Search

Sunday, February 17, 2019

জগন্নাথের টিএসসিতে ছাত্রলীগের লাখ টাকার চাঁদাবাজি


জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন (টিএসসি)-এর জায়গা দখল করে চাঁদাবাজি করছে ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির নেতারা। তাদের একান্ত কর্মীরা এ চাঁদার টাকা তোলার কাজটি করে থাকেন বলে জানা গেছে। 

টিএসসি’র এক দোকানদার জানান, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তরিকুল ইসলাম এর একান্ত আস্থাভাজন কর্মী অ্যাকাউন্টিং বিভাগের ৭ম ব্যাচের মাসুম বিল্লাহ এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ জয়নুল আবেদিন রাসেল এর আস্থাভাজন কর্মী ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ৭ম ব্যাচের আব্দুল্লাহ আল মামুন চাঁদা তোলার কাজটি করে থাকেন।  

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতারা তাদের কর্মীদের মাধ্যমে দীর্ঘদিন চাঁদাবাজি করে আসছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, টিএসসিতে বসানো হয়েছে কমপক্ষে ৭টি চা দোকান, খিচুড়ি দোকান ৩টি, ১টি সমুচা-সিংগাড়ার দোকান, ১টি শুকনো খাবারের দোকান। তবে ক্যাম্পাস খোলা থাকলে মূল ফটকের পাশে সকাল থেকেই বসে বেশ কয়েকটি ঝালমুড়ির দোকানসহ হালিমের দোকান। এ ছাড়া মূল ফটকের পাশেই বসানো হয়েছে মিরাজের একটি বার্গারের দোকান। জানা যায়, দোকানটি সভাপতি তরিকুল ইসলামের একান্ত কর্মী মিরাজের।

নাম জানাতে অনিচ্ছুক দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চায়ের দোকান থেকে প্রতিদিন ১৫০ টাকা হিসেবে মাসে ৩১ হাজার ৫ শত, সমুচা দোকান থেকে প্রতিদিন ৫০০ হিসেবে মাসে ১৫ হাজার, খিচুড়ি দোকান থেকে প্রতিদিন ৪০০ হিসেবে ৩৬ হাজার টাকা চাঁদা তুলে থাকে। এ ছাড়া মূল ফটকের সামনের দোকান থেকেও নেওয়া হয়প্রায় ২০ হাজার টাকা।  সে হিসেবে প্রতি মাসে প্রায় লক্ষাধিক টাকা চাঁদা তুলে জবি ছাত্রলীগের নেতারা। 

এদিকে এসব হোটেলে খাবার দাম আশপাশের অন্যান্য হোটেলের চেয়ে বেশি। টিএসসির খাবার দাম নিয়ে বাংলা বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাহেদ বলেন, অন্যান্য জায়গায় চা ৫ টাকা হলেও এখানে ৬ টাকা, কেক ৮ টাকা হলেও এখানে ১০ টাকা করে খেতে হয়।

দাম বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলেন, এখানে প্রতিদিন একটি চাঁদা দিতে হয়। তার ওপর ছাত্রলীগ নেতাদের আছে ফাঁও খাওয়া।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন চা-বিস্কুট বিক্রেতা বলেন, আমরা যদি চাঁদা না দিতাম আর ফাঁও না খাওয়াতাম তবে অন্যান্য হোটেলের চেয়ে অনেক কম দামে খাওয়াতে পারতাম। 

জবি টিএসসি নিয়ে রসায়ন বিভাগের মাস্টার্স শিক্ষার্থী শামীম বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের কাছে এটা অবসর কাটানোর জায়গা ছিল। যদিও এখনো পূর্ণাঙ্গ টিএসসি হিসেবে জায়গাটি রূপ পায়নি। সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজস্ব অর্থায়নে মুক্তমঞ্চ, বসার বেঞ্চ ও গাছ লাগিয়েছে। তবে বিভিন্ন মহলের দখলদারের কারণে আমরা এখান থেকে তেমন সুবিধা নিতে পারছি না।’ 

জানা যায়, ২০১৪ সালের হল আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের বিপরীত পাশে জনসন রোডে প্রায় ৬ কাঠা জমি সমবায় ব্যাংকের দখলে থাকা জমি দখল নিয়ে টিএসসি ঘোষণা দেন তারা। এরপরেই শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের টিএসসিতে ২০১৪ সালের ১৬ জুন রাতে প্রথমবারের মতো ব্যবসার পথ খুলে বসেন তৎকালীন শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি শরিফুল ইসলাম। শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের মুখে আট দিনের মাথায় ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন তিনি। কিন্তু ব্যবসা থেমে থাকেনি। তারপর থেকে বিভিন্নভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ।

টিএসসি নিয়ে জানতে চাইলে জবি শাখা ছাত্র ইউনিয়ন নেতা রুহুল আমীন বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে তাদের স্বপ্নের টিএসসির জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছি। এখানে আমরা গাছ লাগিয়েছি। তবে বিভিন্ন গোষ্ঠীর কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমার ব্যাপারে যে কথা বলা হচ্ছে তা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। তবে আমি রাসেল ভাইয়ের কর্মী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জবি ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সভাপতি মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, চাঁদাবাজির বিষয়টি আমি অবগত না। আমি বা আমার নেতা কর্মীরা কেউ এমন কাজে লিপ্ত নই। যাদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া হয় তাদের কারো কাছ থেকে কোনো অভিযোগ আসে নি। এখন কেউ যদি ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজি করে থাকে তাহলে এর সঠিক তদন্ত করে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।
  • কার্টসিঃ দৈনিক রূপান্তর / ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

Thursday, February 14, 2019

উন্নয়ন ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনমান


আনু মুহাম্মদ

মানুষ ছাড়া বন বাঁচে/বন ছাড়া মানুষ বাঁচে না/মানুষ ছাড়া নদী বাঁচে/পানি ছাড়া মানুষ বাঁচে না। তাই একটি দেশের বস্তুগত উন্নয়ন কতটা মানুষের জন্য তা বুঝতে শুধু অর্থকড়ির পরিমাণ বৃদ্ধি দেখলে হবে না। তাকাতে হবে বন, নদী, পানি, মানুষসহ সর্বপ্রাণের দিকে। সন্দেহ নেই, গত চার দশকে বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছে সব ক্ষেত্রে। গত দুই দশকে এর বিকাশমাত্রা দ্রুততর হয়েছে। ধনিক শ্রেণির আয়তন বেড়েছে। কয়েক হাজার কোটিপতি সৃষ্টি হয়েছে, সচ্ছল মধ্যবিত্তের একটি স্তর তৈরি হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটেছে। এই বিকাশ প্রক্রিয়ায় দেশের সমাজ অর্থনীতির সব ক্ষেত্র এখন পুঁজির আওতায়, একই সঙ্গে একই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক বেশি বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে অঙ্গীভূত।

পুঁজিবাদের এই বিকাশ নিয়ে সরকারি উচ্ছ্বাস সীমাহীন। উন্নয়নে সরকার সার্থক বলে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ অর্থনীতিবিদদের মধ্যে স্তুতিগানের কমতি নেই। এই স্তুতি বন্দনায় বিশেষভাবে সত্তরের দশকের শুরুতে প্রকাশিত একটি বইয়ের কথা টানা হয়। বইটির নাম- 'বাংলাদেশ : এ টেস্ট কেস অব ডেভেলপমেন্ট'। এর লেখক ১৯৭২-৭৪ সালে ঢাকার বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি জাস্ট ফাল্যান্ড এবং একই সময়ে ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ জে. আর. পারকিনসন। এই গ্রন্থে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ নিয়ে গভীর হতাশা ব্যক্ত করা হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের দর্শন অনুযায়ী তারা পুঁজিবাদ বিকাশের সম্ভাবনাই বিচার করেছিলেন। তাদের বক্তব্যে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের এমনই অবস্থা যে, যদি বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়, তাহলে বিশ্বের কোথাও উন্নয়ন কোনো সমস্যা হবে না। এই হতাশাব্যঞ্জক কথার সূত্র টেনে বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সূচক তুলনা করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়।

