সায়েম সাবু, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
সুলতানা কামাল |
সুলতানা কামাল। মানবাধিকার নেত্রী। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের চেয়ারম্যান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। মানবাধিকার ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে।
দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। দীর্ঘ আলোচনায় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যাকাণ্ড, উন্নয়ন ও রাজনীতির বিভিন্ন প্রসঙ্গ উঠে আসে। অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়নে মানুষের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হতে পারে বলে মত দেন। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ: সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ও চুক্তির প্রসঙ্গ নিয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় আপনি বলেছেন, আগে পাকিস্তান শোষণ করেছে, এখন ভারত শোষণ করছে। কেন এমন উপলব্ধি?
সুলতানা কামাল : আমি ঠিক এ ভাষায় বলিনি। আমি বলেছি, পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানে কাঁচামাল সরবরাহের যেমন ক্ষেত্র বানিয়েছিল, এখন ভারতও তেমন একটি ক্ষেত্র বানাতে চাইছে বাংলাদেশকে। ভারতকে তিনটি ইকোনমিক জোন করার অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। সুন্দরবনের কাছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করতে দেয়া হলো ভারতকে। এ ধরনের প্রকল্প তৈরিতে আমরা ভারতের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ দেখতে পাচ্ছি।
ভারতের এমন আচরণ দেখে আমরা দুটি ভাষা ব্যবহার করছি। একটি হচ্ছে, ভারত বাংলাদেশকে ময়লার ভাগাড় বানাতে চাইছে কি-না? আরেকটি হচ্ছে, ভারত বাংলাদেশকে কলকারখানার ক্ষেত্র বানিয়ে ফেলল কি-না? উদাহরণস্বরূপ আমরা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা উল্লেখ করেছি।
জাগো নিউজ : কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশ সরকারও করছে। বিদেশি বিনিয়োগ হতেই পারে…
সুলতানা কামাল : কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আপত্তি এখন সারা বিশ্বেই। ভারতের যে কোম্পানি রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র করছে, সে কোম্পানির বেশ কয়েকটি প্রকল্প ভারত বন্ধ করে দিয়েছে, পরিবেশ দূষণের কথা বলে। আবার একই কোম্পানির আরও কয়েকটি প্রকল্প অর্ধেক দিন পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রাখছে, কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার জন্য।
এমন একটি কোম্পানিকেই বাংলাদেশে প্রকল্প করার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। আমি বলেছি, একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে বড় কষ্ট হয়, যখন দেখি আমাদের শাসকরা বিদেশে গিয়ে বলেন, তোমরা বাংলাদেশে এসে বিনিয়োগ কর। আমার দেশের শ্রম সস্তা। সস্তা শ্রমের কথা বলে বাইরের দেশের বিনিয়োগকারীদের এভাবে আহ্বান করা সত্যিই দুঃখজনক। আমরা সস্তা শ্রমিক দিচ্ছি, বন উজাড় করে দিচ্ছি। উপকূল ধ্বংস করে দিচ্ছি।
এভাবে সব উজাড় করে দিতে থাকলে বিদেশিরা তাদের জন্য বাংলাদেশকে শুধু উৎপাদনের ক্ষেত্রই মনে করবে। অথচ, উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হচ্ছে ভারত বা অন্য দেশের নামে।
জাগো নিউজ : আপনার যুক্তির বিপরীতেও কথা আছে, অন্তত বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান প্রশ্নে…
সুলতানা কামাল : এমন প্রশ্ন তুলেই বিদেশিদের ডেকে আনা হচ্ছে। তাই বলে দেশের সবকিছু ধ্বংস করে এভাবে বিনিয়োগ হতে পারে না।
আমার দেশের প্রচুর মানুষ বাস্তুহারা। প্রতি বছর নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে হাজার হাজার মানুষ ভিটেহারা হচ্ছে। নিজস্ব শিল্পায়নের জন্যও মানুষকে উৎখাত করা হচ্ছে। আমরা এমনই একটি অর্থনীতিতে বাস করছি যে, যাদের শহরে বাড়ি আছে, তারা গ্রামেও বাগানবাড়ি করে রেখেছে। আবাসন প্রকল্পগুলো মানুষকে উৎখাত করছে। উন্নয়নের নামে ঘরহারা মানুষকে আমরা জায়গা দিতে পারছি না।
ঘরহারা এসব মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে বস্তিতে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। আবার নানা কায়দায় সেই বস্তিবাসীকেও উৎখাত করা হচ্ছে। সেটা বস্তিতে আগুন দিয়ে হলেও! শহরে ভাসমান মানুষের সংখ্যা বাড়ছে কেন? এত উন্নয়ন, তাহলে মানুষ রাস্তায় ঘুমাচ্ছে কেন? এ প্রশ্ন তোলা খুবই ন্যায্য।
মানুষকে পুনর্বাসন না করে বিনিয়োগ হতে পারে না। জীবন বিপন্ন করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জায়গা দিচ্ছি না তো? এমন প্রশ্ন তো সবারই তোলা উচিত। জমি বণ্টনের যে ন্যায্যতা, তা কি আমরা রক্ষা করছি?
জাগো নিউজ : উন্নয়ন করতে হলে তো ক্ষতি কিছুটা মানতে হয়…
সুলতানা কামাল : কতটুকু উন্নয়ন আর কতটুকু ক্ষতি সেটা নিয়ে আলোচনা করা হোক। পরিবেশ ধ্বংস করে, মানুষের জীবন বিপন্ন করে কোনো উন্নয়ন হতে পারে না। কারণ মানুষের জন্যই তো উন্নয়ন। পরিবেশ না থাকলে মানুষ বাঁচবে কী করে?
