Search

Tuesday, October 2, 2018

বারবার সুবিধা নেয় কিন্তু ঋণ পরিশোধ করে না অলটেক্স

মেহেদী হাসান রাহাত 

খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ নিয়েছে অলটেক্স গ্রুপ। গত বছর ১২৯ কোটি টাকা সুদ মওকুফ সুবিধা গ্রহণের সুযোগও পায় গ্রুপটি। তার পরও রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ৩৬৫ কোটি টাকা পরিশোধ করছে না অলটেক্স। ঋণের টাকা পরিশোধে অলটেক্স গ্রুপ তাদের বন্ধ কোম্পানি ও জমি বিক্রির চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে।

জানা যায়, ২০১০ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে সোনালী ব্যাংকের মতিঝিলের স্থানীয় কার্যালয় (লোকাল অফিস) থেকে ঋণ নেয় অলটেক্স গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠান অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, অলটেক্স স্পিনিং ও অলটেক্স ফ্যাব্রিকস। এর মধ্যে ব্যাংকটির সবচেয়ে বেশি ঋণ রয়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে, ২৩৬ কোটি টাকা। এছাড়া অলটেক্স ফ্যাব্রিকসের কাছে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ ৪৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা। ব্যাংকটির ৮০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে অলটেক্স স্পিনিংয়ের কাছে। সব মিলিয়ে অলটেক্স গ্রুপের এ তিন প্রতিষ্ঠানের কাছে সোনালী ব্যাংক লোকাল অফিসের ঋণের পরিমাণ ৩৬৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা, যা এরই মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে।

২০১০ সালে সোনালী ব্যাংক থেকে ৩৪ কোটি টাকার ডিমান্ড ঋণ নেয় অলটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠান অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। ২০১১ সালে নেয় আরো ৯২ কোটি টাকার ঋণ। সুদাসলে শুধু অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের কাছেই সোনালী ব্যাংকের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২৩৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। যদিও এ ঋণ পরিশোধে ২০১৫ সালে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের ঋণের ওপর প্রযোজ্য মোট সুদের ৮৭ শতাংশ বা ৭২ কোটি টাকা মওকুফ করে সোনালী ব্যাংক। মওকুফের পর পাওনা দাঁড়ায় ১৪১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। সুদহারও কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এজন্য ডাউন পেমেন্ট হিসেবে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ সোনালী ব্যাংককে ১৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকার তিনটি চেক দেয়। কিন্তু অ্যাকাউন্টে টাকা না থাকায় চেক ডিজঅনার হয়। এজন্য প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে চেক ডিজঅনারের মামলা করে সোনালী ব্যাংক এবং সুদাসলে পাওনা ২৩৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকাই রয়ে যায়।

প্রতিশ্রুতি অনুসারে ডাউন পেমেন্টের টাকা না দেয়ায় অলটেক্সের সুদ মওকুফ সুবিধা বাতিল হয়ে গেলেও আবারো গ্রুপটিকে একই সুবিধা দেয়ার উদ্যোগ নেয় সোনালী ব্যাংক। গত বছরের আগস্টে অলটেক্সের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৩৬৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা ঋণের বিপরীতে ১২৯ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করার সিদ্ধান্ত নেয় সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ। এর মধ্যে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের ২৩৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকার বিপরীতে ৭২ কোটি টাকার সুদ মওকুফের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ তিন বছরের মধ্যে ঋণের টাকা পরিশোধ করার শর্ত দেয়া হয়। এক্ষেত্রেও সুদহার নির্ধারণ করা হয় ১০ শতাংশ। সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় শাখায় অলটেক্সের নামে থাকা চলতি হিসাব থেকে ৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ডাউন পেমেন্ট হিসেবে কেটে রাখার কথা ছিল সোনালী ব্যাংকের।

অলটেক্স ফ্যাব্রিকসের কাছে থাকা ৪৮ কোটি ৬২ লাখ টাকার খেলাপি ঋণের বিপরীতে সুদ বাবদ ২০ কোটি ৮১ লাখ টাকা মওকুফ করে সোনালী ব্যাংক। অবশিষ্ট ২৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা ৯০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করার শর্ত নির্ধারণ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির আংশিক জমি কিনতে আগ্রহী ক্রেতার নামে থাকা ৬৪ লাখ ও ২০১৩-১৬ সাল পর্যন্ত কিস্তি হিসেবে ব্যাংকে জমা দেয়া ১ কোটি ৯১ লাখ টাকা ডাউন পেমেন্ট হিসেবে গণ্য করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর পরও ১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ডাউন পেমেন্টে ঘাটতি থেকে যায়। তা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে টাকা আদায় হবে, এ আশায় প্রস্তাবটি অনুমোদন করে ব্যাংকের পর্ষদ।

গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান অলটেক্স স্পিনিংয়ের ৩৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকার সুদ মওকুফের পর ব্যাংকের পাওনা দাঁড়ায় ৪৩ কোটি ২১ লাখ টাকা। এ প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকে চলতি হিসাবে ৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা জমা থাকায় ৯০ দিনের মধ্যে অবশিষ্ট ৩৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা জমা দেয়ার শর্ত দেয়া হয়। এ শর্তও পরিপালনে ব্যর্থ হওয়ায় অলটেক্স স্পিনিংয়ের কাছে ব্যাংকটির ঋণের স্থিতি ৮০ কোটি টাকা অপরিবর্তিত থাকে।

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ওবায়েদ উল্লাহ্ আল্ মাসুদ বলেন, অলটেক্সের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে দীর্ঘদিন ধরে টাকা আটকে আছে। তাদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্য বিভিন্ন সময়ে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সুদ মওকুফ করাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পরও গ্রুপটির কাছ থেকে টাকা আদায় করা সম্ভব হয়নি। টাকা আদায়ে আমরা চূড়ান্ত পদক্ষেপের দিকেই হাঁটছি।

সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোম্পানিটির কাছে নগদ টাকা না থাকায় তারা ব্যাংকের ডাউন পেমেন্টের টাকা দিতে পারেনি। এতে গত বছর পর্ষদে ঋণ মওকুফের যে সুবিধা দেয়া হয়েছিল, সেটি নিতে ব্যর্থ হয়েছে অলটেক্স। তাছাড়া কোম্পানিটির জমি কিনতে আগ্রহী ক্রেতার সঙ্গে এ বিষয়ে এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গ্রুপের বন্ধ থাকা প্রতিষ্ঠান অলটেক্স ফ্যাব্রিকস ও অলটেক্স স্পিনিং বিক্রি করে দেয়ার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের জমিও আংশিক বিক্রি করা হবে বলে জানা গেছে। কোম্পানি ও জমি বিক্রির টাকা দিয়ে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের শেষ চেষ্টা করছে তারা।

অলটেক্স গ্রুপের মূল উদ্যোক্তা চট্টগ্রাম-১৪ আসন থেকে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আফছার উদ্দিন আহমদ। গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন তিনি। গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছেন তার ছেলে ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ উদ্দিন আহমদ আসিফ। ঋণ পরিশোধের বিষয়ে জানতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। তবে গ্রুপের একটি সূত্র জানিয়েছে, একসময় কোম্পানির ব্যবসা ভালো থাকলেও রফতানি কমে যাওয়ার কারণে লোকসানে পড়তে হয়েছে। এতে ব্যাংকের পাওনা টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছিল না। এজন্য ওয়ান টাইম এক্সিটের আওতায় সুদ মওকুফ ও ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য ব্যাংকের কাছে আবেদন করা হয়েছিল। তবে নগদ অর্থের সংকটে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়নি। তাই কোম্পানির জমি বিক্রি কিংবা অন্য কোনো উৎস থেকে অর্থ সংস্থানের মাধ্যমে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের জন্য চেষ্টা চলছে। যদিও এ নিয়ে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি।

উল্লেখ্য, অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ রফতানিমুখী একটি প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, জার্মানি, সুইডেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানে পণ্য রফতানি করে কোম্পানিটি। হোম টেক্সটাইল পণ্য রফতানিতে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ বেশ কয়েকবার রফতানির জন্য পদকও পেয়েছে। তবে ১৯৯৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অলটেক্স গত ২০ বছরে বিনিয়োগকারীদের মাত্র চারবার লভ্যাংশ দিয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে প্রকাশিত শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় নাম আসছে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের।

  • কার্টসি: বণিকবার্তা / ০২ অক্টোবর ২০১৮

No comments:

Post a Comment