কিন্তু স্বাধীনতার পর বিপুল প্রত্যাশা আর তার বিপরীতে রাষ্ট্রের যাত্রা নিয়ে সে সময়ের অন্য আরও কিছু বই আছে, যেগুলোর প্রসঙ্গ টানলে বিশ্নেষণ ভিন্ন হবে। উল্লেখযোগ্য, তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান নূরুল ইসলাম এবং সদস্য রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমানের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা বই। যদি আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিশ্নেষণ করি, যদি মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী জনগণের প্রত্যাশা বিবেচনা করি, যদি স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রে যে তিনটি লক্ষ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল সেই সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা-বর্তমান উন্নয়ন ধারায় কতটা অর্জিত হয়েছে তার বিচার করি, তাহলে উচ্ছ্বাসের বদলে উন্নয়নের গতিধারা নিয়েই প্রশ্ন আসবে। যদি ধনিক শ্রেণির আয়তন ও জিডিপি বৃদ্ধির পাশাপাশি কত নদী বিনাশ হলো, কত বন উজাড় হলো, বাতাস কত দূষিত হলো, মানুষের জীবন কত বিপন্ন হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বঞ্চনা ও বৈষম্য কতটা বাড়ল, শ্রেণি লিঙ্গীয়-ধর্মীয়-জাতিগত বৈষম্য নিপীড়ন কী দাঁড়াল তার হিসাব করি, তাহলে উন্নয়নের সংজ্ঞা পাল্টাতে হবে।

সরকারি হিসাবে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বার্ষিক ৭ শতাংশের বেশি এবং মাথাপিছু আয় এখন বার্ষিক ১৬শ' মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। গত ১০ বছরের গড় হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চহারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঘটেছে নাওরু, ইথিওপিয়া, তুর্কমেনিস্তান, কাতার, চীন ও উজবেকিস্তানে। এক দশকের গড় হিসাবে দ্রুত প্রবৃদ্ধির তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ২০। তবে ২০১৭ সালের প্রবৃদ্ধি হার বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বাংলাদেশের চেয়ে বেশি, সমান ও কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি হার অর্জনকারী অন্য দেশগুলো হলো : ইথিওপিয়া, মিয়ানমার, ভারত, কম্বোডিয়া, তানজানিয়া, লাওস, ফিলিপাইন, আইভরি কোস্ট ও সেনেগাল। ভারতে মাথাপিছু আয় ও জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার গত এক দশক ধরে বেশ ভালো দেখালেও তার পদ্ধতিগত বিষয় নিয়ে সেখানকার অর্থনীতিবিদরা অনেক প্রশ্ন তুলেছেন, বিতর্ক হচ্ছে। ডাটার গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের তথ্য-উপাত্ত পরিসংখ্যান হিসাবনিকাশ প্রবৃদ্ধির গতি-প্রকৃতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ অনেক বেশি থাকলেও বাংলাদেশে এ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই, কোনো বিতর্ক নেই। সরকারি ভাষ্যের সঙ্গে মিলে না এ রকম যুক্তি, তথ্য, প্রশ্ন আর বিতর্ক সরকার পছন্দ করে না বলে প্রায় সব অর্থনীতিবিদ, থিঙ্কট্যাঙ্ক, মিডিয়াও বিনা প্রশ্নে সব গ্রহণ করতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। যা হোক, কতটা ও কীভাবে তা নিয়ে অনেক প্রশ্নের অবকাশ থাকলেও জাতীয় আয় নিশ্চিতভাবেই বেড়েছে।

কোনো দেশের অর্থনীতিকে জিডিপি-জিএনপি এবং মাথাপিছু আয় দিয়ে পরিমাপ করায় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ প্রধান পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করে। এই পদ্ধতি সারা দুনিয়ার করপোরেট শাসকদের প্রিয়। কেননা এতে অনেক সত্য আড়াল করা যায়। বিশ্বব্যাংকই সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশকে মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করে থাকে। এগুলো হলো : ১. নিম্ন আয়ভুক্ত দেশ (মাথাপিছু আয় এক হাজার ২৫ মার্কিন ডলার পর্যন্ত); ২. নিম্নমধ্য আয়ভুক্ত দেশ (এক হাজার ২৬ মার্কিন ডলার থেকে চার হাজার ৩৫ ডলার); ৩. উচ্চ মধ্যম আয় (চার হাজার ৩৬ মার্কিন ডলার থেকে ১২ হাজার ৪৭৫ ডলার); ৪. উচ্চ আয়ভুক্ত দেশ (১২ হাজার ৪৭৬ মার্কিন ডলার থেকে বেশি)। 

মাথাপিছু আয়সহ আরও কিছু বিষয় নিয়ে জাতিসংঘেরও বিভাজন আছে। তাদের মাপকাঠি অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশগুলোর গ্রুপের পরের ধাপ উন্নয়নশীল দেশ; এই পর্বের দেশগুলোকে কম উন্নত বা অনুন্নত দেশও বলা হয়। তাদের সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী বিশ্বে ৪৭টি দেশ ও দ্বীপপুঞ্জ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভুক্ত। এর মধ্যে ৩৩টি আফ্রিকায়। এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে আছে ১৩টি, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ানের মধ্যে একমাত্র হাইতি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে চিহ্নিত। এশিয়ার মধ্যে তালিকাভুক্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও ছিল আফগানিস্তান, ভুটান, কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার ও নেপাল। জাতিসংঘের বিবেচনায় সবচেয়ে দরিদ্র ও দুর্বল দেশগুলো নিয়ে স্বল্পোন্নত দেশের গ্রুপ গঠন করা হয় ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশ এই তালিকাভুক্ত হয় ১৯৭৪-৭৫ সালে।

৪৭ বছর আগে এই গ্রুপ গঠন করার পরে এর মধ্যে মাত্র পাঁচটি দেশ স্বল্পোন্নত তালিকা থেকে পুরোপুরি বের হতে পেরেছে। এগুলো হলো- বতসোয়ানা, কেপ ভার্দে, ইকুয়েটরিয়াল গিনি, মালদ্বীপ ও সামোয়া। জাতিসংঘের কমিটি বলেছে, আগামী তিন বছরে আরও দুটি দেশ ভানুয়াতু ও অ্যাঙ্গোলা এই উত্তরণের তালিকায় আছে। নেপাল ও তিমুরও শর্ত পূরণ করেছে। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তাদের বিষয়টি ২০২১ সালে অনুষ্ঠিতব্য পরবর্তী সভায় বিবেচনার জন্য রাখা হয়েছে। গত বছরের ১৫ মার্চ জাতিসংঘের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে- বাংলাদেশ, লাওস ও মিয়ানমার প্রথমবারের মতো স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য শর্ত পূরণ হয়েছে। আরও ক'বছর দ্বিতীয় দফায় শর্ত পূরণ করতে পারলে চূড়ান্তভাবে এলডিসি তালিকা থেকে এ দেশগুলো বের হতে পারবে।

একটি দেশে জিডিপি অনেক বেশি হলেও যে টেকসই উন্নয়ন দুর্বল হতে পারে, মাথাপিছু আয় বেশি হলেও যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্ন হতে পারে- এ বিষয় স্পষ্ট করে অনেক গবেষণামূলক কাজ হয়েছে নানা দেশে। অমর্ত্য সেন এ বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নতুন প্রস্তাবনা হাজির করেছেন। মাহবুবুল হকের সঙ্গে 'মানব উন্নয়ন সূচক' ধারণা প্রবর্তন করেছেন, যার ভিত্তিতে জাতিসংঘ এখন নিয়মিত রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে। জোসেফ স্টিগলিজসহ মূলধারার বহু অর্থনীতিবিদ অর্থনীতি পরিমাপের পদ্ধতি হিসেবে জিডিপি ব্যবহারের সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

ভারতের ভেতরেই রাজ্য থেকে রাজ্যে তাৎপর্যপূর্ণ তফাত পাওয়া যায়। আফ্রিকার বহু দেশে মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি, মধ্যম আয়ের বিবরণে তারা বাংলাদেশ থেকে অনেক আগে থেকেই এগিয়ে; কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্ন। মিয়ানমারে মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের প্রায় সমান, মানে তারাও নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। মিয়ানমারও একই সঙ্গে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে যাওয়ার শর্ত পূরণ করেছে। নাইজেরিয়ার মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের দ্বিগুণেরও বেশি। কী তাদের জীবনযাত্রার মান বাংলাদেশের চাইতে দ্বিগুণ হলো, এটা বলা যাবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং আরও খারাপ। সে জন্য মানব উন্নয়ন সূচকে নাইজেরিয়া বাংলাদেশেরও পেছনে।

