Search

Tuesday, March 31, 2020

অশ্রুতে লেখা নুরুর অক্ষয় স্মৃতি

কাদের গণি চৌধুরী 

কাদের গণি চৌধুরী 
আবারো ফিরে এলো সেই ভয়াল ৩০ মার্চ। 

ছাত্রদল নেতা ও কমিউনিটি সংগঠক নুরুল আলম নুরু হত্যা দিবস। 

মার্চের রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের শেষে মধ্যরাত ফেরিয়ে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বঙ্গোপসাগর হয়ে ভেসে আসা, পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ঠাণ্ডা বাতাসের ছোঁয়ায় গভীর ঘুমে নাগরিকেরা তখন। এই বিশ্বে শুরু হলো আরেকটি দিনের ক্ষণ  গণনা, বৃহস্পতিবার, মার্চ ৩০, ২০১৭। শহরের চন্দনপুরার বাসায় সদ্যজাত শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন নুরুল আলম নুরুও। এই সময়ে দরজায় কড়া নাড়ে আগুন্তক দলেবলে খুনিচক্র। ঘরে ঢুকেই নুরুর বুক থেকে হেঁচকা টানে কেড়ে নেয় শিশু সন্তানকে।  পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেয় নুরুকে।


সেদিন শহর থেকে প্রায় ৭০ কিমি পূর্বে কর্ণফুলী নদীর তীরে তাঁর মৃতদেহ যখন পাওয়া যায় তখন হাত ছিল দড়ি দিয়ে শক্তভাবে বাঁধা। চোখ ও মুখ বাঁধা ছিল শার্ট দিয়ে। পুরো শরীরে ছিল রক্তাক্ত জখমের কালো চিহ্ন। মুখের ভিতর ঢুকানো ছিল কালো রংয়ের জর্জেটের ওড়না। শরীরের বিভিন্নস্থানে চামড়া তুলে নেয়া হয়েছিল। লোহার রডের আঘাতে ঘাড়সহ শরীরের বিভিন্ন অংশে ছিল জখমের চিহ্ন। অত্যন্ত কাছ থেকে মাথায় করা হয়েছিল তিন তিনটি গুলি।

লাশের সুরুতহাল দেখে চিকিৎসকদের ধারণা একটানা তিন ঘন্টা তিলে তিলে অমানবিক নির্যাতন করে তাকে হত্যা করা হয়। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত করতে মাথায় তিন তিনটি গুলি করা হয়েছিল। নির্যাতনের ভয়াবহতা দেখে মনে হয় খুনিদের প্রচণ্ড আক্রোশ ছিল নুরুর ওপর।

এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড দুনিয়ার ইতিহাসে খুব কমই দেখা যায়। কি অমানবিক! কি বর্বরতা!! কি পৈশাচিকতা!!!

নুরুর ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখে সে দিন কঠিন পাথর হৃদয়ও কেঁপে ওঠেছিল। চোখের পানি চেষ্টা করেও ধরে রাখতে পারেনি কেউ। 

এখনও বছর শেষে এদিনটি যখন ফিরে আসে হৃদয়টা যেন কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সে নৃশংসতার ছবি। অগোচরে মুখমণ্ডল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে বেদনার নোনা অশ্রুধারা।

