সায়ন্থ সাখাওয়াৎ |
ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাদের নিয়ন্ত্রিত টর্চার সেলে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে নির্মমভাবে পেটাতে পেটাতে মেরেই ফেলল বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে। তার অপরাধ তিনি ফেইসবুক স্ট্যাটাসে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা করেছেন। বুয়েটসহ সারা দেশে যখন আবরার হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলন তুঙ্গে তখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গণভবনে দেখা করেন নিহত আবরারের পরিবারের সদস্যরা। প্রধানমন্ত্রী তাদের আশ্বস্ত করে বলেন, হত্যাকারীদের বিচার নিশ্চিত করা হবে। তারা যে দলেরই হোক
এর আগে ঢাকায় বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড, লক্ষীপুরে এডভোকেট নুরুল ইসলাম হত্যাকাণ্ড সহ প্রায় সব আলোচিত হত্যাকাণ্ডের পরই আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা একই রকম আশ্বাস দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারের উদাহরণ টেনে সরকারদলীয়রা বলে থাকেন, দেশ বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হয়েছে। সরকারের এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত এগারো বছরের ব্যাপক আলোচিত ও নৃশংস কয়েকটি ঘটনায় বিচারের সর্বশেষ অবস্থা জেনে নেওয়া যাক।
এক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর ছিদ্দিক হত্যা মামলায় ছাত্রলীগের সাবেক ১০ নেতাকর্মীর সবাই বেকসুর খালাস পেয়েছেন। আট মাস আগে এই মামলার রায় হয়েছে। কিন্তু আবু বকরের বাবা-মা, এমনকি বাদীকে রায় সম্পর্কে জানানো হয়নি। হত্যাকারী চিহ্নিত করার মাধ্যমে বিচার নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালতে আপিল করার যে সুযোগ ছিল, তা-ও রাষ্ট্রপক্ষ নেয়নি। এর মধ্যে আপিলের স্বাভাবিক সময়ও পার হয়ে গেছে। ফলে নিহত ব্যক্তির পরিবার বিচার পাওয়ার অধিকার থেকেই বঞ্চিত রয়ে গেল (আবু বকরকে কেউ খুন করেনি! প্রথম আলো, ২৬ জানুয়ারি ২০১৮)
দুই। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮-দলের অবরোধ কর্মসূচি চলার সময় ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে অনেকগুলো ক্যামেরার সামনেই দিনেদুপুরে নির্মমভাবে কুপিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা খুন করে দর্জি দোকানের কর্মী বিশ্বজিৎ দাসকে। ব্যাপক সমালোচনার মুখে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে নিম্ন আদালতে ছাত্রলীগের আটজন নেতাকর্মীর ফাঁসির রায় ও ১৩ জনের যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হলেও হাইকোর্ট তার মধ্যে ছয়জন নেতাকর্মীকে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই দিয়েছে। এই রায়ের পর বিশ্বজিৎ দাসের ভাই উত্তম দাস বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘পাঁচ বছর পরে আজ আরেকটা দুঃসংবাদ এটা। আজকের দিনটাতে যে এরকম কিছু শুনতে হবে আমরা আশাই করিনি। এটাই ঠিক যে সরকার যা চাইবে তা-ই হবে। সরকার যদি চাইত যে অন্তত বিশ্বজিতের ঘটনাটা সুষ্ঠু বিচার হোক তাহলে হতো’(বিবিসি বাংলা, ৬ আগস্ট ২০১৭)
তিন। ‘আমি পাখির মতো মুক্ত... এখন আমি উড়তে পারি...’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ছাত্র জুবায়ের আহমেদ হত্যার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক খান মোহাম্মদ রইস ওরফে সোহান ফেইসবুকে এরকম একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। জুবায়ের হত্যায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্ত ইশতিয়াক মাহবুব ওরফে অরূপও ইন্সটাগ্রামে একটি ছবি পোস্ট করেন। ওই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, কুয়ালালামপুরের একটি স্টারবাকস স্টোরে বসা। এই দুজনসহ সাজাপ্রাপ্ত পাঁচজনই ধরাছোঁয়ার বাইরে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ২০১২ সালে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের প্রতিদ্ববী গগ্রুপের হাতে ছুরিকাহত হয়ে জাবির ইংরেজি বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহত হওয়ার পর হাসপাতালে মারা যান (হত্যার পাঁচ বছর, ‘পাখির মতো মুক্ত’ জুবায়েরের খুনিরা, ডেইলি স্টার, ০৯ জানুয়ারি ২০১৭)।
