রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর
ভবিষ্যত্মুখীন অতীত বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের বহমান অর্থনীতির দশকওয়ারি ভাগ করা যেতে পারে; আবার বৈশিষ্ট্যগুলোকে নির্দিষ্ট করে চলমানতার পর্ব অনুযায়ী বিভক্তি হতে পারে। এ নির্দিষ্টকরণ এ কারণে জরুরি যে, ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে অতীতের শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেই গুরুত্বের দাবি থেকে এখানে বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য খোঁজার চেষ্টা করা হবে।
অতীতের আলোকে বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য খুঁজতে গেলে কতগুলো বিষয় মনে রাখতে হবে। অর্থশাস্ত্রের মূলধারায় অর্থনৈতিক উপাদানের মধ্যেই অর্থনৈতিক ফলাফল নির্ণয়ের চেষ্টা চলে। অর্থনৈতিক উপাদানের বাইরের বিষয়গুলো তাত্ত্বিক কাঠামোয় বহিঃস্থ প্রদত্ত চলক হিসেবে গণ্য করে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পরিবর্তনের আলোকে অর্থশাস্ত্র খাপ খাইয়ে নেয়ার নিয়ত চেষ্টারত। তাত্ত্বিক কাঠামোয় কী কী চলক অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, তা নিয়ে একমত না হতে পারলেও নিঃসন্দেহে এ কথা বলা যেতে পারে, অর্থশাস্ত্র তার চলমান ধারায় এ ঐকমত্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে যে রাষ্ট্র, রাজনীতি, ঐতিহাসিক গতি-প্রকৃতি এবং প্রতিষ্ঠান তথা আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক নিয়ম-নীতি, আচার-আচরণ, রেওয়াজ, মূল্যবোধ ইত্যাদি অর্থনৈতিক ফলাফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে স্বাভাবিক কারণেই প্রতিষ্ঠানমুখীন সমাজবিজ্ঞানে একাধিপত্য বিস্তারকারী এ শাস্ত্রের আত্মপরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি ধীরলয়ের। তাত্ত্বিক কাঠামোর এ সীমাবদ্ধতা এবং ওই কাঠামোর প্রতি একনিষ্ঠতার কারণে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও অর্থনীতির আন্তঃসম্পর্ক বিচার করে তার আলোক থেকে দেখার চেষ্টা থেকে অনেকেই বিরত থেকেছেন। হয়তোবা অনেকেই ওই বৃত্তেই থেকে যেতে চান! রাষ্ট্র, রাজনীতি ও অর্থনীতির আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ‘কেতাবি’ কোনো তাত্ত্বিক কাঠামোও নেই। অধিকাংশের জন্য ব্যবহারযোগ্য তাত্ত্বিক কাঠামোহীনতা যেমন সীমাবদ্ধতা তৈরি করে, তার চেয়ে বেশি করে সৃজনশীলতার অনেক রাস্তা খুলে দেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যে কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশে পুঁজিবাদী রূপান্তর বা উন্নয়নের টেকসই রূপান্তর ঘটেছে, তাদের সঙ্গে আগের উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বড় রকমের পার্থক্য লক্ষণীয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে হাতেগোনা গুটিকয়েক রাষ্ট্রের টেকসই অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটেছে। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এ টেকসই রূপান্তরিত দেশের তালিকায় রয়েছে। অন্যদিকে কতগুলো রাষ্ট্রের কোনো কোনো সময় মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি বেড়েছে। আবার পরবর্তীতে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বিপর্যয় ঘটেছে। ফলে বিপরীতমুখী পরিবর্তন হয়েছে, যেমন— ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, পাকিস্তান। এসব দেশ টানা অগ্রগতির মাধ্যমে স্থিতিশীলতা অর্জন করেনি। অর্থাৎ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলেই চলবে না, টেকসই হয়ে স্থিতিশীল হতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর টেকসই অর্থনৈতিক বিবর্তন অর্জনকারী দেশগুলোয় সক্রিয় রাষ্ট্রের উপস্থিতি লক্ষণীয়। টেকসই রূপান্তরে রাষ্ট্র শুধু নিজেকে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির মধ্যে সীমিত করেনি। রাষ্ট্র যেমন একদিকে পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রণোদনা প্রদান করেছে, তেমনি যদি পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রণোদনার অপব্যবহার হয়েছে, রাষ্ট্র কঠোর হাতে পুঁজিপতিদের দমন করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা বজায় রেখেছে। এ দুই হাতের সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে অত্যন্ত প্রভাবশালীও বাদ পড়েনি। দক্ষিণ কোরিয়া বা চীন থেকে অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর টেকসই অর্থনৈতিক বিবর্তন অর্জনকারী দেশগুলো সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছে, অতীতের উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোকে হুবহু অনুসরণ করেনি, ইতিহাসলগ্নতায় নিবিষ্ট থেকে দেশোপযোগী কৌশল উদ্ভাবন করেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে অনেক অতি উৎসাহীর আড়ম্বরপূর্ণ অথবা কদর্যময় বাগাড়ম্বরের অভাব ঘটেনি। জন্ম থেকেই চলছে। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ দিয়ে শুরু হয়েছিল। একটু চিনির প্রলেপ লাগিয়ে বলা হয়েছিল ‘টেস্ট কেস’। বেশ কয়েক বছর তাদেরই কোনো না কোনো তরফের উত্তরাধিকারীরা ‘বাংলাদেশ’-এর পরে ‘প্যারাডক্স’, ‘সারপ্রাইজ’ বা ‘ধাঁধা’ বা ‘আপাতবৈপরীত্য’ বা ‘আশ্চর্য’ বৈশিষ্ট্য যুক্ত করছেন। সাম্প্রতিককালে ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’ চালুর চেষ্টা লক্ষণীয়। এ বাগাড়ম্বরগুলো গোষ্ঠী স্বার্থ হাসিল বা তাঁদের নিজস্ব অস্তিত্বকে জাস্টিফাই করার ধূম্রজাল সৃষ্টির জন্য করা হয়ে থাকে বলেই এ কথামালা বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে না এবং পরবর্তীতে যখন তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়, তখন অসারতায় পর্যবসিত হয়।
বাংলাদেশের আলোকে বাংলাদেশকে দেখতে হলে বা বাংলাদেশের উন্নয়নের দশকওয়ারি অথবা পর্ব অনুযায়ী বৈশিষ্ট্য খুঁজতে গেলে একদিকে যেমন উৎপাদনের উপকরণ তথা ভূমি, পুঁজি, শ্রমশক্তি, প্রযুক্তির গতিপ্রকৃতি ও পরিবর্তন অনুসন্ধান করতে হবে; পাশাপাশি রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক যথা— জনগণ কী ধরনের রাষ্ট্র চেয়েছে, রাষ্ট্র আসলে কী ধরনের রূপ নিয়েছে এবং কার দ্বারা ও কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তা বিবেচনায় নিতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের আন্তঃসম্পর্কে কী ও কীভাবে পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয়, এ রাষ্ট্রটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে হয়েছে। এই মহান মুক্তিযুদ্ধের একটি ইতিহাসলগ্নতা আছে, তা যেমন পাকিস্তান সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত, তেমনি বাংলাদেশ সৃষ্টির সঙ্গেও। পাকিস্তান সৃষ্টির যৌক্তিক ব্যাখ্যা জানা যেমন প্রয়োজনীয়, ওই রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্রুত মোহভঙ্গের কারণ জানা দরকার। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত তিনটি স্তম্ভ— সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার— বাংলাদেশ বিশ্লেষণের তাত্ত্বিক কাঠামোর মৌল চলক। অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবহমানতা বোঝার জন্য রাজনৈতিক বন্দোবস্তও বোঝা জরুরি।
২
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে কেন উৎপাদনমুখীন অবস্থা তৈরি হলো না কিংবা স্বাধীনতা-পরবর্তী যে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্রের তথা আপামর জনতার স্বপ্নের, সে বাংলাদেশ তৈরি হলো না? এটাই মৌলিক প্রশ্ন। এ প্রশ্নের যদি মীমাংসা করতে হয়, তাহলে ভবিষ্যতের বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বিনির্মাণে তা যথেষ্ট শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের কর্মকৌশল প্রণয়ন করা যাবে এবং বর্তমানে যে ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে তা সহজসাধ্য হয়ে যাবে। স্বাধীন বাংলাদেশে এ বিষয়গুলো কেন বাস্তবায়ন হলো না, তার মীমাংসা রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সঠিক অনুসন্ধানের মধ্যে নিহিত। রাজনৈতিক বন্দোবস্তের চরিত্র লক্ষ করলে এর ইতিবাচক দিকটি হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো রাষ্ট্রই রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেনি। তার মানে এ দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিশ্রুতির