Search

Sunday, March 8, 2020

ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ সংকট আসন্ন


দেশের ব্যাংকিং খাত ক্রমশ ভয়াবহ সংকটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সক্ষমতা অর্জন তো দূরের কথা, দেশের ব্যাংকিং খাতের টিকে থাকাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ স্ট্রেস টেস্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ন্যূনতম ঝুঁকিসহন ক্ষমতা বা ধাক্কা সামলানের অবস্থায় নেই। ব্যাংকগুলো এখনই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আগাম পদক্ষেপ না নিলে গোটা ব্যাংকিংব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন। তারা বলছেন, ব্যাংক খাতের ওপর আস্থা, স্বচ্ছতা ও বিশ্বস্ততার সংকট দেখা দিয়েছে। 

ভুয়া কাগজপত্রের ভিত্তিতে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়ে একেকটি ব্যাংককে ফতুর করে দেয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমে একদিকে আমানত সংকট তৈরি হয়েছে অন্যদিকে খেলাপি লুটেরারা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বিদেশে পাচার করছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন পুরোপুরি গুটিকয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। আস্থাহীনতার কারণে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখা ক্রমান্বয়ে কমিয়ে দিচ্ছে। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, গোটা ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম ও নৈরাজ্যের মহাযজ্ঞ চলছে। এরই মধ্যে প্রস্তাবিত আমানত সুরক্ষা আইন নিয়ে আমানতকারীদের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। এমন একটি সময়ে এই আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যখন একের পর এক ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা আমানত লুটপাটের ফলে কিছু কিছু ব্যাংককে একীভূতকরণের কথাও ভাবতে হয়েছে। অবশ্য, এমনিতেই বিদ্যমান আইনেই বলা আছে, কোনো ব্যাংক অবসায়ন বা দেওউলিয়া হয়ে গেলে আমানতকারীরা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পাবেন। কোনো গ্রাহকের একাউন্টে কোটি টাকা থাকলেও তিনি সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পাবেন। এ বিধানের কথা সাধারণ মানুষ এতদিন জানতোই না। নতুন প্রস্তাবিত আমানত সুরক্ষা আইনে এ বিধান যুক্ত করায় বিষয়টি জনগণের সামনে এসেছে এবং উদ্বেগ-আতংক দেখা দিয়েছে। 

সর্বশেষ, বাংলাদেশ ব্যাংক এর ওপর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ঘটনাটি মানুষের মধ্যে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমানতকারীরা মহাটেনশনে পড়েছে। অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্যত্র বিনিয়োগ করার কথাও ভাবছে। খোদ ব্যাংক পরিচালকরাই কারসাজি করে গ্রাহকদের টাকা বেহাত করে ব্যাংক ফতুর করে দিচ্ছে। দেশের ১০ কোটি আমানতকারীর ব্যাংকে জমানো প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকাই ঋণ আকারে নিয়ে নিজেদের পকেটে ঢুকিয়েছে মাত্র কয়েক শ’ ব্যাংক পরিচালক। এসব ঋণের বড় অংশ খেলাপি হলেও বছরের পর বছর তা নিয়মিত হিসেবে প্রদর্শন করা হচ্ছে। এই নৈরাজ্যের প্রভাব পড়ছে বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে। সৎ উদ্যোক্তা ও সাধারণ ব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত ঋণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শুধু ব্যাংক নয়, ঋণের মচ্ছব ও অনিয়মের এই মহাযজ্ঞ চলছে ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও। বেসরকারি ব্যাংক পরিচালকদের একটি বিরাট অংশ নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছে না। যখন খেলাপি হয়ে যাচ্ছে, তখন বেনামি ঋণ সৃষ্টি করে ওই ঋণ পরিশোধ দেখানো হয়েছে। আবার অনৈতিকভাবে নিজেদের ঋণের সুদও মওকুফ করে নিয়েছেন। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিচালকদের ভাগাভাগি করে এই ঋণ নেয়া, ব্যাংকিং খাতের জন্য খারাপ দৃষ্টান্ত এবং সুশাসনের পরিপন্থী। এমন পরিস্থিতিকে ভয়ংকর খারাপ নজির বলে অভিহিত করেছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, পরিচালকদের দখলে বিপুল অঙ্কের ঋণ কেন্দ্রীভূত হওয়া ব্যাংকিং খাতের জন্য হুমকি ও উদ্বেগের বিষয়।  

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মোটা দাগে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, ঋণ ও আমানতের সুদহার নিয়ে অনিশ্চয়তা, ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব, সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ দেয়া, ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে অতি নমনীয়তা দেখানো, রাজনৈতিক প্রভাব, বিচারিক কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রতা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রভাবই ব্যাংকিং খাতের সংকটের অন্যতম কারণ। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকিং খাতে যে স্বেচ্ছাচারিতা চলছে এবং গুরুতর অনিয়ম ও বিচ্যুতিকে যেভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে, তা ব্যাংকিং খাতের সংকটকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। 

ঋণখেলাপি হওয়ার পর থেকে এক টাকাও পরিশোধ করেননি প্রায় ৪ হাজার ৬০০ ঋণ খেলাপি ও তাদের প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। 

