মিজানুর রহমান খান
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির পথ ও পন্থা নিয়ে কথা উঠেছে রাজনীতিতে। যে অভিযোগে তাঁকে দণ্ড দেওয়া হয়েছে, তর্কের খাতিরে কেউ সেটা যথার্থ মেনে নিতে পারেন। মেনে নিয়েই প্রশ্ন তুলতে পারেন, এই ভূখণ্ডে অভিন্ন বা সমচরিত্রের অভিযোগে অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা কে কোথায়? কারও জন্য আইনের দোহাই, কারও ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ নেই। যদি একজন এরশাদ ও নাজমুল হুদারও জামিন পাওয়া নিয়ে একই রকম আইনের প্রয়োগ দেখা যেত, তাহলে কথা কম উঠত। যেহেতু এক যাত্রায় ভিন্ন ফল পাওয়ার মূল কারণটা রাজনীতিতে, তাই রাজনৈতিকভাবেই এর প্রতিকার প্রতীয়মান হয়। যদি রাজনৈতিক কারণেই খালেদা জিয়া দণ্ডিত হয়ে থাকেন, তাহলে রাজনীতিই হবে তার প্রতিষেধক। এই রকম ব্যাখ্যা যদি বিশ্বাসযোগ্য হয়, তাহলে ‘শুধু আদালতই পারেন’, এই যুক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
কাউকে মুক্তিদান প্রশ্নে আদালত অপেক্ষাকৃত কম এখতিয়ার ভোগ করেন। যে আদালত দণ্ড দিয়েছেন, তাঁর পক্ষে সেটা ওল্টানো যাবে না। আদালত কোনো রায়ই বাতিল করতে পারেন না। আদালত সব সময় স্বতঃপ্রণোদিতভাবে নিজের রায়ের ত্রুটি বদলাতে পারেন না, সুযোগ থাকে না। কিন্তু নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা প্রায় অপরিসীম। তাদের হস্তক্ষেপে মুক্তি পাওয়ার নানা নজির আছে। কিছুকাল আগে একজন দণ্ডিত ব্যক্তির রাষ্ট্রপতির ক্ষমার দরকার পড়ল না। তিনি মুক্ত মানুষ হলেন। অথচ সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের আওতায় তিনি দরখাস্ত দেননি। তিনি দণ্ডিত, তারপরও সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে পেরেছে।
রাষ্ট্র ও সরকারের আছে অনেক ক্ষমতা। সরকার রাজনৈতিকভাবে কিছু একটা করতে চাইছে, কিন্তু আইনে মানা আছে বলে করতে পারছে না, এমন একটা অবস্থা বাংলাদেশে কমই হয়। সুতরাং নানা উপায় আছে। আইন বলছে, রাষ্ট্রপক্ষ চাইলে আদালত যেকোনো কার্যধারা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। এটা মামলার যেকোনো পর্যায়েই—রায়ের আগে হতে পারে, রায়ের পরেও হতে পারে। অবশ্য রায়ের আগে ও পরে সমান কথা নয়। রায়ের পরে হলে শুধু দণ্ড বিরাম বা মওকুফ করা যাবে। কিন্তু তাঁর দোষী সাব্যস্ত হওয়া মুছে ফেলা যাবে না। তিনি আইনের চোখে অপরাধী থাকবেন। ‘এতিমের তিন কোটি টাকা মেরে খাওয়া’র সুবিচার আর ‘ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে খাওয়ার’ অবিচারের মধ্যে কোনটি জনস্বার্থের বেশি বা কম ভালো, সেটা জ্বলন্ত প্রশ্ন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলছেন, তাঁরা খালেদা জিয়ার প্যারোলের দরখাস্ত পাননি। এ কথার মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে যে দরখাস্ত করা হলে তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখা হতে পারে। আবার এটাও ধরে নেওয়ার উপায় নেই যে তাঁরা প্যারোলের দরখাস্তের অপেক্ষায় নেই এবং সেটা পাওয়ামাত্রই সেটা ছুড়ে ফেলে দেবেন। তবে অনুমান করি, সরকার চাইতে পারে যে দরখাস্ত আসুক। এতে তাদের রাজনৈতিক জিত হয়। সুতরাং বিএনপিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সরকারের সামনেও আইন নানা বিকল্প রেখেছে।
দরখাস্ত হোক জামিনের বা প্যারোলের—মোটকথা একটি জীবনকে প্রলম্বিত করার জন্য যেখানে কারামুক্তি পেতেই হবে, সেখানে কার্যপ্রণালি বড় নয়। তবে বিদ্যমান আইন বলছে, নারী, বিশেষ করে তিনি যদি প্রবীণ নাগরিক হন এবং তাঁর স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে, তাহলে তিনি জামিন পেতে বিশেষ বিবেচনার হকদার।
কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, সরকার তাঁকে মুক্তি দিয়ে স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন হওয়ার সামান্য কোনো ঝুঁকি নেবে না। তাই খালেদা জিয়াকে তারা মুক্তি দেবে না। পাল্টা প্রশ্ন হতে পারে, তাঁকে এভাবে রেখে দেওয়াটাই স্থিতিশীলতার গ্যারান্টি, কে সেটা হলফ করে বলবেন?