প্রকৃতপক্ষে জিডিপি দিয়ে একটি দেশের আর্থিক লেনদেন বা বাণিজ্যিক উৎপাদন, বিতরণ, পরিসেবার বিস্তার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কারণ যে কোনো লেনদেন ও বাণিজ্যিক তৎপরতা বৃদ্ধিতেই জিডিপি বাড়ে। কিন্তু এর জন্য সামাজিক ও পরিবেশগত কোনো ক্ষতি হলে তা হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। সে কারণে এর মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বোঝা যায় না, অর্থনীতির গুণগত অগ্রগতিও বোঝা যায় না। যেমন চোরাই অর্থনীতির তৎপরতাতেও জিডিপি বাড়ে; কিন্তু সমাজের বড় একটা অংশের জীবন-জীবিকা তাতে বিপদগ্রস্ত হয়। নদী-নালা, খাল-বিল, বন দখল ও ধ্বংসের মাধ্যমেও জিডিপি বাড়তে পারে; কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে না, বরং অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। এসব তৎপরতায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রকৃত আয় বৃদ্ধি পায় না বরং জীবনমান বিপর্যস্ত হয়। দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও তার কারণে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিও বড় দেখায়, জিডিপির অঙ্কও বাড়ে। একই সময়ে শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ কমে এসেছে তার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে। কিন্তু এই ব্যয় বৃদ্ধি আবার জিডিপি বাড়ায়। অনিয়ন্ত্রিতভাবে গৃহীত বৃহৎ প্রকল্পে ব্যয়ের লাগামহীন বৃদ্ধি, আর্থিক খাত থেকে অভাবনীয় মাত্রায় লুণ্ঠন ও পাচারও জিডিপি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।

দ্বিতীয়ত, যে সমাজে বৈষম্য বেশি সেখানে মাথাপিছু আয়ের হিসাব বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়। একটি পরিবার যদি দশ লাখ টাকা আয় করে, পাশাপাশি অন্য একটি পরিবার যদি দশ হাজার টাকা আয় করে, তাহলে উভয় পরিবারের গড় আয় হবে পাঁচ লাখ পাঁচ হাজার টাকা। এতে কি দুই পরিবারের প্রকৃত অবস্থা বোঝা যায়? বর্তমান মাথাপিছু আয় হিসেবে আমাদের দেশে চার সদস্যের পরিবারের বার্ষিক গড় আয় হয় প্রায় ৭ হাজার মার্কিন ডলার অর্থাৎ মাসে প্রায় ৫৭ হাজার টাকা। তার মানে বাংলাদেশের সব নাগরিক শিশু-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সবারই মাথাপিছু আয় মাসে এখন প্রায় ১৪ হাজার টাকা। অথচ সরকারি পরিসংখ্যান বলে, বাংলাদেশের শতকরা ৮০ জন মানুষের মাসিক আয় এর থেকে অনেক নিচে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় যত, শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ পায় এর মাত্র ৩০ শতাংশ। অন্যদিকে শুধু আর্থিক খাতই নয়, সর্বজনের (পাবলিক) সব সম্পদই অসীম ক্ষুধায় কাতর ধনিক শ্রেণির লক্ষ্যবস্তু।

  • অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। 
  • কার্টসিঃ সমকাল/ ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৯। 

বেগম জিয়া ও কারাবাসের এক বছর



শামসুজ্জামান দুদু
গত ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, বাংলাদেশের সব থেকে জনপ্রিয় নেত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কারাবাসের এক বছর পূর্ণ হলো। যিনি বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আপসহীন নেত্রী হিসেবে জাতির কাছে পরিচিতি, সেই তিনি গত এক বছর ধরে একটি মিথ্যা মামলায় তথাকথিত বিচারে কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁর বয়স এখন প্রায় ৭৩ বছর। নানা জটিল রোগে দীর্ঘদিন থেকে তিনি অসুস্থ। যেসব ডাক্তারের কাছে নিয়মিত চিকিৎসা নিতেন, তা-ও এখন তিনি পাচ্ছেন না। তাঁকে চিকিৎসা নিতে হলেও বারবার কোর্টের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। কদাচিৎ অনুমতি পাচ্ছেন অথবা পাচ্ছেন না। যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। 

যাকে নিয়ে আমরা আলোচনা করছি তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। যে নির্বাচনে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন সে নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসের সব থেকে বিতর্কিত নির্বাচন। এই নির্বাচন প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে এর ভালো দিক উল্লেখ করা বড় কঠিন।


দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের শুরুটা অত্যন্ত কঠিন একটি সময়। তাঁর স্বামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক অন্যতম সেক্টর কমান্ডার রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা বীরউত্তম শহীদ জিয়াউর রহমান। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক শুধু গ্রেফতারই হননি, দুটি মাসুম বাচ্চা নিয়ে পাকিস্তানের কারাগারে নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। দেশনেত্রী বাংলাদেশের জনগণের পরীক্ষিত এক আপসহীন নেত্রী। যার জীবনের প্রায় পুরোটা সময় কেটেছে স্বাধীনতাযুদ্ধ, গণতন্ত্রের জন্য বিরামহীন লড়াই, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা সংগ্রামে। আবার নানামুখি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন বহুবার। তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে সংগ্রামী নায়কদের রূপকথাতুল্য যে কাহিনি থাকে তার অন্যতম উজ্জ্বল উদাহরণ বাংলাদেশের দেশনেত্রী ১৬ কোটি মানুষের প্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। যার শাসনকালে নারী-পুরুষ, কৃষক-শ্রমিক ছাত্রজনতা মুক্তিযোদ্ধা আপামর মেহনতি মানুষ ঠিকানা পেয়েছিল সুখ আর শান্তিময় জীবনের। সেই নেত্রীকে এখন কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে কষ্টকর এবং পীড়াদায়ক ভয়ঙ্কর নির্যাতনের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। এই কাহিনি এখন বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে, অন্তরে।

স্বাধীনতাযুদ্ধের পর বাংলাদেশের মানুষের মত তিনিও ভেবেছিলেন স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে-শান্তিতে দিনযাপন করবেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে তিনি বুঝেছিলেন সেটি বোধ হয় সম্ভব হবে না। স্বাধীনতার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেশের আইনশৃঙ্খলা কাঠামো ভেঙে পড়ে। যে গণতন্ত্রের অর্জনের প্রত্যয় নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ জীবনপণ লড়াই করেছিলেন, ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছিলেন, ২ লক্ষ মা-বোন তাদের আব্রু হারিয়েছিলেন সেই গণতন্ত্র ধরা দিতে দিতে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল। মানুষ খাবারের জন্য হাহাকার করতে লাগলো। এক মুঠো ভাতের জন্য দ্বারে দ্বারে হাত পাততে  থাকলো। 

এক সময় দেশে ভয়ঙ্কর খাদ্য সংকটে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। ভয়ংকর এক সময়। এরমধ্যেই শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এলো। সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা। একদলীয় ব্যবস্থার ছয় সাত মাস যেতে না যেতেই বাংলাদেশের সেই ভয়ংকরতম ঘটনাটি সংঘটিত হয়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। আগস্টের পরে এলো ৩ নভেম্বর। তারপর এলো সিপাই জনতার ৭ নভেম্বর। এর প্রতিটি ঘটনার মধ্যে মৃত্যুর হাতছানি ছিল। এই অস্থির সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা কোনও না কোনোভাবে হতাহত হয়েছেন। শহীদ জিয়াউর রহমান এবং তাঁর পরিবার এই দিনগুলোতে জীবন-মৃত্যুর কাছাকাছি থেকেছেন প্রতিমুহূর্তে। সেসব ঘটনার অনেক বর্ণনা ইতিহাসে পাওয়া যায়। সেসব বিষয় এখানে আলোচ্য নয়। কিন্তু গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে গিয়ে বেগম খালেদা জিয়া এক সময় তাঁর প্রিয়তম স্বামী এবং এ দেশের আপামর জনতা তাদের প্রিয়তম জননায়ক শহীদ জিয়াউর রহমানকে হারিয়েছিলেন।

যে মানুষটি, যে নেত্রী সারা জীবন দেশের মানুষের জন্য গণতন্ত্রের জন্য স্বাধীনতার জন্য এত কষ্ট এবং নির্যাতন ভোগ করলো তাঁকেই কিনা এখন একটা পরিত্যক্ত জেলে অনিশ্চিত জীবনযাপন করতে হচ্ছে একা একা। যাঁর চিকিৎসার ন্যূনতম নিশ্চয়তা নেই, কবে বেরোবেন জেল থেকে, তাও কেউ বলতে পারে না। এমন একটি দেশের জন্যই কি তিনি জীবনবাজি ধরেছিলেন! তিনি কি কখনও কল্পনা করেছিলেন, এই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিচার ব্যবস্থা, শাসন ব্যবস্থা, গণতন্ত্রের স্বাধীনতার এই পরিণতি হবে! হয়তো ভাবেননি। তারপরও আমরা দেশবাসী এইসময়ে এতটুকু তো অন্তত আশা করতে পারি- যিনি স্বাধীনতা গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ লড়াই করেছেন দ্বিধাহীন আপসহীনভাবে, তাঁকে কি সুষ্ঠু বিচারের নিশ্চয়তা দিতে পারি না? রাষ্ট্র হিসেবে কি রাষ্ট্রের কোনও দায়িত্ব নেই!

