Search

Saturday, November 2, 2019

কথিত প্রশিক্ষণের নামে সরকারি অর্থের অপচয়


সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশে প্রশিক্ষণ নেওয়ার নিশ্চয়ই বিশেষ প্রয়োজন রহিয়াছে। মূলত পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য এই সুযোগের বিধান রাখা হইয়াছে। কিন্তু পরিতাপের সহিত দেখা যাইতেছে, সরকারি এই সুযোগের অপব্যবহার হইতেছে হরহামেশাই। প্রশিক্ষণার্থে যাহারা বিদেশে যাইতেছেন, তাহাদের সিংহভাগই যাইতেছেন মূলত বিদেশ-ভ্রমণ অথবা বিনোদনের উদ্দেশ্যে। কিছুদিন পূর্বে আমরা পুকুর খনন প্রকল্পের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জনের অজুহাতে বিদেশে গিয়া প্রশিক্ষণ গ্রহণের উপর প্রশ্ন তুলিয়াছিলাম। সম্প্রতি পত্রিকান্তরে জানা গিয়াছে, ২৬ জন সরকারি কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ ছিল কোরিয়ায়, কিন্তু গিয়াছেন যুক্তরাষ্ট্রেও। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সহিত চুক্তির শর্তে ছিল, দক্ষিণ কোরিয়ায় এক মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণ করিবেন সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ১৮ প্রকৌশলী। কিন্তু ‘শিক্ষা সফরে’ কোরিয়া ঘুরিয়া যুক্তরাষ্ট্রে গিয়াছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পাঁচ কর্মকর্তা, সংসদীয় কমিটির সভাপতির ব্যক্তিগত সচিবসহ ২৬ জন। তাহা ছাড়া, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সহিত চুক্তি অনুযায়ী, শুধু প্রকৌশলীদেরই দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রশিক্ষণ গ্রহণের কথা ছিল। অথচ ‘প্রশিক্ষণার্থী’র সংখ্যা বাড়াইতে প্রশিক্ষণের মেয়াদ এক মাস হইতে কমাইয়া ১২ দিন করা হইয়াছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করা হইয়াছে এই সময়ের মধ্যে। বয়সসীমা শেষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাইয়াছেন কিংবা চাকরির মেয়াদ আর দুই মাস বাকি রহিয়াছে—এমন কর্মকর্তাও দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষা সফরে গিয়াছেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এই তথাকথিত ‘শিক্ষা সফরে’ তাহাদের অর্জিত জ্ঞান কোথায় কাজে লাগিবে?

বলিবার অপেক্ষা রাখে না, প্রশিক্ষণকে গৌণ করিয়া প্রকল্পের টাকায় বিদেশ ভ্রমণকেই গুরুত্ব দেওয়া হইয়া থাকে অনেক ক্ষেত্রে। কেবল সওজ বিভাগের নহে, আমাদের দেশে প্রায় সকল প্রকল্পে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণের প্রবণতা লক্ষণীয়। আমরা আগেই বলিয়াছি, বহু ক্ষেত্রেই বিদেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করিবার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করিবার উপায় নাই। প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ সফর করিতেছেন যিনি, তিনি প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরিয়া বিষয়টির উপর নবলব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগাইবেন—ইহাই স্বাভাবিক চাওয়া। কিন্তু যিনি বিদেশ সফর করিয়াছেন শুধুই প্রমোদভ্রমণ হিসাবে অথবা দায়িত্ববহির্ভূত ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ লইয়াছেন, তিনি কীভাবে পূরণ করিবেন এই চাওয়া? আরেকটি বিষয় হইল, যিনি সত্যিকারের প্রশিক্ষণ লইয়া আসেন, অনেক সময় দেখা যায় যে মাত্র কয়েক মাস পরই তিনি অবসরে যাইবেন। আবার যেই প্রকল্পের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হইল, সেই প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই বদলি করা হয় অন্যত্র। এই ধরনের প্রশিক্ষণও বাস্তবিক অর্থে কোনো কাজে লাগে না।

বস্তুত, সরকারি দপ্তরগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ সফরের যেই প্রয়োজনীয় বিধান রাখা হইয়াছে, বিনা প্রয়োজনে সেই সুযোগ কাজে লাগাইলে তাহা প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। অনেক ক্ষেত্রে এমনও হয় যে, এই বত্সর অমুক যাইবেন তো পরের বত্সর তমুক! সুতরাং আমরা মনে করি, প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ সফরের একটি কার্যকরী সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার, যাহাতে সরকারি অর্থের অপচয় না হয়।

Courtesy —  ইত্তেফাক/ নভেম্বর ০২, ২০১৯ 

Thursday, October 31, 2019

১৪ দলের শরিকদের চোখে জাতীয় নির্বাচন

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
আওয়ামী লীগ ও তাদের সঙ্গীসাথীরা ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে দিনে-রাতে কীভাবে ভোট জালিয়াতি করে ফলাফল নিজেদের পক্ষে নিয়েছে সেটা শুধু জানেই না, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেও। এবং এটা বলার মধ্যে এক ধরনের তৃপ্তিও লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। তাদের ভাবখানা এমন যে আওয়ামী লীগ কতটা চৌকস ও কৌশলী দল যে এভাবে রাতে-দিনে ভোট নেওয়ার পরও বিএনপি কোনো তথ্যপ্রমাণ হাজির করতে পারেনি। প্রতিরোধ তো দূরের কথা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, বিভিন্ন সংস্থা ও পর্যবেক্ষকদের মতামত তুলে ধরে নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তোলার পর আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযাত্রীরা বলে থাকেন, প্রমাণ দেখান। কিছু যৌক্তিক তথ্য তুলে ধরার পর যখন আর জুতসই কোনো জবাব আর তাদের হাতে থাকে না তখন একটাই কথা, এত জালিয়াতি হলে জনগণ রুখে দাঁড়াল না কেন? বিএনপি কেন পারল না জনগণকে মাঠে নামাতে? এ কথা শুধু আওয়ামী লীগ নয়, তাদের পক্ষ নেওয়া সাংবাদিক, শিক্ষকরা পর্যন্ত বলে থাকেন। প্রতিরোধ করতে পারল না বলে সব দায় যেন বিএনপির, সব দায় জনগণের। যারা জালিয়াতিটা করল তাদের কোনো দায় নেই!

‘অফ দ্য রেকর্ড’ যে কথাটি আওয়ামী লীগের অনেকে  বলেন, তাদের পক্ষ নেওয়া শিক্ষক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরাও যা বলেন, তাই বলেছেন তাদের জোটসঙ্গী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা নৌকার এমপি রাশেদ খান মেনন। কিন্তু সমস্যা হলো, তিনি বলে ফেলেছেন অন দ্য রেকর্ড। ব্যস, তিনি হয়ে গেলেন নির্বাচনে জালিয়াতির রাজসাক্ষী। আর আওয়ামী লীগের কাছে রাজ ভিলেন। মেনন বলেছেন, ‘বিগত নির্বাচনে আমিও নির্বাচিত (এমপি) হয়েছি। তারপরও আমি সাক্ষ্য দিয়ে বলছি, গত নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। জাতীয়, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কোথাও ভোট দিতে পারেনি দেশের মানুষ। প্রধানমন্ত্রী, আপনি-আমি মিলে যে ভোটের জন্য লড়াই করেছি, আজিজ কমিশনকে ঘেরাও করেছি, আমরা এক কোটি ১০ লাখ ভুয়া ভোটার তালিকা ছিঁড়ে ফেলে নির্বাচন বর্জন করেছি মনোনয়ন জমা দেওয়ার পরেও। আজ কেন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং জাতীয় নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে আসবে না? সরকারের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশে লুণ্ঠন, দুর্নীতি, মহামারি আকার ধারণ করেছে। উন্নয়ন মানে গণতন্ত্র হরণ নয়, উন্নয়ন মানে ভিন্ন মতের সংকোচন নয়, উন্নয়ন মানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ নয়, উন্নয়ন মানে গণতন্ত্রের স্পেস (সুযোগ) কমিয়ে দেওয়া নয়। সারা দেশে মানবিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয় ঘটেছে।’

মেননের এ কনফেশনাল স্টেটমেন্ট বা অনুশোচনাকে অনেকে রাষ্ট্রীয় অপকর্মের রাজসাক্ষী হিসেবে দেখছেন। কিন্তু নৌকার এমপি রাশেদ খান মেননের এই কথায় চটেছে নৌকার আসল মালিক আওয়ামী লীগ। তারা শোকজ করেছে। অনেকেই বলেছেন, রাশেদ খান মেনন ক্যাসিনোকা-ে ধরা খেয়ে গেছেন। কার থেকে মাসে কত টাকা চাঁদা খেয়েছেন সে সব হিসাব রিমান্ডের তথ্য হিসেবে পত্রিকায় ছাপা হতে শুরু করেছে। তার পতন অবধারিত। গণমানুষের সহানুভূতি আদায় করে সেই ড্যামেজ কিঞ্চিৎ কমানোর কৌশল হিসেবেই তিনি রাজসাক্ষী হয়েছেন। এমন একটা আবহ তৈরির চেষ্টা করেছেন যে মানুষের যেন মনে হয় তিনি নির্বাচন প্রশ্নে সত্য কথা বলায় সরকার তার বিরুদ্ধে ক্যাসিনোকা- ও চাঁদাবাজির মতো অভিযোগে হেনস্তা করছে। কিন্তু তাদের হয়তো স্মৃতিতে নেই যে রাশেদ খান মেনন এর আগেও নির্বাচন নিয়ে প্রায় কাছাকাছি বক্তব্য দিয়েছেন। তখন নিজেকে রক্ষা করে সামগ্রিকভাবে খারাপ নির্বাচন হওয়ার তত্ত্ব হাজির করেছিলেন এবং তার জন্য বিএনপির ইট মেরে পাটকেল খাওয়ার থিওরি দিয়েছিলেন। তিনি ৩০ জানুয়ারি ২০১৯ বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও সরকারবিরোধী দলগুলো থেকে একাদশ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে সে বিষয়ে বলেছিলেন, প্রত্যেকটি নির্বাচনেই এসব অভিযোগ ওঠে। যারা অভিযোগ করছে, তাদের একটি কথা বলতে চাই, ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়। তারা ২০০৬ সালে ইট মেরে ছিল, সেটা কি ভুলে গেছে? কীভাবে আজিজ কমিশনকে দিয়ে ভুয়া ভোটার তালিকা তৈরি করেছিল? এবার তার একটা পাল্টা জবাব পেয়েছে। এখন এটা নিয়ে চিৎকার করে লাভ কী! গণতন্ত্রের কথা বলে লাভ নেই! তাদের মুখে গণতন্ত্রের কথা শোভা পায় না! আর অন্য যারা গণতন্ত্রের কথা বলছে, তারাও সুযোগ পেলে একই কাজ করত। সেই ’৮৬ সালে বামরা, আমাদের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো শেখ হাসিনার সঙ্গে মিলে নির্বাচন করেনি? সেই নির্বাচনে কী হয়েছিল, তা সবার জানা আছে। এরশাদের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে কে কয়টা সিট পাবে, সবই তো ঠিক ছিল সেই সময়। সুতরাং বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে অনেক ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনের কলঙ্ক যদি লেগে থাকে, তাহলে সব রাজনৈতিক দল বা সবার গায়ে কলঙ্ক লেগেছে। অর্থাৎ ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে যে একটা কলঙ্ক সৃষ্টি করেছে তা তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন। শুধু রাশেদ খান মেননই নন, জোটের আরেক দল জাসদের একাংশের নেতা সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনুও নির্বাচন নিয়ে তার মনোভাব প্রকাশ করেছেন। জোটের শরিক জাসদের আরেক অংশও কাছাকাছি মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু বা মইনুদ্দিন বাদল কোন প্রক্রিয়ায় কতটুকু বললেন তা নিয়ে বিচলিত হওয়ার দল আওয়ামী লীগ নয়। বরং তারা বুক ফুলিয়ে তাদের মনোভাব প্রকাশ করেন, দেখো, আমরাই পারি। তারপরও ওপরে থুথু ছিটিয়ে নিজের গায়ে মাখলেন কেন মেনন? এর সঠিক কারণটি তুলে ধরেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, রাশেদ খান মেনন যদি আজ মন্ত্রী হতেন তবে কি এ কথা বলতেন! কথা তো সত্যি। রাশেদ খান মেনন তো আওয়ামী লীগ সরকারের গত আমলে মন্ত্রী ছিলেন। তখন কি ২০১৪ সালের বিনা ভোটের এমপি হওয়ার নৈতিকতা নিয়ে কিছু বলেছেন? একবারও কি বলেছেন, তিনিসহ যে ১৫৪ জন বিনা ভোটে কাগুজে এমপি তারা প্রকৃত জনপ্রতিনিধি নন?

