বাংলাদেশের ধারাবাহিক উচ্চহারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিশ্বজুড়েই এক ধরনের উচ্ছ্বাস আছে। এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বেড়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, শিল্পের পরিকাঠামো, ব্যাংকঋণ, দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগ। পুরনো শহরের পাশে গড়ে উঠছে আধুনিক উপশহর। দেশের গুরুত্বপূর্ণ বড় শহরগুলোয় ফ্লাইওভারের আধিক্য। এসবই উন্নয়ন গবেষকরা বাংলাদেশের দিনবদলের শুভ লক্ষণ মনে করেছেন।
তবে এ সচ্ছলতা ও কর্মযজ্ঞের উচ্ছ্বাসের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না কর্মবাজারে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উচ্চহারের সঙ্গে কর্মবাজারের যোগাযোগহীনতা কিছুটা বিস্ময়েরও বটে। ভালো প্রবৃদ্ধি যদি ভালো কাজের বাজার তৈরি করতে না পারে, তাহলে বিপুলসংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠীর কাছে তার উপযোগিতাইবা কী? প্রশ্নটি অর্থনীতিমনস্ক, সমাজমনস্ক নাগরিক সমাজ তো বটেই, সাধারণ মানুষের পক্ষেও এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি যে গতিতে বাড়ছে, প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থান সে হারে হচ্ছে না। উল্টো মোট কর্মসংস্থানে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের হার ক্রমেই কমছে। ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে যখন দেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, তখনো প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের হার ছিল ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের গণ্ডি পেরিয়েছে। এর বিপরীতে কমেছে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের সুযোগ। ২০১৫-১৬ অর্থবছর ৭ দশমিক ১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলেও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৩ দশমিক ৮ শতাংশে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয় ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ আর প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থান ছিল ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ৮৫ শতাংশ কর্মসংস্থানই অপ্রাতিষ্ঠানিক।
প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থান হলো প্রতিষ্ঠিত কোনো কর্মচুক্তির অধীনে কর্মী নিয়োগ। এ চুক্তিতে কর্মীর বেতন বা মজুরি, স্বাস্থ্য সুবিধা, কর্মঘণ্টা ও কর্মদিবসের নির্দিষ্ট বিবরণ থাকে। নিয়োগদাতা কর্মীকে অবহিত করার মাধ্যমে এ চুক্তিতে পরিবর্তন আনতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক কর্মচুক্তির আওতায় নিয়োজিত কর্মীদের সাধারণত বার্ষিক পারফরম্যান্স নিরীক্ষা এবং এর ভিত্তিতে বেতন বৃদ্ধি ও পদোন্নতির সুবিধা দেয়া হয়। অন্যদিকে অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থান বিদ্যমান আইনি অথবা নিয়ন্ত্রক ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে নিবন্ধিত, নিয়ন্ত্রিত বা সুরক্ষিত থাকে না। কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা বিধানকারী চুক্তি, সুযোগ-সুবিধা, সামাজিক নিরাপত্তা অথবা শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করার মতো সুযোগ পান না এ শ্রমিকরা। আর পেশাগত অবস্থানের কারণে যেসব চাকরির নিরাপত্তাহীনতা তুলনামূলক বেশি, সেগুলোকে ভালনারেবল এমপ্লয়মেন্ট (ভঙ্গুর কর্মসংস্থান) হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। এসব কর্মসংস্থানে কর্মীর সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক কোনো চুক্তি, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বা সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমে প্রবেশাধিকার তেমন একটা থাকে না। দেশের মোট কর্মসংস্থানের অর্ধেকের বেশি ভঙ্গুর।
