Search

Monday, March 9, 2020

মহামারী মোকাবেলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা দুর্বল — জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় ও এনটিআইয়ের প্রতিবেদন


যেকোনো দেশে উদ্ভূত জৈব হুমকিই বিশ্বস্বাস্থ্য, আন্তর্জাতিক সুরক্ষা ও বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। প্রাকৃতিক, ইচ্ছাকৃত বা দুর্ঘটনাজনিত—এমন যেকোনো কারণেই দেখা দিতে পারে এ জৈব হুমকি। সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে ভৌগোলিক সীমারেখা মানে না। এর অন্যতম উদাহরণ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাস। এ ধরনের সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে বিশ্বের সব দেশেরই জনস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি অবস্থা প্রতিরোধ, শনাক্ত ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের সক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। যদিও গবেষণার তথ্য বলছে, মহামারী মোকাবেলায় যথেষ্ট সক্ষমতা নেই বাংলাদেশের।

বৈশ্বিক স্বাস্থ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে তৈরি গ্লোবাল হেলথ সিকিউরিটি (জিএইচএস) বা বৈশ্বিক স্বাস্থ্যনিরাপত্তা সূচক অনুযায়ী, জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা মোকাবেলায় দুর্বল অবস্থানে থাকা দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যনিরাপত্তায় ৩৫ স্কোর নিয়ে তালিকার ১৯৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩তম। দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট জিএইচএস সূচকটি তৈরি করেছে। সূচকের ভিত্তিতে সম্প্রতি ‘জিএইচএস ইনডেক্স: বিল্ডিং কালেক্টিভ অ্যাকশন অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবিলিটি’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নিউক্লিয়ার থ্রেট ইনিশিয়েটিভ ও জন হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের সেন্টার ফর হেলথ সিকিউরিটি। প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিশ্চিতে প্রত্যেক দেশেরই নিজ নিজ সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ছয়টি বিষয়কে কেন্দ্র করে সামগ্রিক সূচকটি তৈরি করা হয়েছে। এগুলো হলো প্রতিরোধ, শনাক্ত ও প্রতিবেদন, দ্রুত সাড়া প্রদান, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ ও ঝুঁকি পরিস্থিতি। এসব মানদণ্ড যাচাইয়ে ৩৪টি নির্দেশক ব্যবহার করা হয়েছে, যেগুলোর অধীনে ছিল ৮৫টি উপনির্দেশক। ১৪০টি প্রশ্নের মাধ্যমে এসব তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। প্রতিটি প্রশ্নের হ্যাঁ সূচক উত্তরের জন্য ১ ও না সূচক উত্তরের জন্য শূন্য নম্বর রাখা হয়। ছয়টি মানদণ্ডের প্রতিটিতে প্রাপ্ত নম্বরকে ওই মানদণ্ডের জন্য নির্দিষ্ট ভার অনুযায়ী হিসাব করা হয়। এরপর সামগ্রিক নম্বর বা স্কোরের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয় সংশ্লিষ্ট দেশের অবস্থান।

প্রতিটি দেশের অবস্থান প্রকাশ করা হয়েছে শূন্য থেকে ১০০ স্কেলে। বেশি স্কোর সংশ্লিষ্ট মানদণ্ডে দেশটির ভালো অবস্থান নির্দেশ করে। তাত্ক্ষণিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা, দ্রুত শনাক্ত ও সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক উদ্বেগসংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি, মহামারীর ব্যাপ্তি কমানো ও তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, রোগীদের চিকিৎসার সুব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যকর্মীর সুরক্ষা, জাতীয় সক্ষমতা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি ও জৈব হুমকির বিপরীতে সংশ্লিষ্ট দেশের ঝুঁকি পরিস্থিতি—এসব বিবেচনায় নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

প্রতিরোধ মানদণ্ডের আওতায় থাকা নির্দেশকগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল রেজিস্ট্যান্স, প্রাণী থেকে সংক্রমিত রোগ, জৈবনিরাপত্তা, দ্বৈত ব্যবহারযোগ্য গবেষণা ও বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণা এবং টিকাদান কর্মসূচি। মূলত আন্তর্জাতিকভাবে উদ্বেগ তৈরি হয় এমন জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা মোকাবেলার সক্ষমতা পরিমাপ করে মানদণ্ডটি। এতে ২৭ দশমিক ৩ স্কোর নিয়ে তালিকার ১৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৬তম। তাত্ক্ষণিক প্রতিরোধ সক্ষমতায় বাংলাদেশের স্কোর বৈশ্বিক গড়েরও কম। এক্ষেত্রে বৈশ্বিক গড় স্কোর ৩৪ দশমিক ৮। অর্থাৎ এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি যৎসামান্যই।

