দেশের ব্যাংকিং খাত ক্রমশ ভয়াবহ সংকটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সক্ষমতা অর্জন তো দূরের কথা, দেশের ব্যাংকিং খাতের টিকে থাকাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ স্ট্রেস টেস্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ন্যূনতম ঝুঁকিসহন ক্ষমতা বা ধাক্কা সামলানের অবস্থায় নেই। ব্যাংকগুলো এখনই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আগাম পদক্ষেপ না নিলে গোটা ব্যাংকিংব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন। তারা বলছেন, ব্যাংক খাতের ওপর আস্থা, স্বচ্ছতা ও বিশ্বস্ততার সংকট দেখা দিয়েছে।
ভুয়া কাগজপত্রের ভিত্তিতে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়ে একেকটি ব্যাংককে ফতুর করে দেয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমে একদিকে আমানত সংকট তৈরি হয়েছে অন্যদিকে খেলাপি লুটেরারা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বিদেশে পাচার করছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন পুরোপুরি গুটিকয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। আস্থাহীনতার কারণে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখা ক্রমান্বয়ে কমিয়ে দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গোটা ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম ও নৈরাজ্যের মহাযজ্ঞ চলছে। এরই মধ্যে প্রস্তাবিত আমানত সুরক্ষা আইন নিয়ে আমানতকারীদের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। এমন একটি সময়ে এই আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যখন একের পর এক ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা আমানত লুটপাটের ফলে কিছু কিছু ব্যাংককে একীভূতকরণের কথাও ভাবতে হয়েছে। অবশ্য, এমনিতেই বিদ্যমান আইনেই বলা আছে, কোনো ব্যাংক অবসায়ন বা দেওউলিয়া হয়ে গেলে আমানতকারীরা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পাবেন। কোনো গ্রাহকের একাউন্টে কোটি টাকা থাকলেও তিনি সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পাবেন। এ বিধানের কথা সাধারণ মানুষ এতদিন জানতোই না। নতুন প্রস্তাবিত আমানত সুরক্ষা আইনে এ বিধান যুক্ত করায় বিষয়টি জনগণের সামনে এসেছে এবং উদ্বেগ-আতংক দেখা দিয়েছে।
সর্বশেষ, বাংলাদেশ ব্যাংক এর ওপর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ঘটনাটি মানুষের মধ্যে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমানতকারীরা মহাটেনশনে পড়েছে। অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্যত্র বিনিয়োগ করার কথাও ভাবছে। খোদ ব্যাংক পরিচালকরাই কারসাজি করে গ্রাহকদের টাকা বেহাত করে ব্যাংক ফতুর করে দিচ্ছে। দেশের ১০ কোটি আমানতকারীর ব্যাংকে জমানো প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকাই ঋণ আকারে নিয়ে নিজেদের পকেটে ঢুকিয়েছে মাত্র কয়েক শ’ ব্যাংক পরিচালক। এসব ঋণের বড় অংশ খেলাপি হলেও বছরের পর বছর তা নিয়মিত হিসেবে প্রদর্শন করা হচ্ছে। এই নৈরাজ্যের প্রভাব পড়ছে বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে। সৎ উদ্যোক্তা ও সাধারণ ব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত ঋণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শুধু ব্যাংক নয়, ঋণের মচ্ছব ও অনিয়মের এই মহাযজ্ঞ চলছে ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও। বেসরকারি ব্যাংক পরিচালকদের একটি বিরাট অংশ নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছে না। যখন খেলাপি হয়ে যাচ্ছে, তখন বেনামি ঋণ সৃষ্টি করে ওই ঋণ পরিশোধ দেখানো হয়েছে। আবার অনৈতিকভাবে নিজেদের ঋণের সুদও মওকুফ করে নিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিচালকদের ভাগাভাগি করে এই ঋণ নেয়া, ব্যাংকিং খাতের জন্য খারাপ দৃষ্টান্ত এবং সুশাসনের পরিপন্থী। এমন পরিস্থিতিকে ভয়ংকর খারাপ নজির বলে অভিহিত করেছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, পরিচালকদের