তবে প্রথম দিকে মন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরে সমালোচনা করতেন। অনেকেরই হয়তো মনে থাকতে পারে, তখন মন্ত্রী পরিষদের বাইরে থাকা রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের সরকারের কর্মকাণ্ডের কড়া সমালোচনা করে প্রকাশ্যে বিরক্তি প্রকাশ করতেন। শেখ হাসিনা তখন তাদের মন্ত্রী বানিয়ে মুখবন্ধ করেছিলেন। রাশেদ খান মেনন হয়তো এবারও সেই ফর্মুলা প্রয়োগ করতে চেয়েছেন। তিনি তার স্ত্রীকে সংরক্ষিত নারী কোটায় এমপি বানিয়েই তুষ্ট থাকতে পারেননি। এই সরকারকে এত বড় অনৈতিক কাজে সহযোগিতার পর তার প্রাপ্তি আরও বেশি হবে বলে হয়তো মনে করেন। তা না পেয়ে নিজের দাম বাড়াতেই তিনি সমালোচনার পথ ধরেছিলেন বলে ওবায়দুল কাদেরের মতোই অনেকে মনে করেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি যে একই ফর্মুলায় বারবার শিকে ছিঁড়ে না। তাই এখন তাকে তার বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে হচ্ছে। লিখিত কৈফিয়ত দিয়ে বলতে হচ্ছে, তার বক্তব্য নাকি মিডিয়া খণ্ডিতভাবে প্রকাশ করেছে। তিনি নাকি আগের নির্বাচনগুলোর অনিয়ম সম্পর্কে বলতে গিয়ে ধারাবাহিকভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গে বলেছেন। কিন্তু মিডিয়া শুধু তার শেষ অংশটুকুই খণ্ডিতভাবে প্রকাশ করেছে। মিডিয়া তো তার দীর্ঘ বক্তব্যের পুরোটা প্রকাশ করার দায়িত্ব নেয়নি। মিডিয়া যতটুকু প্রকাশ করা যৌক্তিক মনে করে ততটুকুই তো করবে। কিন্তু মেনন সাহেব কি বলতে পেরেছেন যে যে কথা মিডিয়া প্রকাশ করেছে তা তিনি বলেননি?


বঙ্গবন্ধুর ১৯৭৩, জিয়াউর রহমানের ১৯৭৯, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ বা তার পরবর্তী নির্বাচনগুলো নিয়ে একক পক্ষ থেকে একেক রকম মূল্যায়ন ও সমালোচনা আছে। বিএনপি আমলের নির্বাচনের সমালোচনা করা তো আওয়ামী লীগ ও মেনন সাহেবরা নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে পালন করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। সেই সব অভিযোগ আর ২০১৪ বা ২০১৮ এর নির্বাচন নিয়ে রাশেদ খান মেননের কনফেশনাল স্টেটমেন্ট কি এক কথা হলো! কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা, রাশেদ খান মেননের এই বক্তব্য অভিনন্দিত হয়নি সরকারবিরোধী পক্ষ বিশেষ করে বিএনপি থেকেও। কারণ তারা নৌকার এই এমপির সমালোচনার মধ্যে কোনো সততা খুঁজে পাননি। রাশেদ খান মেনন আগে নিজে পদত্যাগ করে তারপর এ সমালোচনার বাক্সটি খুললে সেটা হতো একটি সৎ উদ্যোগ। কোনো সুবিধাবাদী রাজনীতিকের পক্ষে পদের লোভ ত্যাগ করা সত্যিই কঠিন।

  • লেখক চিকিৎসক ও কলামিস্ট । 
  • কার্টসি — দেশরূপান্তর/ বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ৩১, ২০১৯

Wednesday, October 30, 2019

রাষ্ট্রব্যবস্থা বদল করতে না পারলে মুক্তি নেই — অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী


ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, এই রাষ্ট্র মানুষের অধিকার দিচ্ছে না। এ রাষ্ট্রে শিশুরাও ধর্ষিত হচ্ছে। রাষ্ট্র এখন মানুষের পক্ষে নয়। রাষ্ট্র এখন মানুষের শত্রু হয়ে গেছে। সব সমস্যা রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। এ ব্যবস্থা বদল করতে না পারলে মুক্তি নেই। 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, পানির সঙ্গে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও অস্তিত্ব জড়িত। মানুষ কীভাবে বাঁচবে তা পানির ওপর নির্ভর করে। পানির অপর নাম জীবন। রাজনৈতিক কারণে, রাষ্ট্রীয় কারণে পানি বিপন্ন হচ্ছে। পাকিস্তান আমল থেকে নদী নিয়ে নানা সমস্যা শুরু হয়েছে। সে সমস্যা বর্তমানে ফেনী নদীর পানিতে গিয়ে ঠেকেছে। পানি সমস্যার সমাধান মানুষকেই করতে হবে। কীভাবে করতে হবে তা মওলানা ভাসানী শিখিয়ে গেছেন। 

মঙ্গলবার, অক্টোবর ২৯, বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে আয়োজিত এক সেমিনারে এসব কথা বলেন তিনি। ভাসানী অনুসারী পরিষদ ‘ভারত-বাংলাদেশ পানি বিতর্ক’ শীর্ষক এ সেমিনারের আয়োজন করে। 

ভাসানী অনুসারী পরিষদের চেয়ারম্যান ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক আসিফ নজরুল। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার। আলোচনা করেন পানি বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক, অধ্যাপক নুরুল আমিন ব্যাপারী, নঈম জাহাঙ্গীর, এটিএম গোলাম মাওলা চৌধুরী প্রমুখ।

অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, সরকার বলেছে মানবিক দিক বিবেচনা করে ফেনী নদীর পানি দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু অভিন্ন ৫৪ নদীর ন্যায্য পানির অভাবে আমাদের দেশের কৃষিসহ নানা দিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের দেশের কোটি কোটি মানুষের মানবিক দিকটি কেউ দেখছে না। 

সভাপতির বক্তব্যে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, একটি নতজানু সরকার পানির অধিকার দিতে পারবে না। ভোটের অধিকারের মাধ্যমেই একটি দেশের সার্বভৌমত্ব ফিরে আসতে পারে।

  • কার্টসি  — বাংলাদেশ প্রতিদিন /বুধবার, অক্টোবর ৩০

    , ২০১৯

Monday, October 28, 2019

সবখানেই সেই লোমশ ভয়াল হাত


দুই কন্যার সামনে বাবাকে নগ্ন করে পেটানোর ভিডিও দেখতে দেখতে পড়ছি মনপুরায় শিশুসন্তানের সামনে মাকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করার খবর। দুটি ঘটনাই ভোলার। শেষ লঞ্চ না পেয়ে সন্তানসহ জননী একটা স্পিডবোটে করে বাড়ি ফিরতে গিয়েছিলেন। পথে পান চার পুরুষ সহযাত্রী। চারজন মিলে তাঁকে এক চরে নামিয়ে নির্যাতন করেন। ধরিত্রীর এতেই কেঁপে ওঠার কথা। কিন্তু কলিকালে কিছুই কাঁপে না, টনক নড়ে না; বরং দৌড়ে আসেন নতুন ধর্ষক। স্পিডবোটের চালক তাঁর মালিক ছাত্রলীগের নেতাকে খবর দেওয়ামাত্রই মওকার গন্ধ পেয়ে তিনি ছুটে আসেন। পুনরায় জঙ্গলে নিয়ে জননীকে আবারও ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের সালিসের নামে পুনরায় ধর্ষণ। সন্তান বা স্বামীকে বেঁধে রেখে ধর্ষণ। মা-মেয়েকে একসঙ্গে ধর্ষণ—এসব আমাদের ‘নিউ-নরমাল’ বাস্তবতা। এসব এই দেশের নতুন স্বাভাবিকতা। যুদ্ধের সময় এমন চরম নির্দয়তা ঘটতে দেখাকে অনেকে স্বাভাবিক বলে থাকেন, কিন্তু যুদ্ধ তো নেই বাংলাদেশে যে ঘটতে ঘটতে সব স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে!

