Search

Sunday, March 1, 2020

চিঁড়েচ্যাপ্টা মধ্যবিত্ত

মরিয়ম চম্পা

রাজধানীর ফার্মগেটের রাজাবাজার এলাকায় এক কক্ষের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন। ব্যবসা থেকে যা আয় হয় তার একটি অংশ দিয়ে নিজের খরচ মেটান। কিছু টাকা বাড়ি পাঠান পরিবারের জন্য। জামাল বলেন, বছরের শুরুতে একবার বাসা ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এখন বিদ্যুৎ এবং পানির দাম বাড়ায় আবার ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দিয়েছে বাড়িওয়ালা। এমনিতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এভাবে সব বাড়তে থাকলে নিজের আয়ে নিজেই চলতে পারব না। পরিবারকে দেখাশোনা করবো কীভাবে? শুধু জামাল উদ্দিনই নন, এমন ত্রাহি অবস্থায় রাজধানীর মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ।

রাত পোহালেই ব্যয় বাড়ে। চাল-পিয়াজের  বাজারে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। এমন অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির দাম বাড়ছে দফায় দফায়। সব মিলিয়ে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের টালি মিলাতে পারছেন না অনেক মানুষ। এতে সাধারণ মানুষের অনেককে ব্যয় কমাতে হচ্ছে। কমাতে হচ্ছে অতি প্রয়োজনীয় চাহিদাও।

রাজধানীর পল্লবীতে দুই সন্তান নিয়ে থাকেন মাহফুজুর রহমান। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মাসে ৩৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। দুই বেড় রুমের বাসা ভাড়া দেন ১২ হাজার টাকা। বাকি টাকায় দুই সন্তানের স্কুলের খচর, মাসের বাজার এবং নিজের মতিঝিলের অফিসে যাতায়াতের খরচ মেটাতে গিয়ে হিমশিম অবস্থা। এই চাকরিজীবী বলেন, এখন যেভাবে চলছি এটা জীবন না। দুই বছর ধরে অফিস কোন বেতন বাড়ায়নি। বলছে ব্যবসার অবস্থা ভাল না। কিন্তু দুই বছরে দুইবার বাসা ভাড়া বেড়েছে। গ্যাসের দাম, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। এবার পানির দামও বাড়লো। চাল, ডাল, পিয়াজসহ নিত্য পন্যের দাম বেড়েই চলছে। বছর শেষে ছেলে-মেয়ের স্কুল থেকে বেতন বাড়ানোর নোটিশ আসে। এতো বৃদ্ধির মধ্যে বেঁচে থাকাই দায়।

পরিস্থিতি আরও জটিল পান্থপথ সিগন্যালে চা বিক্রেতা সবুজের জন্য। তিনি বলেন, বউ বাচ্চা নিয়ে একটি বস্তিতে সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে থাকি। আমরা যারা ছোট ব্যবসা করি তাদের সমস্যা আরো বেশি। আমাদের বেশিরভাগ কাস্টমার রিকশাওয়ালা ও ছোটখাট চাকরিজীবী। পকেটে টাকা না থাকলে তারা কি দোকানে চা খেতে আসবে। পেয়াজ খাওয়াতো ছেড়েছি সেই কবেই। মাছ-মাংস ১৫ দিনে একবার খাওয়া হয়। যেভাবে সব কিছুর দাম বাড়ছে তাতে টিকে থাকাই কষ্টকর।

আয়-ব্যায়ের জটিল এই পরিস্থিতির মধ্যেই পানি ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে চাপে পড়বেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি মানবজমিনকে বলেন, এটার বিরূপ প্রভাবে সব কিছুর দাম বাড়বে। এটাতো নতুন কিছু না। বিদ্যুৎ যে সকল স্থানে ব্যবহৃত হয় সে সকল স্থানে পণ্যের দাম, বাসা ভাড়া, জীবন যাত্রার ব্যয় বাড়বে। বিদ্যুতের জন্য একদিকে যেমন বেশি বিল দিতে হবে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ থেকে উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়বে। যারা বিদ্যুৎ ব্যবহার করে না তাদেরকেও বাড়তি দামে জিনিসপত্র কিনতে হবে। এগুলো হঠাৎ করে হয়নি। আর এটা শুধু নিম্ন আয়ের বা নিন্মমধ্যবিত্তদের জন্য না উদ্যোক্তাদের জন্যও সমস্যা হবে। উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। ফলে তাদের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা কমবে। সরকারের বিদ্যুৎ খাত যে নকশা বা পরিকল্পনা দিয়ে চলছে সে নকশার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে এটা। এবং এটি এখানেই থামবে না। আরো বাড়বে। এবং বিদ্যুতের সঙ্গে দেশি বিদেশি অনেক ব্যবসায়ী জড়িত। তাদের মুনাফা বাড়ানোর জন্য এটি দরকার। পানির ক্ষেত্রেও তাই। দেশি বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যুক্ত হচ্ছে পানির সঙ্গে। তাদের মুনাফা বাড়াতেও এটি দরকার।

তেজতুড়ি বাজার এলাকার বাড়িওয়ালা এখানে আমার দুটি বাড়ি। এরমধ্যে একটিতে ছাত্রী হোস্টেল। যাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। এমনিতেই হোস্টেলগুলোতে ভাড়া আদায়ে নানান ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়। এখন নতুন করে পানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় আগামী মাসের হোস্টেল ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দিয়েছি। গতকাল অনেক ছাত্রী হোস্টেল ছাড়ার আবেদন করেছে। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে পানির দাম বাড়ানো হয়েছে। সরকার তাদের প্রকল্পের চুরি বন্ধ করতে পারে না, এর দায় চাপে আমাদের ওপর। আমরা কোথায় যাব। সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এর ফলে জীবন যাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। কারণ, বিদ্যুৎ ও পানি প্রায় সকল উৎপাদনের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। এগুলোর প্রভাব পরবে দ্রব্যমূল্যে। এর বিরূপ প্রভাবতো সমাজের সাধারণ মানুষের উপর পড়বেই। এগুলো করা হচ্ছে মূলত এরসঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যপক দুর্নীতি ও অনিয়মের দায় সাধারণ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দিতে। যেটা কোনোভাবেই কাঙ্খিত এবং গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে কোনো কথা বলে লাভ নেই। তারপরও আমরা কথা বলছি। অবস্থা এমন হয়ে গেছে যে ক্ষমতাসীনরা কারো প্রতি কর্নপাত করে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এটা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়াবে। কারণ আমাদের দেশের যে প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয় ৮ ভাগেরও বেশি যার সুফল ভোগ করে মাত্র শতকরা চার থেকে পাঁচভাগ লোক। এর নিচে যারা শতকরা ৯৫ ভাগ লোকের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। হলেও খুব সামান্য। কাজেই সাধারণ মানুষ খুব বেশি কষ্টে পড়বে। নিম্নবিত্ত তথা মধ্যেবিত্তদের পক্ষেও এই বাড়তি আয় যোগানো মুশকিল। কারণ তাদের আয় সত্যিকার অর্থে বাড়েনি। কাজেই এটা খুবই দুর্ভোগ বাড়াবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সরকার যে ভর্তুকি দিচ্ছে সেটা কমানোর জন্য দাম বাড়ানো হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হবে যে, ভর্তুকি দেয়া লাগছে কেন? বিদ্যুৎ চুরির জন্য। এই চুরিটা যদি ঠেকানো যায় তাহলে মানুষকে কষ্ট দিয়ে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হয় না। সে জন্য মনে হয় চুরির বিষয়টি দেখা উচিৎ।

  • কার্টসি - মানবজমিন/ মার্চ ১, ২০২০ 

মানুষের নাভিশ্বাস

কাওসার আজম

আবারো বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুৎ ও পানির দাম। সাধারণ চাকরিজীবী ও নিম্ন মধ্যবিত্তের আয় না বাড়লেও সরকার বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধি করায় বড় ধাক্কা লেগেছে নাগরিকদের জীবনযাত্রায়। অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করছেন বিদ্যুৎ-পানির দাম বৃদ্ধির ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে নাগরিক জীবনে।

করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতিতে যে ধাক্কা শুরু হয়েছে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধির ফলে তা বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে। দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি পাবে, মানুষের জীবন যাত্রা আরো ব্যয়বহুল হবে। সাধারণ মানুষ ও গরিব মানুষ আরো বেশি সমস্যার মধ্যে পড়বে। মানুষের নাভিশ্বাস হবে।

ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুৎ ও পানির দাম। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার প্রায় ১২ বছরে এ নিয়ে আটবার বিদ্যুতের দাম এবং ১৩ বার পানির দাম বৃদ্ধি করা হলো। বিদ্যুতের বর্ধিত দাম কার্যকর হচ্ছে চলতি মার্চ মাস থেকেই। গ্রাহকদের এখন থেকে বিদ্যুৎ বিল বাবদ ইউনিটপ্রতি ৩৬ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি দিতে হবে।

অন্য দিকে ঢাকা ওয়াসার পানির বর্ধিত দাম আগামী এপ্রিল মাস থেকে কার্যকর হবে। ওয়াসার সরবরাহকৃত প্রতি হাজার লিটার পানির দাম আবাসিকে ১১ টাকা ৫৭ পয়সার পরিবর্তে ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা, বাণিজ্যিকে প্রতি হাজার লিটার পানির দাম ৩৭ টাকা ৪ পয়সার পরিবর্তে ৪০ টাকা এবং চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রতি হাজার লিটার পানির দাম আবাসিকে ৯ টাকা ৯২ পয়সার পরিবর্তে ১২ টাকা ৪০ পয়সা এবং বাণিজ্যিকে প্রতি হাজার লিটার পানির দাম ২৭ টাকা ৫৬ পয়সার পরিবর্তে ৩০ টাকা ৩০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।

নতুন করে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদ, জ্বালানি ও সমাজ বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এমন একসময় বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানো হলো, যখন করোনাভাইরাসের কারণে এমনিতেই দেশের অর্থনীতি প্রায় স্থবির। চীন থেকে কাঁচামাল না আসায় বেশ কিছু শিল্পোদ্যোক্তা হাত গুটিয়ে আছেন। এ পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ ও পানির মূল্য বৃদ্ধি অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধির ফলে বিপাকে পড়বে সীমিত আয়ের মানুষ। তবে শুধু আবাসিক খাতেই নয়, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে শিল্প খাতেও। শিল্পে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেলে বাড়বে দ্রব্যমূল্যও। এর মাশুলও দিতে হবে সাধারণ ভোক্তাদেরই। এমনিতেই নির্দিষ্ট আয়ের বিভিন্ন পেশার মানুষের কষ্ট ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। এ অবস্থায় আবারো বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় তথা দুর্ভোগের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় বলা হয়, ঢাকা ওয়াসার সেবায় গ্রাহকদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি অসন্তুষ্ট। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে গত প্রায় ১২ বছরে ১৩ বার পানির দাম বেড়েছে। একই সময়ে পানির দাম প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সালে ঢাকায় আবাসিক গ্রাহকদের জন্য পানির দাম ছিল প্রতি ইউনিট (১ হাজার লিটার) ৫ টাকা ৭৫ পয়সা। দাম বাড়ানোর কারণে আগামী এপ্রিল থেকে তা হচ্ছে ২০ টাকা।

গবেষণায় আরো উল্লেখ আছে, ওয়াসার পানির নিম্নমানের কারণে ৯৩ শতাংশ গ্রাহক বিভিন্ন পদ্ধতিতে পানি পানের উপযোগী করে। এর মধ্যে ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে বা সেদ্ধ করে পান করে। অন্য দিকে সাধারণ নাগরিকরা বিভিন্ন সময়ে ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ, ময়লা থাকার অভিযোগ করে আসছে।

জানা যায়, ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এখন পর্যন্ত পাইকারি পর্যায়ে ছয়বার এবং খুচরা বা গ্রাহক পর্যায়ে আটবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের নভেম্বরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়।

সাধারণ গ্রাহকপর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। ফলে গ্রাহককে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য ৭ টাকা ১৩ পয়সা পরিশোধ করতে হবে। আগে প্রতি ইউনিটের দাম ছিল ৬ টাকা ৭৭ পয়সা। পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট গড়ে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। আগে প্রতি ইউনিটের দাম ছিল ৪ টাকা ৭৭ পয়সা। মার্চ থেকে প্রতি ইউনিটের দাম হবে ৫ টাকা ১৭ পয়সা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম নয়া দিগন্তকে বলেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি গণশুনানির মাধ্যমে করা হয়। ফলে বৃদ্ধির যৌক্তিকতা ন্যায্যতা, অসঙ্গতি পাবলিকলি বলা যায়। কিন্তু পানির ক্ষেত্রে সেটা বলা যায় না। কারণ পানির মূল্য বৃদ্ধি অনেকটাই করা হয় একতরফাভাবে। সেটা যৌক্তিক নয়, বরং ভোক্তা অধিকারপরিপন্থী। যে পানি বিক্রি করে (ওয়াসা) সেই যদি নিজে নিজেই দাম বৃদ্ধি করে তা হলে এটি অন্যায় ও অবিচারের শামিল। এতে ভোক্তা অধিকার খর্ব হচ্ছে।

বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অযৌক্তিক ব্যয় ধরে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হয়েছে। কোনোভাবেই এটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সঠিক হয়নি। ভোক্তা সঠিক দামে বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। সে কারণে ভোক্তার অধিকার খর্ব হয়েছে। এতে ভোক্তা ন্যায়বিচার পায়নি।

বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব প্রসঙ্গে এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, এ দু’টির বিল তো বাড়বেই। পাশাপাশি অন্যান্য পণ্যের দাম আরো বেশি বৃদ্ধি পাবে। এতে ১৭ কোটি মানুষের কত ব্যয় বাড়বে সে হিসাব কোথাও নেই। এর ফলে হয়তো সরকারের তিন হাজার কোটি টাকা মিলবে। কিন্তু এর ফলে সরকারের রাজস্ব কমবে, ভ্যাট ও কর কমবে। এতে সরকার কতটা রাজস্ব হারাবে আর ভোক্তার কত ব্যয় বাড়বে তার কোনো হিসাবই আমাদের কাছে নেই। তবে তা তিন হাজার কোটি টাকার চেয়ে অনেক বেশি বাড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধির ফলে মানুষের নাভিশ্বাস সৃষ্টি হবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে, মানুষের জীবনযাত্রা আরো ব্যয়বহুল হবে। সাধারণ মানুষ ও দরিদ্র মানুষ আরো বেশি সমস্যার মধ্যে পড়বে।

তিনি বলেন, বারবার বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। এটা আমরা বলে আসছি কিন্তু সরকার তো কারো কথা শোনে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, বারবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করে সরকার রেন্টাল-কুইক রেন্টালে চার্জ দিচ্ছে। বিদ্যুৎ না কিনেও সরকার সেখানে ভর্তুকি দিচ্ছে। এসব মানুষের ওপর চাপাচ্ছে।

তিনি বলেন, সরকারের উচিত ছিল এসব (রেন্টাল-কুইক রেন্টাল) মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর নবায়ন না করা। সরকারকে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল থেকে সরে এসে বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রে যাওয়া উচিত। যত দিন তাদের ভর্তুকি দেবে, বিদ্যুৎ না কিনলেও দিতে হবে, মুক্তি মিলবে না। আর ছোট বিদ্যুৎ প্ল্যান্টে খরচ বেশি। বড় প্রকল্পে যাওয়া উচিত, যেসব বন্ধ হয়ে পড়ে আছে (সরকারি) সেগুলো চালু করা জরুরি। পানির মিটার এখনো অটোমেটিক না। পানি ফিল্টারে হচ্ছে। অনেক জায়গায় পানির দামই ঠিকমতো দেয় না। ফলে গড়ে পানির খরচ পোষাচ্ছে না।

এ কারণে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধি অযৌক্তিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসবের দাম সরকার বাড়াতে পারে না। বরং সরকারের নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আনা উচিত।

কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে- জানতে চাইলে আবু আহমেদ বলেন, যাদের ইনকাম নেই তাদের বেশি সমস্যায় পড়তে হবে। আর যারা দেশের বড় বড় ধনী হয়ে গেছে, লুটপাটের সাথে জড়িত তাদের তো কিছুই হবে না। হবে তো সাধারণ মানুষের, যাদের আয় নেই।

  • কার্টসি - নয়াদিগন্ত/ মার্চ ১, ২০২০ 

টাকা চলে যাচ্ছে, কোনো অ্যাকশন দেখছি না

আলতাফ হোসাইন

দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা থমকে গেছে। চলমান ধারা থেকে অনেক দূর পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ। দেশীয় সমস্যা ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জগুলো মিলে বাংলাদেশ দোলাচলের মধ্যে আছে। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের জন্য অর্থনীতিতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলো দেশের মানুষের জীবন-মানের উন্নয়ন। কিন্তু সরকারকে মেট্রোরেল, পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্পগুলোর দিকে বেশি নজর দিতে দেখা যায়। তবে এসব উন্নয়ন প্রকল্পের আড়ালে যেমন দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষার সার্বিক উন্নয়ন, সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের প্রতি সরকারের দৃষ্টি কম। তেমনি মানুষের জীবন মানের উন্নয়নের সঙ্গে এসব উন্নয়ন প্রকল্পের সামঞ্জস্যতা নেই।

ফলে মানুষের মধ্যে দিনদিন বৈষম্য বাড়ছে, মানুষের জীবন যাত্রায় হতাশা বাড়ছে, কিন্তু তাদের জীবনমান বাড়ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সালেহউদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, বড় বড় গ্রোথ পার্সেন্ট এসবতো উন্নয়ন নয়। ৮ দশমিক ৪ সরকারের যে হিসেবগুলো করা হচ্ছে, এতে সঠিকভাবে মানুষের জীবন মানের উন্নয়নের বিষয়টি কিন্তু প্রকাশ করে না। মানুষের মধ্যে দিনদিন বৈষম্য বাড়ছে, মানুষের জীবন যাত্রায় হতাশা কাজ করছে, তাদের জীবন মান অপেক্ষাকৃত ভালো বাড়ছে না। কিছু কিছু মানুষ আপনি দেখতে পারছেন যে, ঢাকায় বসে অনেকে পশ্চিমাদের লাইফ লিড করছে, আবার অন্যদের দেখেন তাদের কোন উন্নতি হচ্ছে না। তাদের সন্তানদের স্কুলে দিয়ে ভালো শিক্ষার মান পাচ্ছে না। এরপর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে দেখেন, যেটা দিচ্ছেন সেটা শুধু নামে মাত্র, স্বাস্থ্যে বাংলাদেশের মানুষদের সব চেয়ে বেশি খরচ হয়। এটা অত্যন্ত কষ্টদায়ক ব্যাপার। এভাবে শিক্ষা, কর্মসংস্থান সবখানে একই অবস্থা। সরকার থেকে বলা হচ্ছে, আমরা করছি, কিন্তু কী করা হচ্ছে দৃশ্যমান নয়। আপনি শিক্ষিত তরুণদের জন্য কী করছেন? যারা বেকার, চাকরি পাচ্ছে না তাদের জন্য কী করা হচ্ছে? যারা ব্যবসা করতে চায় তারা ফান্ড পাচ্ছে না। শুধু সামাজিক নিরাপত্তার উদাহরণ দিচ্ছেন কিন্তু সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কোথায়? সেটাতো হচ্ছে না, হবেও না। কারণ, অসমতা বা অসামঞ্জস্যতার যে কারণটা সেটাতো আগে দূর করতে হবে। যেমন ব্যাংকের ঋণ সবার কাছে তো যাচ্ছে না কিছু লোকের কাছে যাচ্ছে। তারপর যারা ব্যবসা করছে কিছু লোক সুযোগ পাচ্ছেন অন্যরা পাচ্ছে না। এরপর স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল এগুলো যাদের রাজনৈতিক প্রভাব আছে তারা করছে। সুতরাং দিনদিন যে অসমতার অবস্থা তৈরি করছেন সেখানে হঠাৎ করে উপর থেকে সমস্যা সমাধান হবে না। স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, যেকোন টেকসই উন্নয়নের পূর্ব শর্ত হলো গণতন্ত্র এবং সুশাসন। এটা ছাড়া কোন উন্নয়ন উন্নয়নই নয়। সেটাকে আমরা টেকসই উন্নয়ন বলতে পারবো না। হতে পারে কিছু উন্নয়ন কিন্তু গণতন্ত্র ও সুশাসন ছাড়া সেটা টেকসই হয় না। যেমন আর্জেন্টিনা, তারা ভালো একটি দেশ ছিলো কিন্তু টিকতে পারেনি, ব্রাজিলেরও একই অবস্থা। এখন অনেকেই চায়নাকে উদাহরণ দেয়। তাদের গণতন্ত্র আবার অন্যরকম। তারা অন্যভাবে জনগনের অংশগ্রহণ নিচ্ছে। সেটাও দেখবেন বেশ সুবিধা হবে না, আল্টিমেটলি তাদের ওপরে প্রভাব আসবে হয়তো সেটা এখন দেখবেন না। এরপর রাশিয়ায় উন্নয়ন হচ্ছিলো তারপর টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। এখন পুতিন ধরে রেখেছে, শক্তিশালী দেশ বলা যায় কিন্তু সেটাকে উন্নত দেশে বলা যাবে না। অর্থাৎ গণতন্ত্র ও টেকসই উন্নয়ন, এবং সমতাভিত্তিক উন্নয়ন হলো সামঞ্জস্যপূর্ণ। একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মানুষের যদি সরকারের প্রতি বিশ্বাস না থাকে, গণতন্ত্র যদি না থাকে তবে যেকোন সরকারের ভালো ইচ্ছাও শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয় না, বিদ্রোহ দেখা যায়। একটা উদাহরণ হয়েছে প্যারিসে, সেখানে সামান্য ফুয়েলের ওপর টেক্স বাড়িয়েছে। এটা সে দেশের জন্য কিন্তু তেমন কিছু না। অথচ এতে সেখানকার মানুষজন ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। একটি দেশে মেট্রোর ভাড়া বাড়িয়েছে, ভালোর জন্য ভাড়া বাড়িয়েছে তবুও সেখানে জনগণ বিদ্রোহ করছে। সে বিদ্রোহ মেট্রোর বিরুদ্ধে নয়, সরকারের বিরুদ্ধে। এরকম হংকংয়ে একটা উদাহরণ আছে। সরকারের ভালো ইচ্ছাও কিন্তু তারা নিতে পারছে না, বিদ্রোহ করছে গণতন্ত্র না থাকার কারণে। মূল বিষয়টা হলো, মানুষের জীবনের মান উন্নয়ন করছেন কি-না। আর এটা গণতন্ত্র ও সুশাসন ছাড়া কোনভাবেই পারবেন না। বলা হচ্ছে গণতন্ত্র আছে। তো কে বলেছে যে গণতান্ত্রিক সরকারের সুশাসন থাকবে না। গণতন্ত্র না থাকলেতো সুশাসন থাকবে কি করে। গনতন্ত্র নেই জন্যই সুশাসন নেই।

তিনি বলেন, এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন তখনই হবে যখন দারিদ্রমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানসহ সব ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। এমনভাবে ডেভেলপমেন্ট করবেন যাতে আপনার পরবর্তী প্রজন্ম সেই ফল ভোগ করতে পারে। কিন্তু এমন কোন আভাস দেখা যাচ্ছে না। আপনি চলে গেলে আপনার ভবিষ্যত প্রজন্ম কী করবে আপনি নিজেও তা জানেন না। কোন সুরক্ষা নেই, শুধু কিছু বিত্তবান লোক ছাড়া। আর এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য প্রচুর অর্থও লাগবে। কিন্তু বাংলাদেশে এতো অর্থ পাবে কি-না। অতএব আমি মনে করি, এসডিজির জন্য সবগুলো গোলের দিকে না গিয়ে বরং সামাজিক কতগুলো বিষয় আছে যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বৈষম্য দূর করা। সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি আয় বাড়ানো। এসব কাজগুলো আগে করতে হবে।

অন্যদিকে, আমাদের শুধু রেমিটেন্স আয় বাদে অন্য সবগুলো সূচক নিম্নমুখী। এখনো সময় আছে আমাদের এই সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আপনাকে সাধারণ মানুষের কনফিডেন্সও নিতে হবে। তাদেরকে বুঝিয়ে সবকিছু করতে হবে। সাধারণ মানুষ যেন বুঝে যে, এটা আমার ভালোর জন্য করা হচ্ছে। তাছাড়া কিন্তু সাধারণ মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। তারা জানেন না যে, তাদের জন্য কী করা হচ্ছে। মানুষ এখন উদাসিন, তারা রাস্তায় হেঁটে আর ব্যানার ফেস্টুনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদের মনের মধ্যে একধরনের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে, যেটা তারা প্রকাশও করতে পারে না। এমন হলেতো হবে না, কারণ মানুষই যদি আপনার সঙ্গে না থাকে যতো বড় সদিচ্ছাই থাকুক সেটা আপনি বাস্তবায়ন করতে পারবেন না।

২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার চিন্তা ছিলো সরকারের। চলতি অর্থবছরের সাড়ে সাত মাসেই সরকার ঋণ নিয়েছে ৫২ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। আর সব মিলিয়ে চলতি বছরের ১৬ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংক খাত থেকে নেয়া সরকারের পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৬০ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। এ বিষয়ে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাজেট বাস্তাবায়নের জন্য সরকার ঋণ নিয়ে থাকে। কিন্তু এবার যেটা হয়েছে যা টার্গেট হয়েছিলো তার চেয়ে অনেক বেশি দাঁড়িয়েছে। এর মূল কারণ হলো, রাজস্ব আয় কমে গেছে। একদিকে, আবার সরকারের খরচ বেড়ে গেছে। বিশেষ করে কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে যে খরচ, সরকারি কর্মকর্তাদের বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা দেয়া। এছাড়া বিভিন্ন কারণে সরকারের খরচ বেড়ে গেছে। এতে বিশেষ করে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে।

