Search

Thursday, October 31, 2019

১৪ দলের শরিকদের চোখে জাতীয় নির্বাচন

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
আওয়ামী লীগ ও তাদের সঙ্গীসাথীরা ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে দিনে-রাতে কীভাবে ভোট জালিয়াতি করে ফলাফল নিজেদের পক্ষে নিয়েছে সেটা শুধু জানেই না, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেও। এবং এটা বলার মধ্যে এক ধরনের তৃপ্তিও লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। তাদের ভাবখানা এমন যে আওয়ামী লীগ কতটা চৌকস ও কৌশলী দল যে এভাবে রাতে-দিনে ভোট নেওয়ার পরও বিএনপি কোনো তথ্যপ্রমাণ হাজির করতে পারেনি। প্রতিরোধ তো দূরের কথা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, বিভিন্ন সংস্থা ও পর্যবেক্ষকদের মতামত তুলে ধরে নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তোলার পর আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযাত্রীরা বলে থাকেন, প্রমাণ দেখান। কিছু যৌক্তিক তথ্য তুলে ধরার পর যখন আর জুতসই কোনো জবাব আর তাদের হাতে থাকে না তখন একটাই কথা, এত জালিয়াতি হলে জনগণ রুখে দাঁড়াল না কেন? বিএনপি কেন পারল না জনগণকে মাঠে নামাতে? এ কথা শুধু আওয়ামী লীগ নয়, তাদের পক্ষ নেওয়া সাংবাদিক, শিক্ষকরা পর্যন্ত বলে থাকেন। প্রতিরোধ করতে পারল না বলে সব দায় যেন বিএনপির, সব দায় জনগণের। যারা জালিয়াতিটা করল তাদের কোনো দায় নেই!

‘অফ দ্য রেকর্ড’ যে কথাটি আওয়ামী লীগের অনেকে  বলেন, তাদের পক্ষ নেওয়া শিক্ষক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরাও যা বলেন, তাই বলেছেন তাদের জোটসঙ্গী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা নৌকার এমপি রাশেদ খান মেনন। কিন্তু সমস্যা হলো, তিনি বলে ফেলেছেন অন দ্য রেকর্ড। ব্যস, তিনি হয়ে গেলেন নির্বাচনে জালিয়াতির রাজসাক্ষী। আর আওয়ামী লীগের কাছে রাজ ভিলেন। মেনন বলেছেন, ‘বিগত নির্বাচনে আমিও নির্বাচিত (এমপি) হয়েছি। তারপরও আমি সাক্ষ্য দিয়ে বলছি, গত নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। জাতীয়, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কোথাও ভোট দিতে পারেনি দেশের মানুষ। প্রধানমন্ত্রী, আপনি-আমি মিলে যে ভোটের জন্য লড়াই করেছি, আজিজ কমিশনকে ঘেরাও করেছি, আমরা এক কোটি ১০ লাখ ভুয়া ভোটার তালিকা ছিঁড়ে ফেলে নির্বাচন বর্জন করেছি মনোনয়ন জমা দেওয়ার পরেও। আজ কেন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং জাতীয় নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে আসবে না? সরকারের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশে লুণ্ঠন, দুর্নীতি, মহামারি আকার ধারণ করেছে। উন্নয়ন মানে গণতন্ত্র হরণ নয়, উন্নয়ন মানে ভিন্ন মতের সংকোচন নয়, উন্নয়ন মানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ নয়, উন্নয়ন মানে গণতন্ত্রের স্পেস (সুযোগ) কমিয়ে দেওয়া নয়। সারা দেশে মানবিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয় ঘটেছে।’

