Search

Sunday, March 29, 2020

কোভিড-১৯ বৃত্তান্ত — জানুন, বাঁচুন

ড. জাহিদ দেওয়ান শামীম

ড. জাহিদ দেওয়ান শামীম

বিশ্বব্যাপী নতুন ভয়ঙ্কর নোবল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত লোকজনের সংখ্যা ৬ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে প্রায় ৩০ হাজার এবং রোগ থেকে সেরে উঠেছে প্রায় ১ লাখের বেশি। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আক্রান্ত মানুষের হিসাবে চীন ও ইতালিকে ছাড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনে আক্রান্ত মানুষের মোট সংখ্যা ৮১৭২৮ এবং ইতালিতে ৮৬৪৯৮ জন। যুক্তরাষ্ট্রে এ পর্যন্ত ১০১৭২৫ মানুষের দেহে এই ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। সংখ্যা বেশি হলেও এই দুই দেশের চেয়ে এই ভাইরাসে মৃত্যুর হার যুক্তরাষ্ট্রে কম । চীনে করোনাভাইরাসে মারা গেছে ৩২২১, ইতালিতে মৃতের সংখ্যা ৯১৩৪ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১৫৮৯ জন। ইতালির পরিস্থিতি এখনো ভয়াবহ, প্রতিদিনই সেখানে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। ইতালির পর প্রাণহানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে আছে ইউরোপের আরেক দেশ স্পেন। সব মিলিয়ে দেশটিতে মোট প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫১৩৮ জনে। 

