শুভ্র দেব
পুলিশের মামলার এজাহারে তারিখ লেখা হয়েছে ৩০শে সেপ্টেম্বর রোববার। ঘটনার সময় দেয়া হয়েছে রাত ৮টা ৫ মিনিট। ঘটনার স্থান মগবাজার রেলগেট। মামলার বাদী পুলিশের উপপরিদর্শক শরিফুল ইসলাম। মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা রাষ্ট্রীয় নাশকতা ও ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম করার জন্য রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটিয়েছেন। এ ছাড়া যানবাহন ভাঙচুর, পুলিশের ওপর আক্রমণ, হত্যার উদ্দেশ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য ককটেল বিস্ফোরণ করেছেন। মামলায় বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা ছাড়াও আসামি করা হয়েছে ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, শ্রমিকদল, জামায়াত ও শিবিরের শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের। এই মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতাকর্মীদের মধ্যে মির্জা আব্বাসকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে।
বাকিরা হলেন- গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, আমান উল্লাহ আমান, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার, রুহুল কবীর রিজভী। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেও আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী সমাবেশের আগে থেকে বিদেশে অবস্থান করছেন। তারপরও তাকে মামলায় আসামি করা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়েছে এই নেতারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে সমাবেশে সরকারবিরোধী উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান ও বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
পুলিশের এমন অভিযোগের পর গতকাল ওই এলাকায় খোঁজ নিয়ে এমন কোনো ঘটনা ঘটার সত্যতা পাওয়া যায়নি। বরং এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে কিনা জানতে চাইলে বিস্মিত হয়েছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ বলছেন ভৌতিক বিষয় সামনে এনে এসব মামলায় জনগণের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ক্রমেই কমছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন শুধু বিএনপির সমাবেশের দিন কেন গত কয়েক বছরে ককটেল বিস্ফোরণ, মারামারি, পুলিশের ওপর হামলার কোনো ঘটনা ঘটতে দেখা যায়নি। মগবাজার রেলগেট থেকে ১০ হাত দূরে চা-পান বিক্রি করেন মুজিবুর রহমান। ওই দিন রাতের বেলা তার দোকান খোলা ছিল।
তিনি বলেন, অনেক সময় কাজের ব্যস্ততার জন্য অনেক কিছু চোখে পড়ে না আবার দেখাও যায় না। তবে এধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে এলাকায় একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ত। আর রেলগেট তো আমার চোখের সামনে। কিছু ঘটলে অবশ্যই চোখে পড়ত। কোনো শব্দও শুনতে পাইনি। ইউনিভার্স মটরর্সের কর্মী রহিম বলেন, আমি ওই রাতে ডিউটিতে ছিলাম। মারামারি বা ককটেল বিস্ফোরণের কোনো ঘটনা ঘটেনি। কারো মুখে এ ধরনের কোনো ঘটনার কথাও শুনিনি।
