Search

Sunday, November 3, 2019

এক দরদি রাজনীতিবিদের স্মৃতি

মাসুম খলিলী


তরিকুল ইসলাম
একসময় রাজনীতির সাথে সমাজ রাষ্ট্র জনগণের সেবার ছিল অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। সাধারণভাবে রাজনীতিকে ‘রাজার নীতির’ সাথে সম্পর্কিত ভাবা হলেও কালক্রমে সমাজে গণতন্ত্র ও প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন বিস্তৃতির সাথে সাথে রাজনীতি কার্যকরভাবে ‘নীতির রাজাতে’ পরিণত হয়। উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের সময় ভারতীয় উপমহাদেশ অঞ্চলে রাজনীতিকে এক ধরনের দেশদ্রোহিতায় রূপান্তর করা হয়েছিল। পাকিস্তান শাসনামলে তা কিছুটা নমনীয় হয়। কিন্তু এরপর বৈষম্যবিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রাম এই ভূখণ্ডে একপর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির রূপ দাঁড়ায় ভিন্ন এক ধরনের। কিন্তু রাজনীতির চক্র যেন এখন আবার পুরনো জায়গায় ফিরে আসছে।

তরিকুল ইসলাম ছিলেন আগাগোড়াই একজন আদর্শবাদী রাজনীতিবিদ। মাটি মানুষের প্রতি অঙ্গীকার থেকে যারা রাজনীতি করেন, তাদের জীবন ধারায় সাফল্য ব্যর্থতা আর জেল-জুলুমের যে পর্বগুলো অনিবার্য হয়ে উঠে তরিকুল ইসলামেরও তাই। ঔপনিবেশিক আমলে জন্ম নেয়া এ ব্যক্তির পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের শিক্ষা জীবনকালে আদর্শবাদী রাজনীতির প্রধান অ্যাজেন্ডা ছিল বৈষম্য ও শোষণমুক্তি। ছাত্রজীবনেই তিনি সেই রাজনীতিতেই দীক্ষা নেন। ১৯৬৩-১৯৬৪ সালে ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হিসেবে মাইকেল মধুসূদন কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৬২ সালে যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজের জরাজীর্ণ শহীদ মিনার মেরামত করতে গেলে তৎকালীন সামরিক সরকার তাকে গ্রেফতার করে। এরপর ১৯৬৮ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন করে নয় মাস রাজশাহী এবং যশোরে কারাভোগ করেন তরিকুল ইসলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়ায় আবারো কারাভোগ করেন তিনি। এরশাদ শাসন এবং ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময়ও কারাবরণ করতে হয় তাকে।

মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ভাবধারার প্রতি একনিষ্ঠ ছিলেন তরিকুল ইসলাম। বাম ছাত্র রাজনীতির মাঠকর্মী থাকার পর রাজনৈতিক জীবনে স্থানীয় নেতা, সেখান থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারক হিসেবে ভূমিকা রেখেছিলেন তরিকুল ইসলাম।

মওলানা ভাসানীর রাজনীতির বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মবিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতার সাথে শোষণমুক্ত সমাজ কাঠামোকে একাত্ম করে তা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা। ভাসানী আবুজর গিফারী র:-এর বিশ্বাস এবং মাও সে তুং-এর শোষণমুক্তির রাজনীতি থেকে নিজের কর্মপ্রেরণা নিয়েছিলেন।

এই মজলুম জননেতা সারা জীবন কাটিয়েছেন সংগ্রাম ও জনগণের কাতারে থেকে। তরিকুল ইসলাম যখন যশোর এম এম কলেজের ছাত্রনেতা ছিলেন, তখন মওলানার সেই আদর্শ তার গভীর মন ও মননে প্রতিষ্ঠিত হয়। মওলানা ভাসানীর জীবনটা যেমন ছিল ত্যাগ নিষ্ঠা ও জনগণের প্রতি দরদ ও আনুগত্যে ভরা, তরিকুল ইসলামও ছিলেন তাই। ১৯৭০ সালে তিনি আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন। সক্রিয় অংশ নেন করেন মুক্তিযুদ্ধে। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি থেকে প্রথমে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল আর পরে জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যোগ দেন তিনি। বিএনপির প্রথম আহ্বায়ক কমিটির ৭৬ সদস্যের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। যশোর জেলা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়কের দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। তিনি বিএনপির যুগ্মমহাসচিব, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, ভাইস চেয়ারম্যান ও ২০০৯ সালের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের পঞ্চম কাউন্সিলে স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।

ভাসানচরের ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী জনগণের নেতায় পরিণত হন। আজীবন তাই তিনি ছিলেন। তিনি শেরেবাংলার লাহোর প্রস্তাব অনুসারে অখণ্ড বাংলা ও আসামকে নিয়ে একটি পৃথক রাষ্ট্র কামনা করেছিলেন। সেই স্বপ্ন পূরণ না হলেও পরে খণ্ডিত বাংলাদেশেই তার স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন মওলানার স্নেহধন্য। তারা এক সাথে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করলেও পরে দু’জনের রাজনৈতিক পথে বেশ খানিকটা ভিন্নতা সৃষ্টি হয়।

মওলানা ভাসানী তার রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তান থেকে শোষণমুক্তির জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ অনিবার্য হয়ে উঠবে। আবার পিন্ডির শোষণমুক্তির পর দিল্লির শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ার সংগ্রামও একসময় অনিবার্য হয়ে দেখা দেবে। শহীদ জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের রাজনীতির প্রাথমিক শেকড়টি প্রোথিত ছিল ওখানে। মরহুম শেখ মুজিবকে যারা রাজনৈতিক আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছিলেন তারা জানেন, এই রাষ্ট্রনায়ক শৃঙ্খল পরা স্বাধীন দেশের শাসক হতে চাননি।

এ জন্য তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে দ্রুততম সময়ে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন। যে ৭ দফা গোপন চুক্তি সৈয়দ নজরুল-তাজউদ্দীনের প্রবাসী সরকার দিল্লির সাথে সম্পন্ন করার কথা বলা হয় এর কোনো ধারা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে বাস্তবে রূপায়িত করেননি। স্বাধীন দেশের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সশস্ত্রবাহিনী তিনি গঠন করেন। পাকিস্তান প্রত্যাগত বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিজ নিজ বাহিনী ও কর্মক্ষেত্রে বহাল করেছেন। ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতের বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে লাহোর যান। চীন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক নির্মাণের উদ্যোগ নেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুর এই রাজনৈতিক কৌশলের ক্ষেত্রে মওলানা ভাসানীর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক প্রভাবের বিরাট ভূমিকা ছিল। ’৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর মওলানা ভাসানীর লালিত এই রাজনীতিই জিয়াউর রহমান ধারণ করে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক অনুসারী তরিকুল ইসলাম খুলনা বিভাগীয় অঞ্চলে আধিপত্যবাদবিরোধী স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে রাখা বাংলাদেশ গড়ার রাজনৈতিক সংগ্রামে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।

বিএনপির অনেক সমালোচক জাতীয়তাবাদী দলকে একটি ক্লাব বা ফোরামের সাথে তুলনা করেন। বলে থাকেন, সুবিধা-অসুবিধার বাঁকে বাঁকে দল পাল্টে এখানে অনেকে নেতা বা মন্ত্রী হয়েছেন। বিএনপির যেসব নেতা এর বিশেষ ব্যতিক্রম তাদের একজন হলেন তরিকুল ইসলাম। তিনি মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী হিসেবে সেই ধারাবাহিকতায় বিএনপি সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি এর মাঠপর্যায়ের সংগঠক নেতা মন্ত্রী এবং সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। বিএনপির রাজনীতির প্রতি একনিষ্ঠতার কারণে এরশাদের সেনাশ্রয়ী শাসন, ওয়ান ইলেভেন এবং পরবর্তী আওয়ামী লীগের আমলে তাকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, কিন্তু তিনি কোনো সময় রাজনীতির আদর্শগত পথ থেকে বিচ্যুত হননি।

তরিকুল ইসলাম বিএনপি সরকারের সময় তথ্য, সমাজকল্যাণ, রেল ও যোগাযোগ, টিঅ্যান্ডটি, খাদ্য এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে পূর্ণাঙ্গ কেবিনেটমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অর্থনীতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন আর মাঠ রাজনীতির অভিজ্ঞতার সমন্বয় নিয়ে মন্ত্রণালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে বেশ দক্ষতার পরিচয় দিতে পেরেছেন যশোরের এই জননেতা। মন্ত্রী থাকাকালে এবং বিরোধী রাজনীতির সময় তার শয়নকক্ষে বা হাসপাতালের কেবিনে শিয়রের পাশে বসে গল্প করা বা আলোচনার সুযোগ হয়েছে। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আমার মনে হয়েছে, এই জননেতা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে অনেক গভীরভাবে বুঝতে পেরেছিলেন।

২০০৭ সালে বাংলাদেশের আকাশে যখন দুর্যোগের ঘনঘটা তখন বিএনপির অনেক নেতাকে বেশ খানিকটা নিরুদ্বিগ্ন মনে হতো। তাদের ধারণা ছিল, বিএনপি আবার ক্ষমতার ধারায় ফিরে আসবে। তারা বাংলাদেশের রাজনীতি ও ক্ষমতার গভীর বলয়ের খেলাধুলাগুলোকে পাঠ করতে পারেননি। কিন্তু তরিকুল ইসলাম ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি এ ব্যাপারে সতর্ক করার চেষ্টা করেছেন। আমি যতটা জানি প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করার ফর্মুলাকে তিনি ভালো সিদ্ধান্ত বলে মনে করেননি। এ সিদ্ধান্ত বিএনপির জন্য পরে বিপর্যয়কর প্রমাণ হয়েছে।

তরিকুল ইসলামের পুরো রাজনীতি ছিল আধিপত্যবাদবিরোধী। কিন্তু তিনি বাস্তবতাকে উপেক্ষা করার মধ্যে কল্যাণ দেখতে পেতেন না। ভারতের সাথে সম্পর্ক তলানিতে নিয়ে যাওয়াকে তিনি দলের জন্য ক্ষতিকর মনে করতেন। তবে দলের মূল নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যের ক্ষেত্রে তিনি কোনো সময় নমনীয়তা দেখাননি। বিএনপির সাবেক মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার প্রতি রাজনৈতিক পটভূমি ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে তার ছিল সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতা। কিন্তু ওয়ান ইলেভেনের কারিগরদের সাথে যোগাযোগ রেখে দলে ভিন্ন ধারা সৃষ্টির উদ্যোগে তিনি কোনো ধরনের সাড়া দেননি। এ জন্য তাকে ভঙ্গুর শরীর নিয়ে ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময় কারা নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়েছে। জীবিত তরিকুল ইসলাম জেল থেকে বেরুতে পারেন কি না, তা নিয়ে পরিবারের মধ্যে শঙ্কা সৃষ্টি হয়।

সংবাদকর্মী হিসেবে তরিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও মামলার গভীরতা সম্পর্কে তখনকার নীতিনির্ধারকদের কারো কারো কাছ থেকে জানার চেষ্টা করেছিলাম। আমার মনে হয়েছে, তরিকুল ইসলামের দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগগুলো ছিল একবারে ঠুনকো। আসলে তার অপরাধ ছিল জিয়াউর রহমানের রাজনীতি ও তার উত্তরাধিকারের প্রতি আনুগত্য। সে আনুগত্য ত্যাগে নমনীয়তা দেখালে তিনি তখন অনেকের মতো জেলের বাইরে ভালো থাকতে পারতেন। কিন্তু সেটি হলে যে আদর্শবাদী রাজনীতিবিদ ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিত্ব এবং সার্বভৌমত্বের প্রহরী হিসেবে তরিকুল ইসলাম এখনো স্বীকৃত ও স্মরিত হচ্ছেন তা হয়তো হতো না।