ছাত্রলীগের নেতাটিও ‘স্বাভাবিক’ কাজই করেছেন। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকেই ‘খারাপ’ ভাবার লোকই দেশে বেশি। সমাজ তার পাশ থেকে সরে যায়। সুতরাং ছাত্রলীগের নেতা এসে যখন দেখলেন তাঁর আগেই চারজন পুরুষ নারীটিকে ‘অপবিত্র’ ও ‘ভোগযোগ্য’ করেই ফেলেছেন, তখন তিনিই–বা বাদ যাবেন কেন? পঞ্চম পুরুষ হিসেবে তিনিও তাঁকে ‘ব্যবহার’ করতেই পারেন। চার ধর্ষককে পিটিয়ে তাঁদের টাকাপয়সা কেড়ে নিয়ে তাড়িয়ে দিতে পারেন যিনি, সেই ক্ষমতার জোরে তো তিনি অপরাধীদের পুলিশে দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি চাননি ঘটনা জানাজানি হোক। হয়তো ভেবেছেন, চারজনের পরে পঞ্চমজনের ধর্ষণে কী আর উনিশ-বিশ হবে! তা ছাড়া ভিডিও করে যেহেতু রেখেছেন, সেহেতু লোকলজ্জার ভয়, স্বামী দ্বারা পরিত্যক্ত হওয়ার ভয়ে নারীটি নরকের পঞ্চম স্তরের অভিজ্ঞতা চেপে যাবেন।

শতকোটি অভিবাদন সেই নারীকে, তিনি চেপে যাননি। ফলে ছাত্রলীগের ওই নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। কিন্তু নারীর ভয় কমল নাকি বাড়ল? এমন বেকায়দায় পড়া নারী যাত্রীই শুধু নন, মামলার আসামি হয়ে পালিয়ে থাকা কিংবা জেলে থাকা ব্যক্তির স্ত্রীরাও দেখা যাচ্ছে ‘অরক্ষিত’—সহজ টার্গেট। সেপ্টেম্বর মাসের শেষেও যশোরে এমন ঘটনা ঘটেছে। স্বামী জেলে যাঁর, সেই নারীর বাড়িতে এসে দুই পুলিশ তাঁকে ধর্ষণ করে যায়। একই মাসে খুলনায় থানায় আটকে ধর্ষণ করা হয় এক নারীকে। মনপুরার ধর্ষক দেখিয়েছিলেন ভিডিও প্রকাশের ভয়, অভিযুক্ত পুলিশেরা দেখায় মাদক মামলার ভয়। এই লেখকের ২০১২ সালের এমন কিছু ঘটনা ধরে লেখায় দেখছি, কুষ্টিয়ায় থানায় ছয় দিন আটকে রেখে মা ও মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ‘অপরাধী’ ধরতে এসে সুযোগ নেওয়া হয়। খবরটি জানাজানি হলে তাঁদের ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। আদালত জামিন দিলে আবার গ্রেপ্তার করা হয় খুনের মামলায়। আবার তোলা হয় আদালতে। সেই আদালত এমনই আদালত, নিপীড়িতদের ফরিয়াদ না শুনে তাঁরা পুলিশের চাওয়ামতো মা ও মেয়েকে জেলে পাঠান। ওই বছরই ঢাকার মিরপুরেও নিহত ব্যবসায়ীর স্ত্রী-কন্যাকে একইভাবে ধর্ষণ করে পুলিশ।

ভাবি, কী ট্রমা জন্ম নেয় এমন নারীদের মনে। মনপুরার কথাই বলি। ছাত্রলীগ নেতা এসে ‘উদ্ধার’ করার পর হয়তো তিনি ভাবলেন দুঃসময়ের প্রহর বুঝি ফুরাল। কিন্তু নরকের শেষ দরজা তখনো দূরে। ধর্ষকদের হাত থেকে হাতে বদল হতে হতে কী দশা হয়েছিল তাঁর? মানুষের ওপর, সরকারের ওপর, আইনের ওপর, মানবাধিকারের ধারণার ওপর কি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি? স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকেরা কি এ রকম বেওয়ারিশ নাকি? তাদের নিয়ে যা খুশি তা করা চলে নাকি?

দেশে নাকি গরু-ছাগলের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু খুনি-ধর্ষকের সংখ্যাও যে বেড়েছে, জরিপ করে তা বলবে কোন সংস্থা? রাজনীতি নাকি মানুষকে রক্ষা করার জন্য, পুলিশ নাকি অপরাধ দমনের জন্য। কিন্তু কে রক্ষক আর কে ভক্ষক, সব যে গুলিয়ে যাচ্ছে? পরিসংখ্যান বলবে, হত্যা-নির্যাতন-ধর্ষণ ক্ষমতাবহির্ভূত লোক কম করে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা এখানে দুজনে দুজনার হয়ে কারবার করে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের সংগঠনগুলো হয়ে পড়েছে অপরাধ-নির্যাতনের নেটওয়ার্ক। সেই নেটওয়ার্কের দুই একটি গ্রন্থিতে সম্প্রতি ধরপাকড় চলছে বটে, কিন্তু সর্বাঙ্গে যখন পচন লাগে, তখন মৃদু সার্জারি করে কি দেহরক্ষা হবে? ব্যক্তি ধর্ষকের শাস্তি যদিবা হয়ও, কিন্তু যে ক্ষমতার তাপে গরম হয়ে তাঁরা ধর্ষণকে ডাল–ভাত মনে করছেন, সেই ক্ষমতাকে থামানো যাবে কী করে?

মানুষ এখন বড় অসহায়। আশ্রয়ে খোঁজে কোন দরজায় কড়া নাড়বে ভিক্টিমরা? উত্তম কুমার অভিনীত একটা ভূতের সিনেমার গল্পের মতো হয়েছে জাতীয় জীবন। অন্ধকার ভূশণ্ডির মাঠ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ফিরছিল এক লোক। বৃষ্টি ঝরছে টুপটাপ, অদূরে জঙ্গল। এর মধ্যে সে দেখে একটা কালো লোমশ বড় নখওয়ালা হাত পেছন থেকে তার ঘাড়ের ওপর এসে পড়ছে। ভয়ে চিৎকার করে লোকটা আরও জোরে সাইকেল চালায়। আবারও সেই ভয়াল হাত তাকে ছোঁয়। হাত ছুটতে ছুটতে পথিক পায় এক বন্ধ বাজার। দেখে এক পাহারাদার বসে ঝিমায়। তাকে জাগিয়ে ঘটনাটা বলে লোকটা। সব শুনে প্রহরী চাদরের ভেতর থেকে একটি হাত বের করে বলে, ‘কেমন হাত দেখেছিলেন, এ রকম?’ পুনরায় সেই লোমশ কালো হাত! সেখান থেকে পালিয়ে ছুটতে ছুটতে লোকটা এসে পড়ে এক থানার সামনে। ভেতরে টেবিলের ওপারে বসা এক দারোগা। টিমটিমে বাতি জ্বলছে দেখে লোকটা জানে পানি পায়। বারান্দা টপকে দৌড়ে গিয়ে দারোগাকে বলে, ‘ভাই বাঁচান’।

দারোগা তাকে বসিয়ে ধীর-সুস্থে ঘটনা শোনে। পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। জিজ্ঞাসা করে, ‘কেমন হাত দেখেছিলেন বলেন তো?’ লোকটা বলে। জবাব শুনে দস্তানাটা খুলে হাতটা সামনে বাড়িয়ে দারোগা বলে, ‘এ রকম দেখেছিলেন, এ রকম?’ তৃতীয়বারের মতো সেই লোমশ কালো হাতের থাবা দেখে লোকটার যে দশা, বোধ করি আমাদেরও সেই দশা।

ধর্ষক নেতাটির গ্রেপ্তারের খবর ইতিবাচক। বাকি চারজনকেও পুলিশ চাইলে খুঁজে বের করতে পারবে। কিন্তু ভাবছি ওই নারীর আড়াই বছরের শিশুটির কথা। এ ঘটনা কি তাকে বদলে দেবে? সম্প্রতি আলোড়ন জাগানো হলিউডি মুভি ‘জোকার’ দেখা হলো। কমেডিয়ান চরিত্রটির মানসিক অসুখ। হঠাৎ হঠাৎ তার প্রচণ্ড হাসি পায়, হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলে সে। জীবনে কোনো কিছুই হলো না তার। না প্রেম না স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ানের চাকরি। তার বন্ধু হয় না, রাস্তায় বখাটেরা তাকে পেটায়। জায়গায়-বেজায়গায় নার্ভাস হাসির জন্য বিপদেও পড়তে হয়। পরে জানা যায়, খুব ছোটবেলায় মা-সহ ছেলেটি নির্যাতিত হয়েছিল। তখনই তার মাথায় কোনো সমস্যা হয়। জীবনটা হয়ে পড়ে অভিশপ্ত। ছবির শেষে দেখা যায়, শহরের মেয়র-স্ত্রীসহ নিহত হলো কিশোর পুত্রের সামনে। থম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ওই ছেলেকে দেখে দর্শকের মনে পড়বে জোকারের কথা। এমন কোনো আঘাতই হয়তো জোকারকে জীবনের জন্য অকেজো করে ফেলেছিল।

এই ‘জোকার’ একদিন বিদ্রোহ করে। তার আজন্ম অপমান লাঞ্ছনার শোধ নেয়। সে হয়ে পড়ে হাজারো বিদ্রোহী তরুণের নায়ক। তাদের সবার মুখে জোকারের মুখোশ। তারা চায়, মানুষকে মানুষের মতো দেখা হোক।

আমাদের সমাজে কেবল নির্যাতক নারী-পুরুষই বাড়ছে না, বাড়ছে নির্যাতিত হয়ে মানসিক আঘাতগ্রস্ত নারী-পুরুষের সংখ্যা। বাড়ছে বাবা-মাকে ভয়াবহভাবে নির্যাতিত বা নিহত হতে দেখা শিশু-কিশোরের সংখ্যা। গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্তানদের মানসিক বিকাশ থমকে যাচ্ছে, কেউ কেউ আত্মহত্যাও করেছে বলে জানা যাচ্ছে। জোকারের মতো তাদের জীবনও যেন ধ্বংস হয়ে না যায়। ওই মর্মান্তিক কৌতুকটি যেন সত্যি না হয় যে অসুখী এক লোক বন্ধুকে বলছে, ‘আর কত দিন এই যন্ত্রণা সহ্য করব ভাই।’

বন্ধুর উত্তর, ‘বেশি না আর কিছুদিন করো।’
‘তারপর? তারপর কী হবে? শান্তি পাব?’
জবাব আসে, ‘তারপর তো তুমি মারাই যাবে, তখন কষ্ট করবে তোমার সন্তান।’

অমানবিকতার চাইতে ভয়াবহ হলো নিষ্ঠুরতাকেই ‘নিউ-নরমাল’, তথা নব্য–স্বাভাবিক বলে ভাবা।


নৃশংসতার শেষ কোথায়?


১. ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনো সমুদ্রবন্দর ছিল না, তৎকালীন সরকার ছয় মাসের জন্য কলকাতাবন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু ভারত আমাদেরকে রাস্তা মাপার পরামর্শ দিচ্ছিল। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মংলাবন্দর খুলে দিতে হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, আজ ভারতকে সে মংলাবন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে বাংলাদেশের কাছে। ২. কাবেরী নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে ভারতের কানাড়ি আর তামিলদের ‘কামড়া কামড়ি’ কয়েক বছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। সে দেশের এক রাজ্যই অন্য রাজ্যকে পানি দিতে চায় না। সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড় লাখ কিউবিক মিটার পানি দিবো। ৩. কয়েক বছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তর ভারত কয়লা-পাথর রফতানি বন্ধ করেছে। অথচ আমরা তাদের গ্যাস দিবো। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায় সেখানে আমাদের সম্পদ দিয়ে বন্ধুরা বাতি জ্বালাবে।

ওপরের কথাগুলো বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের একটি পোস্ট। আর এটিই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে আবরারের। নৃশংস পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করল বুয়েটের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।

একজন সন্তান বড় করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠানোর দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া বাবা-মায়ের জন্য বিরাট যুদ্ধ। সেটি মা-বাবাই বোঝে। আর যে ছেলে দেশের সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে তাকে কতটা যুদ্ধ করতে হয়েছে? সেই যুদ্ধ এভাবে শেষ হয়ে যাবে- ভাবতেও দম বন্ধ হয়ে আসে। আবরারের মায়ের আকুতি ‘আমার সন্তানের হাতের যে জায়গাটা তোমাদের আঘাতে আঘাতে নীল হয়ে আছে, ঠিক ওখানে ধরে তাকে স্কুলে নিয়ে যেতাম, তোমাদের কিলঘুষি আর নির্যাতনের নির্মম আঘাতে আমার ছেলের চোখ বন্ধ করে আছে, তোমরা জানো বাবা, ও যখন ঘুমাত আমি তার কপালে, চোখে চুমু খেতাম। আর মনে মনে চাইতাম সে যেন আরো একটু ঘুমায়, তোমরা তাকে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দিলে।’ মায়ের এমন আহাজারির জবাব কে দেবে? সরকার, প্রশাসন নাকি যারা বর্বর রাজনীতির ধারক-বাহক।

ক্ষমতার ছত্রছায়ায় এই দেশে প্রতিদিন কি পরিমাণ অত্যাচার চলে, সেটি আমরা টের পাই না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিদিন চলছে ক্ষমতার দাপট। এতে অন্ধ হয়ে একের পর এক নির্মম নৃশংসভাবে ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১ বছর আগে বর্তমান সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা ধর্ষণের সেঞ্চুরি করেছিল। দিনের পর দিন আন্দোলন করেও কোনো ফল হয়নি। বরং যারা আন্দোলন করেছে তাদের অনেকের ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে গেছে। অপরাধীদের কোনো বিচার হয়নি। বুয়েটের ছাত্রী সনি হত্যার শিকার হয়েছে। কোনো বিচার পায়নি তার পরিবার। সনি হত্যার প্রতিবাদে তখনো উত্তাল হয়েছিল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। আজ তার ধারাবাহিকতায় সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে। একের পর এক হত্যা এবং দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র দেশবাসীকে হতবাক করে তুলছে। কেউ প্রতিবাদী হলেই তার কপালে জোটে জেল জুলুম, না হয় গুম, হত্যা, নির্যাতন, মামলা ইত্যাদি।

দেশকে ডুবে যেতে দেখে, দেশবিরোধী পদক্ষেপে ছাত্রসমাজ প্রতিক্রিয়া জানাতেই পারে- যার জন্য একজন মেধাবী ছাত্রকে হলে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা যায় না। এটা কোনো স্বাধীন দেশ এবং গণতন্ত্রের ভাষা হতে পারে না। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় আমরা চোখে দেখেছি- বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থেকে শুরু করে স্কুলের শিশু-কিশোর পর্যন্ত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে যারা যুগের পর যুগ ধরে জগদ্দল পাহাড়ের মতো জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছিল। তাদের শিক্ষা দেয়ার জন্য সারা দেশে সে আন্দোলন এক অনন্য নজির সৃষ্টি করে দিলো। ওরা মার খেয়েছে রক্তাক্ত হয়েছে কোনো কোনো ছাত্রী লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে, এসব ঘটনায় পুলিশ এবং সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের দিকেই অভিযোগের আঙুল উঠেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছাত্রকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হলো- ভিসি তাকে দেখতে যাওয়া তো দূরের কথা, একটি বিবৃতিও দিলেন না। ভিসিও ওইসব ছাত্র নামধারী হায়েনাদের দোসর বলে বিবেচিত হোন, জাতি তা আশা করে না। আমরা ছাত্র রাজনীতি চাই। তা হবে আদর্শভিত্তিক এবং সেখানে হবে মেধার প্রতিযোগিতা। মা-বাবা তা হলে পাবেন তাদের যোগ্য সন্তান।

  • লেখকঃ তোফাজ্জল হোসাইন 
  • কার্টসিঃ নয়াদিগন্ত/ ২৭ অক্টোবর ২০১৯

বিদ্যুৎ খাতে অবিশ্বাস্য অদক্ষতা ও অপচয়



পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) পরপর ২০১৭ ও ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে সিদ্ধিরগঞ্জের বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বলে আখ্যা দিয়েছিল। ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, সিদ্ধিরগঞ্জ ৩৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রতি কিলোওয়াটে ব্যয় ৯৬১ ডলার, যা বিশ্বে বর্তমান সময়ে নির্মিত একই ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় যুক্তরাষ্ট্রের ডমিনিয়ন ভার্জিনিয়া পাওয়ার প্ল্যান্টে, প্রতি কিলোওয়াটের জন্য ব্যয় হয়েছে ৯৫৫ ডলার। তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল বিদ্যুৎকেন্দ্র পাকিস্তানের ৭৪৭ মেগাওয়াট সিন্ধু ইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট, যা কম্বাইন্ড সাইকেলের পাশাপাশি দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক, যার প্রতি কিলোওয়াটের খরচ ছিল ৮৫৪ ডলার।

আইএমইডির তথ্যমতে, ৫৬ শতাংশ তাপীয় দক্ষতায় নির্মিত হরিপুর ৪১২ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র আর ৫৮ শতাংশ তাপীয় দক্ষতার আশুগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির তুলনায় সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয় অনেক বেশি হলেও কেন্দ্রটির তাপীয় দক্ষতা কম (সাড়ে ৫৩ শতাংশ)। হরিপুরে কিলোওয়াটপ্রতি ব্যয় হয় ৮৪৭ ডলার, আশুগঞ্জে ৬৩৭ ডলার। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আইসোলেক্সের ব্যর্থতায় স্যামসাং পাওয়ারকে দিয়ে কিছুটা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে অত্যধিক ব্যয়ের পরও নির্ধারিত সময়ে উৎপাদন শুরু করতে পারেনি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।

এখানে কয়েকটি গুরুতর বিষয়ের পর্যলোচনা দরকার। এক. নিম্নমান ও আর্থিক সুনামের সংকটে থাকা ঠিকাদার আইসোলেক্সকে কাজ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতা যাচাই করা জরুরি ছিল। আইসোলেক্সের কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনভিজ্ঞতা আদৌ বিবেচ্য ছিল কি না?

দুই. আর্থিক সংকট, ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা এবং ব্রাজিল, কেনিয়া ও রুয়ান্ডায় আইসোলেক্স কন্ট্রাক্ট হারালেও বাংলাদেশ কেন সেসব তথ্য আগে থেকেই আমলে নিয়ে দেউলিয়া এ ঠিকাদার পরিবর্তন করে ফেলেনি?

তিন. হরিপুর ও আশুগঞ্জে বৃহৎ পরিসরে কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি সিদ্ধিরগঞ্জেও কেন শুরু থেকেই কম্বাইন্ড সাইকেল না করে সিঙ্গেল সাইকেল কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি করা হলো?

চার. কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বিশ্বের শীর্ষ দুই সুনামধারী কোম্পানি মার্কিন জিই ও জার্মান সিমেন্সকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশ কেন বারবার নিম্ন ও মধ্যমানের তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ দিচ্ছে; যারা এই প্রযুক্তির স্বত্ব রাখে না। ঠিকাদারের কারিগরি অযোগ্যতা প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বরে আইসোলেক্স, এমনকি সিম্পল সাইকেল ইউনিটকেও চালুর চেষ্টায় ব্যর্থ হয় গ্যাস বুস্টারের টিউনিংয়ের সমস্যার কারণে। এই সমস্যা সমাধান না করেই আইসোলেক্স বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যায় এবং পরবর্তী সময়ে নিজেদের আন্তর্জাতিকভাবে দেউলিয়া ঘোষণা করে। এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, উচ্চ প্রযুক্তিগত প্রকল্পে কারিগরি স্বত্বধারী টেকনোলজি ভেন্ডরকে বিবেচনা না করে বাংলাদেশ কেন একের পর এক অযোগ্য তৃতীয় পক্ষকে কাজ দেয় এবং এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুর্নীতির সম্পর্ক আছে কি?

পাঁচ. উচ্চপ্রযুক্তিনির্ভর যেকোনো খাতের বড় প্রকল্প নির্মাণের কারিগরি নকশা পর্যালোচনা করার যোগ্যতা বাংলাদেশ কবে অর্জন করবে? বাংলাদেশ কি বিভিন্ন খাতের জন্য আলাদা করে পর্যাপ্তসংখ্যক একাডেমিক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল এক্সপার্ট তৈরির গুরুত্বকে উপলব্ধি করে? সড়ক, সেতু, রেল, বন্দর ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোমিটার বা ইউনিটপ্রতি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি খরচ করার পরও কি বাংলাদেশে টেকনোলজি ট্রান্সফার হচ্ছে? চুক্তিগুলো কি টেকনোলজি ট্রান্সফারের অনুকূলে?