  • লেখক: ভাইস চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি 
  • কার্টসি — ব্রেকিংনিউজবিডি / ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৯। 

গত ১০ বছরে পাচার-খেলাপি খেয়েছে দুই বাজেটের টাকা

গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার, ঋণ খেলাপি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যে পরিমাণ টাকা লোপাট হয়েছে তা প্রায় দেশের দুটি বাজেটের সমান। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টগ্রিটি (জিএফআই), বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। গত ১০ বছরে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। অন্যান্য মিলে খেলাপি ঋণ প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার বেশি। আর বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গত ১০ বছরে জালিয়াতি হয়েছে প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। প্রকৃত হিসাবে এটি আরো বেশি। সবমিলিয়ে প্রায় বাংলাদেশের দুটি বাজেটের মতো টাকা উধাও হয়েছে। বাংলাদেশের চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট যার পরিমাণ ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা।

এদিকে গত বছরের জুনে প্রকাশিত সুইস ব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) পানামা এবং প্যারাডাইস পেপার্সে এ পর্যন্ত অর্থ পাচারকারী হিসেবে ৮২ জন ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশ করেছে। কিন্তু কোনো ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি দৃশ্যমান হয়নি বলে বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেন।

এদিকে আদালতও গত ২০ বছরের ব্যাংকের ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচারকারীদের তালিকা প্রস্তুত করে তা দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে বগত বছরগুলোতে ব্যাংকিং খাতে কী পরিমাণ অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে, তা নির্ণয়ে একটি শক্তিশালী কমিশন গঠনের জন্য কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন।

আদালত যে নিদের্শনা দিয়েছে তা আগে থেকেই সরকারকে পরামর্শ দিয়ে আসছেন দেশের অর্থনীতিবিদেরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আদালতকেই দায়িত্ব নিতে হলো। আর এটি আগেই ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন তারা। তাদের মতে, ব্যাংক খাতের দুর্নীতি ক্যানসারের মতো, একবার দেখা দিলে তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা অর্থনীতিতে।

প্রতি বছর দেশ থেকে টাকা পাচার হলেও টাকা উদ্ধারের তেমন কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। কারা টাকা পাচার করছেন, কেন করছেন, পাচার হওয়া টাকা উদ্ধার করার কি পদক্ষেপ নেয়া যায় সে বিষয়ে তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায় না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এদিকে টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ায় দেশ বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

জিএফআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে প্রায় ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে। ২০১৫ সালে পাচার হয়েছে আরো ৫৯০ কোটি ডলার। সেই হিসাবে গত ১১ বছরে মোট পাচার হয়েছে ৮ হাজার ১৭৫ কোটি ডলার। বর্তমান বাজারদরে এর মূল্যমান ৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ২০১৬ সালে পাচার দেখিয়েছিল, গত ১০ বছরে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছিল। 

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, অর্থ পাচার নিয়ে জিএফআই ও সুইস ব্যাংকের তথ্যে পদ্ধতিগত সমস্যা রয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থ পাচার নিয়ে সুইস ব্যাংক যে তথ্য প্রকাশ করে, তার ৯২ শতাংশ বৈধ পথে যাওয়া অর্থ। আর জিএফআইয়ের অর্থ পাচারসংক্রান্ত তথ্যের পদ্ধতিগত ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে। জিএফআইয়ের তথ্যের বড় অংশই ট্রেড বেজড মানি লন্ডারিং। বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। 

এদিকে ২০০৯ সালে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। আর গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০ বছরে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৪ গুণ। এর বাইরে দীর্ঘদিন আদায় করতে না পারা যেসব ঋণ ব্যাংকগুলো অবলোপন করেছে, তার পরিমাণ প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের সঙ্গে অবলোপন করা এ মন্দ ঋণ যুক্ত করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য। তবে ব্যাংক কর্মকর্তারাই বলছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দুই থেকে আড়াই লাখ কোটি টাকা হবে। বর্তমানে দেশে ৫৯টি ব্যাংক কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর মধ্যে ৪১টি বেসরকারি খাতের ও ৯টি বিদেশি ব্যাংক। রাষ্ট্র খাতের ব্যাংক ৯টি। 

ব্যাংক খাত সূত্রগুলো বলছে, গত ১০ বছরে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বাড়ার অন্যতম কারণ হলো সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি। এ ছাড়া বেসিক ও ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি, জনতা ব্যাংকের ক্রিসেন্ট ও অ্যাননটেক্স গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির কারণে খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সবার আগে ব্যাংক খাত ঠিক করতে হবে। এ জন্য সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে সবার মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। আর যারা দোষী, তাদের দ্রুত দৃশ্যমান বিচারের আওতায় আনতে হবে। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, গত ১০ বছরে সরকারের বড় ব্যর্থতা ব্যাংক খাতের অরাজকতা। এসব দূর করতে তেমন জোরালো উদ্যোগ ছিল না। এ জন্য ঘটনা থেমে থাকেনি।

অন্যদিকে নিয়ম না মেনে ঋণ বিতরণ, বেনামি ঋণ, সুশাসনের অভাব, এসবই ব্যাংক খাতের সামগ্রিক চিত্র। এর ফলে গত ১০ বছরে ব্যাংক খাত থেকে জালিয়াতি হয়েছে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ। গত ১০ বছরে জনতা ব্যাংক থেকে অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট ও থারমেক্স গ্রুপ মিলে ১১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা নিয়ে গেছে, বেসিক ব্যাংক থেকে চলে গেছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা, সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক কেলেঙ্কারিতে আত্মসাৎ হয়েছে ৩ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা, বিসমিল্লাহ গ্রুপ নিয়েছে ১ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা, নতুন প্রজন্মের এনআরবি কমার্শিয়াল ও ফারমার্স ব্যাংক থেকে লোপাট হয়েছে আরো ১ হাজার ২০১ কোটি টাকা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, ব্যাংক খাতে অনেক ধরনের সমস্যা চলছে। সুদের হার ও খেলাপি ঋণ অনেক বেশি, মূলধনে ঘাটতি রয়েছে। ব্যাংকের সংখ্যাও বেশি, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণেও দুর্বলতা রয়েছে। বড় যে সমস্যা পুরো খাতে সংকট বাড়াচ্ছে, তাহলো খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ একটা ক্যানসারের মতো। এটা যেন না ছড়ায়, তার উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।
  • কার্টসিঃ মানবজমিন/ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

Wednesday, February 13, 2019

বেগম খালেদা জিয়া কেন মুক্ত হতে পারছেন না


 
 ড. মাহবুব উল্লাহ্
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃসঙ্গ কারাবরণের ১ বছর কেটে গেল। ইংরেজি ভাষায় যাকে বলা হয় Solitary confinement, সেভাবেই কারারুদ্ধ আছেন তিনি। পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পাশে অবস্থিত পরিত্যক্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাকে বন্দি রাখা হয়েছে।

কারাজীবনে তার একমাত্র সঙ্গী গৃহকর্মী ফাতেমা। বার্ধক্যে একটু সেবা-যত্ন করার জন্য ফাতেমার সাহায্য না পেলে তার কারাবাস হতো অবর্ণনীয় দুঃখ-যন্ত্রণায় জর্জরিত। তিনি খুবই অসুস্থ।

তিনি একজন নারী বটে, পুরুষ হলেও এ ধরনের কারাবাস সাধারণ কারাবাসের চেয়ে হাজারগুণ বেশি কষ্টের। তিনি অনেক রোগে আক্রান্ত, বহু বছর ধরে আর্থ্রাইটিসের রোগী।

এজন্য তার হাঁটু প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এ সত্ত্বেও রোগ যন্ত্রণা একটুও কমেনি। এছাড়াও রয়েছে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপের উপসর্গ। দিন দিন তিনি ক্ষীণকায় হয়ে পড়ছেন। তার বর্তমান ছবি দেখে বোঝা যায় না, এই মানুষটি একদিন এরশাদের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ঢাকার রাজপথে মাইলের পর মাইল জনতার মিছিল নিয়ে হেঁটেছেন।

স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার এই অক্লান্ত সংগ্রাম জনতার কাছে তার পরিচিতি দিয়েছে আপসহীন নেত্রীর। তিনি যখন রাজনীতিতে নামার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তার বছর দুই আগে যৌবনেই তিনি হারিয়েছেন স্বামীকে অত্যন্ত হৃদয়বিদারকভাবে।

কোথা থেকে তিনি এত সাহস পেলেন, ভাবতেও বিস্মিত হতে হয়। বয়স বাড়লেও রাজনীতির চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে তিনি সাহস হারাননি।

শোনা যায়, কারাগারে তাকে নানা ধরনের আপস প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এসব মেনে নিলে তার বিরুদ্ধে আর কোনো মামলা-মোকদ্দমা থাকবে না, এমনটাই ধারণা দেয়া হয়েছে। অবশ্য আমার পক্ষে হলফ করে বলা সম্ভব নয় এসব শোনা কথার সত্যতা কতটুকু।