ডিসেম্বর, ২০১৯’র মাঝামাঝি সময়ে মধ্য চীনের হুপেই প্রদেশের প্রাদেশিক রাজধানী উহান নগরীর কর্তৃপক্ষ এই নতুন ধরনের করোনাভাইরাসটি শনাক্ত করেন। সেসময় এই ভাইরাসে আক্রান্ত প্রায় ৪১ জন চীনা ব্যক্তির গুরুতর ফুসফুস প্রদাহ রোগ নিউমোনিয়া হয়েছিল এবং প্রথমদিকে তাদের রোগের কোনও পরিষ্কার কারণ বের করা যায়নি কিংবা প্রচলিত ভাইরাস নিরোধক চিকিৎসাদিয়ে তাদের সারিয়ে তোলা যায়নি। উহান নগরীর হুয়ানান সামুদ্রিক খাদ্যের পাইকারি বাজারে বিক্রিত কোনও প্রাণী থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে বাজারের দোকানদার ও ক্রেতাদের মধ্যে প্রথম ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটে বলে ধারণা করা হয়। পরবর্তীতে চীনা বিজ্ঞানীরা এই নতুন প্রকারের করোনাভাইরাসটি পরীক্ষাগারে ল্যাব টেষ্টের মাধ্যমে আলাদা করে শনাক্ত করতে সক্ষম হন। করোনাভাইরাস প্রথমে প্রাণীথেকে মানুষে সংক্রমিত হলেও বর্তমানে এটি বিবর্তিত হয়ে মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে সক্ষম। ইতিমধ্যে চীন ছাড়াও সাউথ কোরিয়া, ইরান, জাপান, সিঙ্গাপুর, স্পেন, বৃটেন, কুয়েত, কানাডা, ইতালী, জার্মানি, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ এবং ফ্রান্সসহ ১৮৮ দেশে ভয়াবহ করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফলে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে এবং মহামারী আকার ধারন করেছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানুষ থেকে মানুষে ভাইরাসটির সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। ভাইরাসটি দেহে সংক্রমিত হবার পরে ২ থেকে ১৪ দিন সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে এবং এ সময় বাহকের অগোচরে এটি অপর কোনও ব্যক্তির দেহে সংক্রমিত হতে পারে। ভাইরাসটির সংক্রমণের ফলে যে ব্যাধিটি হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার নাম দিয়েছে ২০১৯ সালের করোনাভাইরাস ঘটিত ব্যাধি- কোভিড-১৯ (coronavirus disease 2019- COVID-19)। এই ব্যাধির উপসর্গ গুলির মধ্যে আছে জ্বর, শুকনো কাশি, ডায়রিয়া, পেশীতে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ও অবসাদগ্রস্ততা। সঠিক সময়ে সেবা-শুশ্রুষা না পেলে ব্যাধিটি জটিল আকার ধারণ করে, যার ফলে ফুসফুস প্রদাহ রোগ নিউমোনিয়া, তীব্র শ্বাসকষ্ট জনিত উপসর্গসমষ্টি, রক্তে জীবাণুদূষণরোধী তীব্র অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়া (সেপসিস) ও জীবাণুদূষণ জনিত অভ্যাঘাত (সেপটিক শক) হতে পারে এবং পরিশেষে মৃত্যুও হতে পারে। ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত কোভিড-১৯ ব্যাধির কোনও ডেফিনেটিভ প্রতিরোধক টিকা কিংবা কার্যকরী প্রতিষেধক চিকিৎসা আবিষ্কার হয় নাই। হাসপাতালে মূলত রোগীদের উপসর্গ উপশম করার চেষ্টা করা হয়। তাই করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে ঘনঘন সাবান-পানি, ৭০% অ্যালকোহল মিশ্রিত মিশ্রণ বা হ্যান্ডসেনিটাইজার দিয়ে হাত ধুতে বা পরিষ্কার করতে হবে, যাতে হাতে লেগে থাকা ভাইরাস বিনষ্ট হয়। কাশি বা হাঁচি দেওয়ার সময় অস্থায়ী কাগজের রুমাল বা টিস্যুপেপার দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখতে হবে এবং সাথে সাথে সেই রুমাল বর্জ্যে ফেলে দিতে হবে ও হাত সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে, যাতে ভাইরাস একব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে না ছড়ায়। যেসব ব্যক্তির জ্বর, সর্দি, কাশি ও হাঁচি হচ্ছে, তাদের থেকে ন্যূনতম ৩ থেকে ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, যাতে বাতাসে ভাসমান ভাইরাস কণা শ্বাসগ্রহণের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ না করে। চোখ, নাক ও মুখে হাত দিয়ে স্পর্শ করা পরিহার করতে হবে, কেননা হাতে পরিবেশে উপস্থিত ভাইরাস স্পর্শের মাধ্যমে লেগে থাকতে পারে এবং নাক, মুখ, চোখের উন্মুক্ত স্থান দিয়ে দেহে প্রবেশ করতে পারে। রাস্তায় ও যত্রতত্র থুতু ফেলা যাবে না, কেননা থুতু থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে। রাস্তায় বা অন্যত্র অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রস্তুতকৃত খাবার খাওয়া পরিহার করতে হবে, কারণে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রস্তুত খাবারের মাধ্যমেও ভাইরাস ছড়াতে পারে। রান্না না করা মাছ-মাংস-ডিম খাবেন না।

চীনা বিজ্ঞানীরা পিসিআর (PCR) টেস্টের মাধ্যমে প্রথম উহান নগরীর বাজারের সাথে সরাসরি জড়িত অনেক ব্যক্তির দেহে এবং বাজারের সাথে জড়িত নয়, এমন ব্যক্তিদের দেহেও ভাইরাসটির সংক্রমণ হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন। ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষেসংক্রমণ হতে পারে, এমন প্রমাণও পাওয়া গেছে এবং বিশ্বের প্রায় ২০০টি  দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এই নতুন করোনাভাইরাসটি ফ্লু বা অন্য সার্স ভাইরাসের তুলনায় কতটা মারাত্মক এখনও তার কোন পরিষ্কার ধারনা নাই। এই ভাইরাসের সংক্রমণে জ্বর, অবসাদ, পেশীতেব্যথা, শুকনো কাশি, শ্বাসকষ্ট ও শ্বাসনালীর রোগ - তথা ব্রঙ্কাইটিস এবং নিউমোনিয়া হয়। কদাচিৎ মাথাব্যথা বা কফসহ কাশি হতে পারে। রোগীদের রক্ত পরীক্ষা করে দেখা গেছে এই ভাইরাসের কারণে তাদের শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা হ্রাস পায়। এছাড়া যকৃৎ ও বৃক্কের (কিডনি) ক্ষতি হয়। সাধারণত এক সপ্তাহের আগ পর্যন্ত উপসর্গগুলি ডাক্তার দেখানোর মত জটিল রূপ ধারণ করে না। কিন্তু ২য় সপ্তাহে এসে ব্যক্তি ভেদে অবস্থার দ্রুত ও গুরুতর অবনতি ঘটতে পারে। যেমন ফুসফুসের ক্ষতি বৃদ্ধির সাথে সাথে ধমনীর রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা (হাইপক্সেমিয়া) দেখা দেয় এবং রোগীকে অক্সিজেন চিকিৎসা দিতে হয়। এছাড়া তীব্র শ্বাসকষ্ট জনিত উপসর্গসমষ্টি (ARDS বা acute respiratory distress syndrome) পরিলক্ষিত হয়।

