Search

Monday, July 30, 2018

রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও অর্থনৈতিক ফলাফল — অন্তর্ভুক্তির অনুপস্থিতিতে এককেন্দ্রিকতা (১৯৭১-৭৫)

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর



ভবিষ্যত্মুখীন অতীত বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের বহমান অর্থনীতির দশকওয়ারি ভাগ করা যেতে পারে; আবার বৈশিষ্ট্যগুলোকে নির্দিষ্ট করে চলমানতার পর্ব অনুযায়ী বিভক্তি হতে পারে। এ নির্দিষ্টকরণ এ কারণে জরুরি যে, ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে অতীতের শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেই গুরুত্বের দাবি থেকে এখানে বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য খোঁজার চেষ্টা করা হবে।

অতীতের আলোকে বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য খুঁজতে গেলে কতগুলো বিষয় মনে রাখতে হবে। অর্থশাস্ত্রের মূলধারায় অর্থনৈতিক উপাদানের মধ্যেই অর্থনৈতিক ফলাফল নির্ণয়ের চেষ্টা চলে। অর্থনৈতিক উপাদানের বাইরের বিষয়গুলো তাত্ত্বিক কাঠামোয় বহিঃস্থ প্রদত্ত চলক হিসেবে গণ্য করে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পরিবর্তনের আলোকে অর্থশাস্ত্র খাপ খাইয়ে নেয়ার নিয়ত চেষ্টারত। তাত্ত্বিক কাঠামোয় কী কী চলক অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, তা নিয়ে একমত না হতে পারলেও নিঃসন্দেহে এ কথা বলা যেতে পারে, অর্থশাস্ত্র তার চলমান ধারায় এ ঐকমত্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে যে রাষ্ট্র, রাজনীতি, ঐতিহাসিক গতি-প্রকৃতি এবং প্রতিষ্ঠান তথা আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক নিয়ম-নীতি, আচার-আচরণ, রেওয়াজ, মূল্যবোধ ইত্যাদি অর্থনৈতিক ফলাফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে স্বাভাবিক কারণেই প্রতিষ্ঠানমুখীন সমাজবিজ্ঞানে একাধিপত্য বিস্তারকারী এ শাস্ত্রের আত্মপরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি ধীরলয়ের। তাত্ত্বিক কাঠামোর এ সীমাবদ্ধতা এবং ওই কাঠামোর প্রতি একনিষ্ঠতার কারণে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও অর্থনীতির আন্তঃসম্পর্ক বিচার করে তার আলোক থেকে দেখার চেষ্টা থেকে অনেকেই বিরত থেকেছেন। হয়তোবা অনেকেই ওই বৃত্তেই থেকে যেতে চান! রাষ্ট্র, রাজনীতি ও অর্থনীতির আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ‘কেতাবি’ কোনো তাত্ত্বিক কাঠামোও নেই। অধিকাংশের জন্য ব্যবহারযোগ্য তাত্ত্বিক কাঠামোহীনতা যেমন সীমাবদ্ধতা তৈরি করে, তার চেয়ে বেশি করে সৃজনশীলতার অনেক রাস্তা খুলে দেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যে কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশে পুঁজিবাদী রূপান্তর বা উন্নয়নের টেকসই রূপান্তর ঘটেছে, তাদের সঙ্গে আগের উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বড় রকমের পার্থক্য লক্ষণীয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে হাতেগোনা গুটিকয়েক রাষ্ট্রের টেকসই অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটেছে। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এ টেকসই রূপান্তরিত দেশের তালিকায় রয়েছে। অন্যদিকে কতগুলো রাষ্ট্রের কোনো কোনো সময় মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি বেড়েছে। আবার পরবর্তীতে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বিপর্যয় ঘটেছে। ফলে বিপরীতমুখী পরিবর্তন হয়েছে, যেমন— ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, পাকিস্তান। এসব দেশ টানা অগ্রগতির মাধ্যমে স্থিতিশীলতা অর্জন করেনি। অর্থাৎ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলেই চলবে না, টেকসই হয়ে স্থিতিশীল হতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর টেকসই অর্থনৈতিক বিবর্তন অর্জনকারী দেশগুলোয় সক্রিয় রাষ্ট্রের উপস্থিতি লক্ষণীয়। টেকসই রূপান্তরে রাষ্ট্র শুধু নিজেকে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির মধ্যে সীমিত করেনি। রাষ্ট্র যেমন একদিকে পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রণোদনা প্রদান করেছে, তেমনি যদি পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রণোদনার অপব্যবহার হয়েছে, রাষ্ট্র কঠোর হাতে পুঁজিপতিদের দমন করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা বজায় রেখেছে। এ দুই হাতের সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে অত্যন্ত প্রভাবশালীও বাদ পড়েনি। দক্ষিণ কোরিয়া বা চীন থেকে অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর টেকসই অর্থনৈতিক বিবর্তন অর্জনকারী দেশগুলো সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছে, অতীতের উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোকে হুবহু অনুসরণ করেনি, ইতিহাসলগ্নতায় নিবিষ্ট থেকে দেশোপযোগী কৌশল উদ্ভাবন করেছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে অনেক অতি উৎসাহীর আড়ম্বরপূর্ণ অথবা কদর্যময় বাগাড়ম্বরের অভাব ঘটেনি। জন্ম থেকেই চলছে। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ দিয়ে শুরু হয়েছিল। একটু চিনির প্রলেপ লাগিয়ে বলা হয়েছিল ‘টেস্ট কেস’। বেশ কয়েক বছর তাদেরই কোনো না কোনো তরফের উত্তরাধিকারীরা ‘বাংলাদেশ’-এর পরে ‘প্যারাডক্স’, ‘সারপ্রাইজ’ বা ‘ধাঁধা’ বা ‘আপাতবৈপরীত্য’ বা ‘আশ্চর্য’ বৈশিষ্ট্য যুক্ত করছেন। সাম্প্রতিককালে ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’ চালুর চেষ্টা লক্ষণীয়। এ বাগাড়ম্বরগুলো গোষ্ঠী স্বার্থ হাসিল বা তাঁদের নিজস্ব অস্তিত্বকে জাস্টিফাই করার ধূম্রজাল সৃষ্টির জন্য করা হয়ে থাকে বলেই এ কথামালা বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে না এবং পরবর্তীতে যখন তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়, তখন অসারতায় পর্যবসিত হয়।

