Search

Tuesday, November 26, 2019

একাদশ সংসদ নির্বাচন যেমন দেখেছি

ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন




দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হচ্ছে দেখে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও চারদলীয় ঐক্যজোট নির্বাচন বয়কট করেছিল। ফলে একতরফা একটি নির্বাচনে প্রায় সকল আসনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ‘মহাজোট’ সরকার আবারো ক্ষমতাসীন হয়। বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোটের দাবি ছিল- সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য একটি দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই ন্যায্য দাবিকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। বাধ্য হয়ে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট নির্বাচন বয়কট করে এবং অন্যদেরও নির্বাচন বয়কটের আহ্বান জানায়।
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রকৃতপক্ষে শতকরা মাত্র ৫-১০ ভাগের বেশি ভোটার ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়নি। সরকারের ‘একান্ত বাধ্যগত’ নির্বাচন কমিশন সারা দেশে ‘ভুতুড়ে’ ভোটকে আমলে নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে নির্বাচিত ঘোষণা করেছে। এতে দেশে একটি ভোটারবিহীন অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক পার্লামেন্ট গঠিত হয়। সেখানে জাতীয় পার্টির এক অংশকে ক্ষমতায় এবং অপর অংশকে বিরোধী দলে বসিয়ে জাতির সাথে তামাশা করা হলো। গায়ের জোরের জনবিচ্ছিন্ন সরকার তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সময়কালে দেশে নজিরবিহীন নৈরাজ্য, অপশাসন এবং বিরোধী দলের ওপর সীমাহীন নির্যাতন, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মিথ্যা, বানোয়াট ও ‘গায়েবি’ মামলা দিয়ে এবং ঢালাওভাবে গ্রেফতার করে বিএনপিকে দুর্বল করার সর্বাত্মক প্রয়াস চালায়।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটকে নির্বাচন থেকে পুনরায় দূরে রাখার অভিপ্রায়ে, কৌশল হিসেবে বিএনপি চেয়ারপারসন, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বানোয়াট ও মিথ্যা মামলায় অন্যায়ভাবে কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। তিনি যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারেন, সেজন্য তার শাস্তি বৃদ্ধি এবং প্রাপ্য জামিন থেকে বঞ্চিত করা হলো।

দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পরামর্শক্রমে বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট দেশনেত্রীর মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধী বৃহত্তর ঐক্য সৃষ্টির উদ্দেশে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠিত হয়। 

ড. কামাল ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় ঐক্যফ্রন্ট প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়। নেতৃত্বহীন ও লক্ষ্যহীন অবস্থায় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে সকল প্রার্থী ধানের শীষ মার্কা নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ক্ষমতাসীন সরকার তার গণতান্ত্রিক চরিত্র ও মূল্যবোধের অভাবে বিরোধী দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেনি। জনগণ বিরোধী দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণকে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির গণভোট হিসেবে গণ্য করে এবং ধানের শীষের পক্ষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থনের মাধ্যমে গণজোয়ার সৃষ্টি করেছে। সরকার স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে যে, জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হবে। তাই ক্ষমতাসীন দল ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের আগের রাতেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়। তা এতটাই লাগামহীন ছিল যে, সারা দেশে বিএনপির মতো জনপ্রিয় দলকে ছয়টিসহ বিরোধী দলকে মাত্র আটটি আসন দিয়ে ক্ষমতাসীনরা ২৯২টি আসন দখল করে নিয়েছে।

এমন একটি প্রহসনমূলক, নজিরবিহীন ও ভোট ডাকাতির কথিত নির্বাচনে আমি নিজে কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি-মেঘনা) এবং কুমিল্লা-২ (হোমনা-তিতাস) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলাম। বিরোধী দল নির্বাচনী চ্যালেঞ্জে অবতীর্ণ হবে, এমন ঘোষণার পর থেকেই সারা দেশের মতো আমার নির্বাচনী এলাকায়ও শুরু হয়েছিল প্রশাসনকে ব্যবহার করে গায়েবি মামলা, হয়রানি ও গ্রেফতার। বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে নির্বাচনের মাঠ থেকে আমাদের নেতাকর্মীদের এলাকাছাড়া করে দেয়া হয়। বিনা প্রতিরোধে ‘ভোট ডাকাতি’র সব আয়োজন সম্পন্ন হলো। 

নির্বাচন কমিশন ও প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের সাথে নির্বাচন-পূর্ব আলোচনায় নির্বাচনে ‘সমতল ভূমি’ সৃষ্টির যে আশ্বাস দিয়েছিলেন, প্রশাসন যন্ত্রের মাধ্যমে এর সম্পূর্ণ বিপরীত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। নির্বাচনের পর দেশী-বিদেশী মিডিয়া এবং গণতান্ত্রিক বিশ্ব বাংলাদেশের একাদশ নির্বাচনকে ভুয়া, অগ্রহণযোগ্য এবং ‘গণতন্ত্রের কফিনে সর্বশেষ পেরেক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গণতন্ত্রের কোনো মানদণ্ডেই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়েছে বলে তারা তা মেনে নেননি।

একাদশ সংসদ নির্বাচনে কী পরিমাণ কারসাজি, অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং ভোট ডাকাতি হয়েছে, তার নমুনা আমার দু’টি নির্বাচনী আসনের ফলাফল পর্যালোচনা করলেই দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। এ দু’টি আসনে ভোটের ফলাফলের একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ প্রদান করা হলো-

একাদশ সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-১ এবং ২ আসনের ভোটের ফলাফল

কুমিল্লা-১ :
















কুমিল্লা-২ :



কুমিল্লা-১ এবং কুমিল্লা-২ আসনের কথিত নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়, এ দুটো নির্বাচনী এলাকাসহ সমগ্র বাংলাদেশে ভোটের নামে কী পরিমাণ জালিয়াতি, কিভাবে ২৯ ডিসেম্বর রাতে বাক্স ভরে এবং পূর্বপরিকল্পিত ছকে অবিশ্বাস্য ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে।

নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বিগত নির্বাচনগুলোতে সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতি ছিল ৭০ শতাংশের কম। বাংলাদেশে কোনো জাতীয় নির্বাচনে এর বেশি উপস্থিতি অস্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য। ৭০ শতাংশের অতিরিক্ত ভোটার উপস্থিতি, সম্ভব ভোট ডাকাতি, একযোগে ব্যালটে সিল মেরে দেয়া বা আগের রাতে বাক্সে ভোট ভর্তি করে দেয়ার মাধ্যমে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে যে তাই ঘটেছে দেশ-বিদেশে সর্বজনস্বীকৃত। কুমিল্লা-১ আসন দাউদকান্দি ও মেঘনা উপজেলা নিয়ে গঠিত। ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দাউদকান্দি উপজেলায় ৯২ ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৫৫টি ভোটকেন্দ্রে ৭০ শতাংশের কম ভোটার উপস্থিত হয়েছে, যা মোটামুটি স্বাভাবিক বলে গণ্য করা যায়। অবশিষ্ট ৩৭টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৭১ থেকে ১০০ শতাংশ। এটা সম্ভব হয়েছে আগের রাতে এবং ভোটের দিন সকালে কেন্দ্র দখল করে নৌকায় একতরফা সিল দেয়ার মাধ্যমে। হুমকি-ধমকি ও প্রশাসনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ভোটাররা যে ৫৫টি ভোটকেন্দ্রে মোটামুটি স্বাভাবিকভাবে ভোট দিতে পেরেছে, সেখানে ধানের শীষ প্রতীক পেয়েছে মোট ৫৫৬৭১ ভোট এবং নৌকা পেয়েছে ২১৭৮১ ভোট। ৭১ শতাংশের ঊর্ধ্বে প্রাপ্ত ভোটের অবশিষ্ট ৩৭টি কেন্দ্রে ধানের শীষ পেয়েছে ২৭৩৭৮ ভোট এবং নৌকা পেয়েছে মোট ৫৪৬২৬ ভোট। উল্লেখ্য ৯০ শতাংশের ঊর্ধ্বে প্রাপ্ত ভোটের ছয়টি কেন্দ্রে ধানের শীষকে দেয়া হয়েছে ১৭৯১ ভোট আর নৌকাকে দেয়া হয়েছে ১২৯০০ ভোট। 

কুমিল্লা-১ আসনের অপর উপজেলা, নদীবেষ্টিত মেঘনা উপজেলায় বিএনপির নেতাকর্মীদের ভোটের আগের রাত থেকে ভোটকেন্দ্রের ধারে-কাছেও যেতে দেয়া হয়নি। আগের রাতেই নৌকা সমর্থকরা ভোটকেন্দ্র দখল করে প্রায় সব ভোট নৌকায় সিল মেরে বাক্সে ভর্তি করে দেয়। নির্বাচনের দিন সকালে ‘ভোট শেষ হয়ে গিয়েছে’ এই কথা বলে ভোটকেন্দ্র থেকে ভোটারদের সরিয়ে দেয়া হয় প্রশাসনের সহযোগিতায়। ফলে দেখা যায়, ৭০ শতাংশ ভোট প্রাপ্তির ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা মাত্র ১টি, যে কেন্দ্রে ধানের শীষ পায় ১৪৩২ ভোট এবং নৌকা পায় ৪৩৯ ভোট। জনগণ ভোট দিতে পারলে ফলাফলের ধরন এ রকম হওয়ারই কথা। কিন্তু প্রস্তুতকৃত ফলাফলে দেখা যায়, অবশিষ্ট ৩৫টি কেন্দ্রে ৭০ থেকে ১০০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয়েছে এবং এই ৩৫টি কেন্দ্রে ধানের শীষকে দেয়া হয় মোট ১০৬৫৬ ভোট, আর নৌকার ভোট দেখানো হয় মোট ৭৭২৬৩ ভোট। এই উপজেলায় একটি ভোটকেন্দ্রে ১০০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি দেখানো হয়, যা কোনোক্রমেই স্বাভাবিক নয়। এ অবস্থায় কুমিল্লা-১ আসনের দাউদকান্দিতে আমি এগিয়ে থেকেও মেঘনা উপজেলায় ভোটের নজিরবিহীন কারচুপি এবং আগের রাতে ভোট ডাকাতি করে আমাকে এই আসনে ‘পরাজিত’ করা হয়েছে।

কুমিল্লা-২ আসনটি হোমনা ও তিতাস উপজেলা নিয়ে গঠিত। এ আসনে মরহুম এম কে আনোয়ার অতীতে সংসদ সদস্য ছিলেন। তার মৃত্যুর কারণে এই আসনে বিএনপি থেকে আমাকে একাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। কুমিল্লা-২ আসনের তিতাস উপজেলাটি আগে দাউদকান্দি উপজেলার অংশ ছিল। দাউদকান্দি উপজেলায় গোমতী নদীর উত্তরে অবস্থিত ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি সরকারের সময় তিতাস নামে একটি নতুন উপজেলা প্রতিষ্ঠা করেছি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২০০৬ সালের ১৭ জানুয়ারি নবগঠিত তিতাস উপজেলার শুভ উদ্বোধন করেন। এ কারণে নতুন এ উপজেলার জনগণ দলমত নির্বিশেষে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, সমর্থক ও গুণগ্রাহী। নবম সংসদ নির্বাচনের আগে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে নবগঠিত তিতাস উপজেলাকে আমার নির্বাচনী এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে হোমনা আসনের সাথে সংযুক্ত করে দেয়া হয়। ফলে তিতাসের জনগণ আমাকে ভোট দেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। 

