কাওসার আজম
আবারো বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুৎ ও পানির দাম। সাধারণ চাকরিজীবী ও নিম্ন মধ্যবিত্তের আয় না বাড়লেও সরকার বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধি করায় বড় ধাক্কা লেগেছে নাগরিকদের জীবনযাত্রায়। অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করছেন বিদ্যুৎ-পানির দাম বৃদ্ধির ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে নাগরিক জীবনে।
করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতিতে যে ধাক্কা শুরু হয়েছে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধির ফলে তা বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে। দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি পাবে, মানুষের জীবন যাত্রা আরো ব্যয়বহুল হবে। সাধারণ মানুষ ও গরিব মানুষ আরো বেশি সমস্যার মধ্যে পড়বে। মানুষের নাভিশ্বাস হবে।
ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুৎ ও পানির দাম। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার প্রায় ১২ বছরে এ নিয়ে আটবার বিদ্যুতের দাম এবং ১৩ বার পানির দাম বৃদ্ধি করা হলো। বিদ্যুতের বর্ধিত দাম কার্যকর হচ্ছে চলতি মার্চ মাস থেকেই। গ্রাহকদের এখন থেকে বিদ্যুৎ বিল বাবদ ইউনিটপ্রতি ৩৬ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি দিতে হবে।
অন্য দিকে ঢাকা ওয়াসার পানির বর্ধিত দাম আগামী এপ্রিল মাস থেকে কার্যকর হবে। ওয়াসার সরবরাহকৃত প্রতি হাজার লিটার পানির দাম আবাসিকে ১১ টাকা ৫৭ পয়সার পরিবর্তে ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা, বাণিজ্যিকে প্রতি হাজার লিটার পানির দাম ৩৭ টাকা ৪ পয়সার পরিবর্তে ৪০ টাকা এবং চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রতি হাজার লিটার পানির দাম আবাসিকে ৯ টাকা ৯২ পয়সার পরিবর্তে ১২ টাকা ৪০ পয়সা এবং বাণিজ্যিকে প্রতি হাজার লিটার পানির দাম ২৭ টাকা ৫৬ পয়সার পরিবর্তে ৩০ টাকা ৩০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।
নতুন করে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদ, জ্বালানি ও সমাজ বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এমন একসময় বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানো হলো, যখন করোনাভাইরাসের কারণে এমনিতেই দেশের অর্থনীতি প্রায় স্থবির। চীন থেকে কাঁচামাল না আসায় বেশ কিছু শিল্পোদ্যোক্তা হাত গুটিয়ে আছেন। এ পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ ও পানির মূল্য বৃদ্ধি অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধির ফলে বিপাকে পড়বে সীমিত আয়ের মানুষ। তবে শুধু আবাসিক খাতেই নয়, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে শিল্প খাতেও। শিল্পে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেলে বাড়বে দ্রব্যমূল্যও। এর মাশুলও দিতে হবে সাধারণ ভোক্তাদেরই। এমনিতেই নির্দিষ্ট আয়ের বিভিন্ন পেশার মানুষের কষ্ট ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। এ অবস্থায় আবারো বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় তথা দুর্ভোগের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় বলা হয়, ঢাকা ওয়াসার সেবায় গ্রাহকদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি অসন্তুষ্ট। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে গত প্রায় ১২ বছরে ১৩ বার পানির দাম বেড়েছে। একই সময়ে পানির দাম প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সালে ঢাকায় আবাসিক গ্রাহকদের জন্য পানির দাম ছিল প্রতি ইউনিট (১ হাজার লিটার) ৫ টাকা ৭৫ পয়সা। দাম বাড়ানোর কারণে আগামী এপ্রিল থেকে তা হচ্ছে ২০ টাকা।
গবেষণায় আরো উল্লেখ আছে, ওয়াসার পানির নিম্নমানের কারণে ৯৩ শতাংশ গ্রাহক বিভিন্ন পদ্ধতিতে পানি পানের উপযোগী করে। এর মধ্যে ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে বা সেদ্ধ করে পান করে। অন্য দিকে সাধারণ নাগরিকরা বিভিন্ন সময়ে ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ, ময়লা থাকার অভিযোগ করে আসছে।
জানা যায়, ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এখন পর্যন্ত পাইকারি পর্যায়ে ছয়বার এবং খুচরা বা গ্রাহক পর্যায়ে আটবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের নভেম্বরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়।