বাংলাদেশের আলোকে বাংলাদেশকে দেখতে হলে বা বাংলাদেশের উন্নয়নের দশকওয়ারি অথবা পর্ব অনুযায়ী বৈশিষ্ট্য খুঁজতে গেলে একদিকে যেমন উৎপাদনের উপকরণ তথা ভূমি, পুঁজি, শ্রমশক্তি, প্রযুক্তির গতিপ্রকৃতি ও পরিবর্তন অনুসন্ধান করতে হবে; পাশাপাশি রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক যথা— জনগণ কী ধরনের রাষ্ট্র চেয়েছে, রাষ্ট্র আসলে কী ধরনের রূপ নিয়েছে এবং কার দ্বারা ও কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তা বিবেচনায় নিতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের আন্তঃসম্পর্কে কী ও কীভাবে পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয়, এ রাষ্ট্রটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে হয়েছে। এই মহান মুক্তিযুদ্ধের একটি ইতিহাসলগ্নতা আছে, তা যেমন পাকিস্তান সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত, তেমনি বাংলাদেশ সৃষ্টির সঙ্গেও। পাকিস্তান সৃষ্টির যৌক্তিক ব্যাখ্যা জানা যেমন প্রয়োজনীয়, ওই রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্রুত মোহভঙ্গের কারণ জানা দরকার। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত তিনটি স্তম্ভ— সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার— বাংলাদেশ বিশ্লেষণের তাত্ত্বিক কাঠামোর মৌল চলক। অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবহমানতা বোঝার জন্য রাজনৈতিক বন্দোবস্তও বোঝা জরুরি।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে কেন উৎপাদনমুখীন অবস্থা তৈরি হলো না কিংবা স্বাধীনতা-পরবর্তী যে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্রের তথা আপামর জনতার স্বপ্নের, সে বাংলাদেশ তৈরি হলো না? এটাই মৌলিক প্রশ্ন। এ প্রশ্নের যদি মীমাংসা করতে হয়, তাহলে ভবিষ্যতের বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বিনির্মাণে তা যথেষ্ট শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের কর্মকৌশল প্রণয়ন করা যাবে এবং বর্তমানে যে ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে তা সহজসাধ্য হয়ে যাবে। স্বাধীন বাংলাদেশে এ বিষয়গুলো কেন বাস্তবায়ন হলো না, তার মীমাংসা রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সঠিক অনুসন্ধানের মধ্যে নিহিত। রাজনৈতিক বন্দোবস্তের চরিত্র লক্ষ করলে এর ইতিবাচক দিকটি হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো রাষ্ট্রই রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেনি। তার মানে এ দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিশ্রুতির জায়গাটি ছিল অনেক বড়। কেন, কী কারণে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসনিক যন্ত্র সে ধরনের কর্মকৌশল প্রণয়ন করতে কিংবা আমলাতন্ত্র সেই কর্মকৌশল কেন বাস্তবায়ন করতে পারল না— এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এবং এটি মীমাংসা করাও জরুরি। যদি এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে সেই অনুযায়ী কর্মকৌশল নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে যে ধরনের বাংলাদেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেই দেশের পথে অগ্রসর হওয়া যাবে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে পুঁজির আকাল ছিল। সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয়েছিল, পুঁজি মূলত কৃষির উদ্বৃত্ত ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে আসবে। কৃষি থেকে উদ্বৃত্ত হলো না। কৃষিতে দিন দিন প্রান্তিক কৃষক যেমন বাড়তে থাকল, তেমনি বাড়তে থাকল ভূমিহীনের সংখ্যা। কৃষিতে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বাড়ার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার দরকার ছিল, তেমনি দরকার ছিল উৎপাদনের উপকরণের সহজলভ্যতা ও মহাজন-ফড়িয়া-বর্গাদার তথা বাজার ব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের থেকে কৃষকদের পরিত্রাণ। ‘সবুজ বিপ্লবে’র ডাক দেয়া হলো কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রদত্ত গভীর নলকূপ ব্যবহারের জন্য গঠিত কৃষক সমবায় সমিতির হর্তাকর্তা যেমন বনে গেলেন শাসকদলের গ্রাম পর্যায়ের নেতা বা তার অনুসারী, অন্যদিকে সারের ডিলার হলেন শাসকদলের গ্রাম পর্যায়ের ওই বা আরেক নেতা বা কর্মী। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের নিজস্ব সম্পদ বাড়তে থাকল কিন্তু উৎপাদনশীল পুঁজি তৈরি হলো না। কৃষিকে আরেক বড় ওজন বয়ে চলতে হলো। অন্য কর্মসংস্থান প্রদানের খাত না থাকায় অধিকাংশ মানুষকে কৃষির ওপর নির্ভরশীল থাকতে হলো। এ অধিকাংশ ছদ্মবেকারের উপার্জনও কম। ফলে তাদের কোনো সঞ্চয় থাকল না, বরং ঋণ নিয়ে জীবন নির্বাহ করতে হলো— এ বিশাল জনগোষ্ঠীও কোনো পুঁজি জোগান দিতে পারল না।

অন্যদিকে পরিত্যক্ত শিল্প-কলকারখানা পরিচালনার জন্য অগত্যা রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হলো। খুবই কমসংখ্যক বাঙালির শিল্পমালিকানা ছিল। এগুলোও জাতীয়করণ হয়েছিল। পরিত্যক্ত শিল্প-কলকারখানার তুলনায় জাতীয়করণের সংখ্যা নগণ্য ছিল। এখানে যে বিষয়টি পরিষ্কার করা এবং বোঝা দরকার তা হচ্ছে, যে জাতীয়করণ করা হয়েছিল, তা কি আদর্শগত, না তা তত্কালীন পরিপ্রেক্ষিতের বাস্তবতা। এ কলকারখানা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন সরকারি দলের নেতা বা সমর্থনপুষ্ট ব্যক্তি বা আমলা। এ প্রশাসকরা প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতির মাধ্যমে উদ্বৃত্ত তৈরি ও বিনিয়োগের পরিবর্তে লুটপাট শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই আগের লাভজনক প্রতিষ্ঠান লোকসানি রোগাক্রান্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় ।

শিল্পের বিকাশ হচ্ছিল না, কিন্তু এক ধরনের বাণিজ্যনির্ভর শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটছিল। তারা যতটা না শিল্প স্থাপনে নিজেদের নিয়োজিত করছিল, তার চেয়ে একজন বেনিয়া বা আমদানিকারক হিসেবে কাজ করার আগ্রহের পরিমাণ তাদের মধ্যে বেশি ছিল। পুঁজির বিকাশ ঘটছিল এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই। পুঁজিকে উৎপাদনমুখী কাজে ব্যবহারের জন্য বা শিল্পের ভিত্তি স্থাপনের তেমন কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। রাষ্ট্র উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে জুতসই কোনো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেনি, যার মাধ্যমে শিল্পের বিকাশ ঘটানো যায়। তবে পরিকল্পনা কমিশনের আমদানি বিকল্প শিল্প নির্মাণের এক ধরনের প্রচেষ্টা ছিল। কিন্তু শাসকদলের চরিত্রের সঙ্গে এ পরিকল্পনাগুলোর যোজন দূরত্ব ছিল। শাসকদলের অধিকাংশ সদস্য মধ্যবর্তী শ্রেণীগুলোর অংশভুক্ত ছিল। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে নিজস্ব সম্পদ বাড়ানোই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। পরিকল্পনাগুলো এতটাই রাজনীতি থেকে বিযুক্ত ছিল।
বাংলাদেশে পুঁজির ঘাটতিমূলক পরিস্থিতি এবং সঞ্চয় ও বিনিয়োগের পার্থক্য মেটাতে বৈদেশিক সাহায্যের আবির্ভাব ঘটল। কম দেশীয় সঞ্চয় মোকাবেলার জন্য বৈদেশিক সাহায্যকে পুঁজি সরবরাহের একটি বড় ক্ষেত্র হিসেবে দেখা হলো। বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে পুঁজি সরবরাহ করলেন তারা, একটি নির্ভরশীলতার অর্থনীতিরও জন্ম দিলেন। এ নির্ভরশীলতা দেশের মধ্যে এক ধরনের নির্ভরশীল শ্রেণী তৈরি করল। এ নির্ভরতা থেকে পশ্চিমা বিশ্বের হেজিমনি তৈরির রাস্তা সুগম হতে থাকল। শাসককুলের মধ্যে আস্তে আস্তে তাদের চিন্তা-চেতনা প্রবেশ করতে থাকল এবং আস্তে আস্তে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব বাড়তে থাকল।

যুদ্ধ-পরবর্তী যেকোনো দেশের মতোই বাংলাদেশে দক্ষ জনশক্তির অভাব ছিল। বিশাল পরিমাণ জনগোষ্ঠীর কাজ ছিল না। ব্যাপক পরিমাণে জনগোষ্ঠী কৃষির ওপর নির্ভর ছিল। শিল্প বিকাশের অভাবে নতুন কোনো কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছিল না, আবার কৃষির ওপর অধিকাংশ মানুষের নির্ভরশীলতার কারণে প্রকৃত খাত বাড়ছিল না। বাংলাদেশে বিরাজ করছিল বড় রকমের দারিদ্র্য পরিস্থিতি। কৃষির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে গ্রামীণ বাংলায় প্রচণ্ড মাত্রায় দারিদ্র্য পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল। একপর্যায়ে লাখ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার হয়।

তেমনি দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যে ধরনের রাষ্ট্রীয় নীতি-কাঠামো প্রয়োজন, সেসবেরও অভাব ছিল। নীতি-কাঠামো ও দক্ষ শ্রমিক সরবরাহ করার মাধ্যমে একদিকে যেমন তারা উৎপাদনে নিজেদের নিয়োজিত করবে, অন্যদিকে নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়াবে, সে রকম প্রক্রিয়াও জারি ছিল না। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কেবল গড়ে উঠছিল এবং দেশের জনসংখ্যার তুলনায় এর সরবরাহ সীমিত ছিল। তাছাড়া বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে তৈরি করার জন্য যে ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা, কারিগরি ব্যবস্থা প্রয়োজন, সে ধরনের প্রচেষ্টা ও পরিস্থিতিও বিদ্যমান ছিল না। অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ কম থাকায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে রাষ্ট্রীয় ব্যয় সীমিত ছিল। অর্থনীতির আকার ছোট থাকায় শুধু আমদানি শুল্কই রাষ্ট্রের আয়ের উৎস ছিল।

