মাহবুব তালুকদার
[একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত বৃহস্পতিবার পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার লিখিত বক্তব্য দেন। তাঁর এ বক্তব্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকদের জন্য তাঁর বক্তব্য তুলে ধরা হলো]
আজ থেকে ৪৮ বছর আগে ১৯৭০ সালে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক থাকাকালে তৎকালীন জাতীয় নির্বাচনে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছিলাম। নির্বাচন বিষয়ে সেটাই ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। নির্বাচন কমিশনে যোগদানের পর সেই অভিজ্ঞতা দিন দিন ফুলে-পল্লবে পল্লবিত হয়েছে, একই সঙ্গে তাতে আছে কিছু কাঁটার আঘাত। আজ আপনাদের সঙ্গে তা শেয়ার করতে চাই।
বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই আমরা দুটি উল্লেখযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করেছিলাম। একটি কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং অপরটি রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এই দুটি নির্বাচনে আমরা সুনামের সঙ্গে উতরে গেছি বলে অনুমান করতে পারি। কারণ, এ দুটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে অভিযোগ শোনা যায়নি। বলতে দ্বিধা নেই, এই দুটি নির্বাচনে বর্তমান নির্বাচন কমিশন জনমানসে একটা আস্থার স্থান তৈরি করে নিতে পেরেছে।
পরবর্তী সময়ে খুলনা, গাজীপুর, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট—এই পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তার অভিজ্ঞতা ছিল ভিন্ন। আমি খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে কোনো কথা বলব না। তবে যেহেতু আমি বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একক দায়িত্বে ছিলাম, সেহেতু এই নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আপনাদের সামনে তুলে ধরব। অন্যদিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার আমাকে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে অনুরোধ জানান। ‘গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের “স্বরূপ সন্ধান”’ শিরোনামে আমি একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তাঁকে সমর্পণ করি। অজ্ঞাত কারণে সেটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
বিগত নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকে আত্মবিশ্লেষণের তাগিদেই আমি গাজীপুর ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন দুটির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন, কোনো ব্যক্তি বা সংস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য নয়, কারও দায়িত্ব পালন অবমূল্যায়ন করার জন্য নয়, বিষয়গুলো উপস্থাপন করতে হচ্ছে আগের সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজে পেতে এবং আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনুরূপ সমস্যা যাতে সৃষ্টি না হয়, সেই পথ সুগম করতেই।
গাজীপুর নির্বাচনের বিষয়ে আমি তিনটি ঘটনার উল্লেখ করব। প্রথম ঘটনা হচ্ছে, গাজীপুর জেলা প্রশাসক ১৭৯ জনের একটি স্বাক্ষরবিহীন তালিকা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে প্রেরণে করলে রিটার্নিং কর্মকর্তা তা গ্রহণে অসম্মতি জানান। পরে জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে নিম্নোক্ত ফরোয়ার্ডিংসহ তালিকাটি পাঠানো হলেও তালিকায় কারও স্বাক্ষর নেই। ফরোয়ার্ডিং নিম্নরূপ:
‘বিষয়: প্রিসাইডিং অফিসারগণের নামের তালিকা প্রেরণ।
উপযুক্ত বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থা থেকে এ কার্যালয়ে একটি প্রতিবেদন পাওয়া গিয়েছে। প্রতিবেদন পর্যালোচনায় প্রতিবেদনটি গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগসংক্রান্ত। প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগসংক্রান্ত কার্যক্রম যেহেতু রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে থাকে, বিধায় প্রতিবেদনটি পরবর্তী প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে এতৎসঙ্গে প্রেরণ করা হলো।
সংযুক্ত: ০৮ (আট) ফর্দ।’
উল্লেখ্য, স্বাক্ষরবিহীন তালিকাটিতে কোনো শিরোনাম নেই। ফরোয়ার্ডিংয়ে জেলা প্রশাসক অফিসের নিম্নপর্যায়ের একজন কর্মকর্তার নাম ও স্বাক্ষর রয়েছে। আমি জানি না প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিয়োগে রিটার্নিং কর্মকর্তার কোনো অযাচিত সহায়তার প্রয়োজন আছে কি না।
দ্বিতীয় বিষয়টিও পুলিশের কার্যক্রম–সম্পর্কিত। রিটার্নিং কর্মকর্তা মৌখিকভাবে বলেছেন, বিরোধী দলের মেয়র প্রার্থীর কোনো অভিযোগপত্র প্রেরণ করা হলে পুলিশ অফিস থেকে তা গ্রহণের স্বীকৃতিপত্র দেওয়া হতো না। অনেক অনুরোধের পর চিঠি গ্রহণ করা হতো। বিরোধী দলের মেয়র প্রার্থীর পুলিশি হয়রানি, গণগ্রেপ্তার, ভীতি প্রদর্শন, কেন্দ্র দখলসংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করেছে। এসব অভিযোগসংবলিত পত্রের কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। রিটার্নিং কর্মকর্তার প্রেরিত ১১টি অভিযোগপত্রের মধ্যে মাত্র ৪টির উত্তর পাওয়া গেছে, যা অনেকটা দায়সারা গোছের। পুলিশ বাকি ৭টি অভিযোগের কোনো উত্তর প্রদান প্রয়োজন মনে করেনি।