প্রকল্প পরিচালনার অদক্ষতা, কারিগরি অদূরদর্শিতা, নিম্নমানের ঠিকাদার নিয়োগের দুর্নীতিমনা ঝোঁক ও প্রকল্প বাস্তবায়নের অতি দীর্ঘসূত্রতার মতো অতি হীন বিষয়গুলোর পাশাপাশি সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্র আরেকটি শোচনীয় আর্থিক অপব্যবস্থাপনার জানান দিয়ে গেছে। সেটি হচ্ছে, বৈদেশিক ঋণের গ্রেস পিরিয়ডের অপব্যবহার। সিদ্ধিরগঞ্জে ৩০০ মেগাওয়াটের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ২০০৮ সালে ৩৫ কোটি ডলার দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। নির্মাণে চুক্তি সই করা হয় ২০১২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর কথা ছিল ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। প্রথমে সিঙ্গেল সাইকেলে করার কথা থাকলেও পরে কম্বাইন্ড সাইকেলে রূপান্তরের জন্য বিশ্বব্যাংক প্রকল্পে অতিরিক্ত ১৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার অর্থায়ন করে (তখনকার বিনিময় হার অনুযায়ী ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বেশি)। দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ হারে ৩৮ বছরে বাংলাদেশকে ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে হবে, যেখানে গ্রেস পিরিয়ড ছিল ছয় বছর। অর্থাৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সুফল আসার আগেই বৈদেশিক ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ। কারিগরি পরিকল্পনা, চুক্তি ও ঠিকাদার নিয়োগ ও প্রকল্প বাস্তবায়নের এই ভয়াবহতা বাংলাদেশের আরও বহু প্রকল্পে দৃশ্যমান।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে বর্তমান সরকারের দৃশ্যমান সাফল্য থাকলেও সেখানে আছে আরও বেশ কিছু কলঙ্ক, যা ভবিষ্যতে বর্তমান নেতৃত্বকে বিচারিক সংকটে ফেলার ঝুঁকি তৈরি করেছে। এ রকম তিনটি বিষয়ের একটি হচ্ছে চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে বারবার উচ্চমূল্যের কুইক রেন্টাল ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নবায়ন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, জ্বালানি খরচের বিপরীতে অদক্ষ বহুসংখ্যক ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন—যেগুলো পিডিবির বোঝা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তৃতীয়ত, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রক্রিয়ায় তৃতীয় পক্ষের যাচাই–বাছাইহীন চুক্তিতে উৎপাদন না করেই বিশেষ বিশেষ কোম্পানিকে অতি উচ্চহারে ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে যাওয়া। কয়েক বছর ধরে বেসরকারি খাতে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে সরকার। পাশাপাশি কয়েকটি মেয়াদোত্তীর্ণ রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোর চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। আর এ বিদ্যুৎ কেনায় প্রতিবছর মোটা অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)। গত ছয় বছরে পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার ৪৮৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এ ব্যয় বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনার প্রায় ৩৭ দশমিক ২২ শতাংশ, যদিও সরকারি উৎপাদনে এ ধরনের কোনো ব্যয় নেই।

দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে প্রায় ১৯ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু চাহিদা না থাকায় গ্রীষ্মকালেই উৎপাদন করা হয়েছে সর্বোচ্চ সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট, সঞ্চালিত হয়েছে আরও কম। শীতে তা ৭ হাজারে নেমে যাওয়ার শঙ্কা করা হচ্ছে। এতে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশই অলস থাকছে। চাহিদা বিবেচনা না করে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই দুই বছর আগে বেসরকারি খাতে নতুন কয়েকটি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে গুনতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ। ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) নামক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বোঝা টানতে হবে ১৫ বছর। ফলে বিদ্যুৎ খাতের বোঝা হয়ে উঠেছে এসব কেন্দ্র, যাদের কারও কারও ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়ছে ৭৫ (অ্যাগ্রিকো পাওয়ার সলিউশন) থেকে ৮১ টাকা (প্যারামাউন্ট বিট্রাক এনার্জি)। এই ধারণা অমূলক নয় যে সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতির চৌহদ্দিতে থেকেই অকারণে রাষ্ট্রের ৩৫ হাজার ৪৮৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা গচ্ছা গেল, ভবিষ্যতে যা আরও বাড়বে।

বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতের প্রধানতম আরেকটি সমস্যা হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে মানানসই বিদ্যুৎ সঞ্চালনের সক্ষমতা না থাকা এবং সঞ্চালনের সঙ্গে বিতরণ অবকাঠামোর ব্যাপক কারিগরি অক্ষমতা।

একদিকে নির্মাণে অতি উচ্চ খরচ হচ্ছে, অন্যদিকে প্রতারক ও দুর্নীতির ইন্টারফেসগুলো চুক্তির ফাঁকফোকরে লুটে নিচ্ছে, আরেক দিকে বিতরণ অবকাঠামোর অক্ষমতায় উৎপাদিত বিদ্যুতের পূর্ণ সুফল পাচ্ছে না দেশের গ্রামীণ ও শহুরে নাগরিক। সরকারি মাল এভাবে দরিয়ায় না ঢেলে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে সমন্বিত ও দুর্নীতিমুক্ত পদক্ষেপ নিতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সুদৃষ্টি কামনা করি।

Sunday, October 27, 2019

বাংলাদেশকে ভাবতে হবে

ড. মাহবুব উল্লাহ্
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব বলে কিছু নেই; দেশের স্বার্থটাই চিরন্তন। বাংলাদেশে যারা চিন্তার জগতের মানুষ বলে পরিচিত তারা অনেকেই মনে করেন আমাদের একটি চিরস্থায়ী বন্ধু আছে।

সেই বন্ধু আমাদের সঙ্গে যতই বিরূপ আচরণ করুক না কেন আমরা বারবার বলতে থাকব, ওই দেশটি তো আমাদের বিপদের সময়ের বন্ধু। সুতরাং কোনো অবস্থাতেই সেই দেশের মনোভাব আমাদের প্রতি বিরূপ হয়ে পড়ুক, সেটা আমরা কোনোক্রমেই হতে দেব না। এমনকি বিষয়টি যদি আমাদের জীবন-মরণের প্রশ্ন হয়, আমাদের আত্মমর্যাদার প্রশ্ন হয় তখনও আমরা বুকের মধ্যে সব ক্ষোভ চেপে রেখে মুখে হাসির রেখা টেনে বলতে থাকব, ওই মিত্র দেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো পদক্ষেপ আমরা নেব না।

এদেশের কেউ কি কখনও বলেছে, অন্য দেশের ক্ষতি করা হলে বাংলাদেশের কিছু আসে যায় না। আসল কথা হল বাংলাদেশকে যেসব আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তির মোকাবেলা করতে হচ্ছে, তাদের কারোর জন্যই বাংলাদেশ বিন্দুমাত্র হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে না। কারণ সামরিক শক্তির দিক থেকে বাংলাদেশ কোনো আঞ্চলিক শক্তির সমকক্ষ তো নয়ই বরং খুবই দুর্বল।

বাংলাদেশের শক্তি কী? বাংলাদেশের কি কোনোই শক্তি নেই? বাংলাদেশের কি কোনোই সম্পদ নেই? বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগোচ্ছে, এটা বাংলাদেশের শক্তি। হতে পারে এই শক্তি এখনও টেকসই হয়ে উঠতে পারেনি। বড় দুর্বল ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। যত কথাই বলা হোক না কেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শক্তির উৎস দুটি প্রধান খাত। এর একটি হল পোশাক শিল্পখাত এবং অপরটি হল বিদেশ থেকে পাওয়া রেমিটেন্স। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে দুটি প্রধান গন্তব্যস্থল হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। অতি সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের অবনতিশীল মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশকে যে অগ্রাধিকার মূলক সুবিধা দেয়া হচ্ছে তা আর অব্যাহত থাকবে না।

একইসঙ্গে শ্রমমান উন্নয়নের শর্তও জুড়ে দেয়া হয়েছে। শ্রমমান উন্নয়নের জন্য পোশাক শিল্প মালিকরা বেশকিছু কাজ করছে। এ ব্যাপারে তারা গত কয়েক বছর একর্ড ও এলায়েন্সের নজরদারিতে ছিল। সংবাদপত্রের খবর পড়ে জেনেছি, একর্ড ও এলায়েন্স পোশাক শিল্প মালিকদের সংস্কার কার্যক্রমে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তাহলে নতুন করে শ্রমমানের শর্ত উল্লেখ করা হচ্ছে কেন। আমি মেহনতি মানুষের পক্ষের লোক। পোশাক খাতে শ্রমিকরা ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে এমন কথা বলার সময় এখনও আসেনি। কূটনীতির ব্যঞ্জনা বড়ই অদ্ভুত।

একজন কূটনীতিবিদ যখন বলেন, তিনি দক্ষিণ দিকে যাচ্ছেন, আসলে তার গতিপথ দক্ষিণমুখী নাও হতে পারে। বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশের কূটনীতিবিদরা যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের গূঢ় ইঙ্গিত বুঝে থাকে, তাহলে ভালো কথা। নচেৎ কী হবে বলা মুশকিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা বা সাধারণ অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা স্থগিত করে রেখেছে। এসব বিবেচনা করলে বলতে হবে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প আন্তর্জাতিক বাজারে চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রেমিটেন্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি কম-বেশি ঊর্ধ্বমুখী ছিল।

তারপরেও বলতে হয় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমবাজার খুব সুখকর অবস্থার মধ্যে নেই। যেসব নারী গৃহকর্মী সৌদি আরবে গিয়েছিল তাদের অভিজ্ঞতা খুবই করুণ! এছাড়া বৈশ্বিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ প্রধানত অদক্ষ শ্রমশক্তিনির্ভর। আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারের ৪০ বছরেরও বেশি অবস্থান করার পর আমাদের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারল না, কীভাবে এ শ্রমবাজারকে আপগ্রেড করা যায়। সর্বোপরি শ্রমবাজার ব্যবস্থাপনার জন্য যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন সেই ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আজ পর্যন্ত গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। অর্থনীতিবিদরা ইন্সটিটিউশন বা প্রতিষ্ঠানের ওপর এত গুরুত্ব দেন কেন? তারা এর ওপর গুরুত্ব দেন এ কারণে যে, সঠিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারলে লেনদেনের ব্যয় অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বিষয়টি খোলাসা করা সম্ভব।