এর ফলে প্রাইভেট সেক্টরকে ব্যাংকগুলো যে ঋণ দেয় সেটার ক্ষমতা হ্রাস পাবে। অথচ প্রাইভেট সেক্টরই কিন্তু আমাদের গ্রোথ, প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে মূল চালিকা শক্তি। আর সরকারি বড় বড় মেগা প্রকল্পগুলো থেকে বেনিফিট আসতে অনেক সময়ের ব্যাপার, প্রায় ৫ থেকে ১০ বছররের আগে আসবে না। তো এরইমধ্যে যে ইম্পেক্ট পড়বে তাতে সব বেসরকারি খাতে ঋণ কমবে, কর্মসংস্থান কমে যেতে পারে, এছাড়াও মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ পড়বে। আর ব্যাংকাররাও দেখে যে কোন ঝামেলা ছাড়াই চুপচাপ বসে থেকেই সরকার থেকে সেটা রিটার্ন পাচ্ছে। শিল্প খাতে ঋণ দিতে ব্যাংকারদের তৎপরতা দেখা যায় না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, প্রাইভেট সেক্টরে ঋণের প্রবাহ কমে যাচ্ছে। অপরদিকে, আবার ডিপোজিট অনেক কমে যাচ্ছে। আর সরকারের সুদের হার যেটা এপ্রিল মাসে কার্যকর হবে কিন্তু ব্যাংকগুলো এখন থেকেই এটা প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকারদের ওপর যে চাপ পড়বে সেটা হলো তাদের যে প্রফিট রেট, ঋণ দেয়ার সক্ষমতা সেটা কমে যাবে।

তিনি বলেন, খেলাপি ঋণে ব্যাংকের যেটা হচ্ছে এখন যে পজিশনে আছে সেটা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। বলবো যে, ব্যাংকিং সেক্টরটা চরম দুরাবস্থার মধ্যে আছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া মানেই হলো- ব্যাংকের যে ঋণ আটকে গেছে, এই ঋণগুলো অন্য প্রডাক্টিভ খাতে গেলে আবার রিটার্ন আসতো। ব্যাংকের ইনকাম বাড়তো, যারা শেয়ার হোল্ডার তাদের ইনকাম বাড়তো।

বিদেশে টাকা পাচারের ব্যাপারে তিনি বলেন, কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে এতে বোঝা যাচ্ছে যে, আমাদের ব্যাংককিং সেক্টরে, আর্থিক খাতে সুশানের অভাব। এখানে যে নিয়মনীতিগুলো আছে সেগুলো পরিপালনের অভাবে এগুলো হচ্ছে এবং এখানে সুপারভিশন মনিটরিংয়েরও যথেষ্ট ঘাটতি আছে। না হলে দিনের পর দিন লোকজন নানা ভাবে এই টাকাগুলো নিয়ে যেতে পারতো না। আর টাকাগুলো নিয়ে যাচ্ছে জেনেও কিন্তু আমরা দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখছি না। শুধু দেখছি যে, কিছু লিস্ট বেরিয়েছে, কিছু নাম বেরিয়েছে কিন্তু এখানে বিশেষ করে বাংলাদেশ ফাইন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট আছে, এসিসি আছে, সিআইডিও এটি নিয়ে ডিল করে, এদের জানাও আছে কিছু কিছু যারা টাকা নিয়ে গেছে,  কিন্তু এদের ব্যাপারে কঠোর যে পদক্ষেপ নেয়া তা দৃশ্যমান নয়। এদেরকে ধরে ধরে শাস্তি দিতে হবে, কারণ শাস্তির বিকল্প কিন্তু কোন কিছু হয় না। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় তারা আরও নতুন করে উৎসাহ পায়। আর টাকা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারটা আরও কঠিন। এটা সরকারকে সচেষ্ট হতে হবে। মানি লন্ডারিং, ফাইন্যানন্স ফর টেররিজম, ফাইন্যান্স ফর প্রস্টিটিউশন, বোর্ডার স্মাগলিংসহ অনেক অপরাধ হয়। এগুলোর ব্যাপারে বাংলাদেশকে আমি দেখছি না, যে স্টেট টু স্টেট, এটা একদম ঢালাওভাবে ৫০ টি দেশের সঙ্গে করতে পারে না, ওয়ান টু ওয়ান পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু কোথায় বেশি যাচ্ছে- সিঙ্গাপুর, তখন তাদের সঙ্গে আলাপ, মালয়েশিয়াতে যাচ্ছে ওটা নিয়ে আমরা কোন অ্যাকশনই দেখছি না, আমেরিকাতে যাচ্ছে সেটার ব্যাপারে ব্যবস্থা দেখছি না, ইন্ডিয়াতে বহু টাকা চলে যাচ্ছে সেটার ব্যাপারে কোন অ্যাকশান দেখছি না। তো ওয়ান টু ওয়ান ব্যবস্থা নেয়া উচিত। একবারেই যে হচ্ছে না তা নয়, তবে সেগুলো খুব দুর্বল, একবার নিয়ে বসে থাকে তারপর আর কোন ফলোআপ অ্যাকশান নেয় না। 

তিনি বলেন, এইযে আমাদের নিজস্ব এতগুলো টাকা বিদেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এর বিশাল অংশ যেটা দিয়ে বিনিয়োগ করা যেতো, আর্থিক খাতে বিনিয়োগ করা যেতো সেটা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। একদিক থেকে আমরা অর্থ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি অন্যদিকে এই অর্থ দিয়ে বিনিয়োগ করে যে লাভ হতো, এ থেকে কর্মসংস্থান হতো সেটা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। সুতরাং দু’দিক থেকেই আমরা বড় ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছি। আর যখন বিদেশে টাকা পাচার হয়ে যায় তখন কিন্তু আমাদের গভর্নেন্স ইকোনমিক মনিটরিং সেটা সাধারণত দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন বাইরে থেকে যারা ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে আসতে যাবে তখন তারা সাবধানতা অবলম্বন করবে। আর আমাদের যে ভালো সৎ ব্যবসায়ী তারাও লেবেল প্লেইং ফিল্ডে কাজ করতে পারবে না। যারা স্থিথিশীল ব্যবসা চায়, ইন্ডাস্ট্রি চায় তাদের জন্য কিন্তু ব্যবসার পরিবেশ দিনদিন ডিফিকাল্ট হয়ে পড়ছে।

  • কার্টসি - মানবজমিন/ ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

Tuesday, February 25, 2020

দুষ্ট অর্থনীতির নষ্ট খেলোয়াড়েরা

ফারুক ওয়াসিফ
পাপিয়া আবিষ্কার কাহিনিতে একটি সংলাপ থাকা দরকার ছিল, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন, বস?’ চলমান রাজনীতি ও অর্থনীতির মিলনে যাদের সৃষ্টি, তাদের কেউ ক্যাসিনো সম্রাট আর কেউবা হোটেল সম্রাজ্ঞী পাপিয়া। খলসময়ের খলকাহিনি খল পার্শ্বনায়ক-পার্শ্বনায়িকা। মূল নায়ক-নায়িকা হতে এঁদের আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হতো। এঁদের অভিযাত্রা রোমাঞ্চকর, শ্বাসরুদ্ধকর এবং ঝুঁকিপূর্ণ। একজন প্রতিষ্ঠিত মাফিয়ার নেতা, এমপি, শিল্পপতি, বিজনেস ম্যাগনেটে পরিণত হওয়ার শেষ ধাপটা খুব বিপজ্জনক। তার আগেই অনেকে ঝরে যায়। ক্যাসিনো সম্রাট, জি কে শামীম, খালেদ বা পাপিয়ারা শেষ ধাপে আটকে গেলেন। এই পতন মাফিয়া মহলের ভেতরে চলতে থাকা তুমুল প্রতিযোগিতার ফল। 

একেকজন মাফিয়া ‘বস’কে ফুলে ফলে ফুটিয়ে তুলতে মোটামুটি পাঁচ বছর লাগে। এই কাহিনির প্রথম অধ্যায়ের সাক্ষী জেলা শহর। সেখানকার উঠতি যুব নেতা–নেত্রীরা প্রথমে দলের ছোট নেতা হয়ে ক্ষমতার নেটওয়ার্কে জড়ান। এই পদ দখলের প্রতিযোগী অনেক। ওপরের মহলের চাহিদা মেটানোর কলাকৌশল যার হাতে বেশি, তিন তত আগুয়ান। তারপর শুরু হয় পদ ধরে রাখার যুদ্ধ, টাকা বানানোর সার্বক্ষণিক সংগ্রাম। চালিয়ে যেতে পারলে এমপি-মন্ত্রী হওয়া যায়। একবার হয়ে গেলে আর ছোঁয় কে। ব্যর্থ হলে বিদেশে পালানোর চেষ্টা হয়। জায়গা নেন ‘বেগমপাড়ায়’। একবার বিদেশে পগারপার হতে পারলে চুপচাপ সঞ্চিত সম্পদ ভোগ করা আর দেশে ফেরার সুযোগের অপেক্ষায় থাকার গুণ এদের আছে। আজকের অনেক খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠিত নেতার অতীত এমনই। এই খেলাই চলছে হরদম হরদম। 

এরা কলঙ্ক নয়, এরাই অলংকার এই রাজনৈতিক অর্থনীতির। একজন পড়ে তো আরেকজন ওঠে। জোগান চলতেই থাকে। নিচ থেকে ওপরে সম্পদ ও সুযোগ দখলের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে এদের দরকার দুই কারণে। এঁরা কেন্দ্রে থাকা প্রতাপশালী ব্যক্তিদের নোংরা কাজগুলো করে দেন। তাঁদের অর্থ ও ক্ষমতার কারবারের যে রশি টানা আছে, এঁরা তার একেকটি গিঁট। আবার ওপর থেকে নিচের মহলে ক্ষমতা ও ইনাম বণ্টনের মাধ্যমও এরাই। 

নিয়মিত গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন যে দেশে পাকাপোক্ত সেই দেশে মাফিয়াচালিত রাজনৈতিক অর্থনীতি মূল খাত হয় না। বাংলাদেশে হয়, কারণ তেমন ‘ভালো’ গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের সুন্দর পরিবেশ এই দেশে আছে। ভঙ্গুর গণতন্ত্র ও দুর্বৃত্ত অর্থনীতি এই ধরনের ‘লিজেন্ড’ ‘গডফাদার’ ‘আম্মাজান’, ‘বড় ভাই’, ‘বস’, ‘দাবাং’ চরিত্রের উর্বর অভয়াশ্রম। বসবাসের অযোগ্য, চরম বৈষম্যপূর্ণ, নোংরা ও অপরাধে ভরা মহানগরগুলোতে এরা গড়ে তোলে শাদ্দাদের স্বর্গ, আলিশান প্রাসাদ। মজা ও মানিকে (অর্থ) একাকার করে ফেলার ওস্তাদি এখানেই জমে। 

গত এক দশকে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক রূপান্তর বাংলাদেশে ঘটেছে, তার আলো-আঁধারিতে এদের বিচরণ। অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের মতে, কালোটাকার পরিমাণ জিডিপির ৪২-৮০ শতাংশের মধ্যে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ সাড়ে ১৭ লাখ কোটি টাকা; যা তিনটি বাজেটের সমান। আর পুঞ্জীভূত কালোটাকার পরিমাণ ৩০ থেকে ৪০ লাখ কোটি টাকা; যা বর্তমানের দুটি জিডিপির সমান। আদর করে একে ইনফর্মাল ইকোনমি ডাকা হলেও আসলে তা ডাকাতির কারবার। সাম্প্রতিক বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি ও অর্থ পাচার কিংবা রানা প্লাজা ও হল–মার্ক কেলেঙ্কারিকেও এরা ছাপিয়ে যাচ্ছে। 

সমাজে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা যত বেশি ততই এদের মওকা বাড়ে। এদের ক্যারিয়ারে টাকার খেলাকে সঙ্গ দেয় নারী, মদ আর ফুর্তি। সাধারণত এদের পারিবারিক জীবন হিন্দি সিরিয়ালের মতো কুটিল এবং যৌনজীবন হয় বিকৃত। ভোটের রাজনীতিতে সম্ভাবনা বজায় রাখতে গ্রামেও এদের খুঁটি পোঁতা থাকে। দুর্বৃত্ত নেটওয়ার্ক তথা ‘ব্যবসায়িক সম্পর্ক’ তখন তাদের জয়ী করে। এসব চালাতে হলে তাদের থাকতে হয় আইনের ঊর্ধ্বে। আইনের লোকজনের সঙ্গে খাতির ছাড়া সেটা অসম্ভব। এরা রাষ্ট্রযন্ত্র ও দলীয় যন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজের অপরাধীকরণের লাঠিয়াল এরা। 

