এমাজউদ্দীন আহমদ
গত দুই মাসে দুটি সিটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথমটি খুলনা সিটি নির্বাচন শেষ হয়েছিল ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটিসহ নানা অনিয়মের মধ্য দিয়ে। খুলনা সিটি নির্বাচনের পর নির্বাচন কমিশনের কাছে বিভিন্ন মহলের দাবি ছিল, খুলনায় উত্থাপিত অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার। এ কথাও বলা হয়েছিল, খুলনার তিক্ত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে গাজীপুর সিটি নির্বাচন প্রশ্নমুক্ত করার সর্বাত্মক প্রয়াস যেন তারা রাখে।
এসব দাবি নির্বাচন কমিশন আমলে নিয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়নি গাজীপুর সিটি নির্বাচনে। তারা তাদের সেই পুরনো রেকর্ডই বাজিয়েছে। গাজীপুরে কয়েকটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হলেও অনিয়মের অভিযোগ ছিল আরও বিস্তৃত। সামনে আরও তিনটি সিটিতে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। বরিশাল, রাজশাহী, সিলেট সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা আশঙ্কা নিয়েই শুরু হয়েছে প্রচার কার্যক্রম। এই তিনটি সিটিতে কি বিগত দুই সিটির নির্বাচনেরই পুনরাবৃত্তি ঘটবে- এমন প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন ও সুশাসনের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। এ কথা তো সত্য যে, জনবান্ধব রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও দক্ষ-নির্মোহ কর্মকর্তারাই সুশাসন নিশ্চিত করতে পারেন। এর সঙ্গে উন্নয়নের বিষয়টিও জড়িত। প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা যদি চাপমুক্ত থাকতে না পারেন কিংবা তারা যদি নিজেদের জনগণের সেবক মনে না করে দল কিংবা কোনো মহলকে তুষ্ট করতেই মনোযোগী হন, তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব সমাজ ও রাষ্ট্রে পড়তে বাধ্য। আমাদের প্রশাসনের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রায় সব স্তরেই কমবেশি গলদ রয়েছে। এর জন্য ব্যবস্থা যেমন দায়ী, তেমনি ক্ষমতাসীনদের মানসিকতাও দায়ী। সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি কোনোই ইতিবাচক ফল দিচ্ছে না। কেন দিচ্ছে না, এর পেছনের কারণ কী তা দেশের সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুণগত মান নিয়ে নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ নিষ্প্রয়োজন। আমাদের প্রত্যাশা মোতাবেক সুশাসন নিশ্চিতকরণের পথে অন্তরায় কী তা যেমন সচেতন মানুষ মাত্রই জানা, তেমনি নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের নানা দুর্বলতার কারণে প্রশ্নমুক্ত, অবাধ, স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলোও অজানা নয়। খুলনার মতোই গাজীপুর সিটি নির্বাচনেও বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টরা কেন্দ্রে থাকতে পারেননি- এই অভিযোগ শুধু বিএনপির তরফেই উত্থাপিত হয়নি, গণমাধ্যমেও এই সংবাদ প্রকাশিত-প্রচারিত হওয়ার পাশাপাশি ব্যালট পেপারে বলপূর্বক সিল মারার চিত্র চোখে পড়েছে গণমাধ্যমেরই কল্যাণে।
যে নির্বাচনে প্রার্থীর এজেন্টরা কেন্দ্রে উপস্থিত থাকতে পারেননি কিংবা থাকতে দেওয়া হয়নি সেই নির্বাচন প্রশ্নমুক্ত হয়েছে তা কী করে বলা সম্ভব? এ হলো অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার একটি দিক। এ ছাড়াও তো আরও নেতিবাচক চিত্র আমাদের সামনে রয়েছে। যে কোনো নির্বাচনে সমতল ভূমি নিশ্চিত করার বিষয়টি সর্বাগ্রে জরুরি। ভীতিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করাও সমভাবেই জরুরি। প্রার্থীর এজেন্ট কেন্দ্রে উপস্থিত আছেন কিনা, তিনি তার দায়িত্ব ভীতি বা চাপমুক্তভাবে পালন করতে পারছেন কিনা- এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের দায়দায়িত্ব রয়েছে। নির্বাচনে অনিয়ম-অস্বচ্ছতার অভিযোগ উত্থাপিত হলে তা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই। যদি এভাবেই চলতে থাকে তাহলে আমাদের গণতন্ত্রের জন্য তা শুভ হবে না। এর পরিণতি ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াতে পারে। নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সবার প্রতিই থাকবে নির্মোহ, এটিই তো স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই প্রত্যাশা বারবার হোঁচট খাচ্ছে। এই যখন অবস্থা তখন বরিশাল, রাজশাহী, সিলেট সিটি নির্বাচন নিয়ে নিরুদ্বিগ্ন থাকার অবকাশ আছে কি? সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেসব অন্তরায় বিদ্যমান সেসব নিরসনে নির্বাচন কমিশন কতটা আন্তরিক- এমন প্রশ্নের উত্তর প্রীতিকর নয়। সু
ষ্ঠু, অবাধ, প্রশ্নমুক্ত নির্বাচনই সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিতকরণের পথ সুগম করতে পারে। দায়িত্বশীলদের সব ক্ষেত্রেই সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠ থাকতে হবে- এই দাবি নানা মহল থেকেই গুরুত্বের সঙ্গে বারবার উঠছে। আমরা আশা করি, দায়িত্বশীলরা এসব যৌক্তিক দাবির ব্যাপারে সজাগ ও সতর্ক হবেন।