মেননের এ কনফেশনাল স্টেটমেন্ট বা অনুশোচনাকে অনেকে রাষ্ট্রীয় অপকর্মের রাজসাক্ষী হিসেবে দেখছেন। কিন্তু নৌকার এমপি রাশেদ খান মেননের এই কথায় চটেছে নৌকার আসল মালিক আওয়ামী লীগ। তারা শোকজ করেছে। অনেকেই বলেছেন, রাশেদ খান মেনন ক্যাসিনোকা-ে ধরা খেয়ে গেছেন। কার থেকে মাসে কত টাকা চাঁদা খেয়েছেন সে সব হিসাব রিমান্ডের তথ্য হিসেবে পত্রিকায় ছাপা হতে শুরু করেছে। তার পতন অবধারিত। গণমানুষের সহানুভূতি আদায় করে সেই ড্যামেজ কিঞ্চিৎ কমানোর কৌশল হিসেবেই তিনি রাজসাক্ষী হয়েছেন। এমন একটা আবহ তৈরির চেষ্টা করেছেন যে মানুষের যেন মনে হয় তিনি নির্বাচন প্রশ্নে সত্য কথা বলায় সরকার তার বিরুদ্ধে ক্যাসিনোকা- ও চাঁদাবাজির মতো অভিযোগে হেনস্তা করছে। কিন্তু তাদের হয়তো স্মৃতিতে নেই যে রাশেদ খান মেনন এর আগেও নির্বাচন নিয়ে প্রায় কাছাকাছি বক্তব্য দিয়েছেন। তখন নিজেকে রক্ষা করে সামগ্রিকভাবে খারাপ নির্বাচন হওয়ার তত্ত্ব হাজির করেছিলেন এবং তার জন্য বিএনপির ইট মেরে পাটকেল খাওয়ার থিওরি দিয়েছিলেন। তিনি ৩০ জানুয়ারি ২০১৯ বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও সরকারবিরোধী দলগুলো থেকে একাদশ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে সে বিষয়ে বলেছিলেন, প্রত্যেকটি নির্বাচনেই এসব অভিযোগ ওঠে। যারা অভিযোগ করছে, তাদের একটি কথা বলতে চাই, ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়। তারা ২০০৬ সালে ইট মেরে ছিল, সেটা কি ভুলে গেছে? কীভাবে আজিজ কমিশনকে দিয়ে ভুয়া ভোটার তালিকা তৈরি করেছিল? এবার তার একটা পাল্টা জবাব পেয়েছে। এখন এটা নিয়ে চিৎকার করে লাভ কী! গণতন্ত্রের কথা বলে লাভ নেই! তাদের মুখে গণতন্ত্রের কথা শোভা পায় না! আর অন্য যারা গণতন্ত্রের কথা বলছে, তারাও সুযোগ পেলে একই কাজ করত। সেই ’৮৬ সালে বামরা, আমাদের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো শেখ হাসিনার সঙ্গে মিলে নির্বাচন করেনি? সেই নির্বাচনে কী হয়েছিল, তা সবার জানা আছে। এরশাদের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে কে কয়টা সিট পাবে, সবই তো ঠিক ছিল সেই সময়। সুতরাং বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে অনেক ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনের কলঙ্ক যদি লেগে থাকে, তাহলে সব রাজনৈতিক দল বা সবার গায়ে কলঙ্ক লেগেছে। অর্থাৎ ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে যে একটা কলঙ্ক সৃষ্টি করেছে তা তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন। শুধু রাশেদ খান মেননই নন, জোটের আরেক দল জাসদের একাংশের নেতা সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনুও নির্বাচন নিয়ে তার মনোভাব প্রকাশ করেছেন। জোটের শরিক জাসদের আরেক অংশও কাছাকাছি মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু বা মইনুদ্দিন বাদল কোন প্রক্রিয়ায় কতটুকু বললেন তা নিয়ে বিচলিত হওয়ার দল আওয়ামী লীগ নয়। বরং তারা বুক ফুলিয়ে তাদের মনোভাব প্রকাশ করেন, দেখো, আমরাই পারি। তারপরও ওপরে থুথু ছিটিয়ে নিজের গায়ে মাখলেন কেন মেনন? এর সঠিক কারণটি তুলে ধরেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, রাশেদ খান মেনন যদি আজ মন্ত্রী হতেন তবে কি এ কথা বলতেন! কথা তো সত্যি। রাশেদ খান মেনন তো আওয়ামী লীগ সরকারের গত আমলে মন্ত্রী ছিলেন। তখন কি ২০১৪ সালের বিনা ভোটের এমপি হওয়ার নৈতিকতা নিয়ে কিছু বলেছেন? একবারও কি বলেছেন, তিনিসহ যে ১৫৪ জন বিনা ভোটে কাগুজে এমপি তারা প্রকৃত জনপ্রতিনিধি নন?