আইএলওর সর্বশেষ ডাটা ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালে বাংলাদেশে মোট কর্মসংস্থান ছিল ৪ কোটি ৬০ লাখ। ২ কোটি ৯৯ লাখই ছিল ভঙ্গুর। ২০০৫ সালে ৫ কোটি ১৯ লাখ কর্মসংস্থানের মধ্যে ভঙ্গুর ছিল ৩ কোটি ৩১ লাখ। আর ২০১২ সালে ভঙ্গুর কর্মসংস্থান ছিল ৩ কোটি ৫৬ লাখ। সে বছর কর্মে নিয়োজিত ছিলেন মোট ৫ কোটি ৮৬ লাখ কর্মক্ষম মানুষ। ২০১৭ সালে দেশে মোট ৬ কোটি ৩৭ লাখ কর্মসংস্থানের মধ্যে ভঙ্গুর ছিল ৩ কোটি ৬৬ লাখ। সংস্থাটির ২০১৮ সালের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি বছর শেষে দেশে মোট কর্মসংস্থান হবে ৬ কোটি ৪৯ লাখ, যার মধ্যে ৩ কোটি ৭৩ লাখই ভঙ্গুর। চলতি বছরের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী দেশে মোট কর্মসংস্থানের ৫৭ শতাংশই ভঙ্গুর। আর ২০১৯ সালে মোট কর্মসংস্থান হবে ৬ কোটি ৬১ লাখ, এর মধ্যে ৩ কোটি ৭৯ লাখ কর্মসংস্থানই হবে ভঙ্গুর।
ভঙ্গুর এ কর্মসংস্থানের মধ্যে আছে বিপুলসংখ্যক ভাসমান শ্রমিক, নারী গৃহশ্রমিক ও শিশুশ্রমিক। আইএলওর হিসাবে, দেশে শিশুশ্রমিকও রয়েছে প্রায় ১২ লাখ। স্পিনিং, অ্যালুমিনিয়াম, তামাক-বিড়িসহ ডজনখানেক উৎপাদনশীল খাতে কাজ করছে তারা। শিশুশ্রমিকের উপস্থিতি রয়েছে সেবা খাতেও।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারকেই প্রশ্নবিদ্ধ বলছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, অন্য অনেক সূচকের সঙ্গে এ প্রবৃদ্ধিকে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয় না। এছাড়া প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা এখন ক্যাপিটাল ইনটেনসিভ প্রডাকশন মেথড ও লেস লেবার ইনটেনসিভ প্রডাকশন মেথড বেছে নিচ্ছেন। কাজেই কর্মসংস্থান খুব একটা বাড়ছে না। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ একেবারেই বাড়ছে না। জিডিপির আনুপাতিক হিসাবে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যা ছিল, তার চেয়ে কিছুটা বেশি বেড়েছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। বিনিয়োগ না বাড়লে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান দুইয়ের ওপরই এর প্রভাব দেখা যায়। এগুলো মূলত বেসরকারি খাতে অপ্রতুল বিনিয়োগ ও শ্রমবিকল্প প্রযুক্তির আবির্ভাবের প্রতিফলন।
প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে বড় ধরনের সম্ভাবনা তৈরি করেছিল টেলিকম খাত। শুরুর দিকে ভালো প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থানও হচ্ছিল খাতটিতে। কিন্তু কয়েক বছর ধরেই প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান কমিয়ে আনছে সেলফোন অপারেটররা। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। চাকরিপ্রার্থীদের জন্য একসময়ের আকর্ষণীয় খাতটির কর্মসংস্থানে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগও সীমিত হয়ে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামীণফোন ও বাংলালিংক কর্মী সংখ্যা কমিয়ে আনতে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে।
সেলফোন অপারেটরদের বৈশ্বিক সংগঠন গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস অ্যাসোসিয়েশনের (জিএসএমএ) তথ্য বলছে, ২০১৫ সালে দেশে সেলফোন সেবা খাতে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান ছিল ৭ লাখ ৬৫ হাজার। এর মধ্যে পরোক্ষ কর্মসংস্থান ৫ লাখ ২০ হাজার। বাকি ২ লাখ ৪৫ হাজার প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান। খাতটিতে প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থানের মধ্যে আনুষ্ঠানিকের চেয়ে অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান হয়েছে তিন গুণেরও বেশি। প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থানে অনানুষ্ঠানিক যেখানে ১ লাখ ৯৫ হাজার, আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান সেখানে মাত্র ৫০ হাজার।
