Search

Sunday, October 27, 2019

ঝুঁকিতে ব্যাংক, সিদ্ধান্ত নেন প্রভাবশালীরা

শওকত হোসেন

বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার প্রবণতার শিকড় অত্যন্ত গভীরে। প্রভাবশালী, ওপর মহলে ভালো যোগাযোগ আছে এবং ধনী, এমন কিছু ব্যবসায়ী ঋণ ফেরত দেওয়ার কোনো তাগিদই অনুভব করেন না। এমনকি বাংলাদেশে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও এখন নিচ্ছেন প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান এসব ঋণগ্রাহকেরা।

এসব মন্তব্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)। বাংলাদেশের আর্থিক খাত বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি বলেছে, এখানে খেলাপি আড়াল করে রাখা আছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি দুর্বল, ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের আচরণ বেপরোয়া। নিয়ম ভাঙলে শাস্তিও পান না তাঁরা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত অত্যন্ত ভঙ্গুর অবস্থায় এবং বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে।

আন্তর্জাতিক এই ঋণ সংস্থা ছয় মাস ধরে বাংলাদেশের আর্থিক খাত পর্যালোচনা করে সরকারকে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। সরকারের আমন্ত্রণেই আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা পর্যালোচনা (এফএসএসআর) করতে দুই দফায় বাংলাদেশে এসেছিল। প্রথম আসে গত এপ্রিলে, এরপর গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে। পর্যালোচনা শেষে সংস্থাটি ৪৩টি সুপারিশ করেছে। ৬৮ পৃষ্ঠার এই রিপোর্টে দেশের ব্যাংক খাতের নানা অব্যবস্থা ও সংকটের খোলামেলা আলোচনা করা হয়েছে।

লুকানো খেলাপি ঋণ

খেলাপি ঋণ নিয়ে দেশের ব্যাংক খাতের ভয়াবহ একটি চিত্রও তুলে এনেছে আইএমএফ। তারা বলেছে, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করা হয়, প্রকৃত খেলাপি ঋণ তার তুলনায় অনেক বেশি। প্রকাশিত খেলাপি ঋণের তথ্য দেখলে মনে হবে তা খুব বেশি নয়। কিন্তু প্রকৃত পরিস্থিতি অনেক বেশি খারাপ।

যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০১৮ সাল শেষে খেলাপি ঋণের হার মাত্র ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু আইএমএফ মনে করে, এর সঙ্গে যুক্ত করা উচিত আরও কয়েকটি বিষয়। যেমন আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে মোট ঋণের ৪ দশমিক ১ শতাংশকে খেলাপি ঋণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না, যা অবশ্যই করা উচিত। আবার বিশেষ নির্দেশিত হিসাব বা স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট—এই নামেও রাখা আছে মোট ঋণের ৫ দশমিক ৬ শতাংশ অর্থ। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে অনাপত্তি সার্টিফিকেট (এনওসি) দিয়ে রেখেছে। এ ধরনের ঋণের হার মোট ঋণের ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। আইএমএফ মনে করে, প্রকৃত চিত্র বুঝতে এই তিন ধরনের খেলাপি ঋণ অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

আইএমএফ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের তথ্য নিয়ে মন্তব্য করেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে গত জুন পর্যন্ত সময়ের খেলাপি ঋণের চিত্র পাওয়া যায়। সরকারি হিসাবে এ সময়ে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ৬৭৫ জন ঋণগ্রহীতা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে রেখেছেন। ফলে ঋণখেলাপি হিসেবে তাঁদের নাম বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) উল্লেখ করা হয় না। এ রকম ঋণের পরিমাণ এখন ৭৯ হাজার ২৪২ কোটি টাকা।

  • দুই দফা বাংলাদেশে এসে আইএমএফের প্রতিনিধিদল ৬৮ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন দিয়েছে
  • সেখানে সুপারিশ আছে ৪৩টি
  • লুকানো খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি
  • কমাতে হবে ব্যাংক পরিচালকের সংখ্যা
  • ভাঙতে হবে পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের বেপরোয়া আচরণের চক্র


বিভিন্ন সময়ে বিশেষ ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়। সরকারের নির্দেশে বারবার ঋণ পুনঃ তফসিল করার উদাহরণও আছে। ২০১৫ সাল থেকে শুরু হয়েছে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণের পুনর্গঠন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এ রকম বিশেষ নির্দেশিত হিসাবে থাকা ঋণের পরিমাণ ২৭ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিয়ে গত জুন পর্যন্ত আরও ২১ হাজার ৩০৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করে দিয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক।

এভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হলে দেশে এখন খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। আইএমএফ এসব ঋণ অন্তর্ভুক্ত করেই খেলাপি ঋণের হিসাব করার পক্ষে।

এদিকে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা বদল করা হয়। ২০১২ সাল থেকে অনুসরণ করা আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী, ৩ মাস ঋণ অনাদায়ি থাকলে তাকে নিম্নমান বলা হতো। নতুন নিয়মে তা ৬ মাস করা হয়েছে। ৬ মাসের অনাদায়ি ঋণকে বলা হতো সন্দেহজনক, এখন তা ৯ মাস করা হয়েছে। সবশেষে ৯ মাসের সময় ঋণ অনাদায়ি হলে তাকে বলা হতো মন্দ ঋণ, এখন তা ১২ মাস করা হয়েছে।

আইএমএফের সুপারিশ হচ্ছে, ঋণ ৯০ দিন অনাদায়ি হলেই তাকে শ্রেণিবিন্যাস করে খেলাপি ঋণ করতে হবে। এটাই আন্তর্জাতিক রীতি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আইএমএফ যা বলছে, ঠিক সে কথাগুলোই দেশের অর্থনীতিবিদেরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন। এসব কথা যে সত্যি, তা-ই প্রমাণিত হলো। এখন প্রয়োজন প্রতিকার। এটা ঠিক যে খেলাপি ঋণ বিভিন্নভাবে লুকিয়ে রাখা হয়। এসব দেখেও না দেখার ভান করা হয়। দেশে প্রকৃত খেলাপি ঋণ অনেক বেশি।

প্রভাবশালীরাই সিদ্ধান্তদাতা

আইএমএফ তাদের প্রতিবেদনে প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের ক্ষমতার একটি উদাহরণ উল্লেখ করেছে। যেমন গত আগস্টেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ১১ বৃহৎ ঋণগ্রহীতার ১৫ হাজার ১৮০ কোটি টাকার ঋণ নবায়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়। চার বছর আগে, ২০১৫ সালে এই ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, এই বিশেষ সুবিধা নিয়ে কেউ খেলাপি হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তারপরও এসব ঋণের বড় অংশ আবার খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে এবার তারা কঠোর হবে, ঋণ পুনর্গঠনের পরও যাঁরা আবার খেলাপি হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দেউলিয়া আইন-১৯৯৭ প্রয়োগ করতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে বলা হবে, যাতে প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতারা বুঝতে পারেন, বারবার খেলাপি হলে আর পার পাওয়া যাবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন করে নবায়নের সুযোগ দিয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতারাই এখানে আর্থিক খাতের সিদ্ধান্ত নেন। আইএমএফের মন্তব্য হচ্ছে, ঋণখেলাপিদের প্রতি এ ধরনের সহৃদয়তা দেশের সামগ্রিক ঋণ শৃঙ্খলাকেই বিনষ্ট করে।

আইএমএফ আরও বলেছে, এ দেশে একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঋণ ফেরত না দেওয়ার প্রবণতা কাজ করে। প্রভাবশালী ও ধনী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ওপর মহলের যোগাযোগ ভালো এবং তাঁরা ঋণ ফেরত দেওয়ার তাগিদই অনুভব করেন না। কারণ, তাঁরা জানেন, তাঁদের কিছু হবে না। যদিও ক্ষুদ্র ও দরিদ্রদের মধ্যে ঋণ ফেরত দেওয়ার হার অনেক বেশি। সংস্থাটি বলেছে, এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে অপরাধী ঋণগ্রহীতারা অর্থ ফেরত দিতে বাধ্য হন। যদিও বাংলাদেশে এর উল্টোটা দেখা যাচ্ছে, তাঁরা ঋণ ফেরত না দিতে বরং উৎসাহ পাচ্ছেন।

সামগ্রিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা দৃশ্যমান, কে আর্থিক খাতের সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছে। এটা সবাই জানে। এ জন্য সব সুবিধা যাচ্ছে খারাপ গ্রাহকদের পক্ষে। এতে ভালো ও ছোট গ্রাহকেরা উৎসাহ হারাচ্ছেন। তাঁদের জন্য কোনো প্রণোদনাও নেই। আমি বলব, আর্থিক খাতে এখন “বিকৃত প্রণোদনা” দেওয়া হচ্ছে। এসব কারণেই আর্থিক খাতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ থেকে বের হতে হবে।’

ক্ষমতা প্রয়োগ করে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক

আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশে আর্থিক খাতের বড় দুর্বলতা হচ্ছে, বিদ্যমান নিয়মকানুন অনুসরণ করা হয় না। আর যখন ব্যাংক এসব মানে না, তখন তা নজরদারিও ঠিকঠাক করা হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে না। আবার ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপকেরা এমন অনেক কাজ করেন, তাতে তাঁদের পদ থাকারই কথা নয়। অথচ ক্ষমতার অপব্যবহার বা দায়িত্বে অবহেলার জন্য অবশ্যই পরিচালক পদ থেকে নিষিদ্ধ করা উচিত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে বাকিদের কাছে সেটিই হতো একটি জোরালো সংকেত। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এখানে ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের বেপরোয়া আচরণের চক্র অবশ্যই ভাঙতে হবে।

আইএমএফ মনে করে, বাংলাদেশ ব্যাংকের যতখানি স্বাধীনতা থাকা উচিত, তা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা বাড়াতে আইএমএফ ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৫৮ ধারা সংশোধনের সুপারিশ করেছে। এ ধারায় নির্দেশনা পালনে একাধিকবার ব্যর্থ বা আমানতকারীদের ক্ষতি করছে, এমন ব্যাংককে সরকার অধিগ্রহণ, সাময়িকভাবে বন্ধ ও অবসায়ন করতে পারে। আইএমএফ এসব ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়ার পক্ষে।

আইএমএফ ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারারও সংশোধন চেয়েছে। এ ধারায় বাংলাদেশ ব্যাংক সরকার কর্তৃক মনোনীত বা নিযুক্ত কোনো চেয়ারম্যান বা পরিচালককে অপসারণ করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক কেবল এ নিয়ে সরকারের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠাতে পারে। প্রসঙ্গত, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির সময় পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার জন্য ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক এই ধারা অনুযায়ী সরকারের কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল। কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি।

এ অবস্থায় আইএমএফ বলেছে, সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সরকারি ব্যাংকগুলোকে পুরোপুরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারির আওতায় আনা হবে। সুতরাং তারা সরকারি ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংককে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে।

আর নতুন ব্যাংক নয়

আইএমএফ মনে করে, বাংলাদেশে আর নতুন ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়া ঠিক হবে না। নতুন যেসব ব্যাংক এসেছে, তারা কেউ কার্যকর প্রতিযোগিতা গড়ে তুলতে পারেনি। তারা নতুন তহবিলও আকৃষ্ট করতে পারছে না। বরং উচ্চ ঝুঁকির বিনিয়োগ করছে। এমনিতে অন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেশি, কিন্তু পরিচালনার দক্ষতায় অনেক পিছিয়ে। ব্যাংক খাতের জন্য দক্ষ ও ভালো বিনিয়োগকারী যদি থেকেই থাকে, তবে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা না করে তারা বিদ্যমান ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ করতে পারে।

উল্লেখ্য, দেশে এখন ব্যাংকের সংখ্যা ৫৯। এর বাইরে আরও তিনটি কার্যক্রম শুরুর প্রক্রিয়ায় আছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালের পর আওয়ামী লীগ সরকার ১৪টি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে। এর অনেকগুলোই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। এর আগে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আরও ১৩টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। এর বাইরে এরশাদের আমলে ৯টি এবং বিএনপির আমলে (১৯৯১-৯৬) আরও ৮টি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। আর বিএনপির পরের মেয়াদে চাপ থাকলেও নতুন ব্যাংক দেওয়া হয়নি।

পরিচালকের সংখ্যা কমাতে হবে

বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা যেমন বেশি, পরিচালকের সংখ্যাও বেশি। বর্তমানে প্রতিটি ব্যাংকে পরিচালকের সংখ্যা ২০। আইএমএফ মনে করে, ব্যাংকের সুশাসনের জন্য এই সংখ্যা অনেক বেশি। আইএমএফ স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যাও তিনজন থেকে বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি নিরীক্ষা কমিটি ও ঝুঁকি নিরূপণ কমিটি যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সে ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। এ ছাড়াও তারা আগামী ৫ বছরের মধ্যে ব্যাংকের ন্যূনতম মূলধন ৪০০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬০০ কোটি টাকা করতে বলেছে।

