Search

Thursday, March 19, 2020

করোনা, কোয়ারেন্টাইন ও প্রবাসীর কষ্ট

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ

এই মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী বহুল ব্যবহৃত দুটি আতঙ্কজনক শব্দ করোনা, কোয়ারেন্টাইন। ধারণা করা যায়, ২০২০ সালে এর চেয়ে আতঙ্কজনক আর কোনো শব্দ হয়তো বিশ্বকে এতটা নাড়া দেবে না। চায়নার উহানে শুরু হয়ে করোনা আতঙ্ক গ্রাস করেছে সারা পৃথিবীকে।

চায়নার পর ইতালি হয়ে ওঠে করোনার সবচেয়ে বড় টার্গেট। আক্রান্ত ও মৃত্যু বিবেচনায় এ দুটি দেশই এখনো শীর্ষে। মহাপরাক্রমশালী আমেরিকাও করোনার থাবায় কাবু হওয়ার পথে। পুরো ইউরোপই করোনার আঘাতে লন্ডভন্ড অবস্থা। এই ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে আশ্রয় করে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের প্রায় সব দেশে। বাদ যায়নি বাংলাদেশও। এ দেশেও আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যে দুই অঙ্ক ছুঁয়েছে। অনেকেই আশঙ্কা করেন, বিশেষ কারণে এত দিন শনাক্ত না করা হলেও অল্প সময়ের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে পারে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিয়েছেন অনেকে।

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
ইউরোপ-আমেরিকার করোনা ক্রাইসিস শুধু সেখানকার অধিবাসীদেরই আতঙ্কিত করেনি। সেখানে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে যে উৎকণ্ঠা, তা বাংলাদেশে বসবাসরত তাদের স্বজনদেরও উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। অনেকে দেশে ফিরতে চেয়েও পড়ছেন বিড়ম্বনায়। ইতিমধ্যে যেসব দেশের মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ফ্লাইট বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। লন্ডন ছাড়া ইউরোপের সব দেশের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ। এই সিদ্ধান্ত অতিমাত্রায় ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে করোনা ঠেকাতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ নিঃসন্দেহে।

কিন্তু যাদের স্বজনরা প্রতিটি মুহূর্ত আতঙ্ক নিয়ে ইতালি, সুইডেন, স্পেনের মতো দেশে আছেন, তাদের তো চিন্তায় ঘুম হারাম। প্রবাসীদের সেই আতঙ্ক, উৎকণ্ঠা ও ঝুঁকির ক্ষততে নতুন করে লবণের ছিটা দেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। তিনি প্রবাসীদের তাচ্ছিল্য করে বলেন, ‘যেসব দেশে করোনাভাইরাস অস্বাভাবিক মাত্রায় ছড়িয়েছে, সেসব দেশ থেকে যিনি আসবেন তাকে অবশ্যই কোয়ারেন্টাইনে যেতে হবে, এটাই সরকারি সিদ্ধান্ত। কিন্তু আমাদের প্রবাসীরা যখন আসেন, তারা এ ব্যবস্থায় খুবই অসন্তুষ্ট হন। দেশে এলেই সবাই নবাবজাদা হয়ে যান। ফাইভস্টার হোটেল না হলে তারা অপছন্দ করেন। কিন্তু বুঝতে হবে এটা তো একটা বিশেষ অবস্থা।’


এ কথা বলার সময় মন্ত্রী মনে রাখেননি, ওই প্রবাসীরাই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে অনেক বড় ভূমিকা রাখছেন। তাদের মধ্যে অনেক উচ্চশিক্ষিতও প্রবাসে বড় পদে অধিষ্ঠিত বা বড় ব্যবসায়ীও আছেন। আর তা না হয়ে খুব সাধারণ শ্রমিক হলেও তার পাঠানো টাকা দিয়ে দেশ চলে। তাদের সঙ্গে এই ব্যবহার কি করতে পারেন একজন মন্ত্রী?