খালেদা জিয়া রাজবন্দি কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ তার বিরুদ্ধে যে ৩০-৩৫টি মামলা চলছে, তার সবই ফৌজদারি মামলা। ফৌজদারি মামলার আসামি রাজবন্দি হতে পারে না, এমনটাই বলছেন শাসক দলের নেতারা।

এই শাসক দল একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় আছে। তাদের বক্তব্যের যথার্থতা বিশ্লেষণ না করেও আমাদের দেশের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি বা Criminal offence-এ মামলা হলেও তার চরিত্রটি মূলত হয় রাজনৈতিক।


খালেদা জিয়া যদি একজন অত্যন্ত শক্তিশালী ও জনপ্রিয় নেত্রী না হতেন এবং অতীতে দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে না থাকতেন, তাহলে তাকে এই বৃদ্ধ বয়সে কারাবাস করতে হতো না। পাকিস্তান আমলে রাজনীতিকদের এভাবে হয়রানি করার ঘটনা সংখ্যায় অনেক কম হলেও খুব অনুল্লেখ্য ছিল না। আমাদের রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির মামলা হয়েছিল।

অবশ্য শেষ পর্যন্ত এসব মামলা আদালতের বিচারে টেকেনি। মরহুম আবুল মনসুর আহমেদ সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। তবে পাকিস্তান আমলে কারাবাসের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হতে হয়েছে বামপন্থী কমিউনিস্টদের। কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলেও তাদের বছরের পর বছর বিনা বিচারে আটক থাকতে হতো।

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আটক রাখার জন্য ব্যবহৃত হতো কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা আইন, প্রাদেশিক নিরাপত্তা আইন ও ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলে বিনা বিচারে আটক শত শত রাজবন্দি মুক্তি লাভ করেছিলেন।

তাদের মধ্যে সর্বাধিক সময় জেল খেটেছেন বামপন্থী নেতা আশু ভরদ্বাজ। সেই যে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর তাকে বন্দি করা হল, তারপর ১০ বছরেরও বেশি কারা জীবনযাপনের পর তিনি মুক্তি পেলেন ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের ফলে। ১৯৬৯-এর ১১ দফা দাবির অন্যতম দাবি ছিল রাজবন্দিদের মুক্তি।

আন্দোলনের তীব্রতা, ব্যাপকতা এবং প্রচণ্ডতা এতই বাঁধভাঙা ছিল যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক শেখ মুজিবসহ অন্যদের মামলা চলা অবস্থাতেই প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান নিঃশর্তভাবে এদের মুক্তি দিতে বাধ্য হন। অথচ এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতার। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ সিভিল না ক্রিমিনাল তা বলতে পারব না। কারণ আমি আইনজ্ঞ নই।

তবে এদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিল, সেগুলো আমার কাছে ক্রিমিনাল বলেই মনে হয়। আইয়ুব খান কেন তাদের মুক্তি দিলেন, তা-ও একটি বিচার্য বিষয়।

আন্দোলনের অপ্রতিরোধ্য শক্তির কাছে আইয়ুব খানের এভাবে নতিস্বীকার শুধু একভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় এবং সেটি হলো ডকট্রিন অব নেসেসিটি। রাষ্ট্র রক্ষার প্রয়োজনে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় আইনকেও উপেক্ষা করা যায়।
আপাতদৃষ্টিতে ডকট্রিন অব নেসেসিটির প্রয়োগ প্রচলিত আইনে গণ্ডির মধ্যে না থাকলেও এটা আইনি ব্যাখ্যা থেকেই উদ্ভূত।

খালেদা জিয়ার কারাবাসের এক বছর পেরিয়ে গেলেও আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে তার মুক্তি সম্ভব এমনটি একজন রাখাল বালকও মনে করে না। আমাদের মতো দেশে প্রবাদতুল্য একটি কথা প্রচলিত আছে। তা হল, ক্ষমতার সিংহাসন থেকে কারাগার বেশি দূরে নয়।

এরকম অভিজ্ঞতা ১৯৪৭-এর পর অনেক রাজনীতিকেরই হয়েছে। খালেদা জিয়া তার ব্যতিক্রম নন। এর আগেও সেনাসমর্থিত অসাংবিধানিক সরকারের আমলেও তাকে কারাভোগ করতে হয়েছে। তবে এখনকার তুলনায় বেশ কিছুটা সুখকর অবস্থায় সেই সময়েও তার কাছে আপস প্রস্তাব এসেছিল।

কিন্তু জেদি খালেদা জিয়া সে প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। সেই সরকারের পক্ষে শেষ পর্যন্ত দুই নেত্রীকে মুক্তি দিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। একটি নির্বাচন করে তারা ক্ষমতা ছাড়লেন।

তবে এ যাত্রায় সংসদে বিএনপির অবস্থান খুবই সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। খালেদা জিয়া যদি আপস করতেন, তাহলে তার এই দুর্গতি হতো না। এখন শাসক দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘পারলে খালেদা জিয়াকে আন্দোলন করে মুক্ত করে নেন।’

এ রকম দম্ভোক্তি যারা করছেন তারা কি জানেন, এর পরিণতি কী হবে? অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, আন্দোলনের মাধ্যমে যদি খালেদা জিয়া মুক্তি লাভ করেন তাহলে শাসক দলকেও ক্ষমতা হারাতে হবে, অথবা হারাতে হতে পারে।

খালেদা জিয়ার মতো একজন জনপ্রিয় নেত্রীকে কারারুদ্ধ করা যাবে কিংবা দণ্ডিত করা যাবে, এমনটি হয়তো কেউ ভাবেননি। না শাসক দল, না তাদের বিরোধী দল। কিন্তু বাস্তবে সবই হয়েছে। শাসক দল নিরুপদ্রবভাবে ক্ষমতায় আসীন আছে। অবস্থাদৃষ্টিতে মনে হয়, তাদেরকে আর নড়ানো যাবে না। গণআন্দোলনেরও কোনো সম্ভাবনা দিগন্ত রেখায় দৃশ্যমান নয়। কারণ একটিই।

যে বাংলাদেশ কবি সুকান্তের ভাষায়, ‘করো কাছে মাথা নোয়াবার নয়’, সেই বাংলাদেশে প্রচণ্ড এক ভয়ের সংস্কৃতি ভর করেছে। গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অসন্তুষ্ট মানুষকে ভয়ে গুটিশুটি করে ফেলেছে।

এত ভয় এদেশে আজ, যার ফলে গুটি খুলে প্রজাপতিও পাখা মেলে না। আকাশের ঘনমেঘ বারি বর্ষণ করে না। এসবের অনেক নজির আছে। রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান যাচ্ছিলেন বিমানবন্দরের দিকে তার বিদেশ থেকে আগত কন্যাকে ঘরে নিয়ে আসতে।

কিন্তু তার কপালে সেই সুযোগ ঘটেনি। পথিমধ্যে তাকে তুলে নেয়া হয়। তারপর থেকে তার আর কোনো হদিস মেলেনি।

এ ঘটনা সংবাদপত্রে এসেছে। দেশবাসীও সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পেরেছে। এদেশের খুব কম লোকই জানত মারুফ জামান নামে একজন ব্যক্তি বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। এমনকি কোনো মানুষই জানত না রাজনীতির সঙ্গে তার কোনো সংশ্রব ছিল। হতে পারে কূটনৈতিক মহলের লোকরা তাকে চিনত। আজ অবধি তার কোনো হদিস নেই। সরকারের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে কোনো রা’ করা হয়নি।
একজন রাষ্ট্রদূতের যদি এমন পরিণতি হতে পারে, তাহলে আমাদের মতো আমজনতার পরিণতি কী ভয়াবহ হতে পারে, তা ভাবাই মুশকিল। শাসক দলের লোকজন বলবেন, এসব কথা তো আমার মতো একজন সামান্য ব্যক্তি খবরের কাগজের পাতায় প্রকাশ করতে পারছি, তাহলে এদেশে গণতন্ত্র নেই- এমন কথা কীভাবে বলা যায়? রাষ্ট্রদূত মারুফ জামানের উদাহরণ এখানে দেয়া হয়েছে।


কিন্তু এছাড়াও একই ধরনের আরও অনেক দৃষ্টান্ত আছে। বছরের একটি দিনে প্রেস ক্লাবে সমবেত হয়ে এভাবে হারিয়ে যাওয়া মানুষের পিতামাতা, সন্তান ও স্ত্রীরা করুণ নয়নপাত করেন। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষটি আর ফিরে আসে না।