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে তিতাস উপজেলায় সর্বস্তরের মানুষ আমাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন প্রদান করে। বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এই আসনের হোমনা উপজেলা ‘বিএনপির ঘাঁটি’ হিসেবে সমধিক পরিচিত। ইতঃপূর্বে হোমনা আসনে ১৯৭৯ সাল থেকে শুরু করে বিএনপি যতবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে, ততবারই বিএনপির প্রার্থী বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন (প্রথমে মর্তুজা হোসেন মোল্লা ও পরবর্তীতে চারবার মরহুম এম কে আনোয়ার বিজয়ী হন)। এই ধারাবাহিকতায় একাদশ সংসদ নির্বাচনে হোমনা উপজেলার জনগণ আমাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন করেছে। নির্বাচনে আমার জনপ্রিয়তা দেখে ভীত হয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ভোটের আগের রাতে (২৯ ডিসেম্বর) প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় কুমিল্লা-২ আসনের উভয় উপজেলার ভোটকেন্দ্রগুলো চর দখলের মতো করে দখলে নিয়ে একতরফা নৌকায় সিল মেরে ভোটের অপমৃত্যু ঘটান।

কুমিল্লা-২ আসনের ঘোষিত ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, হোমনা উপজেলার ৫৪টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে মাত্র তিনটি কেন্দ্রের প্রাপ্ত ভোট ৭০ শতাংশের নিচে। বাকি ৫১টি কেন্দ্রে ৭০ শতাংশের ওপরে ভোট প্রাপ্তি দেখানো হয়েছে। ফলাফলে দেখা যায়, ৭১ থেকে ৮০ শতাংশ প্রাপ্ত ভোটের ১৭টি কেন্দ্রে ধানের শীষে ১৯০৮ ভোট, আর নৌকায় ৩১৪৭৪ ভোট। ৮১ থেকে ৯০ শতাংশ প্রাপ্ত ভোটের ২৭টি কেন্দ্রে ধানের শীষ ১৩২৯ আর নৌকা মার্কায় ৬২৪৯৯ ভোট। ৯১ থেকে ১০০ শতাংশ প্রাপ্ত ভোটের সাতটি কেন্দ্রে ধানের শীষকে ২৪৮ আর নৌকা মার্কায় ১৭৫৯৯ ভোট দেখানো হয়েছে। হোমনার ৫৪টি কেন্দ্রে ধানের শীষ প্রতীকে মোট ৪২১৮ ভোট এবং নৌকা মার্কায় মোট ১১৬৯৪৯ ভোট দেখানো হয়েছে। হোমনায় ভোটের নামে কী ধরনের অনৈতিক ও কদর্য কাণ্ড হয়েছে, তা এই পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে যে কেউ উপলব্ধি করতে পারবেন। একই ভাবে কুমিল্লা-২ আসনের তিতাস উপজেলার ঘোষিত ফলাফল থেকেও একই চিত্র পাওয়া যায়। এ উপজেলার ৪৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৭০ শতাংশের নিচে প্রাপ্ত ভোটের কেন্দ্র মাত্র ৩টি। বাকি ৪২টি কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির হিসাব ৭০ শতাংশের ওপরে। তিতাসের ৪৫টি কেন্দ্রে ধানের শীষের পক্ষে মোট ১৬২০৫ ভোট এবং নৌকার ৮৯৩৪৯ ভোট দেখানো হয়েছে। উল্লেখ্য আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী একজন বড় ব্যবসায়ীর স্ত্রী। তিনি হোমনা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কোনো পর্যায়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কখনো সম্পৃক্ত ছিলেন না। নির্বাচনে আগে হোমনার কেউ তার নাম পর্যন্ত জানত না। এ অবস্থায় ভোটের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে সহজেই বোঝা যায়, সারা দেশের মতো কুমিল্লা-২ আসনের হোমনা ও তিতাস উপজেলার জনগণ ভোট দিতে পারেনি। প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্র ২৯ ডিসেম্বর রাতে এবং ভোটের দিন সকালে দখল করে ব্যালটে নৌকায় সিল দিয়ে বাক্স ভর্তি করে রাখা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই আসনে ৯০ শতাংশ ভোটারকে ভোটে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয়নি। নৌকার প্রার্থী ও সমর্থকরা ধানের শীষের জোয়ার দেখে বুঝতে পেরেছিল, জনগণকে তাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ দিলে নৌকার নিশ্চিত ভরাডুবি হবে। তাই সরকারি দল প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ভোট ডাকাতির মতো ঘৃণ্য, অনৈতিক ও জঘন্য কাজটি করে বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতির এক কলঙ্কময় অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে।

কুমিল্লা-১ এবং ২ আসনের মতোই আগের রাতে ভোট ডাকাতির ঘটনা সমগ্র বাংলাদেশেই ঘটেছে। দেশ-বিদেশের সবার কাছে বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও এ অনৈতিক এবং নজিরবিহীন অপকর্মের নগ্নচিত্র ফলাওভাবে প্রচার করা হয়েছে। এ সত্ত্বেও সরকার প্রধান জোরগলায় বলেছেন, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েই তাকে প্রধানমন্ত্রী করেছে। এ ধরনের মন্তব্য ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত জনগণের সাথে তামাশা মাত্র। গায়ের জোরের সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে এক ভয়ঙ্কর চরিত্রে রূপ ধারণ করেছে। 

দেশে চলছে শাসক দলের নেতাকর্মী আর প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের লুটতরাজ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ক্যাসিনোবাজি, ঘুষ ও দুর্নীতি। নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া ও সামাজিক প্রচারমাধ্যমে প্রতিদিন এসব খবরের বড় শিরোনাম হচ্ছে। সরকারের অনৈতিক ও স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ডে লুণ্ঠিত হয়েছে শেয়ারবাজার, ব্যাংক ও সরকারি কোষাগার। দেশের অর্থনীতি আজ বিপর্যস্ত; আইন-বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত। পেঁয়াজসহ জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দলীয়করণের মাধ্যমে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারখানায় পরিণত করা হয়েছে। মেধাবী সোনার ছেলেরা কেউ দানবে পরিণত হচ্ছে এবং তাদের তাণ্ডবে অনেক সোনার ছেলে প্রাণ দিচ্ছে। দুঃশাসনে রাষ্ট্রের উচ্চ থেকে নিম্নপর্যায় পর্যন্ত পচন ধরেছে, বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। আর এসব কিছুই হচ্ছে দেশে গণতন্ত্রের অভাবে। 

তাই দেশ এবং জনগণকে রক্ষা করতে হলে দেশের সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই সত্যটি যতদ্রুত উপলব্ধি করা হবে, দেশের জন্য ততই মঙ্গল হবে।

  • লেখক : সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সদস্য, জাতীয় স্থায়ী কমিটি, বিএনপি এবং সাবেক অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  • কার্টসি — নয়াদিগন্ত/ নভেম্বর ২৪, ২০১৯ 

Monday, November 18, 2019

আইনের ‘সরকারি’ শাসন

ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা

মূল বক্তব্যে যাবার আগে ভীষণ আলোচিত চারটি ঘটনা একটু দেখে নেয়া যাক। গত ১০ বছরে এমন ঘটনার উদাহরণ অনেক দেয়া যাবে, তবে এই ঘটনাগুলো বেছে নেয়ার কারণ ঘটনাগুলো ঘটেছে সাম্প্রতিককালে। চারটি ঘটনার মধ্যেই খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং রাষ্ট্রের জন্য খুবই ভীতিকর মিল আছে; সেই মিলের জায়গাটি নিয়েই এই লেখা।

১. মানবতাবিরোধী অপরাধের ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজকে পেশাগত অসদাচরণ, শৃঙ্খলা-আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে তার পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও পাসপোর্ট অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মুহাম্মদ ওয়াহিদুল হকের বিরুদ্ধে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ মামলা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ। গত বছর এপ্রিলে অভিযোগ ওঠে, মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর ২০১৭ সালের নভেম্বরে ওয়াহিদুল হককে ফোন করে কথা বলেন তুরিন। পরে পরিচয় গোপন করে ঢাকার একটি হোটেলে তার সঙ্গে দেখাও করেন। তুরিনকে অপসারণের কারণ হিসেবে আইনমন্ত্রী স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন তুরিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ট্রাইব্যুনালেরই আরেকজন প্রসিকিউটর জনাব জিয়াদ আল মালুম বলেছেন তুরিনের অপরাধ একটি ফৌজদারি অপরাধ।

কিন্তু আমরা এখনো তার বিরুদ্ধে কোন ফৌজদারী ব্যবস্থার প্রাথমিক পদক্ষেপ দেখতে পাইনি, তার বিরুদ্ধে শাস্তি অপসারণেই শেষ হয়েছে।

২. তথাকথিত শুদ্ধি অভিযানের মধ্যে বিশেষ নিরীক্ষায় ধরা খেয়ে ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল কয়েক দফায় আত্মসাৎকৃত ৭৪ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছেন। ইসলামিক ফাউণ্ডেশনে (ইফা) গত ১০ বছরে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা নয়-ছয় করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের সরাসরি ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ৬৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩৭ টাকা এবং বিধিবহির্ভূতভাবে খরচ করা হয়েছে ৫১৮ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার ৭৯৮ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির ১৩৪ খাতে এসব অনিয়ম করা হয়েছে। সিভিল অডিট অধিদফতরের বিশেষ নিরীক্ষা দলের ২০০৯-২০১৮ অর্থবছরের প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

ইনি তুরিন আফরোজ এর চাইতে অনেক বেশি ভাগ্যবান, দুর্নীতির প্রমাণ থাকলেও এখনো তিনি স্বপদে বহাল আছেন, কোনো ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়া দূরেই থাকুক।

৩. কুখ্যাত পুলিশ কর্মকর্তা এস পি হারুন কী করেছে তার চমৎকার দলিল হয়ে থাকবে মানবজমিনের দু’টি রিপোর্ট। তার গাজীপুর এবং নারায়ণগঞ্জ অধ্যায়ের উপরে করা সেই অনুসন্ধানী রিপোর্ট দু’টো আমাদেরকে হতবাক করে দেয়। একটা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দায়িত্বে থেকে রাষ্ট্রীয় ইউনিফর্মের বীভৎস অপব্যবহার করে একজন মানুষ কি করে সাধারণ জনগণকে, ব্যবসায়ীদেরকে নির্যাতন এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে কোটি কোটি নগদ টাকা এবং জমি হাতিয়ে নিয়েছেন।

সম্প্রতি চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় এক বিখ্যাত ব্যবসায়ীর স্ত্রী-সন্তানকে ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে যান নারায়ণগঞ্জে। তার এই অপরাধের জন্য সরকার তাকে শাস্তিমূলক ভাবে ঢাকায় পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে বদলি করে। এই ঘটনার কারণে হারুনকে বদলি করা হয়েছে তার প্রমাণ আছে হারুনের বিদায় দিনের বক্তব্য। ফেইসবুক এর ভাইরাল হওয়া বক্তব্যে দেখা যায় কাঁদতে কাঁদতে হারুন ওই ঘটনাকে ইঙ্গিত করে বলছেন, তাকে চক্রান্ত করে নারায়গঞ্জ থেকে সরানো হয়েছে।  বলা বাহুল্য, হারুনের শাস্তিও বদলিতেই শেষ হয়েছে। তিনি নিয়মিত রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন ভাতাও পাচ্ছেন।

৪. এর কিছুদিন আগে ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক অপসারিত হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকান্ডে বরাদ্দকৃত দেড় হাজার কোটি টাকা থেকে ৮৬ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়টাকে মাথায় রেখেই নজিরবিহীনভাবে তাদেরকে পদ থেকে সরিয়ে দেন। শোভন-রাব্বানী যে চাঁদা চেয়েছিলেন এটারও প্রমাণ আছে। একটি জাতীয় পত্রিকার কাছে তারা বলেছিলেন এই উন্নয়ন কর্মকা-ের ‘ন্যায্য’ হিস্যা তারা চেয়েছিলেন। আত্মস্বীকৃত এই অপরাধীদের শুধু অপসারণেই সবকিছু শেষ হয়েছে, কোন ফৌজদারি ব্যবস্থা আমরা তাদের বিরুদ্ধে দেখিনি।