সাধারণ গ্রাহকপর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। ফলে গ্রাহককে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য ৭ টাকা ১৩ পয়সা পরিশোধ করতে হবে। আগে প্রতি ইউনিটের দাম ছিল ৬ টাকা ৭৭ পয়সা। পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট গড়ে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। আগে প্রতি ইউনিটের দাম ছিল ৪ টাকা ৭৭ পয়সা। মার্চ থেকে প্রতি ইউনিটের দাম হবে ৫ টাকা ১৭ পয়সা।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম নয়া দিগন্তকে বলেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি গণশুনানির মাধ্যমে করা হয়। ফলে বৃদ্ধির যৌক্তিকতা ন্যায্যতা, অসঙ্গতি পাবলিকলি বলা যায়। কিন্তু পানির ক্ষেত্রে সেটা বলা যায় না। কারণ পানির মূল্য বৃদ্ধি অনেকটাই করা হয় একতরফাভাবে। সেটা যৌক্তিক নয়, বরং ভোক্তা অধিকারপরিপন্থী। যে পানি বিক্রি করে (ওয়াসা) সেই যদি নিজে নিজেই দাম বৃদ্ধি করে তা হলে এটি অন্যায় ও অবিচারের শামিল। এতে ভোক্তা অধিকার খর্ব হচ্ছে।
বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অযৌক্তিক ব্যয় ধরে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হয়েছে। কোনোভাবেই এটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সঠিক হয়নি। ভোক্তা সঠিক দামে বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। সে কারণে ভোক্তার অধিকার খর্ব হয়েছে। এতে ভোক্তা ন্যায়বিচার পায়নি।
বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব প্রসঙ্গে এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, এ দু’টির বিল তো বাড়বেই। পাশাপাশি অন্যান্য পণ্যের দাম আরো বেশি বৃদ্ধি পাবে। এতে ১৭ কোটি মানুষের কত ব্যয় বাড়বে সে হিসাব কোথাও নেই। এর ফলে হয়তো সরকারের তিন হাজার কোটি টাকা মিলবে। কিন্তু এর ফলে সরকারের রাজস্ব কমবে, ভ্যাট ও কর কমবে। এতে সরকার কতটা রাজস্ব হারাবে আর ভোক্তার কত ব্যয় বাড়বে তার কোনো হিসাবই আমাদের কাছে নেই। তবে তা তিন হাজার কোটি টাকার চেয়ে অনেক বেশি বাড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধির ফলে মানুষের নাভিশ্বাস সৃষ্টি হবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে, মানুষের জীবনযাত্রা আরো ব্যয়বহুল হবে। সাধারণ মানুষ ও দরিদ্র মানুষ আরো বেশি সমস্যার মধ্যে পড়বে।
তিনি বলেন, বারবার বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। এটা আমরা বলে আসছি কিন্তু সরকার তো কারো কথা শোনে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, বারবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করে সরকার রেন্টাল-কুইক রেন্টালে চার্জ দিচ্ছে। বিদ্যুৎ না কিনেও সরকার সেখানে ভর্তুকি দিচ্ছে। এসব মানুষের ওপর চাপাচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকারের উচিত ছিল এসব (রেন্টাল-কুইক রেন্টাল) মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর নবায়ন না করা। সরকারকে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল থেকে সরে এসে বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রে যাওয়া উচিত। যত দিন তাদের ভর্তুকি দেবে, বিদ্যুৎ না কিনলেও দিতে হবে, মুক্তি মিলবে না। আর ছোট বিদ্যুৎ প্ল্যান্টে খরচ বেশি। বড় প্রকল্পে যাওয়া উচিত, যেসব বন্ধ হয়ে পড়ে আছে (সরকারি) সেগুলো চালু করা জরুরি। পানির মিটার এখনো অটোমেটিক না। পানি ফিল্টারে হচ্ছে। অনেক জায়গায় পানির দামই ঠিকমতো দেয় না। ফলে গড়ে পানির খরচ পোষাচ্ছে না।
এ কারণে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধি অযৌক্তিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসবের দাম সরকার বাড়াতে পারে না। বরং সরকারের নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আনা উচিত।
কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে- জানতে চাইলে আবু আহমেদ বলেন, যাদের ইনকাম নেই তাদের বেশি সমস্যায় পড়তে হবে। আর যারা দেশের বড় বড় ধনী হয়ে গেছে, লুটপাটের সাথে জড়িত তাদের তো কিছুই হবে না। হবে তো সাধারণ মানুষের, যাদের আয় নেই।
- কার্টসি - নয়াদিগন্ত/ মার্চ ১, ২০২০
No comments:
Post a Comment