দখলে বিপুল অঙ্কের ঋণ কেন্দ্রীভূত হওয়া ব্যাংকিং খাতের জন্য হুমকি ও উদ্বেগের বিষয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মোটা দাগে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, ঋণ ও আমানতের সুদহার নিয়ে অনিশ্চয়তা, ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব, সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ দেয়া, ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে অতি নমনীয়তা দেখানো, রাজনৈতিক প্রভাব, বিচারিক কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রতা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রভাবই ব্যাংকিং খাতের সংকটের অন্যতম কারণ। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকিং খাতে যে স্বেচ্ছাচারিতা চলছে এবং গুরুতর অনিয়ম ও বিচ্যুতিকে যেভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে, তা ব্যাংকিং খাতের সংকটকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
ঋণখেলাপি হওয়ার পর থেকে এক টাকাও পরিশোধ করেননি প্রায় ৪ হাজার ৬০০ ঋণ খেলাপি ও তাদের প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
জাতীয় সংসদের সাম্প্রতিক এক প্রশ্নোত্তর পর্বে ৮ হাজার ২৪০টি ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের তথ্য তুলে ধরা হয়। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঋণখেলাপিদের কাছে ব্যাংকের পাওনা রয়েছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪ হাজার ৫৬৮টি প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হওয়ার পর থেকে এক টাকাও পরিশোধ করেনি। শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের কাছেই আটকা রয়েছে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। খেলাপিঋণের এই চিত্র দেখলেই বোঝা যায়, যারা এই ঋণ নিয়েছেন তারা শিল্প কারখানা স্থাপন করেননি। শিল্পকারখানা স্থাপনের নামে ঋণ নিয়ে হয় ওই ঋণের অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন, অথবা অন্য অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করেছেন। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) তথ্য বলেছে, গত ১০ বছরে দেশ থেকে টাকা পাচার হয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু গত ২০১৫ সালেই পাচার হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা।
ন্যূনতম ঝুঁকিসহন ক্ষমতাও নেই ব্যাংক খাতের
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ স্ট্রেস টেস্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ন্যূনতম অভিঘাত বা ধাক্কা সামলানের অবস্থায় নেই। ব্যাংকগুলো এখনই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আগাম পদক্ষেপ না নিলে ব্যাংকিংব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন। সাধারণত তিন মাস পর পর এ ঝুঁকিসহন ক্ষমতা যাচাই করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ স্ট্রেস টেস্ট প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে সেপ্টেম্বরভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে। সর্বশেষ ওই প্রতিবেদনে দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে বড় ধরনের আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলা হয়েছে, অভিঘাত সামলানোর মতো অবস্থায় নেই ব্যাংক খাত। বড় ধরনের ধাক্কা এলে ব্যাংক খাতের মূলধন সংরক্ষণের হার ঋণাত্মক ৭ দশমিক ২২ শতাংশে নেমে যাবে। এ ধাক্কা মাঝারি মানের হলে মূলধন সংরক্ষণের হার এক শতাংশের নিচে অর্থাৎ শূন্য দশমিক ৭ শতাংশে নেমে যাবে। আর এ ধাক্কা ন্যূনতম হলেও মূলধন সংরক্ষণের হার সোয়া ৮ শতাংশে নেমে যাবে।
ব্যাংক খাতের যেকোনো অভিঘাত বা ধাক্কা এলে তার সহ্য করার ক্ষমতা কতটুকু তা যাচাই করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ঝুঁকিসহন ক্ষমতা যাচাইকে ব্যাংকিং ভাষায় স্ট্রেস টেস্ট বলা হয়। কতগুলো সূচক বা নির্দেশকের মাধ্যমে এ ঝুঁকিসহন ক্ষমতা যাচাই করা হয়।
দেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান প্রেক্ষাপট অনুযায়ী, বড় অভিঘাত এলে অর্থাৎ খেলাপি ঋণ ১৫ শতাংশ বাড়লে ন্যূনতম মূলধন তথা ১১ দশমিক ৬৫ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হবে দেশের ৩৪টি সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। মাঝারি অভিঘাত অর্থাৎ খেলাপি ঋণ ৯ শতাংশ বাড়লেও ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে ৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংক।
বড় ঋণগ্রহীতাদের ঋণ বৃদ্ধিজনিত ঝুঁকির মধ্যে বড় অভিঘাত এলে অর্থাৎ শীর্ষ ১০জন ঋণগ্রহীতা ঋণখেলাপি হলে ৩৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে। আর মাঝারি মানের ধাক্কা অর্থাৎ শীর্ষ সাতজন ঋণগ্রহীতা ঋণখেলাপি হলে ৩৫টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ করতে পারবে না। আর ন্যূনতম অভিঘাত অর্থাৎ তিন শীর্ষ ঋণগ্রহীতাও যদি ঋণখেলাপি হন তাহলে ২১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ করতে পারবে না।
এ পর্যন্ত যেসব ব্যাংকের বড় ধরনের ঋণকেলেঙ্কারির তথ্য প্রকাশ পেয়েছে তার বেশির ভাগ ঋণেরই পর্যাপ্ত সহায়ক জামানত ছিল না। আবার যে পরিমাণ সহায়ক জামানত ছিল তার বেশির ভাগই সরকারি খাস জমি, ভুয়া দলিল অথবা নতুন ঋণের বিপরীতে সহায়ক জামানত দেখানো হয়েছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, প্রকৃত সহায়ক জামানত খেলাপী ঋণের ১০ শতাংশও নেই।
সহায়ক জামানতের মূল্য হ্রাসজনিত ঝুঁকির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্ট্রেস টেস্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণের বিপরীতে সহায়ক জামানতের মূল্য ৪০ শতাংশ কমে গেলে ব্যাংকিং খাতের ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণের হার ৮ দশমিক ৯৯ শতাংশে নেমে আসবে। আর এ ঝুঁকি মাঝারি মানের হলেও অর্থাৎ সহায়ক জামানতের মূল্য ২০ শতাংশ কমে গেলে মূলধন সংরক্ষণের হার সোয়া ১০ শতাংশে নেমে যাবে।
ব্যাংক খাতে সাধারণত তিন ধরনের খেলাপি ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে নিম্নমানের খেলাপি ঋণ, সন্দেহজনক খেলাপি ঋণ এবং মন্দমানের খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ মন্দমানের হলে ওই ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়। আর প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে। এ কারণে খেলাপি ঋণ মন্দমানের বেশি হলে ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা কমে যায়। অনেক ব্যাংকের আয় দিয়েও তা সঙ্কুলান করা যায় না। এর ফলে প্রভিশন ঘাটতিতে পড়ে ব্যাংকগুলো। আবার মন্দ ঋণের বিপরীতে যে আয় হয় ওই আয় ব্যাংকগুলো আয় খাতে নিতে পারে না। সুদ আয় স্থগিত করে আলাদা হিসেবে রাখতে হয়। খেলাপি ঋণের গুণগত মান পরিবর্তন ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বড় ধরনের ধাক্কা অর্থাৎ খেলাপি ঋণের গুণগত মান যদি ১৫ শতাংশ পরিবর্তন হয় তাহলে বিদ্যমান অবস্থায় ব্যাংক খাতের মূলধন সংরক্ষণের হার ছয় শতাংশে নেমে আসবে। আর যদি মাঝারি মানের ধাক্কাও আসে তাহলে মূলধন সংরক্ষণের হার ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশে নেমে আসবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্ট্রেস টেস্ট প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাজার ঝুঁকির ক্ষেত্রে দেশের ব্যাংক খাতের বর্তমান অবস্থায় তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে বাজার ঝুঁকি ও ঋণঝুঁকি একত্রে এলে আমাদের ব্যাংক খাত ন্যূনতম ধাক্কাও সামলাতে পারবে না। কারণ, বড় ধরনের অভিঘাত এলে দেশের ৩৯টি ব্যাংক মূলধন হারাবে। অর্থাৎ মূলধন ঋণাত্মক ৭ দশমিক ২২ শতাংশে নেমে আসবে। আর মাঝারি মানের ধাক্কা এলেও ৩৮টি ব্যাংক মূলধন হারাবে। অর্থাৎ ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণের হার ১ শতাংশের নিচে (শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ) নেমে আসবে।