ইতালি থেকে দেশে আসা ব্যক্তিরা কোয়ারেন্টাইনে যেতে অনীহা দেখানোতে এই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন মন্ত্রী। কিন্তু তারা কেন সেখানে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেননি সে কথাও বলেছেন মন্ত্রী নিজেই, ‘যারা দেশে এসেছেন, তারা কোয়ারেন্টাইনে যেতে চাননি। দেশে আসছেন, সুতরাং সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে যাবেন, এই আগ্রহ তাদের ছিল। তারপরও জনস্বাস্থ্যের বৃহত্তর স্বার্থে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে তাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়, যেখানে আগেও ৩১২ জনকে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তারা এসে সে জায়গা পছন্দ করেননি। যেমন বাংলাদেশে ফ্ল্যাট বাথরুম ব্যবহার করা হয়, তারা কমোড বাথরুম ব্যবহার করেন। সুতরাং তাদের অসুবিধা হয়েছে। আমরা পর্যটন করপোরেশন থেকে খাবার দিয়েছি, তারা মনে করেন, ফাইভস্টার থেকে খাবার দেওয়া উচিত। আমরা সেটা দিতে পারিনি। সেজন্য তারা অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তাদের বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ ছিল। পাঁচ ফুট দূরে দূরে বেড রাখা হয়েছে, তারা এগুলো পছন্দ করেননি। তারা চাচ্ছিলেন ভালো বেড-টেড।’

কিন্তু ফেরত আসা প্রবাসীদের এই চাওয়া কি খুবই অযৌক্তিক ও বাড়াবাড়ি? তাদের পাঠানো টাকায় দেশ চালাবেন, আর তারা এটুকুও চাইতে পারবে না? তাদের সব চাওয়া এই বিশেষ সময়ে হয়তো পূরণ করা সম্ভব নয়। যতটুকু সম্ভব সেটা করলে আর একটু সহানুভূতির সঙ্গে বুঝিয়ে বললে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত মন্ত্রী মহোদয়ের? আসলে বিনাভোটে ও রাতের ভোটের সরকার হলে যা হয়। কারও প্রতিই কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না তাদের। যাকে-তাকে যা খুশি বলা যায়।

আমাদের রাষ্ট্র পরিচালকদের কথা তো শুনছেন। এবার কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর কথা শুনুন। তিনি তার দেশের নাগরিকদের উদ্দেশে বলেছেন, চলমান কভিড-১৯ (করোনাভাইরাস) প্রাদুর্ভাবের কারণে তার সরকার কানাডিয়ানদের অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় পড়তে দেবে না। নিজের স্বাস্থ্য, পরিবারের স্বাস্থ্য, চাকরি, বাড়িভাড়া নিয়ে চিন্তিত হওয়ার দরকার নেই। সব সরকার দেখবে। করোনার কারণে বাড়িভাড়া, মুদি কেনাকাটা বা শিশুদের অতিরিক্ত সেবায় অর্থ খরচ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। আমরা কানাডিয়ানদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করব। আপনারা নিজের স্বাস্থ্য, পরিবারের স্বাস্থ্য, চাকরি, সঞ্চয়, বাড়িভাড়া, ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানো নিয়ে চিন্তিত আছেন। আমি জানি, (করোনার কারণে) বৈশ্বিক অর্থনীতির কারণে আপনারা অনিশ্চয়তায় আছেন। আপনাদের নিরাপদ রাখতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তাতে দেশের অর্থনীতির ওপর প্রভাব পড়বে। তবে এটা সত্য, আমরা অর্থনৈতিকভাবে এখন যে অবস্থানে আছি, তা আপনাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে যথেষ্ট।

এই হলো একজন স্টেটসম্যানের স্টেমেন্ট! আর আমরা কোথায় আছি! বাংলাদেশ সরকার তার দেশের নাগরিকদের, এমনকি যারা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে মুখ্য ভূমিকা রাখছেন, তাদের পর্যন্ত কোয়ারেন্টাইন ক্যাম্পে মানবেতর অবস্থায় রাখছেন। তা পছন্দ না হওয়ায় প্রতিবাদ করেছেন কিছু প্রবাসী। ব্যাস। অমনি খেপে গেলেন আবদুল মোমেন। শুরু করে দিলেন প্রবাসীদের নিয়ে মর্যাদাহানিকর কটাক্ষ!