এ ধরনের পরিস্থিতি কেন তৈরি হচ্ছিল, সেই আলোচনাটা করা জরুরি। এক্ষেত্রে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। প্রথম বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে, বাংলাদেশ উত্তরাধিকারসূত্রে এমন একটা রাষ্ট্রযন্ত্র পেয়েছে, যা ছিল মাত্রাতিরিক্ত আমলাতান্ত্রিক। এ আমলাতন্ত্রকে অভিহিত করা হতো ‘সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস’ বলে। অর্থাৎ এ শ্রেণীটি নিজেদেরকে সাধারণ মানুষ থেকে উপরে ভাবতে এবং নিজেদের শাসক মনে করত। কর্তৃত্ববাদী আমলাতন্ত্র ক্রমে রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপরে বড় রকমের নিয়ন্ত্রণ জারি করে ফেলেছিল।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে একটা শ্রেণীর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে জোরজবরদস্তির মাধ্যমে সম্পদ ও পুঁজি সঞ্চয়ের চেষ্টা চলল। শাসকদলকে ব্যবহার করে এক ধরনের লাইসেন্স রাজত্ব তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। তার সঙ্গে রাষ্ট্রের ক্ষমতাবলয়ের মাধ্যমে পুঁজি সঞ্চয়নের চেষ্টা করা হয়েছে। আমলাতন্ত্র বাধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা কেবল গুটিকয়েকের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করার জন্য কাজ করেছে। পরিকল্পনা কমিশনেও পরিকল্পনা যন্ত্র ও পরিকল্পনার কৌশল প্রণয়নের প্রক্রিয়াগুলো ছিল কণ্টকপূর্ণ, যা অনেক ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ফলে প্রথম পরিকল্পনা কমিশন একসময় ভেঙে যেতে বাধ্য হয়েছে।

শাসকদল শাসনক্ষমতা রেখেছিল একান্তই নিজেদের মধ্যে। স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেক রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছিল। সব দলকে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠনের চেষ্টাটা ছিল না। ফলে বড় রকমের হুমকি তৈরি হলো এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরোধও চালু ছিল। এক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সক্রিয় ছিল না। এছাড়া রাষ্ট্রের আরেকটি অন্যতম কাঠামো তথা সামরিক বাহিনীতেও এক ধরনের মতপার্থক্য ছিল। ফলে সবসময় একটা দুশ্চিন্তা জারি ছিল।
যেকোনো গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দল থাকবে, মত থাকবে এবং দল-মতের পার্থক্য থাকতে হবে। দল এবং মত তখনই কাজ করতে পারবে যখন দেশে গণতান্ত্রিক সংবিধান তৈরি হবে। সংবিধান হচ্ছে জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের চুক্তি। এটি যত অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে তত অধিকার প্রদান করবে। ১৯৭২ সালে আমরা সংবিধান তৈরি করেছি (যা এখনকার চেয়ে অনেক মানসম্পন্ন ছিল)। কিন্তু সেই সংবিধান তৈরির ক্ষেত্রে যে ধরনের সাংবিধানিক সভা দরকার ছিল, জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটানো দরকার ছিল, তার কিন্তু ঘাটতি রয়েই যায়। ফলে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত মৌলিক অধিকারগুলো কেবল নীতিমালায়ই রয়ে গেছে। নাগরিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার চেষ্টার মৌল ভিত্তি গণতান্ত্রিক সংবিধান। এটি তৈরির চেষ্টার মধ্যেও কিন্তু এক ধরনের ঘাটতি লক্ষণীয়। এ ঘাটতি পূরণ হতে পারত যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি হতো। কিন্তু এর বিপরীতে একটি বড় অংশ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারেনি। নাগরিক রাষ্ট্র তৈরির ক্ষেত্রে এ ঘাটতি লক্ষ করা গেছে।

গণতান্ত্রিক নাগরিক রাষ্ট্র তৈরি না করা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের একমুখিতার ফলে সৃজনশীলতা তৈরি হয়নি। রাষ্ট্র তেমন পরিস্থিতির দিকে অগ্রসর হয়নি, যার মাধ্যমে টেকসই অর্থনীতি ও উৎপাদন ক্ষমতার বিকাশ ঘটবে। কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা সত্ত্বেও তখনো কৃষি খাতে প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটেনি এবং কৃষির বহুমুখীকরণের তেমন কোনো পরিকল্পনা তখন পর্যন্ত নেয়া হয়নি। ফলে বিরাট অংশের মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতে হয়েছে। এর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতার কারণে এমন একটা মধ্যবর্তী শ্রেণী তৈরি হয়েছে, যারা ক্রমাগত তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করেছে। লুটপাট করেছে। ফলে তখন থেকেই বাংলাদেশে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। এ বৈষম্য ব্যবস্থা স্বাধীনতার অন্যতম স্তম্ভ সাম্যের সঙ্গে বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে। এ বৈষম্য থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য যে ধরনের চিন্তা কাঠামো দরকার ছিল, সে ধরনের চিন্তা কাঠামো গঠিত হয়নি। একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র তৈরির জন্য স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যে ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা জরুরি ছিল, যে অনুযায়ী শিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের জন্য সর্বজনীন অধিকারগুলোর কথা চিন্তা করা হয়নি। এমনকি রাষ্ট্র এখন পর্যন্ত পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে পারেনি। সংবিধানে বলা আছে প্রয়োজন অনুযায়ী বিকাশের মাধ্যমে সমতা বজায় রাখার কথা। রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা না হওয়ার কারণে সমতা অর্জনের জন্য কোনো কালেকটিভ বা পাবলিক অ্যাকশনের দিকে যাওয়া সম্ভব হয়নি। যেমন— নদীমাতৃক বাংলাদেশকে ব্যবহার করার জন্য কিংবা জাতীয় সম্পদগুলো ব্যবস্থার মাধ্যমে অনেক কালেকটিভ অ্যাকশন হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। কারণ সামাজিক চুক্তি তৈরি হয়নি। ফলে নাগরিকের অর্থনৈতিক অধিকার এবং উৎপাদনমুখী রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি।

রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এমন কোনো ব্যবস্থা চালু করেনি, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের তত্কালীন চ্যালেঞ্জ, নতুন রকমের কর্মোদ্যোগী কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে উৎপাদনশীল খাতের বিকাশ তৈরি করা সম্ভব ছিল। তাছাড়া শ্রমশক্তি তৈরির জন্য যে ধরনের খাতকে প্রাধান্য দেয়া জরুরি, তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করাও সম্ভব হচ্ছিল না। চলমান পরিস্থিতি থেকে পুঁজিবাদী রূপান্তরের জন্য যে রকম প্রযুক্তিগত উন্নয়ন দরকার ছিল, বিশেষ করে কৃষিতে, শিল্পে, যার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যাবে, সেই ব্যবস্থাও জারি ছিল না। কারণ তেমন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি হচ্ছিল না। বিপরীত ধারায় এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি হচ্ছিল, যা ক্রমে একনায়কত্বের দিকে ধাবিত হচ্ছিল। এক সময়ে একদলীয় শাসন চালু করা হলো। নির্দিষ্ট কয়েকটি রাষ্ট্রীয় মালিকানার বাইরে সব সংবাদমাধ্যম বন্ধ করা হলো। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হতে থাকল। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকারের সংখ্যা বেড়ে চলল। অন্তর্ভুক্তিমূলক বা প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে একটি দেশের মধ্যে যে উন্নয়নশীলতা তৈরি হয়, তা তৈরি করা সম্ভব হলো না।

রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে যারা সম্পদ ও পুঁজি সঞ্চায়ন করেছে, তাদের কাছে রাষ্ট্র আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। এর সঙ্গে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরশীলতার সংস্কৃতি তৈরি করেছে এবং পরবর্তীতেও নির্ভরশীলতার এ সংস্কৃতি চালু রয়েছে। ফলে সৃজনশীল কায়দায় পুঁজি, শ্রম ও দক্ষতার বিকাশের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। অবহেলিত থেকেছে প্রযুক্তির ব্যবহার। অর্থাৎ দেশোপযোগী প্রযুক্তির মাধ্যমে কীভাবে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা যায়, সে প্রক্রিয়ারও অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। রাজনৈতিক বাস্তবতায় যেহেতু রাষ্ট্রের মধ্যে এক ধরনের টেনশন কাজ করেছে, তখন বিভিন্ন বিদেশী সংস্থা বা রাষ্ট্র বিভিন্ন রকমের সুযোগসন্ধানী সুবিধাভোগী ভূমিকা রেখেছে এবং রেখে চলছে। এ ধরনের ভূমিকা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, যার কারণে তারা আন্তর্জাতিক রাজনীতিরও শিকার হয়েছে।