পরিচালকদের ভাগবাটোয়ারার ঋণে ফতুর হচ্ছে ব্যাংক
ব্যাংকিং খাতে পরিচালকদের মধ্যে চলছে ভাগবাটোয়ারার ঋণ। যোগসাজশের মাধ্যমে এক ব্যাংকের পরিচালক আরেক ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা পরিশোধ করছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিজ ব্যাংক ও অন্য ব্যাংক থেকে পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা। এ ঋণ মোট ব্যাংক ঋণের ১২ শতাংশের বেশি। কিন্তু এ হিসাবের বাইরে বেনামেও অনেকের বিরুদ্ধে ঋণ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। বেনামি ঋণের পরিমাণও এর দ্বিগুণ হতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে। কিন্তু বেনামি হওয়ায় তাদের নাম পরিচালকদের ঋণে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। বিশ্লেষকদের মতে, যোগসাজশের মাধ্যমে ঋণ বের হয়ে যাওয়ায় ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকিং খাতে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যোগসাজশের এসব ঋণের অর্থ কোথায় ব্যবহার করা হচ্ছে তারও কোনো হিসাব নেই। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পাচার করে দিচ্ছেন কি না- তারও কোনো তথ্য নেই। পরিচালকরা যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিচ্ছেন তার বেশির ভাগেরই অস্তিত্ব নেই। এভাবে ঋণ নেয়া অনৈতিক ও সুশাসনের পরিপন্থী। এটা আমানতকারীদের আমানতকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নেয়া না হলে, যেভাবে নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে জনগণের অর্থ বের করে নেয়া হচ্ছে তা বন্ধ করতে না পারলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিই ঝুঁকির মুখে পড়বে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী বর্তমানে একটি ব্যাংকের পরিচালক রয়েছেন সর্বোচ্চ ২০ জন। ব্যাংক শুরু করতে পরিশোধিত মূলধন লাগে ৪০০ কোটি টাকা। সেই হিসেবে একজন উদ্যোক্তাকে ব্যাংক পরিচালক হতে বিনিয়োগ করতে হয় সর্বোচ্চ ২০ কোটি টাকা। কিন্তু এ ২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ভাগবাটোয়ারার মাধ্যমে নামে-বেনামে শত শত কোটি টাকা জনগণের আমানত ঋণ আকারে বের করে নিচ্ছেন কিছু পরিচালক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বেসরকারি খাতে ব্যাংক পরিচালক রয়েছেন সর্বোচ্চ ৮০০ জন। কিন্তু ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতকারী রয়েছেন প্রায় ১০ কোটি ৫ লাখ। আর ঋণগ্রহীতা রয়েছেন প্রায় এক কোটি ১০ লাখ। মোট ঋণ রয়েছে প্রায় ৯ লাখ ৭০০ কোটি টাকা, আর আমানত রয়েছে ১০ লাখ কোটি টাকার ওপরে। কিন্তু ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ব্যাংক ঋণের একটি বড় অংশ দখল করে রেখেছেন কিছু ব্যাংক পরিচালক। ব্যাংক পরিচালকদের মধ্যে সর্বোচ্চ ঋণ নিয়েছেন ৩০০ জন, যারা এক ব্যাংকের পরিচালক হয়ে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। এই পরিচালকরা সর্বোচ্চ ব্যাংকের পরিচালক হতে বিনিয়োগ করেছেন ২০ কোটি টাকা করে ৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ঋণের নামে ব্যাংক থেকে বের করে নিয়েছেন প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা। অভিযোগ রয়েছে, এ টাকার বেশির ভাগই বছরের পর বছর পরিশোধ করা হয় না। পরিশোধ দেখানো হলেও তা হয়, বেনামে ঋণ সৃষ্টি করে। কখনো ঋণ পুনঃতফসিলির মাধ্যমে বছরের পর বছর ঋণ নবায়ন করা হচ্ছে কোনোরকম ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই।
আগে পরিচালকরা নিজ ব্যাংক থেকেই বেশি মাত্রায় ঋণ নিতেন। পরে ওই ঋণ পরিশোধ করতেন না। যখন খেলাপি হয়ে যেত, তখন বেনামি ঋণ সৃষ্টি করে ওই ঋণ পরিশোধ দেখাতেন। আবার পরিচালকরা পরিচালনা পর্ষদে বসে নিজেরা অনৈতিকভাবে সুদ মওকুফ করে নিতেন। পরিচালকদের নিজ ব্যাংকের এ অনৈতিক কার্যক্রম ঠেকাতে কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নির্দেশনায় বলা হয়, কোনো পরিচালক তার মোট শেয়ারের ৫০ শতাংশের বেশি ঋণ নিজ ব্যাংক থেকে নিতে পারবেন না। এর পর থেকেই পরিচালকরা নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া কমিয়ে দেন। পরিচালকদের নিজ ব্যাংক থেকে বেপরোয়া ঋণ নেয়া কমানো হলেও তাদের এ অনৈতিক কার্যক্রম থেমে নেই। তারা নিজেদের মধ্যে যোগসাজশ করে ঋণ নেয়া অব্যাহত রেখেছেন। যেমন, ‘ক’ ব্যাংকের পরিচালক ‘খ’ ব্যাংক থেকে নিচ্ছেন। আবার ‘খ’ ব্যাংকের পরিচালক যোগসাজশের মাধ্যমে ‘ক’ ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন।