প্রতীক্ষার অবসান হয় না। জানা যায় না ওরা বেঁচে আছেন কি না, কিংবা কেমন অবস্থায় আছেন। হ্যাঁ, সংবাদপত্রে বা গণমাধ্যমে এসব কথা কিছু করে হলেও প্রকাশ করা যায় বলে দেশটি গণতন্ত্রের লেশমাত্রহীন হয়ে পড়েছে- এমন কথা বলা যায় না। দ্য ইকোনমিস্টের ভাষায় এটা হল, হাইব্রিড গণতন্ত্র। সভা-সমিতি করা বা সমাবেশ করা সবকিছুই এখন পুলিশের মর্জির ওপর নির্ভরশীল।

ভয়ের আবহ যখন ঘন কুয়াশার মতো দেশকে ছেয়ে ফেলে, তখন গণআন্দোলনই বা হবে কীভাবে? তারপরও আশা রাখি কুয়াশার চাদর ভেদ করে আলোর পথযাত্রীরা মশাল হাতে নিয়ে কোনো এক অজানা দিনে রাজপথে বেরিয়ে পড়বে। সে রকম মুহূর্ত এলে খালেদা জিয়া কেন, অন্যসব রাজবন্দিও মামলার জাল থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসবেন। এদেশে মুক্ত হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ খুবই স্বল্পস্থায়ী হয়।

সেই তুলনায় গণবিরোধী সরকারের স্থায়িত্ব অনেক বেশি। আমার আরও আশা থাকবে যদি কোনো অলৌকিক কারণে খালেদা জিয়ার মুক্তি হয়, তাহলে মুক্ত বাতাসে আমাদের নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ যেন অবারিত এবং অসীম হয়। কেউ যেন কোনো প্রতিশোধের স্পৃহায় আক্রান্ত না হয়। অন্যথায়, মুক্ত হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেয়াটাও ভারি হয় যাবে।

  • ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
  • যুগান্তর/ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৯। 


House Foreign Affairs Committee Calls for Administration Action to Protect Democracy in Bangladesh

February 12, 2019


WASHINGTON—Representative Eliot L. Engel, Chairman of the House Committee on Foreign Affairs; Representative Michael T. McCaul (R-TX), the Committee’s Ranking Member; Rep. Brad Sherman (D-CA), the Chairman of the Asia and Pacific Subcommittee; Rep. Ted Yoho (R-FL), the Ranking Member of the Asia and Pacific Subcommittee; Rep. Andy Levin (D-MI); and Rep. Ann Wagner (R-MO) today called on the Trump Administration to address threats to democracy in Bangladesh. In a letter to Secretary of State Mike Pompeo, the members highlighted reports of election fraud, improper election rigging and voter suppression surrounding Bangladesh’s December 2018 election, urging the Department to take action.

“There will be a series of elections taking place this year in Asia, including in Afghanistan, Indonesia, the Philippines, and Thailand. It is crucial that the United States demonstrate its continued commitment to and respect for democratic institutions, beginning with Bangladesh,” the members wrote.

Full text of the letter 

Dear Mr. Secretary,
We are gravely concerned by the negative trajectory of democracy in Bangladesh and request an outline of how the Department intends to respond to this trend, particularly in light of serious allegations that the outcome of the December 2018 elections lacked credibility. As you know, supporting democracy, rule of law, and human rights in the Indo-Pacific region is critical to advancing U.S. interests, and reports of widespread irregularities in Bangladesh’s recent elections seriously threaten those important interests.


Bangladesh has a strong and proud democratic tradition, so we were particularly dismayed that the campaign leading up to the election was marred by violence, mass arrests, and a crackdown on free speech. The Awami League claimed 96 percent of the seats contested -- more than the party and its allies won in 2014, when a key opposition party boycotted the general election and the Awami League ran unopposed in more than half of the seats contested.


Although the government-appointed election commission has claimed the election was legitimate, we believe the allegations of widespread rigging and voter suppression must be taken seriously. According to press accounts, when polls across the country officially opened, reporters found that some ballot boxes looked suspiciously full. There are reports that Awami League activists barred some people from voting, claiming that the polling stations were closed for lunch or had run out of ballots. Some voters were even told their votes had already been cast. To make matters worse, the Government of Bangladesh failed to grant credentials and issue visas to most international election monitors, including those funded by the United States.


There will be a series of elections taking place this year in Asia, including in Afghanistan, Indonesia, the Philippines, and Thailand. It is crucial that the United States demonstrate its continued commitment to and respect for democratic institutions, beginning with Bangladesh.


Thank you for your attention to this matter. We look forward to your timely response.



  • https://foreignaffairs.house.gov/2019/2/house-foreign-affairs-committee-calls-for-administration-action-to-protect-democracy-in-bangladesh


বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের চিঠি


বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্রের নেতিবাচক গতিবিধি’ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস। একই সঙ্গে বাংলাদেশে গণতন্ত্রে হুমকির বিষয়ে নজর দিতে আহ্বান জানানো হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি। বিশেষ করে ৩০ শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ‘ভোট জালিয়াতির গুরুত্বর অভিযোগের’ বিষয়ে দৃষ্টি দেয়ার কথা বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান এলিয়ট এল এনজেলসহ ৬ জন প্রভাবশালী কংগ্রেসম্যান এমন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি পেন্টাগন থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ৬ কংগ্রেসম্যান প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। এ বিষয়ে তারা পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওয়ের কাছে একটি চিঠি লিখেছেন। তাতে বাংলাদেশে সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জালিয়াতি, ভোট কারচুপি ও ভোটারদের ওপর নিষ্পেষণের কথা উল্লেখ করা হয়।

এলিয়ট এল এনজেলের নিজের ওয়েবসাইটে ওই চিঠি এবং এ সংক্রান্ত বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। এর শিরোনাম ‘হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটি কলস ফর অ্যাডমিনিস্ট্রেশন একশন টু প্রটেক্ট ডেমোক্রেসি ইন বাংলাদেশ’। যার অর্থ দাঁড়ায় বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষায় প্রশাসনিক পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে হাউজ ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটি। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওয়ের কাছে যে ৬ জন প্রভাবশালী কংগ্রেসম্যান স্বাক্ষরিত চিঠি পাঠানো হয়েছে তাতে স্বাক্ষর করেছেন প্রতিনিধি পরিষদের হাউস কমিটি অন ফরেন অ্যাফেয়ার্সের চেয়ারম্যান প্রতিনিধি এলিয়ট এল এনজেল। প্রতিনিধি মাইকেল টি ম্যাকল (টেক্সাসের রিপাবলিকান)। তিনি কমিটির র‌্যাংকিং মেম্বার। প্রতিনিধি ব্রাড শারমান (ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্রেট)। তিনি এশিয়া প্যাসিফিক সাব কমিটির চেয়ারম্যান। মিশিগানের ডেমোক্রেট দলীয় প্রতিনিধি অ্যান্ডি লেভিন ও মিসৌরি থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান দলের প্রতিনিধি অ্যান ওয়াগনার। 

তারা মঙ্গলবার লেখা ওই চিঠিতে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য যেসব হুমকি তার বিষয়ে দৃষ্টি দিতে। বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়েছে। 

এতে আরো বলা হয়, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জালিয়াতি, অনুপযুক্তভাবে নির্বাচনে কারচুপি ও ভোটারদের দমিয়ে রাখার বিষয়ে যেসব রিপোর্ট পাওয়া গেছে তা জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন ওই সদস্যরা। তারা এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ‘অ্যাকশন’ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এতে বলা হয়, এ বছর আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডসহ এশিয়ার কিছু দেশে ধারাবাহিকভাবে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহতভাবে যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে এবং সম্মান দেখিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহতভাবে প্রদর্শন করে যেতে হবে। আর তা শুরু করতে হবে বাংলাদেশকে দিয়েই। এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 
চিঠিটি নিচে তুলে ধরা হলো —

জনাব সেক্রেটারি, 

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নেতিবাচক গতিবিধির বিষয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এমন প্রবণতার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিভাবে সাড়া দিচ্ছে সে বিষয়ে একটি রূপরেখার অনুরোধ করছি, বিশেষ করে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের নির্বাচনে সিরিয়াস সব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে, যেখানে বলা হয়েছে নির্বাচনে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব রয়েছে। আপনি যেমনটা জানেন, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকারে সমর্থন দেয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক নির্বাচনে যেসব গুরুতর অনিয়মের রিপোর্ট এসেছে তা এসব গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থের জন্য মারাত্মক হুমকি। 