অর্থাৎ রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা এমন শ্রেণীর কাছে গেছে, যারা উদ্যোক্তা হতে মনোনিবিষ্ট হয়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশে বিশাল অংকের মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেছে। রাষ্ট্র যেহেতু অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না, তাই কোনো কোনো ক্ষেত্রে সশস্ত্র প্রতিরোধের শিকার হয়েছে। রাষ্ট্র স্থির থাকতে পারেনি। রাষ্ট্র রাজনৈতিক বন্দোবস্তে স্থির থেকে স্বাধীনতা-পরবর্তী যে ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা তৈরি করার প্রয়োজন ছিল, তা করতে পারেনি। অন্যদিকে নাগরিক রাষ্ট্র হিসেবে রূপান্তরিত না হওয়ায় নাগরিকদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্ম ও সংবিধানে উল্লিখিত সুযোগগুলো বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। এমন অনেক দ্বন্দ্বমূলক অবস্থানের কারণে এ ধরনের একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা না থাকে, রাষ্ট্র কাঠামো যদি নাগরিক রাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর না হয় এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদের সঞ্চয়ন থাকে, তাহলে যে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়, সে পরিস্থিতি তত্কালে লক্ষ করা গেছে।

  • লেখক: অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারপারসন, উন্নয়ন অন্বেষণ


আজ ভোটডাকাতি!


—  অরুন রহমান



সোমবার, জুলাই ৩০, ২০১৮ — বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেটের কেন্দ্রে  কেন্দ্রে ভোটডাকাতি চলছে,  ঠিক সকাল আটটায় ভোট শুরুর পর থেকেই তিন শহরের ভোটকেন্দ্রগুলো নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় একে একে দখল করে নেয় আলীগের নেতাকর্মীরা। 

সকালে দেশের মানুষ ইন্টারনেটে বিভিন্ন মিডিয়া আউটলেটে ঢুকেই দেখল ও শুনল চারিদিকে চরম অরাজকতা ও বিশৃংখলা, যেন ভোটের শহরগুলোর জনপদে জনপথে ডাকাত পড়েছে —  সহিংসতা, ব্যালটছিনতাই, জালভোট, কেন্দ্রদখল, পোলিংএজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে বাধা, আর প্রার্থী ও ভোটারদের আর্তনাদের স্থির ও ভিডিও চিত্র। সারাদেশ যেন এলোমেলো। কোন আইন নেই। সংবিধান নেই। মানুষের ভোটাধিকার পদদলিত করছে ভোটডাকাতরা। 

‘...দীর্ঘক্ষণ ধরে দলে দলে সিলেটের হাতেম আলী ভোটকেন্দ্রে জালভোট দেয়া হচ্ছে,’ আঙ্গুলে ভোট দেয়ার অমোচনীয় কালি লাগানো একজনকে হাতেনাতে ধরে একাত্তর টিভির এক সাহসী রিপোর্টার তা লাইভ দেখিয়েছেন।

যুগান্তর রিপোর্ট পাবলিশ করেছে, বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জালভোটের প্রতিবাদ করায় বাসদের মেয়রপ্রার্থী ডা. মনীষা চক্রবর্তীর ওপর বাঁশ দিয়ে হামলা, নির্যাতন ও লাঞ্ছিত করেছে আলীগের কর্মীরা। এতে তাঁর হাত ভেঙ্গেছে।  

বরিশাল থেকে একাত্তর টিভির আরেক রিপোর্টার দেখালেন, একজন পোলিং অফিসার নিজেই ভোট দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তখন সেই কেন্দ্রের সব ব্যালটপেপার শেষ! বাইরে ভোটারদের লাইন!   

প্রথম আলো একটি ভিডিওক্লিপ পোস্ট করেছে —  বরিশাল মহানগর পশ্চিম কাউনিয়া এলাকার সৈয়দা মজিদুন্নেছা মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের, যেখানে দেখা যাচ্ছে ভোটকেন্দ্র দখল করে শুধুই নৌকায় সিলমারা হচ্ছে। ব্যালট বইয়ে পুরোটাতেই নৌকায় সিল।  সিলেট সিটির ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের মীরা বাজার মডেল স্কুল কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ছিনতায়ের ছবিও পোস্ট করা হয়েছে । 

বাংলাট্রিবিউনের এক রিপোর্ট’র হেডলাইন — সিলেটে তিন কেন্দ্রে সংঘর্ষ।  

যুগান্তরের আরেক রিপোর্টের হেডলাইন —  সিলেটে ভোট শুরুর ১০ মিনিট পর কেন্দ্র দখল-জালভোট।

মানবজমিন আরেকটি ছবি পোস্ট করেছে যেখানে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মেয়রপ্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ইসলামীয়া ভোটকেন্দ্রের বাইরে অবস্থান নিয়েছেন। ওই কেন্দ্রেমেয়র প্রার্থীর ব্যালট শেষ হয়ে গেছে অভিযোগ করে বুলবুল প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে ব্যালটের হিসাব চেয়েছেন। সেইখানে ভোটাররা লাইন ধরে আছে, কিন্তু মেয়রের ব্যালট নেই।

এনটিভিকে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনার মাহাবুব তালুকদার বলেছেন, ‘আমি শুনেছি বরিশালে ভোটকেন্দ্র দখল হয়েছে। সেখানে একজন মেয়র প্রার্থীর সঙ্গে খারাপ আচরণও করা হয়েছে। বিএনপির প্রার্থী ভোট বর্জনও করেছেন। এসব বিষয় নিয়ে আমরা কমিশনে আলাপ-আলোচনা করছি।’

আজ ইন্টারনেট মিডিয়া আউটলেটগুলের ফ্রন্টপেইজে শুধু ভোট ডাকাতির নিউজ। কাল সকালে এগুলো সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় স্থান পাবে কিনা তা দেখার বিষয়। বাস্তবে ইন্টারনেট মিডিয়ায় পাবলিশ হয়েছে ভোট ডাকাতির খন্ডছিত্র। এই খন্ডচিত্রকে লাখোগুণ বাড়িয়ে দিলেই পুরোচিত্রটি অনুধাবন সম্ভব।

বাংলাদেশে ১৯৯০এ স্বৈরাচার এরশাদ শাহীর পতনের পর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পেরেছিল। ভোটের দিন ছিল ঈদের দিনের মতো আনন্দের, পরিবার,বন্ধু-বান্ধব মিলে কেন্দ্রে যেত সবাই। ভোট যার যার, ভোট উৎসব ছিল সবার। এমনকি একই পরিবারে অথবা বন্ধুদের একই সার্কেলে ছিল বিভিন্ন দলের সমর্থক। তর্ক-বিতর্ক হত। কেন্দ্রে যে যার মত ভোট দিয়ে চা দোকানে বসে আড্ডা দিত। সন্ধ্যা থেকে ফলাফলের খবর আসা শুরু করত । সুস্থ নির্বাচন হওয়াতে সবাই মেনে নিত সেই রেজাল্ট। দলের পরাজয়ে সেইদলের সমর্থকরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করত, যাতে ভবিষ্যতে তাঁরা জিততে পারে। এগুলো কোন রূপকথা নয় — ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এর জাতীয় নির্বাচন এবং এই সময়কালের বিভিন্ন নির্বাচন ছিল এমনই উৎসব মুখর। তখন বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে বলা হত মুসলিম বিশ্বের জন্য রোল মডেল। 

কিন্তু আজ বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকারতো অনেক দূরের কথা স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকারটুকুও নেই। এই বছরেই বিশ্বের নতুন পাঁচটি ‘স্বৈরতান্ত্রিক দেশের’ তালিকায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভূক্ত করেছে জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্যার্টেল্সমান ফাউন্ডেশন৷ জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিশ্বের সব গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা গত একদশক ধরে বাংলাদেশের মানুষের অধিকার হারানোর বিষয়ে বারবার বিনাভোটের স্বঘোষিত সরকারকে তাদের গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতালিপ্সু গোষ্ঠী বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করছে না।