করোনাভাইরাসে আক্রান্তের মধ্যে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ রোগী চিকিৎসা ছাড়ায় ভাল হয়ে যায় শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মাধ্যমে। ১৫ থেকে ২০ শতাংশ আক্রান্ত রোগীর সিম্টোমেটিক চিকিৎসা দরকার হয় এবং প্রায় ১০ শতাংশ রোগী র নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (intensive care unit বা ICU) রেখে যান্ত্রিক ভাবে শ্বাস গ্রহণ করাতে হয় এবং কখনও কখনও কৃত্রিম ফুসফুসের ভেতরে রক্ত পরিচালনার মাধ্যমে রক্তে অক্সিজেন যোগ করতে হয়। এছাড়া ফুসফুসের ব্যাপক ক্ষতি হবার কারণে ব্যাকটেরিয়া ঘটিত ২য় একটি নিউমোনিয়া হবার বড় সম্ভাবনা থাকে এবং নিবিড় পরিচর্যাধীন রোগীদের ১০% ক্ষেত্রে এটি হয়। করোনা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের আক্রমণের মত উপসর্গ হলেও ফ্লুয়ের ঔষধে কোনও কাজ হয় না। এ পর্যন্ত রোগটির জন্য কোনও ঔষধ বা টিকা উদ্ভাবিত না হওয়ায় হাসপাতালে নিবিড় চিকিৎসা ছাড়া রোগ থেকে সেরে ওঠার উপায় নেই। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আগে থেকেই কম, তাদের নিউমোনিয়া হয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এখন পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, কোভিড-১৯ ভাইরাসটির সংক্রামণ প্রাপ্তবয়স্ক ও বৃদ্ধদের মধ্যে বেশি করে, বাচ্চাদের করে শুধুমাত্র ২%। সাধারণত সংক্রামণ গ্রুপের মধ্যে বৃদ্ধরা সবথেকে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে, বৃদ্ধদের মধ্যে ভাইরাসটির ক্ষতিকর প্রভাব বেশি দেখা গেছে এবং এই গ্রুপের লোকদের মৃত্যুর হার সবথেকে বেশি। তাই আমেরিকা, ইটালী, চায়নাসহ বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী ও চিকিৎসারা এই মরনঘাতী ভাইরাসের প্রতিরোধ ও চিকিৎসার দ্রুত নতুন থেরাপি আবিষ্কারের জন্য দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে। আমেরিকার ওয়াশিংটন স্টেটে করোনা ভ্যাকসিন ফেজ-১ (phase-1) ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে।করোনা প্রতিরোধ ট্রাস্টফোর্স কমিটির সদস্য ডা. ফাউসি মতে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে বাজারে আনতে এক থেকে দেড় বছর সময় লাগতে পারে। এই অবস্থায়, আমেরিকার এনআইএইচ করোনার সংস্পর্শে আসা ব্যাক্তিদের চিকিৎসায় ‘হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন’ ড্রাগেরক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করেছে। আসলে ম্যালেরিয়া চিকিৎসায় ক্লোরোকুইন ও হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন এই দুই ওষুধ ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি এই দুইটি ওষুধ ভাইরাস সংক্রামণ প্রতিরোধে কাজ করে। ইতিমধ্যে ক্লোরোকুইন ও হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ইন-ভিট্র টেষ্ট টিউবে করোনাভাইরাসকে কিল করতে পারে এটা প্রমানিত। তাই, ক্লোরোকুইন ও হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন চায়না, ইটালী ও কোরিয়াসহ কিছু দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে করোনা ভাইরাস সংক্রামণ প্রতিরোধে, চিকিৎসায় ও পরবর্তী পরিণতি প্রতিরোধে। জাপানিজ এন্টি-ভাইরাল ওষুধ ফেভিপিরাভির এবং একসাথে ক্লোরোকুইন বা হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ও অ্যাজিথ্রোমাইসিন করোনা চিকিৎসায় ব্যবহার হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ইয়ান লিপকিন করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় ‘ব্লাড-প্লাজমা থেরাপি’ পদ্ধতির কথা জানিয়েছেন। এ পদ্ধতিতে করোনাভাইরাস সংক্রামণ থেকে সেরে ওঠা স্বেচ্ছাসেবীদের প্লাজমা কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। এটা একেবারে অবশ্য নতুন পদ্ধতি নয়। অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এটা এ ক্ষেত্রেও কাজ করেছে। এসব উদ্যোগ করোনা ভাইরাস সংক্রামণ প্রতিরোধে ও চিকিৎসায় মানুষের মধ্যে আশার আলো জাগাচ্ছে।

করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর কোন নির্দিষ্ট চিকিৎসা না থাকায় গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী চার মাসে করোনাভাইরাস শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই কেড়ে নিতে পারে ৮১ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ। দেশটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মিছিল আগামী জুন মাস পর্যন্ত বাড়তেই থাকবে। ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন স্কুল অব মেডিসিন-এর এক গবেষণায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে বলে এনডিটিভিঅনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মত দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় করোনাভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বাংলাদেশে করোনায় কি হতে পারে- ইম্পেরিয়াল কলেজ অফ লন্ডনের মডেল অনুযায়ী প্রজেকশন রিপোর্ট বলা হয়েছে, বাংলাদেশে করোনা মহামারীতে মোট আট কোটি একানব্বই লক্ষ (৮৯, ১২০,১৬১) ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারে, যার মাঝে তেত্রিশ লক্ষ (৩,৩০৭,৩৯৩) জন রোগীর হসপিটাল ট্রিটমেন্ট লাগতে পারে, প্রায় সাত লক্ষ (৬৯৬,৫৯৫) জন রোগীর আইসিইউ সাপোর্ট লাগতে পারে এবং পাচ লক্ষ (৫০৭,৪৪২) জন রোগীর মৃত্যু হতে পারে। ব্র‍্যাকের গবেষণার মডেল অনুসারে করোনা ভাইরাসে বাংলাদেশে পাচ লাখ মানুষ মারা যেতে পারে। এটা কতটা ভয়ঙ্কর ও ভয়াবহ এবং বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলার অপেক্ষা রাখে না। বিষযটাকে গুরত্ব না দিয়ে শাসকদলের নেতা ও মন্ত্রীরা লাগামহীন ও কান্ডজ্ঞানহীন কথাবার্তা ও বক্তব্য দিচ্ছেন যেমন- করোনার চেয়েও আওয়ামী লীগের শক্তি বেশি - ওবায়দুল কাদের; করোনা মারাত্মক নয়, ছোঁয়াচে - জাহিদ মালেক স্বপন; শেখ হাসিনারমত নেত্রী পেয়েছি বলেই করোনা প্রতিরোধ করতে পারছি - মোহাম্মদ নাসিম; আমরা করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছি - হাছান মাহমুদ; করোনা প্রতিরোধে ঢাকা বিমানাবন্দরের মত ব্যবস্থা উন্নত দেশগুলোতেও নেই - শাহরিয়ার আলম; করোনা নিয়ন্ত্রণেআমেরিকা-ইতালির চেয়েও বেশি সফল বাংলাদেশ - জাহিদ মালেক স্বপন; করোনা মোকাবেলায় চীনের মত হাসপাতাল বানানো হবে - মুস্তফা কামাল; করোনা মারাত্মক রোগ নয়, এটা সর্দি-জ্বরের মত - আব্দুল মোমেন; করোনা নিয়ে বিএনপি জনগনকে আতঙ্কিত করছে - হাছান মাহমুদ। এসব লাগামহীন ও কান্ডজ্ঞানহীন কথাবার্তা ও বক্তব্য জনমনে আরও আতঙ্কে সৃষ্টি করছে। তাই বাংলাদেশের মত অনুন্নত বা গরীব দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে এখনই জুরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