মহামারী প্রতিরোধ সক্ষমতায় সবচেয়ে এগিয়ে থাকা ১২টি দেশের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির স্কোর ৮৩ দশমিক ১। এছাড়া প্রতিরোধ সক্ষমতায় এগিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সুইডেন, থাইল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফিনল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, নরওয়ে ও স্লোভেনিয়া। ভালো প্রস্তুতি রয়েছে এমন দেশের সংখ্যা ৭৯। মহামারী প্রতিরোধে সামান্যই সক্ষমতা থাকা দেশগুলোর কাতারে বাংলাদেশ অন্যতম।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া বণিক বার্তাকে বলেন, মহামারীর মতো কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা দুর্বল। এ মুহূর্তে যে রোগ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছে করোনা, এটা ডায়াগনোসিস করার সক্ষমতাসম্পন্ন কোনো ল্যাব ফ্যাসিলিটি-রিএজেন্টস-কিট আমাদের নেই। স্বাস্থ্যনিরাপত্তার প্রথম শর্তই হলো রোগ নির্ণয় করার সক্ষমতা থাকতে হবে। এখন পর্যন্ত স্ট্যান্ডার্ড ল্যাব ফ্যাসিলিটি ও গবেষণা আমাদের নেই। এখন নতুন ধরনের যেসব রোগ দেখা যাচ্ছে, যেকোনো কিছু আউটব্রেক হলে কীভাবে মোকাবেলা করা যাবে, সেদিকে মনোযোগ দিতে হচ্ছে।

প্রতিরোধে আমাদের নজর নেই। আমাদের নজর এখনো কোনো রোগ হলে সেটা সারানোর দিকে। কিন্তু রোগ হতে না দেয়া বিবেচনায় আমাদের সক্ষমতা আসলেই অনেক দুর্বল। আমাদের প্রস্তুতিটা যে কম সেটা দৃশ্যমান।

জিএইচএস প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দ্রুত শনাক্ত ও সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক উদ্বেগসংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ৫০ দশমিক ৯। এক্ষেত্রে অন্য সব দেশের প্রাপ্ত গড় স্কোর ৪১ দশমিক ৯। মহামারীর ব্যাপ্তি কমানো ও তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের প্রাপ্ত নম্বর ২৩ দশমিক ১। এক্ষেত্রে অন্য সব দেশের গড় স্কোর ৩৮ দশমিক ৪।

রোগীদের চিকিৎসার সুব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যকর্মীর সুরক্ষায় বাংলাদেশের প্রাপ্ত স্কোর ১৪ দশমিক ৭। এতে বৈশ্বিক গড় ২৬ দশমিক ৪। জাতীয় সক্ষমতা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ৫২ দশমিক ৫, যেখানে বৈশ্বিক গড় ৪৮ দশমিক ৫। আর জৈব হুমকির বিপরীতে দেশের দুর্বলতা ও সামগ্রিক ঝুঁকি পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশের স্কোর ৪৪, এক্ষেত্রে বৈশ্বিক গড় ৫৫।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, ২০১৬ সালে নির্ধারিত মানদণ্ডের সঙ্গে আরো কিছু বিষয় যুক্ত করে প্রতিবেদনটি তৈরি হয়েছে। প্রতিবেদনটির মূল ভিত্তি ওই সময়ের। এর মধ্যে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। এ সময়ে আমাদের স্বাস্থ্যনিরাপত্তা ব্যবস্থায় অনেক উন্নতি হয়েছে, যা প্রতিবেদনটিতে আসেনি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রেডিও নিউক্লিয়ারের ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতার অভাব ছিল, যা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। সম্প্রতি করোনাভাইরাসকে উপলক্ষ করে আমাদের প্রস্তুতি ও সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যনিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি সাধন হয়েছে। অর্থাৎ আগের অবস্থা এখন নেই। আমাদের ল্যাব ক্যাপাসিটিও এখন অনেক বেড়েছে। করোনার মতো সম্পূর্ণ নতুন রোগ আমরা শনাক্ত করে ফেলেছি। এতেই আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি প্রমাণ হয়েছে।

সার্বিক জিএইচএস সূচকে ৮৩ দশমিক ৫ স্কোর নিয়ে তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে যুক্তরাষ্ট্র। শীর্ষ ১০-এর অন্য দেশগুলো হলো যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, থাইল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, দক্ষিণ কোরিয়া ও ফিনল্যান্ড। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে স্বাস্থ্যনিরাপত্তায় এগিয়ে রয়েছে ভারত, ভুটান, পাকিস্তান ও নেপাল। ভারত তালিকার ৫৭তম, ভুটান ৮৫, পাকিস্তান ১০৫, নেপাল ১১১, শ্রীলংকা ১২০, মালদ্বীপ ১২১ ও আফগানিস্তান ১৩০তম অবস্থানে রয়েছে।

  • কার্টসি - বনিক বার্তা/ মার্চ ৯, ২০২০ 

No comments:

Post a Comment