জায়গাটি ছিল অনেক বড়। কেন, কী কারণে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসনিক যন্ত্র সে ধরনের কর্মকৌশল প্রণয়ন করতে কিংবা আমলাতন্ত্র সেই কর্মকৌশল কেন বাস্তবায়ন করতে পারল না— এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এবং এটি মীমাংসা করাও জরুরি। যদি এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে সেই অনুযায়ী কর্মকৌশল নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে যে ধরনের বাংলাদেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেই দেশের পথে অগ্রসর হওয়া যাবে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে পুঁজির আকাল ছিল। সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয়েছিল, পুঁজি মূলত কৃষির উদ্বৃত্ত ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে আসবে। কৃষি থেকে উদ্বৃত্ত হলো না। কৃষিতে দিন দিন প্রান্তিক কৃষক যেমন বাড়তে থাকল, তেমনি বাড়তে থাকল ভূমিহীনের সংখ্যা। কৃষিতে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বাড়ার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার দরকার ছিল, তেমনি দরকার ছিল উৎপাদনের উপকরণের সহজলভ্যতা ও মহাজন-ফড়িয়া-বর্গাদার তথা বাজার ব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের থেকে কৃষকদের পরিত্রাণ। ‘সবুজ বিপ্লবে’র ডাক দেয়া হলো কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রদত্ত গভীর নলকূপ ব্যবহারের জন্য গঠিত কৃষক সমবায় সমিতির হর্তাকর্তা যেমন বনে গেলেন শাসকদলের গ্রাম পর্যায়ের নেতা বা তার অনুসারী, অন্যদিকে সারের ডিলার হলেন শাসকদলের গ্রাম পর্যায়ের ওই বা আরেক নেতা বা কর্মী। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের নিজস্ব সম্পদ বাড়তে থাকল কিন্তু উৎপাদনশীল পুঁজি তৈরি হলো না। কৃষিকে আরেক বড় ওজন বয়ে চলতে হলো। অন্য কর্মসংস্থান প্রদানের খাত না থাকায় অধিকাংশ মানুষকে কৃষির ওপর নির্ভরশীল থাকতে হলো। এ অধিকাংশ ছদ্মবেকারের উপার্জনও কম। ফলে তাদের কোনো সঞ্চয় থাকল না, বরং ঋণ নিয়ে জীবন নির্বাহ করতে হলো— এ বিশাল জনগোষ্ঠীও কোনো পুঁজি জোগান দিতে পারল না।
অন্যদিকে পরিত্যক্ত শিল্প-কলকারখানা পরিচালনার জন্য অগত্যা রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হলো। খুবই কমসংখ্যক বাঙালির শিল্পমালিকানা ছিল। এগুলোও জাতীয়করণ হয়েছিল। পরিত্যক্ত শিল্প-কলকারখানার তুলনায় জাতীয়করণের সংখ্যা নগণ্য ছিল। এখানে যে বিষয়টি পরিষ্কার করা এবং বোঝা দরকার তা হচ্ছে, যে জাতীয়করণ করা হয়েছিল, তা কি আদর্শগত, না তা তত্কালীন পরিপ্রেক্ষিতের বাস্তবতা। এ কলকারখানা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন সরকারি দলের নেতা বা সমর্থনপুষ্ট ব্যক্তি বা আমলা। এ প্রশাসকরা প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতির মাধ্যমে উদ্বৃত্ত তৈরি ও বিনিয়োগের পরিবর্তে লুটপাট শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই আগের লাভজনক প্রতিষ্ঠান লোকসানি রোগাক্রান্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় ।
শিল্পের বিকাশ হচ্ছিল না, কিন্তু এক ধরনের বাণিজ্যনির্ভর শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটছিল। তারা যতটা না শিল্প স্থাপনে নিজেদের নিয়োজিত করছিল, তার চেয়ে একজন বেনিয়া বা আমদানিকারক হিসেবে কাজ করার আগ্রহের পরিমাণ তাদের মধ্যে বেশি ছিল। পুঁজির বিকাশ ঘটছিল এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই। পুঁজিকে উৎপাদনমুখী কাজে ব্যবহারের জন্য বা শিল্পের ভিত্তি স্থাপনের তেমন কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। রাষ্ট্র উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে জুতসই কোনো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেনি, যার মাধ্যমে শিল্পের বিকাশ ঘটানো যায়। তবে পরিকল্পনা কমিশনের আমদানি বিকল্প শিল্প নির্মাণের এক ধরনের প্রচেষ্টা ছিল। কিন্তু শাসকদলের চরিত্রের সঙ্গে এ পরিকল্পনাগুলোর যোজন দূরত্ব ছিল। শাসকদলের অধিকাংশ সদস্য মধ্যবর্তী শ্রেণীগুলোর অংশভুক্ত ছিল। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে নিজস্ব সম্পদ বাড়ানোই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। পরিকল্পনাগুলো এতটাই রাজনীতি থেকে বিযুক্ত ছিল।