আমাদের দেশের বিদ্যুতের চাহিদা যতটুকু তার চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। এ পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ রফতানির কথা বলা হচ্ছে। নিজের প্রয়োজনে পরিবেশ খানিক নষ্ট হতে পারে। কিন্তু বন উজাড় করে, পানি-বায়ুদূষণ করে, মাটি নষ্ট করে রফতানির জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের তো কোনো মানে হয় না। অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়নে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল কিন্তু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ধ্বংসের মধ্যে থেকে এমন উন্নয়ন সাধারণ মানুষের কোনো প্রয়োজনে আসেনি।
জাগো নিউজ : তার মানে আপনি এমন উন্নয়নে বিশ্বাস রাখছেন না?
সুলতানা কামাল : উন্নয়ন অবশ্যই দরকার। আমরা উন্নয়নের জন্য এসডিজির (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ অঙ্গীকারে স্পষ্ট করে বলা আছে, এমন উন্নয়ন যেন না হয়, যাতে পরিবেশ নষ্ট হয়। সাধারণ মানুষের ভালোর জন্য, বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য উন্নয়ন হোক।
কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনের বিনিময়ে উন্নয়ন, জীবিকার বিনিময়ে উন্নয়ন, তাদের সম্পদের বিনিময়ে উন্নয়ন কতটুকু ন্যায্য, সেই প্রশ্ন তোলা সময়ের দাবি।
জাগো নিউজ : সরকার তো উন্নয়ন নিয়ে উচ্ছ্বাসিত। জিডিপি, মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে...
সুলতানা কামাল : জিডিপি, মাথাপিছু আয় বাড়ছে- এটি সরকারের হিসাব। কার কত বাড়ল, সে হিসাব থাকাও জরুরি। গড় হিসাব দিয়ে আপনি সার্বিক চিত্র তুলে আনতে পারবেন না।
১৭ কোটি মানুষ। ধরলাম, সেখানে পাঁচ কোটি মানুষ প্রচণ্ডভাবে ধনী হলেন। বাকি ১২ কোটি মানুষের ভাগ্যে কী ঘটল, তার খবরও নিতে হয়। যদি জিডিপি বাড়েই সত্যিকার অর্থে, তাহলে রাজস্ব বাড়ে না কেন? সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাড়ে না কেন?
জাগো নিউজ : সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ তো এ সরকারই বাড়িয়েছে…
সুলতানা কামাল : কেউ কি হলফ করে বলতে পারবেন, একটি গ্রামের প্রত্যেক বিধবা বা দরিদ্র ব্যক্তি ভাতা পাচ্ছেন?
এসব ভাতা নিয়ে আমার প্রচণ্ড ক্ষোভ আছে। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত একটি থোক বরাদ্দ দেয়া হয়। একটি গ্রামে পাঁচজন বিধবা আছেন। থোক বরাদ্দ থেকে তিনজনকে দেয়া হলো। বাকি দুজনের কী হবে?
ওই তিনজনকে বাছাই করতেই দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়। বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়, স্বজনপ্রীতি করা হয়, রাজনৈতিক বিবেচনা গুরুত্ব পায়। এ চিত্র সর্বত্রই।
তার মানে এসব পরিকল্পনার মধ্যেই তো অনেক ত্রুটি রয়ে গেছে। চলমান পরিস্থিতি সত্যিকার উন্নয়নের চিহ্ন বহন করে না।
মাত্র প্রতিবন্ধীদের একটি সংবাদ সম্মেলন থেকে আসলাম। ২০১৩ সালে প্রতিবন্ধী সুরক্ষা অধিকার আইন করা হয়েছে। অথচ, ২০১৯ সালে এসেও সে আইনের কোনো বাস্তবায়ন নেই। আজ তারা সংবাদ সম্মেলন করতে বাধ্য হলো। কমিটি করতে বলা হয়েছে। কমিটি করে না। করলেও তারা কোনো মিটিং করে না।
একজন প্রতিবন্ধী মাসে পাচ্ছেন মাত্র ৭০০ টাকা। সেই টাকা পাচ্ছেন আবার তিন মাস অন্তর। আবার যিনি টাকা দিচ্ছেন, তিনি এক মাসের টাকা কেটে রাখছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুই মাসের টাকাও কেটে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
উন্নয়ন আলোচনা থেকে এ প্রসঙ্গগুলো আসছে। আলোচনা করার প্রেক্ষাপটও আছে। সরকার যখন জিডিপি, মাথাপিছু আয়, উন্নয়ন নিয়ে নানা সূচকের গল্প শোনায়, তখন কিন্তু তালিকাগুলো যোগ করে। আন্তর্জাতিক মহল এ সূচকগুলোর খবর রাখেন না।
বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের জন্য ভাতা দিচ্ছে জেনে অমর্ত্য সেন আনন্দিত হতেই পারেন। কিন্তু তিনি তো জানছেন না, ২১০০ টাকা থেকে ৭০০ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৪০০ টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে কেটে নেয়া হচ্ছে। তিনি সরকারের দেয়া তথ্য থেকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবেন। বাস্তব চিত্র কিন্তু ভয়াবহ!
সরকারের দেয়া তথ্যের সঙ্গে বাস্তবের এ ঘাটতি তো অস্বীকার করতে পারবেন না। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছি বলেই মানুষের এ কষ্ট, অভিযোগ জানতে পারছি। সাধারণ মানুষ কোনো সরকারি লোকের কাছে যেতে পারে না। এমনকি জনপ্রতিনিধিদের কাছেও না। আমলা আর জনপ্রতিনিধিদের যোগসাজশেই দুর্নীতি হচ্ছে।
- কার্টসিঃ জাগোনিউজ/ অক্টোবর ১৩, ২০১৯।
No comments:
Post a Comment