জনমনে এই শঙ্কা সঙ্গতই এখন প্রকট যে, আসন্ন তিন সিটির নির্বাচনেও খুলনা-গাজীপুর মডেল বাস্তবায়ন করা হতে পারে। যদি এমন নির্বাচনই হয় তাহলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা আরও বাড়বে এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশাটা মাঠে মারা যেতে পারে। অনিশ্চিত সংকটের মুখোমুখি হতে পারে দেশ। মানুষ চায় নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তারা তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করুক। সত্যিকারভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে একটি নির্বাচন করতে যেসব পূর্বশর্ত প্রয়োজন এর অনেক কিছুরই ঘাটতি ছিল খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনে।
খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনের আগে বিতর্ক ছিল এবং দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নির্বাচনের পর তা আরও পুষ্ট হয়। এ অবস্থায় হতে যাচ্ছে বরিশাল, সিলেট, রাজশাহী সিটি নির্বাচন। নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এটি সত্য; কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাও অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারকে অবশ্যই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাইতে হবে। সরকার যদি সুষ্ঠু কিংবা প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন না চায় এবং এ জন্য যথাযথ সহযোগিতা না করে, তাহলে কোনোভাবেই প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন করা সম্ভব নয়। সরকার হলো এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সহযোগী শক্তি এবং কমিশনকে যথাযথ সহযোগিতা দান করা সরকারের কর্তব্য। নানাভাবে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা হয়। এভাবে চললে সংকট বাড়বে। বরিশাল, রাজশাহী, সিলেট সিটি নির্বাচনে যদি খুলনা-গাজীপুরের ঘটনাবলিরই পুনরাবৃত্তি ঘটে, তাহলে আমাদের গণতন্ত্র ও ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য তা শুভ হবে না।
এ কলামেই কয়েকদিন আগে লিখেছিলাম আমাদের রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতি-প্রকৃতি ও বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে। দেশে ভিন্ন মতাবলম্বীদের সভা-সমাবেশ করাসহ অন্যান্য অধিকারের পথ যেন ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত রক্তস্নাত বাংলাদেশের সংবিধানে সবার সমান অধিকারের কথা লেখা আছে। কিন্তু বাস্তবে কি এর প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়? সমাজ ও রাষ্ট্রে নাগরিকরা ভয়মুক্ত থেকে অধিকার ভোগ করবেন, এটিই তো স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতা যেন আর বিনষ্ট না হয়, সেটিই আমাদের দাবি।
বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে গণতন্ত্রের উপাদান কতটা আছে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এমন প্রশ্নও দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা এখানে নিয়ন্ত্রণমুক্ত নয়। আর এ কারণেই জবাবদিহি-দায়বদ্ধতার পাটও ক্রমেই চুকে যাচ্ছে। সাংবিধানিক সংকট আর রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। বিদ্যমান সংকট নিরসনে সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকারের দায়িত্বশীলদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে, তারা মানুষের অধিকারের সমতল ভূমি নিশ্চিত করতে প্রতিবন্ধক নন। পরমতসহিষুষ্ণতা, সমান অধিকার নিশ্চিত করা, ভীতিমুক্ত পরিবেশে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করে যাওয়া ইত্যাদি হলো গণতন্ত্রের সৌন্দর্যের অন্যতম উপকরণ।
এসব বিষয় আমাদের নাগরিক ও রাজনৈতিক মহলে কতটা নিশ্চিত- এ প্রশ্নের উত্তরও প্রীতিকর নয়। তারপরও আমরা প্রত্যাশা করি, গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে দায়িত্বশীলরা আন্তরিকতার পরিচয় দেবেন।
আসন্ন তিনটি সিটি নির্বাচন কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য কি হবে? পারবেন কি ভোটদাতারা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে? ভোট প্রার্থীরা কি পারবেন তাদের নির্বাচকমণ্ডলীর সঙ্গে নিরাপদে যোগাযোগ করতে? এসব প্রশ্নের সার্থক উত্তর দেওয়ার দায়দায়িত্ব যাদের, তারা যদি নিজ নিজ দায়িত্ব নির্মোহভাবে এবং নিষ্ঠার সঙ্গে পালনে ব্রতী হন, তাহলেই নেতিবাচকতার পথ সংকুচিত হতে পারে। গণতন্ত্র তো শুধু একটি শাসন ব্যবস্থা নয়, গণতন্ত্র এক ধরনের নৈতিকতা। এক ধরনের পরিশীলিত কর্মপ্রবাহ। আমাদের দায়িত্বশীলরা এসব বিষয় ভুলে না গেলেই মঙ্গল।
- সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী
- কার্টসিঃ সমকাল/ জুলাই ১৭,২০১৮