এরা গতিশীল, খোলস বদলাতে ওস্তাদ। নেতা থেকে ব্যবসায়ী, মাফিয়া থেকে এমপি, ব্যবসায়ী থেকে লাভজনক সংস্থার পদাধিকারী হওয়ার দৌড়ই এদের আত্মজীবনী। বিশ্বায়নের সুবাদে বিদেশে অবধি এদের দৌরাত্ম্য, অনেক সময় সেটাই ‘সেকেন্ড অপশন’। রাজনীতি ও অর্থনীতির নিত্যনতুন সুযোগ হাসিল করায় চেইন অব কমান্ড বজায় রাখতে হয়। সেখানে গড়বড় হলেই পতন। 

এটা এমন এক সময়, যখন এক প্রজন্মেই কেউ ধনকুবের হয়ে যেতে পারে অথবা এক প্রজন্মেই বাদশাহ হয়ে যান ফকির। অনেক সময় গোনা সম্ভব হয় না বলে এরা টাকা বা স্বর্ণ ওজন দিয়ে পরিমাপ করে। অস্থিতিশীলতার ভয়ে রূপকথার গল্পের কায়দায় বালিশের মধ্যে কিংবা গর্ত খুঁড়ে টাকা রাখে। রাতারাতি এরা বিদেশে বড় শহরে বিরাট বিরাট ভবন বা প্রাসাদ কিনে ফেলে, করমুক্ত টাকা রাখার জায়গা না পেয়ে অবিশ্বাস্য মূল্যের ঘড়ি, আংটি বা গাড়ি কেনে। আখেরে সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলার জাদু এরা জানে। এরা উদার, নরম মেরুদণ্ডের আদর্শহীন অভিযাত্রী। এরা দেখনেওয়ালা নয়, এরা করনেওয়ালা। তাই জনতা ও ক্ষমতার কাছে এরা দরকারি। টাকা বানাবার শিল্পকে এরা বসগিরির শিল্পে পরিণত করে। ফেসবুকে ভেসে বেড়ানো পাপিয়ার হাতের লাঠি সেই বসিংয়ের একটা প্রতীক। ভারতের ‘লেডি দাবাং’ পার্তিয়ালা রবির সঙ্গে তুলনা চলে তাঁর। 

বাংলাদেশের উন্নয়ন সত্যি সত্যি হচ্ছিল। একজন মানুষ এখানে পিঁপড়ার মতো ৮-১০ জনকে বহন করে যান, চাকরি বা কাজের জোগান দেন অনেকের। একজন প্রবাসী শ্রমিক, কিংবা একজন ছোট খামারি বা ব্যবসায়ী কিংবা ক্ষুদ্র শিল্পের মালিক এবং সমাজসংস্কারক ও প্রতিবাদীরা ছিলেন এই গল্পের নায়ক-নায়িকা। পরিশ্রম ও বুদ্ধি করে এক প্রজন্মে অবস্থা ফেরানোর আত্মবিশ্বাস অনেককেই উচ্চাভিলাষী করে তুলেছিল। তার সুফল দেশ পেয়েছে। তাদের হটিয়ে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী পাপিয়ারা। এরা একজনে লক্ষজনের সুযোগ ও সম্পদ আত্মসাৎ করে উন্নয়নের চাকাটাকে সত্যিই ভেঙে ফেলছে। ক্ষমতা ও বিত্ত হাতানোর এই ‘গোল্ড রাশ’ কতটা ভয়াবহ, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান ও রাজনৈতিক চালচিত্র তা হাড়ে–মাংসে বুঝিয়ে দিচ্ছে। 

এরা বিচ্ছিন্ন কেউ নয়, এরা দুষ্ট অর্থনীতির নষ্ট নায়ক-নায়িকা। জনগণ এখানে পার্শ্বচরিত্রও নয়, ভুক্তভোগী দর্শকমাত্র। 

  • ফারুক ওয়াসিফ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
  • কার্টসি - প্রথম আলো/ ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২০ 

নয়া সম্রাট ও নয়া সম্রাজ্ঞী বা পাপিয়া-কাহিনি

সোহরাব হাসান

বাংলাদেশ হলো খবরের কারখানা। যাঁরা মনে করেন দেশে রাজনীতি নেই বলে খবরও নেই, তাঁরা ভুল করেন। প্রতিদিনই নতুন নতুন খবর পাওয়া যায়। আগের খবরটি থেকে পরের খবরটিতে আরও বেশি চমক থাকে।

গত বছর সেপ্টেম্বরে যখন ক্যাসিনো-রাজা ইসমাইল হোসেন সম্রাট ধরা পড়লেন, তখন অনেকেই অবাক হয়েছিলেন, নিষিদ্ধ ক্যাসিনোর দেশে ক্যাসিনো-সম্রাট। তিনি আবার যুবলীগের নেতাও। এরপর আরও ক্যাসিনো-মোগল ধরা পড়লেন। কিন্তু কয়েক দিন পরই আবিষ্কৃত হলো বাংলাদেশে শুধু ক্যাসিনো-সম্রাট নেই, টেন্ডার-সম্রাটও আছেন। এক জি কে শামীম সরকারের গণপূর্ত বিভাগের প্রায় অর্ধেক কাজ বাগিয়ে নিয়ে গেছেন। এ কারণে সরকারের মন্ত্রী-নেতাদের সঙ্গে তাঁর দহরম-মহরমের কথাও চাউর হয়ে যায়। পরে আরও জানা গেল, কেবল আওয়ামী লীগ সরকার নয়, বিএনপির সরকারের হোমরাচোমরাদের সঙ্গেও তাঁর দারুণ মহব্বত ছিল। সরকার বদলায়, এঁরা বদলান না। সে সময়ে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে বাহবা নেওয়ার চেষ্টা করেছিল সরকার। বলা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগকে এবার তারা পূতপবিত্র করে ছাড়বে।

কিন্তু পাঁচ মাস না যেতেই ক্ষমতাসীনদের ডেরা থেকে আরেক সম্রাজ্ঞী আবির্ভূত হলেন। তাঁর কাহিনি অতীতের যেকোনো রোমাঞ্চকর কাহিনিকে ছাড়িয়ে যাবে। আমরা আরব্য উপন্যাসে নানা অবিশ্বাস্য কাহিনির কথা শুনেছি। সেখানে দৈত্যদানো, রাজা-রানির বিচিত্র ঘটনা দেখে যাঁরা বিস্মিত হতেন, তাঁরা বাংলাদেশের নতুন সম্রাজ্ঞী শামীমা নূর পাপিয়ার কাহিনি দেখে ভিরমি খাবেন। আরব্য উপন্যাস হাজার বছর আগের। আর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশে যে সম্রাজ্ঞীর কাহিনি বের হলো, তার কাছে আরব্য উপন্যাস কিছুই না। কেননা, আরব্য রূপকথাকে আমরা রূপকথা হিসেবেই জানি।

কিন্তু বাংলাদেশের সম্রাজ্ঞীর কাহিনি কোনো রূপকথা নয়; নিরেট বাস্তব। পত্রিকায় ও সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে তাঁর যেসব ছবি প্রকাশিত হয়েছে, তার কোনোটিতে দেখা যায় তিনি চুল উঁচু করে বেঁধে নরম সোফায় লাঠি হাতে বসে আছেন। আবার কোনো ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। 

গত শনিবার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পাপিয়া (২৮), তাঁর স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমন (৩৮), তাঁদের সহযোগী সাব্বির খন্দকার (২৯) ও শেখ তায়্যিবা (২২) গ্রেপ্তার হন। র‍্যাবের দাবি, তাঁরা পালিয়ে যাচ্ছিলেন।

তাহলে কি কোনো মহল তাঁকে বিদেশে পার করে দেওয়ার চেষ্টা করছিল? না হলে যে সম্রাজ্ঞী পাঁচতারা হোটেলে মাসের পর মাস থাকতেন, তাঁকে ধরতে বিমানবন্দর পর্যন্ত যেতে হলো কেন?

গ্রেপ্তারের পর পাপিয়াকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুব মহিলা লীগ। যেন এত দিন পাপিয়ার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তারা কিছুই জানত না। হঠাৎ তাদের হুঁশ ফিরে এসেছে। এ রকম ঘটনা ঘটেছে ক্যাসিনো-সম্রাট ও অন্যদের ক্ষেত্রেও। যখনই দেখা যায় ক্ষমতাসীন সংগঠনের কোনো নেতা বা সদস্যের অপকর্ম ফাঁস হয়ে গেছে, তখনই সংগঠন তাঁকে বহিষ্কার করে।

র‍্যাব-১-এর অধিনায়ক শাফিউল্লাহ বুলবুল জানিয়েছেন, পাপিয়া জাল টাকা, অবৈধভাবে টাকা পাচার, অবৈধ অস্ত্র রাখাসহ বেশ কিছু অপরাধ করেছেন। পাপিয়া পাঁচ তারকা মানের বিভিন্ন হোটেলে নারীদের দিয়ে অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতেন বলে অভিযোগ করেছে র‍্যাব। ওই সব কর্মকাণ্ডের কিছু ভিডিও পাওয়া গেছে। এত সব অপরাধের জড়িত থাকার পরও নাকি পাপিয়ার নামে কোনো মামলা হয়নি। তিনি বিমানবন্দরে ধরা না পড়লে হয়তো যুব মহিলা লীগ তাঁকে সৎ ও সাচ্চা কর্মী হিসেবে সার্টিফিকেট দিত। পত্রিকায় রিপোর্ট হলে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে হইচই করে উঠত।

এবার দেখা যাক একটি জেলা কমিটির যুবলীগ নেত্রী কী কী সম্পদের মালিক হয়েছেন। একটি পাঁচ তারকা হোটেলে বুকিং দেওয়া বিলাসবহুল প্রেসিডেনশিয়াল স্যুইট এবং ইন্দিরা রোডের ফ্ল্যাট থেকে র‍্যাব ১টি বিদেশি পিস্তল, ২টি পিস্তলের ম্যাগাজিন, ২০টি পিস্তলের গুলি, ৫ বোতল দামি বিদেশি মদ, ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা, ৫টি পাসপোর্ট, ৩টি চেকবই, কিছু বিদেশি মুদ্রা, বিভিন্ন ব্যাংকের ১০টি ভিসা ও এটিএম কার্ড উদ্ধার করে। র‍্যাব জানায়, পাপিয়া ও তাঁর স্বামীর মালিকানায় ইন্দিরা রোডে দুটি ফ্ল্যাট, নরসিংদীতে দুটি ফ্ল্যাট ও ২ কোটি টাকা দামের দুটি প্লট, তেজগাঁওয়ে এফডিসি ফটকের কাছে গাড়ির শোরুমে ১ কোটি টাকার বিনিয়োগ ও নরসিংদী জেলায় একটি প্রতিষ্ঠানে ৪০ লাখ টাকার বিনিয়োগ আছে।

অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অনৈতিক কর্মকাণ্ড, জাল নোট সরবরাহ, রাজস্ব ফাঁকি, অর্থ পাচারসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। র‌্যাব বলছে, গত ১২ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে এই দম্পতি পাঁচ তারকা হোটেলের কয়েকটি বিলাসবহুল কক্ষে অবস্থান করেন। এ জন্য তাঁরা পরিশোধ করেন ৮১ লাখ ৪২ হাজার টাকা। এই অর্থের উৎস সম্পর্কে সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি এই দম্পতি।

২০১০ সালে নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক করা হয় পাপিয়াকে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে তাঁকে জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। নরসিংদীর মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল সমকালকে বলেন, পাপিয়াকে যুবলীগ নেত্রী বানানোর সময় স্থানীয় নেতা-কর্মীরা বিরোধিতা করেছিলেন। তবে কেন্দ্রীয় নেতারা তা আমলে নেননি। কাউন্সিল শেষে এলাকায় নয়, পাপিয়ার নাম ঘোষিত হয় ঢাকা থেকে।

শামীমা নূরকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘অপরাধ অনুযায়ী অপরাধী শাস্তি পাবে। সরকার দলের হোক কিংবা বাইরের হোক, কোনো অপরাধীকে পার পেয়ে যেতে দেয়নি। সব অপরাধীকেই বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। পাপিয়ার পরিচয় যেটাই হোক, অপরাধী হিসেবে এবং অপরাধ অনুযায়ী বিচার হবে।’ কিন্তু তিনি যে কথাটি বলেননি, তা হলো পাপিয়ারা কীভাবে তৈরি হন। কারা তৈরি করেন? তাঁদের কাছ থেকে কারা, কী সুবিধা নিয়েছেন।

আমরা ছোটবেলায় ‘লাইলি-মজনু’ ছবি দেখেছি। পরে এসেছে, ‘নয়া লাইলি নয়া মজনু’। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও নয়া সম্রাট ও নয়া সম্রাজ্ঞীদের আবির্ভাব ঘটে চলেছে। যে রাজনীতি সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীদের তৈরি করে, সেই রাজনীতিকে শুদ্ধ করতে না পারলে এ রকম লোকদেখানো অভিযানে কোনো কাজ হবে না। একজন সম্রাট বা সম্রাজ্ঞী ধরা পড়বে। হাজারো সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে।

সহকর্মী ফারুক ওয়াসিফ কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছিলেন, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’ তাঁর বক্তব্যটি আরেকটু সংশোধন করে বলতে হয়, এত দিন তাঁকে কোথায় রেখেছিলেন?

  • সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
  • কার্টসি - প্রথম আলো/ ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২০ 

Saturday, February 22, 2020

পদকের অবনমন!

সাখাওয়াত সায়ন্ত

১৯৯৫ সালে একুশে পদক প্রাপ্ত বিশিষ্টজনের সাথে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ফেব্রুয়ারি ২০, ১৯৯৬, পদক প্রধান করা হয়, 

’৫২-এর ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য একুশে পদক এবং ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা, জনসেবা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সঙ্গীত, খেলাধুলা, শিল্পকলা, উন্নয়নসহ ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষ অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারও চালু করেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম।

১৯৭৬ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান চালু করেন একুশে পদক। তাঁর সময়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ড. মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদা, কবি সুফিয়া কামাল, সাহিত্যিক সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দিন, সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, কবি শামসুর রাহমান, সঙ্গীতশিল্পী আবদুল আলীম, লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, শিল্পী আলতাফ মাহমুদ, কবি আহসান হাবীব, শিল্পী আবদুল লতিফ, সাহিত্যিক আবুল হোসেন, চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর, সাহিত্যিক রাহাত খানসহ অনেককে সম্মানিত করা হয় একুশে পদক দিয়ে।

বিএনপি সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে বেগম খালেদা জিয়ার সময়ে সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, সাংবাদিক আতাউস সামাদ, লেখক আহমেদ রফিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ, শিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী, শিক্ষাবিদ ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসহ আরো অনেককে এ পদকে ভূষিত করে সম্মানিত করা হয়।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার হলো ‘স্বাধীনতা দিবস’ পুরস্কার। আজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা এ পদক পেয়ে গর্বিত হচ্ছেন তারা কি জানেন, শহীদ  জিয়াই এ পদক চালু করে তাদের সম্মানিত করার ব্যবস্থা করেছিলেন?

১৯৭৭ সালে প্রথমবারের মতো দেয়া হয় এ পদকটি। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তার সময়েই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ডা: মোহাম্মদ ইব্রাহীম, শিল্পী রুনা লায়লা, কবি জসীমউদ্দীন, কবি শামসুর রাহমান, রণদা প্রসাদ সাহা, সঙ্গীতজ্ঞ সমর দাস, সাহিত্যক আবুল মনসুর আহমদ, প্রফেসর কাজী মোতাহার হোসেন, শিল্পী ফিরোজা বেগম, চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান, শহীদ মুনীর চৌধুরী, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, কবি ফররুখ আহমদসহ অনেক গুণীজনকে এ পদক দিয়ে সম্মানিত করেন।

১৯৯১ সালে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সময়েও অনেক গুণীজন ও প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনতা দিবস পদক দিয়ে তাদের অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সম্মান দেয়া হয়। এদের মধ্যে রয়েছেন জহির রায়হান, আর্টিস্ট এস এম সুলতান, কবি আহসান হাবীব, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদসহ অনেকে। প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও প্রামীণ ব্যাংকসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

পদকপ্রাপ্ত এসব ব্যক্তির নাম দেখলেই বোঝা যায় প্রকৃত গুণীজনদের সম্মানিত করার ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয়কে কখনোই প্রাধান্য দেননি প্রেসিডেন্ট জিয়া কিংবা বেগম খালেদা জিয়া।
কিন্তু বর্তমানে কী হচ্ছে?

দু'টি ক্ষেত্রেই প্রশ্ন উঠেছে। এমন সব ব্যক্তিদের পদক/পুরস্কার দেওয়া হয়েছে যে তাদের সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক পর্যন্ত চিনেন না। বিশেষ করে সাহিত্যে।

তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, এই পদক/পুরস্কার দু'টি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রবর্তন করেছিলেন বলেই কী তাকে এই ভাবে অবনমন করা হচ্ছে?

আওয়ামী লীগ কোন ক্ষেত্রেই দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না এটা হয়তো সবারই জানা। কিন্তু তাদের দলীয় গণ্ডিতে কী যোগ্য লোকের এতোই অভাব পড়েছে যে অখ্যাত অজানা লোক যাদের কী সাহিত্য কর্ম আছে তা সাহিত্য- সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত প্রায় কেউই জানেন না?
একুশে পদক ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারের মতো উঁচুমানের জায়গাটাকেও এভাবে অবনমন সত্যিই মানা যায় না!

Thursday, February 20, 2020

খালেদা জিয়ার জামিন কোন পথে

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ


এক-এগারোর বিশেষ সরকারের সময় দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দুই প্রধান নেত্রীর নামেই মামলা হয়েছিল। জেলে যেতে হয়েছিল দুজনকেই। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নামে ৫টি ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নামে ১৫টি মামলা হয়ে ছিল তখন। সেই বিশেষ সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে যে বিশেষ নির্বাচনটি হয়েছিল তাতে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তখন থেকেই বাড়তে থাকে খালেদা জিয়ার নামে মামলার সংখ্যা। ৫ মামলা বেড়ে হয়ে যায় ৩৬টি। আর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে থাকা ১৫টি মামলা খারিজ হয়ে যায় বা বাদী প্রত্যাহার করে নেন। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও সরকারের সমর্থকদের সরলীকরণ বক্তব্য, শেখ হাসিনার মামলাগুলো আদালতের মাধ্যমে আইনানুগভাবে ফয়সালা হয়েছে।

তাদের কাছে এবং দেশাবাসীর কাছে যদি আরও দুটি সরল প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়, তবে তার উত্তর কী হতে পারে? এক. এক-এগারো সরকার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো করেছিল তার সবগুলোই মিথ্যা, অপরদিকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে মামলা করেছিল তার সবগুলোই ঠিক ছিল? দুই. ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এসে যদি বিএনপি আসত আর খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হতেন তাহলেও কী দুই নেত্রীর মামলার পরিণতি এখন যা হয়েছে তাই হতো? মানে প্রধানমন্ত্রী হলেও খালেদা জিয়ার এখনকার মতোই সাজা, জেল, পছন্দমতো সেন্টারে চিকিৎসা না পাওয়া- এগুলোই ঘটত? আর শেখ হাসিনার নামে থাকা সব মামলা ‘আইনানুগ ভাবেই’ খারিজ হয়ে যেত অথবা বাদীরা নিজ উদ্যোগে মামলা তুলে নিতেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের মধ্যেই নিহীত আছে বাংলাদেশের আদালতের প্রতি জনমানুষের আস্থার মানদন্ড। এ দেশে রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে আদালতের রায়ের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, সেটাও বেরিয়ে আসবে এই প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমেই। এইবার উত্তরগুলো সৎভাবে দিয়ে নিজের বিবেকের সঙ্গে মিলিয়ে নিন। তারপর বলুন, খালেদা জিয়া প্রতিহিংসার শিকার কি না? একদেশে এক আইন সবার বেলায় একভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কি না সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।

আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক দুর্নীতির দায়ে ১৩ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পরও জামিন পেতে পারেন, মন্ত্রী থাকতে পারেন। সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক বিএনপি নেতা অধুনা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য তৈরি করা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাও সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পর জামিন পেতে পারেন। জাতীয় পার্টির সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জীবিত থাকাকালে আমৃত্যু জামিন ভোগ করে যেতে পারেন। কিন্তু খালেদা জিয়া বারবার আবেদন করেও জামিন পান না। এই যে এক আইনে বিচারের দুই ফল, সেটাই অনেকের মনে এই ধারণা দেয় যে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন বিশেষ কারণে সুতোর টানে আটকে আছে। আর তার পেছনে আছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পরও অনেকে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারেন। কিন্তু গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পরও খালেদা জিয়া সে অধিকারটুকুও পান না।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে তার উদ্দেশ্য নিয়ে জনমনে আছে অনেক প্রশ্ন। সে মামলার বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সেক্রেটারি সাংবাদিক মারুফ কামাল খান লিখেছেন, এই যে এত হেনস্তা যে মামলাটি নিয়ে সেই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার কখনো কোনো ধরনের কোনো সম্পর্কই ছিল না। তিনি এই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান, মেম্বার, ট্রাস্টি কিছুই নন।

ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন জামানায় দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক এ মামলাটি দায়ের করে। মামলায় প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা অভিযোগের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার কোনো রকম সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি বলে রিপোর্ট দেন। তিনি আদালতে তার সাক্ষ্যেও সে কথা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীকালে অধিকতর তদন্তের নামে দুদকের আরেকজন কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই কর্মকর্তা মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকেও অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেন। কুয়েত থেকে পাওয়া অনুদানের অর্থে গঠিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের প্রাথমিক মূলধন ছিল ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫শ টাকা। এই টাকা থেকে বগুড়ায় এতিমখানা স্থাপনের জন্য প্রায় পৌনে তিন একরের বেশি জমি কেনার পর বাকি সমুদয় টাকা ট্রাস্টের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রাখা হয়। সরকারি ব্যাংকের তুলনায় বেসরকারি ব্যাংকে সুদের হার বেশি হওয়ায় ট্রাস্টের টাকা বেসরকারি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। তিনটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সেই টাকা জমি কেনার পরেও সুদাসলে বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৮৮ লাখ ২৫ হাজার টাকারও বেশি।

তারপরেও খালেদা জিয়ার সাজা হয়েছে। প্রথমে পাঁচ বছর। পরে তা বেড়ে দশ বছর হয়েছে। আগেই বলেছি, এর থেকে বড় সাজা নিয়েও অনেকের জামিন পাওয়ার নজির আছে। কিন্তু খালেদা জিয়ার বেলায় ভিন্ন ফয়সালা। কেন এমনটা হচ্ছে সে প্রশ্নই জেগেছে মানুষের মনে।

খালেদা জিয়া কে, তা নতুন করে চিনিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রথমত তিনি এই দেশের একজন সিনিয়র সিটিজেন বা প্রবীণ নারী। তিনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। দেশের জনপ্রিয়তম শীর্ষ রাজনৈতিক নেত্রী যিনি জীবনে কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি। দেশের অন্যতম একটি রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রধান। এই দেশেরই সাবেক রাষ্ট্রপতি, সাবেক সেনাপ্রধান, সেক্টর কমান্ডার ও একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী। তিনি আজ বন্দি অবস্থায় গুরুতর অসুস্থ। তারপরও তিনি কেন জামিন পান না? তিনি কি জামিন পেলে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারেন? তিনি এই মামলাকে প্রভাবিত করতে পারেন? খালেদা জিয়া যে তেমন ব্যক্তি নন এটা সেটাও বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে তাকে জামিন দিতে অসুবিধা কোথায়, সে প্রশ্নটি এখন দেশের প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, খালেদা জিয়ার এই সব পরিচয়ের কোনোই মূল্য নেই আদালতের কাছে। জামিনের জন্য এর কোনো উপাদানই আমলযোগ্য নয়। কিন্তু আইন বিষয়ে দীর্ঘদিন লেখালেখি করা সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান দুদিন আগেই প্রথম আলোতে লিখেছেন, ‘বিদ্যমান আইন বলছে, নারী, বিশেষ করে তিনি যদি প্রবীণ নাগরিক হন এবং তার স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে, তাহলে তিনি জামিন পেতে বিশেষ বিবেচনার হকদার।’ 

তাহলে কেন প্রাপ্য হক থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এই প্রবীণ রাজনীতিবিদকে? এই দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে খালেদা জিয়ার যে সাহসী ভূমিকা রয়েছে সেটাও কয়জন নেত্রীর আছে? খালেদা জিয়ার মুক্তি মিলবে কি না আর মিললে তা কী পদ্ধতিতে ঘটবে সেটাই এখন দেশজুড়ে আলোচনার বিষয়। সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, তারা চান খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তির জন্য আবেদন করুন। খালেদা জিয়ার অসুস্থতার মাত্রা ও জনআকাক্সক্ষা বিবেচনায় যদি মুক্তি দিতেই হয়, সে ক্ষেত্রেও সরকার যেন দেখাতে পারে যে তাদের অনুকম্পা নিয়ে, তাদের সঙ্গে আপোস করেই জামিন নিতে হয়েছে তাকে। অর্থাৎ খালেদা জিয়া আর আপোসহীন নন, তিনি আপোসকামী নেত্রী।