বাংলাদেশে পুঁজির ঘাটতিমূলক পরিস্থিতি এবং সঞ্চয় ও বিনিয়োগের পার্থক্য মেটাতে বৈদেশিক সাহায্যের আবির্ভাব ঘটল। কম দেশীয় সঞ্চয় মোকাবেলার জন্য বৈদেশিক সাহায্যকে পুঁজি সরবরাহের একটি বড় ক্ষেত্র হিসেবে দেখা হলো। বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে পুঁজি সরবরাহ করলেন তারা, একটি নির্ভরশীলতার অর্থনীতিরও জন্ম দিলেন। এ নির্ভরশীলতা দেশের মধ্যে এক ধরনের নির্ভরশীল শ্রেণী তৈরি করল। এ নির্ভরতা থেকে পশ্চিমা বিশ্বের হেজিমনি তৈরির রাস্তা সুগম হতে থাকল। শাসককুলের মধ্যে আস্তে আস্তে তাদের চিন্তা-চেতনা প্রবেশ করতে থাকল এবং আস্তে আস্তে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব বাড়তে থাকল।
যুদ্ধ-পরবর্তী যেকোনো দেশের মতোই বাংলাদেশে দক্ষ জনশক্তির অভাব ছিল। বিশাল পরিমাণ জনগোষ্ঠীর কাজ ছিল না। ব্যাপক পরিমাণে জনগোষ্ঠী কৃষির ওপর নির্ভর ছিল। শিল্প বিকাশের অভাবে নতুন কোনো কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছিল না, আবার কৃষির ওপর অধিকাংশ মানুষের নির্ভরশীলতার কারণে প্রকৃত খাত বাড়ছিল না। বাংলাদেশে বিরাজ করছিল বড় রকমের দারিদ্র্য পরিস্থিতি। কৃষির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে গ্রামীণ বাংলায় প্রচণ্ড মাত্রায় দারিদ্র্য পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল। একপর্যায়ে লাখ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার হয়।
তেমনি দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যে ধরনের রাষ্ট্রীয় নীতি-কাঠামো প্রয়োজন, সেসবেরও অভাব ছিল। নীতি-কাঠামো ও দক্ষ শ্রমিক সরবরাহ করার মাধ্যমে একদিকে যেমন তারা উৎপাদনে নিজেদের নিয়োজিত করবে, অন্যদিকে নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়াবে, সে রকম প্রক্রিয়াও জারি ছিল না। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কেবল গড়ে উঠছিল এবং দেশের জনসংখ্যার তুলনায় এর সরবরাহ সীমিত ছিল। তাছাড়া বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে তৈরি করার জন্য যে ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা, কারিগরি ব্যবস্থা প্রয়োজন, সে ধরনের প্রচেষ্টা ও পরিস্থিতিও বিদ্যমান ছিল না। অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ কম থাকায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে রাষ্ট্রীয় ব্যয় সীমিত ছিল। অর্থনীতির আকার ছোট থাকায় শুধু আমদানি শুল্কই রাষ্ট্রের আয়ের উৎস ছিল।
৩
এ ধরনের পরিস্থিতি কেন তৈরি হচ্ছিল, সেই আলোচনাটা করা জরুরি। এক্ষেত্রে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। প্রথম বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে, বাংলাদেশ উত্তরাধিকারসূত্রে এমন একটা রাষ্ট্রযন্ত্র পেয়েছে, যা ছিল মাত্রাতিরিক্ত আমলাতান্ত্রিক। এ আমলাতন্ত্রকে অভিহিত করা হতো ‘সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস’ বলে। অর্থাৎ এ শ্রেণীটি নিজেদেরকে সাধারণ মানুষ থেকে উপরে ভাবতে এবং নিজেদের শাসক মনে করত। কর্তৃত্ববাদী আমলাতন্ত্র ক্রমে রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপরে বড় রকমের নিয়ন্ত্রণ জারি করে ফেলেছিল।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে একটা শ্রেণীর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে জোরজবরদস্তির মাধ্যমে সম্পদ ও পুঁজি সঞ্চয়ের চেষ্টা চলল। শাসকদলকে ব্যবহার করে এক ধরনের লাইসেন্স রাজত্ব তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। তার সঙ্গে রাষ্ট্রের ক্ষমতাবলয়ের মাধ্যমে পুঁজি সঞ্চয়নের চেষ্টা করা হয়েছে। আমলাতন্ত্র বাধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা কেবল গুটিকয়েকের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করার জন্য কাজ করেছে। পরিকল্পনা কমিশনেও পরিকল্পনা যন্ত্র ও পরিকল্পনার কৌশল প্রণয়নের প্রক্রিয়াগুলো ছিল কণ্টকপূর্ণ, যা অনেক ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ফলে প্রথম পরিকল্পনা কমিশন একসময় ভেঙে যেতে বাধ্য হয়েছে।