বাংলাদেশের আছে একটি শক্তিশালী ও গর্বিত গণতান্ত্রিক প্রবণতা। তাই বিশেষ করে আমরা আতঙ্কিত, নির্বাচনকে সামনে রেখে যে প্রচারণা হয়েছে তা বাধাগ্রস্ত হয়েছে সহিংসতা, গণগ্রেপ্তার ও মুক্ত মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন দ্বারা। আওয়ামী লীগ দাবি করেছে, তারা নির্বাচনে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা হয়েছে যেসব আসনে তার মধ্যে শতকরা ৯৬ ভাগ আসনে বিজয়ী হয়েছে, যা ২০১৪ সালে এই দল ও তার মিত্রদের জয়ী আসনের চেয়েও বেশি। ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল মূল বিরোধী দল। আর তাই অর্ধেকের বেশি আসনে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছিলেন। 

যদিও সরকার নিয়োজিত নির্বাচন কমিশন বলেছে, নির্বাচন ন্যায়সঙ্গত হয়েছে। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি ব্যাপক জালিয়াতি ও ভোটারদের দমিয়ে রাখার অভিযোগগুলো অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া উচিত। প্রেস থেকে বলা হয়েছে, দেশজুড়ে যখন নির্বাচন হয়েছে সরকারিভাবে তা ছিল উন্মুক্ত। তবে সাংবাদিকরা দেখতে পেয়েছেন, কিছু ব্যালটবাক্স সন্দেহজনকভাবে ব্যালটে পূর্ণ দেখা গেছে। আরো রিপোর্ট আছে যে, কিছু মানুষকে ভোট দেয়া থেকে বিরত রেখেছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বলা হয়েছে, মধ্যাহ্নভোজের জন্য ভোটকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। অথবা বলা হয়েছে ব্যালট শেষ হয়ে গিয়েছে। অনেক ভোটার বলেছেন, তাদের ভোট আগেই দেয়া হয়ে গেছে। বিষয়টিকে আরো খারাপ করতে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সুবিধা দিয়ে যাদের পাঠানোর কথা তারাসহ আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের ক্রেডেন্সিয়াল ও ভিসা অনুমোদনে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ সরকার। 

এ বছর আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডসহ এশিয়ায় সিরিজ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিশ্রুতি ও সম্মান তা প্রদর্শন করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ কাজটি শুরু করতে হবে বাংলাদেশ থেকে। 

এ বিষয়ে আপনার মনোযোগের জন্য ধন্যবাদ। সময়মতো এ বিষয়ে সাড়া দেবেন বলে আমরা প্রত্যাশায় রইলাম। 


  • সূত্র — মানবজমিন / ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৯। 

বাংলাদেশ নিয়ে পেন্টাগন শীর্ষ কমান্ডারের উদ্বেগ প্রকাশ

বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে মার্কিন সিনেটের আর্মড সার্ভিসেস কমিটির কংগ্রেশনাল শুনানিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার। তিনি ইউএস ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডার চিফ এডমিরাল ফিলিপস ডেভিডসন। প্রতিনিধি পরিষদের ৬ জন প্রভাবশালী আইনপ্রণেতার উদ্বেগ জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওকে একটি চিঠি লেখার কয়েক ঘন্টা পরেই শুনানিতে এমন উদ্বেগ প্রকাশ করেন ডেভিডসন। তিনি ওই শুনানিতে বলেন, বাংলাদেশের ৩০ শে ডিসেম্বরের নির্বাচন উদ্বেগজনক একটি প্রবণতার কথা বলে। এটা বলে যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার উদ্বেগজনক প্রবণতার দিকে ইঙ্গিত করে ওই নির্বাচন। একই সঙ্গে আতঙ্ক বেড়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে একটি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা পিটিআই। 

এতে বলা হয়, ডেভিডসন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাস দমনে, সহিংস উগ্রপন্থা দমনে, মানবিক সহযোগিতায় সমর্থন, দুর্যোগে ত্রাণ দেয়া, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ। 

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিষয়ক মন্ত্রণালয় পেন্টাগনের শীর্ষ এই কমান্ডার আরো বলেছেন, প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে কমপক্ষে ৭ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়ায় তাতে যে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, তার চাপ পড়েছে বাংলাদেশ সরকারের ওপর। 
  • মানবজমিন / ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৯। 

Sunday, February 10, 2019

ভিন্নমত ও প্রতিবাদ দমনের পদক

কামাল আহমেদ

ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে নিহত সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর মায়ের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে লুটিয়ে পড়ার ছবিটি দেখে অপরাধীরা ছাড়া আর সবারই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠার কথা। এর আগে ২০১৭ সালের নভেম্বরেও দিয়াজের মা ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে আমৃত্যু অনশনে বসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। হত্যার বিচারের আশ্বাসে তখন তিনি অনশন ভেঙেছিলেন। কিন্তু ২০১৬ সালের নভেম্বরের সেই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এখনো শেষ হয়নি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত একটি গোষ্ঠীর প্রকাশনায় হত্যায় অভিযুক্ত একজনের বাণী ছাপা হয়েছে। অর্থাৎ দলীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অভিযুক্ত ব্যক্তির রাজনৈতিক পুনর্বাসন অনেকটাই সাধিত হয়েছে।

বিচারপ্রার্থী দিয়াজের মা যখন দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে লুটিয়ে পড়েছেন, ঠিক তখনই ঢাকায় সুপ্রিম কোর্টের আঙিনায় অসহায় অজ্ঞাতনামাদের অবিচার থেকে মুক্তি চাওয়ার আর্তি। ধান বিক্রি করার টাকা খরচ করে পুলিশি হয়রানি থেকে রেহাই পেতে জামিনের জন্য দেশের সর্বোচ্চ আদালতে ধরনা দিয়ে বসে আছেন শত শত মানুষ। এঁদের অনেকেই হয়তো এর আগে কখনো ঢাকায় পা ফেলেননি। বছরের শুরু থেকে দেশের নানা প্রান্ত থেকে জামিনের আশায় ভিড় করছেন ৪ হাজারের বেশি গায়েবি মামলার আসামি শত শত মানুষ। এঁদের মধ্যে আছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, সত্তরোর্ধ্ব প্রায় চলনশক্তিহীন মানুষও, যাঁরা দলবাজির রাজনীতির ধারেকাছেও নেই। এ রকম গায়েবি মামলায় কতজন কারাগারে বন্দী আছেন, সেই হিসাব কারও কাছেই নেই। তবে মানবাধিকার সংগঠক সুলতানা কামাল বলেছেন, দেশের কারাগারগুলোতে বন্দীদের প্রতি তিনজনের দুজনই বিনা বিচারে আটক রয়েছেন। অবিচারের শিকার নির্দোষ জাহালমের তিন বছর কারাভোগের পর মুক্তিলাভের খবরের পটভূমিতে এসব বিনা বিচারের বন্দীর দুর্ভোগের বিষয়টি মোটেও উপেক্ষণীয় নয়।

ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই বিশ্ব গণমাধ্যমে বাংলাদেশ আবারও সংবাদ শিরোনামে ফিরে এসেছে। নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতার বিষয়টি নিয়ে জানুয়ারিজুড়ে নানা ধরনের বিচার-বিশ্লেষণের পর ফেব্রুয়ারির শুরুতে আলোচনায় এসেছে হারকিউলিস। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা কথিত ক্রসফায়ারের অভিযোগ কয়েক বছর ধরে বেড়েই চলেছে। এই পটভূমিতে ধর্ষণের অভিযোগে কয়েকজন সন্দেহভাজনের সাম্প্রতিক রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড এই আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এ রকম কয়েকটি শিরোনাম হচ্ছে: ‘হারকিউলিস ভিজিল্যান্টে কিলস্ সাসপেক্টেড রেপিস্টস ইন বাংলাদেশ’ (আল-জাজিরা, ৬ ফেব্রুয়ারি), ‘ডেথস অব অ্যাকিউজড রেপিস্টস ইন বাংলাদেশ টায়েড টু সাসপেক্টেড ভিজিল্যান্টে’ (ইউপিআই, ৬ ফেব্রুয়ারি), ‘ইন বাংলাদেশ, এ সিরিয়াল কিলার কলড হারকিউলিস ইজ টার্গেটিং অ্যালেজড রেপিস্টস’ (জি নিউজ, ৫ ফেব্রুয়ারি), ‘হারকিউলিস সাইনস ডেথ ওয়ারেন্টস অব অ্যালেজড রেপিস্টস ইন বাংলাদেশ’ (টিআরটি ওয়ার্ল্ড, ৫ ফেব্রুয়ারি)। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এসব সংবাদ শিরোনাম বাংলাদেশে আইনের শাসনের দুর্বলতার করুণ প্রতিফলন।

এই সপ্তাহেই সাড়ম্বরে পালিত হয়েছে পুলিশ সপ্তাহ। এ সময়ে পুলিশের প্রায় ৪০০ কর্মকর্তা পেশাগত কাজে কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য পদক ও প্রণোদনামূলক পুরস্কার পেয়েছেন। কেউ কেউ দ্বিতীয় বা তৃতীয়বারের মতো পুরস্কৃত হয়েছেন। যাঁরা পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে যোগ্য কেউ ছিলেন না, তা নয়। তবে অনেক পুরস্কারের ক্ষেত্রে কারণগুলো স্পষ্টতই গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের মূল্যবোধের পরিপন্থী। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী বাহিনীর কথিত সাফল্য ও ব্যর্থতার প্রকট বৈপরীত্যের প্রতিফলন আর কী হতে পারে? নিরীহ কাউকে হয়রানি না করতে পুলিশের প্রতি নির্দেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে গাছের ছায়ায় জামিনের অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলোর কানে কি পরিহাসের মতো শোনায়নি?

