— অরুন রহমান
সোমবার, জুলাই ৩০, ২০১৮ — বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেটের কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটডাকাতি চলছে, ঠিক সকাল আটটায় ভোট শুরুর পর থেকেই তিন শহরের ভোটকেন্দ্রগুলো নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় একে একে দখল করে নেয় আলীগের নেতাকর্মীরা।
সকালে দেশের মানুষ ইন্টারনেটে বিভিন্ন মিডিয়া আউটলেটে ঢুকেই দেখল ও শুনল চারিদিকে চরম অরাজকতা ও বিশৃংখলা, যেন ভোটের শহরগুলোর জনপদে জনপথে ডাকাত পড়েছে — সহিংসতা, ব্যালটছিনতাই, জালভোট, কেন্দ্রদখল, পোলিংএজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে বাধা, আর প্রার্থী ও ভোটারদের আর্তনাদের স্থির ও ভিডিও চিত্র। সারাদেশ যেন এলোমেলো। কোন আইন নেই। সংবিধান নেই। মানুষের ভোটাধিকার পদদলিত করছে ভোটডাকাতরা।
‘...দীর্ঘক্ষণ ধরে দলে দলে সিলেটের হাতেম আলী ভোটকেন্দ্রে জালভোট দেয়া হচ্ছে,’ আঙ্গুলে ভোট দেয়ার অমোচনীয় কালি লাগানো একজনকে হাতেনাতে ধরে একাত্তর টিভির এক সাহসী রিপোর্টার তা লাইভ দেখিয়েছেন।
যুগান্তর রিপোর্ট পাবলিশ করেছে, বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জালভোটের প্রতিবাদ করায় বাসদের মেয়রপ্রার্থী ডা. মনীষা চক্রবর্তীর ওপর বাঁশ দিয়ে হামলা, নির্যাতন ও লাঞ্ছিত করেছে আলীগের কর্মীরা। এতে তাঁর হাত ভেঙ্গেছে।
বরিশাল থেকে একাত্তর টিভির আরেক রিপোর্টার দেখালেন, একজন পোলিং অফিসার নিজেই ভোট দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তখন সেই কেন্দ্রের সব ব্যালটপেপার শেষ! বাইরে ভোটারদের লাইন!
প্রথম আলো একটি ভিডিওক্লিপ পোস্ট করেছে — বরিশাল মহানগর পশ্চিম কাউনিয়া এলাকার সৈয়দা মজিদুন্নেছা মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের, যেখানে দেখা যাচ্ছে ভোটকেন্দ্র দখল করে শুধুই নৌকায় সিলমারা হচ্ছে। ব্যালট বইয়ে পুরোটাতেই নৌকায় সিল। সিলেট সিটির ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের মীরা বাজার মডেল স্কুল কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ছিনতায়ের ছবিও পোস্ট করা হয়েছে ।
বাংলাট্রিবিউনের এক রিপোর্ট’র হেডলাইন — সিলেটে তিন কেন্দ্রে সংঘর্ষ।
যুগান্তরের আরেক রিপোর্টের হেডলাইন — সিলেটে ভোট শুরুর ১০ মিনিট পর কেন্দ্র দখল-জালভোট।
মানবজমিন আরেকটি ছবি পোস্ট করেছে যেখানে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মেয়রপ্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ইসলামীয়া ভোটকেন্দ্রের বাইরে অবস্থান নিয়েছেন। ওই কেন্দ্রেমেয়র প্রার্থীর ব্যালট শেষ হয়ে গেছে অভিযোগ করে বুলবুল প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে ব্যালটের হিসাব চেয়েছেন। সেইখানে ভোটাররা লাইন ধরে আছে, কিন্তু মেয়রের ব্যালট নেই।
এনটিভিকে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনার মাহাবুব তালুকদার বলেছেন, ‘আমি শুনেছি বরিশালে ভোটকেন্দ্র দখল হয়েছে। সেখানে একজন মেয়র প্রার্থীর সঙ্গে খারাপ আচরণও করা হয়েছে। বিএনপির প্রার্থী ভোট বর্জনও করেছেন। এসব বিষয় নিয়ে আমরা কমিশনে আলাপ-আলোচনা করছি।’
আজ ইন্টারনেট মিডিয়া আউটলেটগুলের ফ্রন্টপেইজে শুধু ভোট ডাকাতির নিউজ। কাল সকালে এগুলো সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় স্থান পাবে কিনা তা দেখার বিষয়। বাস্তবে ইন্টারনেট মিডিয়ায় পাবলিশ হয়েছে ভোট ডাকাতির খন্ডছিত্র। এই খন্ডচিত্রকে লাখোগুণ বাড়িয়ে দিলেই পুরোচিত্রটি অনুধাবন সম্ভব।