নুরুল আলম নুরু'র মৃতদেহের ওপড়ে আচড়ে পড়েছেন তাঁর শোকার্ত স্ত্রী। 

নুরু ছিল আমার সুপরিচিত। মার্চ ২৫, ২০১৭, জাতীয়তাবাদী হেল্পসেলের আয়োজনে মওলানা ভাসানী মিলনায়তনে ছিল গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের সাথে মতবিনিময় ও আর্থিক সহায়তা প্রদান অনুষ্ঠান। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছিলেন প্রধান অতিথি আর আমি ছিলাম বিশেষ অতিথি। অনুষ্ঠানের প্রধান সমন্বয়কারি ও মতবিনিয় সভার সঞ্চালক ছিলেন নুরুল আলম নুরু। অনুষ্ঠান শেষ করে নুরু আমার সাথে আমার বাসায় আসে। দুপুরে আমার বাসায় এক সাথে খাবার গ্রহণ করি। এরপর আমরা এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দিই। বিকেলের ফ্লাইটে চট্টগ্রাম আসি এবং বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার বেলায়েত হোসেন ভাইয়ের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেই। সারা রাত একসাথেই ছিলাম। পরদিন দুপুরে ফটিকছড়ির গুম হওয়া শহিদুল আলম সিরাজের পরিবারের খোঁজ নিতে ওনাদের বাসায় যাই নুরুসহ আরো কয়েকজন। কয়েকটি সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে রাতে যখন হোটেলে আসি এরই মধ্যে খবর আসে ফটিকছড়ি কলেজ ছাত্রদলের আহবায়ক আবদুল্লাহ আল মামুন, সদস্য সচিব আল মামুন ও সাইমুনুল করিম মোটর সাইকেল এক্সিডেন্টে গুরুতর আহত হয়েছেন। নুরু ও আমি ছুটে যাই চট্টগ্রাম মেডিকেলে। তখন রাত দুইটা। আমি ঘন্টা খানেক থেকে হোটেলে ফিরে আসি। নুরু সারা রাত হসপিটালে কাটিয়ে দেয় আহত ছাত্রনেতাদের শয্যা পাশে। পর দিন ২৭ তারিখ সকালে একসাথে নাস্তা করি নগর বিএনপির সভাপতি ডাঃ শাহদাত হোসের বাসায়। সেখান থেকে হযরত আমানত শাহ'র (রঃ) মাজারে গিয়ে নামাজ পড়ি এবং কবর জিয়ারত করি এক সাথে। আমাদে সাথে ছিল ছাত্রদল নেতা মোরশদ হাজারী, হাটহাজারীর গিয়াস চেয়ারম্যান, নগর বিএনপি নেতা আলমগীর নুর, ফটিকছড়ি ছাত্রদলের আহবায়ক আব্দুল্লাহ আল মামুন, তারেক, জিয়াউর রহমান জিয়া, মহসিন কলেজের সিফাত ও শফি, ওসমান তাহের সম্রাট ইঞ্জিনিয়ার মুন্না, একরামুল হক চৌধুরীসহ অনেকেই। সারা দিন একসাথেই ছিলাম। সন্ধ্যায় আমাকে চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে নুরু ফিরে যায় চট্টগ্রামের বাসায়।

সদ্যজাত শিশু সন্তান কোলে নিয়ে নুরুল আলম নুরু
আমার সাথেই ঢাকায় ফিরে আসার কথা ছিল নুরুর। সেভাবে টিকেটও করা ছিল। আসার দিন হঠাৎ নুরু আমাকে জানায়, ভাই আপনার একটা ভাতিজা হয়েছে। আপনি যদি বলেন দুই দিন ওদের সাথে থেকে যাই। প্রিয় সন্তানের কাছে থাকতে চায়, বাধা দেই কিভাবে? আমি বললাম ঠিক আছে থাক। তবে সাবধানে থেকো। নুরু জানাল ভাই, সব মামলায় জামিন হয়ে গেছে আশা করি আর সমস্যা হবে না।

আমি ফিরে আসি ঢাকায়। বাসায় ফেরার পর প্রথম ফোনটিই নুরুর। ভাই বাসায় কি পৌঁচেছেন। আমি বল্লাম বাসায় এসে মাত্র ফ্রেশ হলাম। আমি জানতে চাইলাম তুমি কোথায়, বাসায় গিয়েছ? বললো না ভাই এখনো বাইরে আছি, কামরুল (নগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক) ভাইদের সাথে। বরাবরের মতো আবারো বললাম সাবধানে থেকো। ফোনটা যখন রাখতে গেলাম তখন হঠাৎ বলে উঠলো ভাই আরেকটা কথা ছিল। আপনিতো পেশাজীবি সমাবেশ যোগদিতে শুক্রবারে আবার চট্টগ্রামে আসবেন, আমি আপনার সাথে ঢাকায় ফিরে যাব। আমার জন্য একসাথে ফেরার টিকেট করবেন। আর মাহমুদ ভাইয়ের (আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান) সাথে আমাকে ভালভাবে পরিচয় করিয়ে দেবেন। আমি বললাম ঠিক আছে। আমি টিকেট করে রাখবো। আর সমাবেশটা যাতে ভালভাবে হয় সেদিকে খেয়াল রেখো। বললো কাল বিকেলে শাহদাত ভাই পেশাজীবী সমাবেশ সফল করতে প্রস্তুতি সভা ডেকেছেন। চিন্তা করবেন না, ভালো প্রোগ্রাম হবে ইনশাআল্লাহ। এটিই ছিল শেষ কথা। পরের দিন আমার সাথে আর কথা হয়নি।