ঝুঁকির মধ্যে ব্যাংক খাত

আইএমএফ মনে করে, বাংলাদেশ সন্ত্রাসী অর্থায়নসহ টাকার সব ধরনের অবৈধ ব্যবহার বা মানি লন্ডারিংয়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে আছে। এসব কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে বাংলাদেশের অগ্রগতি খুবই কম। বিশেষ করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারি ব্যাংকগুলো পিছিয়ে আছে। ফলে বাংলাদেশের পুরো আর্থিক খাত সুনামহানির ঝুঁকির মধ্যে আছে। সুনামজনিত সংকট দেখা দিলে বিদেশের অন্যান্য ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন এবং নিউইয়র্কের বাজারে ঢুকতে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর অসুবিধা হতে পারে। বিশেষ করে গত ১ সেপ্টেম্বর চীন বাংলাদেশের ৫টি ব্যাংককে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। এটা হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি সতর্ক বার্তা, যাতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে, নইলে বিপদে পড়বে বাংলাদেশ।

সবশেষে আইএমএফ জ্বালানি খাতে অনেক বেশি পরিমাণে ঋণ দেওয়া হচ্ছে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি তাদের সুপারিশ হচ্ছে, কোনো একক ঋণগ্রহীতা বা গ্রুপকে মোট মূলধনের ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার যে সীমারেখা, তা কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা প্রয়োজন। কেননা, এই ব্যবস্থায় মাত্র তিনজন বড় ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে পুরো ব্যাংকই দেউলিয়া হয়ে যাবে।

সামগ্রিক বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, আইএমএফ যা বলছে, তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি না হয়ে দিন দিন শুধু খারাপই হচ্ছে। প্রভাবশালীরা ব্যাংকিং খাতকে তাঁদের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করছেন। নীতিনির্ধারণী পরিবর্তনও আনছেন। বাজার ব্যবস্থার পরিপন্থী অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সুদহারে ৬ ও ৯ শতাংশ, ২ শতাংশ জমা দিয়ে ঋণ পুনঃ তফসিল করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। গত ১০ বছরে ব্যাংক খাতের জন্য আসলে সহায়ক কোনো ভূমিকাই নেওয়া হয়নি।

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, আইন পরিবর্তন করে ব্যাংকগুলোকে একক পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আবার একটি পরিবার বেশ কয়টি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানির নামে বড় অঙ্কের ঋণ কয়েকজন গ্রাহকের কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতের ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে।

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ২৭ অক্টোবর ২০১৯

বাংলাদেশের সর্বনাশ হয়ে গেছে

হাসান ফেরদৌস

দুর্নীতি এখন বাংলাদেশের সর্বত্র। পত্রিকার পাতা খুললেই কোটি কোটি টাকা লোপাট হওয়ার খবর। প্রতিটি ক্ষেত্রেই অপরাধের সঙ্গে রয়েছে ক্ষমতার অতি-নিকট সম্পর্ক। টাকা লোপাটের এই ব্যাপারটা সর্বনাশের কারণ নয়। ব্যাপারটাকে যে আমরা স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছি, সেটাই আমার চোখে সর্বনাশের বড় কারণ।

কয়েক সপ্তাহ ধরে পত্রপত্রিকায় ভয়াবহ সব খবর পড়েছি। পুলিশের প্রহরায়, প্রশাসনের নাকের ডগায় হাজার কোটি টাকার ক্যাসিনো ব্যবসা চলেছে বছরের পর বছর। তার বখরা পেয়েছে সরকারি নেতা থেকে পুলিশের বড় কর্তা। জুয়ার টাকা কাছে রাখতে নেই, পাচার করে দিয়েছেন বিদেশে।

এসব খবর বাসি হতে না–হতেই ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান বললেন, ক্রিকেট খেলাও আসলে একরকমের জুয়া খেলা। যে খেলা রুদ্ধশ্বাসে দেখতে দেখতে আমরা নিজ দলের জয়ের জন্য প্রার্থনা করি, তার সবই নাকি পাতানো। কে জিতবে, কে হারবে; সেসব আগেই ঠিক করা থাকে। ক্যাসিনো ব্যবসার চেয়ে কম রমরমা নয় ক্রিকেট–বাণিজ্য। হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয় এই খেলা নিয়ে। ক্যাসিনো ব্যবসায় যেমন প্রশাসনের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সম্রাট সাহেবরা জুয়ার টাকা ঘরে তোলেন, ক্রিকেটেও বাণিজ্যের প্রধান অংশীদার ক্রিকেট পরিচালনা পরিষদ। এই অভিযোগ তুলেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক প্রধান সাবের হোসেন চৌধুরী। তিনি টুইটারে মন্তব্য করেছেন, বিশ্বে বিসিবি একমাত্র ক্রিকেট বোর্ড, যারা ম্যাচ ফিক্সিংকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে।

এই খবর পড়ে কেউ কি বিস্মিত হয়েছেন? পত্রপত্রিকায় ব্যাপারটা তেমন পাত্তাই পায়নি। আমি এ নিয়ে যত লোকের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁদের প্রত্যেকের বক্তব্য, এতে অবাক হওয়ার কী আছে? ক্রিকেট বোর্ডের কেউ যে ধোয়া তুলসী পাতা নয়, সে তো জানা কথা। অন্য কথায়, এমন ভয়াবহ কথা শোনার পরও আমাদের মাথায় আগুন ধরেনি, কারণ, ব্যাপারটা আমাদের কাছে এতটাই ‘নরমাল’।

এটাই হলো আমাদের সর্বনাশের প্রধান কারণ। অপরাধের প্রতিবাদ না করে তা যদি মেনে নেওয়া হয়, তাহলে অপরাধ শুধু বাড়েই।

দুর্নীতি মানে শুধু টাকা এহাত-ওহাত করা নয়। দুর্নীতির মানে ক্ষমতার অপব্যবহার। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাংলাদেশে কিছু লোক হাজার কোটি টাকার ব্যাংকঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না। তাঁদের হাত দিয়েই হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ঋণ গাফিলতি ও অর্থ পাচারের ফলে ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, নগদ টাকার অভাবে ‘লিকুইডিটি’–এর সমস্যাও প্রকট হয়ে উঠছে। একইভাবে ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় ভয়াবহ মাদক ব্যবসা করে দেশের মানুষকে পঙ্গু করে দেওয়া হচ্ছে। কোনো অর্থপূর্ণ প্রতিবাদ নেই, কোনো কার্যকর প্রতিকার নেই।

কারা এই সব কাজে জড়িত, তা খুব ভালো করে জানা। ক্যাসিনো ব্যবসার ক্ষেত্রেই তো দেখেছি, সবকিছু ঘটছে পুলিশ প্রহরায়। কিন্তু এদের কারও বিরুদ্ধে কুটোটাও তোলা যাবে না। দু-চারটি ছোট মাছ হয়তো জালে ধরা পড়বে, ধরা পড়ছেও, কিন্তু রাঘববোয়ালরা ঠিকই জলকেলি করে বেড়াবেন। মুখে তাঁদের নাম নেওয়াও যেন অপরাধ, পত্রিকার খবর পড়ে সে কথাই মনে হয়। সবাই বলছে ‘গডফাদার’দের কথা, কিন্তু কারা এই গডফাদার, তাঁদের নাম আকারে-ইঙ্গিতে বলতেও আপত্তি।

কে বলবে এই দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে!

ক্ষমতার অপব্যবহার এখন কতটা সর্বব্যাপী ও নির্লজ্জ, তার সর্বশেষ প্রমাণ দিয়েছেন নরসিংদী থেকে নির্বাচিত সাংসদ তামান্না নুসরাত বুবলি।

তিনি ঢাকায়, অথচ তাঁর হয়ে নরসিংদীতে পরপর আটটি পরীক্ষা দিতে বসলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন আট নারী। আইন–কানুন বা নীতি-নিয়মের ব্যাপারে সম্পূর্ণ বেপরোয়া হলেই মানুষ এমন কাজ করতে পারে। বাংলাদেশে এমন ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে, এত ঘন ঘন ঘটছে যে আমরা প্রায় অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছি। পত্রিকায় এই খবর পড়ে বলেছি, এমন কাজ বাংলাদেশেই সম্ভব। কিন্তু কেউ ক্রোধে ফেটে পড়েছি, তা মনে হয় না।

অথচ কোথায় কে ফেসবুকে বানোয়াট কথা বলল, তা নিয়ে গত সপ্তাহে ভোলায় চার–চারটা লাশ পড়ে গেল। রাজনীতিক ও প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের ছাতার নিচে থেকে একদল লোক দেশটাকে দেউলিয়া করে দিচ্ছে, তা নিয়ে বিক্ষোভ নেই, অর্থপূর্ণ প্রতিবাদ নেই, তার কারণ কি এই যে এতে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই? আমাদের অনুভূতি এতটাই ভোঁতা হয়ে গেছে?

এই দুর্নীতির সংস্কৃতির কেন্দ্রে রয়েছে ক্ষমতা ও অর্থের নৈকট্য। যারা ক্ষমতাহীন ও দুর্বল, দুর্নীতি থেকে ফায়দা লোটার সুযোগ তাদের নেই। দুর্নীতি এখন একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার, যার সঙ্গে রাজনীতিক থেকে পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন থেকে আদালত পর্যন্ত কোনো না কোনোভাবে জড়িত। ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষের পক্ষে এই ব্যবস্থার সাক্ষী ও শিকার হওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই।

এই অপরাধের সংস্কৃতি এক দিনে সৃষ্টি হয়নি, এক দিনে তা শেষও হবে না। কিন্তু অবস্থা বদলাতে হলে তা কোথাও না কোথাও শুরু করতে হবে।

আমরা যদি এই কথায় সম্মত হই যে ক্ষমতা ও অর্থের নৈকট্যের কারণেই দুর্নীতি, তাহলে লক্ষ্য হওয়া উচিত এই দুইকে বিযুক্ত করা। ব্যাপারটা সহজ নয়, আমাদের কর্তাব্যক্তিরা আলুটা-মুলোটা-মার্সিডিজটা হাতাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আর তা করতে গিয়ে ক্যাসিনো ব্যবসা দেখেও দেখেন না, ম্যাচ ফিক্সিং হচ্ছে জেনেও না জানার ভান করেন, টাকা পাচার হচ্ছে জেনেও সে পাচারের ফাঁকফোকর খোলা রাখেন। ফলে মধু থেকে মৌমাছিকে দূরে রাখা যাবে না।

আমাদের দুর্নীতির সংস্কৃতির একটি প্রধান কারণ রাজনীতিতে অর্থের অনুপ্রবেশ। রাজনীতি শুধু ক্ষমতারই উৎস নয়, দুর্নীতিরও। বাংলাদেশে এখন রাজনীতি মানে নির্বাচনের রাজনীতি। আর এই নির্বাচনী রাজনীতির জোগানদাতা হলো অর্থ। বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, অর্থের ভূমিকা কমানোর একটা পথ নির্বাচনী রাজনীতিতে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা যাবে, তার সীমা বেঁধে দেওয়া ও রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে নির্বাচন পরিচালনা। পৃথিবীর অনেক দেশেই এই কথা মাথায় রেখে নতুন নির্বাচনী নীতিমালা তৈরি হয়েছে। শুধু অর্থের দাপটেই সৎ ও যোগ্য লোক রাজনীতিতে জায়গা পায় না। অর্থের দাপট কমানো গেলে সৎ মানুষেরা রাজনীতিতে আসার সুযোগ পাবে, আমাদের নষ্ট সংস্কৃতির চেহারাটাই বদলে যাবে। বাংলাদেশের সর্বনাশ ঠেকানোর এটা একটা সম্ভাব্য পথ।

এই কাজ করতে হলে বিড়ালের গলায় যে ঘণ্টা পরাতে হবে, সে কাজটি কে করবে, তা আমি জানি না। তবে তার সম্ভাব্য উত্তর হিসেবে আমি বঙ্গবন্ধুর জীবনের একটা ঘটনা উল্লেখ করছি। সেটা ১৯৫৭ সাল, আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেছেন। সে সময় তাঁর একটি প্রধান দায়িত্ব ছিল দলীয় কার্য পরিচালনার জন্য অর্থ সংগ্রহ। ২৬ সেপ্টেম্বর নিজের দলীয় কার্যকলাপ নিয়ে তাঁর কথা হয় ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল উইলিয়াম এল এস উইলিয়ামসের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেন, মন্ত্রী হিসেবে দলের জন্য অর্থ চাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। কাজটা অশোভন হতো। তিনি বলেন, ‘কিন্তু এখন আমি নিজ দলের জন্য তহবিল গড়ছি। দলীয় প্রত্যেক মন্ত্রীর জন্য চাঁদা ধার্য করা হয়েছে মাসিক ১০০ টাকা, আর প্রতি সাংসদের জন্য ৪ টাকা।’

মার্কিন সরকারের অবমুক্ত দলিল খুঁজলে আপনারাও এই তথ্য পেয়ে যাবেন।

  • হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ২৭ অক্টোবর ২০১৯

Monday, October 21, 2019

ভেঙে পড়ছে কি সবকিছু?