জীবন ও স্বাস্থ্যসুরক্ষার অধিকার মৌলিক। রাষ্ট্রের একটি অঙ্গের কাছে আমি মানবিক কারণে দরখাস্ত করতে পারি, কিন্তু একই রাষ্ট্রের আরেকটি অঙ্গের কাছে আমি মানবিক কারণে প্যারোল চাইতে দ্বিধান্বিত—বিএনপির তরফে এই দুই অবস্থা দ্বন্দ্বমূলক। বিএনপির কিছু নীতিনির্ধারক এর আগে প্যারোল চাইতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে বাধা দিয়েছেন। তাঁরা এখনো সক্রিয়। বিএনপি রাজনৈতিক আবেগকে পাথেয় ভাবছে, কিন্তু তা অকার্যকর প্রমাণিত। এই আবেগ একান্তভাবে বিএনপির গোষ্ঠীগত।
বিএনপির প্রতিনিধিদলের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাওয়াও একদম মূল্যহীন ছিল না। একটা সংলাপ সেখানে হয়েছে, সেটা মুছে যায়নি। বিশ্বাস করার কারণ আছে যে মির্জা ফখরুলের মতো প্রবীণ নেতারা আফসোস করতে পারেন এই ভেবে যে কট্টর নেতাদের কারণে প্যারোলের সুযোগটা হাতছাড়া হলো। গত নির্বাচনের পর গণভবনে গিয়ে, শপথ নিয়ে বিএনপি যে ‘কার্যকর রাজনৈতিক বৈধতা’ সরকারকে দিল, তার বিনিময়ে বিএনপি কিছু চেয়েছে কিংবা আওয়ামী লীগ কিছু দিতে রাজি ছিল, এমন কোনো ধারণা আমরা কোথাও থেকে পাই না।
দুদকের প্রধান আইনজীবী খুরশীদ আলম খানের সঙ্গে মুঠোফোনে আলোচনায় কয়েকটি ধারণা জন্মাল। প্রথমত, এর আগে শেখ হাসিনা, তারেক রহমান, খালেদা জিয়া প্যারোল নিয়েছিলেন। কিন্তু তখন তাঁরা কেউ দণ্ডিত ছিলেন না। তাঁর প্রশ্ন, দণ্ডিত ব্যক্তিদের প্যারোল–প্রক্রিয়া কী হবে। তাঁর আরও প্রশ্ন, খালেদা জিয়া দুদকের মামলায় দণ্ডিত। দুদক আইনের মামলা সরকার নয়, তুলতে পারে দুদক। কিন্তু আইনে মামলা তুলে নেওয়ার বিষয়ে কিছু বলা নেই। সুতরাং সিআরপিসির ৪০১ ধারার আওতায় দণ্ডিতের সংশ্লিষ্ট মামলা তুলে নিতে সরকার বা দুদকেরও এখতিয়ার আছে কি না, সেটা একটা প্রশ্ন। এক-এগারোতে হওয়া মামলাগুলো প্রত্যাহারে ৪০১ ধারা প্রয়োগের চিন্তা ছিল। কিন্তু দুদক রাজি না হওয়ায় এই ধারার আওতায় প্রত্যাহার ঘটেনি। যা প্রত্যাহার হয়েছে, সেটা সিআরপিসির ৪৯৪ ধারার আওতায়। দণ্ড ঘোষণার আগের অবস্থায় মামলা প্রত্যাহারে এই বিধানের প্রয়োগ ঘটে।
ওপরের যুক্তির সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করি। ২০১৬ সালের ১ জুন প্যারোল নীতিমালা হালনাগাদ করেছে সরকার। এতে বলা আছে, প্যারোলের সিদ্ধান্ত আদালতের আদেশ ছাড়াও সরকার তার বিশেষ সিদ্ধান্তে নিতে পারবে। এটি সব শ্রেণির হাজতি ও কয়েদির জন্য প্রযোজ্য।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে সাজা মার্জনা, স্থগিত ও হ্রাস ছাড়াও রাষ্ট্রপতি (কার্যত প্রধানমন্ত্রী) কারও দণ্ড বিরাম (রেসপাইট) করতেও পারেন। রাষ্ট্রপতি যা যা পারেন, তার সব কটি বাস্তবায়নের উদাহরণ সম্ভবত তৈরি হয়নি। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি অপরাধের জন্য দণ্ডিত হইলে সরকার যে কোনো সময় বিনা শর্তে বা দণ্ডিত ব্যক্তি, যা মানিয়া লয়, সেইরূপ শর্তে যে দণ্ডে সে দণ্ডিত হইয়াছে, সেই দণ্ডের কার্যকরীকরণ স্থগিত রাখিতে বা সম্পূর্ণ দণ্ড বা দণ্ডের অংশবিশেষ মওকুফ করিতে পারিবে।’
৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার কারাবাসের দুই বছর পূর্তিতে আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক ও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবুল আলম জানামতে সবচেয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির (দেখুন সমকাল প্রতিবেদন, ৮/৮/২০) বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। তাঁরা উভয়ে বলেছেন, উক্ত ৪০১(১) ধারাটি খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। খুরশীদ আলমের সঙ্গে তাই একমত নই। কারণ, দুদক আইনটি সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের অধীনে। দুদকের মামলা বা পেইন্ডিং মামলা বলে প্রাচীর তোলা যাবে না।
ধরে নিই যে বিএনপির পক্ষে ক্ষমা চাওয়া বা প্যারোলের দরখাস্ত করা কঠিন। আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘সাজা কমানো যেতে পারে। কিন্তু তেমন আবেদন সরকার না পেলে তা নিয়ে আলোচনার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না, সিদ্ধান্ত তো পরের বিষয়।’ আইনমন্ত্রীর এই একটি মন্তব্য ধরেই সমাধান সূত্র বের করা সম্ভব। ১২ ফেব্রুয়ারি খবর ছিল, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, মুক্তির সিদ্ধান্ত সরকারই নেবে। এখন আশার বিষয় যে ১৮ ফেব্রুয়ারিতে এসে মির্জা ফখরুল বললেন, প্যারোল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে খালেদার পরিবার। তাঁর পরিবার কোনো ধারার উল্লেখ করে বা না করে রাষ্ট্রপতির কাছে একটি মানবিক আবেদন করতে পারে। যদিও আপিল বিভাগ দুই মাস আগেই জামিনের দরখাস্ত নামঞ্জুর করেছেন। কিন্তু প্রতীয়মান হয় যে, বিশেষ করে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগের ১২ ডিসেম্বরের পূর্ণাঙ্গ রায় আরও বড় ইতিবাচক অগ্রগতি। যদিও বিএনপি শুধু জামিন নামঞ্জুর না হওয়া নিয়ে হাপিত্যেশ করছে।
সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণটি রাজনৈতিকভাবেও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এটি মানবিক আবেদনে সাড়া দেওয়ার পথ সুগম করেছে। আপিল বিভাগের জামিন নামঞ্জুরের চেয়ে ঢের গুরুত্বপূর্ণ তার পর্যবেক্ষণ। আপিল বিভাগ বলেছে, ‘যদি আবেদনকারী (খালেদা জিয়া) প্রয়োজনীয় সম্মতি দেন, তাহলে মেডিকেল বোর্ড দ্রুত তাঁর অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের জন্য পদক্ষেপ নেবে।’ আপিল বিভাগের ১২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ আদেশটি পড়ে প্রতীয়মান হয় যে দরকারে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসারও একটি ভিত্তি হতে পারে রায়টি। মেডিকেল বোর্ড খালেদা জিয়ার হাইপারটেনশন ও হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তাঁর রিউমিউটয়েড আর্থ্রাইটিস ‘হাইলি অ্যাকটিভ’ এবং তার অবস্থাকে ‘অ্যাট আ ক্রিপলড স্টেট’ বলে উল্লেখ করেছে। বোর্ড এরপর বলেছে, ‘অন্যান্য যোগ্যতাসম্পন্ন রিউমেটোলজিস্টদের সুপারিশ গ্রহণে তারা প্রস্তুত।’ আপিল বিভাগ এ অংশটিতে গুরুত্বারোপ করেছে। মেডিকেল বোর্ড সর্বশেষ আন্তর্জাতিক সুপারিশ অনুযায়ী, খালেদার চিকিৎসায় একটি বায়োলজিক থেরাপির প্রেসক্রিপশন দিয়েছিল। কিন্তু তাতে দরখাস্তকারীর সম্মতি মেলেনি।
কেউ বলবেন, সরকারের কিছুটা রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখছি। কারণ, কারাগারের বাইরে খালেদা জিয়া অব্যাহতভাবে হাসপাতালে থাকছেন। উপরন্তু একজন সত্তর পেরোনো নারীর স্বাস্থ্যগত অবস্থাটি যে অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের পর্যায়ের, সেটা আপিল বিভাগের রায়ে দৃঢ়তার সঙ্গে স্বীকৃত। সুতরাং বিএনপি ক্ষমা না চেয়ে দণ্ড কমানোর দরখাস্ত করতেই পারে। দরকার হলে তাঁর পরিবার প্যারোল বা যা সমীচীন, তেমন দরখাস্ত করতে পারে। আলোচ্য ক্ষেত্রে দণ্ড ও প্যারোল যদি রাজনীতির অপর নাম হয়, তাহলে প্যারোলই শেষ কথা নয়। তাই জিয়া পরিবার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, যদি নিরঙ্কুশভাবে তাঁর সুচিকিৎসাকেই তারা একমাত্র বিবেচ্য ভাবতে পারে। সরকারের কাছে কোনো ধরনের আবেদন ছাড়াই প্যারোল বা মুক্তি দেওয়া হলে, সেটা সরকারের জন্য পরাজয় হিসেবে দেখা হবে। বিধ্বস্ত বিএনপি তখন বলে বসবে, তারা সরকারকে নতি স্বীকারে বাধ্য করেছে।
খালেদা জিয়ার মুক্তি বিষয়ে একটি সমঝোতা হলে তা দেশের বর্তমান রাজনীতে নতুন মাত্রা দিতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ‘অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্ট’ তাঁর মৌলিক অধিকার। এটা রাষ্ট্রের অনুকম্পার বিষয় নয়। এটাই সেই পথ, যেখানে সরকার, আদালত ও বিএনপি—সবাই স্বস্তি পেতে পারে। জিয়া পরিবার রাষ্ট্রপতির কাছে দরখাস্ত পাঠাতে পারে। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘দুর্নীতির দায়ে আদালতের বিচারে সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে কেবল আদালতে জামিন বা খালাস পাওয়া ছাড়া বেগম জিয়ার মুক্তির অন্য কোনো পথ নেই।’ ওপরের আলোচনা এই যুক্তিকে সমর্থন করে না।
- মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
- কার্টসি - প্রথম আলো/ ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২০