২৯ মার্চ গভীর রাত। আমি ঘুমোচ্ছিলাম। বার বার ফোন বাজছিল। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে ফোন ধরি। কে? জানতে চাইলে ওপাশ থেকে জবাব আসে মামা আমি নুরুর ভাগিনা রাশেদ। রাশেদ কেমন আছ? এতো রাতে ফোন। সে বললো, নুরু মামাকে পুলিশ বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে। পুলিশের আচরণ খুব রুঢ় ছিল। ভাল ঠেকছে না। মামা কিছু করেন। সারা রাত আর ঘুমাতে পারি নি। টিভি চ্যানেল গুলোকে খবর দিলাম। কয়েকটি টিভি স্ক্রলে নিউজও করেছে। আমাদের ধারণা ছিল যেহেতু পুলিশ তুলে নিয়েছে এবং টিভিতে নিউজ এসে গেছে হয়তো গুম, খুন করবে না। এরেস্ট দেখাবে। কিন্তু না, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের পুলিশ তা করেনি।

সারা রাত ধরে কথা হয় ভাগিনা রাশেদ, ইঞ্জিনিয়ার বেলায়েত হোসেন ও গিয়াস কাদের চৌধুরীর সাথে। সকাল ৯টার দিকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী আমাকে ফোন দেন। কন্ঠ প্রচণ্ডভারি।

গনি তুমি কই?
আমি বললাম ভাইজান মাত্র প্রেসক্লাবে আসলাম।
তিনি বললেন, নুরু মনে হয় নেই। ওকে মেরে ফেলেছে।
আমি বললাম কিভাবে বুঝলেন?
তিনি বলেন, কর্ণফুলী নদীর তীরে তাঁর লাশ পড়ে আছে।
আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন এটি নুরুর লাশ?
আমি লোক পাঠিয়েছিলাম, তাদের দেয়া বর্ণনা অনুযায়ী আমি নব্বই ভাগ নিশ্চিত এটা নুরুর লাশ। কিছুক্ষণের মধ্যে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারবো। আমি বললাম আপনি কি বাসায়, আমি আসতেছি।

তখন আমার দু'চোখ পানিতে ভেসে যাচ্ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল নেতা শাওনকে নিয়ে ছুটে গেলাম গিয়াস ভাইয়ের বাসায়। আমাকে পেয়ে গিয়াস ভাই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। পুরোদিন গিয়াস ভাইয়ের বাসায় ছিলাম। সেখান থেকে বার বার কথা হয় ডাঃ শাহদাত ভাই ও ইঞ্জিনিয়ার বেলায়েত ভাইয়ের সাথে। লাশ উদ্ধারের আয়োজন করা হয়। পুলিশকে জানানোর পরও লাশ উদ্ধারে কোনো আগ্রহ তাদের ছিল না। দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠলে বিকেল ৪টার দিকে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। রাউজান থানার ওসি নুরুর পরিচয় দিল সন্ত্রাসী নুরুইয়্যা বলে।

গিয়াস ভাই পরের দিন ফাস্ট ফ্লাইটে চলে যান চট্টগ্রামে। আমি, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, বিএফইউজে মহাসচিব এম আবদুল্লাহ, ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলাম রিজু, ইঞ্জিনিয়ার আলমগীর হাসিন আহমেদ, ইঞ্জিনিয়ার সবুজ, ইঞ্জিনিয়ার সাইফুল ইসলাম, ইঞ্জিনিয়ার চুন্নুসহ পেশাজীবী নেতারাও ভোরে রওনা দেই চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। দুপুরে জামিয়াতুল ফালাহ মসজিদে জানাজায় অংশ নিই এবং মাহমুদুর রহমানের নেতৃত্বে নুরুর পরিবারের সাথে দেখা করি। মাহমুদুর রহমান নুরুর সন্তানদের লেখা পড়ার ভার নিজ কাঁধে তুলে নেন। নুরুর ছোট বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে অঝোর ধারায় কেঁসেছিলেন মাহমুদুর রহমান।

নুরুর স্ত্রী জানালো, ২৯ মার্চ বুধবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে নুরু তার ছোট শিশুকে বুকে নিয়ে শুয়েছিল৷ এমন সময় পুলিশ এসে দরজার কড়া নাড়ে। নুরুর ভাগিনা দরজা খুলতেই ১০ জন হৈ-হুল্লোড় করে বাসায় ঢুকে যায়। এদের মধ্যে-আট জন সিভিল পোশাকে ছিল আর দু-তিনজন ছিল পুলিশের পোশাকে৷ তাদের হাতে ছিল শট গান এবং চাইনিজ বন্দুক৷ তারা ঘরের ভিতরে ঢুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ছোট ছেলেটিকে নুরুর বুক থেকে টেনে আমার কাছে দিয়ে দেয়। এরপর নুরুকে জামার কলার ধরে টেনে খাট থেকে নামায়৷ ধাক্কাতে ধাক্কাতে মাইক্রোবাসে তোলে। স্যান্ডল পর্যন্ত পড়তে দেয় নি। গাড়িতে তুলেই হ্যান্ডকাপ পড়ানো হয়। জামা দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে। আমার বুক তখন ধড়ফড় ধড়ফড় করে কাঁপছিল। আমি ছুটে গিয়ে বলি, ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? আমাকে সরিয়ে দিয়ে গাড়ি দ্রুত চলে যায়।