চার। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদলের কলেজ শাখার নেতা তাওহীদুল ইসলাম (২৫) হত্যা মামলায় মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগ শাখার সভাপতি সৌমেন দে, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হাইসহ সব আসামিকে বেকসুর খালাস দিয়েছে আদালত। খালাস পাওয়া সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। ২০১৪ সালের ৪ জুন ওসমানী মেডিকেল কলেজের আবু সিনা ছাত্রাবাসের ১০০৩ নম্বর কক্ষে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাওহীদুল ইসলামকে। তাওহীদ এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কলেজ শাখার আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন (ছাত্রদল নেতা তাওহীদুল হত্যা মামলা, সব আসামি খালাস, প্রথম আলো, ১৩ আগস্ট ২০১৮)।
পাঁচ। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মারধরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর সাধারণ ছাত্রসমাজ খুনিদের বিচার দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। এমনই আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল আট বছর আগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) ছাত্রাবাসে। ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে দফায় দফায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল চমেকের ৫১তম ব্যাচের বিডিএস তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আবিদুর রহমান আবিদকে। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার আসামি ছাত্রলীগের ভিপিসহ ১২ নেতাকর্মীর সবাই দুই মাস আগে আদালতের রায়ে বেকসুর খালাস পেয়ে গেছেন। আবিদকে ছাত্রদল কর্মী বলে সন্দেহ করতেন চমেক ছাত্রলীগের নেতারা। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবিদের জনপ্রিয়তা ছিল। এ কারণে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর দুপুর ২টা, সন্ধ্যা ৭টা ও রাত ১০টায় তিন দফা পিটুনির পর চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে আবিদকে তার বোনের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি বোনের বাসা থেকে চিকিৎসার জন্য চমেক হাসপাতালে আনা হলে সেখানেও বাধা দেন ছাত্রলীগে নেতাকর্মীরা। অবশেষে ২১ অক্টোবর মারা যান আবিদ। (চমেক হোস্টেলে দফায় দফায় পেটানো হয় আবিদকে) আবরার হত্যার বিচারে সবাই যখন সোচ্চার, তখন আবিদের খুনি ছাত্রলীগের ১২ নেতাকর্মী খালাস। (কালের কণ্ঠ, ১০ অক্টোবর, ২০১৯)
শুধু এই পাঁচটিই নয়, এমন বহু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে ছাত্রলীগ গত এগারো বছরে। ০৮ অক্টোবর ২০১৯ দৈনিক যুগান্তরের এক রিপোর্টে লেখা হয়, গত ১০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), বুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ (চবি) দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে লাশ হয়েছেন ২৪ জন শিক্ষার্থী। এই ২৪ জনের মধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ জন, রাজশাহীতে ৫ জন, ময়মনসিংহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন, দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ জন। এছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও ৩ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের ১৭টি ঘটেছে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে!
এই হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে বিচার যে কতদূরে সে বিষয়ে ০৯ অক্টোবর ২০১৯ দৈনিক প্রথম আলো লিখেছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১০ বছরে ৮ শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দশকে খুন হয়েছেন চার শিক্ষার্থী। সিলেট শাহজালাল, লিডিং এবং সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে তিন শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন। বিচার হয়নি একটি হত্যাকাণ্ডের। এই হলো আওয়ামী লীগ সরকারের গত এগারো বছরে শুধু ছাত্রলীগের হাতে খুন হওয়াদের বিচারের খতিয়ান। ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের বিশেষ পরিস্থিতিতে আদালত সাজা দিলেও শেষ পর্যন্ত তা যে টিকে থাকে না, এমন নজিরও অনেক।
