আলফাজ আনাম
বাংলাদেশের রাজনীতিতে মানবিকতা ও সহমর্মিতার অবস্থান আর সম্ভবত থাকছে না। ভিন্ন মতের রাজনীতি নির্মূলের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তার বিষবাষ্প প্রজন্মের পর প্রজন্মকে হয়তো বহন করতে হবে।
রাজনীতিবিদদের জন্য জেল নতুন কোনো বিষয় নয়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত বহু রাজনৈতিক নেতা জেলে গেছেন। মাসের পর মাস জেলে থেকেছেন। এমনকি ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন কিংবা ওয়ান-ইলেভেনের অগণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও নেতারা জেলে গেছেন। কিন্তু জেলখানায় তারা চিকিৎসাসুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন কিংবা অসম্মানের সাথে রাখা হয়েছে- এমন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। কিন্তু এখন এসব অভিযোগকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সম্পর্ক আরো তিক্ত হয়ে উঠছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবার ঈদ করেছেন জেলখানায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে যখন ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন, তখন বিএনপি চেয়ারপারসনের দিন কাটছে কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যে। প্রধানমন্ত্রীর মতো প্রতি ঈদে তিনিও বিশিষ্ট ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতৃবর্গ আর কূটনীতিকদের সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন। এবার সেই সুযোগ তিনি পাননি। ফলে বিএনপির নেতাকর্মীদের জন্য ঈদের দিনটি ছিল আনন্দের নয়, বিষাদময়। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বিএনপি চেয়ারপারসনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন কিন্তু অনুমতি পাননি। তবে পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করতে দেয়া হয়েছে।
বিএনপির কয়েকজন নেতাকে যদি দলের চেয়ারপারসনের সাথে দেখা করার অনুমতি দেয়া হতো, তাহলে নিশ্চয়ই সরকারের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ত না। এর আগে বিএনপি নেতারা তার সাথে দেখা করেছেন। এবার দেখা করলে সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলন গড়ে উঠত তা নয়, বরং এতে বিএনপির নেতাকর্মীদের ক্ষোভ কিছুটা হলেও কমত। প্রধানমন্ত্রী ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় বলেছেন, দেশে এখন গণতন্ত্র সুরক্ষিত, কিন্তু তার প্রধান প্রতিপক্ষ দলের নেত্রী যখন কারাগারে এবং তার সাথে ঈদের দিনে দলের নেতাকর্মীদের দেখা করার সুযোগটুকু পর্যন্ত না দেয়ার অভিযোগ ওঠে; তখন গণতন্ত্রের সুরক্ষার দাবি বেশ বেসুরো শোনা যায় নাকি?
বেগম খালেদা জিয়া এবারই প্রথম জেলখানায় ঈদ করছেন, এমন নয়। এর আগেও তিনি জেলখানায় ঈদ করেছেন। ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের সময় তিনি দু’টি ঈদ জেলে কাটিয়েছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও তখন জেলে ঈদ করেছেন। ৭২ বছর বয়সের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থা ভালো নয়। এবার রমজানের সময় তিনি এক দিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকেরা দেখে এসে বলেছেন, তিনি মাইল্ড স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু সরকারের মন্ত্রী আর অ্যাটর্নি জেনারেল বলছেন, তার সুগার ফল করেছিল বলে তিনি কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। সুগার ফল করুক বা মাইল্ড স্ট্রোকে আক্রান্ত হোক, এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় তার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়, বরং জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন।
সরকার চায় তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা হোক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। খালেদা জিয়া এ দুই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে রাজি হচ্ছেন না। বিএনপি নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়ার হাঁটুতে কিছু ধাতব বস্তু প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। খুবই স্পর্শকাতর এসব বন্তু নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যে ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতিসম্পন্ন পরীক্ষাগার দরকার, তা ইউনাইটেড হাসপাতালে আছে। এ ছাড়া, এই হাসপাতালে তিনি আগেও চিকিৎসা নিয়েছেন। সেখানকার চিকিৎসকদের ওপর তার আস্থা আছে।
শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষা নয়, রোগীর সাথে চিকিৎসকের আস্থার সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যখন কারাগারে ছিলেন তখন তিনি তার আস্থা আছে, এমন চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন। সে সময় ডা: সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী এবং ডা: প্রাণগোপাল দত্ত তার চিকিৎসার জন্য একাধিকবার দেখা করেছেন তার সাথে; ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন। তার ইচ্ছা অনুযায়ী স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। বেগম জিয়া এ ধরনের চিকিৎসাসুবিধা চাইছেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষা নয়, বেগম খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা দরকার। সুচিকিৎসার জন্য তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হতে চান। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের নেতারা তিনি কেন সিএমএইচে চিকিৎসা নিতে রাজি হচ্ছেন না, তা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। অনেকটা এমন যে, সাবেক সেনাপ্রধানের স্ত্রী সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে রাজি না হওয়া রহস্যজনক। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে চিকিৎসার জন্য সিএমএইচ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তিনি নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপর তিনি হাসপাতাল থেকে সরাসরি সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। চিকিৎসার পর তিনি বিনা ভোটে এমপি হয়েছিলেন। খালেদা জিয়া কেন সিএমএইচে যেতে চান না, তা তার নিজস্ব ব্যাপার। চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়।
