মরিয়ম চম্পা
রাজধানীর ফার্মগেটের রাজাবাজার এলাকায় এক কক্ষের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন। ব্যবসা থেকে যা আয় হয় তার একটি অংশ দিয়ে নিজের খরচ মেটান। কিছু টাকা বাড়ি পাঠান পরিবারের জন্য। জামাল বলেন, বছরের শুরুতে একবার বাসা ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এখন বিদ্যুৎ এবং পানির দাম বাড়ায় আবার ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দিয়েছে বাড়িওয়ালা। এমনিতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এভাবে সব বাড়তে থাকলে নিজের আয়ে নিজেই চলতে পারব না। পরিবারকে দেখাশোনা করবো কীভাবে? শুধু জামাল উদ্দিনই নন, এমন ত্রাহি অবস্থায় রাজধানীর মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ।
রাত পোহালেই ব্যয় বাড়ে। চাল-পিয়াজের বাজারে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। এমন অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির দাম বাড়ছে দফায় দফায়। সব মিলিয়ে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের টালি মিলাতে পারছেন না অনেক মানুষ। এতে সাধারণ মানুষের অনেককে ব্যয় কমাতে হচ্ছে। কমাতে হচ্ছে অতি প্রয়োজনীয় চাহিদাও।
রাজধানীর পল্লবীতে দুই সন্তান নিয়ে থাকেন মাহফুজুর রহমান। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মাসে ৩৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। দুই বেড় রুমের বাসা ভাড়া দেন ১২ হাজার টাকা। বাকি টাকায় দুই সন্তানের স্কুলের খচর, মাসের বাজার এবং নিজের মতিঝিলের অফিসে যাতায়াতের খরচ মেটাতে গিয়ে হিমশিম অবস্থা। এই চাকরিজীবী বলেন, এখন যেভাবে চলছি এটা জীবন না। দুই বছর ধরে অফিস কোন বেতন বাড়ায়নি। বলছে ব্যবসার অবস্থা ভাল না। কিন্তু দুই বছরে দুইবার বাসা ভাড়া বেড়েছে। গ্যাসের দাম, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। এবার পানির দামও বাড়লো। চাল, ডাল, পিয়াজসহ নিত্য পন্যের দাম বেড়েই চলছে। বছর শেষে ছেলে-মেয়ের স্কুল থেকে বেতন বাড়ানোর নোটিশ আসে। এতো বৃদ্ধির মধ্যে বেঁচে থাকাই দায়।
পরিস্থিতি আরও জটিল পান্থপথ সিগন্যালে চা বিক্রেতা সবুজের জন্য। তিনি বলেন, বউ বাচ্চা নিয়ে একটি বস্তিতে সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে থাকি। আমরা যারা ছোট ব্যবসা করি তাদের সমস্যা আরো বেশি। আমাদের বেশিরভাগ কাস্টমার রিকশাওয়ালা ও ছোটখাট চাকরিজীবী। পকেটে টাকা না থাকলে তারা কি দোকানে চা খেতে আসবে। পেয়াজ খাওয়াতো ছেড়েছি সেই কবেই। মাছ-মাংস ১৫ দিনে একবার খাওয়া হয়। যেভাবে সব কিছুর দাম বাড়ছে তাতে টিকে থাকাই কষ্টকর।
আয়-ব্যায়ের জটিল এই পরিস্থিতির মধ্যেই পানি ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে চাপে পড়বেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি মানবজমিনকে বলেন, এটার বিরূপ প্রভাবে সব কিছুর দাম বাড়বে। এটাতো নতুন কিছু না। বিদ্যুৎ যে সকল স্থানে ব্যবহৃত হয় সে সকল স্থানে পণ্যের দাম, বাসা ভাড়া, জীবন যাত্রার ব্যয় বাড়বে। বিদ্যুতের জন্য একদিকে যেমন বেশি বিল দিতে হবে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ থেকে উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়বে। যারা বিদ্যুৎ ব্যবহার করে না তাদেরকেও বাড়তি দামে জিনিসপত্র কিনতে হবে। এগুলো হঠাৎ করে হয়নি। আর এটা শুধু নিম্ন আয়ের বা নিন্মমধ্যবিত্তদের জন্য না উদ্যোক্তাদের জন্যও সমস্যা হবে। উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। ফলে তাদের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা কমবে। সরকারের বিদ্যুৎ খাত যে নকশা বা পরিকল্পনা দিয়ে চলছে সে নকশার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে এটা। এবং এটি এখানেই থামবে না। আরো বাড়বে। এবং বিদ্যুতের সঙ্গে দেশি বিদেশি অনেক ব্যবসায়ী জড়িত। তাদের মুনাফা বাড়ানোর জন্য এটি দরকার। পানির ক্ষেত্রেও তাই। দেশি বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যুক্ত হচ্ছে পানির সঙ্গে। তাদের মুনাফা বাড়াতেও এটি দরকার।
তেজতুড়ি বাজার এলাকার বাড়িওয়ালা এখানে আমার দুটি বাড়ি। এরমধ্যে একটিতে ছাত্রী হোস্টেল। যাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। এমনিতেই হোস্টেলগুলোতে ভাড়া আদায়ে নানান ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়। এখন নতুন করে পানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় আগামী মাসের হোস্টেল ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দিয়েছি। গতকাল অনেক ছাত্রী হোস্টেল ছাড়ার আবেদন করেছে। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে পানির দাম বাড়ানো হয়েছে। সরকার তাদের প্রকল্পের চুরি বন্ধ করতে পারে না, এর দায় চাপে আমাদের ওপর। আমরা কোথায় যাব। সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এর ফলে জীবন যাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। কারণ, বিদ্যুৎ ও পানি প্রায় সকল উৎপাদনের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। এগুলোর প্রভাব পরবে দ্রব্যমূল্যে। এর বিরূপ প্রভাবতো সমাজের সাধারণ মানুষের উপর পড়বেই। এগুলো করা হচ্ছে মূলত এরসঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যপক দুর্নীতি ও অনিয়মের দায় সাধারণ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দিতে। যেটা কোনোভাবেই কাঙ্খিত এবং গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে কোনো কথা বলে লাভ নেই। তারপরও আমরা কথা বলছি। অবস্থা এমন হয়ে গেছে যে ক্ষমতাসীনরা কারো প্রতি কর্নপাত করে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এটা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়াবে। কারণ আমাদের দেশের যে প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয় ৮ ভাগেরও বেশি যার সুফল ভোগ করে মাত্র শতকরা চার থেকে পাঁচভাগ লোক। এর নিচে যারা শতকরা ৯৫ ভাগ লোকের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। হলেও খুব সামান্য। কাজেই সাধারণ মানুষ খুব বেশি কষ্টে পড়বে। নিম্নবিত্ত তথা মধ্যেবিত্তদের পক্ষেও এই বাড়তি আয় যোগানো মুশকিল। কারণ তাদের আয় সত্যিকার অর্থে বাড়েনি। কাজেই এটা খুবই দুর্ভোগ বাড়াবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সরকার যে ভর্তুকি দিচ্ছে সেটা কমানোর জন্য দাম বাড়ানো হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হবে যে, ভর্তুকি দেয়া লাগছে কেন? বিদ্যুৎ চুরির জন্য। এই চুরিটা যদি ঠেকানো যায় তাহলে মানুষকে কষ্ট দিয়ে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হয় না। সে জন্য মনে হয় চুরির বিষয়টি দেখা উচিৎ।
- কার্টসি - মানবজমিন/ মার্চ ১, ২০২০
No comments:
Post a Comment