জাতীয় সংসদের সাম্প্রতিক এক প্রশ্নোত্তর পর্বে ৮ হাজার ২৪০টি ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের তথ্য তুলে ধরা হয়। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঋণখেলাপিদের কাছে ব্যাংকের পাওনা রয়েছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪ হাজার ৫৬৮টি প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হওয়ার পর থেকে এক টাকাও পরিশোধ করেনি। শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের কাছেই আটকা রয়েছে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। খেলাপিঋণের এই চিত্র দেখলেই বোঝা যায়, যারা এই ঋণ নিয়েছেন তারা শিল্প কারখানা স্থাপন করেননি। শিল্পকারখানা স্থাপনের নামে ঋণ নিয়ে হয় ওই ঋণের অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন, অথবা অন্য অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করেছেন। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) তথ্য বলেছে, গত ১০ বছরে দেশ থেকে টাকা পাচার হয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু গত ২০১৫ সালেই পাচার হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। 

ন্যূনতম ঝুঁকিসহন ক্ষমতাও নেই ব্যাংক খাতের

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ স্ট্রেস টেস্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ন্যূনতম অভিঘাত বা ধাক্কা সামলানের অবস্থায় নেই। ব্যাংকগুলো এখনই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আগাম পদক্ষেপ না নিলে ব্যাংকিংব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন। সাধারণত তিন মাস পর পর এ ঝুঁকিসহন ক্ষমতা যাচাই করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ স্ট্রেস টেস্ট প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে সেপ্টেম্বরভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে। সর্বশেষ ওই প্রতিবেদনে দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে বড় ধরনের আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলা হয়েছে, অভিঘাত সামলানোর মতো অবস্থায় নেই ব্যাংক খাত। বড় ধরনের ধাক্কা এলে ব্যাংক খাতের মূলধন সংরক্ষণের হার ঋণাত্মক ৭ দশমিক ২২ শতাংশে নেমে যাবে। এ ধাক্কা মাঝারি মানের হলে মূলধন সংরক্ষণের হার এক শতাংশের নিচে অর্থাৎ শূন্য দশমিক ৭ শতাংশে নেমে যাবে। আর এ ধাক্কা ন্যূনতম হলেও মূলধন সংরক্ষণের হার সোয়া ৮ শতাংশে নেমে যাবে। 

ব্যাংক খাতের যেকোনো অভিঘাত বা ধাক্কা এলে তার সহ্য করার ক্ষমতা কতটুকু তা যাচাই করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ঝুঁকিসহন ক্ষমতা যাচাইকে ব্যাংকিং ভাষায় স্ট্রেস টেস্ট বলা হয়। কতগুলো সূচক বা নির্দেশকের মাধ্যমে এ ঝুঁকিসহন ক্ষমতা যাচাই করা হয়। 

দেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান প্রেক্ষাপট অনুযায়ী, বড় অভিঘাত এলে অর্থাৎ খেলাপি ঋণ ১৫ শতাংশ বাড়লে ন্যূনতম মূলধন তথা ১১ দশমিক ৬৫ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হবে দেশের ৩৪টি সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। মাঝারি অভিঘাত অর্থাৎ খেলাপি ঋণ ৯ শতাংশ বাড়লেও ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে ৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংক।

বড় ঋণগ্রহীতাদের ঋণ বৃদ্ধিজনিত ঝুঁকির মধ্যে বড় অভিঘাত এলে অর্থাৎ শীর্ষ ১০জন ঋণগ্রহীতা ঋণখেলাপি হলে ৩৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে। আর মাঝারি মানের ধাক্কা অর্থাৎ শীর্ষ সাতজন ঋণগ্রহীতা ঋণখেলাপি হলে ৩৫টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ করতে পারবে না। আর ন্যূনতম অভিঘাত অর্থাৎ তিন শীর্ষ ঋণগ্রহীতাও যদি ঋণখেলাপি হন তাহলে ২১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ করতে পারবে না।

এ পর্যন্ত যেসব ব্যাংকের বড় ধরনের ঋণকেলেঙ্কারির তথ্য প্রকাশ পেয়েছে তার বেশির ভাগ ঋণেরই পর্যাপ্ত সহায়ক জামানত ছিল না। আবার যে পরিমাণ সহায়ক জামানত ছিল তার বেশির ভাগই সরকারি খাস জমি, ভুয়া দলিল অথবা নতুন ঋণের বিপরীতে সহায়ক জামানত দেখানো হয়েছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, প্রকৃত সহায়ক জামানত খেলাপী ঋণের ১০ শতাংশও নেই।

সহায়ক জামানতের মূল্য হ্রাসজনিত ঝুঁকির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্ট্রেস টেস্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণের বিপরীতে সহায়ক জামানতের মূল্য ৪০ শতাংশ কমে গেলে ব্যাংকিং খাতের ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণের হার ৮ দশমিক ৯৯ শতাংশে নেমে আসবে। আর এ ঝুঁকি মাঝারি মানের হলেও অর্থাৎ সহায়ক জামানতের মূল্য ২০ শতাংশ কমে গেলে মূলধন সংরক্ষণের হার সোয়া ১০ শতাংশে নেমে যাবে।