দেশের মানুষের ভোটাধিকার হারানোর প্রক্রিয়াটা শুরু হয় আসলে ১/১১ এর মঈন-ফখরুদ্দিনের সময় থেকে। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে নানা অপকৌশলে দমন করা হয়। এরপর জানুয়ারি ৫, ২০১৪ এর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনাভোট ও ভোটারবিহীন এক ভোট নাটকের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল নিজেদেরকে ক্ষমতায় আসীন রাখে।এরপর থেকেই আর মানুষ ভোট দিতে পারছে না।

দেশ-বিদেশের মানুষের সামনেই বাংলাদেশে এখন প্রতিটি নির্বাচনে ভোট ডাকাতি চলছে। ভোটারবিহীন প্রহসনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা নিজেদেরকে বিজয়ী ঘোষণা করছে, শপথ নিচ্ছে, মিষ্টি খাচ্ছে, হাঁসিমুখে ছবি তুলছে। সংবাদ মাধ্যমে সেগুলো গুরুত্ব দিয়ে প্রচারিত হচ্ছে।  সেখানে শুধু নেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন। 

ক্ষমতালিপ্সু সেইসব গোষ্ঠীদের স্মরণ করিয়ে  দেয়া যেতে পারে — জীবনবাজি রেখে  যুদ্ধকরে দেশ স্বাধীন করেছে সাধারণ মানুষ, দেশের মালিক তাঁরাই। তাঁরাই ঠিক করবে তাঁদের দেশের সরকার কারা হবে, তাঁদের শহর, নগরে কারা নেতা হবেন। তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে গায়ের জোরে তাঁদের শাসন করার চেষ্টা সীমাহীন লজ্জার।   


  •  লেখক ইন্টারনেট এক্টিভিস্ট। 

চবিতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ

আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) দুই গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় সংঘর্ষে দুজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আজ সোমবার বেলা ১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আমানত এবং এএফ রহমান হলে শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির মধ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। সহকারী প্রক্টর লিটন মিত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ছাত্রলীগের দু'গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির বিজয় গ্রুপ ও সিএফসির গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এসময় বিজয় গ্রুপের ছাত্রলীগের কর্মীরা এএফ রহমান হলে ও সিএফসির কর্মীরা শাহ আমানত হলে অবস্থান নেন। পরে উভয় গ্রুপই একে অপরকে ইটপাটকেল ছুড়ে মারে। এসময় দুজন আহত হন। আহতদের চবি মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে।

  • Courtesy: Kalerkantha/ Jul 30,2018

থেঁতলানো দেহ আর ‘...হাসি পুষ্পের হাসি’

গোলাম মোর্তোজা

পরাধীন দেশে শোষকের অত্যাচার-অন্যায্যতা-নিপীড়ন দেখে কবি নজরুল লিখেছিলেন, ‘দেখিয়া-শুনিয়া খেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে’।

দিন বদলেছে। এখন আমরা ‘খেপে’ যাই না। ‘মুখে যা আসে’ তা বলি না। বলতে পারি না।

আমরা নীরব, নির্বিকার। সবকিছু মেনে নিতে শিখেছি। শিখেছি শুধু নিজে ভালো থাকার কায়দা-কানুন। এই কায়দা উটপাখির বালুতে, হাতির জঙ্গলে মুখ লুকানোর কায়দা। আমি দেখলাম না মানে, কেউ আমাকে দেখল না। ‘আমি তো ভালো আছি, আমার সন্তানের তো কিছু হয়নি’- কী দরকার অন্যকে নিয়ে ভাবার বা ঝামেলায় জড়ানোর!

মিম বা রাজীবের বাবা-মা, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুদের আর্তচিৎকার গিজ গিজ করা এই মানুষের শহরে, কংক্রিটের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়। ভেতরে দগ্ধ-মর্মাহত মানুষের কিছু করার থাকে না।

থেঁতলানো দেহ যে রাজীব বা মিমের, কষ্ট হয় চিনতে। পিচঢালা রাজপথ আর রাজীব-মিমের রক্ত মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

কলেজ ছুটির পর বিমানবন্দর সড়কে তারা দলবেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল, রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায়। প্রতিদিনই তারা এভাবে দাঁড়িয়ে থাকে বাসের অপেক্ষায়। একটি বাস আরেকটি বাসকে দানবীয় রূপে অতিক্রম করে চাপা দিয়ে দিল রাজীব, মিমদের। দুজন পৃথিবী থেকে চলে গেল। আহত হয়ে হাসপাতালে স্থান নিলো অনেকে। সহপাঠী বন্ধুদের আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে উঠল বাতাস-আকাশ। আপনি পত্রিকায় পড়ছেন, টেলিভিশনে দেখছেন। তাও টেলিভিশনে রক্ত, থেঁতলানো ক্ষত-বিক্ষত ছবি দেখাচ্ছে না। তা আপনি সহ্য করতে পারছেন না। চোখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন টেলিভিশনের পর্দা থেকে। একটু চিন্তা করেন সহপাঠী বন্ধুদের কথা। এক মুহূর্ত আগে যে রাজীব-মিম তাদের সঙ্গে হাসিমুখে গল্প করছিল, তারা নেই...। ভাবতে পারছেন? রাজীব-মিমের বাবা-মায়ের স্থানে বসান তো নিজেকে। আপনার সন্তানের দিকে তাকিয়ে ভাবেন একবার, রক্ত-থেঁতলে যাওয়া দেহ...। পারছেন ভাবতে?

আপনি পারেন বা না পারেন, তাতে কিছু যায়-আসে না। যাদের পারার কথা তারা ঠিকই পারেন।

রাজীব-মিম এবং আরও অনেক আহতদের রক্ত বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছিল, ক্ষিপ্ত বন্ধুরা কিছু বাস ভাঙচুর করছিল। ঠিক সেই সময়ে অন্য একটি অনুষ্ঠানে সংবাদকর্মীদের মুখোমুখি হলেন নেতা-মন্ত্রী শাহজাহান খান। তিনি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হলেও, মূলত ড্রাইভার হেলপারদের নেতা। নিজের পরিবার-আত্মীয়রা জাবালে নূরসহ অনেক পরিবহনের মালিক। মালিক, শ্রমিকনেতা মন্ত্রীর কাছে সংবাদকর্মীরা জানতে চেয়েছিলেন ঘণ্টাখানেক আগের দুর্ঘটনার বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া। দুই জন শিক্ষার্থীর মৃত্যুবিষয়ক প্রশ্নে মন্ত্রী হাসছিলেন। তার বিগলিত হাসি থামছিল না। বিদ্রোহী কবি যেমন লিখেছিলেন, ’আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি’-সেভাবেই হাসছিলেন মন্ত্রী।

মনে হচ্ছিল, কোনো সাফল্য বা আনন্দের ঘটনাবিষয়ক প্রশ্ন করা হয়েছে। হাসিমুখে মুখে মন্ত্রী বললেন, ‘যে যতটা অপরাধ করবে, সে সেইভাবে শাস্তি পাবে।’

সংবাদকর্মীরা নাছোড়বান্দার মতো প্রশ্ন করছিলেন, বলছিলেন হত্যাকাণ্ড ঘটানো কেউ আপনার মদদে শাস্তি পায় না...। পরিপূর্ণ হাসি মুখে এবার মন্ত্রী বললেন আসল কথা।

‘শোনেন, কয়েকদিন আগে ভারতের মহারাষ্ট্রে একটা গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে ৩৩ জন মারা গেল। এখন সেখানে কী আমরা যেভাবে এগুলোকে নিয়ে কথা বলি, এগুলো কি উনারা কথা বলেন?’

মন্ত্রীর বক্তব্যের অর্থ বা তাৎপর্য বোঝার জন্যে গবেষণার প্রয়োজন হয় না। সহজ-সরলভাবেই বোঝা যায়, ৩৩ জন মারা যাওয়া নিয়ে ভারতে কথা হয় না, দুজন মারা যাওয়া নিয়ে বাংলাদেশে কেন এত কথা হবে? কেন সংবাদকর্মীরা এত প্রশ্ন করবেন?

ভারতে ৩৩ জন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বাসের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন না। বাস তাদের চাপা দিয়ে হত্যা করেনি। দুর্গম পাহাড়ি পথে বাসটি খাদে পড়ে ৩৩ জন নিহত হয়েছেন। চালকের ভুলে হোক, দুর্গম পাহাড় আঁকাবাঁকা পথের কারণে হোক, এটা একটা দুর্ঘটনা। বাসের জন্যে অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীদের চাপা দিয়ে থেঁতলে দেয়া দুর্ঘটনার সঙ্গে তা তুলনা করা যায় কিনা, তা বিবেচনার বিষয়। হ্যাঁ, দুর্ঘটনা সব দেশেই ঘটে, মানুষ মারাও যায়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো এমন নিয়মকানুনহীন দানবীয় ভঙ্গিতে শহরে বা হাইওয়েতে বাস-ট্রাক আর কোনো দেশে চলে? একটি নজিরও দেখানো যাবে? একজন মন্ত্রীর এমন অবস্থানের নজির আছে কোথাও?