একজন মন্ত্রীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তার মন্ত্রণালয়ের সচিব সবচেয়ে সম্যক অবগত থাকেন। তরিকুল ইসলাম যখন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ছিলেন তখন জাফর আহমেদ চৌধুরী ছিলেন সেই মন্ত্রণালয়ের সচিব। সংবাদকর্মী হিসেবে আমার শ্রদ্ধাভাজন ও ঘনিষ্ঠ আমলাদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। নীতিনিষ্ঠা এবং সততার ব্যাপারে ১৯৭৯ ব্যাচের এই মেধাবী বিসিএস কর্মকর্তা সব সময় তরিকুল ইসলাম সম্পর্কে অতি উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। মনে আছে একবার তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হারিছ চৌধুরীর এক তদবির না শোনার কারণে বন সচিব সরকারি কাজে বিদেশে থাকাকালেই তার বদলির আদেশে তিনি স্বাক্ষর করিয়ে নেন। তরিকুল ইসলামের অজ্ঞাতসারে এ ধরনের সিদ্ধান্ত হওয়ার বিষয়টি পরে জানতে পারেন মন্ত্রী। তরিকুল ইসলাম এ সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিত করতে বাধ্য করেন এবং পরে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাথে যোগাযোগ করে তা বাতিল করেন।

তরিকুল ইসলামের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রতি বিএনপিপ্রধান বেগম খালেদা জিয়ার ছিল বিশেষ আস্থা। জটিল কোনো সমস্যা দেখা দিলে বেগম জিয়া তরিকুল ইসলামের সাথে পরামর্শ করতেন এবং অনেক সময় সমস্যা সমাধানে তাকে দায়িত্ব দিতেন। তরিকুল ইসলাম যে বৃহত্তর খুলনা বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্বে ছিলেন সেখানে দলীয় কোনো সঙ্কট অথবা নির্বাচনের সময় জোটের শরিকদের সাথে কোনো সমস্যা দেখা দিত না। এ অঞ্চলে স্থানীয় বা জাতীয় নির্বাচনে সমন্বয় অন্য অনেক এলাকার চেয়ে বেশি সুসংহত ছিল। বিএনপির রাজনীতিকে অনেক গভীরভাবে বুঝতেন বলেই সম্ভবত এটি হতো।

বেগম খালেদা জিয়া চেয়েছিলেন, বিএনপির মহাসচিবের দায়িত্ব তরিকুল ইসলামকে দিতে। তারেক রহমানও এ ব্যাপারে সম্মত ছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের কারণে তরিকুল ইসলাম এ দায়িত্ব নিতে চাননি।

৭২ বছর বয়সেই জনাব তরিকুল ইসলাম স্থায়ী জীবনে চলে গেছেন। সপরিবারে হজ থেকে ফেরার পর তাকে পরবর্তী জীবনের মানসিক প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়। কিছু মানুষ থাকেন যাদের অন্তরের ভেতরের গভীর মমতা মুখের ভাষায় বোঝা যায় না। তরিকুল ইসলাম ছিলেন তেমন একজন ব্যক্তিত্ব। তার গভীর সান্নিধ্যে যারা গেছেন তারা অন্য এক তরিকুল ইসলামকে প্রত্যক্ষ করেছেন। যার মুখের ভাষার স্পষ্টবাদিতার গভীরে লুকিয়ে থাকত অন্তহীন দরদ ও শুভ কামনা। পরম করুণাময় তার ভুলত্রুটি মার্র্জনা করে জান্নাতের উন্নত বাগানে তাকে স্থান করে দিন- সেই আকুতি তার এই মৃত্যু দিবসে।

  • কার্টসি —  নয়াদিগন্ত/ নভেম্বর ২, ২০১৯ 

টোকাই থেকে মস্তান, সন্ত্রাস থেকে ‘সম্রাট’

তৈমূর আলম খন্দকার


তৈমূর আলম খন্দকার
টোকাই, মস্তান, সম্রাট, মাফিয়া প্রভৃতি আমাদের সমাজে বিশেষ করে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে কিছু শব্দ অতি গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল প্রচারিত। টোকাই শব্দটি বাংলা সংস্কৃতি বা বাংলা অভিধানে সদ্য আমদানি করা। রাজনৈতিক অঙ্গনেও এর এখন অনেক সমাদর, আগে যা ছিল না। টোকানি থেকে টোকাই শব্দের উৎপত্তি। মানুষের অপ্রয়োজনীয় বা মূল্যহীন দ্রব্যাদি, যা ফেলে দেয়া বা পৌরসভার আবর্জনা থেকে সংগৃহীত পরিত্যক্ত দ্রব্য সের দরে বিক্রি করে যারা জীবিকা নির্বাহ করে তারাই টোকাই বা টোকানি নামে পরিচিত ছিল। খ্যাতিমান কার্টুনিস্ট রণবীরের আঁকা একটি কার্টুন প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই ‘টোকাই’ শব্দটি আলোচনায় আসে। টোকানি এখনো আছে, তবে টোকানি থেকে টোকাইদের পদমর্যাদা বেড়েছে। কারণ, টোকাইরা এখন সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক ভায়োলেন্সে জড়িত হয়ে টোকানিদের চেয়ে অধিক পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে। টোকানিদের গন্তব্যস্থল ভাঙ্গারির দোকান পর্যন্ত, অন্য দিকে বর্তমানে টোকাইদের অবস্থান অনেকটা এগিয়ে। কারণ, তারা এখন জমি দখল, সন্ত্রাস ও রাজনীতিতে ব্যবহার হচ্ছে। টোকাই পৃথিবীর উন্নত দেশেও রয়েছে। যাদের অন্যতম পেশা চুরি, ছিনতাই বা ছিঁচকে চোর; যারা সাধারণত Street Boy হিসেবে চিহ্নিত। আদালতের ভাষায় তারা Deliquent। বিগত সময়ে দু’টি সরকার বাংলাদেশে টোকাইদের সুস্থ ভাবধারায় নিয়ে আসার জন্য ‘পথশিশু’ ও ‘পথকলি’ বিভিন্ন নামে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেও সংশ্লিষ্ট সরকারের ইতি টানার সাথে সাথে সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়ে গেছে।

লন্ডন কিংস কলেজের একজন শিক্ষয়ত্রী স্যালি আটকিনসন শেফার্ড ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে তিন বছরের মতো অবস্থান করে বখে যাওয়া শিশুদের নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি ২২ জন স্ট্রিট চিলড্রেন ও পুলিশ, সমাজকর্মী, বিচার বিভাগসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের ৮০ জন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে মতামত দিয়ে টোকাই বা স্ট্রিস্ট চিলড্রেনদের ‘Illicit child Labour’ বলে আখ্যায়িত করেছেন (সূত্র : The gangs of Bangladesh)। স্যালি আটকিনসন শেফার্ডের গবেষণা মতে, তিনি বাংলাদেশে মাফিয়া চক্রের সন্ধান পেয়েছেন, যাদের তিনি ইংরেজি ভাষায় Mastaan (মস্তান) নামে অভিহিত করেছেন। ‘মস্তান’ একটি বাংলা বা ইংরেজি শব্দ নয়, বরং ভারতে অভিধানিকভাবে হিন্দু ধর্মের সংস্কৃতি থেকে এর উৎপত্তি। মুম্বাই থেকে রিলিজ হওয়া সিনেমায় মস্তানের ভূমিকা প্রকাশ পায়। কিন্তু কার্যত মস্তান বলতে তার গবেষণায় llicit child Labour, অর্থাৎ অবৈধ কাজে ব্যবহৃত শিশু শ্রমিকদের গডফাদারদের বোঝানো হয়েছে। এ গবেষকের মতে, মাদক বিক্রি, চাঁদাবাজি, ভূমি দখল, হত্যা ও রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা করার জন্য মাস্তানেরা টোকাই বা রাস্তার শিশুদের ভাড়া করে ব্যবহার করে।

২০১০ সালে ‘Urban Crime and Violence in Dhaka’ নামকরণে প্রকাশিত বইতে উল্লেখ করা হয়, মস্তানেরা পুলিশ ও রাজনীতিবিদদের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি ও অব্যাহত রাখে। ওই গবেষকের মতে, মস্তানদের থেকে পুলিশ নিয়মিত টাকা পেয়ে অবৈধ কাজের বৈধতা দেয়। তিনি আরো মনে করেন, রাজনীতিবিদেরা তাদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার জন্য মস্তানদের ব্যবহার করে। ওই গবেষকের মতে, ‘Mastaans operate under the shelter of god father, who are mainly Ministers, Members of Parliament and Business leaders.’ অর্থাৎ মস্তানেরা গডফাদার দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয় যাদের মধ্যে মন্ত্রী, পার্লামেন্ট সদস্য ও ব্যবসায়ী নেতারা রয়েছেন।

২০১২ সালে ইউনিসেফ থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশ একটি স্বল্পোন্নত জাতি এবং জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। তাদের মতে, ঢাকার এক কোটি ৬০ লাখ মানুষের মধ্যে এক কোটি অধিবাসী রাস্তাঘাটে বা বস্তিতে বসবাস করে; যারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা বা বেঁচে থাকার জন্য ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। ওই সব পরিবারের শিশু সন্তান নিজেরা অবৈধ কাজের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার হয়ে নিজেরাই এক সময় টোকাই থেকে মস্তানে পরিণত হয়।

বাংলাদেশ পুলিশ ২০ জন ‘টপ টেরোরিস্টদের’ নাম প্রকাশ করে, যাদের অধীনে শতাধিক টোকাই বাহিনী রয়েছে; যাদের কাজ হচ্ছে মস্তানদের নির্দেশ মোতাবেক অপরাধ সংগঠনের মাধ্যমে অর্থ রোজগার করা। ২০১০ সালের ৩১ মার্চ ডেইলি স্টার পত্রিকায় ‘Crime gants grip city’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলে বলা হয়, ডাকাত শহীদ ১২০ জনের একটি অপরাধী চক্র লালন-পালন করত। মস্তানদের নিয়ন্ত্রণে বস্তিভিত্তিক অপরাধী চক্র গড়ে উঠেছে, যাদের বেশির ভাগই পথশিশু বা টোকাই। ওই অপরাধী চক্র বিভিন্ন নামে বিশেষ করে দলনেতা নামে প্রথম অক্ষর দ্বারা পরিচিত। যেমন- ‘পি’ গ্রুপ, ‘আর’ গ্রুপ প্রভৃতি। মস্তানদের কাজ হচ্ছে টোকাইদের দিয়ে অপরাধ ও ভায়োলেন্স সংগঠিত করে তাদের সুরক্ষা দেয়া। চাঁদাবাজি, চুক্তিভিত্তিক খুন, জমি দখল, দোকান দখল, ফুটপাথ দখল প্রভৃতির মাধ্যমে অর্থসম্পদের মালিক হওয়াই মস্তানদের একমাত্র উদ্দেশ্যে এবং এরা বেশির ভাগই মাফিয়া চক্রের অধীনে কাজ করে। এসব বেআইনি কাজ করার জন্য মস্তান বা মাফিয়ারা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে পুলিশ ও রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করে। রাজনৈতিক দল পরিচালনা, ব্যয়বহুল নির্বাচনের অর্থের জোগান দেয়ার জন্য মস্তান বা মাফিয়ারা স্বেচ্ছায় ব্যবহার হয়, পক্ষান্তরে রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করে প্রচুর ক্ষমতা ও অর্থের মালিক হয়। মস্তানেরা সরকারি ও বিরোধী দল যাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে, তাদের অনেককেই আর্থিক সহায়তা দেয়। যে দল ক্ষমতায় আছে এবং যে দল ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাদেরকে মাফিয়ারা আর্থিক জোগান দেয় এবং ক্ষমতাবানদের প্রকাশ্যে সহায়তা করে এবং যারা ক্ষমতায় নেই তাদের আর্থিক সহায়তা দেয় গোপনে। এভাবেই মস্তান ও মাফিয়ারা অনেক শক্তিধর।