ব্যাংক খাতে সাধারণত তিন ধরনের খেলাপি ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে নিম্নমানের খেলাপি ঋণ, সন্দেহজনক খেলাপি ঋণ এবং মন্দমানের খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ মন্দমানের হলে ওই ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়। আর প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে। এ কারণে খেলাপি ঋণ মন্দমানের বেশি হলে ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা কমে যায়। অনেক ব্যাংকের আয় দিয়েও তা সঙ্কুলান করা যায় না। এর ফলে প্রভিশন ঘাটতিতে পড়ে ব্যাংকগুলো। আবার মন্দ ঋণের বিপরীতে যে আয় হয় ওই আয় ব্যাংকগুলো আয় খাতে নিতে পারে না। সুদ আয় স্থগিত করে আলাদা হিসেবে রাখতে হয়। খেলাপি ঋণের গুণগত মান পরিবর্তন ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বড় ধরনের ধাক্কা অর্থাৎ খেলাপি ঋণের গুণগত মান যদি ১৫ শতাংশ পরিবর্তন হয় তাহলে বিদ্যমান অবস্থায় ব্যাংক খাতের মূলধন সংরক্ষণের হার ছয় শতাংশে নেমে আসবে। আর যদি মাঝারি মানের ধাক্কাও আসে তাহলে মূলধন সংরক্ষণের হার ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশে নেমে আসবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্ট্রেস টেস্ট প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাজার ঝুঁকির ক্ষেত্রে দেশের ব্যাংক খাতের বর্তমান অবস্থায় তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে বাজার ঝুঁকি ও ঋণঝুঁকি একত্রে এলে আমাদের ব্যাংক খাত ন্যূনতম ধাক্কাও সামলাতে পারবে না। কারণ, বড় ধরনের অভিঘাত এলে দেশের ৩৯টি ব্যাংক মূলধন হারাবে। অর্থাৎ মূলধন ঋণাত্মক ৭ দশমিক ২২ শতাংশে নেমে আসবে। আর মাঝারি মানের ধাক্কা এলেও ৩৮টি ব্যাংক মূলধন হারাবে। অর্থাৎ ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণের হার ১ শতাংশের নিচে (শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ) নেমে আসবে। 

পরিচালকদের ভাগবাটোয়ারার ঋণে ফতুর হচ্ছে ব্যাংক

ব্যাংকিং খাতে পরিচালকদের মধ্যে চলছে ভাগবাটোয়ারার ঋণ। যোগসাজশের মাধ্যমে এক ব্যাংকের পরিচালক আরেক ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা পরিশোধ করছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিজ ব্যাংক ও অন্য ব্যাংক থেকে পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা। এ ঋণ মোট ব্যাংক ঋণের ১২ শতাংশের বেশি। কিন্তু এ হিসাবের বাইরে বেনামেও অনেকের বিরুদ্ধে ঋণ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। বেনামি ঋণের পরিমাণও এর দ্বিগুণ হতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে। কিন্তু বেনামি হওয়ায় তাদের নাম পরিচালকদের ঋণে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। বিশ্লেষকদের মতে, যোগসাজশের মাধ্যমে ঋণ বের হয়ে যাওয়ায় ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকিং খাতে। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, যোগসাজশের এসব ঋণের অর্থ কোথায় ব্যবহার করা হচ্ছে তারও কোনো হিসাব নেই। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পাচার করে দিচ্ছেন কি না- তারও কোনো তথ্য নেই। পরিচালকরা যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিচ্ছেন তার বেশির ভাগেরই অস্তিত্ব নেই। এভাবে ঋণ নেয়া অনৈতিক ও সুশাসনের পরিপন্থী। এটা আমানতকারীদের আমানতকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নেয়া না হলে, যেভাবে নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে জনগণের অর্থ বের করে নেয়া হচ্ছে তা বন্ধ করতে না পারলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিই ঝুঁকির মুখে পড়বে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী বর্তমানে একটি ব্যাংকের পরিচালক রয়েছেন সর্বোচ্চ ২০ জন। ব্যাংক শুরু করতে পরিশোধিত মূলধন লাগে ৪০০ কোটি টাকা। সেই হিসেবে একজন উদ্যোক্তাকে ব্যাংক পরিচালক হতে বিনিয়োগ করতে হয় সর্বোচ্চ ২০ কোটি টাকা। কিন্তু এ ২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ভাগবাটোয়ারার মাধ্যমে নামে-বেনামে শত শত কোটি টাকা জনগণের আমানত ঋণ আকারে বের করে নিচ্ছেন কিছু পরিচালক। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বেসরকারি খাতে ব্যাংক পরিচালক রয়েছেন সর্বোচ্চ ৮০০ জন। কিন্তু ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতকারী রয়েছেন প্রায় ১০ কোটি ৫ লাখ। আর ঋণগ্রহীতা রয়েছেন প্রায় এক কোটি ১০ লাখ। মোট ঋণ রয়েছে প্রায় ৯ লাখ ৭০০ কোটি টাকা, আর আমানত রয়েছে ১০ লাখ কোটি টাকার ওপরে। কিন্তু ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ব্যাংক ঋণের একটি বড় অংশ দখল করে রেখেছেন কিছু ব্যাংক পরিচালক। ব্যাংক পরিচালকদের মধ্যে সর্বোচ্চ ঋণ নিয়েছেন ৩০০ জন, যারা এক ব্যাংকের পরিচালক হয়ে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। এই পরিচালকরা সর্বোচ্চ ব্যাংকের পরিচালক হতে বিনিয়োগ করেছেন ২০ কোটি টাকা করে ৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ঋণের নামে ব্যাংক থেকে বের করে নিয়েছেন প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা। অভিযোগ রয়েছে, এ টাকার বেশির ভাগই বছরের পর বছর পরিশোধ করা হয় না। পরিশোধ দেখানো হলেও তা হয়, বেনামে ঋণ সৃষ্টি করে। কখনো ঋণ পুনঃতফসিলির মাধ্যমে বছরের পর বছর ঋণ নবায়ন করা হচ্ছে কোনোরকম ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই। 