তিনি বলেন, ‘‘এরপরই আমরা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করি, থানার ওসিকে জানাই৷ কিন্তু পুলিশ বিষয়টি অস্বীকার করে৷ তারা জানায়, পুলিশের কেউ তাঁকে তুলে নিয়ে যায়নি৷ সারারাত পুলিশের সাথে যোগাযোগ করি। ওরা আমাদের কোনো সহযোগিতাই করলোনা। পরে বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে তাঁর লাশ পরে থাকার খবর পাই আমরা৷''

তিনি আরো জানান, ‘‘নুরুর মাথায় তিনটি গুলির চিহ্ন আছে আর কাধে আছে জখমের চিহ্ন ৷ তাঁর হাত-পা দড়ি দিয়ে বাধা ছিল, মুখ ও চোখ বাধা ছিল ওড়না এবং জামা দিয়ে৷''

৩০ মার্চ বাংলাদেশের সংবাদপত্রে গুরুত্বসহ ছাপা হয় এ নিউজ। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, নিজ বাড়ি থেকে আনুমানিক ৫ কিলোমিটার দূরে কর্ণফুলী নদীর তীর থেকে বিকেল ৪টার দিকে ছাত্রদল নেতা নুরুল আলম নুরুর মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। 

ওই দিন ছিল বৃহস্পতিবার, মার্চ ৩০, ২০২০। দুপুর ২টার দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। ঘটনাস্থলে গিয়ে ২ ঘন্টা শলাপরামর্শ করে বিকেল ৪টার দিকে পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে। রাউজান উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের কোয়েপাড়া গ্রামের খেলাঘাট এলাকায় উপুড় হয়ে ছিল তার মরদেহ।

নুরুর বাড়ি রাউজান উপজেলার গুজরা ইউনিয়নের নোয়াপাড়া গ্রামের কমলার দিঘীর পাড় এলাকায়।

রাউজান থানার ওসি মো.কেফায়েত উল্লাহ গনমাধ্যমকে বলেন," আমরা একটা লাশ উদ্ধার করেছি।মাথায় গুলির চিহ্ন আছে। সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন আছে। হাত-পা রশি দিয়ে বাঁধা।তার পরণে আছে লুঙ্গি।শার্ট দিয়ে চোখ বাঁধা। মুখের ভেতর ওড়না ঢোকানো পাওয়া গেছে।"

ওসি বলেন, "পরিচয়ও আমরা নিশ্চিত হয়েছি। সে বিএনপির ক্যাডার নুরুল আলম নুরু প্রকাশ নুরাইয়া। তার বিরুদ্ধে রাউজান থানায় দুইটি হত্যা, একটি বিস্ফোরকসহ চারটি মামলা আছে। এছাড়া ‌আরও বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা আছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।"

নুরুকে হত্যার পর তাঁর পরিবারের উপর আসতে থাকে নানান হুমকি। আত্নগোপন চলে যেতে হয় প্রত্যক্ষদর্শী নুরুর ভাগিনা রাশেদকে। যার কারণে ঘটনায় ১৩ দিন পর এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ দায়ের করেন তাঁর স্ত্রী সুমি আক্তার। চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম মাসুদ পারভেজের আদালতে এই অভিযোগ দাখিল করেন তিনি। দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায় করা এই অভিযোগে এক পুলিশসহ ১৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। অভিযুক্তরা হলেন রাউজান থানার নোয়াপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির এসআই শেখ মোহাম্মদ জাবেদ, বাবুল মেম্বার, খালেক মেম্বার, জসিম, সেকান্দর, নাসের ওরঢে টাইগার নাসের, এমরান, মো. হাসান, নুরুল ইসলাম, লিটন, মেহেদি, ভূপেষ বড়ুয়া ও রব্বান।