রুমিন ফারহানা
‘শেখ হাসিনা দুর্নীতিবাজ লুটেরাদের আড়াল করে যতই শুদ্ধি অভিযান চালান তাতে কিছুই হবে না। ক্যাসিনো মালিকদের ধরা হচ্ছে, দুর্নীতিবাজদের ধরা হচ্ছে, কিন্তু দুর্নীতির আসল জায়গা নির্বিঘ্নে আছে। সেই দুর্নীতিবাজদের বিচার কবে হবে, তাদের সাজা কবে হবে, তাদের সম্পদ কবে বাজেয়াপ্ত হবে’–কথাগুলো বলেছেন ১৪ দলের শরিক বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন। মহাজোটের একজন প্রভাবশালী শরিক দলের শীর্ষনেতা, সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান সংসদের একজন সদস্য যখন এই প্রশ্নগুলো তোলেন, তখন সঙ্গত কারণেই সাধারণ মানুষের মনে আরও হাজারো প্রশ্নের জন্ম দেয়।

১) শুদ্ধি অভিযান কি শেষ?
২) শুদ্ধি অভিযান কি শুধু ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান ছিল?
৩) শুদ্ধি অভিযান কি যুবলীগের কেবল  তৃতীয় বা চতুর্থ পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে ছিল?
৪) শুদ্ধি অভিযান কি কাউকে বাঁচানোর জন্য কিংবা বিশেষ কোনও ঘটনা এড়ানোর জন্য সরকারের একটি সাময়িক পদক্ষেপ?
৫) ১০ বছর ধরে সর্বক্ষেত্রে অবিরাম লুট করে চলা এই সরকার কেন হঠাৎ শুদ্ধি অভিযানে নামলো?
৬) ক্যাসিনো ছাড়া কি দেশে আর কোনও দুর্নীতি নেই?
৭) দুর্নীতির সঙ্গে কি এমপি, মন্ত্রী কিংবা প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের কেউ জড়িত নেই?
৮) যদি জড়িত থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে?

এসব নানা প্রশ্ন ঘুরছে মানুষের মনে। ক্ষমতায় টানা ১০ বছর থাকার পর হঠাৎ করেই যেন এ সরকারের মনে হলো দেশে ব্যাপক দুর্নীতি চলছে, যা নির্মূল করা দরকার। অঙ্গসংগঠনগুলোর লাগাম টানা জরুরি।  

ছাত্রলীগের মহাক্ষমতাধর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যখন ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অপরাধের ঐতিহ্য বজায় রেখে কাজ করে চলছিল, তখন হঠাৎ করেই বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো তাদের সরিয়ে দেওয়া হলো। বহিষ্কারের পর জানা গেলো তারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামো নির্মাণের প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে তাদের ‘ন্যায্য পাওনা’ ৮৬ কোটি টাকা দাবি করেছিল। এরইমধ্যে আরও জানা গেলো বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ ‘ঈদ সালামি’ বাবদ ইতোমধ্যেই ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে নিয়েছিল। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির ক্ষেত্রে এগুলো তো বৃহৎ চিত্রের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ যা প্রকাশিত হয়েছে। শুধু দুর্নীতির কাহিনি নয়, তাদের প্রতাপ, দম্ভ, স্বেচ্ছাচারিতা সবকিছুই ছিল লাগামছাড়া। এই যেমন কিছুদিন আগে ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার পুরো রাস্তাজুড়ে ছিল ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শোভনের হাসিমুখের পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন। অবাক হয়েছিলাম দেখে, কারণ এলাকার এমপি ছাড়া এ ধরনের প্রচারণা দেখা যায় না। আর এমপির প্রচারণাও তার নিজ এলাকায় সীমাবদ্ধ। পরে বুঝলাম, শোভন এই পথ দিয়ে সিলেট গিয়ে পুরো পথকেই ধন্য করে গেছেন। নেতাকর্মীরাও এতটাই ধন্য হয়েছেন যে, আবেগের চাপে তাকে বিদায় দেওয়ার সময় সিলেট বিমানবন্দরের নিরাপত্তা এলাকা পার হয়ে বিমানের দরজা পর্যন্ত ছুটে গেছেন। 

এমনই এক সময়ে প্রধানমন্ত্রী দলীয় এক সভায় বলেই ফেললেন, ‘ছাত্রলীগকে ধরেছি, এবার যুবলীগকে ধরবো’। আর যায় কোথায়? পরদিন থেকেই পুলিশ, র‍্যাব, প্রশাসন সব ঝাঁপিয়ে পড়লো যুবলীগ এবং আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে দেশে বহু বছর ধরে চলে আসা ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া এই অভিযানে দেখা গেলো দেশে ২২টি ক্লাব, ৫টি বার, ৮ নেতার বাসা ও প্রতিষ্ঠানে চলা ক্যাসিনো আর যুবলীগের গুটিকয় নেতা বাদে আর কোনও অপরাধ বা অপরাধী নেই। তাহলে বরং অভিযানটির নাম শুদ্ধি অভিযান না দিয়ে যুবলীগের কতিপয় নেতার বিরুদ্ধে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান দিলেই বেশি শুদ্ধ হতো। 

এমনকি এটা একটা সত্যিকারের ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানও নয়। যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুকের বিদেশ গমনে নিষেধ আর গণভবনে প্রবেশ বন্ধ করাই প্রমাণ করে এই অপকর্মে তার সংশ্লিষ্টতা। অথচ তাকে আইনের আওতায় আনা হয়নি। একইভাবে যে র‍্যাব, পুলিশ, প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহায়তায় এই ব্যবসা এতদিন ধরে চললো, তারাই বা কোথায়। বিষয়টি তো কেবল পুলিশ প্রশাসন নয়, এই টাকার ভাগ গেছে দলের বহু ওপর পর্যন্ত। সম্রাটের স্ত্রী তো গণমাধ্যমকে পরিষ্কার বলেছেন, তার টাকায় দল চলতো। যুবলীগের ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কিছু নেতা ইতোমধ্যেই পুলিশ প্রশাসনের হেফাজতে আছে, তাই তাদের কাছ থেকে আরও বিস্তারিত জানা এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া খুবই সহজ। 

একটু মনে করিয়ে দেই, অভিযান শুরু হওয়ার পরপরই প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমরা আগে থেকেই ব্যবস্থা নিচ্ছি, যে ১/১১-এর মতো কোনও ঘটনা দেশে আর ঘটতে না পারে। আমি আপনাদের বলতে পারি, দেশে ১/১১-এর মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তির কোনও সুযোগ নেই’। ১/১১-এর বিষয়ে অতীতেও বহুবার কথা হয়েছে। প্রতিবারই প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের কথা স্মরণ করিয়ে তীব্র কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন দেশে ১/১১ করার আর কোনও সুযোগ নেই। যেখানে সংবিধানের ৭(ক) ধারাই এই ধরনের উদ্যোগের শাস্তি মৃত্যদণ্ড রেখেছে সেখানে ১/১১-এর রোধ করতে শুদ্ধি অভিযানের মতো পদক্ষেপের সাহায্য কেন নিতে হয়? 

প্রশ্নগুলো উঠছে কারণ দীর্ঘদিন যারা সরকারের কাছ থেকে পাওয়া নানা সুবিধার বিনিময়ে সরকারের সকল অপকর্মে নীরব ছিল তাদেরই একজন রাশেদ খান মেনন সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমিসহ যারা নির্বাচিত হয়েছি, আমাদের দেশের কোনও জনগণ ভোট দেয়নি। ভোটাররা কেউ ভোটকেন্দ্রে আসতে পারেনি। বিগত জাতীয়, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কোথাও ভোট দিতে পারেনি দেশের মানুষ। আজ দেশের ভোটাধিকার হরণ করেছে সরকার। [...] উন্নয়নের নামে দেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছ।[...] উন্নয়নের নামে আজ দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে সরকার, তাই কেউ মুখ খুলে মত প্রকাশ করতে পারে না।’

এই কথা বলার একদিন পরেই দেখলাম, পত্রিকায় এসেছে সম্রাট ও খালেদের দেওয়া নামের তালিকায় আছে মেননের নাম। যিনি খালেদের কাছ থেকে প্রতি মাসে ৪ লাখ টাকা চাঁদা নিতেন এবং সম্রাটের কাছ থেকেও অর্থ নিতেন। এমনকি প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ বাড়ানোর জন্যও নাকি তিনি চাপ দিচ্ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।  

একই রকম সুর আমরা শুনেছি সরকারদলীয় প্রভাবশালী সাংসদ এবং শেখ পরিবারের সন্তান শেখ ফজলে নূর তাপসের মুখে। তিনি একসঙ্গে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন তুলেছেন। সম্রাট যখন গ্রেফতার হননি তখন তাপস প্রশ্ন করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরও কেন সম্রাটকে গ্রেফতার করা হয়নি? কাকে বাঁচানোর জন্য? বেসিক ব্যাংকের লুটপাটের মূলহোতা আব্দুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আজও  কেন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি? এ কারণে তিনি দুদক চেয়ারম্যানের পদত্যাগও দাবি করেছেন। একইসঙ্গে তিনি প্রশ্ন রাখেন, মশা মারার অর্থ কাদের পকেটে গেছে, কাদের পকেটে যায়? তিনি যোগ করেন, গণপূর্তের বহুল আলোচিত ‘বালিশ প্রকল্পের’ টাকা ভাগাভাগির পাঁয়তারা করা হয়। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী আবার বলেন, দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলে এই অভিযানে দল ও পরিবারের কেউ পার পাবে না। 

কথায় বলে—‘যত গর্জে তত বর্ষে না’। এই শুদ্ধি অভিযানকে যদি বর্ষণের সঙ্গেও তুলনা করা হয়, তাহলেও এই অভিযানকে বাস্তবের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যায়িত করা হয়। এ ছিল নিছক পর্বতের মূষিক প্রসব। দেশে ব্যাংক, শেয়ারবাজার, মেগা প্রকল্প থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে গত এক দশকে। বিভিন্ন সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হলেও সেটা সরকার প্রকাশও করেনি, কিংবা কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। বরং সময়ে সময়ে আমরা দেখেছি, আইন পরিবর্তন করে বড় বড় ঋণখেলাপি, জালিয়াত, টাকা পাচারকারীকে নানারকম সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এমনকি সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী অর্থনীতিবিদরাও বিভিন্ন সময়ে বলতে বাধ্য হয়েছেন, এই সরকার ‘ঋণখেলাপিবান্ধব সরকার’। আজ যখন তথাকথিত শুদ্ধি অভিযানের কথা বলা হচ্ছে, তখন এই বিশাল লুটপাটের কোনোটির ক্ষেত্রে এমনকি লোক দেখানো কোনও চেষ্টাও চোখে পড়ে না। 

রাশেদ খান মেননের কথার সূত্র ধরে তাই প্রশ্ন উঠতেই পারে, কাদের আড়াল করতে, কাদের লুটপাটকে নির্বিঘ্ন রাখতে এই শুদ্ধি অভিযান। এই অভিযানের শুরুতেই এক জাতীয় দৈনিকে আমি লিখেছিলাম, শুদ্ধি অভিযান শুদ্ধ করেনি, করেছে উন্মোচন। এই অভিযান আমাদের দেখিয়েছে—কী করে সরকারের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের তৃতীয় বা চতুর্থ স্তরের পদে থেকেও হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়া যায়। দেশে-বিদেশে অবিশ্বাস্য সম্পদের পাহাড় তৈরি করা যায়। এই হাজার কোটি টাকা তো একদিনে কিংবা একা করা সম্ভব না। সরকারের প্রত্যক্ষ মদত ছাড়া একজন সম্রাট, জি কে শামীম, সেলিম প্রধান, খালেদ মাহমুদ তৈরি হয় না। ঠিক তেমনি বেছে বেছে দুই একজন চুনোপুঁটি ধরে বিচারের নামে প্রহসন করলেই শুদ্ধি অভিযান হয় না। স্তরে স্তরে বসে যারা একেকজন দানব তৈরি করে এবং নিজেদের স্বার্থে তাদের লালন পালন করে টিকিয়ে রাখে তাদের না ধরলে এসব কিছুই অর্থহীন। 