অন্যতম গবেষক Sergi A (২০১৫)-এর মতে, ‘Mafia and Polities as concurrent government actor’ এবং তাদের ‘Concurrent goverance’ এখতিয়ার বা অধিক্ষেত্র রয়েছে। Concerance Juridection বলতে একসাথে চলাকে বোঝায়। খারাপ রাজনৈতিক নেতারা মস্তানদের দিয়ে বিভিন্ন এলাকা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন তার ব্যাখ্যা গবেষক উল্লেখ করেন, যা নিম্নরূপ-
‘(1) It demonstrates that mastaan groups in Dhaka work in collusion with corrupt politicians, (2) It shows that street children are aware of organised crime, this means that it infiltrates life on the streets and that young people share inforation about mastaans with their peers and presumably the adults in their lives & (3) It reveals children’s knowledge of the connection between mastaans and politics, this shows that, even at a young age, children are able to call into question the authority of corrupt politicians.’ ওই তথ্যাদি ২০১৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ‘Asian Journal of Criminology’ থেকে সংগৃহীত।

রাজনীতিবিদ ও মস্তানদের সম্পর্কের নেপথ্যে

ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদদের প্রধান টার্গেট ‘ক্ষমতা’ এবং বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনের দরজা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। ‘জাতীয় নির্বাচন’ নামক একটি প্রহসনমূলক নাটকের মাধ্যমে এখন ক্ষমতার পরিবর্তন হয় যার জন্য প্রয়োজন হয় কিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সন্ত্রাসী বাহিনীর লোক, যারা বাহুবলে কেন্দ্র দখল করে সিল মারতে পারে। মাফিয়া, মস্তানদের হাতে প্রচুর পরিমাণ টাকা এবং অবৈধ অস্ত্র যেহেতু নির্বাচনী প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেহেতু সন্ত্রাসী মস্তানদের ওপর রাজনীতিবিদেরা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এ নির্ভরশীলতাকে কাজে লাগিয়ে মস্তানেরা পালাক্রমে রাজনৈতিক দলের পদ-পদবি শিকার করে নিচ্ছে। ফলে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি এখন প্রকাশ্য রূপ ধারণ করেছে।

রাজনৈতিক প্রভাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মদদ ছাড়া মস্তান বা মাফিয়া হিসেবে গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। কারণ, দেশে প্রচলিত আইনগুলো অনেক কঠিন, কিন্তু এর প্রয়োগ হয় রাজনৈতিক প্রভাবে। ফলে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদদের কাছে জাতি ও রাষ্ট্র অসহায় হয়ে পড়েছে। সরকার নিজেই যেখানে কেন্দ্র দখলের রাজনীতি করে, প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার জন্য মস্তান ও পুলিশ তথা আইনকে ভিন্নভাবে ব্যবহার করে; সেখানে এ অপব্যবস্থা থেকে জাতিকে রক্ষা করা একটি অবাস্তবতা মাত্র। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় অর্থ ও প্রভাবমুক্ত একটি নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদল। নতুবা টোকাইরাই সম্রাট হবে, জনগণ থাকবে অসহায়।

  • লেখক আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ। 
  • কার্টসি  — নয়াদিগন্ত/নভেম্বর ১, ২০১৯

Saturday, November 2, 2019

চলন্ত বোমার শহর ঢাকা!


ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল কাভার্ড ভ্যান৷ নারায়নগঞ্জ লিংক রোডে কাভার্ড ভ্যানটিতে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে৷ ভেতর থেকে চিৎকার ভেসে আসে৷ লোকজন ছুটে গিয়ে টেনে বের করে দেখে দুই ব্যাক্তির শরীরের অধিকাংশই পুড়ে গেছে৷

বাঁচানোর আকুতিতে তাড়াহুড়া করে তাদের নেয়া হলো হাসপাতালে৷ এদের একজন চালক আমীর হোসেন এবং অপরজন হেলপার আবুল কালাম৷ আমীর মারা গেছেন আর পোড়া শরীর নিয়ে এখনো জীবনযুদ্ধে কালাম৷ ঘটনাটি কয়েক মাস আগের৷

শুধু এই কাভার্ড ভ্যানটি নয়, ঢাকা শহরে এমন দুই লাখেরও বেশী যানবাহন ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে৷ এর যে কোনটিতে যখন তখন এই কাভার্ড ভ্যানটির মতো বিস্ফোরণ ঘটতে পারে৷ হতাহত হতে পারেন যাত্রী-চালক যে কেউ৷ প্রতি পাঁচ বছর অন্তত গাড়িতে লাগানো গ্যাসের সিলিন্ডার পরীক্ষা করার নিয়ম রয়েছে৷ বিস্ফোরক অধিদফতরে এই পরীক্ষার তালিকা জমা দেয়ার কথা৷ মাত্র ৩০ থেকে ৪০ হাজার গাড়ির পরীক্ষার তালিকা নিয়মিত জমা দেয়৷ অন্যরা পরীক্ষা করে কি-না বা মেয়াদ আছে কি-না তার কিছুই জানে না বিস্ফোরক পরিদফতর৷

বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান- পরিদর্শক শামসুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মেয়াদ উত্তীর্ণ এক একটি সিলিন্ডার একটি বোমার চেয়েও ভয়াবহ৷ এসব জেনেও আমরা গ্যাসের সিলিন্ডারটি নিয়মিত পরীক্ষা করছি না৷ মঝে মধ্যে আমরা যে রিপোর্ট পাই সেটা প্রাইভেটকারের৷ বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান বা অন্যান্য যানবাহনের কোন তথ্যই আমাদের কাছে নেই৷ ফলে তাদের অবস্থা কি আমরা কিছুই জানি না৷ একটি প্রাইভেট গাড়িতে মালিক নিজেই চলাচল করেন৷ তারপরও তিনি জেনে বুঝে নিয়মিত সিলিন্ডারটি পরীক্ষা করাচ্ছেন না৷ ফলে ঝুঁকিতে থাকছেন তিনি নিজেই৷ এর জন্যে আমরা নানাভাবে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি''


‘মেয়াদ উত্তীর্ণ সিলিন্ডার বোমার চেয়েও ভয়াবহ’

শামসুল আলম বলেন, ‘‘প্রতি বছর গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষার সময় গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষার রিপোর্ট জমা দেয়ার জন্য আমরা বছর দু'য়েক আগে মন্ত্রণালয়কে লিখেছিলাম৷ তারাও বিষয়টি আন্তরিকভাবে নিয়েছিল৷ কিন্তু সমস্যা হল দেশে মাত্র ৩০/৩২টি রিটেষ্ট সেন্টার আছে৷ ফলে এটি আইনের মধ্যে ঢুকালে ওই রিটেষ্ট সেন্টারগুলোতে এমন চাপ পড়বে তখন একটা লেজেগুবরে অবস্থা হয়ে যাবে৷ এ কারণ তখন আইনের মধ্যে বিষয়টি ঢোকানো হয়নি৷ ফলে গাড়ির মালিকরা ইচ্ছেমতো হয় পরীক্ষা করাচ্ছেন, নতুবা মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন৷ আর আইনের মধ্যে কিছু না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও কোন সুযোগ নেই৷''

গত বুধবার বিকেলে রাজধানীর রূপনগর আবাসিক এলাকার ১১ নম্বর সড়কে বেলুনে গ্যাস ভরে বিক্রি করার সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে সাত শিশুর মৃত্যু হয়েছে৷ পুলিশ গ্যাস বেলুন বিক্রেতা আবু সাঈদের বিরুদ্ধে রূপনগর থানায় মামলা করেছে৷ বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রেফতার আহত আবু সাঈদ বর্তমানে ঢাকা  মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন৷ এই ঘটনার পর থেকে আবারও গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে৷

নিয়ন্ত্রক সংস্থা রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানির (আরপিজিসিএল) হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে প্রায় ৫ থেকে ৭ লাখ সিএনজিচালিত যানবাহন রয়েছে৷ এর মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি সময় অতিক্রম করা গাড়ির সংখ্যা চার লাখেরও বেশি৷

‘বড় বাস-ট্রাকের বিস্ফোরণের ঝুঁকি অনেক বেশি’

এর মধ্যে শুধু ঢাকা শহরেই দুই লাখের মতো৷ এগুলোর ৬০ থেকে ৭০ ভাগই পুনঃপরীক্ষা করা হয়নি৷ সিএনজি নিরাপত্তার আন্তর্জাতিক মান নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি গ্যাস সিলিন্ডার পাঁচ বছর পরপর রিটেস্টের বিধান রয়েছে৷ ফলে ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডার নিয়েই হাজার হাজার যানবাহন রাস্তায় চলাচল করছে৷ এর ফলে মাঝে মধ্যে গাড়িতে ঘটছে বিস্ফোরণ৷ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুযায়ি গত ৫ বছরে দুই শতাধিক গাড়িতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে৷ সামনে এই সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তাদের৷ 

ফায়ার সার্ভিসের সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সিএনজি সিলিন্ডারে প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে তিন হাজার পাউন্ড চাপে যখন গ্যাস ভরা হয় তখন রাস্তায় চলাচলকারী একেকটি গাড়ি যেন চলমান বোমা হয়ে ওঠে৷ গ্যাস ভরার সময় সিলিন্ডার এমনকি গ্যাসও উত্তপ্ত অবস্থায় থাকে৷ সিলিন্ডার যথাযথ না হলে বড় রকমের অঘটন ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে৷ বড় বাস-ট্রাকের বিস্ফোরণের ঝুঁকি অনেক বেশি৷ কারণ বাস- ট্রাকগুলোতে ছয় থেকে আটটি সিলিন্ডার থাকে৷'' 

এর বাইরে বাসা-বাড়িতে যে গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয় সেগুলোরও একই অবস্থা৷ তবে ওইসব সিলিন্ডারে গ্যাসের চাপ কম থাকায় বিস্ফোরণের ঝুঁকি বেশি৷ তবে নিয়মিত পরীক্ষা না করালে লিকেজ থেকে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে৷ যেটা ঘটে যাচ্ছে- বলছিলেন আলী আহমেদ খান৷ এই সিলিন্ডারগুলোর নিয়মিত পরীক্ষা একটা আইনের মধ্যে আনা দরকার৷ 

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির হিসাব অনুযায়ি, সারাদেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৪২ লাখ৷ যদিও এই হিসাব স্বাধীনতার পর থেকে৷ এর বাইরে অনিবন্ধিত অনেক গাড়িও আছে৷ আবার বহু গাড়ি এখন আর রাস্তায় চলে না৷ সব মিলিয়ে এই সংখ্যা ৩০ থেকে ৩২ লাখ৷ সংশিষ্টরা বলছেন, আইন করে যদি বিআরটিএর ফিটনেস নেয়ার সময় সিলিন্ডার রিটেস্ট করানো বাধ্যতামূলক করা যায় তাহলে এই ধরনের ঝুঁকি কমবে৷ সবাই সচেতন হবে৷ এর ফলে প্রাণহানি ও যানবাহনও নিরাপদ হবে৷


  • Courtesy —   dw.com/ নভেম্বর ২, ২০১৯
  • লিঙ্ক —  http://bit.ly/33crvf2

কথিত প্রশিক্ষণের নামে সরকারি অর্থের অপচয়


সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশে প্রশিক্ষণ নেওয়ার নিশ্চয়ই বিশেষ প্রয়োজন রহিয়াছে। মূলত পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য এই সুযোগের বিধান রাখা হইয়াছে। কিন্তু পরিতাপের সহিত দেখা যাইতেছে, সরকারি এই সুযোগের অপব্যবহার হইতেছে হরহামেশাই। প্রশিক্ষণার্থে যাহারা বিদেশে যাইতেছেন, তাহাদের সিংহভাগই যাইতেছেন মূলত বিদেশ-ভ্রমণ অথবা বিনোদনের উদ্দেশ্যে। কিছুদিন পূর্বে আমরা পুকুর খনন প্রকল্পের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জনের অজুহাতে বিদেশে গিয়া প্রশিক্ষণ গ্রহণের উপর প্রশ্ন তুলিয়াছিলাম। সম্প্রতি পত্রিকান্তরে জানা গিয়াছে, ২৬ জন সরকারি কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ ছিল কোরিয়ায়, কিন্তু গিয়াছেন যুক্তরাষ্ট্রেও। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সহিত চুক্তির শর্তে ছিল, দক্ষিণ কোরিয়ায় এক মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণ করিবেন সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ১৮ প্রকৌশলী। কিন্তু ‘শিক্ষা সফরে’ কোরিয়া ঘুরিয়া যুক্তরাষ্ট্রে গিয়াছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পাঁচ কর্মকর্তা, সংসদীয় কমিটির সভাপতির ব্যক্তিগত সচিবসহ ২৬ জন। তাহা ছাড়া, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সহিত চুক্তি অনুযায়ী, শুধু প্রকৌশলীদেরই দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রশিক্ষণ গ্রহণের কথা ছিল। অথচ ‘প্রশিক্ষণার্থী’র সংখ্যা বাড়াইতে প্রশিক্ষণের মেয়াদ এক মাস হইতে কমাইয়া ১২ দিন করা হইয়াছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করা হইয়াছে এই সময়ের মধ্যে। বয়সসীমা শেষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাইয়াছেন কিংবা চাকরির মেয়াদ আর দুই মাস বাকি রহিয়াছে—এমন কর্মকর্তাও দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষা সফরে গিয়াছেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এই তথাকথিত ‘শিক্ষা সফরে’ তাহাদের অর্জিত জ্ঞান কোথায় কাজে লাগিবে?