হ্যাঁ, এই ঘটনাগুলোর মধ্যকার মিলটি হলো ভয়ঙ্কর ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হয়েও সরকারের আস্থাভাজন ব্যক্তিরা কেউ দায়িত্ব থেকে অব্যহতি পান, কেউ শাস্তিমূলক বদলি হন এমনকি কেউ নিজ পদে থেকে যান বহাল তবিয়তে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যধারা মতাবেক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। ফৌজদারি কার্যবিধিতে স্পষ্ট বলা আছে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে থানায় ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট (এফআইআর) দায়ের করতে হবে। এফআইআর দায়েরের সাথে যেহেতু গ্রেফতারের বিষয়টি জড়িত তাই অভিযুক্তকে জামিন নিতে হয়। এফআইআর পর পুলিশ তদন্ত করে হয় তাদের নামে চার্জশিট দাখিল করে অথবা তারা চার্জশিট থেকে অব্যহতি পায়। অথচ ওপরে আলচিত এই সকল ক্ষেত্রে দেখা গেছে তাদের বিরুদ্ধে সব ভয়ঙ্কর অভিযোগ ওঠা, ভিডিও ফুটেজ বা অডিও ক্লিপ থাকা সত্ত্বেও আইনের স্বাভাবিক পথে না গিয়ে বারবার বলা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত চলছে। এই ধরণের আচরণ অপরাধীকে শুধু স্বস্তিতেই রাখে না, বরং নতুন নতুন অপরাধী তৈরিতে সাহায্য করে। দেশে আইনও আছে, শাসনও আছে, নেই কেবল আইনের শাসন। আইনের শাসনের জন্য বিচার দৃশ্যমান হওয়া অত্যন্ত জরুরি। যে দেশে আইনের প্রয়োগ, গতি, ফলাফল ব্যক্তির পরিচয়ভেদে ভিন্ন ভিন্ন সে দেশে আর যাই হোক ন্যায়বিচার, সুশাসন বা আইনের শাসন কিছু ক্লিশেই শব্দের বাইরে ভিন্ন কোনো অর্থ বহন করে না।
  • কার্টসি— মানবজমিন /১৮ নভেম্বর ২০১৯

Sunday, November 17, 2019

People’s Bhashani, Bhashani’s people

Maulana Bhashani in Afro-Asian cooperation movement held in Havana, Cuba, 1965.











November 17 marks the death anniversary of Maulana Abdul Hamid Khan Bhashani. Azfar Hussain pays tribute to a revolutionary who remains an inspiration in the struggle against all form and forces of oppression and exploitation.

What have I to fear? I would welcome being hanged for my people.

— Maulana Bhashani


Every social group, coming into existence on the original terrain of an essential function in the world of economic production, creates together with itself, organically, one or more strata of intellectuals which give it homogeneity and an awareness of its own function not only in the economic but also in the social and political fields.

— Antonio Gramsci, Prison Notebooks


The party should be the direct expression of the masses. The party is not an administration responsible for transmitting government orders; it is the energetic spokesman and the incorruptible defender of the masses.

— Frantz Fanon, The Wretched of the Earth

I
HE COULD chew his betel-leaf with relish, reddening his lips; and he could go on and on talking about the history of the Indian subcontinent, attesting to a sure grasp of all the dates and details; and he could keep driving away flies with his soiled gamchha, while seated in his rural courtyard; and he could keep looking at the river Brahmaputra-the river he had known so well-all at once. And he could even sing some Tagore tunes right after saying his fazar prayers. And in his speeches and his dialogues, he could rub his words together in such a way that they could catch fire. And, indeed, he could talk-with equal ease-to those hard-nosed pragmatists and dewy-eyed dreamers and wild-haired leftists he encountered, among numerous other folks.

And he himself actively exemplified what Frantz Fanon-the Caribbean theorist-activist of anti-colonial national liberation movements-asserts in favour of the wretched of the earth: ‘Everything can be explained to the people, on the single condition that you really want them to understand.‘

And he was with the people, always.

And thus he was with fisherfolk and rickshaw-wallas and jute-producers and sugar-producers and industrial workers and farm labourers and poor peasants and the urban poor and shopkeepers and primary-school teachers and other segments of the ‘wretched of the earth.‘ And he could attract all of them, while even mobilising them in many instances. And about him Shamsur Rahman has a poem, one that speaks not only of his spotless white punjabi-his favourite dress along with his lungi and his tupi-but also of the ways in which his speeches could attract artists and poets and journalists and shopkeepers and workers and students and intellectuals and social workers and cameramen and office clerks and even intelligence agents, to use the poet‘s own catalogue provided in the poem. Indeed, the poem in question offers us a superb combination-rather a constellation-of images to describe him: his healing appearance resembling that of the post-deluge Noah; his face mirroring the depth of his concern and his commitment; his catkin beard fluttering in the north wind; and finally his struggle-driven and expressive hands flashing out repeatedly like quivering spears.

And his spears or hands smelled of his own land and his own labour. And he characteristically accentuated the need for rootednesss-one‘s integral rootedness in one‘s own land-going to the extent of even asserting that to know is to be rooted; that to be rooted is to know. And, as he indicated and even exemplified, knowledge, after all, is love made visible. And, for him, knowledge itself is political as well: what you know and what you do not know are never politically innocent, never ideologically neutral.

And one event-among numerous others-underlines his premium decisively placed on the political and ideological question of rootedness itself. It was early 1955. He visited London. There a Bengali student came to meet him. Accessible and approachable as he was, he himself eagerly moved forward to have a conversation with the student. But at one point he asked the student, ‘So do you know what the prices of rice and daal are in your country now?‘ The student probably did not expect such a question. Indeed, the question itself immediately tells us where he was coming from.

And the student stammered out only an incomplete answer: while he knew the approximate price of rice, he could not tell the price of daal. And the one who threw the question did not hesitate to point out to the student right away that the knowledge of the West minus that of one‘s own land and people might turn out to be not-all-that-useful in the final instance. In short, in his conversation, he called attention to the issue of rootedness-something that comes from, among other things, an intimate knowledge of one‘s own land, own people, own culture, and own language. And his own knowledge of his land and people and culture and language was simply phenomenal.

But who is he?

He is our Bhashani-Maulana Abdul Hamid Khan Bhashani-one who is popularly known as the Mozloom Jananeta (the leader of the oppressed). Because of his certain Maoist accents falling on the peasant question as an urgent and even revolutionary one for a meaningful social transformation, he is also known as the Red Maulana. And without question Bhashani was a popular political leader, one who led not only a long life but also an inordinately eventful, chequered, and at least occasionally dramatic, yet unmistakably simple, life-a life that of course continues to serve as a paradigmatic illustration of how commitment, conviction, and courage came to be organically orchestrated, or how knowledge and action came to be dialectically united, in the very service of the people‘s struggle for justice, freedom, and a revolutionary social transformation.


II
ALTHOUGH one cannot accurately ascertain the date of his birth, according to at least a couple of his biographers, Maulana Bhashani was born on December 12 in 1885 in a village called Dhangara in the present-day district of Sirajganj. He was born in a relatively poor peasant family. In fact, his father Haji Sharafat Ali Khan was a small rural shop-keeper. He died at the age of only thirty-six or thirty-seven in 1889, when Bhashani-then nicknamed Chyaga Mia-was about four or five. Then, a vicious epidemic in 1894 caused the unfortunate deaths of his mother Maziran Bibi, his grandmother, his two brothers, and his sister. In other words, Chyaga Mia did not become merely an orphan but also lost almost everyone when he was roughly ten.

Thus, at a very early age, he came to know closely what deaths-and disasters and famines that he experienced directly-could do and undo. Thus, struggle for him always became nothing short of a life-and-death question, indeed characterising his entire life-personal and political. But he lived. And he lived long. He died at the age of about ninety-one on November 17, 1976 in Bangladesh. But when he lived, he lived fully, while living always in the thick of his people‘s struggle.

And, of course, when he was a child, he always struggled against death. As a child, sometimes he worked as a porter, carrying people‘s luggage and other loads weighing probably heavier than the child himself; and sometimes he worked as a paddy-cutting labourer in the field; and sometimes he assisted fishermen in the river; while sometimes he worked for some market-shops. For him, every moment was a moment of simply resisting the dissolution of the borders between life and death. Physical survival itself was literally the toughest and even only challenge to Chyaga-the-child-labourer. And, of course, he knew what it meant to be hungry and homeless under indifferent, sometimes even hostile, skies.

And it is not for nothing that Chyaga Mia remained throughout his life firmly committed to the cause of poor, hungry, homeless, and rootless children, while always saying no to a system ‘that neither feeds its children nor loves them,‘ to borrow Eduardo Galeano‘s words from another context.

I should provide a quick parenthetical note here: Chyaga Mia only later came to be known as Bhashani, because of his deep, intimate link to a place called Bhashanchar in Assam, a place where he lived and organised poor peasants and earned tremendous popularity, in addition to performing many other tasks. This is reminiscent of how the Argentine Ernesto Guevara came to be called, lovingly indeed, just ‘Che‘ in Cuba, which, of course, was not his place of birth.

But all odds and obstacles notwithstanding-or despite the threats of hunger and even death-Bhashani somehow managed to have his elementary education at a small madrassah in Sirajganj; while, later in 1907, Pir Nasiruddin Baghdadi, a local saint, sent Bhashani to Deoband in North India for further Islamic studies. There he stayed till 1909, and met a number of prominent alems-Islamic scholars-particularly including Muhammad Qasim Nanatoyi and Maulana Mahmudul Hassan.

And those scholars all variously contributed to an anti-imperial ideological formation of Bhashani at a time when British colonial rule had not only reached a particular point of intensity and impact but also invited remarkable indigenous oppositions and resistances, some of which one already witnessed in the famous Sepoy Uprising of 1857. Of course, later, the division of Bengal in 1905 began to elicit and even provoke all sorts of responses and reactions from both Hindus and Muslims in India-reactions and responses that Bhashani not only experienced first-hand, but they also shaped, inflected, informed and even inspired his anti-colonial stance at a relatively early stage.

But it was the year 1917-that crucial, exciting, and even globally heady year of the Russian Revolution-that fully inaugurated Bhashani‘s political life in India at a historical conjuncture when he came into contact with none other than Deshbandhu Chitta Ranjan Das himself (1870-1925), the most oppositional and uncompromising anti-colonial figure of his time in India, one whose charged political speech delivered in Mymensingh exercised a profound impact on the young Bhashani.

And, also, it was in the year 1917 that Bhashani became a member of the Indian National Congress. Then, in 1923, he enthusiastically joined the Swarajya Dal of Deshbandhu Chitta Ranjan Das who might be reckoned as one of the major ideological mentors of Maulana Bhashani. But, given Bhashani‘s characteristic rootedness in the struggle of indigenous peasants, he primarily worked with them, while his immediate radicalism was exemplified in the ways in which he got to the root causes of their problems-imperialism and its by-product, the Zamindari system-against which Bhashani was always vocal and active. Thus, because of his fiercely antagonistic confrontation with the Moharaja of Santosh, Bhashani was expelled from Mymensingh on the ground that he allegedly disturbed peace and order in the area in question. In fact, in 1926, Bhashani was declared persona non grata in his own land, Bengal.

Indeed, it would be no exaggeration to maintain that Bhashani is one of the most outstanding and committed peasant leaders the Indian subcontinent has hitherto produced. For instance, he organised the largest peasant rally ever held in Bengal during British colonial rule. The rally was organised at Kawa Maidan in the district of Sirajganj in December, 1931. And the peasant rally decisively targeted the Zamindari system-a system predicated on a political-economic and even an ideological transaction and exchange between feudalism and imperialism-while advocating the need for its total abolition. And, then, moving on to Assam, Bhashani engineered a famous peasant movement to amend the Line System so as to allow Bengali peasants to settle in the area. But, as usual, Bhashani was fiercely threatened; he even faced official punishment, including frequent imprisonments. But prison could never silence Bhashani‘s voice and stop his action, but rather animated and energised him. And it was in 1937 that Mohammad Ali Jinnah invited him to join the Muslim League. In the same year Bhashani was elected a member of the Assam Provincial Constituent Assembly.