এসব ঋণের বেশির ভাগ সম্পর্ক, যোগসাজশ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে নেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে কোনো ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী হয় না অনেক ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব জেনেও চুপ করে বসে থাকে।
হদিস মিলছে না দেড় লাখ কোটি টাকার
ব্যাংকের বাইরে থাকা প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার কোনো হদিস মিলছে না। এই অর্থ কোথায় রয়েছে, কার কাছে রয়েছে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকও তার কোনো খবর পাচ্ছে না। অথচ গত এক দশকে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপকভাবে ব্যাংকিং অন্তর্ভুক্তি বেড়েছে। নতুন নতুন ব্যাংক যেমন এসেছে তেমনি বেড়েছে ব্যাংকের শাখার সংখ্যাও। এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংসহ অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে ব্যাংক ছড়িয়ে পড়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ব্যাংকিং খাতে যুক্ত হয়েছে অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন সেবা। এর ফলে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের হার কমে আসার কথা। কিন্তু উল্টো তা বেড়েছে।
২০১০ সালে দেশে ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ ছিল ৪৬ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯ সাল শেষে নগদ এ অর্থের পরিমাণ ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশের মতো একটি অর্থনীতির দেশে ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকার নগদ অর্থ যথেষ্ট বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তবে বাস্তবে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ এর তিন গুণ। এই বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ কার কাছে বা কাদের কাছে কোথায় রয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে ব্যাংকিং খাতের ওপর বেড়ে চলা অবিশ্বাস, অন্যদিকে অবৈধ উৎস থেকে উপার্জিত অর্থ নিরাপদে রাখতে চাওয়া- এই দুই কারণে ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ বেড়ে চলেছে। দুর্নীতি ও অবৈধভাবে অর্জিত কালো টাকা ব্যাংকিং খাতে আসছে না। আবার বড় বড় কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংকিং খাতের ওপর আস্থা কমে আসায় মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে নিজস্ব ব্যবস্থায় রাখছে। অন্যদিকে আবার প্রভাবশালীরা অবৈধ অর্থ হুন্ডির কাজে ব্যবহার করছে।
মনে করা হচ্ছে, ব্যাংকের বাইরে থাকা অর্থের বড় অংশই কালো টাকা। অবৈধভাবে অর্জিত এ অর্থ অপরাধীরা ব্যাংকে রাখতে সাহস পাচ্ছে না। ফলে এ অর্থের একটি অংশ হুন্ডির কাজে ব্যবহার হচ্ছে, অন্য অংশ বাড়িতে সিন্দুক বা বালিশ-তোশকে ঢুকছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র বলছে, কোনো পরিসংখ্যানেই ইস্যুকৃত অর্থের অন্তত ২৫ শতাংশের অবস্থান নির্ণয় করা যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাম্প্রতিক বিভিন্ন অভিযানেও এর প্রমাণ মিলেছে। ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িত আওয়ামী লীগ নেতা দুই ভাই এনামুল হক ও রূপন ভূঁইয়ার পুরান ঢাকার একটি বাসার পাঁচটি সিন্দুক থেকে সম্প্রতি নগদ ২৬ কোটি ৫৫ লাখ ৬০০ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা পাওয়া গেছে যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট, খালেদ, জিকে শামীমের বাড়ি থেকেও।
