ব্যক্তি যদি দুর্ধর্ষ প্রকৃতির ও কুখ্যাত অপরাধী হতেন, তাহলে জনমনে একধরনের স্বস্তিই দেখা দিত। সমাজে বন্দুকযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠত কেবল তখনই, যখন বন্দুকযুদ্ধে নিহত ব্যক্তিটি হতেন নিরীহ, নিরপরাধ, ভালো মানুষ।

বন্দুকযুদ্ধ সম্পর্কে সমাজের এই সাধারণ মনোভাব সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানগুলো এবং বন্দুকযুদ্ধ অনুমোদনকারী নীতিনির্ধারক কর্তৃপক্ষ অবগত ছিল বলেই মনে হয়। কারণ, প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধ হত্যাকাণ্ডের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রচার ও প্রমাণ করার চেষ্টা করত যে নিহত ব্যক্তিটি অপরাধী বা মন্দ লোক ছিলেন। বিষয়টা এমন যেন, অপরাধী হলেই বিনা বিচারে তাঁকে হত্যা করা জায়েজ হয়ে যায়।

এই মানসিকতা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়েছে। ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, বন্দুকযুদ্ধ ইত্যাদি নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদের দ্বারা মানুষ হত্যার ঘটনা এমন নিয়মিতভাবে ঘটে চলেছে, যেন এটাকে অপরাধ দমনের একটা স্থায়ী ও প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। যদিও সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো কখনো এসব হত্যাকাণ্ডকে বিচার ছাড়াই হত্যার ঘটনা বলে স্বীকার করে না এবং কাগজে-কলমে গোলাগুলির মধ্যে পড়ে প্রাণহানির বিবরণ দেওয়া হয়, তবু সেসব বিবরণ এখন সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, সেগুলো প্রায় একই রকমের গৎবাঁধা বিবরণ।

বন্দুকযুদ্ধে এখন অনেক নিরীহ-নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া যায়। এ ছাড়া সরকারবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনেক নেতা-কর্মীও এভাবে নিহত হয়েছেন বলে তাঁদের আত্মীয়স্বজন অভিযোগ করেন। গুম বা নিখোঁজ, নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাও প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, আইনানুগ পন্থার বাইরে এসব ঘটনার বিষয়ে সরকারের দিক থেকে অস্বীকারের সঙ্গে সঙ্গে নির্বিকার ভাবেরও প্রকাশ ঘটে। এর ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদের একাংশের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধের ভিন্নতর ব্যবহারের প্রবণতা দেখা দিয়ে থাকতে পারে, যার একটা বড় প্রমাণ নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের চাঞ্চল্যকর ঘটনা।

বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে বন্দুকযুদ্ধ ও নিরাপত্তা হেফাজতে ৪৬ জন মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক (২৮ জন) মানুষ নিহত হয়েছে পুলিশ বাহিনীর (ডিবিসহ) সদস্যদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে। পুলিশই আমাদের প্রধান আইন প্রয়োগকারী বাহিনী, তাদের কাছে প্রত্যাশা আইনানুগ পন্থা বা ডিউ প্রসেস। আইনবহির্ভূতভাবে অপরাধ দমনের এই প্রবণতা অবিলম্বে বন্ধ করা প্রয়োজন।

  • Courtesy: Prothom Alo /সম্পাদকীয় /May 09, 2018


No comments:

Post a Comment