মৃত্যু বা দুর্ঘটনার পর বাস, চালক-হেলপাররা চলে আসেন দোষারোপের কেন্দ্রে। পরিসংখ্যান বলে ৪৯% দুর্ঘটনা ঘটে চালকদের দায়িত্বহীন চালানোর কারণে। এখানেই শেষ নয়, আরও কথা আছে। যে বাসটি চালককে দেওয়া হয়েছে, সেটা ফিটনেসবিহীন চলাচলের অনুপযোগী। প্রতি ট্রিপ অনুযায়ী মালিককে ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। সকাল থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত একজন চালকই গাড়ি চালান। তার ঠিক মতো খাওয়া নেই, বিশ্রাম নেই। পুলিশকে নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। ফলে চালক আইন না মানার সুযোগ পেয়ে যায়। আর মালিক-শ্রমিকদের উভয় নেতা মন্ত্রী হওয়ায়, দুর্ঘটনা বা যা কিছু ঘটাক না কেন- তার শাস্তি হবে না, সেটা চালক-হেলপারদের জানা। বিশেষ একটি কারণে নয়, সামগ্রিক অব্যবস্থাপনার কারণে ঘটে দুর্ঘটনা। নিয়মিত মারা যায় মানুষ। মারা গেলেন রাজীব-মিম।

তা নিয়ে হাসি মুখের নেতা-মন্ত্রীর বক্তব্য শুনেছেন-দেখেছেন, এদেশের মানুষ। রাতে ভাত খেয়েছেন, ঘুমিয়েছেন। সকালে বেরিয়ে পড়েছেন, যে যার কাজে।

আজও দেশের কোথাও না কোথাও মানুষের শরীর থেঁতলে দেবে ক্ষমতাবানদের পরিবহন। তাতে আমাদের কারও ঘুমে কোনো সমস্যা হবে না, শুধু সন্তান বা বন্ধু হারানো কয়েকজন ছাড়া।
  • কার্টসিঃ দ্য ডেইলি স্টার/ জুলাই ৩০,২০১৮ 


Curious logic of govt.'s costly borrowing

AKM Zamir Uddin

The cost of borrowing, be it for the government or businesses, is imperative: the lower the costs, the better.
But for the Bangladesh government this fact seems to be immaterial: it has been resorting to costlier options for the last several years even though the cheaper ones are knocking at its front door.

The government borrowed from high-cost national savings tools instead of going for the low-cost bank borrowing in the recently concluded fiscal year, and in doing so, have created a large financial burden for the near future.

In fiscal 2017-18, the government borrowed only Tk 5,666 crore from the banking sector by using Treasury bills and bonds against the annual target of Tk 28,203 crore.

On the other hand, the net sales of savings certificates stood at Tk 46,758 crore against the annual upward revised target of Tk 44,000 crore.

The government is yet to face any obstacle in managing its deficit financing but it would have gotten more fiscal space for the development projects if the interest payment against its domestic borrowing was lower, said Ahsan H Mansur, executive director of the Policy Research Institute of Bangladesh.

More than Tk 51,000 crore was allocated for interest payments this fiscal year in contrast to about Tk 41,000 crore last year, he said. “It is a matter of concern that the interest payment is increasing.”

The government should frame a fresh regulation for the savings instruments, one that allows revision of the yield every quarter in line with the market rate, he said. The yield of the savings tools should be revised in line with the banks' fixed deposit receipts' rate.

The difference in rate between the savings tools and banks' products hovered from 1 percentage point to 1.50 percentage points a few years ago. Now, it has widened substantially. The rate of interest on bank borrowings is from 3.10 percent to 8.09 percent, whereas on savings instruments it is 11.04 percent to 11.76 percent.

INTEREST RATES POLITICISED

Politicians and bureaucrats have mainly forced the government not to lower the interest rate on savings tools, meaning that the issue has already become 'politicised', Mansur added. AB Mirza Azizul Islam, a former caretaker government adviser, echoed the same. “The government's debt servicing costs would balloon.”

Since it is the most expensive borrowing tool for the government, sales of savings instrument should be stopped once the annual target is reached, he observed. 

  • Courtesy: The Daily Star Business /Jul 30, 2018

Saga of price hike

Price hikes have ever remained a bane for people in this country. What needs to be considered is the condition that triggers any price spiral. If it is artificially induced, it is not only an unethical business practice but also leaves its deleterious impact on the country's economy in many ways. Every year during the monsoon when rains fall incessantly and many areas go under water, the kitchen market becomes volatile with lean supply. Items like green chilli, vegetables can be dearer, no doubt. But then there is a section of traders who create an artificial crisis -greater than it really is -- in order to make the most of the situation. This is unfair. Right at this moment, the elements have conspired to produce an inclement weather where production and supply will definitely suffer a bit but this should not lead to a condition for fleecing the consumers with outrageous price hikes of all the essentials.

It is not only the prices of perishable varieties of agricultural produce that have become jittery, the staple rice has also registered increased price. Rice price is falling in the international market. Along with those, livestock items such as eggs and chicken are also becoming dearer. The list does not quite end there. Onion and spices have also marked a restive price tendency. Anyone can see that some items have nothing to do with the worsening weather. The crux of the problem has to be found there. There is no need to be an expert to identify the reason behind the price escalation. Traders have done this before and they are doing it now and they will be doing it in the future unless, of course, effective measures are taken against manipulative means resorted to for conditioning market to suit their purpose.         

Traders target occasions like the big festivals for maximising their profit. Eid-ul-Azha is not far away and the time has proved doubly propitious because of the rains. Until recently, their syndicated attempt to raise prices of essentials was not very conspicuous this time. But now they seem to have thrown caution into the wind and are after exaggerated profit. Consumer rights bodies have noticed the move and have pleaded with the government for conducting regular market monitoring and supervision. What needs to be ensured is that traders have no scope for artificial disruption of the supply line in order to hike prices.

True, in open market economy demand and supply are decisive in matters of maintaining price levels. But when the process itself is disrupted by manipulative means, it is criminal. In this country, prices shoot up vigorously if commodities in the international market go up even moderately. But if prices fall in the international market, prices do not respond accordingly; or if they do, it takes a long time to do so. The excuse is that the stock was of the earlier lots but the same excuse from the consumers is not entertained when cheaper import of earlier batches suddenly register hike. The hike is made effective immediately. Monitoring should cover imported commodities at this level too.

  • Courtesy: The Financial Express/ Editorial/ Jul 30,2018

ব্যাংকগুলোর দক্ষতা বাড়াতে হবে

বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয় নিয়ে বণিক বার্তায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাংক পরিচালনার ব্যয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যয়ের যে তফাত তুলে ধরা হয়েছে, তাতে অবাক না হয়ে পারা যায় না। দেখা যাচ্ছে, যেখানে অন্যান্য দেশের ব্যাংকগুলোর আয়ের বড় অংশ যাচ্ছে নিট মুনাফা হিসেবে, সেখানে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর বড় ব্যয় পরিচালন খাতে। অন্যদের তুলনায় বাংলাদেশে পরিচালন ব্যয় বেশি হওয়ায় ব্যাংকগুলোর ব্যবসায়িক নীতি ও মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।

দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত ব্যাংকিং। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত খাত। একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারি আর অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে দেশের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে সরকারকে জনগণের করের টাকা দিতে হচ্ছে। এবারের বাজেটেও এজন্য বরাদ্দ রয়েছে। এসব মিলিয়ে দেশের মানুষের আস্থা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে ব্যাংকিং খাত। এ অবস্থায় ব্যাংকিং খাতের পরিচালন ব্যয় নিয়ে যে চিত্র সামনে এসেছে, তাতে ব্যাংকগুলো ব্যবসায়িক উন্নতির দিকে কতটুকু মনোযোগী, সেটা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে। 