অর্থনীতিতে কালো টাকার দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত এ অর্থ ব্যাংকে না গিয়ে বিদেশে হুন্ডির কাজে ব্যবহার হচ্ছে কিংবা সিন্দুকে আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে ব্যাংকিং খাতের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ দিনদিন বেড়েই চলছে। ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
প্রস্তাবিত আমানত সুরক্ষা আইন নিয়ে উদ্বেগ
গোটা ব্যাংকিং খাতে যখন চরম অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা আর আস্থার সংকট চলছে; ঠিক সেই মুহূর্তে এই উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে প্রস্তাবিত ‘আমানত সুরক্ষা আইন।’ এই আইনের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে বা অবসায়িত হলে সেই ব্যাংকের বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীরা তাদের জমানো সব টাকা ফেরত পাবেন না। শুধু তাই নয়, গ্রাহকের নামে ব্যাংক একাউন্টে কোটি টাকা জমা থাকলেও তাকে মাত্র এক লাখ টাকা ফেরত দেয়ার বিধান রেখে আমানত সুরক্ষা আইনের প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে এই প্রস্তাবনা তুলে ধরে ‘তহবিল এর দায়’ বিষয়ক ধারা-৭ এর (১) উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসায়নের আদেশ হলে, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ওই অবসায়িত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক আমানতকারীকে তার বীমাকৃত আমানতের সম পরিমাণ (যা সর্বাধিক এক লাখ টাকা অথবা সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সময়ে সময়ে নির্ধারিত টাকার বেশি হবে না), তহবিল হতে প্রদান করবে। প্রস্তাবনার ৭ এর (২) এর ধারায় বলা হয়েছে, অবসায়িত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কোনো আমানতকারীর একাধিক হিসাব থাকলে ওই হিসাবে যদি একত্রে এক লাখ টাকার বেশি স্থিতি থাকে তবুও তাকে সর্বাধিক এক লাখ টাকা কিংবা সরকারের পুর্বানুমোদনক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সময়ে সময়ে নির্ধারিত টাকার বেশি পরিশোধ করা হবে না।
আমানত সুরক্ষা আইনের এই প্রস্তাবনা নিয়ে বিভিন্নমহলে বিশেষ করে আমানতকারীদের উদ্বেগ গণমাধ্যমে আসার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়েছে, কোনো ব্যাংক যদি বন্ধ হয়ে যায় সেক্ষেত্রে মোট ১৮০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীকে এক লাখ টাকা দিয়ে দেবে। একাউন্টে এক কোটি টাকা থাকলেও আমানতকারী পাবেন এক লাখ। প্রথম ৯০ দিনের মধ্যে আমানতকারীরা আবেদন করবেন। পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে এক লাখ টাকা বুঝিয়ে দেয়া হবে। বাকি টাকা পরবর্তী সময়ে বন্ধ হওয়া ব্যাংকের সম্পদ বিক্রি করে আমানতকারীকে যতটুকু সম্ভব পরিশোধ করা হবে। যদিও ব্যাংকগুলোর দুয়েকটি ভবন ছাড়া বিক্রি করার মতো তেমন কোনো স্থাবর সম্পদ থাকে না যা বিক্রি করে আমানত পরিশোধ করা যায়। অতীতে যেসব ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে সেগুলো থেকে এক যুগেও আমানতকারীরা অর্থ ফিরে পায়নি।
দেশে যে হারে ব্যাংক খাতে লুটপাট চলছে, একের পর এক ব্যাংক ফতুর হয়ে আমানত ঘাটতি তৈরি হচ্ছে তাতে গ্রাহকরা বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই কথায় আস্থা রাখতে পারছে না। বরং এই সংবাদ সম্মেলনের পরে ব্যাংক বন্ধ হতে পারে এবং ব্যাংক বন্ধ হলে টাকা মারা যেতে পারে- এমন উদ্বেগ আরো বেড়েছে।