আগে পরিচালকরা নিজ ব্যাংক থেকেই বেশি মাত্রায় ঋণ নিতেন। পরে ওই ঋণ পরিশোধ করতেন না। যখন খেলাপি হয়ে যেত, তখন বেনামি ঋণ সৃষ্টি করে ওই ঋণ পরিশোধ দেখাতেন। আবার পরিচালকরা পরিচালনা পর্ষদে বসে নিজেরা অনৈতিকভাবে সুদ মওকুফ করে নিতেন। পরিচালকদের নিজ ব্যাংকের এ অনৈতিক কার্যক্রম ঠেকাতে কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নির্দেশনায় বলা হয়, কোনো পরিচালক তার মোট শেয়ারের ৫০ শতাংশের বেশি ঋণ নিজ ব্যাংক থেকে নিতে পারবেন না। এর পর থেকেই পরিচালকরা নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া কমিয়ে দেন। পরিচালকদের নিজ ব্যাংক থেকে বেপরোয়া ঋণ নেয়া কমানো হলেও তাদের এ অনৈতিক কার্যক্রম থেমে নেই। তারা নিজেদের মধ্যে যোগসাজশ করে ঋণ নেয়া অব্যাহত রেখেছেন। যেমন, ‘ক’ ব্যাংকের পরিচালক ‘খ’ ব্যাংক থেকে নিচ্ছেন। আবার ‘খ’ ব্যাংকের পরিচালক যোগসাজশের মাধ্যমে ‘ক’ ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। 

এসব ঋণের বেশির ভাগ সম্পর্ক, যোগসাজশ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে নেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে কোনো ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী হয় না অনেক ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব জেনেও চুপ করে বসে থাকে।

হদিস মিলছে না দেড় লাখ কোটি টাকার 

ব্যাংকের বাইরে থাকা প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার কোনো হদিস মিলছে না। এই অর্থ কোথায় রয়েছে, কার কাছে রয়েছে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকও তার কোনো খবর পাচ্ছে না। অথচ গত এক দশকে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপকভাবে ব্যাংকিং অন্তর্ভুক্তি বেড়েছে। নতুন নতুন ব্যাংক যেমন এসেছে তেমনি বেড়েছে ব্যাংকের শাখার সংখ্যাও। এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংসহ অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে ব্যাংক ছড়িয়ে পড়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ব্যাংকিং খাতে যুক্ত হয়েছে অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন সেবা। এর ফলে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের হার কমে আসার কথা।  কিন্তু উল্টো তা বেড়েছে। 
২০১০ সালে দেশে ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ ছিল ৪৬ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯ সাল শেষে নগদ এ অর্থের পরিমাণ ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশের মতো একটি অর্থনীতির দেশে ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকার নগদ অর্থ যথেষ্ট বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তবে বাস্তবে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ এর তিন গুণ। এই বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ কার কাছে বা কাদের কাছে কোথায় রয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে ব্যাংকিং খাতের ওপর বেড়ে চলা অবিশ্বাস, অন্যদিকে অবৈধ উৎস থেকে উপার্জিত অর্থ নিরাপদে রাখতে চাওয়া- এই দুই কারণে ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ বেড়ে চলেছে। দুর্নীতি ও অবৈধভাবে অর্জিত কালো টাকা ব্যাংকিং খাতে আসছে না। আবার বড় বড় কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংকিং খাতের ওপর আস্থা কমে আসায় মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে নিজস্ব ব্যবস্থায় রাখছে। অন্যদিকে আবার প্রভাবশালীরা অবৈধ অর্থ হুন্ডির কাজে ব্যবহার করছে।

মনে করা হচ্ছে, ব্যাংকের বাইরে থাকা অর্থের বড় অংশই কালো টাকা। অবৈধভাবে অর্জিত এ অর্থ অপরাধীরা ব্যাংকে রাখতে সাহস পাচ্ছে না। ফলে এ অর্থের একটি অংশ হুন্ডির কাজে ব্যবহার হচ্ছে, অন্য অংশ বাড়িতে সিন্দুক বা বালিশ-তোশকে ঢুকছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র বলছে, কোনো পরিসংখ্যানেই ইস্যুকৃত অর্থের অন্তত ২৫ শতাংশের অবস্থান নির্ণয় করা যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাম্প্রতিক বিভিন্ন অভিযানেও এর প্রমাণ মিলেছে। ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িত আওয়ামী লীগ নেতা দুই ভাই এনামুল হক ও রূপন ভূঁইয়ার পুরান ঢাকার একটি বাসার পাঁচটি সিন্দুক থেকে সম্প্রতি নগদ ২৬ কোটি ৫৫ লাখ ৬০০ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা পাওয়া গেছে যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট, খালেদ, জিকে শামীমের বাড়ি থেকেও।