তৃতীয় বিষয়টিও পুলিশকে নিয়েই। গাজীপুরে নির্বাচনকালে ইউনিফর্মধারী পুলিশ ও সাদাপোশাকের পুলিশ অনেক ব্যক্তিকে বাসা থেকে কিংবা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ আছে। অনেককে অন্য জেলায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের একজন ছাড়া পুলিশ অন্যদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে কোনো স্বীকারোক্তি করেনি। নির্বাচনের পর তাঁদের বেশ কয়েকজনকে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তার না করলে তাঁরা কারাগারে গেলেন কীভাবে? এ প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
এবার বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন প্রসঙ্গে আসি। এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দায়িত্বে এককভাবে আমি ছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ৫টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল বরিশালের। সকালে ভোট গ্রহণ কার্যক্রম বেশ ভালো ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানে বিভিন্নমুখী অনিয়ম শুরু হয়। বেলা ১১টার মধ্যে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়, এভাবে ভোট গ্রহণ চলতে পারে না। মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনারকে আমি জানাই, বরিশালের ভোট কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন। একপর্যায়ে কমিশনারদের সবাই ভোট বন্ধ করার বিষয়ে একমত হলেও নির্বাচন বন্ধ করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে কি না এবং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হবে কি না, ভেবে নির্বাচন বন্ধ করা থেকে আমরা বিরত থাকি। ইতিমধ্যে ছয়জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে পাঁচজন তাঁদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন এবং একজন প্রার্থীই প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনভাবে বিজয়ী হন।
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে পরে নির্বাচন কমিশনের যে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, তার সামনে রিটার্নিং কর্মকর্তা যে বক্তব্য দেন, তার কিয়দংশ তুলে ধরছি: ‘কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিরোধী প্রার্থীদের পুলিশ কর্তৃক অযাচিতভাবে হয়রানি করা হয়েছে। আবার সরকারি দলের প্রার্থীর আচরণবিধি ভঙ্গের ঘটনায় পুলিশকে নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেছে। শুধু তা–ই নয়, উল্টো বিরোধী প্রার্থীর প্রচার-প্রচারণায় পুলিশের অযাচিত হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে।’ অন্যদিকে নির্বাচনের সার্বিক পর্যালোচনায় তদন্ত কমিটির বক্তব্য: ‘বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ভোট গ্রহণের দিন অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না এবং ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কমিশনার এ বিষয়ে আন্তরিক ছিলেন না। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষক ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিরাপত্তায় কোনো পুলিশ সদস্য নিয়োগ দেননি। ভোটকেন্দ্রসহ নির্বাচনী এলাকায় অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল নাজুক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অনেক ক্ষেত্রে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার নির্দেশনা অনুসরণ করেননি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভোটকেন্দ্রে ও ভোটকেন্দ্রের বাইরে প্রচুর বহিরাগতের অবস্থান ছিল।’
প্রায় ৫ হাজার পৃষ্ঠার সংযুক্ত ডকুমেন্টসহ টাইপ করা ৭১ পৃষ্ঠার মূল তদন্ত রিপোর্টটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি দুটি স্থান মাত্র উদ্ধৃত করলাম।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক হলো, এসব নির্বাচনে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। বিভিন্ন স্থানে অনিয়ম সত্ত্বেও ভোটকেন্দ্রগুলোতে মোটামুটি শান্তি বজায় ছিল। শৃঙ্খলা কতটুকু বজায় ছিল, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। একই সময়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় নির্বাচনে ১৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। সেসব দিক বিবেচনায় সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ইতিবাচক বিষয়টি উপেক্ষা করা যায় না।
বর্তমানে বহুল প্রচলিত গায়েবি মামলা এখন আর গায়েবি আওয়াজ নয়। মাননীয় হাইকোর্ট পর্যন্ত এ ধরনের মামলায় পুলিশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয় বলে উল্লেখ করেছেন। ঢাকার পুলিশ কমিশনার মহোদয় পুলিশ বাহিনীকে গায়েবি মামলা না করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তারপরও অনেক ক্ষেত্রে এরূপ মামলা চালু রয়েছে। আমার প্রশ্ন হলো, শিডিউল ঘোষণার পূর্বে যে পুলিশ গায়েবি মামলা করেছে, শিডিউল ঘোষণার পর তার পক্ষে রাতারাতি পাল্টে গিয়ে নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করা কতটুকু সম্ভব? এ প্রশ্ন মনে জাগে। পুলিশ বাহিনী নির্বাচনে সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি। তারা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।
কিছুসংখ্যক গায়েবি মামলার আসামিদের তালিকা বিরোধী দল থেকে নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়েছে। যদিও অধিকাংশ পুরোনো মামলা। এসব মামলার অজ্ঞাতনামা আসামিদের অনেকের আদালত থেকে জামিন নেওয়া হয়তো সম্ভব হবে না। কোনো কোনো সম্ভাব্য প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা থাকার কারণে তাঁরা নির্বাচনী প্রচারকাজ চালাতে ভয় পাচ্ছেন। এহেন ভীতি সর্বক্ষেত্রে অমূলক নয়। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে নির্বাচনপূর্ব সময়ে প্রার্থীরা যাতে হয়রানির শিকার না হন, সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এ সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন থেকে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা যথাযথভাবে পরিপালন করা প্রয়োজন।