১৯৯৮ সাল। ভোরের কাগজ থেকে বিশাল কর্মীবাহিনী যখন সম্পাদক মতিউর রহমানের ডাকে প্রথম আলোর দিকে পা বাড়ায়, তখন লেখক আবু সুফিয়ানের সঙ্গী হয়ে আমরা কয়েকজন যোগ দিই যায়যায়দিনে। ‘যায়যায়দিন প্রতিদিন’ নামে দৈনিক বের করার আগে শফিক রেহমান কয়েক মাস ধরে বেশ কিছু সাংবাদিক নিয়োগ দিয়ে ট্রেনিং করাচ্ছিলেন। প্রশিক্ষক হিসেবে তিনি নিজে ও তার স্ত্রী ডেমোক্রেসিওয়াচের নির্বাহী পরিচালক তালেয়া রেহমান ছাড়াও দেশি-বিদেশি অনেকেই ছিলেন। ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক আতাউস সামাদও।

তখনই সাংবাদিক শফিক রেহমানের একটা কথা মনে ধরেছিল। তিনি বলেছিলেন, সব সময় সতর্ক থাকবে, যাতে তোমাদের লেখায় কেউ বিনা দোষে আঘাত না পায়। আর অন্তত তিনটা শ্রেণির ব্যাপারে মমতা নিয়ে লিখবে। সীমান্তবর্তী বাংলাদেশি, সমুদ্রের জেলে ও প্রবাসী বাংলাদেশি। এরা সবাই বাঁচার জন্য, পরিবারের জন্য, দেশের জন্য ঝুঁকি ও কষ্টের জীবনযাপন বেছে নিতে বাধ্য হয়। অনেকে পরিবার থেকে দূরে থাকে।

সেই থেকে মাথায় ঢুকে আছে এই তিন শ্রেণির মানুষের প্রতি অগাধ মমতা।

ভাবুন তো, নিজের দেশ, পরিবার-পরিজন রেখে, জমিজমা বিক্রি করে, কত ঝুঁকি নিয়ে আমাদের ছেলেরা পাড়ি দেয় বিদেশবিভুঁইয়ে। বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণি। কেন যায়? যায় এজন্য যে, তারা এই দেশে মোটামুটি সম্মানজনকভাবে খেয়ে-পরে থাকার মতো কোনো কাজের নিশ্চয়তা পান না। পাশাপাশি দেখে, পরিচিত কেউ কেউ বিদেশে গিয়ে অর্থ উপার্জন করে দেশে পাঠিয়ে তার পরিবারের অসচ্ছল অবস্থা কাটিয়েছেন।

যদি তারা নিজের বাড়িতে বা দেশে থেকেই আয়-রোজগার করে পরিবার পরিজন নিয়ে চলতে পারতেন, তবে কি আর এত কষ্ট ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে বিদেশে যেতেন?

বিদেশে আয়-রোজগার করে সেই টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন বলেই আমাদের সরকারের লোকজন এত ফুটানি দেখাতে পারছে। রিজার্ভের যে তৃপ্তিটা দেখাতে পারছে সরকার, তার পেছনেও এই প্রবাসীরাই মুখ্য ভূমিকা রাখছেন। প্রায় এক কোটি প্রবাসী বছরে দেড় হাজার কোটি ডলারের বেশি অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন। দেশের জিডিপিতে তাদের পাঠানো অর্থের অবদান প্রায় ১২ শতাংশ। অথচ সেই প্রবাসীদেরই এত তাচ্ছিল্য! প্রবাসীদের এভাবে ছোট করার, কটাক্ষ করার ঔদ্ধত্য ও রুচি দেখে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বড় ভাই সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিশ্চয়ই মনে মনে বলছেন, রাবিশ।

  • সায়ন্থ সাখাওয়াৎ-লেখক, চিকিৎসক ও কলামিস্ট
  • কার্টসি - দেশ রুপান্তর  

No comments:

Post a Comment