অর্থনীতিতে কালো টাকার দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত এ অর্থ ব্যাংকে না গিয়ে বিদেশে হুন্ডির কাজে ব্যবহার হচ্ছে কিংবা সিন্দুকে আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে ব্যাংকিং খাতের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ দিনদিন বেড়েই চলছে। ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। 

প্রস্তাবিত আমানত সুরক্ষা আইন নিয়ে উদ্বেগ

গোটা ব্যাংকিং খাতে যখন চরম অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা আর আস্থার সংকট চলছে; ঠিক সেই মুহূর্তে এই উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে প্রস্তাবিত ‘আমানত সুরক্ষা আইন।’ এই আইনের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে বা অবসায়িত হলে সেই ব্যাংকের বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীরা তাদের জমানো সব টাকা ফেরত পাবেন না। শুধু তাই নয়, গ্রাহকের নামে ব্যাংক একাউন্টে  কোটি টাকা জমা থাকলেও তাকে মাত্র এক লাখ টাকা ফেরত দেয়ার বিধান রেখে আমানত সুরক্ষা আইনের প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে এই প্রস্তাবনা তুলে ধরে ‘তহবিল এর দায়’ বিষয়ক ধারা-৭ এর (১) উপধারায়  বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসায়নের আদেশ হলে, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ওই অবসায়িত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক আমানতকারীকে তার বীমাকৃত আমানতের সম পরিমাণ (যা সর্বাধিক এক লাখ টাকা অথবা সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সময়ে সময়ে নির্ধারিত টাকার বেশি হবে না), তহবিল হতে প্রদান করবে। প্রস্তাবনার ৭ এর (২) এর ধারায়  বলা হয়েছে, অবসায়িত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কোনো আমানতকারীর একাধিক হিসাব থাকলে ওই হিসাবে যদি একত্রে এক লাখ টাকার বেশি স্থিতি থাকে তবুও তাকে সর্বাধিক এক লাখ টাকা কিংবা সরকারের পুর্বানুমোদনক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সময়ে সময়ে নির্ধারিত টাকার বেশি পরিশোধ করা হবে না।

আমানত সুরক্ষা আইনের এই প্রস্তাবনা নিয়ে বিভিন্নমহলে বিশেষ করে আমানতকারীদের উদ্বেগ গণমাধ্যমে আসার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়েছে, কোনো ব্যাংক যদি বন্ধ হয়ে যায় সেক্ষেত্রে মোট ১৮০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীকে এক লাখ টাকা দিয়ে দেবে। একাউন্টে এক কোটি টাকা থাকলেও আমানতকারী পাবেন এক লাখ। প্রথম ৯০ দিনের মধ্যে আমানতকারীরা আবেদন করবেন। পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে এক লাখ টাকা বুঝিয়ে দেয়া হবে। বাকি টাকা পরবর্তী সময়ে বন্ধ হওয়া ব্যাংকের সম্পদ বিক্রি করে আমানতকারীকে যতটুকু সম্ভব পরিশোধ করা হবে। যদিও ব্যাংকগুলোর দুয়েকটি ভবন ছাড়া বিক্রি করার মতো তেমন কোনো স্থাবর সম্পদ থাকে না যা বিক্রি করে আমানত পরিশোধ করা যায়।  অতীতে যেসব ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে সেগুলো থেকে এক যুগেও আমানতকারীরা অর্থ ফিরে পায়নি।  

