সাজিদ হোসেন
- গত সেপ্টেম্বর থেকে যশোরের ৯ থানায় ৩৮টি গায়েবি মামলা
- মামলায় বিএনপির ৭০০ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে
- গ্রেপ্তার করা হয়েছে অন্তত ২০০ জনকে
- যশোরের ৫ মামলায় ১৮ শিক্ষকসহ ১১৭ জনের আগাম জামিন
- স্বাধীন অনুসন্ধান কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে রিটের শুনানি শুরু
যশোরের চাঁড়চা গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন মারা গেছেন ২০১৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর। মৃত্যুর নয় মাস পর তিনি ‘গায়েবি মামলা’র আসামি হয়েছেন। মামলার এজাহারে পুলিশ বলেছে, জাহাঙ্গীর দলবল নিয়ে ট্রেনের বগিতে আগুন দিয়েছেন, রেললাইনও উপড়ে ফেলেছেন।
মজিবুল এলাহীর বাড়ি ঝিকরগাছা উপজেলার মোবারকপুর গ্রামে। চার বছর ধরে তিনি বিদেশে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি পুলিশের ওপর ককটেল ছুড়ে মেরেছেন। এই অভিযোগে গত ৩০ আগস্ট তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা ঠুকেছে। শুধু জাহাঙ্গীর বা মজিবুলই নন, গত সেপ্টেম্বর থেকে যশোরের ৯টি থানায় এমন ৩৮টি গায়েবি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় বিএনপির ৭০০ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে অন্তত ২০০ জনকে।
বিএনপির তথ্য অনুসারে সারা দেশে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩ হাজার ৭৩৬টি ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ৩ লাখ ১৩ হাজার ১৩০ জনকে। এসব মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামিও আছে। এসব মামলার এজাহারের বিবরণ প্রায় একই ধরনের।
এদিকে বিএনপির তিন আইনজীবীসহ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া গায়েবি মামলার বিষয়ে একটি স্বাধীন অনুসন্ধান কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে করা রিট আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হয়েছে। গতকাল সোমবার বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ শুনানি গ্রহণ করেন। শুনানিকালে কয়েকটি এজাহার পর্যবেক্ষণ করে আদালত বলেন, এ ধরনের মামলা করার ফলে পুলিশের ভাবমূর্তি ও বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হচ্ছে।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর বিএনপির তিন আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, নিতাই রায় চৌধুরী ও সানাউল্লাহ মিয়া রিটটি করেন। তাঁদের মধ্যে খন্দকার মাহবুব ও নিতাই রায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এবং সানাউল্লাহ বিএনপির আইনবিষক সম্পাদক।
রিট আবেদনের পক্ষে শুনানিতে অংশ নিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, এসব মামলার অভিযোগ একই ধরনের। জব্দ করা যে আলামতের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোও একই। খন্দকার মাহবুব হোসেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। তিনিও নাকি পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ছুড়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক বলেন, তিনি (খন্দকার মাহবুব) তো শুধু আইনজীবীই নন, একটি রাজনৈতিক দলের পদেও আছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে এজাহারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে যে তাঁরা কর্মীদের উসকানি দিয়েছেন।
একপর্যায়ে আদালত বলেন, ‘আপনি এটা কী বললেন? আইনজীবী হলে কি রাজনীতি করা যাবে না? আইনে কোনো বিধিনিষেধ আছে? আইনজীবীরাই তো আগে রাজনীতিতে বেশি যুক্ত ছিলেন। আপনারা যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেন, তাহলে এ ধরনের মামলা হতো না। এতে পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।’
পরে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানির জন্য সময় চান। আদালত বলেন, ‘কাল (মঙ্গলবার) আদেশের জন্য রাখছি। এর আগে আপনার বক্তব্য উপস্থাপন করবেন।’
রিট দায়েরের পর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, এজাহারে উল্লেখিত ঘটনার তারিখ ও সময়ে ওই ধরনের ঘটনা না ঘটা সত্ত্বেও জ্যেষ্ঠ আইনজীবীসহ ঢালাওভাবে বিরোধী নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘কল্পিত’ মামলা হচ্ছে। এসব মামলা সঠিক হয়েছে কি না, তা অনুসন্ধানে উচ্চপর্যায়ের স্বাধীন কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে রিটটি করা হয়।
১৮ শিক্ষকসহ ১১৭ জনের আগাম জামিন