বলিবার অপেক্ষা রাখে না, প্রশিক্ষণকে গৌণ করিয়া প্রকল্পের টাকায় বিদেশ ভ্রমণকেই গুরুত্ব দেওয়া হইয়া থাকে অনেক ক্ষেত্রে। কেবল সওজ বিভাগের নহে, আমাদের দেশে প্রায় সকল প্রকল্পে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণের প্রবণতা লক্ষণীয়। আমরা আগেই বলিয়াছি, বহু ক্ষেত্রেই বিদেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করিবার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করিবার উপায় নাই। প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ সফর করিতেছেন যিনি, তিনি প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরিয়া বিষয়টির উপর নবলব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগাইবেন—ইহাই স্বাভাবিক চাওয়া। কিন্তু যিনি বিদেশ সফর করিয়াছেন শুধুই প্রমোদভ্রমণ হিসাবে অথবা দায়িত্ববহির্ভূত ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ লইয়াছেন, তিনি কীভাবে পূরণ করিবেন এই চাওয়া? আরেকটি বিষয় হইল, যিনি সত্যিকারের প্রশিক্ষণ লইয়া আসেন, অনেক সময় দেখা যায় যে মাত্র কয়েক মাস পরই তিনি অবসরে যাইবেন। আবার যেই প্রকল্পের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হইল, সেই প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই বদলি করা হয় অন্যত্র। এই ধরনের প্রশিক্ষণও বাস্তবিক অর্থে কোনো কাজে লাগে না।

বস্তুত, সরকারি দপ্তরগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ সফরের যেই প্রয়োজনীয় বিধান রাখা হইয়াছে, বিনা প্রয়োজনে সেই সুযোগ কাজে লাগাইলে তাহা প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। অনেক ক্ষেত্রে এমনও হয় যে, এই বত্সর অমুক যাইবেন তো পরের বত্সর তমুক! সুতরাং আমরা মনে করি, প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ সফরের একটি কার্যকরী সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার, যাহাতে সরকারি অর্থের অপচয় না হয়।

Courtesy —  ইত্তেফাক/ নভেম্বর ০২, ২০১৯ 

Thursday, October 31, 2019

১৪ দলের শরিকদের চোখে জাতীয় নির্বাচন

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
আওয়ামী লীগ ও তাদের সঙ্গীসাথীরা ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে দিনে-রাতে কীভাবে ভোট জালিয়াতি করে ফলাফল নিজেদের পক্ষে নিয়েছে সেটা শুধু জানেই না, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেও। এবং এটা বলার মধ্যে এক ধরনের তৃপ্তিও লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। তাদের ভাবখানা এমন যে আওয়ামী লীগ কতটা চৌকস ও কৌশলী দল যে এভাবে রাতে-দিনে ভোট নেওয়ার পরও বিএনপি কোনো তথ্যপ্রমাণ হাজির করতে পারেনি। প্রতিরোধ তো দূরের কথা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, বিভিন্ন সংস্থা ও পর্যবেক্ষকদের মতামত তুলে ধরে নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তোলার পর আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযাত্রীরা বলে থাকেন, প্রমাণ দেখান। কিছু যৌক্তিক তথ্য তুলে ধরার পর যখন আর জুতসই কোনো জবাব আর তাদের হাতে থাকে না তখন একটাই কথা, এত জালিয়াতি হলে জনগণ রুখে দাঁড়াল না কেন? বিএনপি কেন পারল না জনগণকে মাঠে নামাতে? এ কথা শুধু আওয়ামী লীগ নয়, তাদের পক্ষ নেওয়া সাংবাদিক, শিক্ষকরা পর্যন্ত বলে থাকেন। প্রতিরোধ করতে পারল না বলে সব দায় যেন বিএনপির, সব দায় জনগণের। যারা জালিয়াতিটা করল তাদের কোনো দায় নেই!

‘অফ দ্য রেকর্ড’ যে কথাটি আওয়ামী লীগের অনেকে  বলেন, তাদের পক্ষ নেওয়া শিক্ষক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরাও যা বলেন, তাই বলেছেন তাদের জোটসঙ্গী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা নৌকার এমপি রাশেদ খান মেনন। কিন্তু সমস্যা হলো, তিনি বলে ফেলেছেন অন দ্য রেকর্ড। ব্যস, তিনি হয়ে গেলেন নির্বাচনে জালিয়াতির রাজসাক্ষী। আর আওয়ামী লীগের কাছে রাজ ভিলেন। মেনন বলেছেন, ‘বিগত নির্বাচনে আমিও নির্বাচিত (এমপি) হয়েছি। তারপরও আমি সাক্ষ্য দিয়ে বলছি, গত নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। জাতীয়, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কোথাও ভোট দিতে পারেনি দেশের মানুষ। প্রধানমন্ত্রী, আপনি-আমি মিলে যে ভোটের জন্য লড়াই করেছি, আজিজ কমিশনকে ঘেরাও করেছি, আমরা এক কোটি ১০ লাখ ভুয়া ভোটার তালিকা ছিঁড়ে ফেলে নির্বাচন বর্জন করেছি মনোনয়ন জমা দেওয়ার পরেও। আজ কেন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং জাতীয় নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে আসবে না? সরকারের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশে লুণ্ঠন, দুর্নীতি, মহামারি আকার ধারণ করেছে। উন্নয়ন মানে গণতন্ত্র হরণ নয়, উন্নয়ন মানে ভিন্ন মতের সংকোচন নয়, উন্নয়ন মানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ নয়, উন্নয়ন মানে গণতন্ত্রের স্পেস (সুযোগ) কমিয়ে দেওয়া নয়। সারা দেশে মানবিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয় ঘটেছে।’

মেননের এ কনফেশনাল স্টেটমেন্ট বা অনুশোচনাকে অনেকে রাষ্ট্রীয় অপকর্মের রাজসাক্ষী হিসেবে দেখছেন। কিন্তু নৌকার এমপি রাশেদ খান মেননের এই কথায় চটেছে নৌকার আসল মালিক আওয়ামী লীগ। তারা শোকজ করেছে। অনেকেই বলেছেন, রাশেদ খান মেনন ক্যাসিনোকা-ে ধরা খেয়ে গেছেন। কার থেকে মাসে কত টাকা চাঁদা খেয়েছেন সে সব হিসাব রিমান্ডের তথ্য হিসেবে পত্রিকায় ছাপা হতে শুরু করেছে। তার পতন অবধারিত। গণমানুষের সহানুভূতি আদায় করে সেই ড্যামেজ কিঞ্চিৎ কমানোর কৌশল হিসেবেই তিনি রাজসাক্ষী হয়েছেন। এমন একটা আবহ তৈরির চেষ্টা করেছেন যে মানুষের যেন মনে হয় তিনি নির্বাচন প্রশ্নে সত্য কথা বলায় সরকার তার বিরুদ্ধে ক্যাসিনোকা- ও চাঁদাবাজির মতো অভিযোগে হেনস্তা করছে। কিন্তু তাদের হয়তো স্মৃতিতে নেই যে রাশেদ খান মেনন এর আগেও নির্বাচন নিয়ে প্রায় কাছাকাছি বক্তব্য দিয়েছেন। তখন নিজেকে রক্ষা করে সামগ্রিকভাবে খারাপ নির্বাচন হওয়ার তত্ত্ব হাজির করেছিলেন এবং তার জন্য বিএনপির ইট মেরে পাটকেল খাওয়ার থিওরি দিয়েছিলেন। তিনি ৩০ জানুয়ারি ২০১৯ বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও সরকারবিরোধী দলগুলো থেকে একাদশ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে সে বিষয়ে বলেছিলেন, প্রত্যেকটি নির্বাচনেই এসব অভিযোগ ওঠে। যারা অভিযোগ করছে, তাদের একটি কথা বলতে চাই, ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়। তারা ২০০৬ সালে ইট মেরে ছিল, সেটা কি ভুলে গেছে? কীভাবে আজিজ কমিশনকে দিয়ে ভুয়া ভোটার তালিকা তৈরি করেছিল? এবার তার একটা পাল্টা জবাব পেয়েছে। এখন এটা নিয়ে চিৎকার করে লাভ কী! গণতন্ত্রের কথা বলে লাভ নেই! তাদের মুখে গণতন্ত্রের কথা শোভা পায় না! আর অন্য যারা গণতন্ত্রের কথা বলছে, তারাও সুযোগ পেলে একই কাজ করত। সেই ’৮৬ সালে বামরা, আমাদের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো শেখ হাসিনার সঙ্গে মিলে নির্বাচন করেনি? সেই নির্বাচনে কী হয়েছিল, তা সবার জানা আছে। এরশাদের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে কে কয়টা সিট পাবে, সবই তো ঠিক ছিল সেই সময়। সুতরাং বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে অনেক ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনের কলঙ্ক যদি লেগে থাকে, তাহলে সব রাজনৈতিক দল বা সবার গায়ে কলঙ্ক লেগেছে। অর্থাৎ ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে যে একটা কলঙ্ক সৃষ্টি করেছে তা তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন। শুধু রাশেদ খান মেননই নন, জোটের আরেক দল জাসদের একাংশের নেতা সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনুও নির্বাচন নিয়ে তার মনোভাব প্রকাশ করেছেন। জোটের শরিক জাসদের আরেক অংশও কাছাকাছি মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু বা মইনুদ্দিন বাদল কোন প্রক্রিয়ায় কতটুকু বললেন তা নিয়ে বিচলিত হওয়ার দল আওয়ামী লীগ নয়। বরং তারা বুক ফুলিয়ে তাদের মনোভাব প্রকাশ করেন, দেখো, আমরাই পারি। তারপরও ওপরে থুথু ছিটিয়ে নিজের গায়ে মাখলেন কেন মেনন? এর সঠিক কারণটি তুলে ধরেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, রাশেদ খান মেনন যদি আজ মন্ত্রী হতেন তবে কি এ কথা বলতেন! কথা তো সত্যি। রাশেদ খান মেনন তো আওয়ামী লীগ সরকারের গত আমলে মন্ত্রী ছিলেন। তখন কি ২০১৪ সালের বিনা ভোটের এমপি হওয়ার নৈতিকতা নিয়ে কিছু বলেছেন? একবারও কি বলেছেন, তিনিসহ যে ১৫৪ জন বিনা ভোটে কাগুজে এমপি তারা প্রকৃত জনপ্রতিনিধি নন?