It is true that Bhashani fought with zeal and gusto for the establishment of Pakistan in the 1940s, but his vision of Pakistan-which was fundamentally tied to a total emancipation of the peasantry and the working class in Bengal and Assam at least-was of course different from those of many of his middle-class contemporaries and counterparts, who also variously fought against British colonialism. Indeed, it was Bhashani‘s deeply orchestrated class politics-an issue I will take up later for further discussion-that distinguished him from most of his seniors and contemporaries including Mohanlal Karamchand Gandhi, certainly Mohammad Ali Jinnah, Maulana Abul Kalam Azad, and even AK Fazlul Haq, for instance.

To say the least, most of those political leaders and activists were, in the final instance, alienated from the masses-from the peasantry, for example. As some subaltern historiographers have already pointed out, Gandhi could never sustain his interest in the cause of the peasantry, while Jinnah-of course, stubbornly elitist and even West-bound as he was-was light-years away from the peasantry. Indeed, both of them ended up representing the interests of the national ruling classes. Even AK Fazlul Haq, who went to the extent of naming his own party ‘Krishaak-Praja Party’ and who later led ‘Krishaak-Sramik Party,’ and who, thus, zeroed in on the interests and issues of the peasants and working-class, finally gravitated towards the bourgeois politics of electoral votes, at least marginalising, and even dropping in some instances, the agendas of the peasantry and the working class.

But Maulana Bhashani was organically tied to the struggle of those classes, never moving even an inch away from them. Thus, borrowing from the Italian Marxist-Leninist activist Antonio Gramsci, I feel inclined to call Bhashani an organically grown revolutionary, whose politics, practices, and discourses were all rooted in the four material sites of anti-imperial and anti-feudal struggles-the land, labour, language, and body of peasants and workers.

And in the very class interest of peasants and workers themselves, Maulana Bhashani played his role in a number of significant ways from 1947 to 1976. Given his long and exceedingly eventful life, it is impossible here to provide an account of the entire range of his political activities and moves. In other words, I can only be selective here, merely scratching certain events that I find simultaneously crucial, illustrative, and even symptomatic. For instance, he was elected a member of the East Pakistan Legislative Assembly from Tangail in 1947. But fiercely uncompromising as he was, he resigned from the assembly after a few months in 1948. Then Bhashani moved on to found the East Pakistan Awami Muslim League in June 1949, becoming its first president. At this point Bhashani unmistakably foregrounded the agendas of the peasantry and the working class at the centre of his political and activist preoccupations and pursuits.

And, indeed, no less significant was the role of Bhashani in the historic Language Movement of 1952-one that can be reckoned as a historically formed marker of what one might call an emancipatory consciousness of the right-to-self-determination and a marker of a consciousness of national liberation itself. It is true that some critics of Bhashani have diminished the importance of his role in this movement. But history is stubborn. One then should not forget that it was none but Maulana Bhashani himself who for the first time spoke in Bengali at the Assam Management Committee meeting back in 1937, thereby establishing one’s right to speak in one’s language at that gathering. In any event, Bhashani formed ‘All Party Language Movement Committee’ in 1952. Later in the same year, he was arrested, and suffered a year-long imprisonment.

Indeed, Bhashani moved from party to party. He was in the Muslim League; then, he founded the Awami Muslim League; and then he turned it into the Awami League; and then he left it to found the National Awami Party, yet leaving it later. Such trajectories might give one the impression that he was restless and indecisive. But more important than his restlessness or indecisiveness-as Serajul Islam Choudhury has rightly pointed out-was his uncompromising stance. Choudhury maintains, ‘the issue at stake here is

this: he himself advanced in his political march while the parties in question could not keep pace with him,’ because those parties in question almost characteristically remained invested in the bourgeois politics of electoral votes and individual power-ascendancy, staying far away from the actual, material sites of the people’s struggles-the struggles, again, of the peasantry and the working class.

But Bhashani’s class politics was dialectically tied to the question of national liberation. Indeed, back in 1968, Bhashani led a mass upsurge against the Ayub regime, as a result of which Ayub Khan was compelled to hand over power to Yahya Khan. But, then, Bhashani stood up against Yahya Khan himself. Bhashani’s role in 1969 was simply remarkable. Even when Sheikh Mujibur Rahman-to use, rather relatively mildly, the historian-theorist-activist Badruddin Umar’s otherwise-well-researched version-had resorted to some kind of strategic silence, Bhashani was out and out vocal against the military tyranny and internal colonialism imposed by the Pakistani ruling class. In fact, one can go further back in history to see Bhashani’s own uncompromising concern with regional autonomy as such, one that was expressed in the famous Kagmari conference of 1957-a conference that took place precisely because Bhashani was openly critical of the Awami League activists gravitating towards the politics of gaining personal power, while abandoning the party’s principle demands. It was at this conference that Bhashani foregrounded the demand for regional autonomy of East Bengal with full force. A historic move indeed! And it was a move in which the seeds of the National Liberation Movement of Bangladesh were sown. But where was Suhrawardy of the Awami League back in 1957? He even went to the extent of saying that the issue of Bengali self-determination had been solved 95 per cent. Solved? 95 per cent? Yes, that was Suhrawardy-Sheikh Mujib’s initial ideological mentor. But Bhashani made a prophetic pronouncement, saying something to this effect: if the province of the then East Pakistan was not granted full regional autonomy, the people of that province would ultimately embark on their own course of action and say ‘Assalamu Alaikum’ (good-bye) to Pakistan. Even the bourgeois Time magazine, while doing a report on Maulana Bhashani and thus calling him ‘a prophet of violence,’ could not hide the fact that Bhashani was courageous enough to have said: ‘what have I to fear?… I would welcome being hanged for my own people.’ Although somewhat orientalist in style and character, part of this report is worth quoting: ‘As much as any one man, Bhashani inspired the riots that last month forced President Ayub Khan to step down from the presidency. Now Bhashani is the most severe single threat to a fragile peace brought to the troubled and geographically divided land by the imposition of martial law. Under fear of harsh penalties, Pakistan’s other politicians, including Bhashani’s chief Bengali rival, moderate Sheikh Mujibur Rahman, have kept silent. Not Bhashani, who continues to receive newsmen and followers at his bamboo-walled hut.’

Certainly, in terms of courage and conviction and principles, and in terms of emancipatory politics and praxis, Bhashani stood apart from the run-of-the-mill Awami League activists that included even H.S. Suhrawardy and Sheikh Mujibur Rahman. Indeed, Bhashani worked for the independence movement of Bangladesh with utmost dedication from December 1970; while during the war of liberation in 1971, Bhashani actively played his role as chair of the ‘All Party Consultative Committee’ of the Bangladesh Government in exile.

As Bangladesh emerged as a distinctive nation-state-achieving geographical-territorial independence-Bhashani did not cease to act at all, while he came to realise soon that power was just transferred from one ruling-class to another, reproducing an almost similar political culture that I would like to characterise by such interconnected trends and tendencies as: (1) the individualisation and bureaucratisation of politics, and the politicisation of the bureaucracy and that of what might be called ‘the-individual-for-itself’; (2) the politicisation of the military and the militarisation of politics; (3) the ‘communalisation’ of politics and the politicisation of religion; (4) the criminalisation of politics and the politicisation of criminals; and 3) the consequent alienation of the plundering national ruling classes from the class politics of the peasantry and the working class.

But Maulana Bhashani never in his life sought personal power, never cared to hold a position in the mainstream establishment, while remaining consistently oppositional in his politics and organically rooted in the struggle of the masses themselves. One can see this Bhashani very clearly from 1971 to 1976. And, in 1976, Maulana Bhashani, when he was even 91, led the famous anti-Farakka long march towards the Bangladesh-India borders. Again, that was a paradigmatic illustration of an oppositional activist’s unflagging youthfulness mobilised in the service of the masses.


III
WHAT, then, is the significance of Maulana Bhashani today? I raise this question at a time when capitalism, imperialism, fundamentalism, and militarism have all been profoundly interconnected on a global level against the wretched of the earth, while in Bangladesh we keep witnessing a heavily crisis-ridden political culture characterised by the trends that I have identified above by way of dwelling on Bhashani’s own work. Now, in the light of our foregoing accounts, I intend to advance a few categorical propositions in an attempt to underline Maulana Bhashani’s political-cultural-ideological significance today.

First, Maulana Bhashani was an organic revolutionary remaining integrally rooted in the struggle of the masses-particularly the peasantry. Given his emphasis on mass-line organising as well as on the peasantry as the agent of change in history, some have detected at least traces of Maoist proclivities in Bhashani. And I feel tempted to place Bhashani in the tradition of such Third World revolutionaries as the Vietnamese freedom-fighter Ho Chi Minh, the African revolutionary Amilcar Cabral, and-to an extent-another African revolutionary, Kwame Nkrumah. Like them, Bhashani could see-theoretically and practically-a profound link between the emancipation of the peasantry in a third-world country and national liberation itself, while remaining aware of how the fruits of national liberation always run the risk of being appropriated or reaped by the opportunist middle class (something that Frantz Fanon theoretically anticipated in his The Wretched of the Earth). In other words, true national liberation for Bhashani came to mean a liberation of the masses by way of forging a site in which the class struggle might interact and even intersect with the national liberation struggle itself, something that we are yet to see in Bangladesh.

Second, obviously, Maulana Bhashani’s politics was consistently anti-imperial and anti-feudal. For him, national liberation itself cannot but involve struggles against both imperialism and the national ruling classes, operative as they are in differentially determined class-cahoots. Thus Bhashani-to provide just one instance-was fiercely opposed to British imperialism and the Zamindari system all at once, while, in another context, he was critical of Pakistan’s internal colonialism and the pro-US stances of the Awami League prior to the emergence of Bangladesh.

Third, Maulana Bhashani was of course not a Marxist in the traditional sense of the term. But as a socialist, Bhashani certainly longed for an exploitation-free system and society that are impossible under capitalism, for instance. And, as a socialist, he exemplarily internalised the values and messages of socialism such that he was able to turn them into active, material, and national-popular forces, without falling into the trap of a theory-fetishising intellectualism. It is probably here where Bhashani-almost à la Antonio Gramsci (true, Bhashani never read Gramsci, nor did he need to read him, given Bhashani’s own solid life-based understanding, insights, and farsightedness)-came to realise that culture is political and that politics is cultural. It is not for nothing that the Bhashani-convened Kagmari Council Session of the Awami League was followed by a three-day cultural conference which probably was the largest cultural gathering ever held in East Bengal. A commentator on Bhashani rightly puts it, ‘Bhashani personally appealed to the Conference to ensure that folk art be preserved.’ Syed Abul Maksud, a noted biographer of Bhashani, quotes him thus: ‘the onslaught of polished urban art should not lead to the demise of traditional village folk-art.’ Also, no less significantly for Bhashani, the cultural aspect of politics resided in the ways in which he could not only use and energise a language immediately accessible to the masses but could also turn that language into a vehicle of what he himself and the people called praner dabi.

Finally, Bhashani continues to remain our inspiration for our struggle against all forms and forces of domination and oppression. He died in 1976, but he is not dead. He remains alive in the hearts of millions struggling for emancipation and for a world free from exploitation.

Dr Azfar Hussain teaches in the Integrative, Religious, and Intercultural Studies Department at Grand Valley State University, Michigan, and is vice-president of the Global Centre for Advanced Studies, New York, USA. The article was originally published in the Slate weekend magazine of New Age in its early years.

  • Courtesy  - NewAge / Nov 17, 2019 

সংবাদ ঠিক করে দেয় গোয়েন্দা সংস্থা: শওকত মাহমুদ

সাক্ষাৎকার


শওকত মাহমুদ৷ সিনিয়র সাংবাদিক ও ইকোনিক টাইমস-এর সম্পাদক৷ জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি৷ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের প্রধানও ছিলেন তিনি৷ একই সঙ্গে তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা৷ ডয়চে ভেলের সাথে তিনি বাংলাদেশের সমসাময়িক সাংবাদিকতা ও সংবাদমাধ্যম নিয়ে কথা বলেছেন৷

ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশের সাংবাদিকরা এবং সংবাদমাধ্যম এখন কতটা স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে পারছে?