আলোচিত ঘটনাগুলো থেকেই কতগুলো স্ন্যাপশট দেখে নেওয়া যাক পরপর–একেবারেই চ্যালেঞ্জবিহীন একটি মহাশক্তিধর সরকার দোর্দণ্ড প্রতাপে আর দম্ভে দেশ চালাচ্ছে। বছরের পর বছর পুরো দেশটাকে এমনভাবে লুটপাট করছে, যেমন লুটপাট ঔপনিবেশিক শাসকরাও করেনি। অথচ বর্তমান সরকার তাদের বিরোধী মতকে বাগে রাখতে মানুষকে মিথ্যা মামলায় জেল খাটাচ্ছে, বিচারবহির্ভূত খুন করছে, গুম করছে। হঠাৎ গৃহদাহ—জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি দলের দুই পক্ষ ছাত্রলীগ আর ভিসি বখরা দাবি আর লুটপাটের পাল্টাপাল্টি অভিযোগে প্রকাশ্যে জড়িয়ে পড়লো। ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বহিষ্কৃত হলেন। শুরু হলো তথাকথিত শুদ্ধি অভিযান। শুদ্ধি অভিযান নিয়ে যুবলীগ প্রেসিডেন্টের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘আঙুল চোষা’ ও ‘রাজনীতিকীকরণে’র চেষ্টার অভিযোগ—ক্যাসিনো মূলহোতা সম্রাটের নিজ কার্যালয়ে শত শত কর্মীর পরিবেষ্টিত হয়ে শোডাউন, ‘ওপরের নির্দেশের’ অভাবে গ্রেফতার না হয়ে বহাল তবিয়তে থাকার অভিযোগ উঠলো। এরপর বিপর্যয়কর ভারত সফরের পরদিন কাকতালীয়ভাবে তাকে গ্রেফতারে ‘ওপরের নির্দেশ’ আসা—প্রধানমন্ত্রীর এক-এগারোর ইঙ্গিত, ব্যবস্থা নিয়ে সেটা হবে না মর্মে আশ্বস্ত করা। শেখ ফজলে নূর তাপসের হঠাৎ বোধোদয়—সম্রাট, বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি, বালিশ কাণ্ড এবং ওষুধের দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার হওয়া–সবশেষে রাশেদ খান মেননের মাঠে নামা এবং ঘোষণা দেওয়া, ‘প্রধানমন্ত্রীসহ আমাদের কাউকে জনগণ ভোট দেয়নি।’

স্ন্যাপশটগুলো মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এটি একটি হ-য-ব-র-ল অবস্থা। এই হ-য-ব-র-ল সুকুমার রায়ের রম্য রচনা নয়, এটিকে বরং ব্যাখ্যা করে WB Yates-এর সেই বিখ্যাত কবিতার লাইনটি ‘Things fall apart; the centre cannot hold’। জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া একের পর এক মেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে দেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে সবকিছু কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পাপের বোঝা কি আজ এত বড় হয়ে গেছে যে, কেন্দ্র আর ধরে রাখতে পারছে না সেটা? নিজ পাপের ভারেই কি ভেঙে পড়ছে সবকিছু?

লেখক আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য। 

Saturday, October 19, 2019

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত বলেই নৃশংস ঘটনা ঘটছে


রোকেয়া হায়দার

‘আমি হতে চেয়েছিলাম ব্যারিস্টার। সাংবাদিক হবো- এমন স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষাই ছিল না। তবে যখন যা করেছি নিষ্ঠার সঙ্গেই করেছি। নিজেকে একজন নারী সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিতে কখনই স্বস্তিবোধ করি না’- বলছিলেন রোকেয়া হায়দার। যিনি বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। সাংবাদিকতায় দৌড়ঝাঁপে পোশাক বিন্যাস বড় বিষয়। কিন্তু তিনি একাট্টা। শাড়িতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

বাঙালিয়ানাকে সঙ্গী করে দুনিয়া ঘুরেন। পশ্চিমা দুনিয়ায় বড় বড় সেমিনার আর খেলার মাঠে খবর খুঁজে ফেরেন এ পোশাকেই। কাজের ক্ষেত্রে এ পোশাক নেতিবাচক না হয়ে বরং ইতিবাচক- এমনটাই মনে করেন তিনি। বলেন, এর জন্য বাড়তি সুবিধাও পেয়েছি। দুনিয়ার তাবৎ মিডিয়াকে ফিরিয়ে দিলেও মাদার তেরেসাঁ তাকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন শাড়ি পরা দেখেই।

রোকেয়া হায়দারের সাংবাদিকতা শুরু বিটিভি দিয়ে। খবর পড়তে ভালোবাসতেন। ১৯৮১ সালে পাড়ি জমান ওয়াশিংটনে। ভয়েস অব আমেরিকাতে। একমাত্র নারী প্রতিনিধি হিসেবে বাংলা বিভাগে যোগ দেন। কালে তিনিই ২০১১ সালে বাংলা বিভাগের প্রধান হন। পরে একই বিভাগের ব্যবস্থাপনা সম্পাদকের দায়িত্বও লাভ করেন। কোনো আন্তর্জাতিক মাল্টিমিডিয়া প্রতিষ্ঠানে বাংলা বিভাগের প্রধান হওয়ার কৃতিত্ব তারই। নিজ কর্মদক্ষতার স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ১৯৯০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। স্পষ্ট উচ্চারণ, বলিষ্ঠ কণ্ঠ আর দৃঢ়চেতা মনোভাব এই মানুষটিকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। যিনি বিশ্বাস করেন সততা, সাহস আর ইচ্ছা থাকলে নির্ভয়ে যেকোনো খবর প্রকাশ সম্ভব। জোর দিয়ে বলেন, কাউকে তুষ্ট করার জন্য সাংবাদিকতা করবো এই মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মুক্ত গণমাধ্যম, মিডিয়ায় সেল্‌ফ সেন্সরশিপ, কনফ্লিক্ট  রিস্যলুশান নিয়ে মানবজমিনের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন তিনি।

দীর্ঘ পথপরিক্রমায় কোনো প্রতিকূলতার মধ্যে পড়েছেন কিনা?

কোথাও কোনো প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়িনি। বিরাট কোনো দুর্ঘটনাও ঘটেনি। তবে পেশাগত অভিজ্ঞতায় কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হয়েছি। তা হচ্ছে প্রেস ফ্রিডম বা যেটাকে আমরা বলি মুক্ত গণমাধ্যম তা নিয়ে। একজন সাংবাদিকের পুরোপুরি প্রেস ফ্রিডম এখনো নেই। আমার কাজের শুরুতেও তা ছিল না। বর্তমানেও তা সীমিত। আর তা কেবল বাংলাদেশেই নয় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেই এ অবস্থা বিদ্যমান। এখানকার মিডিয়ায় এখনো কথা বলার অধিকার সীমিত।

আমি দেখেছি, এখানে সকলেই চিন্তাভাবনা করে কথা বলে। বর্তমানে মিডিয়া বেড়েছে, পত্র-পত্রিকা, রেডিও বেড়েছে বলে হয়তো অনেককেই সোচ্চার হতে দেখা যায়। কিন্তু আমি জানি না, কতজন নির্ভয়ে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে পারছেন। কারা নির্ভয়ে কথা বলতে পারছেন? বুয়েটে সাম্প্রতিক সময়ে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড থেকে কিছুটা হলেও কি প্রমাণিত হয় না যে, নির্ভয়ে কথা বলার অধিকার এদেশে এখনো সীমিত। বুয়েটের মতো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, যেখানে মেধাবী ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করতে যায় সেখানে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি, সেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত বলেই এ ধরনের নৃশংস, বর্বরোচিত ঘটনা ঘটছে। এটা খুবই দুঃখজনক।

ভয়েস অব আমেরিকাতে দীর্ঘদিন কাজ করছেন, দু’ একটি অভিজ্ঞতার কথা বলবেন?

আমাদের টার্গেট এরিয়া বাংলাদেশ এবং দুনিয়ায় যেখানে বাংলাদেশিরা আছেন। আর সে লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করি। একটু লক্ষ্য করে দেখবেন, ভয়েস অব আমেরিকাতে আমরা নির্দ্বিধায় লিখছি, পড়ছি। দেশের সর্বোচ্চ পদে যিনি আছেন তার বিরুদ্ধেও বা তার পক্ষে যা কিছু বলার প্রয়োজন হলে তা অত্যন্ত সোচ্চারভাবেই আমরা বলছি। সেখানে সরকারি কোনো চাপ নেই, আমরা নির্দ্বিধায় যা বলার তা বলতে পারছি। এমনকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রে যে ধরনের সমালোচনা তা প্রচার করছি। বহু গণতান্ত্রিক দেশেই তা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে কীভাবে দেখেন যুক্তরাষ্ট্রে বসে?

বাংলাদেশের গণমাধ্যম কর্মীদের বলবো, তোষামোদের রাজনীতি না করে কিছুটা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ঝুঁকি নিতে। আমি কাউকে তুষ্ট করার জন্য সাংবাদিকতা করবো এই মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যদি কোনো সুবিধা লাভের আশায় সাংবাদিকতা করি তাহলে বিষয়টি অন্যরকম হবে। বহু দেশেই আমরা দেখি অনেকে থাকেন যারা সাংবাদিকতার তকমা লাগিয়ে বাড়তি সুবিধা আদায়ের চেষ্টায় লিপ্ত থাকেন, যার মাধ্যমে বিশেষ সুযোগ পাওয়া যায়। বাংলাদেশেও এ ধরনের ঘটনা কমবেশি ঘটে থাকে। এটা কীভাবে ঘটে? যেমন আমি একজনের বিষয়ে কিছু তথ্য জানি। এখন আমি যদি তাকে গিয়ে বলি, তার বিষয়ে আমার কাছে তথ্য আছে তা আমি প্রকাশ করবো। সাংবাদিক শুনে অনেকেই শঙ্কিত হন। অনেকেই আছেন এমন একটা অবস্থানে থাকেন তারা চান না তাদের বিষয়ে কিছু প্রকাশ হোক। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে অসৎ সাংবাদিকরা সুযোগ নিয়ে থাকে।

সরকার বলছে, মিডিয়ায় সেন্সরশিপ নেই, কিন্তু একটি সেল্‌ফ সেন্সরশিপ আলোচনায় আছে?

দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়া ছাড়াও অনেক বড় দেশেও সেল্‌ফ সেন্সরশিপ রয়েছে। অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক দেশেও এটা লক্ষ্য করা যায়। আর স্বৈরশাসন যেসব দেশে সেখানে তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এটা পারসন টু পারসন ভেরি করে। কথা হচ্ছে,  আমি সাংবাদিক হিসেবে সেই সুবিধা নিতে চাই কিনা। আমি সত্য প্রকাশ করলাম তার প্রতিক্রিয়া কি হলো, কে কি ভাবলো, কতটা ভীত সেটা ভেবে আমি কতটা সন্ত্রস্ত বা আমি চাই না এ ধরনের কোনো পরিস্থিতিতে পড়ি।

খবর প্রচারের ক্ষেত্রে হয়তো এ বিষয়গুলো কাজ করে। ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই ভাবেন যে, আচ্ছা এই খবরটি আমি প্রকাশ করবো এর প্রতিক্রিয়া কি হবে? আমি একটু যাচাই করে, চিন্তাভাবনা করে দেখি। এই খবরটি প্রকাশ করে আমারই বা কি লাভ হচ্ছে আর তার প্রতিক্রিয়ায় আমি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবো। এই যে আমি ভাবি, এটা করে আমার কি লাভ হবে, এটা ভেবে অনেকেই চুপ করে যান। আবার অনেকেই মনে করেন যে, না এটা আমাদের বলা উচিত। এরকম কিছু মানুষ মিডিয়ায় আছেন যেটা আমরা আশা করি। কথায় আছে, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে। অর্থাৎ উভয়েই সমান অপরাধী। হয়তো এসবের মধ্য থেকেই সত্যিকার সাহসী সাংবাদিক বেরিয়ে আসবে এবং যার পদাঙ্ক অনুসরণ করবে অনেকেই।

বাংলাদেশে সৎ, সাহসী সাংবাদিকতা নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?