শাসকদল শাসনক্ষমতা রেখেছিল একান্তই নিজেদের মধ্যে। স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেক রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছিল। সব দলকে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠনের চেষ্টাটা ছিল না। ফলে বড় রকমের হুমকি তৈরি হলো এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরোধও চালু ছিল। এক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সক্রিয় ছিল না। এছাড়া রাষ্ট্রের আরেকটি অন্যতম কাঠামো তথা সামরিক বাহিনীতেও এক ধরনের মতপার্থক্য ছিল। ফলে সবসময় একটা দুশ্চিন্তা জারি ছিল।
যেকোনো গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দল থাকবে, মত থাকবে এবং দল-মতের পার্থক্য থাকতে হবে। দল এবং মত তখনই কাজ করতে পারবে যখন দেশে গণতান্ত্রিক সংবিধান তৈরি হবে। সংবিধান হচ্ছে জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের চুক্তি। এটি যত অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে তত অধিকার প্রদান করবে। ১৯৭২ সালে আমরা সংবিধান তৈরি করেছি (যা এখনকার চেয়ে অনেক মানসম্পন্ন ছিল)। কিন্তু সেই সংবিধান তৈরির ক্ষেত্রে যে ধরনের সাংবিধানিক সভা দরকার ছিল, জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটানো দরকার ছিল, তার কিন্তু ঘাটতি রয়েই যায়। ফলে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত মৌলিক অধিকারগুলো কেবল নীতিমালায়ই রয়ে গেছে। নাগরিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার চেষ্টার মৌল ভিত্তি গণতান্ত্রিক সংবিধান। এটি তৈরির চেষ্টার মধ্যেও কিন্তু এক ধরনের ঘাটতি লক্ষণীয়। এ ঘাটতি পূরণ হতে পারত যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি হতো। কিন্তু এর বিপরীতে একটি বড় অংশ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারেনি। নাগরিক রাষ্ট্র তৈরির ক্ষেত্রে এ ঘাটতি লক্ষ করা গেছে।
গণতান্ত্রিক নাগরিক রাষ্ট্র তৈরি না করা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের একমুখিতার ফলে সৃজনশীলতা তৈরি হয়নি। রাষ্ট্র তেমন পরিস্থিতির দিকে অগ্রসর হয়নি, যার মাধ্যমে টেকসই অর্থনীতি ও উৎপাদন ক্ষমতার বিকাশ ঘটবে। কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা সত্ত্বেও তখনো কৃষি খাতে প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটেনি এবং কৃষির বহুমুখীকরণের তেমন কোনো পরিকল্পনা তখন পর্যন্ত নেয়া হয়নি। ফলে বিরাট অংশের মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতে হয়েছে। এর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতার কারণে এমন একটা মধ্যবর্তী শ্রেণী তৈরি হয়েছে, যারা ক্রমাগত তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করেছে। লুটপাট করেছে। ফলে তখন থেকেই বাংলাদেশে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। এ বৈষম্য ব্যবস্থা স্বাধীনতার অন্যতম স্তম্ভ সাম্যের সঙ্গে বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে। এ বৈষম্য থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য যে ধরনের চিন্তা কাঠামো দরকার ছিল, সে ধরনের চিন্তা কাঠামো গঠিত হয়নি। একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র তৈরির জন্য স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যে ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা জরুরি ছিল, যে অনুযায়ী শিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের জন্য সর্বজনীন অধিকারগুলোর কথা চিন্তা করা হয়নি। এমনকি রাষ্ট্র এখন পর্যন্ত পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে পারেনি। সংবিধানে বলা আছে প্রয়োজন অনুযায়ী বিকাশের মাধ্যমে সমতা বজায় রাখার কথা। রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা না হওয়ার কারণে সমতা অর্জনের জন্য কোনো কালেকটিভ বা পাবলিক অ্যাকশনের দিকে যাওয়া সম্ভব হয়নি। যেমন— নদীমাতৃক বাংলাদেশকে ব্যবহার করার জন্য কিংবা জাতীয় সম্পদগুলো ব্যবস্থার মাধ্যমে অনেক কালেকটিভ অ্যাকশন হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। কারণ সামাজিক চুক্তি তৈরি হয়নি। ফলে নাগরিকের অর্থনৈতিক অধিকার এবং উৎপাদনমুখী রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি।