ধরুন দেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠান নেই। কিন্তু প্রচুর শিক্ষার্থী আছে যারা উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করতে চায়। আবার প্রচুর শিক্ষকও রয়েছে যারা উচ্চতর পর্যায়ের শিক্ষাদানে সক্ষম। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের খুঁজে খুঁজে বের করতে হবে কোন পণ্ডিতের বাড়িতে গেলে কোন বিষয়ে পাঠ নেয়া যায়। এ রকম পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের শহরময় শিক্ষকদের বাড়িতে যেতে অনেক সময় ও অর্থের অপচয় করতে হবে। আর শহরটি যদি ঢাকার মতো হয়, তাহলে যানজটে নাকাল হয়ে উচ্চতর জ্ঞানের পিপাসা নিবৃত্ত করার চেষ্টা ছেড়ে দিতে হবে।

এত সব সমস্যার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে জ্ঞানার্জন করার পর প্রশ্ন উঠবে সনদ বা সার্টিফিকেট কে দেবে? এসব সমস্যা অতিক্রম করার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব হয়েছিল। পাশ্চাত্যে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠার আগেই মুসলিম দুনিয়ায় এ রকম প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। যে গাউন পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কনভোকেশন উৎসব করে সেই গাউনও মুসলিম সভ্যতার সৃষ্টি। আজ বিশ্ব দরবারে মুসলিম দেশগুলোর অবস্থান কোথায়? বলছিলাম, প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার কথা। দেশের বাইরে শ্রমশক্তি রফতানির জন্যও গভীর চিন্তা-ভাবনা করে অভিজ্ঞতার আলোকে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, যেন গরিব শ্রমিকরা প্রতারণার শিকার না হয়, অভিবাসন ব্যয় যাতে ন্যায্য হয় এবং বিদেশে কর্ম পরিবেশ এবং কাজের শর্ত যাতে মানবিক হয়। এ আলোচনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠতে পেরেছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। এছাড়া উন্নয়নের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল অর্থনীতির বহুমুখীকরণ। বাংলাদেশে ছোট-বড়-মাঝারি বহু ধরনের শিল্প কারখানা গড়ে তোলা সম্ভব।

সরকার দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে চাচ্ছে। এগুলোকে সব ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধা দিয়ে গড়ে তোলা সম্ভব হলে হয়তো দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে। কিন্তু আমাদের ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের যে অবস্থা এবং পুঁজিবাজারের যে অবস্থা, সে অবস্থা কাটিয়ে উঠতে না পারলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগও খুব একটা উৎসাহিত হবে বলে আশা করা যায় না। অর্থাৎ অর্থনীতির যে শক্তির জোরে আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাই সে শক্তিটাও সঞ্চয় করা সম্ভব হবে না।

এবার আসা যাক আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সম্পর্কের শেকড় লুকিয়ে আছে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে। এ প্রশ্নে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুবই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছে। পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে ভারতে নরসিমা রাওরের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় থেকে। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনরি কিসিঞ্জার এখন মনে করেন অতীতকে পেছনে ফেলে রেখে দুটি দেশই নিরাপত্তা ও অর্থনীতি বিষয়ে সমান্তরাল উদ্যোগ নিয়ে আজকের সম্পর্কের জন্ম দিয়েছে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় হেনরি কিসিঞ্জারের ভূমিকা এদেশের অনেকেরই অজানা নয়। সেই সময় প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পলিসি ছিল Tilt Pakistan policy. প্রেসিডেন্ট নিক্সন ইন্দিরা গান্ধীকেও খুবই অপছন্দ করতেন। জনান্তিকে নিক্সন ইন্দিরা সম্পর্কে খুবই অশালীন শব্দ ব্যবহার করতেন।

হেনরি কিসিঞ্জারের বর্তমান বয়স ৯৬। নবতিপর হওয়া সত্ত্বেও তিনি এখনও মানসিকভাবে খুবই সজাগ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় অত্যন্ত তৎপর। হার্ভার্ডের সাবেক এ প্রফেসর একের পর এক বই লিখে চলেছেন। এসব দেখে মনে হয়, বার্ধক্য তাকে কাবু করতে পারেনি। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত অংশীদারিত্ব ফোরামে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ সংকট দুই দেশকে (ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) সংঘাতের কিনারায় নিয়ে গিয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের একদম শেষ পর্যায়ে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল ভারত ও পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র পাকিস্তানের পক্ষে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌ-বহর পাঠানোর ঘোষণা দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অজুহাত ছিল বাংলাদেশে থাকা মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তায় তারা এটি করেছে, তবে ভারত এ ঘটনাকে নিজেদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবেই দেখেছিল। কারোর কারোর ভাষ্য হচ্ছে, ভারত যাতে পশ্চিম পাকিস্তানও দখল করে ফেলতে না পারে, সেজন্যই যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ। কিসিঞ্জার বলেছেন, এটি ছিল কোল্ড ওয়ারের সময়। তাই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থও ছিল ভিন্ন।

বার্লিন সংকটের উদাহরণ দিয়ে হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, ওই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ও ভারত সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন না করায় মার্কিন সরকারের অনেকেই ছিলেন হতাশ। কিসিঞ্জারের ভাষায়, ভারত ছিল তখন ঐতিহাসিক বিবর্তনের সূচনালগ্নে। বিশ্বে যেসব সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল সেগুলোর সবটা ভারতের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।

ভারত তখন তার নিজস্ব বিবর্তন ও নিরপেক্ষতার নীতিতে নিবিষ্ট ছিল। আমি অবশ্য কিসিঞ্জার কথিত ভারতের নিরপেক্ষ দেহভঙ্গির ব্যাপারে সন্দিহান। কারণ ১৯৬২-র চীন-ভারত যুদ্ধের পর ভারত জোট নিরপেক্ষতার পরিবর্তে দ্বৈতপক্ষতার নীতি অবলম্বন করে। অর্থাৎ ভারত ছিল Doubly Aligned. ভারত তখন আমেরিকার অস্ত্র সাহায্য নিচ্ছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকেও অস্ত্র সাহায্য পাচ্ছিল।

কিসিঞ্জার উপর্যুক্ত ফোরামে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যখন চীনের জন্য নিজেকে উম্মুক্ত করে দিয়েছিল, সেই সময় হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। তার ভাষায়, আমরা এ সংকটকে দেখেছি বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায় যে, শুধু মৌলিক বিবর্তনই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সমান্তরাল উন্নয়ন করতে পারে। অনেক বছর ধরে আমরা এমন একটি পরিস্থিতিতে এসে পৌঁছেছি যেখানে অনেক ইস্যুতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অভিন্ন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য রয়েছে। হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, এ দুটি দেশের মধ্যে বিশ্বের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। পূর্ববর্তী কোনো আয়োজন ছাড়াই এ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে এ দুই দেশের মধ্যে।

কিসিঞ্জারের ভাষায়, যদি আপনি বিশ্বের দিকে তাকান তাহলে দেখবেন পৃথিবীর প্রতিটি স্থান উত্তাল। আপনি তাদের প্রত্যেকের জন্য একটি সাধারণ ধারণার বিকাশ ঘটাতে পারবেন না। প্রশ্ন উঠছে, ইন্দো-মার্কিন সমান্তরাল পথ চলায় বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়? বাংলাদেশ কি দুটি বড় শক্তির মধ্যে অভিসারের মতো অবস্থা দেখে সেই দ্বৈত শক্তিকে নৈবদ্য প্রদান করে যাবে? সেটা কি বাংলাদেশের স্বার্থানুকূল? বাংলাদেশের উপকূলজুড়ে ভারতের শক্তিশালী রাডার ব্যুহ নির্মাণের প্রশ্নে বাংলাদেশের সমঝোতায় পৌঁছানোর ব্যাপারটি বাংলাদেশকে বিশেষ বলয়ভুক্ত করে ফেলছে কিনা সেটাও তো ভাবার বিষয়। এ ব্যাপারে আমাদের সংবিধান কী বলে? সেটাও তো বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। আমাদের ভাবতে হবে, বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে আমরা কী পদক্ষেপ নিতে পারি? আমি পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ নই। পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞদের মুখেই শুনেছি, বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা রয়েছে। তাই যদি হয়, এ সুবিধা দেশের স্বার্থে কেমন করে কাজে লাগান হবে- সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

  • ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ
  • কার্টসিঃ যুগান্তর / ২৭ অক্টোবর ২০১৯

শিক্ষার্থীদের কাছে সংগঠনের আদর্শ তুলে ধরব

ইকবাল হোসেন শ্যামল
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে চলতি বছর কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব পেয়েছে ছাত্রদল। বর্তমানে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিপক্ষের হামলা-মামলায় পর্যুদস্ত ছাত্রদলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড অনেকটা সংকুচিত। নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে ছাত্রদল কতটা সক্রিয় হবে, সাংগঠনিক গতিশীলতা ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় কতটা তৎপর হবে—এসব বিষয় নিয়ে সম্প্রতি কালের কণ্ঠ’র পক্ষ থেকে কথা হয় ইকবাল হোসেন শ্যামলের সঙ্গে। কথা বলেছেন রফিকুল ইসলাম ও হাসান মেহেদী।

কালের কণ্ঠ : কেমন চলছে ছাত্রদল?


ইকবাল হোসেন শ্যামল : হামলা-মামলা, রোষানলের মধ্যে টিকে আছি। দেশে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা বিরোধীপক্ষের রোষানলের শিকার। শিক্ষার্থীর স্বার্থ ও অধিকার সম্পর্কিত কোনো দাবি আদায়ে কর্মসূচিতে গেলেই পড়তে হয় রোষানলে। রাজনৈতিক সহনশীলতা, শিষ্টাচার বলে এখন আর কিছু নেই। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রদলের সম্পৃক্ততাও অনেক কমে গেছে। তবে আমরা তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।

কালের কণ্ঠ : সারা দেশে ছাত্রদলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাই।


ইকবাল হোসেন শ্যামল : সারা দেশে ছাত্রদলের ১১৭টি ইউনিটের কার্যক্রম চলছে। বেশির ভাগ ইউনিটের মেয়াদ রয়েছে। কিছু ইউনিটে মেয়াদ পার হয়েছে। সরকারের রোষানলের কারণে সংগঠনের প্রতিটি ইউনিটের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই রাজনৈতিক সহাবস্থান নেই। প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় একটি বিশেষ সংগঠনের আধিপত্য সর্বত্র। ছাত্রদলের ১ নম্বর ইউনিটকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে দেয়নি ৯ বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আমরা ঢুকতে পারলেও প্রকাশ্যে হামলা করা হচ্ছে। ছাত্ররাজনীতির আঁতুড়ঘর মধুর ক্যান্টিনে গেলে চেয়ার সরিয়ে নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেহারা একই।

কালের কণ্ঠ : ২৭ বছর পর কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্বে এসেছেন। দায়িত্ব পালনে ছাত্রদলের সামনে চ্যালেঞ্জ কী?