এর আগেও ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালন ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। অথচ পরিচালন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ব্যাংকেরই কাজের একটি অংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের মাসিক বেতন-ভাতা ব্যাংক বিশেষে মাসে ৮ থেকে ১৮ লাখ টাকা। এছাড়া শাখা প্রতিষ্ঠা ও ব্যয় নির্বাহেও বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। দেশে ব্যাংকের তুলনায় দক্ষ এমডির সংখ্যা কম। এতে স্বাভাবিকভাবেই দক্ষদের চাহিদা থাকে, ফলে বেতন বাড়ে। এর প্রভাব পড়ে ব্যাংকের পরিচালন ব্যয়ের ওপর। এমডিসহ কর্মীদের বেতন নির্ধারণে ব্যাংকের সম্পদ ও মূলধন বিবেচ্য হওয়া উচিত। আর গ্রাহকসেবার জন্য ব্যাংক শাখায় প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত করা ব্যতীত অতিরিক্ত সাজসজ্জার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় বেশি হওয়ার পেছনে খেলাপি ঋণও বড় একটি কারণ। খেলাপি ঋণের হার বেশি হওয়ায় ব্যাংককে সঞ্চিতি সংরক্ষণের জন্য পরিচালন মুনাফার বড় একটি অংশ রেখে দিতে হচ্ছে। খেলাপি ঋণ সমস্যা সমাধানে ব্যাংক ও সরকারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। 

পরিচালন ব্যয় বেশি হওয়ার জন্য করপোরেট ট্যাক্সের উচ্চহারকেও দায়ী করছেন ব্যাংকাররা। তবে এবারের বাজেটে ব্যাংকিং খাতে আড়াই শতাংশীয় পয়েন্ট করপোরেট ট্যাক্স কমানো হয়েছে। এতে পরিচালন ব্যয় কমে যাওয়ার কথা। আবার প্রযুক্তিগত উন্নতির জন্য ব্যয় বাড়লে অন্য খাতে কমানোর মাধ্যমে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় বেশি হওয়ায় এর প্রভাব গ্রাহকদের ওপর পড়ছে। ব্যয়কৃত অর্থ গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করতে গিয়ে ব্যাংক আমানতকারীদের সুদের হার কমিয়ে ঋণ গ্রহণকারীদের সুদ বাড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে গ্রাহকদের ওপর বিভিন্ন ধরনের অযৌক্তিক ফি চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমরা দেখছি, সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা নিলেও অতিরিক্ত পরিচালন ব্যয়ের কারণে সুদের হারও কমাতে পারছে না ব্যাংকগুলো। ১ জুলাই থেকে ঋণ বিতরণে সুদের হার এক অংকে নামিয়ে আনার কথা বলা হলেও অধিকাংশ ব্যাংক এটি কার্যকর করতে পারেনি।

পরিচালন ব্যয় কমাতে হলে ব্যাংকগুলোকেই এ ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে। যথাসম্ভব অপব্যয় কমাতে হবে। এজন্য ব্যাংকগুলোকে দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে। পরিচালন ব্যয় কমিয়ে আনতে পারলে ব্যাংকের মুনাফা বাড়বে। ব্যাংকগুলো স্বল্প সুদে গ্রাহকদের ঋণ ও আমানতকারীদের বেশি সুদ দিতে পারবে, এতে দেশের ব্যাংকিং খাতেরই কল্যাণ হবে।

  • কার্টসিঃ বনিকবার্তা/ জুলাই ৩০,২০১৮ 

গ্রামে উচ্চশিক্ষার প্রসারতা এখনো ২ শতাংশে সীমিত

সুমন আফসার

ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উচ্চপ্রবৃদ্ধি হচ্ছে দেশে। প্রসার বাড়ছে উচ্চশিক্ষারও। তবে শহরে যেভাবে বাড়ছে, গ্রামে সেভাবে বাড়ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য বলছে, গ্রামে উচ্চশিক্ষার প্রসারতা এখনো ২ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে সীমিত। যদিও শহরাঞ্চলে এ হার ৮ দশমিক ৬ শতাংশ।

উচ্চশিক্ষায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে আর্থিক সক্ষমতার অভাবকেই বড় করে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ধারে-কাছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকাকেও আরেকটি কারণ বলে মনে করছেন তারা। এছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতায় উচ্চশিক্ষার জন্য বেসরকারি খাতের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে বেশি। কিন্তু আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় গ্রামের অনেকের পক্ষেই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উচ্চব্যয় বহন করা সম্ভব হচ্ছে না।

লক্ষ্মীপুরের মান্দারি ইউনিয়নের রেদওয়ান আহমেদ উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে স্নাতক সম্মানে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকা-খাওয়ার পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উচ্চব্যয় বহন করা আর সম্ভব হয়নি। ভর্তির এক বছরের মধ্যেই শিক্ষার যতি টানতে হয় তাকে। এরপর চাষাবাদের জমি বিক্রি করে অর্থের সন্ধানে পাড়ি দিতে হয় সৌদি আরবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, মাধ্যমিকের পর অধিকাংশ শিক্ষার্থীকেই শিক্ষাগ্রহণে বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভর করতে হয়। বেসরকারি শিক্ষা খাতের ব্যয় বহন গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের পক্ষেই সম্ভব হয় না। অভাব-অনটনে পরিবার-সন্তানের পাশে দাঁড়াতে পারে না। উল্টো পড়ালেখা বাদ দিয়ে তারা পরিবারের পাশে দাঁড়ায়। এছাড়া গ্রামে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকলেও কলেজ নেই। ধারেকাছে বিশ্ববিদ্যালয়ও নেই। তাই দূরত্ব ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণেও গ্রামের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে মাত্র ৪০টি। পক্ষান্তরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন ১০০-এর মতো। একইভাবে সারা দেশে ৪ হাজার ৪১৯টি কলেজের মধ্যে সরকারি মাত্র ৩২৮টি। বাকি ৪ হাজার ৯১টি কলেজই বেসরকারি।

তবে বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চলে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমাদের দেশে অধিকাংশ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ই শহরকেন্দ্রিক। আবার শহরের সঙ্গে গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো কাঙ্ক্ষিত মানে উন্নীত করা সম্ভব হয়নি। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চলে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি কিছু প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের পরিকল্পনাও করা হচ্ছে।

উচ্চশিক্ষার মতো উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্নেও শহরের তুলনায় অনেক পিছিয়ে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, শহরে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা সম্পন্ন করছে ১১ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ। যদিও গ্রামে এ হার বেশ কম, মাত্র ৬ শতাংশ। শহর ও গ্রামের শিক্ষার এ বৈষম্য আবার নারীদের ক্ষেত্রে তুলনামূলক বেশি। শহুরে নারীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের হার যেখানে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, সেখানে গ্রামের নারীদের মধ্যে এ হার মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ।

যদিও প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে শহর-গ্রামে পার্থক্য সেভাবে নেই। গ্রামে ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্নের হার ২৩ দশমিক ১ শতাংশ। শহরে এ হার ২০ দশমিক ৪ শতাংশ। মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্নের হার শহর ও গ্রামে যথাক্রমে ৩৮ দশমিক ৩ ও ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশ।

বিনামূল্যে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি উপবৃত্তি ও খাবার বিতরণের মতো কর্মসূচির সুবাদে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ এখন প্রায় শতভাগ। মাধ্যমিকেও বিনামূল্যে বইসহ বিভিন্ন প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। এ কারণে শিক্ষার এ দুই স্তরে শহর ও গ্রামের মধ্যে তেমন একটা তফাত থাকছে না।

রাশেদা কে চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রাথমিকের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই সরকারি। বিনামূল্যে বইসহ উপবৃত্তি গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলোকে সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে উৎসাহিত করছে। বিনামূল্যে বইসহ প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে মাধ্যমিকেও। এসব কারণেই মূলত গ্রামের শিক্ষার্থীরাও শহরের মতো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক সম্পন্ন করতে পারছে। পরে তা আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। মাধ্যমিক-পরবর্তী শিক্ষা থেকেই মূলত শহর ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যবধান তৈরি হচ্ছে। এরও প্রধান কারণ অর্থনৈতিক।

আর্থিক সক্ষমতার অভাবে মাধ্যমিকের পর আর শিক্ষা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার চড়ানল গ্রামের কামাল হোসেনের। স্থানীয় একটি বিদ্যালয় থেকে জিপিএ ৪ নিয়ে মাধ্যমিক সম্পন্ন করার পরও কলেজে না গিয়ে পরিবারের হাল ধরতে বিদেশ পাড়ি দিতে হয়েছে তাকে।