ধারা একদিন না একদিন পাল্টে যাবেই। পাল্টাতে বাধ্য। আমি যদি সারাজীবন মনে করি, না একইভাবে চলবে তা হবে না। আপনি নিজেই দেখুন, এতকিছু আড়াল করার পরও এখন অনেক কিছু বেরিয়ে আসছে। এখন অবাধ সংবাদ সরবরাহের দিন। আপনি মোবাইলে একটি চিত্র ধারণ করলেন বা সিসিটিভির একটি ফুটেজ সোস্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করে দিলেন তা তো আমি অস্বীকার করতে পারি না। আপনার মুঠোফোন এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। যেটাকে আমরা সিটিজেন জার্নালিজম বলছি। আপনি যদি অন্যায় কিছু চিন্তা করেন যে, আমি একটি ছবি তুলে আটকে দেবো, সেই মনোবৃত্তি ছাড়া আমি সঠিক তথ্যটি তুলে ধরবো এমন চিন্তা করলে, সততা নিয়ে কাজ করলে, আপনি সমাজের অনেক চিত্রই তুলে ধরতে পারবেন।

কি চেয়েছিলেন আর কি হলেন?

ব্যারিস্টার হতে চেয়েছিলাম। সাংবাদিক হওয়ার চিন্তা ছিল না। বাবা-মা চেয়েছিলেন ডাক্তার হই। আমার খবর পড়তে ভালো লাগতো। সেই ভালোলাগা থেকেই এতদূর। অমি নিজেকে এখনো পুরোপুরি সাংবাদিক হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছি বলে মনে করি না। এ পেশায় এসেও অনেক কিছু করতে চেয়েছি কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। চার ছেলেমেয়েকে দেখাশুনা করার জন্য অনেক সময় দিতে হয়েছে। তবে যেটাই করতে চেয়েছি, সেটা একেবারে সর্বোচ্চ মানে গিয়ে করবো তা ভেবেছি সবসময়। যাই করি খুব ভালোভাবে করবো এবং নিষ্ঠার সঙ্গে করবো এবং সেটাই লক্ষ্য ছিল। বিখ্যাত হবো বা নাম করবো এমন কোনো লক্ষ্য ছিল না। চার দশকের সাংবাদিকতায় মনে হয়েছে, টেলিভিশনে যখন খবর পড়েছি সে সময়ই আমার কাছে স্বর্ণযুগ। কেউ দূর দেখে দেখলে এখনো বলে, আপনি বাংলাদেশের খবর পাঠিকা। এই যে খবর পড়ে এতটা জনপ্রিয় হওয়া যায়- এটা ভাবতেই ভালো লাগে।

নিজেকে নারী সাংবাদিক বলতে নারাজ?

এটা আমার একদম ভালো লাগে না। নারী সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে স্বস্তিবোধ করি না। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমি একজন মানুষ। আমি যদি ডাক্তার হতাম আর খুব ভালো কাজ করতাম তাহলে আমাকে কেউ মহিলা ডাক্তার হিসেবে দেখলে আমি এটাও পছন্দ করতাম না। তেমনি আমার খুবই অপছন্দ নারী সাংবাদিক বলাটা। আমি যে পেশায় আছি সে হিসেবে পরিচিত হতে চাই। সেই কাজের স্বীকৃতি চাই। আমি কতটা ভালো কাজ করতে পারছি তার স্বীকৃতি চাই নারী বা পুরুষ হিসেবে নয়। তবে হ্যাঁ কথা থাকে হয়তো নারীদের জন্য সাংবাদিকতা অনেক ক্ষেত্রে কঠিন। সেটা তো অন্য পেশার সময়ও আছে। একটি পরিবারে বাবা যদি একদিন রান্না করেন তাহলে তাকে বাহবা দেয়া হয়, কিন্তু মা তো প্রতিদিন রান্না করেন তার কাজের স্বীকৃতিটা কে দেয়? ঠিক তেমনি নারীদের যেকোনো কাজে সফলতা আনতে হলে দ্বিগুণ না দশগুণ কাজ করতে হয়। এখন নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে এসেছে। তারা সর্বস্তরে কাজ করছে। রাস্তার ইট ভাঙা থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনা পর্যন্ত নারীরা। পোশাক শিল্পে কাজ করে নারীরাই আশি শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন দেশের জন্য। যেমন খেলাধুলার মাঠেই বলুন, আগে মেয়েদের খুব একটা দেখা যেত না। এখন অনেক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আসছে মেয়েদের থেকে। একইভাবে মেয়েরা আগের চেয়ে অনেক বেশি হারে সাংবাদিকতায়ও এসেছে। আমি যখন শুরু করি ১৯৮১ সালে, তখন ভয়েজ অব আমেরিকাতে একজন মাত্র নারী কাজ করতেন। আজ দিন বদলেছে সেখানেও।

সাংবাদিকতায় স্পোর্টস বাছাই করলেন কেন?

আমার বাইরে বেড়াতে খুব ভালো লাগতো। আর খেলার মাঠে যাওয়া মানেই বাইরে যাবার সুযোগ। অন্যদিকে খেলার মাঠে প্রাণের জোয়ার, তারুণ্যের জোয়ার দেখা যায় তা অন্য কোনো কিছুতে সম্ভব নয়। তারুণ্যের জোয়ার দেখতে মাঠে যেতে আমার খুব ভালো লাগে। খেলার মাঠে অবাধে চলাফেরা করতে পারতাম, স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারতাম- এটাও একটা কারণ। সেখানে কোনো রাজনৈতিক চাপ ছিল না। ফলে খুব সহজেই স্পোর্টস নিয়ে কাজে মেতেছি। খেলার মাঠে বড় বড় তারকাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। কিংবদন্তির ফুটবল তারকা পেলের সাক্ষাৎকার নিয়েছি, সেফ ব্লাটারের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। বিশ্বকাপ ফুটবলের ট্রফি ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।

মাদার তেরেসাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন?

এটি একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। আমেরিকাতেই মাদার তেরেসাঁ এসেছিলেন তার প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দেখতে। সেখানেই ওনার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। আমি যখন মাইক্রোফোন নিয়ে ওনার সাক্ষাৎকার চাইলাম প্রথমদিকে তিনি মাইক্রোফোন সরিয়ে দিয়েছিলেন। তখন আমি বললাম, আমি আপনারই দেশ থেকে এসেছি। আমি বাঙালি। আমার পোশাক দেখেই বুঝতে পারছেন, আমি আপনাদেরই লোক। তারপর তিনি কথা বলতে শুরু করলেন। এটা আমার জীবনে অসাধারণ পাওয়া।

তরুণ প্রজন্মের সাংবাদিকদের জন্য আপনার কি পরামর্শ?

একটাই কথা বলবো, প্রেস ফ্রিডমে বিশ্বাস করেন। সততার সঙ্গে নির্ভয়ে দায়িত্ব পালন করেন। আমি অন্তত এটি বলতে পারি, যতদিন সাংবাদিকতা করছি নির্ভয়ে এবং সততার সঙ্গে করছি। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ভয়েস অব আমেরিকা শুরু হয়েছিল দুটি লাইনের ওপর ভিত্তি করে- খবর ভালো হোক মন্দ হোক, আমরা প্রকৃত তথ্য তুলে ধরবো। এতদিন পরও এর ভিত্তিতেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি প্রেস ফ্রিডম নিয়ে।

কখনও সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সমস্যা হয়েছে?

কনফ্লিক্ট রিস্যলুশান বলে একটি বিষয় আছে। আমি এই প্রশিক্ষণও নিয়েছিলাম। যেখানে বলা হয়েছে দু’পক্ষেরই কথা শুনতে হবে। অন্যের মতকে গুরুত্ব দিতে হবে। সবসময় নিজের মত ঠিক নাও হতে পারে। এটা তো আমার কাজের জায়গা। সুতরাং অনেক কিছু মেনে নিতে হয়।

কার্টসি — মানবজমিন/ অক্টোবর ১৯, ২০১৯।


Thursday, October 17, 2019

বিচার কত দূরে





সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা  তাদের নিয়ন্ত্রিত টর্চার  সেলে নিয়ে ঘণ্টার পর  ঘণ্টা ধরে নির্মমভাবে পেটাতে পেটাতে মেরেই ফেলল বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে। তার অপরাধ তিনি ফেইসবুক স্ট্যাটাসে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা করেছেন। বুয়েটসহ সারা দেশে যখন আবরার হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলন তুঙ্গে তখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গণভবনে দেখা করেন নিহত আবরারের পরিবারের সদস্যরা। প্রধানমন্ত্রী তাদের আশ্বস্ত করে বলেন, হত্যাকারীদের বিচার নিশ্চিত করা হবে। তারা যে দলেরই হোক

এর আগে ঢাকায় বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড, লক্ষীপুরে এডভোকেট নুরুল ইসলাম হত্যাকাণ্ড সহ প্রায় সব আলোচিত হত্যাকাণ্ডের পরই আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা একই রকম আশ্বাস দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারের উদাহরণ টেনে সরকারদলীয়রা বলে থাকেন, দেশ বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হয়েছে। সরকারের এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত এগারো বছরের ব্যাপক আলোচিত ও নৃশংস কয়েকটি ঘটনায় বিচারের সর্বশেষ অবস্থা জেনে নেওয়া যাক।



এক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর ছিদ্দিক হত্যা মামলায় ছাত্রলীগের সাবেক ১০ নেতাকর্মীর সবাই বেকসুর খালাস পেয়েছেন। আট মাস আগে এই মামলার রায় হয়েছে। কিন্তু আবু বকরের বাবা-মা, এমনকি বাদীকে রায় সম্পর্কে জানানো হয়নি। হত্যাকারী চিহ্নিত করার মাধ্যমে বিচার নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালতে আপিল করার যে সুযোগ ছিল, তা-ও রাষ্ট্রপক্ষ নেয়নি। এর মধ্যে আপিলের স্বাভাবিক সময়ও পার হয়ে গেছে। ফলে নিহত ব্যক্তির পরিবার বিচার পাওয়ার অধিকার থেকেই বঞ্চিত রয়ে গেল (আবু বকরকে কেউ খুন করেনি! প্রথম আলো, ২৬ জানুয়ারি ২০১৮)

দুই। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮-দলের অবরোধ কর্মসূচি চলার সময় ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে অনেকগুলো ক্যামেরার সামনেই দিনেদুপুরে নির্মমভাবে কুপিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা খুন করে দর্জি দোকানের কর্মী বিশ্বজিৎ দাসকে। ব্যাপক সমালোচনার মুখে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে নিম্ন আদালতে ছাত্রলীগের আটজন নেতাকর্মীর ফাঁসির রায় ও ১৩ জনের যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হলেও হাইকোর্ট তার মধ্যে ছয়জন নেতাকর্মীকে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই দিয়েছে। এই রায়ের পর বিশ্বজিৎ দাসের ভাই উত্তম দাস বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘পাঁচ বছর পরে আজ আরেকটা দুঃসংবাদ এটা। আজকের দিনটাতে যে এরকম কিছু শুনতে হবে আমরা আশাই করিনি। এটাই ঠিক যে সরকার যা চাইবে তা-ই হবে। সরকার যদি চাইত যে অন্তত বিশ্বজিতের ঘটনাটা সুষ্ঠু বিচার হোক তাহলে হতো’(বিবিসি বাংলা, ৬ আগস্ট ২০১৭)

তিন। ‘আমি পাখির মতো মুক্ত... এখন আমি উড়তে পারি...’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ছাত্র জুবায়ের আহমেদ হত্যার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক খান মোহাম্মদ রইস ওরফে সোহান ফেইসবুকে এরকম একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। জুবায়ের হত্যায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্ত ইশতিয়াক মাহবুব ওরফে অরূপও ইন্সটাগ্রামে একটি ছবি পোস্ট করেন। ওই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, কুয়ালালামপুরের একটি স্টারবাকস স্টোরে বসা। এই দুজনসহ সাজাপ্রাপ্ত পাঁচজনই ধরাছোঁয়ার বাইরে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ২০১২ সালে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের প্রতিদ্ববী গগ্রুপের হাতে ছুরিকাহত হয়ে জাবির ইংরেজি বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহত হওয়ার পর হাসপাতালে মারা যান (হত্যার পাঁচ বছর, ‘পাখির মতো মুক্ত’ জুবায়েরের খুনিরা, ডেইলি স্টার, ০৯ জানুয়ারি ২০১৭)।

চার। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদলের কলেজ শাখার নেতা তাওহীদুল ইসলাম (২৫) হত্যা মামলায় মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগ শাখার সভাপতি সৌমেন দে, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হাইসহ সব আসামিকে বেকসুর খালাস দিয়েছে আদালত। খালাস পাওয়া সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। ২০১৪ সালের ৪ জুন ওসমানী মেডিকেল কলেজের আবু সিনা ছাত্রাবাসের ১০০৩ নম্বর কক্ষে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাওহীদুল ইসলামকে। তাওহীদ এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কলেজ শাখার আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন (ছাত্রদল নেতা তাওহীদুল হত্যা মামলা, সব আসামি খালাস, প্রথম আলো, ১৩ আগস্ট ২০১৮)।