তবে প্রথম দিকে মন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরে সমালোচনা করতেন। অনেকেরই হয়তো মনে থাকতে পারে, তখন মন্ত্রী পরিষদের বাইরে থাকা রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের সরকারের কর্মকাণ্ডের কড়া সমালোচনা করে প্রকাশ্যে বিরক্তি প্রকাশ করতেন। শেখ হাসিনা তখন তাদের মন্ত্রী বানিয়ে মুখবন্ধ করেছিলেন। রাশেদ খান মেনন হয়তো এবারও সেই ফর্মুলা প্রয়োগ করতে চেয়েছেন। তিনি তার স্ত্রীকে সংরক্ষিত নারী কোটায় এমপি বানিয়েই তুষ্ট থাকতে পারেননি। এই সরকারকে এত বড় অনৈতিক কাজে সহযোগিতার পর তার প্রাপ্তি আরও বেশি হবে বলে হয়তো মনে করেন। তা না পেয়ে নিজের দাম বাড়াতেই তিনি সমালোচনার পথ ধরেছিলেন বলে ওবায়দুল কাদেরের মতোই অনেকে মনে করেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি যে একই ফর্মুলায় বারবার শিকে ছিঁড়ে না। তাই এখন তাকে তার বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে হচ্ছে। লিখিত কৈফিয়ত দিয়ে বলতে হচ্ছে, তার বক্তব্য নাকি মিডিয়া খণ্ডিতভাবে প্রকাশ করেছে। তিনি নাকি আগের নির্বাচনগুলোর অনিয়ম সম্পর্কে বলতে গিয়ে ধারাবাহিকভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গে বলেছেন। কিন্তু মিডিয়া শুধু তার শেষ অংশটুকুই খণ্ডিতভাবে প্রকাশ করেছে। মিডিয়া তো তার দীর্ঘ বক্তব্যের পুরোটা প্রকাশ করার দায়িত্ব নেয়নি। মিডিয়া যতটুকু প্রকাশ করা যৌক্তিক মনে করে ততটুকুই তো করবে। কিন্তু মেনন সাহেব কি বলতে পেরেছেন যে যে কথা মিডিয়া প্রকাশ করেছে তা তিনি বলেননি?


বঙ্গবন্ধুর ১৯৭৩, জিয়াউর রহমানের ১৯৭৯, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ বা তার পরবর্তী নির্বাচনগুলো নিয়ে একক পক্ষ থেকে একেক রকম মূল্যায়ন ও সমালোচনা আছে। বিএনপি আমলের নির্বাচনের সমালোচনা করা তো আওয়ামী লীগ ও মেনন সাহেবরা নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে পালন করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। সেই সব অভিযোগ আর ২০১৪ বা ২০১৮ এর নির্বাচন নিয়ে রাশেদ খান মেননের কনফেশনাল স্টেটমেন্ট কি এক কথা হলো! কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা, রাশেদ খান মেননের এই বক্তব্য অভিনন্দিত হয়নি সরকারবিরোধী পক্ষ বিশেষ করে বিএনপি থেকেও। কারণ তারা নৌকার এই এমপির সমালোচনার মধ্যে কোনো সততা খুঁজে পাননি। রাশেদ খান মেনন আগে নিজে পদত্যাগ করে তারপর এ সমালোচনার বাক্সটি খুললে সেটা হতো একটি সৎ উদ্যোগ। কোনো সুবিধাবাদী রাজনীতিকের পক্ষে পদের লোভ ত্যাগ করা সত্যিই কঠিন।

  • লেখক চিকিৎসক ও কলামিস্ট । 
  • কার্টসি — দেশরূপান্তর/ বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ৩১, ২০১৯

Wednesday, October 30, 2019

রাষ্ট্রব্যবস্থা বদল করতে না পারলে মুক্তি নেই — অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী


ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, এই রাষ্ট্র মানুষের অধিকার দিচ্ছে না। এ রাষ্ট্রে শিশুরাও ধর্ষিত হচ্ছে। রাষ্ট্র এখন মানুষের পক্ষে নয়। রাষ্ট্র এখন মানুষের শত্রু হয়ে গেছে। সব সমস্যা রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। এ ব্যবস্থা বদল করতে না পারলে মুক্তি নেই। 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, পানির সঙ্গে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও অস্তিত্ব জড়িত। মানুষ কীভাবে বাঁচবে তা পানির ওপর নির্ভর করে। পানির অপর নাম জীবন। রাজনৈতিক কারণে, রাষ্ট্রীয় কারণে পানি বিপন্ন হচ্ছে। পাকিস্তান আমল থেকে নদী নিয়ে নানা সমস্যা শুরু হয়েছে। সে সমস্যা বর্তমানে ফেনী নদীর পানিতে গিয়ে ঠেকেছে। পানি সমস্যার সমাধান মানুষকেই করতে হবে। কীভাবে করতে হবে তা মওলানা ভাসানী শিখিয়ে গেছেন। 

মঙ্গলবার, অক্টোবর ২৯, বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে আয়োজিত এক সেমিনারে এসব কথা বলেন তিনি। ভাসানী অনুসারী পরিষদ ‘ভারত-বাংলাদেশ পানি বিতর্ক’ শীর্ষক এ সেমিনারের আয়োজন করে। 

ভাসানী অনুসারী পরিষদের চেয়ারম্যান ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক আসিফ নজরুল। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার। আলোচনা করেন পানি বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক, অধ্যাপক নুরুল আমিন ব্যাপারী, নঈম জাহাঙ্গীর, এটিএম গোলাম মাওলা চৌধুরী প্রমুখ।

অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, সরকার বলেছে মানবিক দিক বিবেচনা করে ফেনী নদীর পানি দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু অভিন্ন ৫৪ নদীর ন্যায্য পানির অভাবে আমাদের দেশের কৃষিসহ নানা দিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের দেশের কোটি কোটি মানুষের মানবিক দিকটি কেউ দেখছে না। 

সভাপতির বক্তব্যে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, একটি নতজানু সরকার পানির অধিকার দিতে পারবে না। ভোটের অধিকারের মাধ্যমেই একটি দেশের সার্বভৌমত্ব ফিরে আসতে পারে।

  • কার্টসি  — বাংলাদেশ প্রতিদিন /বুধবার, অক্টোবর ৩০

    , ২০১৯

Monday, October 28, 2019

সবখানেই সেই লোমশ ভয়াল হাত


দুই কন্যার সামনে বাবাকে নগ্ন করে পেটানোর ভিডিও দেখতে দেখতে পড়ছি মনপুরায় শিশুসন্তানের সামনে মাকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করার খবর। দুটি ঘটনাই ভোলার। শেষ লঞ্চ না পেয়ে সন্তানসহ জননী একটা স্পিডবোটে করে বাড়ি ফিরতে গিয়েছিলেন। পথে পান চার পুরুষ সহযাত্রী। চারজন মিলে তাঁকে এক চরে নামিয়ে নির্যাতন করেন। ধরিত্রীর এতেই কেঁপে ওঠার কথা। কিন্তু কলিকালে কিছুই কাঁপে না, টনক নড়ে না; বরং দৌড়ে আসেন নতুন ধর্ষক। স্পিডবোটের চালক তাঁর মালিক ছাত্রলীগের নেতাকে খবর দেওয়ামাত্রই মওকার গন্ধ পেয়ে তিনি ছুটে আসেন। পুনরায় জঙ্গলে নিয়ে জননীকে আবারও ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের সালিসের নামে পুনরায় ধর্ষণ। সন্তান বা স্বামীকে বেঁধে রেখে ধর্ষণ। মা-মেয়েকে একসঙ্গে ধর্ষণ—এসব আমাদের ‘নিউ-নরমাল’ বাস্তবতা। এসব এই দেশের নতুন স্বাভাবিকতা। যুদ্ধের সময় এমন চরম নির্দয়তা ঘটতে দেখাকে অনেকে স্বাভাবিক বলে থাকেন, কিন্তু যুদ্ধ তো নেই বাংলাদেশে যে ঘটতে ঘটতে সব স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে!

ছাত্রলীগের নেতাটিও ‘স্বাভাবিক’ কাজই করেছেন। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকেই ‘খারাপ’ ভাবার লোকই দেশে বেশি। সমাজ তার পাশ থেকে সরে যায়। সুতরাং ছাত্রলীগের নেতা এসে যখন দেখলেন তাঁর আগেই চারজন পুরুষ নারীটিকে ‘অপবিত্র’ ও ‘ভোগযোগ্য’ করেই ফেলেছেন, তখন তিনিই–বা বাদ যাবেন কেন? পঞ্চম পুরুষ হিসেবে তিনিও তাঁকে ‘ব্যবহার’ করতেই পারেন। চার ধর্ষককে পিটিয়ে তাঁদের টাকাপয়সা কেড়ে নিয়ে তাড়িয়ে দিতে পারেন যিনি, সেই ক্ষমতার জোরে তো তিনি অপরাধীদের পুলিশে দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি চাননি ঘটনা জানাজানি হোক। হয়তো ভেবেছেন, চারজনের পরে পঞ্চমজনের ধর্ষণে কী আর উনিশ-বিশ হবে! তা ছাড়া ভিডিও করে যেহেতু রেখেছেন, সেহেতু লোকলজ্জার ভয়, স্বামী দ্বারা পরিত্যক্ত হওয়ার ভয়ে নারীটি নরকের পঞ্চম স্তরের অভিজ্ঞতা চেপে যাবেন।

শতকোটি অভিবাদন সেই নারীকে, তিনি চেপে যাননি। ফলে ছাত্রলীগের ওই নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। কিন্তু নারীর ভয় কমল নাকি বাড়ল? এমন বেকায়দায় পড়া নারী যাত্রীই শুধু নন, মামলার আসামি হয়ে পালিয়ে থাকা কিংবা জেলে থাকা ব্যক্তির স্ত্রীরাও দেখা যাচ্ছে ‘অরক্ষিত’—সহজ টার্গেট। সেপ্টেম্বর মাসের শেষেও যশোরে এমন ঘটনা ঘটেছে। স্বামী জেলে যাঁর, সেই নারীর বাড়িতে এসে দুই পুলিশ তাঁকে ধর্ষণ করে যায়। একই মাসে খুলনায় থানায় আটকে ধর্ষণ করা হয় এক নারীকে। মনপুরার ধর্ষক দেখিয়েছিলেন ভিডিও প্রকাশের ভয়, অভিযুক্ত পুলিশেরা দেখায় মাদক মামলার ভয়। এই লেখকের ২০১২ সালের এমন কিছু ঘটনা ধরে লেখায় দেখছি, কুষ্টিয়ায় থানায় ছয় দিন আটকে রেখে মা ও মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ‘অপরাধী’ ধরতে এসে সুযোগ নেওয়া হয়। খবরটি জানাজানি হলে তাঁদের ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। আদালত জামিন দিলে আবার গ্রেপ্তার করা হয় খুনের মামলায়। আবার তোলা হয় আদালতে। সেই আদালত এমনই আদালত, নিপীড়িতদের ফরিয়াদ না শুনে তাঁরা পুলিশের চাওয়ামতো মা ও মেয়েকে জেলে পাঠান। ওই বছরই ঢাকার মিরপুরেও নিহত ব্যবসায়ীর স্ত্রী-কন্যাকে একইভাবে ধর্ষণ করে পুলিশ।

ভাবি, কী ট্রমা জন্ম নেয় এমন নারীদের মনে। মনপুরার কথাই বলি। ছাত্রলীগ নেতা এসে ‘উদ্ধার’ করার পর হয়তো তিনি ভাবলেন দুঃসময়ের প্রহর বুঝি ফুরাল। কিন্তু নরকের শেষ দরজা তখনো দূরে। ধর্ষকদের হাত থেকে হাতে বদল হতে হতে কী দশা হয়েছিল তাঁর? মানুষের ওপর, সরকারের ওপর, আইনের ওপর, মানবাধিকারের ধারণার ওপর কি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি? স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকেরা কি এ রকম বেওয়ারিশ নাকি? তাদের নিয়ে যা খুশি তা করা চলে নাকি?

