সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
দেশ এখন পাপিয়াময়। ভার্চুয়াল মিডিয়া তো বটেই, দেশের সংবাদমাধ্যমের নিয়মিত আইটেম হিসেবে থাকছে পাপিয়াকা-। সংবাদমাধ্যমে খবর বের হচ্ছে, পাপিয়া রিমান্ডে কী তথ্য দিচ্ছেন। তার সঙ্গে কোন ক্ষমতাধরদের সখ্য ছিল। আর তার কাছে কোন বিশিষ্টজনদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা, জাল টাকার ব্যবসা ও বিভিন্ন অনৈতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে কোটি টাকার সম্পদ পাচার এবং কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের অনুসন্ধানের কথাও আমরা জানতে পারছি। রাজধানীর ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডে এবং নরসিংদীতে বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়িসহ তাদের নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদের সন্ধান পাওয়ার খবরও আসছে।
সায়ন্থ সাখাওয়াৎ |
র্যাব জানাচ্ছে, পাপিয়া মাসে শুধু হোটেল ওয়েস্টিনে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার বিল পরিশোধ করেছেন। ওয়েস্টিন হোটেলে প্রতিদিন শুধু বারের খরচ বাবদ প্রায় আড়াই লাখ টাকা পরিশোধ করতেন পাপিয়া। ওয়েস্টিনে তার নিয়ন্ত্রণে সাতজন নারী ‘কাজ’ করতেন। হোটেল ওয়েস্টিনে প্রেসিডেনশিয়াল স্যুট পাপিয়ার নামে সব সময় ‘বুকড’ থাকত। কিন্তু তাদের অর্জিত অবৈধ সম্পদের বিবরণের দিকে মানুষের আগ্রহ খুব একটা লক্ষণীয় নয়। সবার কৌতূহল তার কাছে যাওয়া ব্যক্তিদের তালিকা নিয়ে। রিমান্ডে পাপিয়া তার ওয়েস্টিন হোটেলের আস্তানায় যাতায়াতকারী যেসব ব্যক্তির নাম বলছেন, তা নিয়ে নাকি খোদ পুলিশ কর্মকর্তারাই বিব্রত।
রিমান্ডে থাকা ব্যক্তির বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে কীভাবে আসে, এটা আইনসম্মত কি না এবং কতটা বিশ্বাসযোগ্য, সে প্রশ্ন থাকলেও সংবাদমাধ্যম বিরামহীনভাবে সেসব তথ্য দিয়ে পাঠকচাহিদা মিটিয়ে থাকে। তেমনই একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে মুখরোচক আলোচনার জন্ম দেয় দৈনিক মানবজমিন। ২ মার্চ ২০২০ ‘পাপিয়ার মুখে আমলা-এমপি ব্যবসায়ীসহ ৩০ জনের নাম’ শিরোনামে পত্রিকাটি লেখে, গোয়েন্দা সূত্রে প্রাপ্ত একটি তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পাপিয়ার আস্তানায় নিয়মিত যেতেন এমন ব্যক্তিদের মধ্যে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীও আছে তালিকায়। সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্য আছেন। সরকারের সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা আছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী আছেন।
ইতিমধ্যে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, গ্রেপ্তার করা পাপিয়ার সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, কাউকে ছাড়া হবে না। সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। এই কথা শুনে অনেকেই মুচকি হেসে মনে করিয়ে দেন, ‘শুদ্ধি’ অভিযানের সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা। তখনো বলা হয়েছিল, কাউকে ছাড়া হবে না। কাউকে না ছাড়ার কথা বাদ দিয়ে বরং মনে করার চেষ্টা করুন সেই ‘শুদ্ধি’ অভিযানে কাদের ধরা হয়েছিল। যাদের ধরা হয়েছিল, তারা আওয়ামী লীগের কোন পর্যায়ের নেতা? খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ছিলেন যুবলীগের একটি ইউনিটের (ঢাকা দক্ষিণ) সাংগঠনিক সম্পাদক। আর জি কে শামীম যুবলীগের সমবায় সম্পাদক। শফিকুল আলম ফিরোজ ছিলেন কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। তার বাইরে লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, সেলিম প্রধানসহ আর যে কয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য পদধারী কেউ ছিলেন না।