ইকবাল হোসেন শ্যামল : দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। ছাত্রলীগ ও সরকার অনুগত প্রশাসনের নির্যাতনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে চলে গেছে ছাত্রদল, যা সংগঠনের ভিত্তিকে নাজুক করেছে। শিক্ষার্থীদের কাছে যেতে না পারলে সংগঠন আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। বিরূপ পরিবেশে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে সংগঠনের আদর্শ তুলে ধরা এখন আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এরই মধ্যে বিভিন্ন জেলা ইউনিটকে সে রকম নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

কালের কণ্ঠ : ছাত্র অধিকার আদায়ে ছাত্রদলের অগ্রাধিকার বিষয় কী কী?


ইকবাল হোসেন শ্যামল : একটি ছাত্রসংগঠনের প্রাণ সাধারণ কর্মী। কর্মী বাড়াতে শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। আমরা শিক্ষার্থী অধিকার আদায়ে অঙ্গীকারবদ্ধ। বিরূপ পরিস্থিতি ও হামলা-মামলার মধ্যেও ছাত্রদের অধিকার আদায়ে লড়ব। অনেকে বলেন ছাত্রদল সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে না। দীর্ঘদিন শিক্ষার্থীদের কাছে যেতে পারিনি, তাহলে আমরা কিভাবে কাজ করব? সারা দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবিতে শিগগিরই কর্মসূচি দেওয়া হবে।

কালের কণ্ঠ : দীর্ঘ সময় বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থাকায় ছাত্রদলের প্রকাশ্যে খুব একটা কর্মসূচি নেই। জেলা পর্যায়ে কর্মকাণ্ড অনেকটাই সংকুচিত। এই অবস্থায় সাংগঠনিক গতিশীলতা আনতে কী করবে ছাত্রদল?


ইকবাল হোসেন শ্যামল : দেখুন, সংগঠনে কমিটি না থাকলে ও দলে কর্মীর পরিচয় না পেলে সংগঠন গতিশীল হয় না। তাদের কাছে প্রত্যাশিত কাজও আশা করা যায় না। সংগঠনকে গতিশীল করতে ও নবীনদের রাজনীতির সুযোগ করে দিতে নিয়মিত কমিটি গঠন কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরেই সারা দেশের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির কার্যক্রম শুরু হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনূর্ধ্ব ৪৫ দিনের জন্য ৩১ থেকে ৪১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি করা হবে শিগগিরই। পরে গণতান্ত্রিক উপায়ে প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত নেতাদের কাছে দায়িত্ব তুলে দেওয়া হবে।

কালের কণ্ঠ : ছাত্রলীগ বুয়েটের আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে মেরেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে বুয়েট প্রশাসন। এ বিষয়ে কী ভাবছে ছাত্রদল?


ইকবাল হোসেন শ্যামল : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) পরিচালিত হয় ১৯৬১ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী। ওই সময় ক্ষমতায় ছিলেন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান। ইতিহাস বলে স্বৈরশাসকরা দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ চান না। মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে চান না। তাঁরা মনে করেন, তাঁদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ছাত্ররাজনীতি বড় হুমকি। আর সেটা অনুসরণ করে বর্তমান সময়ে বুয়েটের মতো একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সচেতন ছাত্র ও ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে এটা মেনে নিতে পারি না। আমরা মনে করি, ছাত্রলীগের এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ভার সব ছাত্রসংগঠন নেবে না। এর দায়ভার শুধুই ছাত্রলীগের। নিষিদ্ধ যদি করতে হয়, তাহলে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হোক।

  • সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
  • কার্টসিঃ কালের কণ্ঠ

Taqi’s murder in the list of unsolved mysteries

Why has no charge sheet been submitted in six years?

Tanwir Muhammad Taqi

It has been six years since the body of 17-year-old Tanwir Muhammad Taqi, a brilliant student, was found on the bank of the river Shitalakkhya after he had gone missing for two days in March 2013. According to his family, his murder is the result of a personal vendetta against Taqi’s father, cultural activist Rafiur Rabbi, for his political views. The fact that investigators did not submit a charge sheet before the court over the murder case filed by Taqi’s family gives rise to disturbing questions. Why has there been no charge sheet submitted after six years of this murder? Why have the law enforcement officers failed to arrest the people who have been accused by Taqi’s family? There have been rallies and discussions demanding justice for Taqi and his family, yet these have fallen on deaf ears. 

There is little doubt that the murderers are being protected by the culture of impunity enjoyed by the politically well-connected. There have been allegations against certain political leaders but because of their powerful connections, there has been no attempt to arrest them. Such inordinate delay in the investigation reflects an indifference on the part of the state to get to the bottom of the mystery. For ordinary people, when there is no justice for these horrendous crimes, it erodes confidence in the judicial system. Unfortunately for Bangladesh, there have been too many unsolved murders—Taqi, Tonu, Shagor-Runi— with no sign of progress in the investigations.

Now that the government seems to be trying to clamp down on corruption and crime committed by those associated with the ruling party, it would only be befitting if these unsolved murders are investigated properly and the culprits brought to book, regardless of their political connections. For Taqi’s family and the families of other such victims, only when the murderers are meted exemplary punishment will there be some closure. This is also the only way that public confidence in the state’s ability to ensure justice for its citizens can be restored.  

  • Courtesy  - The Daily Star/October 27, 2019

ঝুঁকিতে ব্যাংক, সিদ্ধান্ত নেন প্রভাবশালীরা

শওকত হোসেন

বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার প্রবণতার শিকড় অত্যন্ত গভীরে। প্রভাবশালী, ওপর মহলে ভালো যোগাযোগ আছে এবং ধনী, এমন কিছু ব্যবসায়ী ঋণ ফেরত দেওয়ার কোনো তাগিদই অনুভব করেন না। এমনকি বাংলাদেশে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও এখন নিচ্ছেন প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান এসব ঋণগ্রাহকেরা।

এসব মন্তব্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)। বাংলাদেশের আর্থিক খাত বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি বলেছে, এখানে খেলাপি আড়াল করে রাখা আছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি দুর্বল, ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের আচরণ বেপরোয়া। নিয়ম ভাঙলে শাস্তিও পান না তাঁরা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত অত্যন্ত ভঙ্গুর অবস্থায় এবং বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে।

আন্তর্জাতিক এই ঋণ সংস্থা ছয় মাস ধরে বাংলাদেশের আর্থিক খাত পর্যালোচনা করে সরকারকে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। সরকারের আমন্ত্রণেই আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা পর্যালোচনা (এফএসএসআর) করতে দুই দফায় বাংলাদেশে এসেছিল। প্রথম আসে গত এপ্রিলে, এরপর গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে। পর্যালোচনা শেষে সংস্থাটি ৪৩টি সুপারিশ করেছে। ৬৮ পৃষ্ঠার এই রিপোর্টে দেশের ব্যাংক খাতের নানা অব্যবস্থা ও সংকটের খোলামেলা আলোচনা করা হয়েছে।

লুকানো খেলাপি ঋণ

খেলাপি ঋণ নিয়ে দেশের ব্যাংক খাতের ভয়াবহ একটি চিত্রও তুলে এনেছে আইএমএফ। তারা বলেছে, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করা হয়, প্রকৃত খেলাপি ঋণ তার তুলনায় অনেক বেশি। প্রকাশিত খেলাপি ঋণের তথ্য দেখলে মনে হবে তা খুব বেশি নয়। কিন্তু প্রকৃত পরিস্থিতি অনেক বেশি খারাপ।

যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০১৮ সাল শেষে খেলাপি ঋণের হার মাত্র ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু আইএমএফ মনে করে, এর সঙ্গে যুক্ত করা উচিত আরও কয়েকটি বিষয়। যেমন আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে মোট ঋণের ৪ দশমিক ১ শতাংশকে খেলাপি ঋণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না, যা অবশ্যই করা উচিত। আবার বিশেষ নির্দেশিত হিসাব বা স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট—এই নামেও রাখা আছে মোট ঋণের ৫ দশমিক ৬ শতাংশ অর্থ। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে অনাপত্তি সার্টিফিকেট (এনওসি) দিয়ে রেখেছে। এ ধরনের ঋণের হার মোট ঋণের ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। আইএমএফ মনে করে, প্রকৃত চিত্র বুঝতে এই তিন ধরনের খেলাপি ঋণ অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

আইএমএফ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের তথ্য নিয়ে মন্তব্য করেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে গত জুন পর্যন্ত সময়ের খেলাপি ঋণের চিত্র পাওয়া যায়। সরকারি হিসাবে এ সময়ে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ৬৭৫ জন ঋণগ্রহীতা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে রেখেছেন। ফলে ঋণখেলাপি হিসেবে তাঁদের নাম বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) উল্লেখ করা হয় না। এ রকম ঋণের পরিমাণ এখন ৭৯ হাজার ২৪২ কোটি টাকা।

  • দুই দফা বাংলাদেশে এসে আইএমএফের প্রতিনিধিদল ৬৮ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন দিয়েছে
  • সেখানে সুপারিশ আছে ৪৩টি
  • লুকানো খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি
  • কমাতে হবে ব্যাংক পরিচালকের সংখ্যা
  • ভাঙতে হবে পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের বেপরোয়া আচরণের চক্র


বিভিন্ন সময়ে বিশেষ ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়। সরকারের নির্দেশে বারবার ঋণ পুনঃ তফসিল করার উদাহরণও আছে। ২০১৫ সাল থেকে শুরু হয়েছে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণের পুনর্গঠন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এ রকম বিশেষ নির্দেশিত হিসাবে থাকা ঋণের পরিমাণ ২৭ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিয়ে গত জুন পর্যন্ত আরও ২১ হাজার ৩০৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করে দিয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক।

এভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হলে দেশে এখন খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। আইএমএফ এসব ঋণ অন্তর্ভুক্ত করেই খেলাপি ঋণের হিসাব করার পক্ষে।

এদিকে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা বদল করা হয়। ২০১২ সাল থেকে অনুসরণ করা আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী, ৩ মাস ঋণ অনাদায়ি থাকলে তাকে নিম্নমান বলা হতো। নতুন নিয়মে তা ৬ মাস করা হয়েছে। ৬ মাসের অনাদায়ি ঋণকে বলা হতো সন্দেহজনক, এখন তা ৯ মাস করা হয়েছে। সবশেষে ৯ মাসের সময় ঋণ অনাদায়ি হলে তাকে বলা হতো মন্দ ঋণ, এখন তা ১২ মাস করা হয়েছে।