শুরুতে মনে করা হত করোনার মৃত্যুর হার ফ্লু’র চেয়ে কম, বর্তমান তথ্য মতে করোনার মৃত্যুর হার ফ্লু’র চেয়ে ১০-১৫ গুন বেশি। করোনাভাইরাসে মহামারির প্রকোপ কমিয়ে আনতে সন্দেহভাজন রোগীদের পরীক্ষা পরীক্ষা পরীক্ষার কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্যকরেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। একই সঙ্গে সংকট কাটাতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের উৎপাদন বাড়াতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তারা। বিশ্বব্যাপী ভয়ঙ্কর করোনা ভাইরাস সংক্রমণে আতঙ্কিত। সিম্টোমেটিক চিকিৎসা ছাড়া করোনা ভাইরাসআক্রান্ত রোগীর কোন চিকিৎসা নাই। তাই করোনা ভাইরাস সংক্রমণ কিভাবে প্রতিরোধ করা যাবে এবং কিভাবে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করা হবে? আর করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ ও আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় কারা ফাস্ট লাইন ডিফেন্স হিসেবে কাজ করবে? এসব নিয়ে সবাই চিন্তিত। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই ভয়াঙ্কর করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ ও আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় ফাস্ট লাইন ডিফেন্স হিসেবে পেশাগত স্বাস্থ্যকর্মীরা (চিকিৎসক, নার্স, এ্যাসিস্টেন্ট) মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে দিন-রাত ২৪/৭ কাজ করছে। অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, দোকান-পাট, রেস্টুরেন্ট, বারসহ বন্ধ কিন্তু হাসপাতাল খোলা রোগীর চিকিৎসার জন্য।হাসপাতাল খোলা থাকবে আর পেশাগত স্বাস্থ্যকর্মীদের রোগীদের চিকিৎসা দিতে হবে এটাই চিরাচরিত নিয়ম।

ভাইরাসটি নতুন হওয়াতে এখনো এর কোনও টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি, এমনকি তেমন কোনও চিকিৎসাও নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ইতোমধ্যে মানুষকে নিয়মিত ভালোভাবে হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশির সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখা, ঠান্ডা ও ফ্লু আক্রান্ত মানুষ থেকে দূরেথাকা, ইমার্জেন্সী ছাড়া ট্রাভেল না করা, কোন গ্যাদারিং-এ না যাওয়া, পানি বা জুস বেশি করে খান, লক্ষণ দেখা দিলে সাথে সাথেডাক্তারের দেখানোর, লক্ষণ অনুযায়ী ঔষুধ খান, আক্রান্ত হলে মুখোশ পরা এবং স্ত্রী-সন্তান-আত্মীয়স্বজনসহ কোন লোকের সাথে হাগনা করা বা চুমু না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। আতঙ্কিত না হওয়ার ও আতঙ্ক না ছড়ানোর পাশাপাশি প্রতিরোধের নিয়ম মানুন এবং সুস্থ থাকুন।

  •  লেখক পরিচিত — সিনিয়র সায়েন্টিস্ট, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, ইউএসএ। 



No comments:

Post a Comment