ব্যানবেইসের সর্বশেষ প্রকাশিত বাংলাদেশ এডুকেশন স্ট্যাটিস্টিকস রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭ সালে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার ছিল ১৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি মাধ্যমিকে। এ ধাপে গিয়ে ঝরে পড়ছে ৩৭ দশমিক ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থী। আর উচ্চ মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার ২২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।

শিক্ষাবিদ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, শহরে শিক্ষার্থী উপস্থিতির বিষয়টিতে খুবই গুরুত্ব দেয়া হয়, নিয়মিত না এলে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে না। গ্রামাঞ্চলের কলেজগুলোয় শিক্ষার্থী উপস্থিতির বিষয়টি ততটা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। গ্রামের অনেক শিক্ষার্থী কলেজে ভর্তি হয়ে পার্টটাইম কাজ করে। আবার কেউ কেউ পরিবারকে কৃষি কিংবা ব্যবসায় সময় দিয়ে থাকে। কলেজে না যেতে যেতে একসময় তারা অনিয়মিত হয়ে পড়ে।

  • কার্টসিঃ বনিকবার্তা/ জুলাই ৩০,২০১৮ 

সরকারি টাকায় রাজনৈতিক কর্মীরা যাচ্ছেন হজে

সরকারি টাকায় রাজনৈতিক কর্মীরা যাচ্ছেন হজে। তাদের পাশাপাশি সমাজের ধনাঢ্য, বিভিন্ন দপ্তরের সরকারি কর্মচারী এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সরকারি টাকায় হজ করতে সৌদি আরবে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে রাষ্ট্রীয় খরচে হজ পালনের জন্য ৮৬ জনের সরকারি আদেশ (জিও) জারি করেছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হজ শাখা। নতুন করে আরো একটি তালিকা তৈরির কাজ চলছে। দুয়েক দিনের মধ্যে এ তালিকা জারি করা হতে যারে। 

ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শেষ মুহূর্তে তালিকা কাঁটাছেঁড়ার কাজ চলছে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা ধর্মমন্ত্রী এবং সচিবের নির্দেশনা অনুযায়ী কাঁটাছেঁড়ার কাজ করছেন। তবে সচিবের দেয়া তালিকা অনেক ক্ষেত্রে বাদ যাচ্ছে। এমনটাই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। রাষ্ট্রীয় খরচে হজে যাওয়া ব্যক্তিদের তালিকা ঘেটে দেখা গেছে, রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো. জিয়াউদ্দিন খান, চাটখিল উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক মনির হোসেন, আওয়ামী লীগ সিরাজগঞ্জ জেলা শাখার তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন ফারুক, রংপুর পীরগঞ্জের ১নং চৈত্রকোল ইউনিয়ন শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. সেকেন্দার আলী, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক সোহরাব হোসেন হাওলাদার। 

এদিকে সাধারণ ব্যক্তিদের মধ্যে সরকারি খরচে হজ করতে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন-গোপালগঞ্জ সদরের হাসমত আলী শেখ, টুঙ্গিপাড়ার মো. আয়ুব আলী শেখ ও মুন্সী মো. কামরুজ্জামান, কোটালীপাড়ার বেগম নুরুন নাহার মাহমুদা ও অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেন সরদার, রংপুরের পীরগঞ্জের মো. রফিকুল ইসলাম (বকুল), সাভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মো. মনিরুজ্জামান, কুড়িগ্রামের উলিপুরের মো. হাবিবুর রহমান, ফরিদপুরের বোয়ালমারীর মো. ইদ্রিস মোল্লা, পটুয়াখালির দশমিনার সৈয়দ মাহবুব আলম, নরসিংদী সদরের মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহজাহান ভূঁইয়া, ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ পৌরসভার মো. আনছার আলী, নাটোরের দুর্গাবাহারপুরের হাফেজ মো. মহসীন আলী, পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার জিয়াউর রহমান ও মো. জহিরুল ইসলাম মামুন মিয়া, পটুয়াখালীর বাউফলের মো. হাবিবুর রহমান, চট্টগ্রামের পটিয়ার মফজল আহমদ (মাস্টার), সূত্রাপুরের ঋষিকেশ দাস রোডের বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খাদেম হাফেজ মো. জসিম উদ্দিন, খিলগাঁও ঈদগাহ জামে মসজিদের খাদেম মো. সাইদুর রহমান, নরসিংদীর ভিরিন্দা পূর্বপাড়া জামে মসজিদের ইমাম মো. খলিলুর রহমান এবং মাদারীপুরের বিসিক শিল্প নগরীর মো. আজাদ হোসেন মুন্সী। 

এ ছাড়া স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অডিটর কেরামত আলী মোল্লা, ফ্ল্যাট নং- সি-৪, স্কাইভিউ গার্ডেন, ৭৭/১, শান্তিনগরের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত কন্ট্রোলার মির্জা সিরাজুল আলমও রাষ্ট্রীয় খরচে হজ করতে যাচ্ছেন। এদের বাইরে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরের কর্মচারীরা রাষ্ট্রীয় খরচে হজ করতে সৌদি আরবে যাবেন। এ তালিকায় সহকারী প্রকৌশলী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, উপ-প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা, ব্যক্তিগত কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং অফিস সহায়ক, ড্রাইভারসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারী রয়েছেন। 
কার্টসিঃ মানবজমিন/ জুলাই ৩০,২০১৮ 

জাল ভোটের প্রতিবাদ করায় বরিশালের মেয়র প্রার্থীর উপর আওয়ামী লীগে হামলা

বরিশালে কাউন্সিলর পদে কিছু ভোট হলেও মেয়র পদের ব্যালট দেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। জাল ভোটের প্রতিবাদ করায় বাসদের মেয়র প্রার্থী ডাঃ মনিষা চক্রবর্তীর উপর হামলা করা হয়েছে। বাসদ জেলা সভাপতি জানান, রিটার্নিং অফিসারের সামনে এ ঘটনা ঘটলেও কোন একশনে তিনি যাননি ।

জেলা বাসদ সভাপতি ইমরুল হাকিম রুমন মানবজমিনকে জানান, পৌনে ১০টার দিকে তারা তাদের মেয়র প্রার্থী ডাঃ মনিষা চক্রবর্তীসহ সদর গার্লস কেন্দ্রে জান। সেখানে তারা জানতে পারেন মেয়র ব্যালট বাদে অন্য ব্যালট দেয়া হচ্ছে। প্রার্থী ভিতরে গিয়ে দেখেন মেয়র ব্যালটে আওয়ামী লীগের কর্মীরা প্রকাশ্যে সিল মারছে। তিনি সাথে সাথে রিটার্নিং অফিসারকে সংবাদ দেন।

রিটার্নিং অফিসার দ্রুত চলে আসেন। এসময় তার সামনেই বাক বিতন্ডার এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের দুই কর্মী মনিষাকে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করে। বাসদ সভাপতি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান। এ ব্যাপারে রিটার্নিং অফিসারকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে অভিযোগ জানানোর চেষ্টা করলেও তিনি রিসিভ করেননি। 

২৫ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউদ্দিন সিকদার মানবজমিনকে অভিযোগ করেন, সোয়া ৮টার মধ্যে তার কেন্দ্রগুলো থেকে বিএনপির এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। এখন ২৪, ২৫ ২৬ নং ওয়ার্ড পুরোপুরি আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের দখলে । এখানে স্থানীয় পত্রিকার এক সাংবাদিক ভোট দিতে এসে পড়েন বিড়ম্বনায়। তাকে শুধু কাউন্সিল প্রার্থীর ব্যালট দেয়া হয়।

৪ নং ওয়ার্ডের মহাবাজ কেন্দ্রে কোন ব্যালটই দেয়া হচ্ছে না বলে ভোটারদের অভিযোগ। পুরো কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের কর্মীরা সিল মারছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রিজাইডিং অফিসার তানভির হাসান সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি আমি উপরের মহলকে অবহিত করেছি। 

মাহামুদিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে মেয়র পদে ব্যালট দেয়া বন্ধ করা নিয়ে ইসলামী আন্দোলন কর্মীদের সাথে আওয়ামী লীগ কর্মীদের হাতাহাতি হয়। সংবাদ পেয়ে ছুটে যান মেয়র প্রার্থী মাওলানা ওবায়েদুর রহমান মাহাবুব। তার সাথে বাদানুবাদের এক পর্যায়ে কিছু ভোটার ভোট দিয়েছেন বলে জানা গেছে। 

  • কার্টসিঃ মানবজমিন/ জুলাই ৩০,২০১৮