শামীম রাহমান
সড়ক বিভাজকগুলো ভাঙা-শ্রীহীন। সেটাও অনেক জায়গায় নেই। এক্সপ্যানশন জয়েন্টগুলোর দূরত্ব বাড়ছে ক্রমেই। দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট সড়কবাতি। রাস্তার পিচ উঠতে চলেছে। কোথাও কোথাও বেরিয়ে এসেছে পাথর। দুই পাশে আবর্জনার স্তূপ। এসবের মধ্যেই পার্ক করে রাখা সিএনজিচালিত অটোরিকশা-বাস-ট্রাক। আরো আছে ভাসমান দোকানপাট। এ চিত্র দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতুর। সংস্কার-রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আর বিশৃঙ্খলায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে দেশের ষষ্ঠ দীর্ঘতম সড়ক সেতুটি।
ঢাকা শহর ও কেরানীগঞ্জের মধ্যে সড়কপথে যাতায়াতে বুড়িগঙ্গার ওপর তিনটি সেতু রয়েছে। প্রথম বুড়িগঙ্গা সেতুটি পোস্তগোলায়। দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতুটি বাবুবাজারে। অনেকে বলেন বাবুবাজার ব্রিজ। এছাড়া রয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতু। ঢাকা শহর থেকে যেতে মধ্যবর্তী অবস্থানে রয়েছে বাবুবাজার ব্রিজ। এ কারণে কেরানীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ এমনকি দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে আসা মানুষ বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিতে এ সেতুটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে। ২০০১ সালে চালু হওয়া এ সেতু ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে টোলমুক্ত করে দেয়া হয়। এর পর থেকে সেতু দিয়ে যান চলাচল যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে অব্যবস্থাপনা-বিশৃঙ্খলা।
গতকাল সরেজমিন ঘুরে দিশারী, স্বাধীন, ইলিশ, এয়ারপোর্ট-বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, গ্রেট বিক্রমপুর পরিবহনসহ চলাচল করা প্রায় সব বাসকে সেতুর ওপর যাত্রী ওঠাতে-নামাতে দেখা গেছে। সেতুর ওপর দেখা মিলেছে সিএনজি অটোরিকশা স্ট্যান্ডেরও। দুই পাশে অটোরিকশা দাঁড় করিয়ে যাত্রী ডাকছেন চালকরা। সেতুর মাঝামাঝি গাড়ি দাঁড় করানোর কারণ জানতে চাইলে একাধিক চালক বলেন, এটাই তাদের স্ট্যান্ড। এজন্য কর্তৃপক্ষকে মাসে মাসে টাকা দেয়া হয় বলে জানান তারা।
দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতুতে পার্ক করে রাখা ছিল বাস-ট্রাকও। তবে ওইসব বাহনের চালক বা হেলপারের দেখা মেলেনি। স্থানীয়রা জানায়, দিনের বেলা সেতুর ওপর সবসময় ২০-২৫টি বাস-ট্রাক পার্ক করা থাকে। আর রাতে সেতুর এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত দুই পাশেই হয় পার্কিং স্পট। সারি সারি বাস-ট্রাকের কারণে সারা রাত সেতুর একটি লেন বন্ধ থাকে। রাতে গাড়ি পারাপারের চাপ বাড়লে দেখা দেয় তীব্র যানজট। যানবাহনের পাশাপাশি সেতুতে অসংখ্য ভাসমান দোকান।
দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতুতে সবচেয়ে খারাপ দশা সড়ক বিভাজকের। ইস্পাতের তৈরি বেশির ভাগ বিভাজক ভাঙা। কোথাও একেবারেই নেই। এতে সেতুর ওপর গাড়ি ইউটার্ন করতে সুবিধা হচ্ছে অনেক চালকের। সড়ক বিভাগের প্রকৌশলীদের অভিযোগ, স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্রের কারণে বিভাজকগুলোর এমন দশা। সেতুর ওপর সিএনজি অটোরিকশা স্ট্যান্ড বসানোর সুবিধার্থে বিভাজক ভেঙে ফেলা হয়েছে বলে প্রকৌশলীরা জানান। সেতুর এক্সপ্যানশন জয়েন্টগুলোরও বেহাল দশা। বেশির ভাগ জয়েন্ট ভেঙে লোহা বেরিয়ে এসেছে। কয়েকটি জায়গায় জয়েন্ট ৩-৪ ইঞ্চি পর্যন্ত