অনেকেই মনে করেন, তার জন্য কাল হয়েছে অপরাজিত জনপ্রিয় ও ‘আপোসহীন নেত্রী’ অভিধাটি। খালেদা জিয়া ‘আপোসহীন নেত্রী’ উপাধি নিয়ে থাকবেন সেটা মেনে নেওয়া অনেকের জন্য কষ্টকর হতেই পারে। তাই তারা চান, খালেদা জিয়া যেন প্যারোলে মুক্তির জন্য আবেদন করেন। যাতে তারা বলতে পারেন যে ‘আপোসহীন নেত্রী’ তো আপোস করলেন। তাই বিএনপির একটা অংশ প্যারোলে মুক্তি চাওয়ার বিরুদ্ধে। কিন্তু তাদেরও মনে রাখা দরকার, খালেদা জিয়াকে সুচিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখাটাও জরুরি। তাকে সাজা দিয়ে যদি আটকে রেখে, চিকিৎসার সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে, তবে যে কোনো কৌশল অবলম্বন করে সে ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এলে তাতে আপোসহীন চরিত্র ক্ষুণ্ণ হয়ে যাবে এমনটা ভাবারও কোনো কারণ নেই। প্যারোলে মুক্তি তো এর আগেও নিয়েছেন দুই নেত্রীই। সুতরাং প্যারোল বা আদালতে আবেদনের মাধ্যমে মুক্তি নিয়ে চিকিৎসা করানো হলো সেটা বড় বিষয় নয়। বরং শঙ্কাটা অন্য জায়গায়। প্যারোলে মুক্তির আবেদনের পর এই সরকার সেটা নিয়ে আবার কোনো নাটক ফেঁদে বসবে কিনা সেটাই বা কে জানে। শেষ পর্যন্ত প্যারোলেও মুক্তি হবে নাকি খালেদা জিয়াকে জেলেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হবে সে প্রশ্নও অনেকের মনে আছে।        

  • লেখক- চিকিৎসক ও কলামিস্ট
  • কার্টসি - দেশ রূপান্তর/ ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২০

Wednesday, February 19, 2020

একজন খালেদা জিয়া

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও মুজতবা খন্দকার


বেগম খালেদা জিয়া 



একজীবনে একজন মানুষের যা কিছু পাওয়ার থাকে,সব তিনি পেয়েছেন। গৃহবধূ  থেকে দেশের সরকার প্রধান।  কি আর থাকে বাকি! নির্বাচন যদি একজন রাজনীতিকের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের মাপকাঠি হয়ে থাকে, তবে নি:সন্ধেহে তিনি সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। কোনো নির্বাচনে তিনি হারেননি। জনগন তাকে সব সময় বসিয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ আসনে। জনগনকে কিছুমাত্র কমও দেননি তিনি। হেঁসেল থেকে রাজপথে তপ্তরোদকে উপেক্ষা করে দীর্ঘ নয়বছর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। পেয়েছেন, আপোষহীন রাজনীতিকের সুখ্যাতি। সরকার গঠন করে, নারী প্রগতির জন্য গ্রহন করেছেন এক একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। নারী শিক্ষা বাধ্যতামূলক,  বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা সবই তাড় হাত ধরে সূচিত হয়েছে,এই দেশে। রাষ্ট্রের যা কিছু ভালো,কল্যানকর সবই তার সুযোগ্য নেতৃত্বেই এসেছে।

জীবন সায়ান্বে এসে, তিনি কথিত চোরের অপবাদ নিয়ে বন্দি জীবন কাটাতে হচ্ছে তাঁকে। উপযুক্ত চিকিৎসা সেবাও দেয়া হচ্ছেনা তাকে। ধীরে ধীরে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন,অথচ আমরা সবাই কেমন নির্বিকার। তাকে জামিনে মুক্তি দেয়া হবে কি না, তা নিয়ে পুতুল খেলায় মেতে উঠেছে সরকার। যারা তার তিল পরিমান সমালোচনার যোগ্যতা রাখেনা, তারাই এখন সকাল বিকাল তাকে নিয়ে মশকরা করছে। যারা লুটপাট করে,দেশকে ফতুর করে দিয়েছে, তারাই এখন তাকে চোর বলতেও কসুর করছেনা। সবই তার ট্রাজেডি।  প্রতিহিংসারর রাজনীতি করেননি কখনো, রিকনসিলিয়েশনের কথা বলতেন, অথচ তাঁকেই চরমপ্রতিহিংসার শিকার হতে হয়েছে। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতা হয়েও.  তার কারবন্দিত্বের অবসানে তার দল কাতর মিনতি ছাড়া আর কার্যত কিছুই করতে পারছেনা। মূলত: দলটির নেতৃত্বভাগের অযোগ্যতা এবং দূরদর্শীতার অভাব তার বন্ধিত্বকে প্রলম্বিত করে চলছে।

বেগম জিয়ার ওপর প্রতিশোধ নেয়া কি শেষ হবে না। সম্ভবত না। তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করাই যেন শাসকদলের ইচ্ছা। বলা হচ্ছে, তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দেয়া হতে পারে, যদি তিনি চান। তাঁরা বলছে,প্যারোলে মুক্তি মানে খালেদা জিয়ার রাজনীতিক মৃত্যু। অথচ, তাঁরা জানেনা, খালেদা জিয়ার মৃত্যু নেই, খালেদা জিয়ার ইতিহাসে অমরত্বের আসন আগেই নিশ্চিত হয়ে গেছে। আর প্যারোল মানে যদি রাজনৈতিক মৃত্যু হয়, তবে শেখ হাসিনার সে মৃত্যু হয়েছে বহু আগে, ওয়ান ইলেভেনের সময়, যে সময় তিনি প্যারোলে মুক্তি পেয়ে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন।

প্রত্যেক মানুষকেই একদিন মরতে হবে। কিন্তু বেগম জিয়ার মৃত্যু নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের যতসব অয়োজন দেখে দু:খের মধ্যেও কৌতুকবোধ করছি। একজন মানুষকে এত ভয়, এত পরোয়া ওদের!
ভুলে যাই আমরা, একটি প্রতিহিংসা হাজারটা প্রতিহিংসার জন্ম দেয়... এক মাঘে শীত যায়না... তাই একজন খালেদা জিয়াকে মৃত্যু নিশ্চিত করে রাজনীতির মাঠ নিষ্কন্টক করার স্বপ্ন হয়তো দিবাস্বপ্নই থেকে যাবে ওদের। খালেদা জিয়া এখন শুধু একজন মানুষের নাম নয়, অটোক্রেটিক সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিয়োজিত সকল বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণাও বটে!

দুই

খালেদা জিয়া ১৯৭১ সালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অন্তরীণ
২০১৮ তে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে কারাবন্দী


বাঙালি কমান্ডো মেজর জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম আসেন, সাথে সুন্দরী স্ত্রী খালেদা খানম পুতুল ও দুই শিশু সন্তান পাঁচ বছর বয়সী তারেক রহমান (জন্ম — নভেম্বর ২০, ১৯৬৫) ও ৭ মাসের আরাফাত রহমান কোকো (জন্ম — আগস্ট ১২, ১৯৭০)। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে মেজর জিয়াউর রহমানের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর তার আর কোয়ার্টারে ফেরা সম্ভব হয়নি, সাথের সেনানীদের নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছিল। অন্য বাঙালি সেনানীদের পরিবারের মতো ক্যান্টনমেন্টে রয়ে গেল মেজর জিয়ার পরিবার-পরিজনও। পাকিস্তানি সৈন্যরা চট্টগ্রাম দখল নিলে, বাঁচার তাগিদে দুই শিশুসন্তান নিয়ে প্রায় দেড় মাস চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করার পর অতর্কিতে একদিন কালো বোরকা পরে সপুত্র খালেদা খানম পুতুল মোটরলঞ্চে চট্টগ্রাম ছেড়ে মে ১৬,  ১৯৭১ নারায়ণগঞ্জ পৌঁছেন [ সূত্র — মাহফুজউল্লাহ, ‘ Begum Khaleda Zia- Her life, Her History , দি ইউনিভারসাল একাডেমি, ঢাকা ২০১৮] । সেখান থেকে বড়বোন খুরশীদ জাহান ও ভগ্নিপতি মোজাম্মেল হক একটি রেডক্রস চিহ্নিত জিপে করে তাদের ঢাকায় এনে ধানমণ্ডিতে এক বন্ধুর বাড়িতে প্রায় দুই সপ্তাহ বসবাসের ব্যবস্থা করেন। একই সময়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা, এ কে এম আহসান CSP-এর বাড়িতে অন্তরীণ ছিলেন। পরে খালেদা সপুত্র ক্ষুদ্রঋণের উদ্ভাবক কুমিল্লা একাডেমির মহাপরিচালক আখতার হামিদ খান ICS-এর যোগ্য সহকারী ম্যাগসাইসাই পুরস্কারপ্রাপ্ত গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি তাহেরুন্নেছা আবদুল্লাহর স্বামী পাকিস্তান জিওলজিক্যাল সার্ভের পরিচালক ভূতত্ত্ববিদ এম আবদুল্লাহর সিদ্ধেশ্বরীর বাড়িতে আত্মগোপনে থাকেন। তাদের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য পাকিস্তান গোয়েন্দা বাহিনী ব্যাপক চিরুনি অনুসন্ধান চালায়। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ ও ক্যাপ্টেন আরিফ এম আবদুল্লাহর বাড়ি থেকে ১৯৭১ সালের ২ জুলাই খালেদা জিয়া ও তার শিশুসন্তানদের গ্রেফতার করে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অন্তরীণ করে রাখে। ২১ আগস্ট মেজর জিয়া পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মেজর জেনারেল জামসেদকে ‘বন্দী স্ত্রী খালেদা’ সাথে সম্ভ্রমের সাথে ব্যবহার করার জন্য একটি চিঠি পাঠান — 

‘Dear Gen. Jamshed, My wife Khaleda is under your custody. If you do not treat her with respect, I will kill you someday —  Zia’

জিয়ার চিঠিটা মেজর শাফায়াত জামিল বাংলাদেশে প্রবেশ করে দেওয়ানগঞ্জ থেকে পোস্ট করেছিলেন। [ সূত্র —  মেজর হাফিজউদ্দিন আহম্মেদ, বীর বিক্রম, ‘রক্তে ভেজা একাত্তর’ সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা ২০১৩।] 

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানে সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করার পর, সপুত্র খালেদা খানম পুতুলকে অন্তরীণমুক্ত হন। 

কালের বিবর্তনে খালেদা খানম পুতুল পরিচিত হলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপি এর প্রধান খালেদা জিয়া রূপে এবং ১৯ মার্চ ১৯৯১ নির্বাচিত হলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। পরে খালেদা জিয়া আরো দু’বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা সাময়িকী Forbes পরপর তিন বছর, ২০০৪ থেকে ২০০৬,  তাকে পৃথিবীর অন্যতম ‘প্রভাবশালী নারী’ চিহ্নিত করেছিলেন। ১৯৯১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি সিনেট খালেদা জিয়াকে “Fighter for Democracy” সনদে সম্মানিত করেছিলেন।

খালেদা জিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বকালে, বাংলাদেশের এতিমদের সহায়তার জন্য কুয়েতের আমির ১২ লাখ ৫৫ হাজার মার্কিন ডলার (৪ কোটি ৪৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা) অনুদান পাঠান। ওই টাকা দিয়ে সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট স্থাপন করা হয় এবং বগুড়া ও ঢাকায় দুটো জমি কেনা হয়। দুই ট্রাস্টের কোনোটির ট্রাস্টি খালেদা জিয়া নন এবং প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কোনো লেনদেনের সাথে জড়িত ছিলেন না। ট্রাস্টের জমা ফিক্সড ডিপোজিটের টাকা বর্তমানে ৭ কোটি অতিক্রম করেছে।

৫ আগস্ট ২০০৯ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থ আত্মসাতের অতিযোগে দুর্নীতি দমন ৫ (২) ও পেনাল কোডের ৪০৯/১০৯ ধারায় মামলা দায়ের করে। বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আখতারুজ্জামান খালেদা জিয়াকে ৫(২) ধারায় দোষী নির্ণীত করে ৫ বছর কারাদণ্ড ও ২ কোটি ১০ লাখ অর্থদণ্ড করে ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডস্থ পরিত্যক্ত শত একরের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠান। ২০১৯ সালে দণ্ড প্রদানকারী বিচারক আখতারুজ্জামান হাইকোর্টের বিচারপতি পদে উন্নীত হয়েছেন। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ হয়েছে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় আরো ৭ বছর কারাদণ্ডে।

উল্লেখ্য, কথিত দুর্নীতি মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে শাস্তি প্রদানের লক্ষ্যে ১৯৫৮ সালে দুর্নীতি দমন আইনে সংশোধন করে ৫(২) ধারা যুক্ত করা হয়েছিল।


