Search

Wednesday, March 4, 2020

বিদ্যুৎ-পানির মূল্যবৃদ্ধি ও ভূলুণ্ঠিত ভোক্তা অধিকার

এস এম নাজের হোসাইন


‘ভোক্তা’ শব্দের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। ভোক্তার ইংরেজি শব্দ কনজ্যুমার, যার অর্থ ভোগকারী। অর্থাৎ কোনো পণ্য, খাদ্য, পানীয় দ্রব্য বা সেবা প্রদানকারীর সেবা গ্রহণ করে যারা, তাদের ভোক্তা বলা হয়।

দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ২০০৯-এর আওতায় ‘ভোক্তা হলেন তিনিই, যিনি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যতীত সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে বা সম্পূর্ণ বাকিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন অথবা কিস্তিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন।’ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কোনো না কোনোভাবে একজন ভোক্তা।

আবার অনেকে বলে থাকেন, মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে যেসব অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্র ও জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত, সেগুলোই ভোক্তা অধিকারের আওতায় থাকে।

জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকারগুলোর মধ্যে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, নিরাপদ পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার, পণ্যের উপাদান, ব্যবহারবিধি, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি তথ্য জানার অধিকার, ন্যায্যমূল্যে সঠিক পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার, কোনো পণ্য বা সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ ও বসবাস করার অধিকার, অভিযোগ করার ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার অন্যতম।

আর সাধারণ মানুষ আশা করে, এ বর্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য, বিদ্যুৎ-পানি ও গ্যাসের মূল্য তাদের নাগালের মধ্যে থাকবে। কিন্তু বছরের শুরুতেই একসঙ্গে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়িয়েছে সরকার।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান সংবাদ সম্মেলন করে এবং ঢাকা ওয়াসা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। বিইআরসি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে অন্তত লোক দেখানো গণশুনানি করেছিল।

ঢাকা ওয়াসা গণমাধ্যমের মুখোমুখি না হয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। ইতিমধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম হু-হু করে বেড়েছে। সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের খরচ আরও বাড়বে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের বিরোধিতার পরও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি ছিল না। বাড়তি দামে বিদ্যুৎ কেনার পাশাপাশি এর প্রভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ও সেবা সার্ভিসের দাম বাড়বে।

প্রতিমাসে ভোক্তাদের বাড়তি টাকা গুনতে হবে। এমনিতে গত কয়েক মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রধান প্রধান ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। চালের দাম বাড়ানো হয়েছে কয়েক দফা। বেড়েছে চিনি, ভোজ্যতেল, ডাল, পেঁয়াজ ও রসুনের দাম। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতিও হঠাৎ লাফ দিয়েছে।

সব মিলিয়ে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষ যখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখনই বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়াল সরকার। অন্যদিকে গত বছরের ২৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে প্রদত্ত সুপারিশের একটিও কার্যকর না করে গণশুনানিকে হাস্যকর করা হয়েছে।

ভোক্তাদের স্বার্থ চিন্তা না করে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে গণশুনানির মাধ্যমে নতুন মূল্য পুনর্নির্ধারণের দাবি উঠেছে। একতরফাভাবে গ্রাহকের মতামত ছাড়া ওয়াসার পানির দাম বাড়ানো ভোক্তা সংরক্ষণ আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মনে করছেন ভোক্তা আন্দোলনের নেতারা।

বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করে এবং এ খাতে বিরাট দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি করে।

সাময়িক সংকট সমাধানের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কথা বলা হলেও এখনও সেগুলো চলছে। উৎপাদন না করেই ভাড়া হিসেবে জনগণের পয়সা নিয়ে হরিলুট করা হচ্ছে। বিদ্যুতের এ দাম বাড়ার প্রভাব কেবল বাসাবাড়িতে পড়বে তা নয়, কৃষি ও শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচও অনেক বাড়বে।

করোনাভাইরাসসহ বৈশ্বিক অনেক কারণে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে। অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকই নিম্নগামী। বিশ্ব অর্থনীতিও মন্দার আশঙ্কায়। কমে যাচ্ছে সামগ্রিক চাহিদা। এ রকম একসময়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কতটা সময়োপযোগী?

এ মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিম্ন ও মধ্যবিত্তের স্বার্থবিরোধী। অর্থ খরচ করে অর্থহীন কাজ হয়েছে। সব ক্ষেত্রে জনগণের খরচ ও পণ্যের দাম বাড়বে। পুরো প্রক্রিয়াটিই জনগণের বিরুদ্ধে চলে গেছে।

এটা খুবই দুঃখজনক, বিইআরসির চেয়ারম্যান সৌজন্যবশত বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পক্ষে গণমাধ্যমে কিছু কথাবার্তা বললেও ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ সেই সৌজন্য দেখানোরও প্রয়োজন বোধ করেনি।

ওয়াসা নামক প্রতিষ্ঠানটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ না করে লোকসানের দায়ভার সব সময় জনগণের ওপর চাপানো হচ্ছে। ওয়াসার সব পর্যায়ে অনিয়ম, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে হরিলুট, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, সিস্টেম লস কমানো গেলে লোকসানের মাত্রা এত হতো না।