দেশে যে হারে ব্যাংক খাতে লুটপাট চলছে, একের পর এক ব্যাংক ফতুর হয়ে আমানত ঘাটতি তৈরি হচ্ছে তাতে গ্রাহকরা বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই কথায় আস্থা রাখতে পারছে না। বরং এই সংবাদ সম্মেলনের পরে ব্যাংক বন্ধ হতে পারে এবং ব্যাংক বন্ধ হলে টাকা মারা যেতে পারে- এমন উদ্বেগ আরো বেড়েছে। 
অতীতেও ব্যাংক দেউলিয়া হলে এক লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের বিধান ছিলো। কিন্তু তা নিয়ে এতো আলোচনা সমালোচনা উদ্বেগ-অস্থিরতা ছিলোনা। কিন্তু গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে চরম আস্থাহীনতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে জালিয়াতি করে হাজার হাজার কোটি টাকা চুরির ঘটনা ঘটেছে। জনগণের আমানতের সেই টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার অভিযোগ সামনে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ‘পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড’ ও ‘ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড’ নামক দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি করে বিদেশে পাচারের ঘটনা সামনে এসেছে। অর্থাৎ ব্যাংকসহ আর্থিক খাত সুরক্ষিত নয়, জনমনে এমন ধারণা প্রায় স্থায়ী বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। সে কারণেই ‘ক্ষতিপূরণ কেন এত কম’ বিষয়টি নিয়ে আতঙ্ক বা অস্থিরতা দৃশ্যমান হয়েছে। আসলে বিষয়টি ক্ষতিপূরণ বা ক্ষতিপূরণের অংক কম বা বেশির নয়। মূল বিষয় ব্যাংক-আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা ও গ্রাহকের আস্থাহীনতার সঙ্কট। সম্প্রতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অবসায়নের উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু আমানতকারীদের অর্থ ফেরতের কোনো নিশ্চয়তা নেই। এর আগে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক এবং দ্য ফারমার্স ব্যাংকের ক্ষেত্রেও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৬ সালে দেউলিয়া হয় ওরিয়েন্টাল ব্যাংক। মালিকপক্ষের লুটপাটের কারণে অতিরুগ্ন হয়ে পড়লে ওই বছরের ১৯ জুন ব্যাংকটির দায়িত্ব নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে মালিকপক্ষের ৮৬ শতাংশ শেয়ারের বড় অংশ কিনে নেয় আইসিবি গ্রুপ। তারপর ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে করা হয় আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। কিন্তু গ্রাহকরা এখনও টাকা ফেরত পাননি। ১৯৯২ সালে ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল (বিসিসিআই) বিলুপ্ত হয়ে ইস্টার্ন ব্যাংক গড়ে উঠেছিল। যদিও বিসিসিআই’র বিভিন্ন দেশের গ্রাহকরা এখনও টাকা ফেরত পাননি।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, আমানতকারীরা তখনই সুরক্ষিত থাকবে, যখন ব্যাংক থেকে লুটপাট বন্ধ হবে। কোনও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে এক লাখ টাকার বেশি পাবে না। এটা ঠিক আছে, অন্যান্য দেশেও আমানত সুরক্ষা আইনে এমনটি থাকে। তবে অন্যান্য দেশে ব্যাংক থেকে এভাবে টাকা লুটপাট হয় না।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর গ্রাহকের আমানতের সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক আমানত বীমা আইন ২০০০ এর অধীনে একটি তহবিল আছে। এই তহবিলে প্রতি ছয় মাস পর ব্যাংকগুলোকে মোট আমানতের ওপর নির্দিষ্ট হারে প্রিমিয়াম জমা দিতে হয়। কোনও ব্যাংক নির্ধারিত সময়ে প্রিমিয়াম পরিশোধে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যাংকে তার রক্ষিত হিসাব থেকে প্রিমিয়ামের সমপরিমাণ অর্থ কেটে নেওয়া হয়। ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো হলে কম প্রিমিয়াম এবং খারাপ হলে বেশি হারে প্রিমিয়াম দিতে হয়। স্বাভাবিক ব্যাংকগুলোকে প্রতি ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৮ পয়সা হারে প্রিমিয়াম জমা দিতে হচ্ছে। এছাড়া সতর্কতামূলক অবস্থায় (আরলি ওয়ার্নিংয়ে) থাকা ব্যাংকের ক্ষেত্রে ৯ পয়সা হারে এবং সমস্যাগ্রস্ত (প্রবলেম) ব্যাংকের ক্ষেত্রে ১০ পয়সা হারে প্রিমিয়াম জমার বিধান করা হয়েছে। এখন আমানত সুরক্ষা আইন করে ব্যাংক ছাড়াও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এর আওতায় আনা হবে। প্রস্তাবিত সুরক্ষা আইনে আগের আইনের মতো সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আমানত বীমার প্রিমিয়াম দ্বারা সুরক্ষিত করা হবে। কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে এ আইনের ক্ষমতাবলে গ্রাহককে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ফেরত দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমানত সুরক্ষার এই আইন বাস্তবায়ন হলে বন্ধ হওয়া ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ আমানত বেহাত হবে। 

  • কার্টসি - সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজ/ ২ মার্চ ২০২০

Thursday, March 5, 2020

সম্রাট পাপিয়ার সাম্রাজ্য ও রাজনীতি

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
দেশ এখন পাপিয়াময়। ভার্চুয়াল মিডিয়া তো বটেই, দেশের সংবাদমাধ্যমের নিয়মিত আইটেম হিসেবে থাকছে পাপিয়াকা-। সংবাদমাধ্যমে খবর বের হচ্ছে, পাপিয়া রিমান্ডে কী তথ্য দিচ্ছেন। তার সঙ্গে কোন ক্ষমতাধরদের সখ্য ছিল। আর তার কাছে কোন বিশিষ্টজনদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা, জাল টাকার ব্যবসা ও বিভিন্ন অনৈতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে কোটি টাকার সম্পদ পাচার এবং কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের অনুসন্ধানের কথাও আমরা জানতে পারছি। রাজধানীর ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডে এবং নরসিংদীতে বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়িসহ তাদের নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদের সন্ধান পাওয়ার খবরও আসছে। 