তবে প্রথম দিকে মন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরে সমালোচনা করতেন। অনেকেরই হয়তো মনে থাকতে পারে, তখন মন্ত্রী পরিষদের বাইরে থাকা রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের সরকারের কর্মকাণ্ডের কড়া সমালোচনা করে প্রকাশ্যে বিরক্তি প্রকাশ করতেন। শেখ হাসিনা তখন তাদের মন্ত্রী বানিয়ে মুখবন্ধ করেছিলেন। রাশেদ খান মেনন হয়তো এবারও সেই ফর্মুলা প্রয়োগ করতে চেয়েছেন। তিনি তার স্ত্রীকে সংরক্ষিত নারী কোটায় এমপি বানিয়েই তুষ্ট থাকতে পারেননি। এই সরকারকে এত বড় অনৈতিক কাজে সহযোগিতার পর তার প্রাপ্তি আরও বেশি হবে বলে হয়তো মনে করেন। তা না পেয়ে নিজের দাম বাড়াতেই তিনি সমালোচনার পথ ধরেছিলেন বলে ওবায়দুল কাদেরের মতোই অনেকে মনে করেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি যে একই ফর্মুলায় বারবার শিকে ছিঁড়ে না। তাই এখন তাকে তার বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে হচ্ছে। লিখিত কৈফিয়ত দিয়ে বলতে হচ্ছে, তার বক্তব্য নাকি মিডিয়া খণ্ডিতভাবে প্রকাশ করেছে। তিনি নাকি আগের নির্বাচনগুলোর অনিয়ম সম্পর্কে বলতে গিয়ে ধারাবাহিকভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গে বলেছেন। কিন্তু মিডিয়া শুধু তার শেষ অংশটুকুই খণ্ডিতভাবে প্রকাশ করেছে। মিডিয়া তো তার দীর্ঘ বক্তব্যের পুরোটা প্রকাশ করার দায়িত্ব নেয়নি। মিডিয়া যতটুকু প্রকাশ করা যৌক্তিক মনে করে ততটুকুই তো করবে। কিন্তু মেনন সাহেব কি বলতে পেরেছেন যে যে কথা মিডিয়া প্রকাশ করেছে তা তিনি বলেননি?


বঙ্গবন্ধুর ১৯৭৩, জিয়াউর রহমানের ১৯৭৯, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ বা তার পরবর্তী নির্বাচনগুলো নিয়ে একক পক্ষ থেকে একেক রকম মূল্যায়ন ও সমালোচনা আছে। বিএনপি আমলের নির্বাচনের সমালোচনা করা তো আওয়ামী লীগ ও মেনন সাহেবরা নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে পালন করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। সেই সব অভিযোগ আর ২০১৪ বা ২০১৮ এর নির্বাচন নিয়ে রাশেদ খান মেননের কনফেশনাল স্টেটমেন্ট কি এক কথা হলো! কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা, রাশেদ খান মেননের এই বক্তব্য অভিনন্দিত হয়নি সরকারবিরোধী পক্ষ বিশেষ করে বিএনপি থেকেও। কারণ তারা নৌকার এই এমপির সমালোচনার মধ্যে কোনো সততা খুঁজে পাননি। রাশেদ খান মেনন আগে নিজে পদত্যাগ করে তারপর এ সমালোচনার বাক্সটি খুললে সেটা হতো একটি সৎ উদ্যোগ। কোনো সুবিধাবাদী রাজনীতিকের পক্ষে পদের লোভ ত্যাগ করা সত্যিই কঠিন।

  • লেখক চিকিৎসক ও কলামিস্ট । 
  • কার্টসি — দেশরূপান্তর/ বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ৩১, ২০১৯

No comments:

Post a Comment