যশোরে যে ৩৮টি গায়েবি মামলা হয়েছে, তার পাঁচটি মামলার আসামিরা গতকাল হাইকোর্টে আসেন আগাম জামিন নিতে। তাঁদের মধ্যে ১৮ শিক্ষকসহ ১১৭ জন আগাম জামিন পেয়েছেন। জামিন পাওয়া শিক্ষকেরা বলেছেন, তাঁরা কেউই ঘটনার ব্যাপারে কিছুই জানতেন না।
বাঘারপাড়ার একটি মাদ্রাসার শিক্ষক শামীম মিঞা বলেন, তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। অথচ বাঘারপাড়া থানার পুলিশ তাঁর নামে গত ৩০ সেপ্টেম্বর নাশকতার মামলা দিয়েছে।
আসামিদের আইনজীবী সাহানূর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আদালতকে তিনি বলেছেন, নাশকতার নামে পুলিশ মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই।
গতকাল সকাল ১০টার পর থেকে এই আসামিদের আদালত চত্বরে জড়ো হতে দেখা যায়। সেখানে যশোর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাবেরুল হক, বাঘারপাড়া বিএনপির সভাপতি টি এস আয়ুবসহ অন্য বিএনপি নেতাদেরও দেখা যায়।
বাড়ি বাড়ি অভিযান
যশোরের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পুলিশের ভয়ে নেতা-কর্মীরা বাড়িতে ঘুমাতে পারছেন না। গায়েবি মামলার আসামি ধরতে পুলিশ প্রায় প্রতিদিনই বাড়ি বাড়ি অভিযান চালাচ্ছে। ৩ অক্টোবর এ ব্যাপারে যশোর জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে বিএনপি।
একটি গায়েবি মামলার বিবরণে বলা হয়, গত ২১ সেপ্টেম্বর রাতে যশোর শহরের রেল সড়ক আশ্রম মোড় এলাকা থেকে নাশকতা পরিকল্পনার অভিযোগে আটটি হাতবোমাসহ ইসমাইল হোসেনকে আটক করে পুলিশ। পরে কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক খবির হোসেন বাদী হয়ে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা করেন। ওই মামলায় যশোর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাবেরুল হক, যুগ্ম সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ, শহর বিএনপির সভাপতি ও যশোর পৌরসভার সাবেক মেয়র মারুফুল ইসলামকে আসামি করা হয়। তাঁদের সঙ্গে আসামি করা হয় ঘটনার ৯ মাস আগে মারা যাওয়া যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া গ্রামের লতিফ মোল্লার ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেনকে।
জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর হোসেনের ভাই চাঁচড়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মোজাহার আলী বলেন, ‘আমার ভাই জাহাঙ্গীর ২০১৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর হৃদ্রোগে মারা যান।’
গত ৩০ আগস্ট নাশকতা পরিকল্পনার জন্য যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার পদ্মপুকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীরা সমবেত হন। এ সময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সবাই পালিয়ে যান। এ অভিযোগে ঝিকরগাছা থানার উপপরিদর্শক কামরুজ্জামান জিয়া বাদী হয়ে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে ৩৭ জনকে আসামি করে মামলা করেন। ওই মামলায় উপজেলার মোবারকপুর গ্রামের গ্রিন বিশ্বাসের ছেলে মো. মজিবুল এলাহীকে আসামি করা হয়। অথচ মজিবুল এলাহী চার বছর ধরে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন।
মজিবুল এলাহীর ভাই ঝিকরগাছার উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোর্তজা এলাহী বলেন, ‘আমি বিএনপির রাজনীতি করি বলেই পুলিশ আমার ভাইকে আসামি করে গায়েবি মামলা দিয়েছে। অথচ আমার ভাই ২০১৪ সাল থেকে মালয়েশিয়ায় রয়েছেন।’
গত ১ সেপ্টেম্বর একই থানায় এসআই আশরাফুল ইসলামের করা নাশকতা পরিকল্পনার আরেক মামলায় ঝিকরগাছা উপজেলার হাড়িয়া গ্রামের নিজাম উদ্দীনের ছেলে মো. বাবলুকে আসামি করা হয়েছে। বাবলু ঘটনার সময় ওমরাহ হজ পালনের জন্য সৌদি আরবে ছিলেন। একই ধারায় গত ১৫ সেপ্টেম্বর বেনাপোল বন্দর থানায় করা মামলায় বেনাপোল পৌর বিএনপির সহসভাপতি হাবিবুর রহমানকে আসামি করা হয়। তিনিও ওমরাহ হজ করতে দেশের বাইরে ছিলেন। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে গত ৮ সেপ্টেম্বর শার্শা থানায় করা মামলায় আসামি করা হয় মো. সারোয়ার হোসেনকে। তিনি ভারতে চিকিৎসাধীন।
মৃত ব্যক্তি ও বিদেশে থাকা ব্যক্তিদের আসামি করার ব্যাপারে জানতে চাইলে যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সালাউদ্দীন শিকদার বলেন, ‘মৃত ব্যক্তিকে যদি আসামি করা হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের ভুল হয়েছে।’
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ০৯ অক্টোবর ২০১৮