দেশে নাকি গরু-ছাগলের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু খুনি-ধর্ষকের সংখ্যাও যে বেড়েছে, জরিপ করে তা বলবে কোন সংস্থা? রাজনীতি নাকি মানুষকে রক্ষা করার জন্য, পুলিশ নাকি অপরাধ দমনের জন্য। কিন্তু কে রক্ষক আর কে ভক্ষক, সব যে গুলিয়ে যাচ্ছে? পরিসংখ্যান বলবে, হত্যা-নির্যাতন-ধর্ষণ ক্ষমতাবহির্ভূত লোক কম করে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা এখানে দুজনে দুজনার হয়ে কারবার করে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের সংগঠনগুলো হয়ে পড়েছে অপরাধ-নির্যাতনের নেটওয়ার্ক। সেই নেটওয়ার্কের দুই একটি গ্রন্থিতে সম্প্রতি ধরপাকড় চলছে বটে, কিন্তু সর্বাঙ্গে যখন পচন লাগে, তখন মৃদু সার্জারি করে কি দেহরক্ষা হবে? ব্যক্তি ধর্ষকের শাস্তি যদিবা হয়ও, কিন্তু যে ক্ষমতার তাপে গরম হয়ে তাঁরা ধর্ষণকে ডাল–ভাত মনে করছেন, সেই ক্ষমতাকে থামানো যাবে কী করে?

মানুষ এখন বড় অসহায়। আশ্রয়ে খোঁজে কোন দরজায় কড়া নাড়বে ভিক্টিমরা? উত্তম কুমার অভিনীত একটা ভূতের সিনেমার গল্পের মতো হয়েছে জাতীয় জীবন। অন্ধকার ভূশণ্ডির মাঠ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ফিরছিল এক লোক। বৃষ্টি ঝরছে টুপটাপ, অদূরে জঙ্গল। এর মধ্যে সে দেখে একটা কালো লোমশ বড় নখওয়ালা হাত পেছন থেকে তার ঘাড়ের ওপর এসে পড়ছে। ভয়ে চিৎকার করে লোকটা আরও জোরে সাইকেল চালায়। আবারও সেই ভয়াল হাত তাকে ছোঁয়। হাত ছুটতে ছুটতে পথিক পায় এক বন্ধ বাজার। দেখে এক পাহারাদার বসে ঝিমায়। তাকে জাগিয়ে ঘটনাটা বলে লোকটা। সব শুনে প্রহরী চাদরের ভেতর থেকে একটি হাত বের করে বলে, ‘কেমন হাত দেখেছিলেন, এ রকম?’ পুনরায় সেই লোমশ কালো হাত! সেখান থেকে পালিয়ে ছুটতে ছুটতে লোকটা এসে পড়ে এক থানার সামনে। ভেতরে টেবিলের ওপারে বসা এক দারোগা। টিমটিমে বাতি জ্বলছে দেখে লোকটা জানে পানি পায়। বারান্দা টপকে দৌড়ে গিয়ে দারোগাকে বলে, ‘ভাই বাঁচান’।

দারোগা তাকে বসিয়ে ধীর-সুস্থে ঘটনা শোনে। পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। জিজ্ঞাসা করে, ‘কেমন হাত দেখেছিলেন বলেন তো?’ লোকটা বলে। জবাব শুনে দস্তানাটা খুলে হাতটা সামনে বাড়িয়ে দারোগা বলে, ‘এ রকম দেখেছিলেন, এ রকম?’ তৃতীয়বারের মতো সেই লোমশ কালো হাতের থাবা দেখে লোকটার যে দশা, বোধ করি আমাদেরও সেই দশা।

ধর্ষক নেতাটির গ্রেপ্তারের খবর ইতিবাচক। বাকি চারজনকেও পুলিশ চাইলে খুঁজে বের করতে পারবে। কিন্তু ভাবছি ওই নারীর আড়াই বছরের শিশুটির কথা। এ ঘটনা কি তাকে বদলে দেবে? সম্প্রতি আলোড়ন জাগানো হলিউডি মুভি ‘জোকার’ দেখা হলো। কমেডিয়ান চরিত্রটির মানসিক অসুখ। হঠাৎ হঠাৎ তার প্রচণ্ড হাসি পায়, হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলে সে। জীবনে কোনো কিছুই হলো না তার। না প্রেম না স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ানের চাকরি। তার বন্ধু হয় না, রাস্তায় বখাটেরা তাকে পেটায়। জায়গায়-বেজায়গায় নার্ভাস হাসির জন্য বিপদেও পড়তে হয়। পরে জানা যায়, খুব ছোটবেলায় মা-সহ ছেলেটি নির্যাতিত হয়েছিল। তখনই তার মাথায় কোনো সমস্যা হয়। জীবনটা হয়ে পড়ে অভিশপ্ত। ছবির শেষে দেখা যায়, শহরের মেয়র-স্ত্রীসহ নিহত হলো কিশোর পুত্রের সামনে। থম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ওই ছেলেকে দেখে দর্শকের মনে পড়বে জোকারের কথা। এমন কোনো আঘাতই হয়তো জোকারকে জীবনের জন্য অকেজো করে ফেলেছিল।

এই ‘জোকার’ একদিন বিদ্রোহ করে। তার আজন্ম অপমান লাঞ্ছনার শোধ নেয়। সে হয়ে পড়ে হাজারো বিদ্রোহী তরুণের নায়ক। তাদের সবার মুখে জোকারের মুখোশ। তারা চায়, মানুষকে মানুষের মতো দেখা হোক।

আমাদের সমাজে কেবল নির্যাতক নারী-পুরুষই বাড়ছে না, বাড়ছে নির্যাতিত হয়ে মানসিক আঘাতগ্রস্ত নারী-পুরুষের সংখ্যা। বাড়ছে বাবা-মাকে ভয়াবহভাবে নির্যাতিত বা নিহত হতে দেখা শিশু-কিশোরের সংখ্যা। গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্তানদের মানসিক বিকাশ থমকে যাচ্ছে, কেউ কেউ আত্মহত্যাও করেছে বলে জানা যাচ্ছে। জোকারের মতো তাদের জীবনও যেন ধ্বংস হয়ে না যায়। ওই মর্মান্তিক কৌতুকটি যেন সত্যি না হয় যে অসুখী এক লোক বন্ধুকে বলছে, ‘আর কত দিন এই যন্ত্রণা সহ্য করব ভাই।’

বন্ধুর উত্তর, ‘বেশি না আর কিছুদিন করো।’
‘তারপর? তারপর কী হবে? শান্তি পাব?’
জবাব আসে, ‘তারপর তো তুমি মারাই যাবে, তখন কষ্ট করবে তোমার সন্তান।’

অমানবিকতার চাইতে ভয়াবহ হলো নিষ্ঠুরতাকেই ‘নিউ-নরমাল’, তথা নব্য–স্বাভাবিক বলে ভাবা।


নৃশংসতার শেষ কোথায়?


১. ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনো সমুদ্রবন্দর ছিল না, তৎকালীন সরকার ছয় মাসের জন্য কলকাতাবন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু ভারত আমাদেরকে রাস্তা মাপার পরামর্শ দিচ্ছিল। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মংলাবন্দর খুলে দিতে হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, আজ ভারতকে সে মংলাবন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে বাংলাদেশের কাছে। ২. কাবেরী নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে ভারতের কানাড়ি আর তামিলদের ‘কামড়া কামড়ি’ কয়েক বছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। সে দেশের এক রাজ্যই অন্য রাজ্যকে পানি দিতে চায় না। সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড় লাখ কিউবিক মিটার পানি দিবো। ৩. কয়েক বছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তর ভারত কয়লা-পাথর রফতানি বন্ধ করেছে। অথচ আমরা তাদের গ্যাস দিবো। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায় সেখানে আমাদের সম্পদ দিয়ে বন্ধুরা বাতি জ্বালাবে।

ওপরের কথাগুলো বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের একটি পোস্ট। আর এটিই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে আবরারের। নৃশংস পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করল বুয়েটের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।

একজন সন্তান বড় করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠানোর দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া বাবা-মায়ের জন্য বিরাট যুদ্ধ। সেটি মা-বাবাই বোঝে। আর যে ছেলে দেশের সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে তাকে কতটা যুদ্ধ করতে হয়েছে? সেই যুদ্ধ এভাবে শেষ হয়ে যাবে- ভাবতেও দম বন্ধ হয়ে আসে। আবরারের মায়ের আকুতি ‘আমার সন্তানের হাতের যে জায়গাটা তোমাদের আঘাতে আঘাতে নীল হয়ে আছে, ঠিক ওখানে ধরে তাকে স্কুলে নিয়ে যেতাম, তোমাদের কিলঘুষি আর নির্যাতনের নির্মম আঘাতে আমার ছেলের চোখ বন্ধ করে আছে, তোমরা জানো বাবা, ও যখন ঘুমাত আমি তার কপালে, চোখে চুমু খেতাম। আর মনে মনে চাইতাম সে যেন আরো একটু ঘুমায়, তোমরা তাকে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দিলে।’ মায়ের এমন আহাজারির জবাব কে দেবে? সরকার, প্রশাসন নাকি যারা বর্বর রাজনীতির ধারক-বাহক।

ক্ষমতার ছত্রছায়ায় এই দেশে প্রতিদিন কি পরিমাণ অত্যাচার চলে, সেটি আমরা টের পাই না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিদিন চলছে ক্ষমতার দাপট। এতে অন্ধ হয়ে একের পর এক নির্মম নৃশংসভাবে ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১ বছর আগে বর্তমান সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা ধর্ষণের সেঞ্চুরি করেছিল। দিনের পর দিন আন্দোলন করেও কোনো ফল হয়নি। বরং যারা আন্দোলন করেছে তাদের অনেকের ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে গেছে। অপরাধীদের কোনো বিচার হয়নি। বুয়েটের ছাত্রী সনি হত্যার শিকার হয়েছে। কোনো বিচার পায়নি তার পরিবার। সনি হত্যার প্রতিবাদে তখনো উত্তাল হয়েছিল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। আজ তার ধারাবাহিকতায় সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে। একের পর এক হত্যা এবং দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র দেশবাসীকে হতবাক করে তুলছে। কেউ প্রতিবাদী হলেই তার কপালে জোটে জেল জুলুম, না হয় গুম, হত্যা, নির্যাতন, মামলা ইত্যাদি।

দেশকে ডুবে যেতে দেখে, দেশবিরোধী পদক্ষেপে ছাত্রসমাজ প্রতিক্রিয়া জানাতেই পারে- যার জন্য একজন মেধাবী ছাত্রকে হলে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা যায় না। এটা কোনো স্বাধীন দেশ এবং গণতন্ত্রের ভাষা হতে পারে না। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় আমরা চোখে দেখেছি- বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থেকে শুরু করে স্কুলের শিশু-কিশোর পর্যন্ত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে যারা যুগের পর যুগ ধরে জগদ্দল পাহাড়ের মতো জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছিল। তাদের শিক্ষা দেয়ার জন্য সারা দেশে সে আন্দোলন এক অনন্য নজির সৃষ্টি করে দিলো। ওরা মার খেয়েছে রক্তাক্ত হয়েছে কোনো কোনো ছাত্রী লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে, এসব ঘটনায় পুলিশ এবং সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের দিকেই অভিযোগের আঙুল উঠেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছাত্রকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হলো- ভিসি তাকে দেখতে যাওয়া তো দূরের কথা, একটি বিবৃতিও দিলেন না। ভিসিও ওইসব ছাত্র নামধারী হায়েনাদের দোসর বলে বিবেচিত হোন, জাতি তা আশা করে না। আমরা ছাত্র রাজনীতি চাই। তা হবে আদর্শভিত্তিক এবং সেখানে হবে মেধার প্রতিযোগিতা। মা-বাবা তা হলে পাবেন তাদের যোগ্য সন্তান।