শওকত মাহমুদ: আমরা ১০-১১ বছর ধরে মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছি৷ কারণ এক এগারোর সময় মিডিয়ার যেভাবে টুঁটি চেপে ধরা হয়েছিল তারপর নির্বাচিত সরকার এসে আরো বেশি করে সংবাদমাধ্যম, সংবাদপত্রে স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে৷ এর মধ্যে অনেক সাংবাদিক কারাগারে গেছেন৷ একইসঙ্গে আমরা কিছু কালো আইন দেখেছি৷ ডিজিটাল আইন, তার আগে আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যথেচ্ছভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে৷ এসব কারণে এখন সাংবাদিকরা সেল্ফ সেন্সরশিপের মধ্যে রয়েছে৷ অনেক ভৌতিক বাধা আছে৷ বলবো না যে আগের মত তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রেস অ্যাডভাইস আসে৷ এখন কতগুলো গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ফোন আসে এটা দেয়া যাবে না, ওটা দেয়া যাবে না৷ সাংবাদিকেরা চাকরি হারিয়েছে৷ শাসক দল এমনকি সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সংবাদমাধ্যম, সাংবাদিকদের ব্যাপারে কটু মন্তব্য করা হয়৷ আমার মনে হয় সাংবাদিকেরা এখন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে আছেন৷

ডয়চে ভেলে: এই পরিস্থিতির জন্য আপনি প্রধানত কাদের দায়ী করবেন?

শওকত মাহমুদ


শওকত মাহমুদ: এই পরিস্থিতির জন্য আমি মূলত শাসক দলকে দায়ী করব৷ একইসঙ্গে আমি আমলাতন্ত্রের কথাও বলব৷ বিচার বিভাগের ক্ষেত্রেও একধরণের আতঙ্ক আছে৷ আদালত অবমাননার জন্য দাঁড় করানো হয়েছে৷ প্রশাসনিক বাধাও আছে৷ সামাজিকভাবে সাংবাদিকরা আতঙ্কে আছেন৷ খবর সংগ্রহ করতে গেলেও তাদের ওপর হামলা হয়৷ আসলে সরকার যদি বাধা না দেয় তাহলে সাংবাদিকদের আর কোনো পক্ষই বাধা দেয়ার চিন্তা করতে পারেনা৷

ডয়চে ভেলে: অধিকার আদায়ে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য অতীতের মত সাংবাদিকরা এখন কেন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছেনা?


শওকত মাহমুদ: এখন যারা বিরোধী দল সমর্থিত সাংবাদিক তারা আন্দোলন করছেন৷ আর যারা সরকার সমর্থক সাংবাদিক রয়েছেন তারা এই ধরনের আন্দোলনকে উৎসাহিত করেন না অংশও নেন না৷ আমরা সাগর-রুনি হত্যার বিচারের দাবীতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম৷ পরে তারা আলাদা হয়ে গেল৷ সরকার কতগুলো ক্ষেত্রে ঘুসের মত দেয়৷ যেমন যেদিন পার্লামেন্টে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট পাশ হয়, সেদিন সরকার সমর্থক দু'শতাধিক সাংবাদিককে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে ২০ কোটি টাকা অনুদানের ঘোষণা দেয়া হয়৷ আর ট্রেড ইউনিয়ন আইনের পরিবর্তনের কারণে এখন সাংবাদিকদের চেয়ে মালিকেরা শক্তিশালী ৷ যেসব সাংবাদিক সরকার বা বিরোধী কোনো পক্ষেই নেই তারাও পরিস্থিতির কারণে চুপ আছেন৷ মাঠে নামছেন না৷

ডয়চে ভেলে: তাহলে সাংবাদিকতার ভবিষ্যতকে আপনি কিভাবে দেখেন বাংলাদেশে?


শওকত মাহমুদ: বাংলাদেশে সাংবাদিকেরা এখন প্রান্তিক মানুষে পরিণত হয়েছেন৷ শুধুমাত্র মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে নয়, এখন শত শত সাংবাদিক ছাটাই হচেছ, চাকরি হারাচ্ছে৷ এর কোনো প্রতিকার নেই৷ কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা বলে সংবাদমাধ্যম শুরু করেন, কিন্তু বাস্তবে তারা কিছুদিন পরেই আর্থিক দুরবস্থা, বিজ্ঞাপন না থাকার অজুহাত দেখিয়ে সাংবাকিদের ছাটাই করেন৷ এসব দেখার কেউ নেই৷

ডয়চে ভেলে: সাংবাদিকেরা এখন নীতি নির্ধারণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভূমিকা কেন রাখতে পারছেন না?


শওকত মাহমুদ: যার নীতি নির্ধারক তাদের মধ্যে যদি লজ্জা বোধ না থাকে তাহলেতো তারা সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনকে গুরুত্ব দেবেন না৷ তারা যদি মনে করেন কোনো অনিয়ম. দুর্নীতি প্রকাশ হলে কিছু এসে যায় না তাহলে তারা সংবাদমাধ্যমকে কেন গুরুত্ব দেবেন? এই সরকার সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় হওয়া কিছু বিষয় যা পরে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে সে ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছে৷ কিন্তু অধিকাংশ খবরকে আমলে নেয় না৷ বলে, সম্পাদক তার স্বার্থে এটা করেছেন৷

ডয়চে ভেলে: আপনি বলছিলেন সরকার সমর্থক সাংবাদিক, বিরোধী দল সমর্থক সাংবাদিক৷ সাংবাদিকদের এই দলীয় বিভাজন ঠিক কি না?


শওকত মাহমুদ: পৃথিবীর উন্নত দেশেও রাজনৈতিক কারণে সাংবাদিকদের বিভাজন নয়, পৃথক চিন্তা, স্বাতন্ত্র্য থাকে৷ সেখানেও নানা দলের সমর্থক সাংবাদিকরা আছেন৷ কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সত্য প্রকাশ যাতে কোনোভাবে প্রভাবিত না হয় সেটা সবার চেষ্টা কর উচিত৷ বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমে বিরোধী দলের যত সমালোচনা করা হয়, সরকারের সমালোচনা তেমন হয় না৷ এখন সরকার সমর্থক সাংবাদিকেরা এখন বেশি চাকরিতে আছে৷ আর দক্ষতা আর যোগ্যতা থাকার পরও বিরোধী দল সমর্থক সাংবাদিকদের চাকরি দেয়া হয় না৷

ডয়চে ভেলে: সাংবাদিকদের এই সরকার সমর্থক বা বিরোধীদল সমর্থক হওয়ার পিছনে কি শুধু আদর্শিক কারণ না অন্য কোনো কারণ বা স্বার্থ আছে?


শওকত মাহমুদ: প্রথমত, সরকার সমর্থক হলে সাংবাদিকতার চাকরির ক্ষেত্রে সুবিধা হয়৷ দ্বিতীয়, সরকার সমর্থক হলে অনেক সামাজিক সুবিধা পাওয়া যায়৷ যেমন সাংবাদিকেরা জায়গা পেয়েছেন, জমি পেয়েছেন অনেক৷ বিদেশ ভ্রমণ সরকাারি টেলিভিশনের সদস্য হলে অনেক সহজ হয়ে যায়৷ আরো অনেক সুবিধা আছে৷

ডয়চে ভেলে: তারপরও ভবিষ্যতে কেমন সাংবাদিকতার স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশে?


শওকত মাহমুদ: দেশে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে এলে সাংবাদিকতা ফোর্থ স্টেট বা ওয়াচ ডগের কাজটি করতে পারবে৷ তবে এরজন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে৷ লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে কেন সাংবাদিকতা করব৷ সেটা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, নিজের জন্য না দলের জন্য?

  • কার্টসিঃ  ডয়চে ভেলে/ নভেম্বর ৮, ২০১৯ 

Thursday, November 14, 2019

দাবির মুখে টাকার অবমূল্যায়ন করা হবে একটা ভুল কাজ

আবু আহমেদ

আমাদের মুদ্রা টাকা মার্কিন ডলারের বিপরীতে মূল্য হারাচ্ছে, তবে ধীরে ধীরে। এই মূল্য হারানো আমাদের মতো দেশের কাছে শঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। শঙ্কা হলো, সামনের দিনগুলোয় টাকা-ডলার বিনিময়ের ক্ষেত্রে আরো বিপক্ষে চলে যায় কিনা। গত তিন মাসে আমাদের রফতানির প্রবৃদ্ধি কমে গেছে।

এটা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। আগামী তিন মাস দেখার বিষয়। বিশ্বে এখনো কিন্তু অনেক অর্থনীতি আছে, যেগুলোর রফতানি বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত আছে। এতদিন আমাদের অর্থনীতির মজবুত ভিত গড়তে অব্যাহত রফতানি প্রবৃদ্ধি সহায়কের ভূমিকা রেখেছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কয়েক বছর ধরেই ৩২-৩৩ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে আছে। এটাও সম্ভব হয়েছে আমাদের অব্যাহত বর্ধিত রফতানির কারণে। অন্য মুখ্য কারণ হলো, ৮০ লাখ বাংলাদেশী বিদেশে আছে, তাদের বর্ধিত রেমিট্যান্স প্রেরণ। না হলে আমাদের কে সাহায্য করবে? আন্তর্জাতিক ঋণ বিক্রেতারা আমাদের অতটা ঋণ কেনার জন্য অফার করত না, যদি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতির অবস্থা নড়বড়ে থাকত। তারা এখন দেখছে বাংলাদেশ পরিশোধ করতে পারে। সুতরাং বাংলাদেশের কাছে ঋণ বিক্রয় করো। ঋণ কিনে কোনো অর্থনীতি উপরে উঠতে পারেনি। অর্থনীতি উপরে ওঠে নিজেদের আয়-রোজগারে। 
আবু আহমেদ

সবচেয়ে বড় কথা হলো, দেশের মানুষ যদি মনে করে তাদের দেশ উন্নতি করবে, তাহলে উন্নতি করবে। একটা আশাবাদী জনগোষ্ঠী নিজেদের সামনে নিতে প্রতিনিয়তই চেষ্টা করতে থাকে এবং তারা সফলও হয়। যাহোক, আজকের বিষয়টি অন্য ইস্যু। কথা হলো, আমরা আমাদের মুদ্রা টাকাকে ডলারের বিপরীতে আরো মূল্য হারাতে দেব কিনা। মূল্য হারানো বা মূল্য হারাতে দেয়াকে অনেকে টাকার অবমূল্যায়ন হিসেবে দেখেন। তবে সত্য হলো, এখন আমাদের স্তরে আছে এমন অর্থনীতিগুলোর কোনোটিই ঘটা করে বা ঘোষণা দিয়ে তাদের মুদ্রাকে অবমূল্যায়ন করে না। যা সত্য তা হলো, সংশ্লিষ্ট মুদ্রা যখন ক্রয়ক্ষমতা হারাতে থাকে, তখন এমনিতেই বিনিময়ের বাজারে ওই মুদ্রার মূল্য পড়তে থাকে। বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার ক্ষেত্রে এমন অবস্থার উদ্ভব হয়েছে কি? তাহলে কেন দাবি তোলা হবে যে টাকাকে আরো পড়তে দেয়া হোক। যারা টাকাকে পড়তে দিতে বলছেন, তারা অতি ক্ষুদ্র বা ক্ষীণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টাকে দেখছেন। বাংলাদেশে অর্থনীতির সামষ্টিক স্থিতিশীলতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। মূল্যস্ফীতি কম থাকা মানে টাকার ক্রয়ক্ষমতা অক্ষুণ্ন থাকা। টাকার ক্রয়ক্ষমতা অক্ষুণ্ন ছিল বলেই সঞ্চয় ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও করপোরেট পর্যায়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়েছিল। মূল্যস্ফীতির কারণে আমাদের টাকার মানের ওপর যদি আস্থা ঢিলেঢালা হয়ে যেত, তাহলে আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও থমকে যেত। কমপক্ষে প্রকৃত হিসাবে তা-ই হতো। সে অবস্থায় আমরা অনেক কম বিদেশী বিনিয়োগ পেতাম। 

যারা টাকার অবমূল্যায়ন চাইছেন, তারা সামগ্রিকভাবে বিষয়গুলো বিবেচনায় আনছেন না। তাদের বড় যুক্তি হলো, টাকার অবমূল্যায়ন হলে রফতানি বেড়ে যাবে। অতীতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে আমাদের মতো অর্থনীতিগুলো রফতানি বাড়াতে কমই সফল হয়েছে। রফতানি বাড়ে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে রাখার মাধ্যমে। আর আজকের রফতানি প্রবৃদ্ধির বড় অনুঘটক হলো, অর্থনীতিগুলো আমাদের রফতানি করতে কী সুবিধা দিচ্ছে। অন্যরা যদি আমাদের বিশেষ সুবিধা না দিয়ে জোটভুক্ত অন্য মিত্রদের বেশি সুবিধা দেয়, তাহলে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেও কি আমরা রফতানি বাড়াতে পারব?