এ ক্ষেত্রে আরেকটি কথা বলতে চাই। ২০১৬ সালের ২৪ মে বাংলাদেশ সরকার বনাম ব্লাস্ট-এর মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় আপিল বিভাগ ‘গাইড লাইনস ফর ল এনফোর্সমেন্ট এজেন্সিস’ শিরোনামে গ্রেপ্তার সম্পর্কে যে নির্দেশনাটি প্রদান করেছেন, তা কোথাও যথাযোগ্যভাবে পরিপালন করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আপিল বিভাগের নির্দেশনাটিতে মানবিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদা সমুন্নত রাখার যে অভিব্যক্তি রয়েছে, তা পরিচালিত হলে পুলিশের আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রবণতা অনেক কমে যেতে পারত।
‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বলে একটা বিষয় নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রায়ই দাবি করা হয়ে থাকে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কমিশন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের আশ্বাস দিলেও সত্যিকার অর্থে এর তেমন কোনো কার্যকারিতা ছিল না। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড একটি আপেক্ষিক কথা। এর কোনো নির্দিষ্ট পরিমাপক নেই। তবে নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন বিধিবিধান সামনে রেখে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরিতে বদ্ধপরিকর ছিল, এ কথা স্বীকার করতে হবে। কিন্তু নির্বাচনী এলাকার বাস্তব পরিস্থিতি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের অনুকূল ছিল না। আমার মনে হয়, সরকার যদি সরকারি দলের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকে, তাহলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির পথ সুগম হবে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এককভাবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা সম্ভব নয়। তবু আমি মনে করি, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে পুলিশের একটা বিরাট ভূমিকা আছে। পুলিশ যদি সবার প্রতি সমান আচরণ করে, তাহলে সেটা সম্ভব হতে পারে।
আমি জানি, সিটি করপোরেশন নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক কথা নয়। আগেই বলেছি, সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিষয়গুলো উল্লেখ করেছি নির্বাচনকালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার জন্য। এটা কখনোই পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে অবমূল্যায়ন করার জন্য নয়। আমার বক্তব্য আত্মবিশ্লেষণ হিসেবেই গ্রহণযোগ্য।
আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সম্প্রতি মিডিয়ায় যে বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে তা হলো, নির্বাচন কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহে পুলিশ দুই মাস পূর্ব থেকে মাঠে নেমেছে। তারা প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পোলিং কর্মকর্তাদের বিষয়ে নানারূপ তথ্য সংগ্রহ করছে এবং জিজ্ঞাসাবাদ করছে। পত্রিকামতে এই তথ্যানুসন্ধানের বিষয়ে পুলিশকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। কমিশন নির্বাচন কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহের জন্য কোনো নির্দেশনা দেয়নি। সুতরাং এসব কর্মকাণ্ড কে কী উদ্দেশ্যে করছে, তা রহস্যজনক। বলা বাহুল্য, অতি উৎসাহী কিছু পুলিশ সদস্যের এই কর্মকাণ্ডে ব্যাপক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে, যার দায় নির্বাচন কমিশনের ওপর এসে পড়ে।
প্রিয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাবৃন্দ, আমি আগেও আপনাদের বলেছি, সংবিধান অনুযায়ী দায়িত্ব পালনের নিমিত্ত আমরা যে শপথ গ্রহণ করেছি, আপনারা সেই শপথের অংশীদার। কারণ, নির্বাচন আমরা করি না, নির্বাচন আপনারাই করে থাকেন। আপনারা আমাদের সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি। অতীতে যেসব জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, আপনারা তাতে দক্ষতা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আমি আশা করি, অতীতের মতো আপনাদের সার্বিক সহযোগিতায় এবারও নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। তবু আমার বক্তব্যে আত্মবিশ্লেষণমূলক কথা বলতে হলো অধিকতর সচেতনতা সৃষ্টির জন্য।
এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নানা কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু দেশবাসী নয়, বিশ্ববাসী আমাদের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। সত্যি বলতে কি, একাদশ জাতীয় নির্বাচন আমাদের আত্মসম্মান সমুন্নত রাখার নির্বাচন। আমরা কোনোভাবেই এই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে দিতে পারি না। আর এ কথা সত্য, আমরা প্রশ্নবিদ্ধ হলে তার দায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর বর্তাবে এবং আপনারা প্রশ্নবিদ্ধ হলে আমরা দায় এড়াতে পারব না। সুতরাং আশা করি, জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব।
- মাহবুব তালুকদার নির্বাচন কমিশনার
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ নভেম্বর ২৫,২০১৮