আইনের খসড়া প্রস্তুত
আয়নাল হোসেন
বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে চাকরি করছেন। চাকরিতে থাকাকালীন নিয়ন্ত্রণাধীন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য নানা নীতিও তৈরি করছেন। অবসরে যাওয়ার পরপরই তারাই আবার স্বার্থসংশ্লিষ্ট সেই প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে যোগ দিচ্ছেন। এতে স্বার্থের সংঘাত দেখা দিচ্ছে। এ-সংক্রান্ত কোনো আইন না থাকায় সুযোগটি নিচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তারা।
এ সুযোগ বন্ধে আইন প্রণয়ন করছে সরকার। ‘স্বার্থ সংঘাত প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা আইন ২০১৮’ শীর্ষক একটি খসড়াও এরই মধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। তাতে অবসরের দুই বছরের মধ্যে কোনো সরকারি কর্মকর্তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে যোগদানে নিষেধাজ্ঞা প্রস্তাব করা হয়েছে। আইনের লঙ্ঘন হলে তিন বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের মুখে পড়তে হবে অভিযুক্তকে।
শুল্ক খাতে অনেক নীতি ও বিধি প্রণীত হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্কনীতির সাবেক সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিনের সময়। সরকারের সচিব হিসেবে গত বছরের ৩০ মার্চ অবসরে যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি যোগ দেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা পদে। আর কয়েক বছর আগে অবসরে যান ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক সেলিম বারামি। অবসরের পরপরই তিনি যোগ দেন ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডে। এ-সংক্রান্ত আইন না থাকায় বাধাহীনভাবে অবসরের পরপরই স্বার্থসংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে পেরেছেন তারা।
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর তফসিলভুক্ত একটি আইন হবে এটি। দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক এ আইনের অধীন অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্তযোগ্য হবে। উপপরিচালকের নিচে নন, দুর্নীতি দমন কমিশনের এমন কর্মকর্তা অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্ত করবেন। আইনের খসড়া প্রণয়নের পর মতামত সংগ্রহ করা হচ্ছে। খসড়ায় স্বার্থ সংঘাত কখন হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, স্বার্থ সংঘাত তখনই হবে, যখন কোনো ব্যক্তি যদি একটি সরকারি দপ্তর থেকে অবসর গ্রহণের ১২ মাস পর বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত হবেন, যার সঙ্গে চাকরি থাকাকালীন তার যোগাযোগ ছিল। এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এনবিআরে থাকাকালীন তিনি বিভিন্ন এনজিওকে কর অবকাশ প্রদানের নিমিত্তে নীতিমালা প্রণয়ন করেন। অবসরের দুই বছরের মধ্যে যদি ওই কর্মকর্তা একটি এনজিওতে যোগদান করেন, যা তার আগে প্রণীত নীতিমালার মাধ্যমে কর রেয়াত পেয়েছে, সেক্ষেত্রে ওই নিয়োগে স্বার্থ সংঘাত বিরাজ করবে।
এনজিওতে না হলেও অবসরের পরপরই স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে যোগ দিচ্ছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা। রাজস্ব আহরণে নিয়োজিত সংস্থাটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দায়িত্ব পালনের পর স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে সাবেক সদস্য হেলাল উদ্দিন উত্তরা মটরসে, এনায়েত হোসেন ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো লিমিটেডে, এইচএম সিরাজী আবুল খায়ের গ্রুপে ও মীর মোস্তাক আলী নিটল-নিলয় গ্রুপে উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
যদিও এ ধরনের নিয়োগে সমস্যা দেখছেন না এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিন। সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এ কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তা দীর্ঘদিন সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা দেয়ার পর অবসরে তার যোগ্যতা দিয়ে যেকোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারেন। চাকরিতে থাকার সময় সরকারি চাকরিজীবীদের অনেকেই সীমিত আয়ে সাধারণ জীবনযাপন করেন। অবসরে যাওয়ায় জীবনযাপনের প্রয়োজনেই অনেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। অনেক ক্ষেত্রে দক্ষতা ব্যবহারের বিষয়টিও থাকে। এ ধরনের আইন হলে তা হবে দুঃখজনক। নতুন নতুন আইন না করে পুরনো আইন বাস্তবায়নে বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে অনৈতিক চর্চা বন্ধের কথাও বলা হয়েছে আইনের খসড়ায়। এতে বলা হয়েছে, অনেক সময় চিকিৎসককে তার সব রোগীর পরীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠাতে দেখা যায়। এর বিনিময়ে রোগীর পরীক্ষা ফির ৪০ শতাংশ সংশ্লিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার চিকিৎসককে প্রদান করে। এমনটা প্রমাণ হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসক উভয়েই এ আইনের আওতায় অভিযুক্ত হবে।
আইন লঙ্ঘনের সর্বোচ্চ শাস্তি উল্লেখ করা হয়েছে তিন বছর কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। সর্বনিম্ন শাস্তি হিসেবে আইন লঙ্ঘনকারীকে এক বছরের কারাদণ্ড বা ১ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। এছাড়া কেউ আইন লঙ্ঘন করলে বা লঙ্ঘনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে বা লঙ্ঘনে সহায়তা করলে দুই বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ব্যক্তিগত স্বার্থ সংঘাতসংক্রান্ত আইন অনেক আগেই প্রণয়ন করা জরুরি ছিল বলে জানান সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন, তাদের অবিলম্বে সরিয়ে দেয়া উচিত। সরকার ইচ্ছা করলে আইন ছাড়াই তাদের সরিয়ে দিতে পারে। আর এ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা হলে তা আরো ফলদায়ক হবে।
- কার্টসিঃ বণিকবার্তা/ নভেম্বর ২৯,২০১৮