  • লেখকঃ তোফাজ্জল হোসাইন 
  • কার্টসিঃ নয়াদিগন্ত/ ২৭ অক্টোবর ২০১৯

বিদ্যুৎ খাতে অবিশ্বাস্য অদক্ষতা ও অপচয়



পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) পরপর ২০১৭ ও ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে সিদ্ধিরগঞ্জের বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বলে আখ্যা দিয়েছিল। ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, সিদ্ধিরগঞ্জ ৩৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রতি কিলোওয়াটে ব্যয় ৯৬১ ডলার, যা বিশ্বে বর্তমান সময়ে নির্মিত একই ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় যুক্তরাষ্ট্রের ডমিনিয়ন ভার্জিনিয়া পাওয়ার প্ল্যান্টে, প্রতি কিলোওয়াটের জন্য ব্যয় হয়েছে ৯৫৫ ডলার। তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল বিদ্যুৎকেন্দ্র পাকিস্তানের ৭৪৭ মেগাওয়াট সিন্ধু ইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট, যা কম্বাইন্ড সাইকেলের পাশাপাশি দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক, যার প্রতি কিলোওয়াটের খরচ ছিল ৮৫৪ ডলার।

আইএমইডির তথ্যমতে, ৫৬ শতাংশ তাপীয় দক্ষতায় নির্মিত হরিপুর ৪১২ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র আর ৫৮ শতাংশ তাপীয় দক্ষতার আশুগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির তুলনায় সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয় অনেক বেশি হলেও কেন্দ্রটির তাপীয় দক্ষতা কম (সাড়ে ৫৩ শতাংশ)। হরিপুরে কিলোওয়াটপ্রতি ব্যয় হয় ৮৪৭ ডলার, আশুগঞ্জে ৬৩৭ ডলার। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আইসোলেক্সের ব্যর্থতায় স্যামসাং পাওয়ারকে দিয়ে কিছুটা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে অত্যধিক ব্যয়ের পরও নির্ধারিত সময়ে উৎপাদন শুরু করতে পারেনি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।

এখানে কয়েকটি গুরুতর বিষয়ের পর্যলোচনা দরকার। এক. নিম্নমান ও আর্থিক সুনামের সংকটে থাকা ঠিকাদার আইসোলেক্সকে কাজ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতা যাচাই করা জরুরি ছিল। আইসোলেক্সের কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনভিজ্ঞতা আদৌ বিবেচ্য ছিল কি না?

দুই. আর্থিক সংকট, ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা এবং ব্রাজিল, কেনিয়া ও রুয়ান্ডায় আইসোলেক্স কন্ট্রাক্ট হারালেও বাংলাদেশ কেন সেসব তথ্য আগে থেকেই আমলে নিয়ে দেউলিয়া এ ঠিকাদার পরিবর্তন করে ফেলেনি?

তিন. হরিপুর ও আশুগঞ্জে বৃহৎ পরিসরে কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি সিদ্ধিরগঞ্জেও কেন শুরু থেকেই কম্বাইন্ড সাইকেল না করে সিঙ্গেল সাইকেল কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি করা হলো?

চার. কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বিশ্বের শীর্ষ দুই সুনামধারী কোম্পানি মার্কিন জিই ও জার্মান সিমেন্সকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশ কেন বারবার নিম্ন ও মধ্যমানের তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ দিচ্ছে; যারা এই প্রযুক্তির স্বত্ব রাখে না। ঠিকাদারের কারিগরি অযোগ্যতা প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বরে আইসোলেক্স, এমনকি সিম্পল সাইকেল ইউনিটকেও চালুর চেষ্টায় ব্যর্থ হয় গ্যাস বুস্টারের টিউনিংয়ের সমস্যার কারণে। এই সমস্যা সমাধান না করেই আইসোলেক্স বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যায় এবং পরবর্তী সময়ে নিজেদের আন্তর্জাতিকভাবে দেউলিয়া ঘোষণা করে। এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, উচ্চ প্রযুক্তিগত প্রকল্পে কারিগরি স্বত্বধারী টেকনোলজি ভেন্ডরকে বিবেচনা না করে বাংলাদেশ কেন একের পর এক অযোগ্য তৃতীয় পক্ষকে কাজ দেয় এবং এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুর্নীতির সম্পর্ক আছে কি?

পাঁচ. উচ্চপ্রযুক্তিনির্ভর যেকোনো খাতের বড় প্রকল্প নির্মাণের কারিগরি নকশা পর্যালোচনা করার যোগ্যতা বাংলাদেশ কবে অর্জন করবে? বাংলাদেশ কি বিভিন্ন খাতের জন্য আলাদা করে পর্যাপ্তসংখ্যক একাডেমিক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল এক্সপার্ট তৈরির গুরুত্বকে উপলব্ধি করে? সড়ক, সেতু, রেল, বন্দর ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোমিটার বা ইউনিটপ্রতি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি খরচ করার পরও কি বাংলাদেশে টেকনোলজি ট্রান্সফার হচ্ছে? চুক্তিগুলো কি টেকনোলজি ট্রান্সফারের অনুকূলে?

প্রকল্প পরিচালনার অদক্ষতা, কারিগরি অদূরদর্শিতা, নিম্নমানের ঠিকাদার নিয়োগের দুর্নীতিমনা ঝোঁক ও প্রকল্প বাস্তবায়নের অতি দীর্ঘসূত্রতার মতো অতি হীন বিষয়গুলোর পাশাপাশি সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্র আরেকটি শোচনীয় আর্থিক অপব্যবস্থাপনার জানান দিয়ে গেছে। সেটি হচ্ছে, বৈদেশিক ঋণের গ্রেস পিরিয়ডের অপব্যবহার। সিদ্ধিরগঞ্জে ৩০০ মেগাওয়াটের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ২০০৮ সালে ৩৫ কোটি ডলার দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। নির্মাণে চুক্তি সই করা হয় ২০১২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর কথা ছিল ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। প্রথমে সিঙ্গেল সাইকেলে করার কথা থাকলেও পরে কম্বাইন্ড সাইকেলে রূপান্তরের জন্য বিশ্বব্যাংক প্রকল্পে অতিরিক্ত ১৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার অর্থায়ন করে (তখনকার বিনিময় হার অনুযায়ী ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বেশি)। দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ হারে ৩৮ বছরে বাংলাদেশকে ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে হবে, যেখানে গ্রেস পিরিয়ড ছিল ছয় বছর। অর্থাৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সুফল আসার আগেই বৈদেশিক ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ। কারিগরি পরিকল্পনা, চুক্তি ও ঠিকাদার নিয়োগ ও প্রকল্প বাস্তবায়নের এই ভয়াবহতা বাংলাদেশের আরও বহু প্রকল্পে দৃশ্যমান।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে বর্তমান সরকারের দৃশ্যমান সাফল্য থাকলেও সেখানে আছে আরও বেশ কিছু কলঙ্ক, যা ভবিষ্যতে বর্তমান নেতৃত্বকে বিচারিক সংকটে ফেলার ঝুঁকি তৈরি করেছে। এ রকম তিনটি বিষয়ের একটি হচ্ছে চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে বারবার উচ্চমূল্যের কুইক রেন্টাল ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নবায়ন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, জ্বালানি খরচের বিপরীতে অদক্ষ বহুসংখ্যক ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন—যেগুলো পিডিবির বোঝা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তৃতীয়ত, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রক্রিয়ায় তৃতীয় পক্ষের যাচাই–বাছাইহীন চুক্তিতে উৎপাদন না করেই বিশেষ বিশেষ কোম্পানিকে অতি উচ্চহারে ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে যাওয়া। কয়েক বছর ধরে বেসরকারি খাতে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে সরকার। পাশাপাশি কয়েকটি মেয়াদোত্তীর্ণ রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোর চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। আর এ বিদ্যুৎ কেনায় প্রতিবছর মোটা অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)। গত ছয় বছরে পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার ৪৮৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এ ব্যয় বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনার প্রায় ৩৭ দশমিক ২২ শতাংশ, যদিও সরকারি উৎপাদনে এ ধরনের কোনো ব্যয় নেই।

দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে প্রায় ১৯ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু চাহিদা না থাকায় গ্রীষ্মকালেই উৎপাদন করা হয়েছে সর্বোচ্চ সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট, সঞ্চালিত হয়েছে আরও কম। শীতে তা ৭ হাজারে নেমে যাওয়ার শঙ্কা করা হচ্ছে। এতে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশই অলস থাকছে। চাহিদা বিবেচনা না করে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই দুই বছর আগে বেসরকারি খাতে নতুন কয়েকটি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে গুনতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ। ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) নামক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বোঝা টানতে হবে ১৫ বছর। ফলে বিদ্যুৎ খাতের বোঝা হয়ে উঠেছে এসব কেন্দ্র, যাদের কারও কারও ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়ছে ৭৫ (অ্যাগ্রিকো পাওয়ার সলিউশন) থেকে ৮১ টাকা (প্যারামাউন্ট বিট্রাক এনার্জি)। এই ধারণা অমূলক নয় যে সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতির চৌহদ্দিতে থেকেই অকারণে রাষ্ট্রের ৩৫ হাজার ৪৮৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা গচ্ছা গেল, ভবিষ্যতে যা আরও বাড়বে।

বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতের প্রধানতম আরেকটি সমস্যা হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে মানানসই বিদ্যুৎ সঞ্চালনের সক্ষমতা না থাকা এবং সঞ্চালনের সঙ্গে বিতরণ অবকাঠামোর ব্যাপক কারিগরি অক্ষমতা।

একদিকে নির্মাণে অতি উচ্চ খরচ হচ্ছে, অন্যদিকে প্রতারক ও দুর্নীতির ইন্টারফেসগুলো চুক্তির ফাঁকফোকরে লুটে নিচ্ছে, আরেক দিকে বিতরণ অবকাঠামোর অক্ষমতায় উৎপাদিত বিদ্যুতের পূর্ণ সুফল পাচ্ছে না দেশের গ্রামীণ ও শহুরে নাগরিক। সরকারি মাল এভাবে দরিয়ায় না ঢেলে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে সমন্বিত ও দুর্নীতিমুক্ত পদক্ষেপ নিতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সুদৃষ্টি কামনা করি।

Sunday, October 27, 2019

বাংলাদেশকে ভাবতে হবে

ড. মাহবুব উল্লাহ্
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব বলে কিছু নেই; দেশের স্বার্থটাই চিরন্তন। বাংলাদেশে যারা চিন্তার জগতের মানুষ বলে পরিচিত তারা অনেকেই মনে করেন আমাদের একটি চিরস্থায়ী বন্ধু আছে।

সেই বন্ধু আমাদের সঙ্গে যতই বিরূপ আচরণ করুক না কেন আমরা বারবার বলতে থাকব, ওই দেশটি তো আমাদের বিপদের সময়ের বন্ধু। সুতরাং কোনো অবস্থাতেই সেই দেশের মনোভাব আমাদের প্রতি বিরূপ হয়ে পড়ুক, সেটা আমরা কোনোক্রমেই হতে দেব না। এমনকি বিষয়টি যদি আমাদের জীবন-মরণের প্রশ্ন হয়, আমাদের আত্মমর্যাদার প্রশ্ন হয় তখনও আমরা বুকের মধ্যে সব ক্ষোভ চেপে রেখে মুখে হাসির রেখা টেনে বলতে থাকব, ওই মিত্র দেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো পদক্ষেপ আমরা নেব না।

এদেশের কেউ কি কখনও বলেছে, অন্য দেশের ক্ষতি করা হলে বাংলাদেশের কিছু আসে যায় না। আসল কথা হল বাংলাদেশকে যেসব আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তির মোকাবেলা করতে হচ্ছে, তাদের কারোর জন্যই বাংলাদেশ বিন্দুমাত্র হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে না। কারণ সামরিক শক্তির দিক থেকে বাংলাদেশ কোনো আঞ্চলিক শক্তির সমকক্ষ তো নয়ই বরং খুবই দুর্বল।