বাংলাদেশে ১৯৯০এ স্বৈরাচার এরশাদ শাহীর পতনের পর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পেরেছিল। ভোটের দিন ছিল ঈদের দিনের মতো আনন্দের, পরিবার,বন্ধু-বান্ধব মিলে কেন্দ্রে যেত সবাই। ভোট যার যার, ভোট উৎসব ছিল সবার। এমনকি একই পরিবারে অথবা বন্ধুদের একই সার্কেলে ছিল বিভিন্ন দলের সমর্থক। তর্ক-বিতর্ক হত। কেন্দ্রে যে যার মত ভোট দিয়ে চা দোকানে বসে আড্ডা দিত। সন্ধ্যা থেকে ফলাফলের খবর আসা শুরু করত । সুস্থ নির্বাচন হওয়াতে সবাই মেনে নিত সেই রেজাল্ট। দলের পরাজয়ে সেইদলের সমর্থকরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করত, যাতে ভবিষ্যতে তাঁরা জিততে পারে। এগুলো কোন রূপকথা নয় — ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এর জাতীয় নির্বাচন এবং এই সময়কালের বিভিন্ন নির্বাচন ছিল এমনই উৎসব মুখর। তখন বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে বলা হত মুসলিম বিশ্বের জন্য রোল মডেল।
কিন্তু আজ বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকারতো অনেক দূরের কথা স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকারটুকুও নেই। এই বছরেই বিশ্বের নতুন পাঁচটি ‘স্বৈরতান্ত্রিক দেশের’ তালিকায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভূক্ত করেছে জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্যার্টেল্সমান ফাউন্ডেশন৷ জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিশ্বের সব গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা গত একদশক ধরে বাংলাদেশের মানুষের অধিকার হারানোর বিষয়ে বারবার বিনাভোটের স্বঘোষিত সরকারকে তাদের গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতালিপ্সু গোষ্ঠী বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করছে না।
দেশের মানুষের ভোটাধিকার হারানোর প্রক্রিয়াটা শুরু হয় আসলে ১/১১ এর মঈন-ফখরুদ্দিনের সময় থেকে। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে নানা অপকৌশলে দমন করা হয়। এরপর জানুয়ারি ৫, ২০১৪ এর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনাভোট ও ভোটারবিহীন এক ভোট নাটকের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল নিজেদেরকে ক্ষমতায় আসীন রাখে।এরপর থেকেই আর মানুষ ভোট দিতে পারছে না।
দেশ-বিদেশের মানুষের সামনেই বাংলাদেশে এখন প্রতিটি নির্বাচনে ভোট ডাকাতি চলছে। ভোটারবিহীন প্রহসনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা নিজেদেরকে বিজয়ী ঘোষণা করছে, শপথ নিচ্ছে, মিষ্টি খাচ্ছে, হাঁসিমুখে ছবি তুলছে। সংবাদ মাধ্যমে সেগুলো গুরুত্ব দিয়ে প্রচারিত হচ্ছে। সেখানে শুধু নেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন।
ক্ষমতালিপ্সু সেইসব গোষ্ঠীদের স্মরণ করিয়ে দেয়া যেতে পারে — জীবনবাজি রেখে যুদ্ধকরে দেশ স্বাধীন করেছে সাধারণ মানুষ, দেশের মালিক তাঁরাই। তাঁরাই ঠিক করবে তাঁদের দেশের সরকার কারা হবে, তাঁদের শহর, নগরে কারা নেতা হবেন। তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে গায়ের জোরে তাঁদের শাসন করার চেষ্টা সীমাহীন লজ্জার।
- লেখক ইন্টারনেট এক্টিভিস্ট।