পাঁচ। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মারধরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর সাধারণ ছাত্রসমাজ খুনিদের বিচার দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। এমনই আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল আট বছর আগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) ছাত্রাবাসে। ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে দফায় দফায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল চমেকের ৫১তম ব্যাচের বিডিএস তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আবিদুর রহমান আবিদকে। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার আসামি ছাত্রলীগের ভিপিসহ ১২ নেতাকর্মীর সবাই দুই মাস আগে আদালতের রায়ে বেকসুর খালাস পেয়ে গেছেন। আবিদকে ছাত্রদল কর্মী বলে সন্দেহ করতেন চমেক ছাত্রলীগের নেতারা। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবিদের জনপ্রিয়তা ছিল। এ কারণে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর দুপুর ২টা, সন্ধ্যা ৭টা ও রাত ১০টায় তিন দফা পিটুনির পর চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে আবিদকে তার বোনের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি বোনের বাসা থেকে চিকিৎসার জন্য চমেক হাসপাতালে আনা হলে সেখানেও বাধা দেন ছাত্রলীগে নেতাকর্মীরা। অবশেষে ২১ অক্টোবর মারা যান আবিদ। (চমেক হোস্টেলে দফায় দফায় পেটানো হয় আবিদকে) আবরার হত্যার বিচারে সবাই যখন সোচ্চার, তখন আবিদের খুনি ছাত্রলীগের ১২ নেতাকর্মী খালাস। (কালের কণ্ঠ, ১০ অক্টোবর, ২০১৯)

শুধু এই পাঁচটিই নয়, এমন বহু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে ছাত্রলীগ গত এগারো বছরে। ০৮ অক্টোবর ২০১৯ দৈনিক যুগান্তরের এক রিপোর্টে লেখা হয়, গত ১০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), বুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ (চবি) দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে লাশ হয়েছেন ২৪ জন শিক্ষার্থী। এই ২৪ জনের মধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ জন, রাজশাহীতে ৫ জন, ময়মনসিংহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন, দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ জন। এছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও ৩ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের ১৭টি ঘটেছে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে!

এই হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে বিচার যে কতদূরে সে বিষয়ে ০৯ অক্টোবর ২০১৯ দৈনিক প্রথম আলো লিখেছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১০ বছরে ৮ শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দশকে খুন হয়েছেন চার শিক্ষার্থী। সিলেট শাহজালাল, লিডিং এবং সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে তিন শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন। বিচার হয়নি একটি হত্যাকাণ্ডের। এই হলো আওয়ামী লীগ সরকারের গত এগারো বছরে শুধু ছাত্রলীগের হাতে খুন হওয়াদের বিচারের খতিয়ান। ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের বিশেষ পরিস্থিতিতে আদালত সাজা দিলেও শেষ পর্যন্ত তা যে টিকে থাকে না, এমন নজিরও অনেক।

লক্ষীপুরের আওয়ামী লীগ নেতা আবু তাহের ও তার ছেলে বিপ্লবের নৃশংসতার বলি হয়েছিলেন বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম। বাসা থেকে অপহরণ করে তাকে হত্যার পর লাশ টুকরো টুকরো করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রথম আমলের শেষ দিকে ২০০০ সালে। আলোচিত নুরুল ইসলাম হত্যাসহ অপর একটি হত্যা মামলায় বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ডর রায় দেওয়া হয়। আপিল বিভাগ পর্যন্ত রায়ে বলেছিল, সমস্ত তথ্য প্রমাণ করে বিপ্লব হত্যাকারী। তাই তার সাজা হ্রাস করার কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় খুনি বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ড রহিত হয়। বহু মামলার আসামি সাজাপ্রাপ্ত বিপ্লব এখন মুক্ত।

এই বিচারহীনতা ও খুনিদের ক্ষমার সংস্কৃতি এই দেশে ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রত্যাশাকে যে কতদূরে ঠেলে দিয়েছে তা উঠে এসেছে দুর্বৃত্তদের হাতে হত্যাকাণ্ড্ররে শিকার ফয়সাল আরেফিন দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের কথায়। দৈনিক মানবজমিনকে তিনি বলেছেন, চারদিকে সবাই বিচার দাবি করে। পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়। কিন্তু বিচার আর হয় না। বাংলাদেশের যে বিচারব্যবস্থা এখানে ন্যায়বিচার পাওয়া খুব কঠিন। তাই আমি একজন সন্তানহারা বাবা হয়ে আবরারের বাবাকে বলব, বিচার হলো কী হলো না সেটা নিয়ে যেন তিনি না ভাবেন। আসলে রাষ্ট্রের পরিচালনা ঠিক নেই। রাজনীতি দুর্নীতিগ্রস্ত। এই দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির মধ্যে সরকার কোনো কিছু ঠিকমতো চালাতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ভ‚মিকা সঠিকভাবে পালন করছে না। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেই সরকারের ছাত্র সংগঠনগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে ওঠে।

আদালতে যখন চাক্ষুষ অপরাধী পার পেয়ে যায় এবং সেটা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয় তখন জানা যায় পুলিশি তদন্ত ও চার্জশিটের দুর্বলতার কথা। তার মানে হলো, বিষয়টি আদালতে আসার আগেই অপরাধীদের বাঁচানোর পথ তৈরি করে রাখা হয়। কারা করে এটা? তদন্ত কর্মকর্তা তো? তিনি কেন করেন? উত্তর সোজা। এর পেছনের কারণ দুর্নীতি ও রাজনীতি। কখনো অর্থের বিনিময়ে, কখনো রাজনৈতিক প্রভাবে আবার কখনো উভয় কারণে চার্জশিট এমনভাবে দেওয়া হয় যে আদালতে গিয়ে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায় প্রকৃত অপরাধী।

ক্ষমতাসীন দলের যে সব অপরাধী এভাবে পার পেয়ে যান তাদের সঙ্গে ক্ষমতা ও টাকার সম্পর্ক যে গভীর সেটা সবারই জানা। তার দায় তো অবশ্যই সরকার ও দলকেই নিতে হবে। এভাবে খুন করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি দলীয় অপরাধীদের সাহস জোগায় আরও ভয়াবহ অপরাধ করতে। তারা বুঝে যায়, তাদের মাথার ওপরে ‘বড় ভাইয়ের’ ছায়া আছে। কোনো না কোনো পথে তাদের বাঁচানো হবে। আর সরকারি দলের দাপুটে সন্ত্রাসীদের কাছে তো টাকা কোনো সমস্যাই নয়।

এত কিছুর পরেও যদি কারও শাস্তি হয়েই যায় তবে শেষ ভরসা হিসেবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ তো আছেই। তার ক্ষমাও হয়তো মিলতে পারে, এই ভরসাও কারও মনে কাজ করতেই পারে। তাই তারা খুন করে, বেঁচে যায়, আবারও খুন করে। এভাবে হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য অপরাধী। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তাদের এই বেঁচে যাওয়ার প্রক্রিয়া দেখে উৎসাহিত হয়ে ছিঁচকে সন্ত্রাসীও এক সময় হয়ে ওঠে ভয়াবহ খুনি। এভাবে রাজনৈতিক প্রশ্রয় ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফলে যে খুনি শ্রেণির উদ্ভব ঘটে ও বিস্তৃত হয় তার দায় কোনো ভাবেই এড়াতে পারেন না রাজনীতিবিদরা। সুশাসন ও সুবিচার নিশ্চিত করতে হলে আগে চাই সৎ ও স্বচ্ছ রাজনীতি।

—  লেখক চিকিৎসক ও কলামিস্ট 
  • কার্টসি — দেশরুপান্তর / অক্টোবর ১৭, ২০১৯

Wednesday, October 16, 2019

মানসিক বিকাশ হচ্ছে না গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্তানের

শাহেদ মতিউর রহমান


আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে বাবাকে ফিরে পেতে এক শিশুর কান্না




বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্তানের মানসিক বিকাশ হচ্ছে না। অনেকে দীর্ঘ সময় বাবাকে কাছে না পেয়ে রীতিমতো অস্বাভাবিক আচরণও করছে। যশোরের এক শিশুপুত্র বাবার আদর না পেয়ে অভিমানে আত্মহত্যা করেছে। বাবা গুম হওয়ার পর ঢাকার তেজগাঁওয়ের এক শিশুকন্যার অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ করে এক বছর ধরে তার মা মোহাম্মদপুরের একটি মানসিক বিকাশ কেন্দ্রে মেয়ের কাউন্সেলিং করাচ্ছেন। নয়া দিগন্তের অনুসন্ধানে গুম হওয়া ব্যক্তির অবর্তমানে তাদের এমন অনেক শিশুসন্তানের খোঁজ মিলেছে যারা মানসিকভাবে অসুস্থ। এসব শিশুসন্তানদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাও করাচ্ছেন তাদের স্বজনেরা।


২০১১ সালের ৩১ অক্টোবর ঢাকার তোপখানা রোডের নিউ ইয়র্ক হোটেলের নিচ থেকে নিখোঁজ বা গুম হয় নড়াইলের ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম লিটন। লোহাগড়ার লুটিয়া গ্রামের মৃত শেখ তারামিয়ার ছয় ছেলের মধ্যে লিটন ছিল দ্বিতীয়। নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে গুম হওয়া লিটনের পরিবারের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়েছে। লিটনের ভাই শেখ ফিরোজ আলম জানিয়েছেন, লিটনের ফিরে আসার দীর্ঘ অপেক্ষার পরেও বাবার আদর আর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেছিল ছোট্ট ছেলে আকাশ। চাওয়ার আগেই বাবার কাছে সবই পেত সে। কিন্তু দীর্ঘ দিন বাবার আদর না পেয়ে ২০১৪ সালের ২৬ অক্টোবর মায়ের সাথে অভিমান করে গলায় দড়ি দেয় বাবার স্নেহবঞ্চিত আকাশ। ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে দড়ি বেঁধে আত্মহত্যা করে সে।


২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর গুম হন রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার শাহিনবাগের সাজেদুল ইসলাম সুমন। দীর্ঘ দিন ধরে বাবার আদর না পেয়ে সুমনের দুই মেয়ের জীবনও যেন অনেকটা ছন্নছাড়া। বাবা গুম হওয়ার পর বড় মেয়ে হাফসা ইসলাম রায়তার পড়াশোনা এক বছর সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। শাহীন স্কুলের মেধাবী ছাত্রী রায়তার পরীক্ষার ফলাফলে আসে চরম বিপর্যয়। পরিবার তার মানসিক অবস্থাটি বুঝতে পেরে ইংলিশ মিডিয়াম পরিবর্তন করে বাংলা মাধ্যমে আবার ভর্তি করিয়েছে তাকে। রায়তার ছোট বোন আরোয়া ইসলামের মানসিক অবস্থা আরো করুণ। স্থানীয় উত্তরণ প্রিপারেটরি স্কুলে পড়াশোনা করছে সে। কিন্তু বাবার আদর না পেয়ে মানসিক বিকাশ হচ্ছে না তার। আরোয়ার মা মোহাম্মদপুরের কিডস্ ক্লাবে নিয়মিত কাউন্সেলিং করাচ্ছেন তাকে।


২০১৩ সালে ২ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও থেকে গুম হন কায়সার নামে একজন প্রাইভেটকার চালক। ঘরে তখন তার তিন বছর বয়সের মেয়ে মীম। মীম এখন ক্লাস টুতে পড়ছে। কিন্তু প্রতিক্ষণেই মীম যেন তার বাবার অভাব অনুভব করছে। মানসিকভাবেও বিষন্ন থাকে সব সময়। মীমের মা মিনু বেগম জানান, মেয়ে আমার ঠিকমতো খাওয়া দাওয়াও করে না। ডাক্তারের কাছে বেশ কয়েকবার নিয়ে গেছি। ডাক্তার বলেছেন কোনো রোগ নেই। তারপরও মেয়ে আমার সুস্থভাবে বেড়ে উঠছে না।


ছয় বছর আগে শাহবাগ থেকে গুম হন বংশালের চঞ্চল। চঞ্চলের একমাত্র ছেলে আহাদ। আহাদের বয়স এখন ৯ বছর। বাবা গুম হওয়ার পর আহাদ বড় ধরনের একটি মানসিক আঘাত পায়। তার মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ করছে তার পরিবার। আহাদের মা জানান, ছেলের বয়স ৯ বছর হলেও শারীরিক কিংবা মানসিক কোনোভাবেই সে বেড়ে উঠছে না। তার ওজন এখনো মাত্র ১৫ থেকে ১৬ কেজি। যদিও স্বাভাবিকভাবে এই বয়সে ওজন থাকার কথা ২৮ থেকে ৩০ কেজি।

আহাদের মা আরো জানান, ওর বড় সমস্যা হলো পড়াশোনা কিছুই মনে রাখতে পারে না। সকালের কথা দুপুরেই ভুলে যায়। স্মৃতিশক্তি খুবই দুর্বল। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গিয়ে কয়েকবার দেখিয়েছি। সবাই বলেছে বাবার কথা বেশি চিন্তা করছে সে। এই বয়সে বাবাকে কাছে না পাওয়া ওর জন্য বড় আঘাত।


২০১৩ সালে নিখোঁজ হওয়া বংশালের ছাত্রদল নেতা পারভেজ হোসেনের সাত বছরের মেয়ে হৃদির মানসিক বিকাশ হচ্ছে না। হৃদির মা জানান, আমার মেয়ে সাত বছর ধরেই রাতে ঘুমাতে পারে না। মেয়ের একটাই দাবি, পাপার বুকে আমি ঘুমাতে চাই। পাপা তো আসে না। প্রতিদিন আমি পাপার জন্য অপেক্ষায় থাকি। কোথায় গিয়েছে পাপা?