অতীতেও ব্যাংক দেউলিয়া হলে এক লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের বিধান ছিলো। কিন্তু তা নিয়ে এতো আলোচনা সমালোচনা উদ্বেগ-অস্থিরতা ছিলোনা। কিন্তু গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে চরম আস্থাহীনতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে জালিয়াতি করে হাজার হাজার কোটি টাকা চুরির ঘটনা ঘটেছে। জনগণের আমানতের সেই টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার অভিযোগ সামনে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ‘পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড’ ও ‘ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড’ নামক দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি করে বিদেশে পাচারের ঘটনা সামনে এসেছে। অর্থাৎ ব্যাংকসহ আর্থিক খাত সুরক্ষিত নয়, জনমনে এমন ধারণা প্রায় স্থায়ী বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। সে কারণেই ‘ক্ষতিপূরণ কেন এত কম’ বিষয়টি নিয়ে আতঙ্ক বা অস্থিরতা দৃশ্যমান হয়েছে। আসলে বিষয়টি ক্ষতিপূরণ বা ক্ষতিপূরণের অংক কম বা বেশির নয়। মূল বিষয় ব্যাংক-আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা ও গ্রাহকের আস্থাহীনতার সঙ্কট। সম্প্রতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অবসায়নের উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু আমানতকারীদের অর্থ ফেরতের কোনো নিশ্চয়তা নেই। এর আগে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক এবং দ্য ফারমার্স ব্যাংকের ক্ষেত্রেও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৬ সালে দেউলিয়া হয় ওরিয়েন্টাল ব্যাংক। মালিকপক্ষের লুটপাটের কারণে অতিরুগ্ন হয়ে পড়লে ওই বছরের ১৯ জুন ব্যাংকটির দায়িত্ব নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে মালিকপক্ষের ৮৬ শতাংশ শেয়ারের বড় অংশ কিনে নেয় আইসিবি গ্রুপ। তারপর ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে করা হয় আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। কিন্তু গ্রাহকরা এখনও টাকা ফেরত পাননি। ১৯৯২ সালে ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল (বিসিসিআই) বিলুপ্ত হয়ে ইস্টার্ন ব্যাংক গড়ে উঠেছিল। যদিও বিসিসিআই’র বিভিন্ন দেশের গ্রাহকরা এখনও টাকা ফেরত পাননি।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, আমানতকারীরা তখনই সুরক্ষিত থাকবে, যখন ব্যাংক থেকে লুটপাট বন্ধ হবে। কোনও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে এক লাখ টাকার বেশি পাবে না। এটা ঠিক আছে, অন্যান্য দেশেও আমানত সুরক্ষা আইনে এমনটি থাকে। তবে অন্যান্য দেশে ব্যাংক থেকে এভাবে টাকা লুটপাট হয় না।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর গ্রাহকের আমানতের সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক আমানত বীমা আইন ২০০০ এর অধীনে একটি তহবিল আছে। এই তহবিলে প্রতি ছয় মাস পর ব্যাংকগুলোকে মোট আমানতের ওপর নির্দিষ্ট হারে প্রিমিয়াম জমা দিতে হয়। কোনও ব্যাংক নির্ধারিত সময়ে প্রিমিয়াম পরিশোধে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যাংকে তার রক্ষিত হিসাব থেকে প্রিমিয়ামের সমপরিমাণ অর্থ কেটে নেওয়া হয়। ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো হলে কম প্রিমিয়াম এবং খারাপ হলে বেশি হারে প্রিমিয়াম দিতে হয়। স্বাভাবিক ব্যাংকগুলোকে প্রতি ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৮ পয়সা হারে প্রিমিয়াম জমা দিতে হচ্ছে। এছাড়া সতর্কতামূলক অবস্থায় (আরলি ওয়ার্নিংয়ে) থাকা ব্যাংকের ক্ষেত্রে ৯ পয়সা হারে এবং সমস্যাগ্রস্ত (প্রবলেম) ব্যাংকের ক্ষেত্রে ১০ পয়সা হারে প্রিমিয়াম জমার বিধান করা হয়েছে। এখন আমানত সুরক্ষা আইন করে ব্যাংক ছাড়াও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এর আওতায় আনা হবে। প্রস্তাবিত সুরক্ষা আইনে আগের আইনের মতো সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আমানত বীমার প্রিমিয়াম দ্বারা সুরক্ষিত করা হবে। কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে এ আইনের ক্ষমতাবলে গ্রাহককে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ফেরত দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমানত সুরক্ষার এই আইন বাস্তবায়ন হলে বন্ধ হওয়া ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ আমানত বেহাত হবে।
- কার্টসি - সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজ/ ২ মার্চ ২০২০