লক্ষীপুরের আওয়ামী লীগ নেতা আবু তাহের ও তার ছেলে বিপ্লবের নৃশংসতার বলি হয়েছিলেন বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম। বাসা থেকে অপহরণ করে তাকে হত্যার পর লাশ টুকরো টুকরো করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রথম আমলের শেষ দিকে ২০০০ সালে। আলোচিত নুরুল ইসলাম হত্যাসহ অপর একটি হত্যা মামলায় বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ডর রায় দেওয়া হয়। আপিল বিভাগ পর্যন্ত রায়ে বলেছিল, সমস্ত তথ্য প্রমাণ করে বিপ্লব হত্যাকারী। তাই তার সাজা হ্রাস করার কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় খুনি বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ড রহিত হয়। বহু মামলার আসামি সাজাপ্রাপ্ত বিপ্লব এখন মুক্ত।
এই বিচারহীনতা ও খুনিদের ক্ষমার সংস্কৃতি এই দেশে ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রত্যাশাকে যে কতদূরে ঠেলে দিয়েছে তা উঠে এসেছে দুর্বৃত্তদের হাতে হত্যাকাণ্ড্ররে শিকার ফয়সাল আরেফিন দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের কথায়। দৈনিক মানবজমিনকে তিনি বলেছেন, চারদিকে সবাই বিচার দাবি করে। পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়। কিন্তু বিচার আর হয় না। বাংলাদেশের যে বিচারব্যবস্থা এখানে ন্যায়বিচার পাওয়া খুব কঠিন। তাই আমি একজন সন্তানহারা বাবা হয়ে আবরারের বাবাকে বলব, বিচার হলো কী হলো না সেটা নিয়ে যেন তিনি না ভাবেন। আসলে রাষ্ট্রের পরিচালনা ঠিক নেই। রাজনীতি দুর্নীতিগ্রস্ত। এই দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির মধ্যে সরকার কোনো কিছু ঠিকমতো চালাতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ভ‚মিকা সঠিকভাবে পালন করছে না। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেই সরকারের ছাত্র সংগঠনগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে ওঠে।
আদালতে যখন চাক্ষুষ অপরাধী পার পেয়ে যায় এবং সেটা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয় তখন জানা যায় পুলিশি তদন্ত ও চার্জশিটের দুর্বলতার কথা। তার মানে হলো, বিষয়টি আদালতে আসার আগেই অপরাধীদের বাঁচানোর পথ তৈরি করে রাখা হয়। কারা করে এটা? তদন্ত কর্মকর্তা তো? তিনি কেন করেন? উত্তর সোজা। এর পেছনের কারণ দুর্নীতি ও রাজনীতি। কখনো অর্থের বিনিময়ে, কখনো রাজনৈতিক প্রভাবে আবার কখনো উভয় কারণে চার্জশিট এমনভাবে দেওয়া হয় যে আদালতে গিয়ে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায় প্রকৃত অপরাধী।
ক্ষমতাসীন দলের যে সব অপরাধী এভাবে পার পেয়ে যান তাদের সঙ্গে ক্ষমতা ও টাকার সম্পর্ক যে গভীর সেটা সবারই জানা। তার দায় তো অবশ্যই সরকার ও দলকেই নিতে হবে। এভাবে খুন করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি দলীয় অপরাধীদের সাহস জোগায় আরও ভয়াবহ অপরাধ করতে। তারা বুঝে যায়, তাদের মাথার ওপরে ‘বড় ভাইয়ের’ ছায়া আছে। কোনো না কোনো পথে তাদের বাঁচানো হবে। আর সরকারি দলের দাপুটে সন্ত্রাসীদের কাছে তো টাকা কোনো সমস্যাই নয়।
এত কিছুর পরেও যদি কারও শাস্তি হয়েই যায় তবে শেষ ভরসা হিসেবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ তো আছেই। তার ক্ষমাও হয়তো মিলতে পারে, এই ভরসাও কারও মনে কাজ করতেই পারে। তাই তারা খুন করে, বেঁচে যায়, আবারও খুন করে। এভাবে হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য অপরাধী। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তাদের এই বেঁচে যাওয়ার প্রক্রিয়া দেখে উৎসাহিত হয়ে ছিঁচকে সন্ত্রাসীও এক সময় হয়ে ওঠে ভয়াবহ খুনি। এভাবে রাজনৈতিক প্রশ্রয় ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফলে যে খুনি শ্রেণির উদ্ভব ঘটে ও বিস্তৃত হয় তার দায় কোনো ভাবেই এড়াতে পারেন না রাজনীতিবিদরা। সুশাসন ও সুবিচার নিশ্চিত করতে হলে আগে চাই সৎ ও স্বচ্ছ রাজনীতি।
— লেখক চিকিৎসক ও কলামিস্ট
- কার্টসি — দেশরুপান্তর / অক্টোবর ১৭, ২০১৯
No comments:
Post a Comment