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
র‌্যাব জানাচ্ছে, পাপিয়া মাসে শুধু হোটেল ওয়েস্টিনে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার বিল পরিশোধ করেছেন। ওয়েস্টিন হোটেলে প্রতিদিন শুধু বারের খরচ বাবদ প্রায় আড়াই লাখ টাকা পরিশোধ করতেন পাপিয়া। ওয়েস্টিনে তার নিয়ন্ত্রণে সাতজন নারী ‘কাজ’ করতেন। হোটেল ওয়েস্টিনে প্রেসিডেনশিয়াল স্যুট পাপিয়ার নামে সব সময় ‘বুকড’ থাকত। কিন্তু তাদের অর্জিত অবৈধ সম্পদের বিবরণের দিকে মানুষের আগ্রহ খুব একটা লক্ষণীয় নয়। সবার কৌতূহল তার কাছে যাওয়া ব্যক্তিদের তালিকা নিয়ে। রিমান্ডে পাপিয়া তার ওয়েস্টিন হোটেলের আস্তানায় যাতায়াতকারী যেসব ব্যক্তির নাম বলছেন, তা নিয়ে নাকি খোদ পুলিশ কর্মকর্তারাই বিব্রত।

রিমান্ডে থাকা ব্যক্তির বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে কীভাবে আসে, এটা আইনসম্মত কি না এবং কতটা বিশ্বাসযোগ্য, সে প্রশ্ন থাকলেও সংবাদমাধ্যম বিরামহীনভাবে সেসব তথ্য দিয়ে পাঠকচাহিদা মিটিয়ে থাকে। তেমনই একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে মুখরোচক আলোচনার জন্ম দেয় দৈনিক মানবজমিন। ২ মার্চ ২০২০ ‘পাপিয়ার মুখে আমলা-এমপি ব্যবসায়ীসহ ৩০ জনের নাম’ শিরোনামে পত্রিকাটি লেখে, গোয়েন্দা সূত্রে প্রাপ্ত একটি তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পাপিয়ার আস্তানায় নিয়মিত যেতেন এমন ব্যক্তিদের মধ্যে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীও আছে তালিকায়। সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্য আছেন। সরকারের সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা আছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী আছেন।

ইতিমধ্যে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, গ্রেপ্তার করা পাপিয়ার সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, কাউকে ছাড়া হবে না। সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। এই কথা শুনে অনেকেই মুচকি হেসে মনে করিয়ে দেন, ‘শুদ্ধি’ অভিযানের সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা। তখনো বলা হয়েছিল, কাউকে ছাড়া হবে না। কাউকে না ছাড়ার কথা বাদ দিয়ে বরং মনে করার চেষ্টা করুন সেই ‘শুদ্ধি’ অভিযানে কাদের ধরা হয়েছিল। যাদের ধরা হয়েছিল, তারা আওয়ামী লীগের কোন পর্যায়ের নেতা? খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ছিলেন যুবলীগের একটি ইউনিটের (ঢাকা দক্ষিণ) সাংগঠনিক সম্পাদক। আর জি কে শামীম যুবলীগের সমবায় সম্পাদক। শফিকুল আলম ফিরোজ ছিলেন কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। তার বাইরে লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, সেলিম প্রধানসহ আর যে কয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য পদধারী কেউ ছিলেন না।

যুবলীগের আলোচিত নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট তখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেন তাকে ধরা যাচ্ছে না, তা নিয়ে ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ প্রথম আলো লিখেছিল, ‘অভিযানের সঙ্গে যুক্ত র‌্যাবের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, যাদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তারা গ্রেপ্তার হলে ক্ষমতাসীন দলের অনেকের নাম বেরিয়ে আসবে। তাই ঝুঁকি নিতে চাইছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।’  প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর অবশ্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল যুবলীগ নেতা সম্রাটকে। তার ওপর যে প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত ছিলেন সেটা আগেই বোঝা গিয়েছিল। কিন্তু তারপর? আর এগোতে পারেনি সে অভিযান। আমরা জানতে পারিনি সম্রাট তার কোন রাজনৈতিক গুরুদের নাম বলেছেন। এমন কী চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি, জাতীয় সংসদের হুইপ ক্লাবভিত্তিক জুয়া থেকে মাসে কত টাকা পেয়ে থাকেন, সে হিসাব পর্যন্ত প্রকাশিত হওয়ার পরও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। আওয়ামী যুবলীগের তখনকার চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে যুবলীগ থেকে বিদায় করা হয়েছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আনা হয়নি আইনের আওতায়।

একসময় থেমে যায় সে অভিযান। অনেক দিন পর আবার আলোচনায় আসেন গে-ারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এনামুল হক এনু ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুপন ভূঁইয়ার গ্রেপ্তারের খবর। প্রথম আলোর রিপোর্টে লেখা হয়, ১০ বছর আগেও এনামুল হক এনু ও রুপন ভূঁইয়ার সম্পদ বলতে ছিল ২৯ বানিয়ানগরে লোহা-লক্কড় বিক্রির একটি দোকান। তারা থাকতেন দোকানের পেছনে একটি টিনশেড বাড়িতে। অভিযানের প্রথম পর্যায়ে র‌্যাবের কাছে দুই ভাইয়ের মালিকানায় ১৫টি বাড়ির তথ্য ছিল, গ্রেপ্তারের পর সিআইডি জানায়, বাড়ির সংখ্যা ২২। আর রিমান্ড শেষে জানা যায়, জিজ্ঞাসাবাদে তারা ১২০টি বাড়ির তথ্য দিয়েছে। এই দুই সহোদর গত ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর গা-ঢাকা দিয়েছিলেন। তখন এনুর ফ্ল্যাটে থাকা দুটি ভল্ট ও রুপনের ফ্ল্যাটে থাকা একটি ভল্ট থেকে অভিযান চালিয়ে র‌্যাব এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা, প্রায় চার কোটি টাকা মূল্যের আট কেজি স্বর্ণালংকার ও পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছিল।