পরিবারের প্রধান তথা বাবার অবর্তমানে এসব শিশুর মানসিক বিকাশের প্রতিবন্ধকতা কিভাবে দূর করা যায় সেই বিষয়ে নয়া দিগন্তের এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেছেন রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ও অধ্যাপক ডা: এম এ মোহিত (মোহিত কামাল)। তিনি বলেন, গুমের বিষয়ে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। কাজেই এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্যও নেই। তবে পরিবারের বাবা অথবা মায়ের আদরবঞ্চিত হলে যেকোনো শিশুর মনেই একটা বিরূপ বা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। ওই শিশু অন্যের দ্বারা সহজে প্রভাবিত হবে। বিশেষ করে বাবার আদর না পেলে শিশুরা জীবনে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারে না। তাদের মধ্যে সহনশীলতাও কমে যায়।

তবে পরিবারের অন্য সদস্যরা যদি এই শিশুদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে তাদেরকে আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন তাহলে তাদের মধ্যে কোনো হতাশা থাকবে না বলেও জানান এই মনোবিজ্ঞানী।

  • কার্টসি  — নয়াদিগন্ত/ অক্টোবর ১৬, ২০১৯

Monday, October 14, 2019

ভারত বাংলাদেশকে ময়লার ভাগাড় বানাতে চাইছে কি-না?

সায়েম সাবু, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

সুলতানা কামাল

সুলতানা কামাল।  মানবাধিকার নেত্রী। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের চেয়ারম্যান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। মানবাধিকার ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে।

দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। দীর্ঘ আলোচনায় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যাকাণ্ড, উন্নয়ন ও রাজনীতির বিভিন্ন প্রসঙ্গ উঠে আসে। অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়নে মানুষের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হতে পারে বলে মত দেন। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ: সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ও চুক্তির প্রসঙ্গ নিয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় আপনি বলেছেন, আগে পাকিস্তান শোষণ করেছে, এখন ভারত শোষণ করছে। কেন এমন উপলব্ধি?


সুলতানা কামাল : আমি ঠিক এ ভাষায় বলিনি। আমি বলেছি, পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানে কাঁচামাল সরবরাহের যেমন ক্ষেত্র বানিয়েছিল, এখন ভারতও তেমন একটি ক্ষেত্র বানাতে চাইছে বাংলাদেশকে। ভারতকে তিনটি ইকোনমিক জোন করার অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। সুন্দরবনের কাছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করতে দেয়া হলো ভারতকে। এ ধরনের প্রকল্প তৈরিতে আমরা ভারতের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ দেখতে পাচ্ছি।

ভারতের এমন আচরণ দেখে আমরা দুটি ভাষা ব্যবহার করছি। একটি হচ্ছে, ভারত বাংলাদেশকে ময়লার ভাগাড় বানাতে চাইছে কি-না? আরেকটি হচ্ছে, ভারত বাংলাদেশকে কলকারখানার ক্ষেত্র বানিয়ে ফেলল কি-না? উদাহরণস্বরূপ আমরা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা উল্লেখ করেছি।

জাগো নিউজ : কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশ সরকারও করছে। বিদেশি বিনিয়োগ হতেই পারে…

সুলতানা কামাল : কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আপত্তি এখন সারা বিশ্বেই। ভারতের যে কোম্পানি রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র করছে, সে কোম্পানির বেশ কয়েকটি প্রকল্প ভারত বন্ধ করে দিয়েছে, পরিবেশ দূষণের কথা বলে। আবার একই কোম্পানির আরও কয়েকটি প্রকল্প অর্ধেক দিন পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রাখছে, কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার জন্য।

এমন একটি কোম্পানিকেই বাংলাদেশে প্রকল্প করার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। আমি বলেছি, একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে বড় কষ্ট হয়, যখন দেখি আমাদের শাসকরা বিদেশে গিয়ে বলেন, তোমরা বাংলাদেশে এসে বিনিয়োগ কর। আমার দেশের শ্রম সস্তা। সস্তা শ্রমের কথা বলে বাইরের দেশের বিনিয়োগকারীদের এভাবে আহ্বান করা সত্যিই দুঃখজনক। আমরা সস্তা শ্রমিক দিচ্ছি, বন উজাড় করে দিচ্ছি। উপকূল ধ্বংস করে দিচ্ছি।

এভাবে সব উজাড় করে দিতে থাকলে বিদেশিরা তাদের জন্য বাংলাদেশকে শুধু উৎপাদনের ক্ষেত্রই মনে করবে। অথচ, উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হচ্ছে ভারত বা অন্য দেশের নামে।

জাগো নিউজ : আপনার যুক্তির বিপরীতেও কথা আছে, অন্তত বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান প্রশ্নে…


সুলতানা কামাল : এমন প্রশ্ন তুলেই বিদেশিদের ডেকে আনা হচ্ছে। তাই বলে দেশের সবকিছু ধ্বংস করে এভাবে বিনিয়োগ হতে পারে না।

আমার দেশের প্রচুর মানুষ বাস্তুহারা। প্রতি বছর নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে হাজার হাজার মানুষ ভিটেহারা হচ্ছে। নিজস্ব শিল্পায়নের জন্যও মানুষকে উৎখাত করা হচ্ছে। আমরা এমনই একটি অর্থনীতিতে বাস করছি যে, যাদের শহরে বাড়ি আছে, তারা গ্রামেও বাগানবাড়ি করে রেখেছে। আবাসন প্রকল্পগুলো মানুষকে উৎখাত করছে। উন্নয়নের নামে ঘরহারা মানুষকে আমরা জায়গা দিতে পারছি না।

ঘরহারা এসব মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে বস্তিতে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। আবার নানা কায়দায় সেই বস্তিবাসীকেও উৎখাত করা হচ্ছে। সেটা বস্তিতে আগুন দিয়ে হলেও! শহরে ভাসমান মানুষের সংখ্যা বাড়ছে কেন? এত উন্নয়ন, তাহলে মানুষ রাস্তায় ঘুমাচ্ছে কেন? এ প্রশ্ন তোলা খুবই ন্যায্য। 

মানুষকে পুনর্বাসন না করে বিনিয়োগ হতে পারে না। জীবন বিপন্ন করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জায়গা দিচ্ছি না তো? এমন প্রশ্ন তো সবারই তোলা উচিত। জমি বণ্টনের যে ন্যায্যতা, তা কি আমরা রক্ষা করছি?

জাগো নিউজ : উন্নয়ন করতে হলে তো ক্ষতি কিছুটা মানতে হয়…


সুলতানা কামাল : কতটুকু উন্নয়ন আর কতটুকু ক্ষতি সেটা নিয়ে আলোচনা করা হোক। পরিবেশ ধ্বংস করে, মানুষের জীবন বিপন্ন করে কোনো উন্নয়ন হতে পারে না। কারণ মানুষের জন্যই তো উন্নয়ন। পরিবেশ না থাকলে মানুষ বাঁচবে কী করে?

আমাদের দেশের বিদ্যুতের চাহিদা যতটুকু তার চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। এ পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ রফতানির কথা বলা হচ্ছে। নিজের প্রয়োজনে পরিবেশ খানিক নষ্ট হতে পারে। কিন্তু বন উজাড় করে, পানি-বায়ুদূষণ করে, মাটি নষ্ট করে রফতানির জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের তো কোনো মানে হয় না। অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়নে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল কিন্তু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ধ্বংসের মধ্যে থেকে এমন উন্নয়ন সাধারণ মানুষের কোনো প্রয়োজনে আসেনি।

জাগো নিউজ : তার মানে আপনি এমন উন্নয়নে বিশ্বাস রাখছেন না?


সুলতানা কামাল : উন্নয়ন অবশ্যই দরকার। আমরা উন্নয়নের জন্য এসডিজির (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ অঙ্গীকারে স্পষ্ট করে বলা আছে, এমন উন্নয়ন যেন না হয়, যাতে পরিবেশ নষ্ট হয়। সাধারণ মানুষের ভালোর জন্য, বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য উন্নয়ন হোক।

কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনের বিনিময়ে উন্নয়ন, জীবিকার বিনিময়ে উন্নয়ন, তাদের সম্পদের বিনিময়ে উন্নয়ন কতটুকু ন্যায্য, সেই প্রশ্ন তোলা সময়ের দাবি।

জাগো নিউজ : সরকার তো উন্নয়ন নিয়ে উচ্ছ্বাসিত। জিডিপি, মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে...


সুলতানা কামাল : জিডিপি, মাথাপিছু আয় বাড়ছে- এটি সরকারের হিসাব। কার কত বাড়ল, সে হিসাব থাকাও জরুরি। গড় হিসাব দিয়ে আপনি সার্বিক চিত্র তুলে আনতে পারবেন না।

১৭ কোটি মানুষ। ধরলাম, সেখানে পাঁচ কোটি মানুষ প্রচণ্ডভাবে ধনী হলেন। বাকি ১২ কোটি মানুষের ভাগ্যে কী ঘটল, তার খবরও নিতে হয়। যদি জিডিপি বাড়েই সত্যিকার অর্থে, তাহলে রাজস্ব বাড়ে না কেন? সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাড়ে না কেন?

জাগো নিউজ : সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ তো এ সরকারই বাড়িয়েছে…


সুলতানা কামাল : কেউ কি হলফ করে বলতে পারবেন, একটি গ্রামের প্রত্যেক বিধবা বা দরিদ্র ব্যক্তি ভাতা পাচ্ছেন?

এসব ভাতা নিয়ে আমার প্রচণ্ড ক্ষোভ আছে। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত একটি থোক বরাদ্দ দেয়া হয়। একটি গ্রামে পাঁচজন বিধবা আছেন। থোক বরাদ্দ থেকে তিনজনকে দেয়া হলো। বাকি দুজনের কী হবে?

ওই তিনজনকে বাছাই করতেই দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়। বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়, স্বজনপ্রীতি করা হয়, রাজনৈতিক বিবেচনা গুরুত্ব পায়। এ চিত্র সর্বত্রই।

তার মানে এসব পরিকল্পনার মধ্যেই তো অনেক ত্রুটি রয়ে গেছে। চলমান পরিস্থিতি সত্যিকার উন্নয়নের চিহ্ন বহন করে না।

মাত্র প্রতিবন্ধীদের একটি সংবাদ সম্মেলন থেকে আসলাম। ২০১৩ সালে প্রতিবন্ধী সুরক্ষা অধিকার আইন করা হয়েছে। অথচ, ২০১৯ সালে এসেও সে আইনের কোনো বাস্তবায়ন নেই। আজ তারা সংবাদ সম্মেলন করতে বাধ্য হলো। কমিটি করতে বলা হয়েছে। কমিটি করে না। করলেও তারা কোনো মিটিং করে না।

একজন প্রতিবন্ধী মাসে পাচ্ছেন মাত্র ৭০০ টাকা। সেই টাকা পাচ্ছেন আবার তিন মাস অন্তর। আবার যিনি টাকা দিচ্ছেন, তিনি এক মাসের টাকা কেটে রাখছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুই মাসের টাকাও কেটে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

উন্নয়ন আলোচনা থেকে এ প্রসঙ্গগুলো আসছে। আলোচনা করার প্রেক্ষাপটও আছে। সরকার যখন জিডিপি, মাথাপিছু আয়, উন্নয়ন নিয়ে নানা সূচকের গল্প শোনায়, তখন কিন্তু তালিকাগুলো যোগ করে। আন্তর্জাতিক মহল এ সূচকগুলোর খবর রাখেন না।

বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের জন্য ভাতা দিচ্ছে জেনে অমর্ত্য সেন আনন্দিত হতেই পারেন। কিন্তু তিনি তো জানছেন না, ২১০০ টাকা থেকে ৭০০ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৪০০ টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে কেটে নেয়া হচ্ছে। তিনি সরকারের দেয়া তথ্য থেকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবেন। বাস্তব চিত্র কিন্তু ভয়াবহ!

