রফিকুজজামান রুমান
অফুরান চোখের পানিতে ভেসে যাচ্ছে সব। ফেনী নদী থেকে যত কিউসেক পানি নিয়ে যাবে ভারত, হয়তো তার চেয়েও বেশি অশ্রু ঝরেছে আবরারের মা-বাবার চোখ থেকে; অসহায়ত্বের শিকল পরা এদেশের অগণন মানুষের চোখ থেকে। কিন্তু বিশ্বাস করুন প্রিয় পাঠক, চোখের পানিতে এর সমাধান নেই। চোখের পানিতে পৃথিবীতে কখনো কোনো বিপ্লব হয়নি; পরিবর্তন ঘটেনি।
চুক্তি না-হওয়া তিস্তা নদীতে ভরা বর্ষায় জল এসে বন্যা হয় যত পানিতে, এদেশের মায়েদের কান্নার কাছে হার মানে সেই প্রবাহ। আবু বকরের মা কাঁদে, শরীফুজ্জামান নোমানীর মা কাঁদে, ফারুক হোসেনের মা কাঁদে; কাঁদতে কাঁদতে চলে যায় দিন, মাস, বছর; বিচারের বাণীও নিভৃতে কাঁদে! নয় বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুবকর সিদ্দিককে হত্যা করা হয়। সাত বছরের মধ্যে খালাস পেয়ে যায় ১০ আসামির সবাই! আবুবকর কি তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে? মা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেলে আবুবকর হয়তো আসে। এসে বলে, ‘আমি ছিলাম তোমাদের আশার আলো।
কুৎসিত রাজনীতির ভয়াল থাবা নৃশংস কালিমা হয়ে সে আশায় চিরস্থায়ী আঁধার-প্রলেপ বসিয়ে দিয়েছে। তিল তিল করে তোমরা আমাকে বড় করে তুলেছিলে। আর তার চেয়েও বড় করেছিলে আমাকে নিয়ে তোমাদের নির্মিত স্বপ্নের পরিধি। আমি সেই স্বপ্নের নাগালও পেয়েছিলাম মা! কিন্তু পরাজিত মানবতার শূন্য পীঠে আজ সেই স্বপ্ন শুধুই হাহাকার করে ফিরে আসে। আমার নির্দোষ নিষপ্রাণ রক্তাক্ত দেহেই তোমার সমস্ত স্বপ্নের যবনিকাপাতের উদ্বোধনী ঘোষণা হয়ে গেল মা!’ আবুবকরের বাবা দিনমজুর। টেনেটুনে সংসার চালাতে হতো বলে মা রাবেয়া খাতুন তিন বছর মাথায় তেল না দিয়ে সেই টাকা আবুবকরের পড়াশুনার খরচের জন্য জমাচ্ছিলেন। ছেলের পড়াশুনার জন্য মা মাথায় তেল দিচ্ছেন না এমন এক রাষ্ট্রে, যেখানে নরপশুরা গড়ে তুলছে সম্পদের পাহাড়, ক্যাসিনো সাম্রাজ্য।
এমন রাষ্ট্রে কান্নাই শেষ কথা নয়। ২০০৯ সাল থেকে কেঁদে চলেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন হওয়া শরীফুজ্জামান নোমানীর মা। কান্না থামলেই প্রশ্ন করেন, ‘তোমরা বলো, কী অপরাধ ছিল আমার নোমানীর? আজ আমার নোমানী যদি থাকতো, আমার বুকের সমস্ত শূন্যতা পূরণ হয়ে যেত।’ কার কাছে এই প্রশ্ন? রাষ্ট্রের কাছে? এই রাষ্ট্র কি জীবিত?
আবরারের লাশ যখন পৌঁছালো মায়ের কাছে, বুকফাটা কান্নায় মায়ের প্রশ্ন, ‘আমার বাবা, ওরা তোমার কোথায় মেরেছে? তুমি কেন আমায় ছেড়ে চলে গেলে?’ মায়ের আদরে, ভালোবাসায়, নিখাঁদ ছোঁয়ায় গড়ে উঠেছিল আবরারের যে শরীর, তাতে হায়েনার লাঠির আঘাতের তামাটে চিহ্ন- পৃথিবীর কোন মা পারেন এমন দৃশ্য মেনে নিতে? ‘ওরা তোমার কোথায় মেরেছে’- ফুলের টোকাও লাগতে দেইনি তোমার যে শরীরে, যে শরীরে আমার নির্ঘুম রাত জাগার ছাপ, যে শরীরে আমার ভালোবাসার অসংখ্য চুমু, তিলে তিলে যে শরীরে নির্মিত হচ্ছিল স্বপ্ন আর সম্ভাবনারা, যে শরীর প্রতিদিন জায়নামাজে লুটিয়ে পড়তো প্রভুর ডাকে; সেই শরীরের কোন জায়গাটায় ওরা মেরেছে? মা রোকেয়া খাতুন জবাব খুঁজে পান না।
কোথাও আজ কোনো জবাব নেই। নেই জবাবদিহিতা। গত দশ বছরে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই কমপক্ষে ২৪ শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়েছে। বিচার হয়নি কোনোটিরই। এ এক অদ্ভুত আঁধারে ঢেকে থাকা সময়। ইচ্ছে হলেই পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা যায়। গুজব ছড়িয়ে মানুষ হত্যা করা যায়। ভিন্নমত ধারণ করলে তাকে পিটিয়ে মারা যায়। ব্যর্থতার নির্লজ্জ হাসিতে সবকিছু জায়েজ করা হয় ‘শিবির সন্দেহে’ আর ‘অনুপ্রবেশকারী’ ট্যাগ লাগিয়ে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী তার মতামত প্রকাশ করতে পারবে না যেই রাষ্ট্রে, সেই রাষ্ট্র কি ছাত্রলীগের কাছে বর্গা দেয়া হয়েছে? তিস্তার কোনো সমাধান না করেই ফেনী নদীর পানি ভারতকে দিয়ে দেয়ার চুক্তির মধ্যে যে অসহায়ত্ব রয়েছে, তার বিরোধিতা করা অন্যায়? তাহলে দেশপ্রেম কী? ক্যাসিনো সাম্রাজ্য গড়ে তোলা?
হায়েনাদের এমন উল্লাসে কান্না হলো সবচেয়ে বড় পাপ। নিয়মিত বিরতিতে এক একটি ঘটনা ঘটছে। আমরা কোরাস করে কেঁদে উঠছি। এই কান্না পরাজয়ের কান্না। রাষ্ট্র নির্মিত হয় বিপ্লবে; কান্নায় নয়।
- লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কলাম লেখক
- কার্টসিঃ মানবজমিন/ ১০ অক্টোবর ২০১৯, বৃহস্পতিবার
No comments:
Post a Comment