অধিকন্তু প্রতিটি সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের পদাধিকারীরা ভোক্তা তথা জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। ঢাকা ওয়াসা আইনের তোয়াক্কা করছে না, বিষয়টি দুঃখজনক। ঢাকা ওয়াসার পানি বিপজ্জনক মাত্রায় দূষিত, যা মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।

ফুটিয়ে বা অন্য উপায়ে বিশুদ্ধ না করলে এ পানি পানযোগ্য হয় না। ওয়াসার পানিতে কাদা-ময়লা, শ্যাওলা তো থাকেই, মাঝে মাঝে কীট-কেঁচোরও দেখা মেলে। তাই পানির দাম বাড়ানোর আগে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের উচিত ভেবে দেখা কী মানের পানি গ্রাহককে দিচ্ছে তারা।

একতরফাভাবে গ্রাহকের মতামত ছাড়া পানির দাম বাড়ানো ভোক্তা সংরক্ষণ আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ভোক্তা অধিকার আইন ২০০৯ অনুসারে, পানির দাম বাড়াতে হলে ওয়াসাকে অবশ্যই ভোক্তাদের মতামত নিতে হবে।

গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে গণশুনানির ব্যবস্থা আছে, কিন্তু ওয়াসা সে বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তাই ওয়াসার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা উচিত।

সরকার এমন একসময়ে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়াল, যখন চাল, চিনি, ভোজ্যতেল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ভোগ্যপণ্য ও সেবা সার্ভিসের দাম বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব ইতিমধ্যে দেশের অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে।

বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়লে সে প্রভাব আরও প্রকট হবে। সরকার বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়িয়ে শিল্প গ্রাহকদের কাছ থেকে যে বাড়তি অর্থ পাবে, তা শিল্পের মালিকরা কি নিজেদের পকেট থেকে দেবে? তারা তাদের উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের পকেট থেকে তা সুদে-আসলে উশুল করবেন।

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে শেষ বিচারে ভোক্তাদের ওপরই সবকিছুর আর্থিক চাপ বাড়বে, বিপুলসংখ্যক সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান আরও কমে যাবে। বিদ্যুৎ ও পানির দাম না বাড়িয়ে ওই দুটি খাতে যে বিপুল অপচয়, অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে হরিলুট চলছে, তা বন্ধ করতে কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে।

জনগণের করের অর্থে পরিচালিত সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের পদাধিকারীদের ব্যর্থতা, অদক্ষতা, অনিয়ম ও অপচয়ের দায় জনগণের ওপর চাপানো ঠিক হবে না। এছাড়া সরকারি দফতরগুলোর কার্যক্রম তদারকির জন্য গণশুনানির পাশাপাশি উন্নয়ন কার্যক্রম ও প্রকল্পের মান যাচাই ও সেবার মান নিশ্চিতে নাগরিক পরিবীক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করা ছাড়া জাতির পিতার নির্দেশিত তৃণমূলে জনসেবা নিশ্চিত যেমন কঠিন হবে, তেমনি সরকারি দফতরের অদক্ষতা, অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করা শুধু কঠিন নয়, স্বপ্ন হয়ে থাকবে।

আর জনগণ শুধু করের বোঝা টানবে না, সবকিছুর দায়ভারও তাদের বহন করতে হবে, যা জাতির পিতার স্বপ্নের পরিপন্থী। তাই আমরা আশা করি, সরকার মুজিববর্ষের চেতনা বাস্তবায়নে ভোক্তা অধিকার সুরক্ষায় পানি, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা থেকে সরে আসবে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ও সেবা জনগণের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখতে কার্যকর উদ্যোগ নেবে।

বিদ্যুৎ ও ওয়াসার মতো সরকারি অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কোনোভাবেই জনমত ও ভোক্তা অধিকার আইনকে উপেক্ষা করতে পারে না। কারণ জনগণের করের টাকায় তাদের বেতন-ভাতা দেয়া হয়।

জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে ‘ঋণ ও ভর্তুকিনির্ভরশীল উন্নয়ন নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ, প্রকল্প বাজেট বারবার সংশোধন করে বিপুল অর্থ লুটপাট করে আবার সেই অর্থের দায় গ্রাহকদের ওপর চাপিয়ে পানির দাম বাড়ানোর খোঁড়া যুক্তি প্রদর্শন কোনোভাবেই কাম্য নয়।

অন্যদিকে অপচয় রোধ, বিতরণ ও সরবরাহ লাইনে ত্রুটি, লিকেজ, চুরি বন্ধ, সিস্টেম লস বন্ধ, বিলিং ব্যবস্থার ত্রুটি দূর করে সেবা সার্ভিসের অব্যবস্থাপনা রোধে গ্রাহকদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি, গ্রাহক সেবার মান বাড়ানো এবং অনিয়ম রোধে ত্রিপাক্ষিক গণশুনানির আয়োজন করা, উন্নয়ন প্রকল্পের নাগরিক পরিবীক্ষণ নিশ্চিত করা, গ্রাহক হয়রানি রোধে তাৎক্ষণিক প্রতিকারের জন্য ডিজিটাল হেল্পলাইন চালু ও হেল্পডেস্ক আধুনিকায়ন, সেবার মানোন্নয়নে নীতিমালা প্রণয়নে ভোক্তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলেই এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

  • এসএম নাজের হোসাইন : ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
  • কার্টসি - যুগান্তর/ মার্চ ৩, ২০২০ 

No comments:

Post a Comment