৪
রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এমন কোনো ব্যবস্থা চালু করেনি, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের তত্কালীন চ্যালেঞ্জ, নতুন রকমের কর্মোদ্যোগী কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে উৎপাদনশীল খাতের বিকাশ তৈরি করা সম্ভব ছিল। তাছাড়া শ্রমশক্তি তৈরির জন্য যে ধরনের খাতকে প্রাধান্য দেয়া জরুরি, তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করাও সম্ভব হচ্ছিল না। চলমান পরিস্থিতি থেকে পুঁজিবাদী রূপান্তরের জন্য যে রকম প্রযুক্তিগত উন্নয়ন দরকার ছিল, বিশেষ করে কৃষিতে, শিল্পে, যার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যাবে, সেই ব্যবস্থাও জারি ছিল না। কারণ তেমন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি হচ্ছিল না। বিপরীত ধারায় এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি হচ্ছিল, যা ক্রমে একনায়কত্বের দিকে ধাবিত হচ্ছিল। এক সময়ে একদলীয় শাসন চালু করা হলো। নির্দিষ্ট কয়েকটি রাষ্ট্রীয় মালিকানার বাইরে সব সংবাদমাধ্যম বন্ধ করা হলো। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হতে থাকল। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকারের সংখ্যা বেড়ে চলল। অন্তর্ভুক্তিমূলক বা প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে একটি দেশের মধ্যে যে উন্নয়নশীলতা তৈরি হয়, তা তৈরি করা সম্ভব হলো না।
রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে যারা সম্পদ ও পুঁজি সঞ্চায়ন করেছে, তাদের কাছে রাষ্ট্র আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। এর সঙ্গে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরশীলতার সংস্কৃতি তৈরি করেছে এবং পরবর্তীতেও নির্ভরশীলতার এ সংস্কৃতি চালু রয়েছে। ফলে সৃজনশীল কায়দায় পুঁজি, শ্রম ও দক্ষতার বিকাশের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। অবহেলিত থেকেছে প্রযুক্তির ব্যবহার। অর্থাৎ দেশোপযোগী প্রযুক্তির মাধ্যমে কীভাবে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা যায়, সে প্রক্রিয়ারও অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। রাজনৈতিক বাস্তবতায় যেহেতু রাষ্ট্রের মধ্যে এক ধরনের টেনশন কাজ করেছে, তখন বিভিন্ন বিদেশী সংস্থা বা রাষ্ট্র বিভিন্ন রকমের সুযোগসন্ধানী সুবিধাভোগী ভূমিকা রেখেছে এবং রেখে চলছে। এ ধরনের ভূমিকা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, যার কারণে তারা আন্তর্জাতিক রাজনীতিরও শিকার হয়েছে।
অর্থাৎ রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা এমন শ্রেণীর কাছে গেছে, যারা উদ্যোক্তা হতে মনোনিবিষ্ট হয়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশে বিশাল অংকের মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেছে। রাষ্ট্র যেহেতু অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না, তাই কোনো কোনো ক্ষেত্রে সশস্ত্র প্রতিরোধের শিকার হয়েছে। রাষ্ট্র স্থির থাকতে পারেনি। রাষ্ট্র রাজনৈতিক বন্দোবস্তে স্থির থেকে স্বাধীনতা-পরবর্তী যে ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা তৈরি করার প্রয়োজন ছিল, তা করতে পারেনি। অন্যদিকে নাগরিক রাষ্ট্র হিসেবে রূপান্তরিত না হওয়ায় নাগরিকদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্ম ও সংবিধানে উল্লিখিত সুযোগগুলো বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। এমন অনেক দ্বন্দ্বমূলক অবস্থানের কারণে এ ধরনের একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা না থাকে, রাষ্ট্র কাঠামো যদি নাগরিক রাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর না হয় এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদের সঞ্চয়ন থাকে, তাহলে যে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়, সে পরিস্থিতি তত্কালে লক্ষ করা গেছে।
- লেখক: অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারপারসন, উন্নয়ন অন্বেষণ