সরকারের দেয়া তথ্যের সঙ্গে বাস্তবের এ ঘাটতি তো অস্বীকার করতে পারবেন না। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছি বলেই মানুষের এ কষ্ট, অভিযোগ জানতে পারছি। সাধারণ মানুষ কোনো সরকারি লোকের কাছে যেতে পারে না। এমনকি জনপ্রতিনিধিদের কাছেও না। আমলা আর জনপ্রতিনিধিদের যোগসাজশেই দুর্নীতি হচ্ছে।

  • কার্টসিঃ জাগোনিউজ/ অক্টোবর ১৩, ২০১৯। 

Thursday, October 10, 2019

আবরারের স্ট্যাটাস ও ফেনী নদীর পানি

আসিফ নজরুল
ফেসবুকে একটি পোস্ট দেওয়ার পর ছাত্রলীগের হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ। ফেসবুক পোস্টে তিনি বাংলাদেশ-ভারতের সর্বশেষ চুক্তিগুলোর সমালোচনা করেছিলেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ফেনী নদী প্রসঙ্গ। আবরারের আপত্তি বুঝতে হলে বিচ্ছিন্নভাবে শুধু ফেনী চুক্তি না, অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে বাংলাদেশের বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিত দেখতে হবে। আবরার তাঁর পোস্টে সেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এবং এরপর অকালে হারিয়েছেন তাঁর অসীম সম্ভাবনাময় জীবন।

২.
ফেনী নদী থেকে ভারতকে পানি দেওয়া হবে সেকেন্ডে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক, অর্থাৎ প্রায় ৫০ লিটার। প্রতিদিনের হিসাবে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ লিটার পানি। শুকনা মৌসুমে (ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল) ফেনী নদীতে যে পানি পাওয়া যায়, তা বিবেচনায় নিলে এই পরিমাণ পানিকে অনুল্লেখ্য বিবেচনা করার সুযোগ নেই।





বর্তমানে অনেক বাড়িয়ে বলা হলেও ২০০৫ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রকাশিত বাংলাদেশের নদ-নদী গ্রন্থের ৪৪ নম্বর পৃষ্ঠার তথ্য অনুসারে, শুকনা মৌসুমে এই পানির পরিমাণ সর্বনিম্ন মাত্র ৪৭ কিউসেক। মুহুরী সেচ প্রকল্প বাদেও অন্যান্য কারণে ফেনী নদীর পানি তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য। এই পানির একটা অংশ তবু দেওয়া হয়েছে ত্রিপুরার মাত্র হাজার আটেক অধিবাসীর একটি শহরের খাওয়ার পানির চাহিদা মেটানোর জন্য। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এটা দেওয়া হচ্ছে মানবিক কারণে।

ফেনী নদীর সামান্য অংশ সীমান্তে, বাংলাদেশের বিভিন্ন ছড়ার পানি মিলে এটি বেগবান হয়েছে সীমান্ত পার হওয়ার পর। বাংলাদেশ নিম্ন অববাহিকার দেশ বলে এই পানি ভারতকে দেওয়ার কোনো রকম আইনগত বাধ্যবাধকতা বাংলাদেশের নেই। মানবিক কারণ ছাড়া এ পানি দেওয়ার তাই কোনো কারণ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, মানবিকতা কি শুধু একতরফা একটি বিষয়? মানবিকতা দূরের কথা, এমনকি আইনগত অধিকারগুলো কি আমরা ভারত থেকে পেয়েছি অভিন্ন নদীর পানির ক্ষেত্রে? কিংবা অন্য অনেক ক্ষেত্রে?

আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিতে ‘ভাইটাল হিউম্যান নিডস’ বলে একটি কথা আছে। খাওয়ার পানি ও জীবন-জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয় শস্য উৎপাদনে ব্যবহৃত পানিকে ভাইটাল হিউম্যান নিডস বলা হয়। এসব কারণে এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য অভিন্ন ৫৪টি নদ-নদী থেকে পানি পাওয়া খুব জরুরি বাংলাদেশের জন্য। সেই আলোকে ১৯৮৬ সালে গঙ্গা বাদে আরও আটটি বড় অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি করা হবে—বলেছিল দুই দেশের জয়েন্ট কমিটি অব এক্সপার্ট। ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তিতে সব অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে চুক্তি করার কথা বলা আছে। কিন্তু গত কয়েক দশকে এই ভাগাভাগির চুক্তি আর হয়নি।

ভারতের যুক্তি, এসব নদীর পানিপ্রবাহের পরিমাণ নিয়ে দুই দেশের তথ্যে গরমিল আছে। গত মাসেও ভারত বলেছে, এ বিষয়ে আগে স্বীকৃত তথ্য মিলুক, ভাগাভাগি চূড়ান্ত হবে তারপর। ভারতের পানিসচিব বাংলাদেশে এসে বললেন, আটটি নদীর (মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা, ফেনী, তিস্তা ও দুধকুমার) পানি ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ ভাগাভাগির বিষয়ে তাঁরা ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে অগ্রগতি আশা করছেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে সমঝোতা হলো শুধু ফেনীর বিষয়ে। এমনকি ২০১১ সাল থেকে ঝুলে থাকা তিস্তার বিষয়ে কোনো নতুন কথা শোনা গেল না।

এসব চুক্তি কবে হবে, তা নিয়ে আবরারের মতো বাংলাদেশের যেকোনো মানুষের হতাশা স্বাভাবিক। কারণ, অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে ভারতের অনীহার তথ্য আমরা বহু সময় পেয়েছি। দুই দেশের সচিব পর্যায়ের মিটিংটি গত মাসে হয়েছে প্রায় আট বছর পর। যৌথ নদী কমিশনে মন্ত্রী পর্যায়ে মিটিং শেষবার হয়েছে ২০১০ সালে। এরপর বহুবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিটিং করার প্রস্তাব দেওয়া হলেও সাড়া মেলেনি। আন্তনদী-সংযোগ প্রকল্প নিয়ে যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে ভারত, তাতে বাংলাদেশের পানির চাহিদা কীভাবে সমন্বয় করা হবে, তা নিয়ে এবারও কিছু বলেনি তারা।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ফেনী নদীর পানি ভারতকে দিতে রাজি হওয়ার বিষয়টি বহু মানুষকে ক্ষুব্ধ করতেই পারে।

৩.
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে আরও বেশ কয়েকটি। প্রশ্ন উঠেছে সেসব নিয়েও। বাংলাদেশ ভারতে তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস রপ্তানি করতে রাজি হয়েছে। বিদ্যমান সড়কব্যবস্থার ওপর এর প্রভাব, পরিবহনঝুঁকি আর বাংলাদেশের জ্বালানিনিরাপত্তা স্পষ্ট করা হয়নি দুই দেশের প্রকাশিত তথ্যে।

নতুন একটি চুক্তি অনুসারে ভারত বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে নজরদারি করার জন্য রাডার সিস্টেম বসাবে। এমন রাডার সিস্টেম ভারত বসাতে পেরেছে মালদ্বীপ, মরিশাস আর সেশেলসের মতো ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলোয়। সেই কাতারে আমরা নামলাম কিসের বিনিময়ে? এই সার্ভিল্যান্সের নিয়ন্ত্রণ থাকবে কার হাতে?

প্রশ্ন আছে অন্য বিষয়গুলো নিয়েও। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম আর মোংলা বন্দর ব্যবহারের বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে, কিন্তু ভারতের কোনো বন্দর বাংলাদেশের ব্যবহারের কথা নেই কেন? বাংলাদেশের সঙ্গে ভুটান আর নেপালের সরাসরি সংযোগের জন্য ভারতের স্থল করিডর ব্যবহার প্রসঙ্গে কোনো অগ্রগতি নেই কেন এবারও? বহু আশ্বাসের পরও সীমান্তে বাংলাদেশের মানুষ হত্যা অব্যাহত রয়েছে। এ বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই কেন কোথাও?

ভারত থেকে আমরা পেয়েছি সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা বিনিময়ের কিছু সহায়তা, যার গুরুত্ব অনুল্লেখ্য। যেমন রামকৃষ্ণ মিশনে ছাত্রাবাস নির্মাণ বা খুলনায় একটি পেশাজীবী প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপনে সহায়তা। ভারত বাংলাদেশকে ঋণসহায়তা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে। এই ঋণের শর্ত নিয়েও প্রশ্ন আছে দেশে।

৪.
ভারত সফরে যাওয়ার আগে দুটো বিষয় নিয়ে উদ্বেগের কথা বলেছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। এসবের কোনো সদুত্তরও আসেনি দুই দেশের চুক্তি, সমঝোতা বা যৌথ বিবৃতিতে। গণহত্যা করে মিয়ানমার থেকে অমানবিকভাবে ঠেলে দেওয়া হয়েছে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে। এমন একটা ইস্যুতে সর্বশেষ হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ভোটদানে বিরত থেকেছে ভারত। এ বিষয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ ও প্রত্যাশা কতটা গুরুত্বহীন, তা আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে। ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি পর্যন্ত উল্লেখ না করে সেখানে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষদের সহায়তার অঙ্গীকার করেছে ভারত। কিন্তু আমরা তো খাবার, কম্বল বা তাঁবুর মতো পুনর্বাসন সহায়তা চাইনি ভারতের কাছে, আমাদের প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজভূমিতে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে ভারতের সমর্থন ও সহায়তা। দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে তার প্রতিফলন নেই।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী উত্কণ্ঠা জানিয়েছিলেন ভারতের জাতীয় নাগরিক তালিকা (এনআরসি) নিয়ে। আসামের পর এমন এনআরসি করার তোড়জোড় হচ্ছে ভারতের আরও কিছু রাজ্যে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা প্রকাশ্যেই বলছেন, এনআরসি থেকে বাদ পড়া লোকজনকে ফেরত পাঠানো হবে বাংলাদেশে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগের জবাবে মৌখিকভাবে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে এ নিয়ে বাংলাদেশের চিন্তার কিছু নেই, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সত্যি চিন্তার কিছু না থাকলে তার উল্লেখ বা আশ্বাস যৌথ বিবৃতিতে নেই কেন?

‘চিন্তার কিছু নেই’ বা ‘বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না’—এসব আশ্বাস রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে যথেষ্টও নয়। এর আগে বাংলাদেশের জন্য চরম ক্ষতিকর ফারাক্কা ব্যারাজ চালুর আগে এক দশক ধরে ভারত তা-ই বলে এসেছিল। মাত্র কয়েক বছর আগে পরিত্যক্ত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের ক্ষেত্রে একই কথা বলেছিল ভারত। কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়া আশ্চর্যজনকভাবে একই কথা বলেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের কিছু মন্ত্রীও।

এনআরসি নিয়ে একই ধরনের আভাস পাই ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকার কাছে দেওয়া বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টার ৬ অক্টোবরের সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেছেন, ভারতে সব প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর নিজেদের যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত আছে বাংলাদেশ। এই বক্তব্য কী বার্তা দেবে ভারতকে?

৫.
দুই দেশের সম্পর্ক শুধু নীতিনির্ধারকদের সম্পর্ক নয়; এটি দুই দেশের জনগণের সম্পর্কও হতে হয়। প্রশ্নবিদ্ধ সংসদ, দুর্বল আমলাতন্ত্র, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অতিকেন্দ্রিকতা এবং জাতীয় ঐক্য সৃষ্টিতে অনীহার কারণে ভারতের সঙ্গে আমরা দর-কষাকষি শক্তি অনেকটুকু হারিয়েছি।

এ সুযোগে বাংলাদেশ থেকে বহু একতরফা সুবিধা নিচ্ছে ভারত। ফেনী চুক্তিসহ এবার স্বাক্ষরিত অন্য সমঝোতাগুলো এর নতুন উদাহরণ মাত্র। এসব অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের মানুষের মনে ভারত নিয়ে অস্বস্তি আরও বাড়বে।

দীর্ঘ মেয়াদে দুই দেশের সম্পর্কে এর নেতিবাচক প্রভাব হতে পারে মারাত্মক। আবরারের হত্যাকাণ্ডের পর মানুষের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় সেই ইঙ্গিত রয়েছে।

  • আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ অক্টোবর ১০, ২০১৯