নুরুর ওপর ফ্যাসিবাদী সরকারের আক্রোশের মূলকারণ ছিল সে ছিল জাতীয়তাবাদী হেল্প সেলের সমন্বয়কারী। যেখানেই গুম খুনের ঘটনা ঘটতো, নুরু সেখানেই গিয়ে হাজির হতো। হেল্প সেলের ব্যানারে নিয়মিত সভা,সমাবেশ ও সেমিনারের মাধ্যমে সংবিধান ও মানবতা বিরোধী এ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন জোরালো ভাবেই। মে মাসে সারা দেশের গুম পরিবারকে নিয়ে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে একটি সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। ওই সমাবেশের সমন্বয়ক ছিলেন নুরু।

নুরু হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে ওইদিনই বিবৃতি দেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া।

ক্ষমতাসীনদের নির্দেশেই আইনশৃংখলা বাহিনী নুরুকে হত্যা করেছে বলে দাবি করেন তিনি।

তিনি বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হবে, সেদিন আর বেশি দূরে নয়।

বৃহস্পতিবার রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে খালেদা জিয়া বলেন,এ পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বর্তমান সরকার রেহাই দিলেও সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন তাদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। ত্রাস সৃষ্টি করে ক্ষমতার দাপটে জনগণকে ভয় পাইয়ে দেয়ার অপকৌশল করে কোনো লাভ হবে না।

তিনি বলেন, আমি আইনশৃংখলা বাহিনীর দ্বারা নির্মমভাবে নিহত নুরুল আলম নুরুর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোকে কাতর পরিবারবর্গ ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।

সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, নুরুল আলম নুরুকে পুলিশ আটক করেও অস্বীকার করে। পরে তাকে হত্যা করে লাশ চট্টগামের রাউজান উপজেলার দাগুয়ান ইউনিয়নের কর্ণফুলী নদীর তীরে খেলাঘাট কৈয়াপাড়া এলাকায় ফেলে রাখা হয় এ মর্মন্তুদ ও পৈশাচিক ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান তিনি।

বিবৃতিতে খালেদা বলেন, বাংলাদেশকে গোরস্থানে পরিণত করাই যেন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য। দেশের শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত মৃত্যু বিভীষিকা ওঁৎ পেতে আছে। দেশের মানুষ আজ রক্তহিম করা ভীতি এবং উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন যাপন করছে। চারিদিকে সংশয়-ভয়জনিত আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে।

তিনি বলেন, রক্তাক্ত সহিংসতা আওয়ামী দুঃশাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ সরকারের ক্রোধের প্রধান টার্গেট হচ্ছে যুবক ও তরুণরা। ফ্যাসিস্টদের ভয়াবহ ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে প্রতিবাদী তরুণরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। আর সেজন্যই দেশবিরোধী নানা অপতৎপরতায় লিপ্ত সরকারের বিরুদ্ধে তারুণ্যের দ্রোহকে নির্মূল করার জন্যই আওয়ামী সরকার জাতীয়তাবাদী শক্তির ছাত্র ও যুবকদের হত্যা করছে। সরকারের এ ধারাবাহিক প্রাণঘাতী নৃশংসতার করুণ শিকার হয়েছে নুরুল আলম নুরু।

খালেদা জিয়া বলেন, ছাত্রনেতা নুরুল আলম নুরু হারানো গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। এজন্যই তাকে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, যে সরকার বাক, চিন্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিতে পারে, সেই সরকার নিজেদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার স্বার্থে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্বিচারে হত্যা করতে দ্বিধা করে না। বর্তমান ভোটারবিহীন সরকার ক্ষমতার মোহে অন্ধ ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সরকার নিজেই দুর্বিনীত অনাচার সৃষ্টি করে দেশকে এক মহাদুর্যোগের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। তবে রক্তাক্ত পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে লাশের স্তূপ বানিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে না বর্তমান শাসকগোষ্ঠী। ক্ষমতাসীনরা টের পাচ্ছে না যে, তাদের অপকীর্তি ও অনাচারের জন্য তাদের দিকে মহাদুর্দিন এগিয়ে আসছে। বর্তমান আওয়ামী সরকারের অপশাসনে দেশের সামগ্রিক আইনশৃংখলা পরিস্থিতি এখন কুৎসিত রূপ ধারণ করেছে।

মনে বাজছে সেই বিখ্যাত দেশাত্নবোধক গানের কয়েকট লাইন — 


কত বিপ্লবি বন্ধুর রক্তে রাঙা, বন্দীশালার ওই শিকল ভাঙাতাঁরা কি ফিরিবে আজ সুপ্রভাতেযত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে৷


  • লেখক পরিচিত — সভাপতি, ডিইউজে। 

No comments:

Post a Comment