আমরা কি ভিয়েতনামের রফতানি মূল্যের ধারেকাছেও যেতে পারব? পারব না এজন্য, ভিয়েতনাম এরই মধ্যে বড় অর্থনীতিগুলোয় রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা ভোগ করছে। আর ওই সুবিধাটাই হলো অন্যতম কারণ কেন যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় কোম্পানি চীন-আমেরিকার বাণিজ্য বিরোধের প্রেক্ষাপটে তাদের স্থাপনাগুলো ভিয়েতনামে সরিয়ে নিচ্ছে। সেজন্যই পণ্য রফতানি বাড়াতে গেলে বাংলাদেশকেও চেষ্টা করতে হবে অর্থনৈতিক জোটে শামিল হওয়ার। কিন্তু বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ব্যর্থ। ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো জোটবদ্ধ হওয়ার জন্য বাংলাদেশ নিজে চেষ্টা করে না। চেষ্টাটা যা করে তা হলো ভারতের মাধ্যমে। ফলে জোট গঠনে কথা হয় অনেক। কিন্তু কাজ হয় না। ভারত আমাদের কাছে ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য বিক্রি করে। বাংলাদেশ অতি কষ্টে অনেক দিন অপেক্ষা করে মাত্র গত অর্থবছরে ১ বিলিয়ন ডলারের রফতানি পণ্য ভারতে পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। তা নিয়েও ভারতের একটা মহল প্রতিবাদ শুরু করে দিয়েছে। তারা তাদের সরকারকে বলছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পণ্য ঠেকাও। 

যাহোক, ভারতকে নেতা মেনে বাংলাদেশ যদি মনে করে কোনো অর্থনীতি জোটকে এগিয়ে নিতে পারবে, তাহলে মনে হয় না ওই জোটটা বাণিজ্য প্রসারের ক্ষেত্রে কোনো বড় কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে রফতানি বৃদ্ধিতে কিছুটা সফলতা আসতে পারে, যদি দেখা যায় যাদের কাছে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে তাদের চাহিদার স্থিতিস্থাপকতা আছে। বাংলাদেশ যে ধরনের পণ্য রফতানি করে, ওইসব পণ্যের জন্য ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদা স্থিতিস্থাপকতা নেই বললেই চলে। তাহলে যারা টাকার অবমূল্যায়ন চাইছেন, তারা কেমন করে শুধু মূল্য কমিয়ে বেশি বিক্রি করবেন। মূল্য কমানোর ব্যাপারটা আসতে হবে দক্ষ ব্যবস্থাপনা থেকে। যে কৌশল ও যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলোর দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে। যারা টাকার অবমূল্যায়ন চাইছেন তাদের যুক্তি হলো, আমাদের রফতানি পণ্যকে বিদেশীদের জন্য সস্তা করে দিতে হবে। সেটা কীভাবে? সেটা হলো এভাবে: আগে তারা ১ ডলার দিয়ে ৮৪ টাকা পেত। এখন তাদের সেই একই ডলার দিয়ে ৮৭-৮৮ টাকা পেতে দাও, যাতে তারা বেশি একক পণ্য বাংলাদেশ থেকে কিনতে পারে। কিন্তু এ যুক্তি অতি দুর্বল এবং কার্যকর হলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতি বয়ে আনবে।

বাংলাদেশের যে একটি মাত্র পণ্য মোট রফতানির ৮০ শতাংশ অধিকার করে আছে, সেই আরএমজির কাঁচামাল ও অন্য উপকরণ আসে বিদেশ থেকে। তৈরি পোশাক খাতে স্থানীয় উৎস থেকে ভ্যালু অ্যাডিশন কত? যদি ৭০-৭৫ শতাংশ ভ্যালু অ্যাডিশনের উৎস হয়ে থাকে বিদেশ থেকে ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে কাপড় ও অন্যান্য সরঞ্জাম আমদানির মাধ্যমে, তাহলে অবমূল্যায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশী রফতানিকারকদের আদৌ উপকার হবে কি? অবমূল্যায়ন হলে তাদের তো সেই বেশি মূল্যেই ওইসব পণ্য কিনতে হবে। আসলে যেটা মনে হয় সেটা হলো ওই যে সামান্যটুকু নিট ভ্যালু অ্যাডিশন তারা এ দেশে করে, তার মূল্য বেশি পেতে চাইছে। এতে স্বল্পমেয়াদে তাদের হাতে কিছু বাড়তি অর্থ প্রবাহিত হলেও হতে পারে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তা হবে অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। যে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আমরা এতদিন দেখে আসছি তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি ফেরত আসতে পারে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে বড় শাস্তি পাবেন দেশের নিম্ন আয়ের ভোক্তারা। আর টাকার অবমূল্যায়ন হলে আমাদের রফতানি বাড়বে তার গ্যারান্টিইবা কী? 

আমাদের রফতানিকারকদের গোষ্ঠীস্বার্থ না দেখে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির স্বার্থ দেখা উচিত। টাকার অবমূল্যায়নই যদি রফতানি বৃদ্ধির জন্য ভালো পথ হতো তাহলে অনেক দেশ অন্য কিছু না করে শুধু এ কাজটিই করত। আমাদের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হলে আরো কিছু সংস্কার করতে হবে। সংস্কারগুলোর মধ্যে থাকা উচিত করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স কমানো। বিশ্বের অন্য অর্থনীতিগুলো ঠিক তা-ই করছে। আমরা বহু বছর ধরে এক জায়গায় করপোরেট কর ধরে রেখেছি। 

দ্বিতীয়ত, আমাদের অর্থনীতিতে বিশেষ করে সরকারি খাতে অনেক অলস সম্পদ আছে। আমাদের বিশ্বাস হয় না, ওইসব সম্পদ সরকারি ব্যবস্থাপনায় থেকে অর্থনীতিতে আয়ের জোগান দেবে। ওইসব সম্পদকে কোম্পানি করে শেয়ারবাজারের মাধ্যমে জনগণের কাছে বিক্রি করে দেয়া ভালো হবে। অন্য বিষয় হলো, সরকার যেসব বড় স্থাপনা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে নির্মাণ করছে, ওগুলোকে অর্থনৈতিক ব্যবহারের আওতায় আনতে হবে। ওগুলো যারা ব্যবহার করবে তাদের বলা হোক ফি বা প্রাইস দিতে। আর সব নীতির উপরে হতে হবে অর্থনীতিতে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখা। মুদ্রার বিনিময় বাজারে টাকার মূল্য কোন দিকে যাচ্ছে, এটা লক্ষ করার বিষয়। মানুষকে এমন ধারণা দেয়া যাবে না যে আমাদের মুদ্রা মূল্য হারাবে। মূল্য যাতে না হারায় সেই লক্ষ্যে আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজারশক্তির তোড়ে যদি মূল্য পড়ে যায়, সেটা দেখা যাবে। কিন্তু কারো কথা ধরে বা কেউ চাইছেন বলে টাকার মূল্য কমাতে হবে, এটা যাতে না ঘটে।

  • আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ/ অনারারি অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  • কার্টসিঃ বণিক বার্তা/ নভেম্বর ১৪, ২০১৯

অস্থির ক্যাম্পাসের দায় কার?

আমিরুল আলম খান

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রগুলো জরাগ্রস্ত। দুনিয়ায় তার স্বীকৃতি কতখানি, সে প্রশ্নও জোরদার হয়ে উঠছে। হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা মেলে না। আত্মপ্রতারকেরা বলছেন, তথ্য আপডেট না করায় নাকি এ বিপত্তি। বেকুব কাকে বলে? তথ্য হালনাগাদ করে না কেন, তার জবাবদিহি নেই, শুধু শুধু লোক হাসানো।

দেশের পাবলিক, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে ফারাক করা কঠিন। কোনোটিই ঠিকঠাক চলছে না। কার দায় বেশি, সে প্রশ্নও বড় হয়ে উঠছে ক্রমেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দায় পুরোটাই সরকারের। সেখানে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, শিক্ষক, কর্মচারী নিয়োগে দলীয় সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি সবকিছু ভন্ডুল করে দিচ্ছে।

আনুগত্য যদি যোগ্যতা ও সততা দিয়ে বিচার করা হতো, তাহলে এমন লেজেগোবরে অবস্থা হতো না। কিন্তু সরকার চায় নিঃশর্ত আনুগত্য। আইন সেখানে অবান্তর। আর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে পারে কেবল দুর্বৃত্তরাই। পাপ যেমন আরও পাপ ডেকে আনে, দুর্বৃত্ত প্রশাসন তেমনি গোটা প্রশাসনযন্ত্রকেই দুর্বৃত্তায়নের ঘেরাটোপে বাঁধে। বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন দীর্ঘ পাঁচ দশকে কোনো সুফল দেয়নি। ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অরডিন্যান্স দেশের চারটি সর্বজন (পাবলিক) বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোটিতেই উত্তম প্রশাসন উপহার দিতে পারেনি। গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত শক্তিকে পাশ কাটিয়ে তা সর্বনাশের শেষ কিনারে নিয়ে ফেলেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল কাজ গবেষণা। তার মধ্য দিয়ে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হয়। জ্ঞান সৃষ্টির প্রথম শর্ত উদার ও মুক্ত পরিবেশ। চিন্তা ও মতপ্রকাশের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা ছাড়া কখনোই তা সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়সংক্রান্ত বোলনা ঘোষণা তা-ই বলে। কিন্তু পরাধীন যুগে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যেটুকু মুক্তচিন্তাচর্চার সুযোগ ছিল, এখন তার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই।

শুধু গবেষণা ও শিক্ষাদান নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল কাজ সুনাগরিক গড়ে তোলা। আগামী নেতৃত্ব সৃষ্টি করা। স্বাধীন ছাত্র সংসদ এর সেরা নিদান। তিন দশক ধরে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তা অচিন্তনীয়। সরকারি দলের পেটুয়া ছাত্রসংগঠনের মাস্তানি সেখানে এত প্রবল যে, ভিন্নমতের কারও ক্যানটিনে ঢোকার অধিকারটুকুও নেই! রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া তো হনুজ দূর অস্ত। এই ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বে-লাজ সমর্থনে বেড়ে ওঠে, দাপট দেখায়।

ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, বেগম রোকেয়া, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাহিনি কল্পনাকেও হার মানায়। বরিশাল বা গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য লাঠিয়াল হয়ে উঠেছিলেন অপরাজনীতির মদদেই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যুবলীগের সভাপতি পদের জন্য লালায়িত। সে কথা টিভি টক শোতে লাইভে বলতে লজ্জা করেনি তাঁর। পরেও কোনো দুঃখবোধ করেছেন, এমন খবর নেই। বুয়েট তো গোটা দেশের কলজে ছিঁড়ে দিয়েছে। র‍্যাগিংয়ের নামে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে, তা গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকেই উপহাস করছে। আবরার প্রাণ দিয়ে স্বাধীনতার জয়গান গেয়ে গেছেন। কিন্তু তাতে সত্যিই কোনো শিক্ষা নিয়েছে কেউ?

