জিয়া হাসান
জিয়া হাসান |
প্রতিদিন নিত্যনতুন দেশ ও এলাকায় ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়া এবং মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়েই মনে হচ্ছিল, করোনাভাইরাস চায়না এবং তার পাশের অঞ্চলে সীমিত থাকবে। কিন্তু, ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ নাগাদ সেই আশা সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে এবং এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কবে থামবে ও এর প্রাদুর্ভাবে বর্তমান বিশ্বায়িত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যে ক্ষতি হবে, তা কত গভীর হবে, এর ভবিষ্যদ্বাণী কারও পক্ষেই করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় বিগত সপ্তাহে, বিশ্ব জুড়ে স্টক মার্কেটগুলো ২০০৮ সালের ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিসের পর সবচেয়ে ভয়াবহ পতনের সম্মুখীন হয়েছে। মুডিজ এনালিটিকস ২০২০-এর প্রথমার্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাস দিয়েছে। এমতাবস্থায় কভিড-১৯ নভেল করোনাভাইরাসের আর্থিক প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে বাধ্য।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাব নিয়ে একটি রিপোর্ট জমা দিয়েছে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত একটি সংবাদ সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি, এই রিপোর্টে চীনের ওপর বাংলাদেশের বাণিজ্যিক নির্ভরশীলতা এবং পোশাকশিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ঝুঁকির বিষয়টি প্রধান ঝুঁকি হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে ব্যবহৃত কাপড়ের ৬০ শতাংশ, নিটওয়্যার-শিল্পের কাঁচামাল ও এক্সেসরিজের ৮৫ শতাংশ, ডাইং কেমিক্যালের ৮৫ শতাংশ কাঁচামাল, প্রিন্টিং প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজের ৪০ শতাংশ কাঁচামাল, পোশাকশিল্পের এক্সেসরিজের ৪০ শতাংশ চীন থেকে আমদানি করা হয়ে। পোশাকশিল্পের স্টেকহোল্ডারদের বয়ানে এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি ঝুঁকির মুখে পড়লে সামগ্রিকভাবে ১৫ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির আশঙ্কা আছে, যা আমাদের মোট রপ্তানির ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
অভ্যন্তরীণ শিল্পের প্রভাবের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, চীন থেকে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৭৫০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ২০০ কনটেইনার কসমেটিক ও টয়লেট্রিজ, ২৫ কনটেইনার মেডিকেল ইন্সট্রুমেন্ট, ওষুধের কাঁচামাল ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার প্রিন্টিং প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রির কাঁচামাল, চোখের চিকিৎসার ৯৫ শতাংশ কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আনা হয়। করোনাভাইরাসের কারণে এই আমদানি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি, স্থিতিশীলতা ও সামাজিক নিরাপত্তা বহুমাত্রিক হুমকির মুখে পড়বে। চীনের কাঁচামালের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের টেলিভিশন-রেফ্রিজারেটর-মোবাইল ফোনসহ বেশ কিছু ‘সংযোজন শিল্প’ গড়ে উঠেছে। কাঁচামাল সরবরাহ ব্যাহত হলে এই শিল্পগুলোও হুমকির মুখে পড়বে। এই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের বড় খাত প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রির মোল্ডিং প্রিন্টিং এবং এক্সট্রুশনের যন্ত্রপাতি ও খুচরা সাপ্লাই, সব ধরনের শিল্পের মেশিনারি ও স্পেয়ার পার্টসের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ চীন থেকে আসে। স্পেয়ার পার্টসের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে এই শিল্পগুলো চলমান রাখা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এই আশঙ্কাও ওই রিপোর্টে করা হয়েছে। রপ্তানি ঝুঁকির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পাটশিল্পের স্পিনিং মিলগুলোর উৎপাদিত পণ্যের বড় একটি অংশ চীনে রপ্তানি করা হয়। ওই শিল্পে বর্তমানে নতুন অর্ডার বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশের ফিনিশড লেদার গুডস ও কাঁচা চামড়ার ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ চীনে রপ্তানি করা হয়। ওই সেক্টরে ৩০ বিলিয়ন টাকা ক্ষতির আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে।
করোনাভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কাঁকড়াচাষিরা। খুলনা ও বাগেরহাটে চিংড়ির বদলে কাঁকড়া চাষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠার মূল কারণ চীনের চাহিদা। প্রায় তিন থেকে চার হাজার কাঁকড়াচাষি তাদের পুঁজি হারিয়ে ফেলেছেন। কারণ গত ২৫ জানুয়ারি থেকে এই শিল্পে নতুন কোনো রপ্তানি হয়নি। ট্যারিফ কমিশনের রিপোর্টে শিকার করা হয়েছে, কাঁকড়া ও ইল মাছের শিল্পে ক্ষতির পরিমাণ ৪০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। মাত্র গত সপ্তাহে দেওয়া হলেও, ট্যারিফ কমিশনের এই রিপোর্টটির পূর্ণ ভাবনা চীন ও পাশের এলাকায় সাপ্লাই চেইনের হুমকি এবং চীনের রপ্তানি হুমকিকেন্দ্রিক। এই হুমকিগুলো চিহ্নিত করার জন্য ট্যারিফ কমিশন অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার; কিন্তু এই রিপোর্ট আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকির বিষয়ে আলোকপাত করা হয়নি। তা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বমন্দার ঝুঁকি, যার ফলে বাংলাদেশ বহুমাত্রিক ঝুঁকিতে পড়বে। আমেরিকা-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ, বিভিন্ন দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ পরিমাণ অভ্যন্তরীণ ঋণ এবং বৈদেশিক ঋণ, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পরিবেশ বিপর্যয়, মুক্তবাণিজ্য-বিমুখ অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর দুর্বল প্রবৃদ্ধিসহ বিবিধ কারণে বিশ্ববাণিজ্যের স্থিতিশীলতা ২০০৮-০৯-এর বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পর সবচেয়ে ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। কয়েক বছর ধরেই, জোসেফ স্টিগলিজ, রুচির শর্মাসহ বেশ কিছু অর্থনীতিবিদ একটি মন্দার আশঙ্কা করেছেন। ইউনাইটেড নেশনের ট্রেড ও ডেভেলপমেন্ট সংস্থা আঙ্কটাডের রিপোর্টে বলা হয়েছে ২০১৯ সালে বিশ্ববাণিজ্যে দশকের সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে কয়েক বছর ধরেই বিশ্বব্যাপী স্টক মার্কেট ফুলে-ফেঁপে উঠেছে, যার মধ্যে অনেকেই একটি বুদবুদ দেখতে পেয়েছেন।
আশঙ্কার কারণ রয়েছে, নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এই আর্থিক বুদবুদ চুপসে যেতে পারে। নভেল করোনাভাইরাসের প্রাথমিক ধাক্কায় সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে বিশ্বজুড়ে ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের ট্রেড শো ইন্ডাস্ট্রি, ট্যুরিজম, এয়ারলাইনস, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, খেলাধুলা, কনসার্ট, মঞ্চনাটক, মিউজিকসহ বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি। বিশ্বজুড়ে রিটেইলাররা জানাচ্ছেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে তাদের ব্যবসা ২০২০ সালে কমে আসবে। এর মধ্যে ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতিটি হবে তৎক্ষণাৎ ও ভয়াবহ। কারণ ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে ট্যুরিস্টরা ভ্রমণ কমিয়ে দেবেন। এর ফলে ট্যুরিজমের ওপর নির্ভরশীল থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়ার অর্থনীতি সংকুচিত হবে। শুধু পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো নয়, দক্ষিণ আমেরিকা, ইতালি, ফ্রান্স, পর্তুগাল, ভূ-মধ্যসাগরের দেশগুলোর অর্থনীতি ট্যুরিজমের ওপর নির্ভরশীল। এমনকি বড় অর্থনীতির দেশ জাপান বা যুক্তরাষ্ট্রের রিটেইল ইন্ডাস্ট্রির বড় একটি অংশ ট্যুরিজম ও ট্যুরিস্টদের দ্বারা কেনাকাটা থেকে আসে। বিশেষত, চায়নার ধনী ট্যুরিস্টদের ওপর এসব অনেক দেশের অর্থনীতির নির্ভরশীলতা আছে। করোনাভাইরাসের কারণে হোটেল, এয়ারলাইনস, বিনোদন, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি নিঃসন্দেহে মন্দার মুখে পড়বে।