বর্তমান বিশ্বে টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানগুলোর বহুমাত্রিক সেবাদানের সুযোগ থাকলেও দেশে সরকারের নীতিগত বাধার কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন তথ্যপ্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্নএশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো আবু সাইদ খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রকের অদক্ষতা কাজে লাগিয়ে জনবল কমিয়ে মুনাফা বৃদ্ধির সুযোগ নিচ্ছে সেলফোন অপারেটররা। এছাড়া টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন পদে বিদেশী কর্মীরা কাজ করছেন। যদিও এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরিভাবেই দেশীয়দের দ্বারা পরিচালিত হওয়ার পর্যায়ে চলে এসেছে। বিদেশী কর্মী নিয়োগের কারণেও খাতটিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে।
দেশে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাক শিল্প। এ খাতের সম্প্রসারণও থেমে আছে। এর ওপর যোগ হচ্ছে প্রযুক্তির ব্যবহার। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের পোশাক শিল্পও দ্রুত অটোমেশনের দিকে এগোচ্ছে। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ও রোবট এখন তাদের কর্মস্থল দখলে নিতে শুরু করেছে। এতে কর্ম হারানোর শঙ্কায় ভুগছেন এ খাতের শ্রমিকরা। এরই মধ্যে বড় কারখানাগুলোয় এর প্রভাবও দেখা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টিও পোশাক শিল্পে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুযোগ সংকুচিত করে আনছে।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর হিসাব বলছে, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে পোশাক কারখানা ছিল ৫ হাজার ৪০০টি। এতে কর্মসংস্থান হয়েছিল ৪০ লাখ মানুষের। ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে কারখানার সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৫৬০টিতে। কিন্তু কর্মসংস্থান ৪০ লাখেই আটকে আছে। সাত বছর ধরে পোশাক খাতের কর্মসংস্থানে এ স্থবিরতা চলছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, যে অনুপাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার কথা, সে অনুপাতে হচ্ছে না, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলাদেশে এখন যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, তা রাষ্ট্রায়ত্ত খাতচালিত। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রবৃদ্ধি জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে অনেক সাহায্য করছে। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের কর্মসংস্থান মূলত নির্মাণকাজে। এ খাতে জনবলের প্রয়োজন কম, পাশাপাশি এ কর্মসংস্থান অস্থায়ী। এ খাতে প্রযুক্তিনির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় জনবলের প্রয়োজনও কমে আসছে। বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি জিডিপির অনুপাতে স্থবির হয়ে আছে। অথচ বেসরকারি খাতেই কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ বেশি। আমরা ধারাবাহিকভাবে সংগঠনের পক্ষে বলে আসছি, বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে আমাদের প্রণোদনা ও উৎসাহ দেয়া হোক। কর-অবকাশ, ব্যবসার সহজ প্রক্রিয়া— এ ধরনের আরো অনেক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে। বিনিয়োগ বাস্তবায়নে বিলম্ব হলেই বিনিয়োগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। প্রযুক্তির কারণে চাকরির ক্ষেত্র সীমিত হয়ে আসতে শুরু করেছে। এজন্য এখন শ্রমঘন শিল্পে অগ্রাধিকারমূলক বিনিয়োগ প্রয়োজন। এখন অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে, সেখানে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু সেখানেও সুষম কর্মসংস্থান নিশ্চিতের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো গড়ে তুলতে হবে সুষমভাবে। যেখানে-সেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল করলে হবে না।
দেশের প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের গুরুত্বপূর্ণ খাতের অন্যতম ব্যাংক। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে তফসিলভুক্ত ব্যাংক রয়েছে ৫৯টি। এর মধ্যে নতুন ব্যাংক ১২টি। গত এক দশকে ব্যাংকিং খাতে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থান হিসেবে ব্যাংকে চাকরির নিশ্চয়তা এখন আর নেই। ব্যাংকিং খাতের অপরিকল্পিত বিনিয়োগ, ডিজিটাইজেশন ও অটোমেশনের কারণে কর্মক্ষেত্র হিসেবে খুব ঝুঁকিমুক্ত নয় এ খাতও।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, প্রযুক্তির উত্কর্ষের কারণে বিশ্বব্যাপী ব্যাংকিং খাত অটোমেশন ও ডিজিটাইজেশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এটা ঠিক, অটোমেশন ও ডিজিটাইজেশনের ফলে আগের মতো চাকরির পদ সৃষ্টি হচ্ছে না। ম্যানুয়ালি যে কাজ করতে ১০ জনের দরকার হতো, প্রযুক্তির মাধ্যমে তা পাঁচজন দিয়েই সম্ভব হচ্ছে।