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও ভালো নয়। সেখানেও মুক্তচিন্তা চর্চার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক বিবেচনায় যেমন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি মিলেছে, তার সঙ্গে যুক্ত অভাবনীয় শিক্ষাবাণিজ্য। উচ্চশিক্ষায় ভ্যাট আরোপ করতে গিয়ে এখানেও সরকার তার কুৎসিত চেহারা আলগা করেছে। বিপরীতে শিক্ষার্থীদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন অন্তত এই আশাবাদের জন্ম দিয়েছে যে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও যৌবধর্ম তাদের প্রতিবাদী করেছে।

সরকারি হোক, কিংবা বেসরকারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর সরকারের বজ্রমুষ্টি শাসন বজায় রাখতে তাদের চেষ্টায় কোনো খামতি নেই। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শীর্ষ পদে রাষ্ট্রপতির মনোনীত উপাচার্য, সহ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের বিধান সে কথাই বলে। কিন্তু ক্ষমতা হাতে রাখলে যে তার দায়ভার নিতে হয়, সেটা তারা ভুলে যান। সম্প্রতি বেসরকারি আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বনির্ধারিত সমাবর্তন শেষ সময়ে বাতিল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু তা করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় দায়িত্বহীনতার চরম প্রকাশ ঘটিয়েছে। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টি এক বছরের বেশি আগে থেকে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সম্মতি চেয়ে আচার্যকে চিঠি লিখেছিল। পুরো প্রক্রিয়াটি ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। আবার জুলাই মাসে পূর্বতন উপাচার্যের কার্যমেয়াদ শেষ হবে বিধায় আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয় নতুন উপাচার্য নিয়োগের জন্য ইউজিসির মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। নতুন কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের জন্যও তারা আবেদন করে। ইউজিসি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় যথাসময়ে তাদের দায়িত্ব পালন করে এই শীর্ষপদে নিয়োগ দিলে এমন সংকট সৃষ্টিই হতো না।

ইউজিসি ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৮ সালের জুলাই মাসে ইউজিসি এক গণবিজ্ঞপ্তি প্রচার করে। তাতে মাত্র ৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি শীর্ষপদে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োজিত ছিলেন। তাতে অন্য কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বাধ্যতামূলক পদ শূন্য, তা বোঝা যায় না। কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সহ-উপাচার্য নিয়োগে আগ্রহী নয়। শীর্ষ প্রশাসনে শাসন-দ্বৈততা ও অতিরিক্ত ব্যয় এড়াতে তারা এটা করে। ইউজিসি সহ-উপাচার্য নিয়োগে কড়াকড়ি আরোপ করেছে কি না, তা জানা যায় না। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সহ-উপাচার্য পদটি খালি রেখে চলছে। কিন্তু একই সঙ্গে উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ পদ শূন্য থাকার দায় ইউজিসি বা মন্ত্রণালয় এড়াবে কী করে? গত ২২ অক্টোবর ইউজিসি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে শীর্ষ তিন পদে জরুরি নিয়োগের আহ্বান জানায়। তাতে উল্লেখ করা হয়, আচার্য কর্তৃক নিয়োগ না পেলে কোনো ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের স্বাক্ষরিত সনদ বৈধ হবে না। ঠিক এই ইস্যুতেই উত্তাল হয়ে ওঠে আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয় অন্যান্য ন্যায্য দাবি। সেসব দাবি আদায়ে শিক্ষার্থীরা সুশৃঙ্খল আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

মাত্র চার দিনের ছাত্র বিক্ষোভের মুখে আহছানউল্লার ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কী এমন নজির আছে? বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন এত নাটক করতে দিল সরকার? জাহাঙ্গীরনগরের সমস্যা তো সরকারই জিইয়ে রেখেছে। সেখানকার অভিযোগ কিন্তু অনেক বেশি গুরুতর। ছাত্র-শিক্ষক এক কাতারে শামিল হয়ে মাসের পর মাস আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ন্যায়সংগত দাবি আদায়ে, ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্যই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা। তিন দশক ধরে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্র সংসদ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ বছর আদালতের নির্দেশে যে নির্বাচন করল ২৭ বছর পর, তা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে কলঙ্কতিলক হয়েই রইবে। ভাবতেও কষ্ট হয়, সে কলঙ্ক সৃষ্টি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে নীতিহীন একদল শিক্ষকই।

এটা কল্পনা করা সত্যিই কঠিন, মুক্তচিন্তা চর্চা দূরে থাক, বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন সংস্কৃতি চর্চা একেবারে তলানিতে। শিক্ষা, মুক্তচিন্তা, সংস্কৃতি চর্চার প্রকট অভাব যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাধারণ চিত্র, সেই দেশ দুনিয়ার সেরা ধনী, নাকি ফকির সে প্রশ্ন অবান্তর হয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলার কি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখায়নি?

বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তি ফিরিয়ে আনার চাবি কিন্তু সরকারের হাতে।

  • আমিরুল আলম খান: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/১৪ নভেম্বর ২০১৯ 

Thursday, November 7, 2019

৭ নভেম্বর : ইতিহাসের অমীমাংসিত জিজ্ঞাসা

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ


বাংলাদেশ হলো রাজনৈতিক বিভাজনের এক উর্বর ক্ষেত্র। এখানে পক্ষপ্রতিপক্ষ, দলউপদল সব সময়ই প্রকট। ঘৃণার বীজ বপনের প্রতিযোগিতা চলে প্রতিনিয়ত। এই প্রতিযোগিতায় যখন যে পক্ষই জিতুক, নিশ্চিতভাবে সব সময়ই হারে দেশ। হেরে যায় দেশের রাজনীতি। একটা দেশে বিভাজন প্রকট হলে সেখানে দেশবিরোধী দালাল শ্রেণির উদ্ভব হয় অধিক হারে। ফলে বিদেশি শক্তি ও দেশবিরোধী শক্তির সখ্য গড়ে ওঠে সহজেই। এতে চূড়ান্ত ক্ষতিটা হয় দেশেরই।

বাংলাদেশে যে সব বিষয় নিয়ে বড় ধরনের বিভাজন বিদ্যমান, তার মধ্যে অন্যতম ৭ নভেম্বর। এই দিনটিকে ঘিরে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক বলয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অবস্থান বরাবরই ভিন্ন মেরুতে।

বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে ৭ নভেম্বর ছিল সরকারি ছুটির দিন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সে ছুটি বাতিল করায় এ দিনকে ঘিরে বিভাজন আরও পোক্ত হয়। এ দিনটি উদযাপনেও আছে ভিন্নতা। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ৭ নভেম্বরকে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ পালন করে সেনা হত্যা দিবস হিসেবে। আর জাসদ করে সিপাহি জনতার অভ্যুত্থান দিবস হিসেবে। এই তিন রকম দিবস হওয়ার পেছনেও কারণ আছে। অনেকেই মনে করেন, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর থেকেই সেনাবাহিনীতে যে বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়েছিল, তার একটি ধারাবাহিকতা হচ্ছে নভেম্বরের অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান। ফলে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে ৭ নভেম্বরকে ইতিবাচকভাবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। এ দিনে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে নতুন জীবন ফিরে পেয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে এনে দেশকে স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে এসেছিলেন। পরে তিনি রাষ্ট্রপতি হন এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠা করেন। সুতরাং বিএনপি ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী ঘরানার দলের জন্য ৭ নভেম্বর এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। আর জাসদ কেন এ দুয়ের মাঝামাঝি অবস্থানে তার ধারণা পাওয়া যাবে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ এর একজন সাক্ষী তৎকালীন মেজর ও পরে মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত)  সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীরপ্রতীকের বয়ানে। তিনি লিখেছেন, ‘৭ নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখে অনেক অফিসার নিহত হয়েছিলেন, তাদের হত্যাকারী কে? বেশিরভাগের হত্যাকারী জাসদপন্থি সৈনিক সংস্থা বা জাসদের গণবাহিনী? হত্যাকারীদের নির্দেশদাতা কে? উত্তর, এই কলামে আমি বিস্তারিত আলোচনা করতে না পারলেও পাঠক বুঝে নেবেন। ৭ নভেম্বর তারিখে ব্যর্থ হয়ে, পুনরায় সৈনিক বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিল কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন জাসদ। পুনরায় সেনানিবাসের অভ্যন্তরে সৈনিকদের সংগঠিত করা শুরু করেছিল, জিয়াউর রহমানকে উৎখাত করার নিমিত্তে। সৈনিকদের মধ্যে রাজনীতি ঢুকিয়েছিল তৎকালীন জাসদ। ৭ নভেম্বরের আগে এবং ৭ নভেম্বরের পরে দুই কিস্তিতে সেনাবাহিনীর সৈনিকদের মধ্যে রাজনীতি ঢোকানোর কাজটি, রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধ ছিল। ৭ নভেম্বরের পরের চেষ্টা, আগের চেষ্টা থেকে বেশি বিপজ্জনক বিবেচিত হয়েছিল’ (৭ নভেম্বর ১৯৭৫ : একজন সাক্ষীর স্মৃতিচারণ, মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীরপ্রতীক, ৭ নভেম্বর, ২০১৭, দৈনিক ইনকিলাব)।

সুতরাং এই জাসদের পক্ষে যেমন আওয়ামী লীগের সুরে লাইন ধরে ৭ নভেম্বরের মূল্যায়ন সম্ভব নয়, আবার জিয়াউর রহমানের দল বিএনপির সুরে কথা বলাও সম্ভব নয়।

৭ নভেম্বরকে বুঝতে হলে কয়েকটি ডেটলাইন বোঝা জরুরি। একটু দেখে নেওয়া যাক ১৯৭৫ এর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের সেই উত্তাল দিনগুলোতে কী ঘটেছিল!

০৩ নভেম্বর : সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দি করে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ কর্তৃক অভ্যুত্থান। তাজউদ্দীন আহমদ ও অপর তিন জ্যেষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় নিহত।

সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়ে আওয়ামী লীগ-সিবিপি-ন্যাপ এর কর্মী-সমর্থকদের মিছিল।

০৪ নভেম্বর : অভ্যুত্থানকারীদের চাপে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি প্রদান ও সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ। কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কর্মীদের দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে লিফলেট বিতরণ। লিফলেটে সৈনিকদের বিদ্রোহ করা এবং ‘ভারতের দালাল ও বিশ্বাসঘাতক খালেদ চক্র’কে উৎখাত করার আহ্বান।

৬ নভেম্বর : বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ।

জাতীয় সংসদ বাতিল ঘোষণা।

জিয়াউর রহমানের তরফ থেকে আবু তাহেরের কাছে সাহায্যের আবেদন।

ঢাকায় প্রকৌশলী আনোয়ার সিদ্দিকীর বাসভবনে জাসদ ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃবৃন্দের বৈঠক। আখলাকুর রহমানসহ অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও  সামরিক অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

৭ নভেম্বর : সেনানিবাসগুলোতে কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সৈনিকদের অভ্যুত্থান; বন্দি জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার।

ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও তার দুই সামরিক সহযোগী অজ্ঞাতনামা বিদ্রোহী সৈনিকদের গুলিতে ঢাকার শেরে বাংলা নগরে নিহত।

রাষ্ট্রপতি সায়েম কর্তৃক সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ। তিন বাহিনীর প্রধানদের উপ-সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত।

রক্ষীবাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের ভারত পলায়ন। (সূত্র: মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী: ইতিহাসের পুনর্পাঠ, আলতাফ পারভেজ, পৃষ্ঠা ৪২৮-২৯)।