ফাঁকা হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতুতে যার যেভাবে ইচ্ছা ময়লা-আবর্জনা ফেলছে। দুর্গন্ধে ভুগতে হচ্ছে যাত্রী-পথচারীদের। নজরুল ইসলাম নামে এক পথচারী জানান, কোরবানির ঈদে জবাই করা পশুর বর্জ্যও সেতুর ওপর ফেলা হয়েছিল। ওই বর্জ্য পচে-গলে এখনো দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সেতুর পিচ উঠে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য খানাখন্দ। যথাযথ নজরদারি না থাকায় অতিরিক্ত পণ্য নিয়ে অবাধে চলছে যানবাহন, যা স্থায়ী ক্ষতি করছে এ সেতুর।
সেতুটির এ দশা সম্পর্কে আরমানীটোলা সমাজকল্যাণ সংসদের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন রনি বলেন, সেতুটি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আওতাধীন। সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ তাদেরই করার কথা। তবে দীর্ঘদিনেও সেতু সংস্কার কিংবা রক্ষণাবেক্ষণে তাদের কোনো তত্পরতা চোখে পড়েনি। সেতুর লাইট নষ্ট, জয়েন্টগুলোয় লোহার পাত বেরিয়ে এসেছে, ডিভাইডার ভেঙে গেছে। উপরে অবৈধ পার্কিং, দোকানসহ নানা অব্যবস্থাপনা। ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম এ সেতু। আমরা জনগুরুত্বপূর্ণ সেতুটি দ্রুত সংস্কার ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের দাবি জানাই।
দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতুটি চালু হয় ২০০১ সালে। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই বেহাল হয়ে পড়েছে সেতুটি। এজন্য সড়ক ও জনপথ অদিধপ্তরের উদাসীনতাকে দায়ী করছে স্থানীয়রা। তবে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সেতু সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণে তারা কখনই কোনো গাফিলতি করেননি। বিশৃঙ্খলার জন্য অধিদপ্তরের জনবলস্বল্পতাকে দায়ী করছেন তারা। আর সংস্কারেও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।
বিষয়টি সম্পর্কে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা সড়ক উপবিভাগ-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী ইকবাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাবুবাজার সেতুর ওপর সিএনজি অটোরিকশা স্ট্যান্ড, দোকানপাটসহ নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা আছে, এটা আমরা স্বীকার করছি। কিন্তু এ ধরনের বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধ করতে যে ধরনের জনবল দরকার, তা আমাদের নেই। তবে আমরা সেতুটি সংস্কারের উদ্যোগ নিচ্ছি। শিগগিরই সেতুতে দুই ধাপে সংস্কারকাজ করা হবে। প্রথম ধাপে সেতুর লাইটগুলো ঠিক করা হবে। এ কাজের জন্য সাত-আটদিনের মধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হবে।
সেতুর ইস্পাতের সড়ক বিভাজকগুলো কংক্রিটে বদলে ফেলা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইস্পাতের বিভাজকগুলো দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। আবার স্থানীয়রাও ইউটার্ন নেয়ার সুবিধার্থে অনেক সময় ভেঙে ফেলে। কংক্রিটের ডিভাইডার হলে যেমন টেকসই হবে, তেমনি ইউটার্ন নেয়ার সুবিধা না থাকায় সিএনজি অটোরিকশা স্ট্যান্ডগুলোও আপনা থেকে সরে যাবে। সড়ক বিভাজকসহ আনুষঙ্গিক সংস্কারকাজের জন্য আমরা প্রস্তাবনা তৈরি করেছি। এক-দুদিনের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। আশা করছি, নভেম্বরের মধ্যেই সেতুর চেহারা পাল্টে যাবে।
- কার্টসিঃ বনিক বার্তা/ ০৯ অক্টোবর ২০১৮
No comments:
Post a Comment