শোভন কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে নানা শিল্পপল্লী গড়ে তোলার। এর একটি সাভারের চামড়া শিল্পনগরী। হাজারীবাগ থেকে চামড়া কারখানা এরই মধ্যে সরিয়ে নেয়া হয়েছে চামড়া শিল্পনগরীতে। যদিও চামড়া শিল্পপল্লীতে অনেক কারখানাই এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। ফলে রফতানি আয়ের গুরুত্বপূর্ণ খাতটিতে কর্মসংস্থান না বেড়ে উল্টো কমছে।
ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, হাজারীবাগে থাকাকালে ২০-২৫ হাজার শ্রমিক ট্যানারিতে কর্মরত ছিলেন। ট্যানারি খাতে বর্তমানে বৈধ নিয়োগপ্রাপ্ত ও নিয়োগ ছাড়া ১২-১৫ হাজার শ্রমিক কর্মরত। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরের কারণে নতুন নিয়োগ তো হয়ইনি, বরং পুরনো অনেক শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। ট্যানারি স্থানান্তরের পর অনেক কারখানাই পুরোদমে চালু হয়নি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে জনবল ছিল ১ লাখ ৬৬ হাজার। পরের অর্থবছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার। আর চলতি অর্থবছর শেষে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১ লাখ ৬৪ হাজারে।
প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সরকারি চাকরিতে বিপুলসংখ্যক পদ শূন্য পড়ে আছে। ১৭ লাখ ৬২ হাজার ১৯৫টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৮৯৭টি পদ শূন্য আছে। এর মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পদ শূন্য রয়েছে যথাক্রমে ৪৮ হাজার ও ৬৫ হাজার। তৃতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে শূন্য পদের সংখ্যা দুই লাখ ও চতুর্থ শ্রেণীতে ৭৯ হাজার।
দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কর্মসংস্থানে প্রবৃদ্ধি না হওয়ার জন্য কর্মদক্ষতার অভাবকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন নীতিনির্ধারকরা। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, কর্মসংস্থানে আমাদের অন্যতম দুর্বলতার জায়গা হলো দক্ষতা। দক্ষতা বৃদ্ধিতে সরকার বড় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। দেশের শ্রমঘন পোশাক খাতে কাজ করেন দেড়-দুই লাখ বিদেশী। তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ নিচ্ছেন দক্ষতা কাজে লাগিয়েই। শিক্ষিত বেকারদের মানসিকতার পরিবর্তনও প্রয়োজন।
শিল্পে বৈচিত্র্য আনার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যদি আরো সক্রিয় করা যেত, তাহলে চিত্রটি ভিন্ন হতে পারত বলে মনে করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিআইএলএস)। সংস্থাটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও নির্বাহী পরিচালক মো. জাফরুল হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে সম্ভাবনাময় শিল্পের ঘাটতি নেই। কিন্তু সে সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। তাই প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শোভন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করা যাচ্ছে না। দেশে শিল্প বলতে যেন পোশাক বাদে অন্য কিছু নেই। এ পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর। কোনো কারণে খাতটির সমস্যা হলে পুরো কর্মবাজারেই বিপর্যয় নেমে আসবে। এ কারণেই অন্যান্য খাতে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। সেটা সম্ভব হলে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। আর ভালনারেবল কর্মসংস্থানের কারণ মূলত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়া।
- কার্টসিঃ বনিক বার্তা/ নভেম্বর ১৩,২০১৮