যুবলীগের আলোচিত নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট তখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেন তাকে ধরা যাচ্ছে না, তা নিয়ে ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ প্রথম আলো লিখেছিল, ‘অভিযানের সঙ্গে যুক্ত র্যাবের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, যাদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তারা গ্রেপ্তার হলে ক্ষমতাসীন দলের অনেকের নাম বেরিয়ে আসবে। তাই ঝুঁকি নিতে চাইছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।’ প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর অবশ্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল যুবলীগ নেতা সম্রাটকে। তার ওপর যে প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত ছিলেন সেটা আগেই বোঝা গিয়েছিল। কিন্তু তারপর? আর এগোতে পারেনি সে অভিযান। আমরা জানতে পারিনি সম্রাট তার কোন রাজনৈতিক গুরুদের নাম বলেছেন। এমন কী চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি, জাতীয় সংসদের হুইপ ক্লাবভিত্তিক জুয়া থেকে মাসে কত টাকা পেয়ে থাকেন, সে হিসাব পর্যন্ত প্রকাশিত হওয়ার পরও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। আওয়ামী যুবলীগের তখনকার চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে যুবলীগ থেকে বিদায় করা হয়েছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আনা হয়নি আইনের আওতায়।
একসময় থেমে যায় সে অভিযান। অনেক দিন পর আবার আলোচনায় আসেন গে-ারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এনামুল হক এনু ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুপন ভূঁইয়ার গ্রেপ্তারের খবর। প্রথম আলোর রিপোর্টে লেখা হয়, ১০ বছর আগেও এনামুল হক এনু ও রুপন ভূঁইয়ার সম্পদ বলতে ছিল ২৯ বানিয়ানগরে লোহা-লক্কড় বিক্রির একটি দোকান। তারা থাকতেন দোকানের পেছনে একটি টিনশেড বাড়িতে। অভিযানের প্রথম পর্যায়ে র্যাবের কাছে দুই ভাইয়ের মালিকানায় ১৫টি বাড়ির তথ্য ছিল, গ্রেপ্তারের পর সিআইডি জানায়, বাড়ির সংখ্যা ২২। আর রিমান্ড শেষে জানা যায়, জিজ্ঞাসাবাদে তারা ১২০টি বাড়ির তথ্য দিয়েছে। এই দুই সহোদর গত ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর গা-ঢাকা দিয়েছিলেন। তখন এনুর ফ্ল্যাটে থাকা দুটি ভল্ট ও রুপনের ফ্ল্যাটে থাকা একটি ভল্ট থেকে অভিযান চালিয়ে র্যাব এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা, প্রায় চার কোটি টাকা মূল্যের আট কেজি স্বর্ণালংকার ও পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছিল।
অনেকেই বলছেন, সরকারি দলের সম্রাট-জি কে শামীম-খালেদ-পাপিয়া-এনু-রুপনের মতো স্তরের নেতাদেরই যদি এ অবস্থা হয়, তবে আরেকটু ওপরে উঠলে কী অবস্থা দেখা যাবে? মাত্র দশ বছরে সরকারি দলের পাতি নেতা হয়েই যদি লোহা-লক্কড় বিক্রির একটি দোকান ও একটি টিনশেড বাড়ি থেকে এনু-রুপন সম্পদেও পাহাড় গড়তে পারেন। যদি পাপিয়া অঢেল সম্পদের মালিক হতে পারেন। তাহলে তাদের আশ্রয়দাতা রাজনৈতিক গডফাদাররা কত টাকার মালিক হয়েছেন, সেটা কী অনুমান করা অসাধ্য? অভিযানের নামে মাঝেমধ্যে যে নাটকটা মঞ্চস্থ করা হয়, সে বিষয়ে “রাজনীতির ‘নতুন দিন’, ক্যাসিনো টু ওয়েস্টিন” শিরোনামে রিপোর্টে ডয়চে ভেলে লিখেছে, অভিযানের সময় যত ঢাকঢোল পেটানো হয়, মামলায় তা কতটুকু প্রতিফলিত হয়? তা ছাড়া শেষ পর্যন্ত তারা কী শাস্তি পান? যারা জড়িত, তাদের সবাইকে কী আইনের আওতায় আনা হয়? ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তখনকার ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের ক্যাসিনো থেকে আয়ের কোটি কোটি টাকা কোথায়? সম্রাটের নাকি এখন তেমন কোনো টাকা-পয়সার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
মানুষের মুখে মুখে পাপিয়া সম্রাটদের নিয়ে আলোচনা হলেও অনেকেই মনে করেন পুরো দেশটাতেই চলছে অসংখ্য পাপিয়া-সম্রাট ও তাদের রাজনৈতিক গুরুদের একচ্ছত্র রাজত্ব। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে শাসনব্যবস্থা জেঁকে বসেছে, তার প্রোডাক্ট হচ্ছে এই পাপিয়া-সম্রাটের রাজত্ব। সে রাজত্বে মাঝেমধ্যে এক-আধটু বৈরী বাতাস বহে বটে। তাতে সে রাজত্বে নেতৃত্বের কিছুটা হাতবদল হলেও কাজ-কারবারে কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। অনেকটা আন্ডার ওয়ার্ল্ডের খুনোখুনির মতোই। নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকে এক সন্ত্রাসী আরেক সন্ত্রাসীকে খুন করলে তাতে কখনো সন্ত্রাস কমে না। শুধু নেতৃত্বের হাতবদল হয়। তাই একজন পাপিয়া বা সম্রাটের গ্রেপ্তারে ডাকাতি, অনৈতিক কর্মকাণ্ড বা লুটপাটের কমতি হবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। শুধু হাতবদল হতে পারে। যে রাজনীতি এই মাফিয়া রাজত্বটাকে টিকিয়ে রাখে, সে রাজনীতির অবসান না হলে এই রাজত্বেরও অবসান হবে না, এটা নিশ্চিত।
- লেখক, চিকিৎসক ও কলামনিস্ট
- কার্টসি - দেশ রুপান্তর/ মার্চ ৫, ২০২০