বাংলাদেশের শক্তি কী? বাংলাদেশের কি কোনোই শক্তি নেই? বাংলাদেশের কি কোনোই সম্পদ নেই? বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগোচ্ছে, এটা বাংলাদেশের শক্তি। হতে পারে এই শক্তি এখনও টেকসই হয়ে উঠতে পারেনি। বড় দুর্বল ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। যত কথাই বলা হোক না কেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শক্তির উৎস দুটি প্রধান খাত। এর একটি হল পোশাক শিল্পখাত এবং অপরটি হল বিদেশ থেকে পাওয়া রেমিটেন্স। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে দুটি প্রধান গন্তব্যস্থল হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। অতি সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের অবনতিশীল মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশকে যে অগ্রাধিকার মূলক সুবিধা দেয়া হচ্ছে তা আর অব্যাহত থাকবে না।

একইসঙ্গে শ্রমমান উন্নয়নের শর্তও জুড়ে দেয়া হয়েছে। শ্রমমান উন্নয়নের জন্য পোশাক শিল্প মালিকরা বেশকিছু কাজ করছে। এ ব্যাপারে তারা গত কয়েক বছর একর্ড ও এলায়েন্সের নজরদারিতে ছিল। সংবাদপত্রের খবর পড়ে জেনেছি, একর্ড ও এলায়েন্স পোশাক শিল্প মালিকদের সংস্কার কার্যক্রমে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তাহলে নতুন করে শ্রমমানের শর্ত উল্লেখ করা হচ্ছে কেন। আমি মেহনতি মানুষের পক্ষের লোক। পোশাক খাতে শ্রমিকরা ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে এমন কথা বলার সময় এখনও আসেনি। কূটনীতির ব্যঞ্জনা বড়ই অদ্ভুত।

একজন কূটনীতিবিদ যখন বলেন, তিনি দক্ষিণ দিকে যাচ্ছেন, আসলে তার গতিপথ দক্ষিণমুখী নাও হতে পারে। বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশের কূটনীতিবিদরা যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের গূঢ় ইঙ্গিত বুঝে থাকে, তাহলে ভালো কথা। নচেৎ কী হবে বলা মুশকিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা বা সাধারণ অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা স্থগিত করে রেখেছে। এসব বিবেচনা করলে বলতে হবে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প আন্তর্জাতিক বাজারে চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রেমিটেন্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি কম-বেশি ঊর্ধ্বমুখী ছিল।

তারপরেও বলতে হয় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমবাজার খুব সুখকর অবস্থার মধ্যে নেই। যেসব নারী গৃহকর্মী সৌদি আরবে গিয়েছিল তাদের অভিজ্ঞতা খুবই করুণ! এছাড়া বৈশ্বিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ প্রধানত অদক্ষ শ্রমশক্তিনির্ভর। আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারের ৪০ বছরেরও বেশি অবস্থান করার পর আমাদের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারল না, কীভাবে এ শ্রমবাজারকে আপগ্রেড করা যায়। সর্বোপরি শ্রমবাজার ব্যবস্থাপনার জন্য যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন সেই ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আজ পর্যন্ত গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। অর্থনীতিবিদরা ইন্সটিটিউশন বা প্রতিষ্ঠানের ওপর এত গুরুত্ব দেন কেন? তারা এর ওপর গুরুত্ব দেন এ কারণে যে, সঠিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারলে লেনদেনের ব্যয় অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বিষয়টি খোলাসা করা সম্ভব।

ধরুন দেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠান নেই। কিন্তু প্রচুর শিক্ষার্থী আছে যারা উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করতে চায়। আবার প্রচুর শিক্ষকও রয়েছে যারা উচ্চতর পর্যায়ের শিক্ষাদানে সক্ষম। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের খুঁজে খুঁজে বের করতে হবে কোন পণ্ডিতের বাড়িতে গেলে কোন বিষয়ে পাঠ নেয়া যায়। এ রকম পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের শহরময় শিক্ষকদের বাড়িতে যেতে অনেক সময় ও অর্থের অপচয় করতে হবে। আর শহরটি যদি ঢাকার মতো হয়, তাহলে যানজটে নাকাল হয়ে উচ্চতর জ্ঞানের পিপাসা নিবৃত্ত করার চেষ্টা ছেড়ে দিতে হবে।

এত সব সমস্যার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে জ্ঞানার্জন করার পর প্রশ্ন উঠবে সনদ বা সার্টিফিকেট কে দেবে? এসব সমস্যা অতিক্রম করার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব হয়েছিল। পাশ্চাত্যে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠার আগেই মুসলিম দুনিয়ায় এ রকম প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। যে গাউন পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কনভোকেশন উৎসব করে সেই গাউনও মুসলিম সভ্যতার সৃষ্টি। আজ বিশ্ব দরবারে মুসলিম দেশগুলোর অবস্থান কোথায়? বলছিলাম, প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার কথা। দেশের বাইরে শ্রমশক্তি রফতানির জন্যও গভীর চিন্তা-ভাবনা করে অভিজ্ঞতার আলোকে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, যেন গরিব শ্রমিকরা প্রতারণার শিকার না হয়, অভিবাসন ব্যয় যাতে ন্যায্য হয় এবং বিদেশে কর্ম পরিবেশ এবং কাজের শর্ত যাতে মানবিক হয়। এ আলোচনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠতে পেরেছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। এছাড়া উন্নয়নের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল অর্থনীতির বহুমুখীকরণ। বাংলাদেশে ছোট-বড়-মাঝারি বহু ধরনের শিল্প কারখানা গড়ে তোলা সম্ভব।

সরকার দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে চাচ্ছে। এগুলোকে সব ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধা দিয়ে গড়ে তোলা সম্ভব হলে হয়তো দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে। কিন্তু আমাদের ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের যে অবস্থা এবং পুঁজিবাজারের যে অবস্থা, সে অবস্থা কাটিয়ে উঠতে না পারলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগও খুব একটা উৎসাহিত হবে বলে আশা করা যায় না। অর্থাৎ অর্থনীতির যে শক্তির জোরে আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাই সে শক্তিটাও সঞ্চয় করা সম্ভব হবে না।

এবার আসা যাক আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সম্পর্কের শেকড় লুকিয়ে আছে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে। এ প্রশ্নে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুবই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছে। পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে ভারতে নরসিমা রাওরের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় থেকে। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনরি কিসিঞ্জার এখন মনে করেন অতীতকে পেছনে ফেলে রেখে দুটি দেশই নিরাপত্তা ও অর্থনীতি বিষয়ে সমান্তরাল উদ্যোগ নিয়ে আজকের সম্পর্কের জন্ম দিয়েছে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় হেনরি কিসিঞ্জারের ভূমিকা এদেশের অনেকেরই অজানা নয়। সেই সময় প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পলিসি ছিল Tilt Pakistan policy. প্রেসিডেন্ট নিক্সন ইন্দিরা গান্ধীকেও খুবই অপছন্দ করতেন। জনান্তিকে নিক্সন ইন্দিরা সম্পর্কে খুবই অশালীন শব্দ ব্যবহার করতেন।

হেনরি কিসিঞ্জারের বর্তমান বয়স ৯৬। নবতিপর হওয়া সত্ত্বেও তিনি এখনও মানসিকভাবে খুবই সজাগ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় অত্যন্ত তৎপর। হার্ভার্ডের সাবেক এ প্রফেসর একের পর এক বই লিখে চলেছেন। এসব দেখে মনে হয়, বার্ধক্য তাকে কাবু করতে পারেনি। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত অংশীদারিত্ব ফোরামে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ সংকট দুই দেশকে (ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) সংঘাতের কিনারায় নিয়ে গিয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের একদম শেষ পর্যায়ে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল ভারত ও পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র পাকিস্তানের পক্ষে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌ-বহর পাঠানোর ঘোষণা দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অজুহাত ছিল বাংলাদেশে থাকা মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তায় তারা এটি করেছে, তবে ভারত এ ঘটনাকে নিজেদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবেই দেখেছিল। কারোর কারোর ভাষ্য হচ্ছে, ভারত যাতে পশ্চিম পাকিস্তানও দখল করে ফেলতে না পারে, সেজন্যই যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ। কিসিঞ্জার বলেছেন, এটি ছিল কোল্ড ওয়ারের সময়। তাই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থও ছিল ভিন্ন।

বার্লিন সংকটের উদাহরণ দিয়ে হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, ওই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ও ভারত সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন না করায় মার্কিন সরকারের অনেকেই ছিলেন হতাশ। কিসিঞ্জারের ভাষায়, ভারত ছিল তখন ঐতিহাসিক বিবর্তনের সূচনালগ্নে। বিশ্বে যেসব সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল সেগুলোর সবটা ভারতের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।

ভারত তখন তার নিজস্ব বিবর্তন ও নিরপেক্ষতার নীতিতে নিবিষ্ট ছিল। আমি অবশ্য কিসিঞ্জার কথিত ভারতের নিরপেক্ষ দেহভঙ্গির ব্যাপারে সন্দিহান। কারণ ১৯৬২-র চীন-ভারত যুদ্ধের পর ভারত জোট নিরপেক্ষতার পরিবর্তে দ্বৈতপক্ষতার নীতি অবলম্বন করে। অর্থাৎ ভারত ছিল Doubly Aligned. ভারত তখন আমেরিকার অস্ত্র সাহায্য নিচ্ছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকেও অস্ত্র সাহায্য পাচ্ছিল।

কিসিঞ্জার উপর্যুক্ত ফোরামে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যখন চীনের জন্য নিজেকে উম্মুক্ত করে দিয়েছিল, সেই সময় হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। তার ভাষায়, আমরা এ সংকটকে দেখেছি বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায় যে, শুধু মৌলিক বিবর্তনই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সমান্তরাল উন্নয়ন করতে পারে। অনেক বছর ধরে আমরা এমন একটি পরিস্থিতিতে এসে পৌঁছেছি যেখানে অনেক ইস্যুতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অভিন্ন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য রয়েছে। হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, এ দুটি দেশের মধ্যে বিশ্বের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। পূর্ববর্তী কোনো আয়োজন ছাড়াই এ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে এ দুই দেশের মধ্যে।

কিসিঞ্জারের ভাষায়, যদি আপনি বিশ্বের দিকে তাকান তাহলে দেখবেন পৃথিবীর প্রতিটি স্থান উত্তাল। আপনি তাদের প্রত্যেকের জন্য একটি সাধারণ ধারণার বিকাশ ঘটাতে পারবেন না। প্রশ্ন উঠছে, ইন্দো-মার্কিন সমান্তরাল পথ চলায় বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়? বাংলাদেশ কি দুটি বড় শক্তির মধ্যে অভিসারের মতো অবস্থা দেখে সেই দ্বৈত শক্তিকে নৈবদ্য প্রদান করে যাবে? সেটা কি বাংলাদেশের স্বার্থানুকূল? বাংলাদেশের উপকূলজুড়ে ভারতের শক্তিশালী রাডার ব্যুহ নির্মাণের প্রশ্নে বাংলাদেশের সমঝোতায় পৌঁছানোর ব্যাপারটি বাংলাদেশকে বিশেষ বলয়ভুক্ত করে ফেলছে কিনা সেটাও তো ভাবার বিষয়। এ ব্যাপারে আমাদের সংবিধান কী বলে? সেটাও তো বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। আমাদের ভাবতে হবে, বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে আমরা কী পদক্ষেপ নিতে পারি? আমি পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ নই। পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞদের মুখেই শুনেছি, বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা রয়েছে। তাই যদি হয়, এ সুবিধা দেশের স্বার্থে কেমন করে কাজে লাগান হবে- সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

  • ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ
  • কার্টসিঃ যুগান্তর / ২৭ অক্টোবর ২০১৯