উচ্চ আদালতে খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন এবং
অসম্পূর্ণ মেডিক্যাল রিপোর্ট


পরিত্যক্ত ঢাকা, কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্জনতায় খালেদা জিয়া একাকিত্বের কারণে স্বভাবতই বিষণ্ণতা ও মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হয়েছেন। সাথে তার পূর্বতন রোগগুলোর (১) বহুমূত্র (Diabetes), (২) উচ্চ রক্তচাপ (৩) শ্বাস-প্রশ্বাস সমস্যা (৪) রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের অবস্থার অবনতি হলে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে অক্টোবর ৬, ২০১৮ ভর্তি করা হয়। স্বতন্ত্র, নির্জন কোনায় কেবিনে।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশে বিএসএমএমইউর ভিসি ডিসেম্বর ১০,  ২০১৯ একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করেন ৭ জন বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, কারাবন্দী খালেদা জিয়ার জেলে অর্জিত মানসিক অবসাদ ও বিষণ্ণতা নির্ণয় এবং চিকিৎসায় সক্ষম কোনো মানসিক রোগবিশেষজ্ঞকে বিএসএমএমইউর নির্ধারিত ৭ বিশেষজ্ঞ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ওষুধ ছাড়া মাংসপেশি ও সন্ধির বিভিন্ন প্রকার ব্যায়াম ও ইলেকট্রিক চার্জ দিয়ে আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা প্রদানকারী ফিজিওথেরাপিস্টকেও কমিটিতে রাখা হয়নি এবং তার পর্যবেক্ষণ মেডিক্যাল রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

খালেদা জিয়ার মেডিক্যাল রিপোর্ট অসম্পূর্ণ। তার ‘রক্তচাপ ও কাশি সম্পৃক্ত হাঁপানি (Cough variant Asthma) পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন (Well Controlled)’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু পরিমাপ উল্লেখ করা হয়নি, বুকের এক্স-রে রিপোর্ট সংযুক্ত করা হয়নি।

তার “Recurreut Hyponatremia” কথা বলা হয়েছে অথচ দৈনন্দিন ব্লাড ইলেকট্রোলাইটস তথ্য রিপোর্টে উল্লেখ নেই। একইভাবে ডায়াবেটিসের পুরো তথ্য নেই এই নিমিত্তে HbAIC নিরূপণ করা অতীব প্রয়োজনীয়।

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে সপ্তাহে মাত্র একবার ৭.৫ মিলিগ্রাম মেথোট্রেক্সেট (Methotrexate) তিন ট্যাবলেট সেব্য। তবে প্রয়োজনে ২.৫ মিলিগ্রাম করে সপ্তাহে বাড়ানো যায়। নখ ও চামড়ার রঙ পরিবর্তন, চোখের প্রদাহ, গলায় ব্যথা (Sore throat), যকৃতে সমস্যা যথা বমি বমি ভাব, পেটে অস্বস্তি, কালো প্রস্রাব এবং শ্বাসকষ্ট মেথোট্রেক্সটের পরিচিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। কবে ব্লাড কাউন্ট ও লিভার ফাংশন টেস্ট করা হয়েছিল এবং ফলাফল খালেদা জিয়ার মেডিক্যাল রিপোর্টে যুক্ত থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল।

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের সাথে যুক্ত সেকেন্ডারি সজোগ্রেন সিনড্রোমের কী কী উপসর্গ খালেদা জিয়ার চোখে, মুখে ও শরীরে পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং কী কী চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে তা খালেদা জিয়ার মেডিক্যাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়নি। এই রোগ নিরূপণের জন্য চক্ষুবিশেষজ্ঞ ও ডেন্টাল সার্জনের পরামর্শ নেয়া হয়েছে কি? হয়ে থাকলে তাদের অভিমত যুক্ত না করার কারণ কী?

বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, মেথোট্রেক্সটে পর্যাপ্ত উন্নতি না হওয়ায় অপর একটি ইউমিউনো নিরোধক তসিলিজুমাব (Tocilijumab) ইনজেকশন নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এই ইনজেকশন নেয়ার আগে রক্তের পূর্ণ পরীক্ষা, লিভার ও কিডনির কার্যকারিতাও নির্ণয় করে নেয়া বাঞ্ছনীয়।

অসম্পূর্ণ মেডিক্যাল রিপোর্ট সম্পূর্ণ করে কারাবন্দী খালেদা জিয়াকে অবিলম্বে জামিন দেয়া হবে যৌক্তিক ও মানবিক ব্যাপার। এতে দেশের সর্বোচ্চ বিচারপতিদের ওপর জনগণের শ্রদ্ধা বাড়বে। এতদসঙ্গে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মেডিক্যাল প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসাসেবায় অসুস্থ খালেদা জিয়ার আস্থাও কাম্য।

খালেদা জিয়াকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্ত্বনা


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের ভাষ্যে বিএনপি নেত্রী বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কথিত ‘এতিমের টাকা চোর’।

চোর অভিযোগ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের উক্তি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য — ‘এগারো মাস মন্ত্রিত্ব করে ছিলাম। আমাকে চোর বলতে কারো বাধল না। আমি নাকি বলাকা সিনেমা হল করেছিলাম। আমাদের কিসমত যাদের জন্য রাজনীতি করি তাদের কেউ আমাদের বিশ্বাস করে না, এই তো দুনিয়া। জনাব সোহরাওয়ার্দীকে চোর বলেছে, হক সাহেবকে চোর বলেছে, নেতাজী সুভাষ বসুকে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে এই বাঙালিরা চোর বলেছে, দুঃখ করার কী আছে?’

খালেদা জিয়া আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? সুস্থ হলে অনুগ্রহ করে বইগুলো পড়বেন। 

  • কার্টসি — মুজতবা খন্দকারের ব্লগ
  • লিঙ্ক — https://bit.ly/2SXKqGD 


প্যারোলের রাজনীতি ও আইনের প্রশ্ন

কামাল আহমেদ

কান্ডারিহীন বিএনপি এবার প্যারোল রাজনীতির ফাঁদে পা দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কেননা, প্যারোল অনুমোদন ও ব্যবস্থাপনার জন্য দেশে কোনো আইন নেই এবং তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছাধীন ও পরিবর্তনশীল নীতিমালায় অনুশীলন করা হয়। অতএব, একজন সত্তরোর্ধ্ব ও অসুস্থ রাজনীতিকের প্যারোল নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও মন্ত্রীরাও মনের মাধুরী মিশিয়ে নানা ধরনের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। এমনকি, ১২ বছর একটানা ক্ষমতা ধরে রাখার সুবাদে অভ্যাসসূচক ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে চলেছেন। অবস্থাদৃষ্টে তাই প্রশ্ন উঠছে, আন্দোলন ও নির্বাচনের মতোই প্যারোলের রাজনীতিতেও কি বিএনপি বিভ্রান্তির কবলে পড়তে চলেছে?

প্যারোল কথাটা রাজনীতিতে নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশে অতীতে দুটো কারণে প্যারোলের কথা শোনা গেছে। একটি হচ্ছে মানবিক এবং অপরটি রাজনৈতিক। মানবিক কারণে প্যারোল বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়া এর আগেও পেয়েছেন। ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যে বছরখানেক সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি একই ভবনে একই ধরনের কারাজীবন পার করছিলেন, সে সময়ে তাঁর মায়ের মৃত্যুতে তিনি প্যারোলে মুক্তি পেয়েছিলেন। আর, রাজনৈতিক কারণে যাঁরা প্যারোলে মুক্তি পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অংশগ্রহণের অনুকূল পরিবেশ তৈরির শর্ত পূরণে তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার এঁদের প্যারোলের ব্যবস্থা করে। রাজনীতির অন্দরমহলের খবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা জানেন যে এসব প্যারোলের জন্য কাউকে মাঠে বক্তৃতা দিতে হয়নি এবং রাজনৈতিক চাপ অনুভব করার কারণেই তখন সরকার এগিয়ে এসে তার ব্যবস্থা করেছিল। স্বাধীনতার আগের ইতিহাসে না গেলেও পরের ইতিহাসে সুপরিচিত রাজনীতিকদের চিকিৎসার প্রয়োজনে প্যারোলের দৃষ্টান্ত আছে। যেমন, জাসদ নেতা আ স ম আবদুর রবের জার্মানিতে চিকিৎসার কথা এখানে স্মরণ করা যায়।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, পুত্র চিকিৎসাজনিত প্যারোল পেয়েছিলেন যত সহজে, মায়ের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্যারোল ততটাই কঠিন হয়ে দেখা দিয়েছে। পুত্রের প্যারোলের বিষয়ে তখন সরকার চাপ অনুভব করেছিল, আর এখন সরকার একেবারেই চাপমুক্ত। তখন প্যারোলের ফয়সালা হয়েছিল নেপথ্যে, আর এখন প্রকাশ্য দেন-দরবারেও সাড়া মেলার কোনো লক্ষণ নেই। তবে, যতটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে তাতে রাজনীতিক হিসেবে খালেদা জিয়া কারাজীবনে মৃত্যুর আশঙ্কা নিয়ে ততটা চিন্তিত নন। তবে, তাঁর দলের অন্যদের মধ্যে অস্থিরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তাঁরা রাজনীতিতে ক্রমেই তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন।

ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যখন বলেন অপরাধ স্বীকার করেই প্যারোলের আবেদন করতে হবে, তখন বোঝা যায় বিষয়টি মানবিক নাকি রাজনৈতিক। প্রশ্ন হচ্ছে, প্যারোল সম্পর্কে আইনের বিধান কী? প্যারোলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কার? সরকারের না আদালতের? বিস্ময়কর হলেও সত্য, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই, যার আলোকে প্যারোল সম্পর্কে সরকার বা বিরোধী দল বিএনপির পরস্পরবিরোধী দাবির নিষ্পত্তি হতে পারে। অবশ্য প্যারোলের সুনির্দিষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় ২০১০ সালে তৈরি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন এবং ২০১৬-এর কোস্টগার্ড আইনে, যা শুধু ওই দুই বাহিনীর সদস্যদের জন্য প্রযোজ্য। প্যারোলের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকায় বিষয়টির প্রয়োগের সম্ভাব্য ব্যাখ্যা মেলে অন্য দুটো আইনে—যার একটি হচ্ছে, দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডারস অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ এবং অন্যটি হচ্ছে দ্য প্রিজন্স অ্যাক্ট, ১৮৯৪। তবে, সরকারের যে হালনাগাদ করা প্যারোল নীতিমালার সন্ধান মেলে, সেটি জারি হয়েছিল ২০১৬ সালের ১ জুন। হালনাগাদ নীতিমালায় অতীতের যেগুলোর উল্লেখ (রেফারেন্স) পাওয়া যায় তার একটি হচ্ছে ২০১০ সালের ৩ মার্চের এবং অন্য আরেকটি ২০০৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বরের। তবে, নীতিমালা কোন আইনের অধীনে তৈরি হয়েছে, তার কোনো উল্লেখ এতে নেই।

সরকারের সর্বসাম্প্রতিক প্যারোল নীতিতে বলা হয়েছে বন্দীদের নিকটাত্মীয়দের কেউ মারা গেলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়া যাবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্যারোল মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবেন। তবে, এই নির্দেশনায় আরও বলা আছে ‘নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর কারণ ছাড়াও কোনো আদালতের আদেশ বা সরকারের বিশেষ সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্যারোলে মুক্তির প্রয়োজন দেখা দিলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্দীকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া যাবে।’ এতে নিরাপত্তা ও দূরত্ব বিবেচনায় এই সময় বেঁধে দেওয়ার এবং বন্দীকে সার্বক্ষণিকভাবে পুলিশ প্রহরাধীন থাকতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নীতিমালার আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এই সময়সীমা কোনো অবস্থাতেই ১২ ঘণ্টার বেশি হবে না বলার পরই তাতে লেখা হয়েছে, তবে ‘বিশেষ ক্ষেত্রে সরকার মুক্তির সময়সীমা হ্রাস/বৃদ্ধি করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করবে।’ এই নীতিমালায় প্যারোলের মেয়াদ নির্ধারণের এখতিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হলেও বন্দীর দোষ স্বীকারের কোনো শর্ত নেই। সুতরাং মন্ত্রীদের মধ্যে যাঁরা অপরাধ স্বীকার করে প্যারোলের আবেদন করতে হবে বলে দাবি করছেন, তাঁদের বক্তব্যে যদি কেউ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেয় করার উদ্দেশ্য খুঁজে পান, তা নাকচ করা সহজ নয়।