বেসরকারি হাসপাতালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেত্রী চিকিৎসাসুবিধার অনুমতি না পেলেও দেশের অনেক বড় অপরাধী ও শীর্ষ মাদক কারবারিরা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে আমরা একটি খবর দেখে নিই। ‘কোমর ব্যথা’ নিয়ে ভর্তি হয়ে টানা ১৮ মাস হাসপাতালের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে আরাম-আয়েশে কাটাচ্ছেন ইয়াবা ব্যবসায়ী আমিন হুদা। অথচ কারা কর্তৃপক্ষের কাগজপত্রে এ রোগীর ‘বুকে ব্যথা’র কথা বলা হয়েছে। চিকিৎসাব্যয়ের বাইরে হাসপাতালের ভিআইপি কেবিনের জন্য আমিন হুদা ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধকোটি টাকা বিল দিয়েছেন। তিনি মাঝে মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়িচালককে নিয়ে ভ্রমণে বের হন। বারডেম হাসপাতালে কারাবন্দীদের রাখার নিয়ম নেই; কিন্তু মাসের পর মাস সেখানে থাকছেন সাজাপ্রাপ্ত ওই আসামি। শাস্তি হওয়ার পর এ পর্যন্ত কয়েকবার ‘হাজিরা’ দিতে দু-এক ঘণ্টার জন্য কারাগারে গেছেন তিনি। এবার টানা ১৮ মাস ধরে হাসপাতালে আছেন। হাসপাতালের ৬, ৮, ৯ ও ১৫ তলার বিভিন্ন কক্ষে ঘুরেফিরে থাকছেন তিনি। ( প্রথম আলো, ৭ মে ২০১৭)।
সারা দেশে এখন মাদকবিরোধী অভিযান চলছে। এ পর্যন্ত দেড় শতাধিক মাদক কারবারি নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন নারীও আছে। এর মধ্যে ইয়াবা ব্যবসায়ের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে টেকনাফে একরামুল হক নামে ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা নিহত হওয়া নিয়ে তোলপাড় চলছে। কিন্তু ইয়াবার গডফাদার হাসপাতালে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে থাকছেন। শুধু মাদক কারবারি নয়, ব্যাংক থেকে টাকা লুটের সাথে জড়িত আসামিরাও বারডেমের মতো বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার নামে মাসের পর মাস অবস্থান করছেন।
এর চেয়ে আর অমানবিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কী হতে পারে, একজন মাদক কারবারি যে সুবিধা পায়, একজন শীর্ষ রাজনৈতিক নেত্রীকে সেই সুবিধা দিতেও সরকার রাজি হচ্ছে না। মনে হয়, খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে সরকার এক ধরনের সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে আছে কিংবা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাইছে না। বেগম জিয়ার চিকিৎসার বিষয়টি এখন রাজনৈতিক জেদাজেদির বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যেহেতু বিএনপি ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করাতে চাইছে, সেখানে ভর্তি করানো হলে সরকারের পরাজয় হবে- এমন ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে ক্ষমতাসীন মহলে। কিন্তু একজন অসুস্থ ও বয়স্ক রাজনৈতিক নেত্রীর চিকিৎসা নিয়ে টানাটানি বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি যে জনমনে সহানুভূতি সৃষ্টি করছে, তা অনুধাবন করতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। এ ছাড়া, খালেদা জিয়া যে অসুস্থ তা সব চিকিৎসক বলেছেন। কিন্তু চিকিৎসার চেয়ে রাজনীতি যেন বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
খালেদা জিয়া গ্রেফতারের পর থেকে ক্ষমতাসীন দলের কৌশল হলো, বিএনপির চেয়ে খালেদা জিয়ার ওপর বেশি চাপ সৃষ্টি করা। বিএনপি নেতারা আশা করেছিলেন, বেগম জিয়া গ্রেফতার হলেও দ্রুত জামিন পাবেন। এর কারণ হিসেবে তারা বলেছিলেন, তাকে যে মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে, এমন মামলায় অন্য আসামিরা দ্রুত জামিন পেয়েছেন। এমনকি, খালেদা জিয়া গ্রেফতারের পর ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু ১৯ ফেব্রুয়ারি নয়া দিগন্তের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আপিল করলে হয়তো তিনি জামিন পাবেন। একজন নারী ও বয়স্ক মানুষ, একই সাথে দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি জামিন পেতে পারেন বলে আমার ধারণা।’ না, আবদুল মতিন খসরুর এ ধারণা বাস্তবে রূপ পায়নি। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে একটি অন্য মামলায় তিনি জামিন পেলেও তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো একের পর এক সচল হয়েছে। তার জামিন কার্যকর হওয়ার আগেই উচ্চ আদালতে হয়তো তার মামলার রায় চলে আসবে।
বেগম জিয়াকে কারাগারে রেখে বা তাকে চিকিৎসাসুবিধা থেকে বঞ্চিত করে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এক ধরনের রাজনৈতিক বিজয়ের আনন্দ পাচ্ছেন। ‘স্যাডিস্টিক পলিটিক্যাল প্যাথলজি’ বলে একটা কথা আছে। এর অর্থ, একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাওয়া। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে হয়তো কেউ কেউ বিকৃত জয়ের আনন্দ পাচ্ছেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন দলের এমন অন্যায় অবস্থান সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করছে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ১৪ দলের সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিম একটি দৈনিকের সাথে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘খালেদা জিয়া মুক্ত হবেন এবং নির্বাচনে অংশ নেবেন।’ ক্ষমতাসীন দলের মনোভাব যদি সত্যিই এ রকম হয়, তাহলে তার চিকিৎসা নিয়ে কেন এমন টানাহেঁচড়া চলছে? নাকি আবদুল মতিন খসরুর মতো মোহাম্মদ নাসিমের এ বক্তব্য শুধুই আশাবাদ, বাস্তবে যার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল ইতোমধ্যে অনেক চাপ ও দায় নিয়ে ফেলেছে। এখন খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক কৌশল বড় ধরনের বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। কারণ, সময়ের নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতে নয়।
- কার্টেসিঃ নয়াদিগন্ত/ জুন ১৯,২০১৮