Search

Monday, October 28, 2019

নৃশংসতার শেষ কোথায়?


১. ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনো সমুদ্রবন্দর ছিল না, তৎকালীন সরকার ছয় মাসের জন্য কলকাতাবন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু ভারত আমাদেরকে রাস্তা মাপার পরামর্শ দিচ্ছিল। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মংলাবন্দর খুলে দিতে হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, আজ ভারতকে সে মংলাবন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে বাংলাদেশের কাছে। ২. কাবেরী নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে ভারতের কানাড়ি আর তামিলদের ‘কামড়া কামড়ি’ কয়েক বছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। সে দেশের এক রাজ্যই অন্য রাজ্যকে পানি দিতে চায় না। সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড় লাখ কিউবিক মিটার পানি দিবো। ৩. কয়েক বছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তর ভারত কয়লা-পাথর রফতানি বন্ধ করেছে। অথচ আমরা তাদের গ্যাস দিবো। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায় সেখানে আমাদের সম্পদ দিয়ে বন্ধুরা বাতি জ্বালাবে।

ওপরের কথাগুলো বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের একটি পোস্ট। আর এটিই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে আবরারের। নৃশংস পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করল বুয়েটের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।

একজন সন্তান বড় করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠানোর দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া বাবা-মায়ের জন্য বিরাট যুদ্ধ। সেটি মা-বাবাই বোঝে। আর যে ছেলে দেশের সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে তাকে কতটা যুদ্ধ করতে হয়েছে? সেই যুদ্ধ এভাবে শেষ হয়ে যাবে- ভাবতেও দম বন্ধ হয়ে আসে। আবরারের মায়ের আকুতি ‘আমার সন্তানের হাতের যে জায়গাটা তোমাদের আঘাতে আঘাতে নীল হয়ে আছে, ঠিক ওখানে ধরে তাকে স্কুলে নিয়ে যেতাম, তোমাদের কিলঘুষি আর নির্যাতনের নির্মম আঘাতে আমার ছেলের চোখ বন্ধ করে আছে, তোমরা জানো বাবা, ও যখন ঘুমাত আমি তার কপালে, চোখে চুমু খেতাম। আর মনে মনে চাইতাম সে যেন আরো একটু ঘুমায়, তোমরা তাকে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দিলে।’ মায়ের এমন আহাজারির জবাব কে দেবে? সরকার, প্রশাসন নাকি যারা বর্বর রাজনীতির ধারক-বাহক।

ক্ষমতার ছত্রছায়ায় এই দেশে প্রতিদিন কি পরিমাণ অত্যাচার চলে, সেটি আমরা টের পাই না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিদিন চলছে ক্ষমতার দাপট। এতে অন্ধ হয়ে একের পর এক নির্মম নৃশংসভাবে ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১ বছর আগে বর্তমান সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা ধর্ষণের সেঞ্চুরি করেছিল। দিনের পর দিন আন্দোলন করেও কোনো ফল হয়নি। বরং যারা আন্দোলন করেছে তাদের অনেকের ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে গেছে। অপরাধীদের কোনো বিচার হয়নি। বুয়েটের ছাত্রী সনি হত্যার শিকার হয়েছে। কোনো বিচার পায়নি তার পরিবার। সনি হত্যার প্রতিবাদে তখনো উত্তাল হয়েছিল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। আজ তার ধারাবাহিকতায় সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে। একের পর এক হত্যা এবং দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র দেশবাসীকে হতবাক করে তুলছে। কেউ প্রতিবাদী হলেই তার কপালে জোটে জেল জুলুম, না হয় গুম, হত্যা, নির্যাতন, মামলা ইত্যাদি।

দেশকে ডুবে যেতে দেখে, দেশবিরোধী পদক্ষেপে ছাত্রসমাজ প্রতিক্রিয়া জানাতেই পারে- যার জন্য একজন মেধাবী ছাত্রকে হলে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা যায় না। এটা কোনো স্বাধীন দেশ এবং গণতন্ত্রের ভাষা হতে পারে না। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় আমরা চোখে দেখেছি- বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থেকে শুরু করে স্কুলের শিশু-কিশোর পর্যন্ত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে যারা যুগের পর যুগ ধরে জগদ্দল পাহাড়ের মতো জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছিল। তাদের শিক্ষা দেয়ার জন্য সারা দেশে সে আন্দোলন এক অনন্য নজির সৃষ্টি করে দিলো। ওরা মার খেয়েছে রক্তাক্ত হয়েছে কোনো কোনো ছাত্রী লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে, এসব ঘটনায় পুলিশ এবং সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের দিকেই অভিযোগের আঙুল উঠেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছাত্রকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হলো- ভিসি তাকে দেখতে যাওয়া তো দূরের কথা, একটি বিবৃতিও দিলেন না। ভিসিও ওইসব ছাত্র নামধারী হায়েনাদের দোসর বলে বিবেচিত হোন, জাতি তা আশা করে না। আমরা ছাত্র রাজনীতি চাই। তা হবে আদর্শভিত্তিক এবং সেখানে হবে মেধার প্রতিযোগিতা। মা-বাবা তা হলে পাবেন তাদের যোগ্য সন্তান।

  • লেখকঃ তোফাজ্জল হোসাইন 
  • কার্টসিঃ নয়াদিগন্ত/ ২৭ অক্টোবর ২০১৯

No comments:

Post a Comment