বিশ্বখ্যাত ফুটওয়ার কোম্পানি ক্রক ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, করোনা ভাইরাসের কারণে ২০২০ সালের আয় কমে আসবে। অন্যদিকে সাপ্লাই চেইনে প্রতিবন্ধকতার কারণে চীনের রপ্তানি যদি কমে আসে, তবে চীনের অভ্যন্তরীণ ভোগ বা কনজাম্পশনও কমে আসবে। নাইকি, লিভাইস, আইফোনসহ বিশ্বের মেগা সাইজের প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফার বড় একটি অংশ আসে চীন থেকে। বিশ্ব জিডিপিতে চীন ১৬ শতাংশ অবদান রাখে। তাই চীনের উৎপাদন যদি সংকুচিত হয়, তবে তা আবার বৃহৎ কোম্পানির উৎপাদন কমিয়ে আনবে। এর সবকিছু চক্রাকারে বিশ্বের শেয়ারবাজারগুলোকে হুমকির মুখে ফেলবে। ২০০৮-০৯-এর বিশ্বমন্দার প্রভাব কাটাতে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে, এর ফলে বিশ্বের অনেকগুলো দেশের অর্থনীতিতে ফিন্যান্সিয়ালাইজেশন বা আর্থিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। পেনশন ফান্ড, রিটায়ারমেন্ট ফান্ড, তেলের আয় থেকে তৈরি সভেরেইন ফান্ড, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদ্বৃত্ত আয় থেকে তৈরি বিশাল অঙ্কের ফান্ড যেমন নরওয়ে সরকারের পেনশন ফান্ড, চীনা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন, আবুধাবি ইনভেস্টমেন্ট অথরিটি, কুয়েত ইনভেস্টমেন্ট অথরিটিসহ ইত্যাদি ফান্ডের বড় অংশ স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ হয়েছে। ফলে যদি স্টক মার্কেট হুমকির মুখে পড়ে, তবে এই ফান্ডগুলো চক্রাকারে ওই ফান্ডগুলোর মূলধনের জোগানদাতা পেনশনার, বড় পুঁজিপতি, সরকারসহ সবার আয় ও পুঁজি উভয়কেই সংকুচিত করবে। ফলে তাদের খরচ করার প্রবণতা কমে আসবে। এর ফলে নির্দ্বিধায় তাদের দেশে ভোগ ও আমদানি কমে আসবে, যার একটি প্রভাব অবধারিতভাবে আমাদের পোশাকশিল্পে পড়বে। এমনকি ওই দেশগুলোতে আয় কমে যাওয়ার কারণে চাকরি ছাঁটাইসহ বিভিন্ন প্রবণতায় রেমিট্যান্সের পরিমাণও কমে আসতে পারে।
ট্যারিফ কমিশনের রিপোর্টে পাট, চামড়া ও কাঁকড়াশিল্পে বিপর্যয়ের যে আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে, তা ভবিষ্যতের নয়, সেসব এখনই ঘটছে। খুলনার কাঁকড়াশিল্পের বিপর্যয়ের কারণে ইতিমধ্যেই হাজার হাজার পরিবারে বিপর্যয় নেমে এসেছে, যাদের সুরক্ষার জন্য ন্যূনতম কোনো ব্যবস্থা সরকার নেয় নেই এবং সরকারের নিস্পৃহতা নিয়ে নাগরিকদের মধ্যেও তেমন কোনো আলোড়ন দেখা যায়নি। রাজনীতি নিয়ে আমাদের নিমগ্নতার কারণে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের ইস্যুগুলো আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, করোনাভাইরাসের প্রভাব বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই আঘাত করেছে এবং বিশ্ব যদি একটি মন্দার মুখে পড়ে জটিল বহুমাত্রিক হুমকির মুখে পড়বে, বাংলাদেশের অর্থনীতি, জীবন-জীবিকা এবং সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, এই সম্ভাব্য মন্দা কবে শেষ হবে এবং এর চূড়ান্ত পরিণতি কী হবে, তা কেউ বলতে পারে না। ২০০৮ সালে বিশ্বমন্দা বাংলাদেশ সফলভাবে মোকাবিলা করেছিল। এই সফলতার মূলে ছিল, মন্দার আগের ৩০ বছরে তৈরি আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ। কিন্তু সেই সক্ষমতাগুলো অনেকটুকুই এখন কমে এসেছে এবং বিবিধ কারণে আমাদের ব্যাংকব্যবস্থা ও আর্থিক ব্যবস্থাও ঝুঁকির মুখে।
এ অবস্থায় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা সামাল দিতে বাংলাদেশ সরকারের হাতে দুটি পথ আছে। প্রথমটি হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক সব ধরনের উদ্যোগকে সমন্বিত করে এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া। অথবা খুলনার কাঁকড়াচাষিদের ক্ষতির মতো সম্পূর্ণভাবে বিষয়টি উপেক্ষা করে যাওয়া এবং ধরে নেওয়া যে কিছু না হলেও কোনো না কোনোভাবে সবকিছু ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে এমন ভাবতে থাকা। কোন পথটি সরকার বেছে নেয়, তার ওপর নির্ভর করবে এই দুর্যোগের প্রভাব জনজীবনে কী ধরনের পড়বে।
- লেখক-প্রাবন্ধিক ও স্বাধীন গবেষক
- কার্টসি - দেশ রুপান্তর / মার্চ ৪, ২০২০