প্রবেশন অর্ডিন্যান্স অনুসরণ করা হলে দণ্ডিত ব্যক্তির শর্তাধীন মুক্তির আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র আদালতের, সরকারের নয়। এই আইনে মামলার রায় ঘোষণার সময়ে বিচারিক আদালত অথবা আপিল দায়েরের সময়ে উচ্চ আদালত দণ্ডিত ব্যক্তিকে শর্তাধীন মুক্তি দিতে পারেন। মুক্ত থাকার সময়ে তাঁকে ওই সব শর্ত পালন করতে হয় এবং সেগুলো দেখার জন্য প্রবেশন কর্মকর্তা থাকেন। একমাত্র মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত না হলে যেকোনো নারী এই আইনে শর্তাধীন মুক্তিলাভের অধিকার রাখেন। মামলার রাজনৈতিক চরিত্রের কারণে বিচারিক আদালতে তেমনটি যে সম্ভব ছিল না, তা মোটামুটি সবারই জানা। তবে, উচ্চ আদালতে আপিলের পর্যায়ে খালেদা জিয়ার সেই আবেদনের সুযোগ এখনো থাকার কথা। প্রবেশনের সিদ্ধান্তটি একান্তই বিচারকদের, সরকারের নয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে বিএনপি বিভিন্ন সময়ে যেসব অভিযোগ করে এসেছে, বিশেষ করে খালেদার জামিনের আবেদন নাকচ হওয়ার পটভূমিতে, তাতে অবশ্য আদালতের প্রতি আস্থার প্রশ্নে তাঁদের মধ্যে সংশয় থাকা অস্বাভাবিক নয়।

তা ছাড়া, এ কথাও সত্য যে বাংলাদেশে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে আদালতে প্রবেশন আইন প্রয়োগের প্রবণতা নেই বললেই চলে। বিষয়টিতে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি ইমান আলীর একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও পেনাল রিফর্ম ইন্টারন্যাশনাল (পিআরআই) প্রকাশনা ‘ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইউজ অব দ্য প্রবেশন সিস্টেম ইন বাংলাদেশ’-এ। বিচারপতি ইমান আলীর কথায় ‘সম্ভবত বিজ্ঞ বিচারকদের শাস্তি প্রদানমূলক মনোভাবের কারণে আমাদের বিচারিক আদালতে প্রবেশনের ব্যবহার অত্যন্ত বিরল এবং এই অবস্থা দেশের সর্বত্র বিরাজ করছে।’

অন্য আইন, যেটি সোয়া শ বছরের পুরোনো দ্য প্রিজন্স অ্যাক্ট, তাতে অন্তত তিনটি ধারায় সরকারকে বন্দীদের সাজা কমানো ও আগাম মুক্তির বিষয়ে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ধারণা করা অযৌক্তিক হবে না যে মন্ত্রীদের কেউ কেউ হয়তো এই আইনের আলোকে বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। ক্ষমতাটি সরকারের হাতে থাকলে এ রকম হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়। এবং তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করাটাও অপ্রত্যাশিত নয়। প্রিজন্স অ্যাক্টের ৫৯ ধারার ৫,৭ এবং ৯ উপধারায় বন্দীদের আচরণের ভিত্তিতে মূল্যায়ন এবং সাজা কমানো, বন্দীর মৃত্যুঝুঁকি বিবেচনায় মুক্তিদান এবং দণ্ডের সময় এবং শ্রেণি নির্ধারণের উদ্দেশ্যে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা পুরোপুরি সরকারের। এই ক্ষমতা প্রয়োগ করেই যে বিকাশের মতো দুর্ধর্ষ অপরাধীরা সাজার মেয়াদ শেষ করার আগেই সরকারের কৃপায় মুক্তি পেয়েছেন, সন্দেহ নেই।

সরকারের এখতিয়ার এবং কর্তৃত্ব বিবেচনায় প্যারোল প্রশ্নে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি ক্ষমতাসীন দল সহানুভূতিশীল হবে বিএনপির মধ্যে যাঁরা এমনটি ভাবছেন, তাঁদের ভাবনার ভিত্তি কী, তা-ও স্পষ্ট নয়। সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে হঠকারিতার ফাঁদে পা দিয়ে দলটির যে দুর্গতির শুরু, তা আরও প্রকট হয়েছে নির্বাচন প্রশ্নে অসংলগ্ন অস্থিরতায়। যে কারণে নির্বাচনে অংশগ্রহণ কখন অর্থপূর্ণ আর কখন নয়, সেই ভেদবোধও তাদের লোপ পাওয়ার আলামত দৃশ্যমান। নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করা যখন ক্ষমতাসীনদের জন্য জরুরি ছিল, তখন কোনো ধরনের ছাড় আদায় করতে না পারলেও উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকারগুলোর নির্বাচনকে বৈধতা দিতে দলটির উৎসাহে কোনো ঘাটতি নেই। এখন প্যারোলের রাজনীতিতেও দলটির ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে।

  • কামাল আহমেদ: সাংবাদিক
  • কার্টসি - প্রথম আলো/ ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২০  

প্যারোলে মুক্তি ‘দোষ স্বীকার’ ও বিদেশ যাওয়া প্রসঙ্গ

গোলাম মোর্তোজা

কিছুদিন পরপর প্রায় নিয়ম করে খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রসঙ্গটি সামনে আসে। সেই আলোচনায় এখনকার প্রসঙ্গ ‘প্যারোল’। আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীদের মুখ থেকে ‘প্যারোল’ শব্দটি বেশি শোনা যাচ্ছে।

বিএনপির নেতা-আইনজীবীরা বলছেন ‘প্যারোলে’ মুক্তি নয়, খালেদা জিয়াকে জামিন দিতে হবে। তাদের বক্তব্য, যেহেতু খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাগুলো রাজনৈতিক, ফলে সরকারের সদিচ্ছায় চিকিৎসাজনিত কারণে জামিন হতে পারে। জামিন পেলে তিনি উন্নততর চিকিৎসার জন্যে ইংল্যান্ডে যাবেন।

বিএনপি নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পাচ্ছেন না। খালেদা জিয়ার সঙ্গে কারাগারে দেখা করছেন তার আত্মীয়-স্বজন। বিএনপি মহাসচিব খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ও মনোভাব সম্পর্কে জানছেন, দেখা করে আসা আত্মীয়দের থেকে।

খালেদা জিয়ার মুক্তিকে কেন্দ্র করে কয়েকটি প্রসঙ্গে সামনে আসছে। আইনগতভাবে খালেদা জিয়া জামিন পেতে পারেন কিনা বা জামিন পাওয়ার সুযোগ আছে কিনা? ‘প্যারোল’র আওতায় মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা? ‘প্যারোলে’ মুক্তি পেলে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার সুযোগ আছে কিনা?

প্রথমে আসি ‘প্যারোল’ প্রসঙ্গে।

‘প্যারোল’ বিষয়ে সংসদ প্রণীত কোনো আইন নেই। প্যারোল সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয়। ২০১৬ সালের ১ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা নীতিমালা অনুযায়ী প্যারোলে ‘শর্তাধীনে সাময়িক সময়’র জন্যে মুক্তির সুযোগ আছে। গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যান্য শ্রেণির হাজতি বন্দিদের কাছের কেউ মারা গেলে সাধারণত প্যারোলে মুক্তি পেয়ে থাকেন।

‘সাময়িক সময়’ ১২ ঘণ্টার বেশি হবে না, নীতিমালায় বলা হয়েছে। তবে বিশেষ বিবেচনায় সরকার সময় কমাতে বা বাড়াতে পারে। কতদিন, মাস বা বছর বাড়াতে পারে তা নির্দিষ্ট করে বলা নেই।

‘সাময়িক সময়’ কমবেশি যাই হোক পুরো সময় তাকে পুলিশি প্রহরা বা নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। নীতিমালা অনুযায়ী, প্যারোলে মুক্ত বন্দিকে পুলিশ কারাগারের ফটক থেকে বুঝে নিবে এবং নির্দেশিত সময়সীমার মধ্যে আবার কারাগার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করবে।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আরিফ খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “প্যারোলে মুক্ত কোনো বন্দি বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী চিকিৎসা বা অন্য কোনো বিবেচনায় বিদেশে যেতে পারবেন না। এছাড়া প্যারোলে মুক্তির সঙ্গে বন্দির দোষ স্বীকার করা বা না করার কোনো সম্পর্ক নেই।”

“প্যারোলে মুক্তি পাওয়া বন্দির বিদেশে যাওয়ার সুযোগ আছে”-দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক আইন বিষয়ক সম্পাদক এবং বর্তমান মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। তিনি বলেন, “বিদেশে গিয়ে সেই বন্দিকে সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসকে বিষয়টি জানাতে হবে। তিনি কোথায় থাকছেন, কোন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন সবকিছু দূতাবাসকে জানিয়ে রাখতে হবে।”

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহাসচিব আবদুল জলিল প্যারোলে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্যে সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন।

প্যারোলে মুক্তির পর বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই, আবদুল জলিলকে কীভাবে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো? তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন এ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি।

২০০৮ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আট সপ্তাহের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন।

এবার আসি জামিন প্রসঙ্গে।

বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৪টি মামলা চলমান এবং দুটি মামলায় তিনি দণ্ড পেয়েছেন। দণ্ডপ্রাপ্ত দুটি মামলা অ্যাপিলেট ডিভিশন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। অর্থাৎ মামলার পুরো কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এই দুটি মামলার সম্পূর্ণ কার্যক্রম শেষ হয়ে যাওয়ায় জামিনের কোনো সুযোগ নেই। কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়ে যাওয়া মামলায় আদালত জামিন দিতে পারেন না। খালেদা জিয়া জামিন পেতে পারেন চলমান মামলাগুলোতে। চলমান সবকয়টি মামলায় যদি খালেদা জিয়া জামিন পান, তবুও তার কারামুক্তির সুযোগ নেই।

‘প্যারোলে’ মুক্তির বাইরে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ আছে। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দোষ স্বীকার করে নিয়েই ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়। রাষ্ট্রপতি ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন অগ্রাহ্য করতে পারেন। বিবেচনায় নিয়ে সম্পূর্ণ দণ্ড মাফ করে দিতে পারেন। দণ্ডের মেয়াদ কমিয়ে দিতে পারেন। নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে দণ্ড স্থগিত রেখে মুক্তির ব্যবস্থা করতে পারেন।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন খালেদা জিয়া কী চাইছেন? কয়েক মাস আগে বিএনপির সংসদ সদস্যরা কারাগারে দেখা করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে। বিএনপির একজন সংসদ সদস্য দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তিনি প্যারোল বা মুক্তির প্রক্রিয়া নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। ‘কোনো লাভ নেই’-বলে খালেদা জিয়া তাকে আলোচনা করতে না করে দিয়েছিলেন।

তার মতে, তখনই খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল। তিনি উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না।

কয়েক দিন আগে খালেদা জিয়ার বোনসহ আত্মীয়রা দেখা করেছেন। বিএনপির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, আত্মীয়রা দেখা করে এসে বলেছেন খালেদা জিয়ার অবস্থা খারাপের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। তার দুই হাত বাঁকা হয়ে গেছে। খেতে পারছেন না। জামিন বা প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে এই প্রথম তিনি বলেছেন ‘যা ভালো মনে করো’ করতে পারো। ধারণা করছি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন বলেই হয়তো তিনি একথা বলেছেন। তবে বেগম খালেদা জিয়া কোনো অবস্থাতেই রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন না। কারণ তিনি কোনো অপরাধ করেননি।

একটি সূত্র অনুযায়ী, বিএনপি দলীয়ভাবে প্যারোলে মুক্তি চাইবে না। পরিবার সরকারের থেকে নিশ্চয়তা পেলে প্যারোলে মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে। তখন বিএনপি বলবে, আত্মীয়রা মানবিক কারণে প্যারোল চেয়েছে। রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

বিএনপি নেতাদের প্রায় সবাই এখন মনে করছেন, অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে খালেদা জিয়ার সুস্থ থাকা বা বেঁচে থাকা জরুরি। প্যারোলে মুক্তি চাইলে বা পেলে খালেদা জিয়ার ‘আপসহীন’ ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও তারা মনে করছেন না। সরকার এমন প্রচারণা চালালেও, বিএনপি নেতারা মনে করছেন, সরকারের কথা দেশের মানুষ বিশ্বাস করবেন না। মানবিক বিবেচনায় বেগম খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি পেলে বিএনপির রাজনীতির জন্যে তা মঙ্গলজনক হবে। কিন্তু তাদের ভেতরে একটি সংশয় বা সন্দেহ তীব্রভাবে বিরাজ করছে, সরকারপ্রধান কী ভাবছেন তা তারা জানেন না। ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে কথা বলে মির্জা ফখরুলের সংশয় বা সন্দেহ কাটেনি। আদালত নয়, খালেদা জিয়ার মুক্তি নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর। এবং সেই সিদ্ধান্ত মূলত সরকার প্রধানের।

  • কার্টসি - ডেইলি স্টার/ ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২০