৩ নভেম্বর জিয়াউর রহমানকে বন্দি করে খালেদ মোশাররফের সেনাপ্রধানের পদ গ্রহণ করার বিষয়টি বেশিরভাগ অফিসার ও সাধারণ সৈনিকরা মেনে নিতে পারেনি। এতে সেনাবাহিনীতে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। একদিকে খালেদ মোশাররফের ভাই এবং মায়ের নেতৃত্বে ঢাকায় মিছিল, অন্যদিকে জাসদের লিফলেটের বক্তব্য অনেকের মনে একটা ভিত গেড়ে দিল যে, ৩ তারিখের সেনাঅভ্যুত্থান ভারতপন্থি এবং তা করা হয়েছে ভারতপন্থি আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতায় স্থাপনের জন্য। সেনাবাহিনীর অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল যে, খালেদ মোশাররফ ভারতপন্থি এবং ভারতের সমর্থনেই তিনি অভ্যুত্থান করেছেন।

পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বরের আলোচনায় অবধারিতভাবে তিনটি নাম বারবার আসে। জিয়াউর রহমান, আবু তাহের ও  খালেদ মোশাররফের নামই সব সময় থাকে আলোচনার কেন্দ্রে। তখন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) এবং তাহের ছিলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্নেল, যার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল জাসদের সঙ্গে। কর্নেল তাহের সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন ১৯৭২ সালে। এরপর থেকে তিনি সরাসরি জাসদের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। এরই মধ্যে গঠিত হয় সেনাসদস্যদের নিয়ে সৈনিক সংস্থা এবং গণবাহিনী। এই তিনজনের মধ্যে সংগত কারণেই জিয়াউর রহমান থাকেন আলোচনার মধ্যমণি। ৩ থেকে ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি, জিয়াউর রহমানের বন্দিত্ব ও মুক্ত হয়ে  সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনা, পরবর্তী সময়ে দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ তাকে আলোচনার কেন্দ্রে এনে দেয়। স্বাধীনতার ঘোষণা ও সেক্টর কমান্ডার হিসেবে প্রথম সারির মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে জিয়াউর রহমান আগে থেকেই ছিলেন পরিচিত ও জনপ্রিয়। তার আর্থিক দুর্নীতিমুক্ত পরিচিতিও তাকে এক ভিন্ন অবস্থান এনে দেয়। দেশের দুটি মহাক্রান্তিলগ্নে ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণের দায়িত্ব এসে ধরা দিয়েছিল তার হাতে।

লে. কর্নেল এম এ হামিদ (অব.), মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব.), মেজর জেনারের আমীন আহম্মেদ চৌধুরী (অব.), ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.)-সহ তৎকালীন বহু সেনা অফিসারের লেখায় যে সত্যতা বেরিয়ে আসে তাতে এটা স্পষ্ট যে, অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের পর ৭ নভেম্বর দেশ অনিশ্চয়তা কাটিয়ে একটা স্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে চলতে শুরু করে জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই। ৭ নভেম্বরের সিপাহি জনতার বিপ্লবকে যারা কর্নেল তাহের ও জাসদের একক কৃতিত্ব হিসেবে দেখিয়ে জিয়াউর রহমানকে ছোট করতে চান তারা হয়তো মাথায় রাখেন না যে একজন অফিসার তার বাহিনীর মধ্যে কতটা জনপ্রিয় হলে সৈনিকরা তাকে মুক্ত করে আনতে পারে। জিয়াউর রহমান তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন বলেই কর্নেল তাহের  সেটাকে কাজে লাগিয়ে অভ্যুত্থান করে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে তৎপর হয়েছিলেন। ৭ নভেম্বর নিয়ে যত বিভাজন, ভিন্নমত ও আলোচনা-সমালোচনাই থাকুক, যত প্রশ্নই অমীমাংসিত থাকুক, সেটা হয়তো ইতিহাসের নিয়মেই একদিন মীমাংসিত হবে। তবে একটা বিষয়ে অনেকেই একমত, এ দিনটিতে বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন নায়কের উত্থান ঘটেছিল। তিনি সাবেক সেনাপ্রধান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।

  • লেখক চিকিৎসক ও কলামিস্ট 
  • কার্টসি —  দেশ রূপান্তর / নভেম্বর ৭, ২০১৯

Tuesday, November 5, 2019

একাত্তরের সূর্যসন্তান

মনজুর আহমদ

অস্তাচলে হারিয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোর এক উজ্জ্বল সূর্য। একাত্তরের ঘোর বিভীষিকাময় দিনগুলোতে যিনি  আলোকবর্তিকা হাতে মুক্তি পথের দিশারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, সেই দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা অবশেষে নিজেকে সমর্পণ করলেন মরণব্যাধি ক্যানসারের কাছে। নিউ ইয়র্কে এসেছিলেন চিকিৎসা করাতে। পাঁচটি বছর লড়াই করেছেন মৃত্যুর সঙ্গে। কিন্তু ‘জীবনেরে কে রুধিতে পারে, আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে...’, সেই অসীম আকাশের হাতছানিতে সাড়া দিয়ে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন তিনি।

সাদেক হোসেন খোকা, ঢাকাবাসীর প্রিয় খোকা ভাই, অনেক অভিধায় অভিহিত তিনি, অনেক পরিচয় রয়েছে তার।  কিন্তু সঠিক কোন পরিচয়ে তিনি শ্রদ্ধার আসন দখল করে রয়েছেন মানুষের মনে? অবিভক্ত ঢাকার শেষ মেয়র ছিলেন তিনি, ছিলেন একাধিক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছেন বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে ছিল তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা, গোপীবাগকেন্দ্রিক ব্রাদার্স ইউনিয়নের কর্মকর্তা ছিলেন। তবে অবশ্যই বলা যায়, এসব কিছুর  ঊর্ধ্বে তার যে পরিচয়টি অম্লান হয়ে রয়েছে, তা তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়।

তিনি ছিলেন ঢাকা কাঁপানো মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকা যখন কেঁপেছে সারা বাংলাদেশ তখন উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্ব তখন দু’চোখ মেলে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়েছে। একাত্তরে ঢাকার বিভিন্ন অভিযানে অংশ নেয়া গেরিলাদের একজন ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। তিনি ছিলেন নেতৃস্থানীয়, একটি গ্রুপের কমান্ডার।

একাত্তরে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে সাদেক হোসেন খোকা মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ছাত্র ইউনিয়নের আরো কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে ঢাকা ছাড়েন। প্রথমে যান নরসিংদীর শিবপুর, সেখান থেকে আগরতলা।  সেখানে গিয়ে দুই নম্বর সেক্টরে যোগ দেন তারা। খালেদ মোশাররফ ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার। তাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের নাম ছিল ‘মেলাঘর’। বসবাসের অনুপযুক্ত, পাহাড় আর ঘন জঙ্গলে ঘেরা এই ক্যাম্পের বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন ঢাকা শহরের ছেলে। তাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন মেজর হায়দার। তার কাছে তিন সপ্তাহের গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে সম্মুখ যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য তাদের এক গভীর রাতে পাঠানো হয় ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বাধীন একটি সাব-সেক্টরে। সেখানে দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ শেষ করে শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের সরাসরি সম্মুখযুদ্ধ। সাদেক হোসেন খোকা প্রথমবারের মতো সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন কসবা-মন্দাভাগ সীমান্তে। এখানে যুদ্ধ করেই মূলত তিনি অভিজ্ঞতা অর্জন করেন এসএমজি, এসএলআর, চাইনিজ রাইফেল ও অন্যান্য অস্ত্র পরিচালনার।

সব ধরনের প্রশিক্ষণের পর সাদেক হোসেন খোকার নেতৃত্বে ৪০ যোদ্ধার একটি গ্রুপ গঠন করে তাদের পাঠানো হয় ঢাকায় অপারেশনের জন্য। ঢাকায় আরো ২৫ জন যুক্ত হয় তাদের সঙ্গে। এর আগেও কয়েকটি গ্রুপ ঢাকায় অভিযান চালিয়েছে। তবে কিছু ভুল-ত্রুটির জন্য তাদের সবগুলো অভিযান সফল হতে পারেনি। কয়েকজন ধরাও পড়েছিল পাকিস্তানিদের হাতে। সেই সব অভিজ্ঞতাগুলো বিশ্লেষণ করে সাদেক হোসেন খোকার দল তাদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করে। তারা টার্গেট নির্ধারণ করতেন প্রচারের গুরুত্ব বিবেচনা করে, যাতে অপারেশনের খবর মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পায় এবং শত্রুও আতঙ্কগ্রস্ত হয়। তখন পাকিস্তানি শাসকেরা বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে বলে দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছিল। খোকা এবং তার গ্রুপের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন বড় ধরনের কয়েকটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাদের প্রচারণার অসত্যতা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার। এই লক্ষ্যেই তারা একের পর এক অপারেশন চালিয়ে গেছেন। তারা অপারেশন চালিয়েছেন পিলখানায় ইপিআর সদর দপ্তরে, উড়িয়ে দিয়েছেন শান্তিনগরে সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা দপ্তর, রাজারবাগে নির্বাচন কমিশন ভবন, শহীদুল্লাহ হলের দক্ষিণে অবস্থিত বিমান বাহিনীর রিক্রুটিং কেন্দ্র, বায়তুল মোকাররমের বিপরীতে গ্যানি’জ বিপণি বিতান প্রভৃতি। প্রতিটি অপারেশনেই তারা সাফল্য পেয়েছেন এবং এর মধ্যদিয়ে তারা সন্ত্রস্ত করে দিয়েছেন পাকিস্তানিদের। প্রতিটি অপারেশনের পরই তারা ঘটনাস্থল থেকে সরে পড়তেন এবং জনগণের মধ্যে মিশে গিয়ে আক্রমণের ফলাফল ও প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করতেন। সব অভিযানই যে তারা গোপনে সম্পন্ন করতে পেরেছেন তা নয়। কোথাও কোথাও তাদের শক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছে। দারোয়ান বা পাহারাদের নিরস্ত্র করে তাদের চাপের মধ্যে রাখতে হয়েছে।

সাদেক হোসেন খোকা ও তার গ্রুপের দুঃসাহসিক তৎপরতা আজ এক কিংবদন্তি। বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয় যখন শুনি, পিলখানায় ইপিআর সদর দপ্তরের অভ্যন্তরে নির্মাণ কাজে নিয়োজিত একটি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকের ছদ্মবেশে সাদেক হোসেন খোকা সেই ভয়ঙ্কর শত্রুপুরীর ভেতরে ঢুকে গেছেন এবং পর পর কয়েকদিন রেকি করে এসেছেন, দেখে এসেছেন ভেতরের সব কিছুর অবস্থান।

এই অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা আজ চিরনিদ্রায় শায়িত। নিউ ইয়র্কের জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে এক দফা জানাজা শেষে তার মরদেহ নেয়া হয়েছে ব্রুকলিনের একটি ফিউনারেল হোমে। পাসপোর্ট না থাকায় জটিলতা দেখা দিয়েছিল লাশ ঢাকায় নেয়া নিয়ে। মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় তার এবং তার স্ত্রীর পাসপোর্ট নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেটে জমা দেয়া হয়েছিল নবায়নের জন্য। দীর্ঘ সময়েও সে পাসপোর্ট আর ফেরত পাননি তারা। তাদের পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে সরকারিভাবে কিছু বলাও হয়নি। তবে শেষ মুহূর্তে সৌজন্য দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একাত্তরের সূর্য সন্তান খোকার লাশ দেশে আনার জন্য ব্যবস্থা নিতে বলেছেন তিনি। তার সবুজ সংকেতে লাশ এখন যাচ্ছে ঢাকায়। লক্ষণীয়, প্রধানমন্ত্রীর এই মনোভাবের পরই যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতারা শেষ মুহূর্তে খোকাকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন।

ঢাকা কাঁপানো মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যুকে একাত্তরে উদিত একটি সূর্যের অস্তাচলে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করা যায়। শঙ্কা লাগে এ ভাবে শেষ সূর্যটির অস্ত যাওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের গৌরবে উজ্জ্বল আমাদের একাত্তর কি গভীর অমানিশার কবলে নিমজ্জিত হবে!

  • কার্টসি— মানবজমিন/ ৫ নভেম্বর ২০১৯