আইএমএফের সুপারিশ হচ্ছে, ঋণ ৯০ দিন অনাদায়ি হলেই তাকে শ্রেণিবিন্যাস করে খেলাপি ঋণ করতে হবে। এটাই আন্তর্জাতিক রীতি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আইএমএফ যা বলছে, ঠিক সে কথাগুলোই দেশের অর্থনীতিবিদেরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন। এসব কথা যে সত্যি, তা-ই প্রমাণিত হলো। এখন প্রয়োজন প্রতিকার। এটা ঠিক যে খেলাপি ঋণ বিভিন্নভাবে লুকিয়ে রাখা হয়। এসব দেখেও না দেখার ভান করা হয়। দেশে প্রকৃত খেলাপি ঋণ অনেক বেশি।

প্রভাবশালীরাই সিদ্ধান্তদাতা

আইএমএফ তাদের প্রতিবেদনে প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের ক্ষমতার একটি উদাহরণ উল্লেখ করেছে। যেমন গত আগস্টেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ১১ বৃহৎ ঋণগ্রহীতার ১৫ হাজার ১৮০ কোটি টাকার ঋণ নবায়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়। চার বছর আগে, ২০১৫ সালে এই ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, এই বিশেষ সুবিধা নিয়ে কেউ খেলাপি হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তারপরও এসব ঋণের বড় অংশ আবার খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে এবার তারা কঠোর হবে, ঋণ পুনর্গঠনের পরও যাঁরা আবার খেলাপি হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দেউলিয়া আইন-১৯৯৭ প্রয়োগ করতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে বলা হবে, যাতে প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতারা বুঝতে পারেন, বারবার খেলাপি হলে আর পার পাওয়া যাবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন করে নবায়নের সুযোগ দিয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতারাই এখানে আর্থিক খাতের সিদ্ধান্ত নেন। আইএমএফের মন্তব্য হচ্ছে, ঋণখেলাপিদের প্রতি এ ধরনের সহৃদয়তা দেশের সামগ্রিক ঋণ শৃঙ্খলাকেই বিনষ্ট করে।

আইএমএফ আরও বলেছে, এ দেশে একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঋণ ফেরত না দেওয়ার প্রবণতা কাজ করে। প্রভাবশালী ও ধনী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ওপর মহলের যোগাযোগ ভালো এবং তাঁরা ঋণ ফেরত দেওয়ার তাগিদই অনুভব করেন না। কারণ, তাঁরা জানেন, তাঁদের কিছু হবে না। যদিও ক্ষুদ্র ও দরিদ্রদের মধ্যে ঋণ ফেরত দেওয়ার হার অনেক বেশি। সংস্থাটি বলেছে, এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে অপরাধী ঋণগ্রহীতারা অর্থ ফেরত দিতে বাধ্য হন। যদিও বাংলাদেশে এর উল্টোটা দেখা যাচ্ছে, তাঁরা ঋণ ফেরত না দিতে বরং উৎসাহ পাচ্ছেন।

সামগ্রিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা দৃশ্যমান, কে আর্থিক খাতের সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছে। এটা সবাই জানে। এ জন্য সব সুবিধা যাচ্ছে খারাপ গ্রাহকদের পক্ষে। এতে ভালো ও ছোট গ্রাহকেরা উৎসাহ হারাচ্ছেন। তাঁদের জন্য কোনো প্রণোদনাও নেই। আমি বলব, আর্থিক খাতে এখন “বিকৃত প্রণোদনা” দেওয়া হচ্ছে। এসব কারণেই আর্থিক খাতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ থেকে বের হতে হবে।’

ক্ষমতা প্রয়োগ করে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক

আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশে আর্থিক খাতের বড় দুর্বলতা হচ্ছে, বিদ্যমান নিয়মকানুন অনুসরণ করা হয় না। আর যখন ব্যাংক এসব মানে না, তখন তা নজরদারিও ঠিকঠাক করা হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে না। আবার ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপকেরা এমন অনেক কাজ করেন, তাতে তাঁদের পদ থাকারই কথা নয়। অথচ ক্ষমতার অপব্যবহার বা দায়িত্বে অবহেলার জন্য অবশ্যই পরিচালক পদ থেকে নিষিদ্ধ করা উচিত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে বাকিদের কাছে সেটিই হতো একটি জোরালো সংকেত। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এখানে ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের বেপরোয়া আচরণের চক্র অবশ্যই ভাঙতে হবে।

আইএমএফ মনে করে, বাংলাদেশ ব্যাংকের যতখানি স্বাধীনতা থাকা উচিত, তা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা বাড়াতে আইএমএফ ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৫৮ ধারা সংশোধনের সুপারিশ করেছে। এ ধারায় নির্দেশনা পালনে একাধিকবার ব্যর্থ বা আমানতকারীদের ক্ষতি করছে, এমন ব্যাংককে সরকার অধিগ্রহণ, সাময়িকভাবে বন্ধ ও অবসায়ন করতে পারে। আইএমএফ এসব ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়ার পক্ষে।

আইএমএফ ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারারও সংশোধন চেয়েছে। এ ধারায় বাংলাদেশ ব্যাংক সরকার কর্তৃক মনোনীত বা নিযুক্ত কোনো চেয়ারম্যান বা পরিচালককে অপসারণ করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক কেবল এ নিয়ে সরকারের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠাতে পারে। প্রসঙ্গত, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির সময় পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার জন্য ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক এই ধারা অনুযায়ী সরকারের কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল। কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি।

এ অবস্থায় আইএমএফ বলেছে, সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সরকারি ব্যাংকগুলোকে পুরোপুরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারির আওতায় আনা হবে। সুতরাং তারা সরকারি ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংককে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে।

আর নতুন ব্যাংক নয়

আইএমএফ মনে করে, বাংলাদেশে আর নতুন ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়া ঠিক হবে না। নতুন যেসব ব্যাংক এসেছে, তারা কেউ কার্যকর প্রতিযোগিতা গড়ে তুলতে পারেনি। তারা নতুন তহবিলও আকৃষ্ট করতে পারছে না। বরং উচ্চ ঝুঁকির বিনিয়োগ করছে। এমনিতে অন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেশি, কিন্তু পরিচালনার দক্ষতায় অনেক পিছিয়ে। ব্যাংক খাতের জন্য দক্ষ ও ভালো বিনিয়োগকারী যদি থেকেই থাকে, তবে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা না করে তারা বিদ্যমান ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ করতে পারে।

উল্লেখ্য, দেশে এখন ব্যাংকের সংখ্যা ৫৯। এর বাইরে আরও তিনটি কার্যক্রম শুরুর প্রক্রিয়ায় আছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালের পর আওয়ামী লীগ সরকার ১৪টি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে। এর অনেকগুলোই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। এর আগে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আরও ১৩টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। এর বাইরে এরশাদের আমলে ৯টি এবং বিএনপির আমলে (১৯৯১-৯৬) আরও ৮টি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। আর বিএনপির পরের মেয়াদে চাপ থাকলেও নতুন ব্যাংক দেওয়া হয়নি।

পরিচালকের সংখ্যা কমাতে হবে

বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা যেমন বেশি, পরিচালকের সংখ্যাও বেশি। বর্তমানে প্রতিটি ব্যাংকে পরিচালকের সংখ্যা ২০। আইএমএফ মনে করে, ব্যাংকের সুশাসনের জন্য এই সংখ্যা অনেক বেশি। আইএমএফ স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যাও তিনজন থেকে বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি নিরীক্ষা কমিটি ও ঝুঁকি নিরূপণ কমিটি যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সে ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। এ ছাড়াও তারা আগামী ৫ বছরের মধ্যে ব্যাংকের ন্যূনতম মূলধন ৪০০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬০০ কোটি টাকা করতে বলেছে।

ঝুঁকির মধ্যে ব্যাংক খাত

আইএমএফ মনে করে, বাংলাদেশ সন্ত্রাসী অর্থায়নসহ টাকার সব ধরনের অবৈধ ব্যবহার বা মানি লন্ডারিংয়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে আছে। এসব কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে বাংলাদেশের অগ্রগতি খুবই কম। বিশেষ করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারি ব্যাংকগুলো পিছিয়ে আছে। ফলে বাংলাদেশের পুরো আর্থিক খাত সুনামহানির ঝুঁকির মধ্যে আছে। সুনামজনিত সংকট দেখা দিলে বিদেশের অন্যান্য ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন এবং নিউইয়র্কের বাজারে ঢুকতে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর অসুবিধা হতে পারে। বিশেষ করে গত ১ সেপ্টেম্বর চীন বাংলাদেশের ৫টি ব্যাংককে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। এটা হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি সতর্ক বার্তা, যাতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে, নইলে বিপদে পড়বে বাংলাদেশ।

সবশেষে আইএমএফ জ্বালানি খাতে অনেক বেশি পরিমাণে ঋণ দেওয়া হচ্ছে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি তাদের সুপারিশ হচ্ছে, কোনো একক ঋণগ্রহীতা বা গ্রুপকে মোট মূলধনের ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার যে সীমারেখা, তা কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা প্রয়োজন। কেননা, এই ব্যবস্থায় মাত্র তিনজন বড় ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে পুরো ব্যাংকই দেউলিয়া হয়ে যাবে।

সামগ্রিক বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, আইএমএফ যা বলছে, তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি না হয়ে দিন দিন শুধু খারাপই হচ্ছে। প্রভাবশালীরা ব্যাংকিং খাতকে তাঁদের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করছেন। নীতিনির্ধারণী পরিবর্তনও আনছেন। বাজার ব্যবস্থার পরিপন্থী অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সুদহারে ৬ ও ৯ শতাংশ, ২ শতাংশ জমা দিয়ে ঋণ পুনঃ তফসিল করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। গত ১০ বছরে ব্যাংক খাতের জন্য আসলে সহায়ক কোনো ভূমিকাই নেওয়া হয়নি।

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, আইন পরিবর্তন করে ব্যাংকগুলোকে একক পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আবার একটি পরিবার বেশ কয়টি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানির নামে বড় অঙ্কের ঋণ কয়েকজন গ্রাহকের কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতের ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে।

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ২৭ অক্টোবর ২০১৯