যাঁরা পদক পেয়েছেন তাঁদের কৃতিত্বের যেসব বিবরণ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে আছে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন ও কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ, কথিত ‘রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণামূলক’ সাক্ষাৎকারের জন্য (আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে) গ্রেপ্তারে ‘পেশাগত দক্ষতা’র স্বীকৃতি, ডিজিটাল মাধ্যমে কথিত অপপ্রচার বন্ধে সাফল্য ইত্যাদি। প্রতিবাদ-বিক্ষোভের বৈধ নাগরিক অধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা চর্চার বিরুদ্ধে মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ ও দমন-পীড়নের স্বীকৃতি দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের পদক দেওয়ার ঘটনা এক নতুন দৃষ্টান্ত। দৃশ্যত এর উদ্দেশ্য: ১. পুলিশকে দমনমূলক নীতি অনুসরণে উৎসাহ দেওয়া; ২. সরকারবিরোধী সব দল, গোষ্ঠী ও ব্যক্তির মধ্যে ভীতি ছড়ানো, যাতে কোনো ধরনের রাজনৈতিক বা সামাজিক আন্দোলন দানা বাঁধতে না পারে।

রাজনৈতিক দলগুলো যে প্রতিবাদ জানানোর শক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেছে, তাতে সন্দেহ নেই। এর ফলে নাগরিক সমাজে সৃষ্ট উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছে বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলেছে যে তারা উদ্বিগ্ন। কেননা, যেসব সাফল্যের জন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের পদক দেওয়া হয়েছে, সেসব ঘটনার প্রতিটির ক্ষেত্রেই পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘নিষ্ক্রিয়তা’, ‘পক্ষপাতিত্ব’ বা ‘অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের’ অভিযোগ সর্বজন বিদিত।

টিআইবি আরও বলেছে, পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরে শুদ্ধাচার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি চর্চা সব নাগরিকের নিরাপত্তা ও আইনের সমান সুযোগ লাভের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য। তাই শান্তি ও জনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ আইন লঙ্ঘনকারীকে বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে পুলিশ বাহিনীকে সর্বোচ্চ পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন সময় পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের যেসব অভিযোগ উঠেছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। এই বাহিনীর প্রতি জনগণের নির্ভরশীলতা প্রতিষ্ঠায় এই মুহূর্তে এটাই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত।

টিআইবির এই দাবি নতুন নয়। বরং পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য একটি আলাদা ও স্বাধীন তদন্ত সংস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি অনেক দিনের। পুলিশে যেসব সংস্কারের জন্য ২০০৯ সালে সরকার জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সঙ্গে সমঝোতা করেছিল, তাতে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের জন্য নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কথা ছিল। পুলিশ কমপ্লেইন্টস কমিশন বা পুলিশ কমিশন গঠিত হলে পুলিশের কর্তাব্যক্তিদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা কিছুটা খর্ব হবে বলে তাঁরা এ বিষয়ে ছাড় দিতে রাজি নন, এটা জানা কথা। কিন্তু রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা দুর্ভাগ্যজনক। 

গত এক দশকেও আমাদের রাজনীতিকেরা ওই সুপারিশটি বাস্তবায়নের পথে পা বাড়াননি। এর সম্ভাব্য ব্যাখ্যা পুলিশকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার ছাড়া আর কী হতে পারে? রাজনীতিকেরা এটা ভালোই জানেন যে এ রকম স্বাধীন ও নিরপেক্ষ জবাবদিহির ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হলে পুলিশকে দলীয় কাজে ব্যবহার করা কঠিন হয়ে পড়বে। ৩০ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে দলীয় স্বার্থে নজিরবিহীনভাবে পুলিশকে কাজে লাগানো অথবা নিষ্ক্রিয় করায় বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে। নির্বাচনের মাত্র এক মাসের মাথায় পুলিশ কর্তাদের পুরস্কারের বিষয়ে তাই প্রশ্ন ওঠা মোটেও অস্বাভাবিক নয়।

পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সদস্যদের বীরত্বপূর্ণ কাজ কিংবা জনস্বার্থমূলক ব্যতিক্রমী ভূমিকার স্বীকৃতি দেওয়ার রীতি সব দেশেই আছে। সাধারণত স্বাধীনতা দিবস বা জাতীয় দিবসগুলোতে এসব পদক দেওয়া হয়। সমাজ-সংস্কৃতির অগ্রযাত্রায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের যেভাবে সম্মান জানানো হয়, পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও তাঁদের দায়িত্ব পালনে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য এ ধরনের স্বীকৃতির ন্যায্য দাবিদার। কিন্তু জনমনে যদি এমন ধারণা হয় যে এই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক স্বার্থ, বিশেষত দলীয় বিবেচনার ছায়া পড়েছে, তাহলে তা বিতর্কের জন্ম দিতে বাধ্য। এবারের পুলিশ সপ্তাহে বিদেশে দূতাবাসে পদায়ন ও আলাদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার মতো বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দাবিগুলোও এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পুলিশের সাম্প্রতিক ভূমিকা ও তাদের পুরস্কার ও প্রণোদনার পদক্ষেপগুলো সেই বিতর্ক বাড়িয়েই দিয়েছে।

  • কামাল আহমেদ সাংবাদিক
  • প্রথম আলো/ ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

Tuesday, February 5, 2019

ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ৪৮ হাজার কোটি টাকা!

রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ এখন ৪৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ব্যাংকগুলোর নিজস্ব সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে মোট খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার ২২২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর আগে সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৮ হাজার ৩৪৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ কমেছে ১২৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। 

রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সর্বশেষ খেলাপি ঋণ পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ যাতে আর না বাড়ে সেজন্য আমরা একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি। এটি সফল হলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আর বাড়বে না। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলো নিজেরাও কর্মপরিকল্পনা নিচ্ছে। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে হাইকোর্টে একটি পৃথক বেঞ্চ গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটি নিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কাজ করছে। আমরা আশা করছি, অর্থবছর শেষে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমে একটি সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে। 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে ব্যাংকগুলোর প্রেরিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে একমাত্র জনতা ব্যাংক ছাড়া বাকি পাঁচটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে। আলোচ্য সময়ে জনতা ব্যাংকে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৩০৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এটি এর আগের প্রান্তিকের তুলনায় দুই হাজার ৮৬৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা বেশি। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। 

অন্য দিকে বাকি পাঁচটি ব্যাংকের মধ্যে গত ডিসেম্বর শেষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে এক হাজার ৫৭৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে সোনালী ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ১৭৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা, ডিসেম্বর শেষে এটি কমে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৬০০ কোটি ১৯ লাখ টাকা। 

একই সময়ে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে ৮৫৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে রূপালী ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল চার হাজার ৯৭০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, ডিসেম্বর শেষে এটি কমে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ১১৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা। 

গত ডিসেম্বর শেষে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে ৩৩৮ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ৮৯ কোটি টাকা, ডিসেম্বর শেষে এটি কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। 

আলোচ্য সময়ে বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে ২১১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল আট হাজার ৮২৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ডিসেম্বর শেষে এটি কমে দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৬১৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা। 

গত ডিসেম্বর শেষে ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ (বিডিবিএল)-এর খেলাপি ঋণ কমেছে ১৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৪৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা, ডিসেম্বর শেষে এটি কমে দাঁড়িয়েছে ৮৩২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। 

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, দেশের ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেক-ই হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর। গত বছর নভেম্বরের শেষদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ‘কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল’-এর বৈঠকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে (বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত) খেলাপি ঋণ (নন-পারফর্মিং লোন) বেড়ে যাওয়ায় তা দেশের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। 

দেশের ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৯ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। তবে অবলোপনকৃত ঋণ ধরলে তা দেড় লাখ কোটি টাকায় পৌঁছে যাবে। কারণ অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। যা কিনা ব্যাংকগুলো খেলাপি তালিকায় স্থান না দিয়ে অন্য হিসাবে রেখে দিয়েছে।
  • নয়াদিগন্ত/ ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৯।