মগবাজার রেলগেট থেকে এফডিসি রেলগেট পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ পান-সিগারেট বিক্রেতা আলাউদ্দিন মিয়া বলেন, আমার যতটুকু মনে পড়ে ওই দিন সাড়ে ৮টার দিকে আমি এই এলাকায় ছিলাম। আমি একসঙ্গে অনেক লোক জমায়েত হতে দেখিনি। স্বাভাবিক ভাবেই যানবাহন চলাচল করছিল। কোনো যানবাহন ভাঙচুর হতে দেখিনি। রেলগেটের খুব কাছেই অবস্থান আকরাম অটো পার্টস ও সার্ভিসিং সেন্টারের। আকরাম বলেন, মগবাজার এলাকায় এখন আর এসব হয় না। এখানে কিছু ঘটলে আমরা জানতে পারি। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ঘটেনি।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আসামিরা বেআইনিভাবে সড়ক অবরোধ ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ না করার জন্য পুলিশের অনুরোধ উপেক্ষা করে পুলিশের ওপর আক্রমণসহ ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এ সময় আশেপাশে থাকা ২টি সিএনজি ও ১টি বলাকা বাস ভাঙচুর করে। ভাঙচুরের কারণে ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে ১ লাখ টাকা। গাড়িগুলো নিজেদের আত্মরক্ষার্থে দ্রুত চলে যাওয়ার কারণে গাড়িগুলোর নম্বর রাখা সম্ভব হয়নি। কিন্তু গতকাল রাজধানীতে চলাচলকারী বলাকা বাসের অন্তত ২০ জন চালক ও তাদের সহযোগীদের সঙ্গে কথা বলে বলাকা বাস ভাঙচুরের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। মগবাজার এলাকায় বলাকা বাসের চালক শরীফ বলেন, আমাদের কোনো বাস দুর্ঘটনার কবলে পড়লে বা অন্য কোনো ঘটনার শিকার হলে আমরা খবর পাই। তবে বিএনপির সমাবেশের দিনে কোনো বাস ভাঙচুর হয়েছে বলে আমার জানা নাই। অপর এক বাসের চালকের সহকারী আলম জানান, সড়কে চলাচল করলে আমাদের বলাকা বাসের সব খবরই আমরা কোনো না কোনোভাবে পেয়ে যাই। তবে গত কয়েকদিন ধরে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।
পুলিশ বলছে, এসব ঘটনার পর জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ঘটনাস্থল থেকে পালানোর চেষ্টাকালে কুমিল্লা জেলা বিএনপির ভাইস প্রেসিডেন্ট মোবাশ্বের আলম ভুঁইয়া, বাড্ডা থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মো. আওলাদ হোসেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৪৮নং ওয়ার্ড কমিশনার মো. শফিউদ্দিন, ১৮নং গুলশান থানার বিএনপি সভাপতি রাশেদ বিন সোলায়মান, ভালুকা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন, ৪১নং সাতারকুল বাড্ডা থানার যুবদল সভাপতি মো. সামছুল হক, লাঙ্গলকোট থানা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক শিহাব খন্দকারকে গ্রেপ্তার করা হয়। সোমবার তাদেরকে আদালতে হাজির করে রিমান্ড আবেদন করা হয়। আদালত তাদের এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
মামলার বাদী হাতিরঝিল থানার উপপরিদর্শক শরিফুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, ঘটনাটি খুবই ক্ষণিকের। একদিকে গাড়ি চলাচল করছে অন্যদিকে এই ঘটনা ঘটেছে। একটি বাস আরেকটি বাসের সঙ্গে সংঘর্ষ লাগলে যে ধরনের শব্দ হয় ঠিক সে ধরনের শব্দই হয়েছিল। আশেপাশের লোকজন বুঝে উঠার আগে বিষয়টি শেষ হয়ে যায়।
তিনি বলেন, ঘটনাস্থল থেকে আমাদের অবস্থান কাছেই ছিল। আমরা আগে থেকেই সতর্ক ছিলাম। ওইদিন রাত সাড়ে আটটার দিকে ডিউটিরত অবস্থায় খবর পেয়ে মগবাজার রেলগেট এলাকায় এ ধরনের পরিস্থিতি দেখতে পাই। তখন আশেপাশে থাকা পুলিশের আরো কয়েকটি টিম মিলিত হই। আমাদের বাধা উপেক্ষা করে তারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আমাদের ওপর লাঠি দিয়ে হামলা করে। গাড়ি ভাঙচুরের বিষয়টি আশেপাশের মানুষ টের পায়নি বলে ককটেল বিস্ফোরণের শব্দও কি কেউ টের পায়নি এমন প্রশ্নে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, গাড়ির সংঘর্ষের শব্দের মতো হওয়ায় কেউ আর বুঝেনি।
- কার্টসি: মানবজমিন/ ০৩ অক্টোবর ২০১৮