অনেকেই বলছেন, সরকারি দলের সম্রাট-জি কে শামীম-খালেদ-পাপিয়া-এনু-রুপনের মতো স্তরের নেতাদেরই যদি এ অবস্থা হয়, তবে আরেকটু ওপরে উঠলে কী অবস্থা দেখা যাবে? মাত্র দশ বছরে সরকারি দলের পাতি নেতা হয়েই যদি লোহা-লক্কড় বিক্রির একটি দোকান ও একটি টিনশেড বাড়ি থেকে এনু-রুপন সম্পদেও পাহাড় গড়তে পারেন। যদি পাপিয়া অঢেল সম্পদের মালিক হতে পারেন। তাহলে তাদের আশ্রয়দাতা রাজনৈতিক গডফাদাররা কত টাকার মালিক হয়েছেন, সেটা কী অনুমান করা অসাধ্য?  অভিযানের নামে মাঝেমধ্যে যে নাটকটা মঞ্চস্থ করা হয়, সে বিষয়ে “রাজনীতির ‘নতুন দিন’, ক্যাসিনো টু ওয়েস্টিন” শিরোনামে রিপোর্টে ডয়চে ভেলে লিখেছে, অভিযানের সময় যত ঢাকঢোল পেটানো হয়, মামলায় তা কতটুকু প্রতিফলিত হয়? তা ছাড়া শেষ পর্যন্ত তারা কী শাস্তি পান? যারা জড়িত, তাদের সবাইকে কী আইনের আওতায় আনা হয়? ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তখনকার ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের ক্যাসিনো থেকে আয়ের কোটি কোটি টাকা কোথায়? সম্রাটের নাকি এখন তেমন কোনো টাকা-পয়সার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

মানুষের মুখে মুখে পাপিয়া সম্রাটদের নিয়ে আলোচনা হলেও অনেকেই মনে করেন পুরো দেশটাতেই চলছে অসংখ্য পাপিয়া-সম্রাট ও তাদের রাজনৈতিক গুরুদের একচ্ছত্র রাজত্ব। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে শাসনব্যবস্থা জেঁকে বসেছে, তার প্রোডাক্ট হচ্ছে এই পাপিয়া-সম্রাটের রাজত্ব। সে রাজত্বে মাঝেমধ্যে এক-আধটু বৈরী বাতাস বহে বটে। তাতে সে রাজত্বে নেতৃত্বের কিছুটা হাতবদল হলেও কাজ-কারবারে কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। অনেকটা আন্ডার ওয়ার্ল্ডের খুনোখুনির মতোই। নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকে এক সন্ত্রাসী আরেক সন্ত্রাসীকে খুন করলে তাতে কখনো সন্ত্রাস কমে না। শুধু নেতৃত্বের হাতবদল হয়। তাই একজন পাপিয়া বা সম্রাটের গ্রেপ্তারে ডাকাতি, অনৈতিক কর্মকাণ্ড বা লুটপাটের কমতি হবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। শুধু হাতবদল হতে পারে। যে রাজনীতি এই মাফিয়া রাজত্বটাকে টিকিয়ে রাখে, সে রাজনীতির অবসান না হলে এই রাজত্বেরও অবসান হবে না, এটা নিশ্চিত।

  • লেখক, চিকিৎসক ও কলামনিস্ট
  • কার্টসি - দেশ রুপান্তর/ মার্চ ৫, ২০২০ 

ঢাকায় মশার উৎপাত

মশকনিধন কার্যক্রম জোরদার করুন

ঢাকা মহানগরের বাসিন্দারা মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। কিছু সংবাদমাধ্যমে এ সম্পর্কে কিছু খবর ছাপা হয়েছে। এটা প্রাথমিক কাণ্ডজ্ঞানের কথা যে মশার উপদ্রব বাড়ে তখনই, যখন মশকনিধন কার্যক্রম থাকে না। গত বছর ঢাকাসহ সারা দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাবের সময় নাগরিক সমাজের প্রবল সমালোচনার চাপে মশকনিধন কার্যক্রমে যে তৎপরতা দেখা দিয়েছিল, ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। এর মানে কি এই যে ডেঙ্গু  জ্বর কিংবা মশাবাহিত কোনো রোগ প্রায় মহামারির আকার ধারণ না করা পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের চেতনায় কোনো সাড়া পড়তে নেই? তাদের টনক শুধু তখনই নড়বে, যখন হাজার হাজার মানুষ মশার কামড় খেয়ে রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতাল-ক্লিনিক-স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে উপচে পড়বে? 

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন সারা বছর নিয়মিতভাবে মশকনিধন কার্যক্রম চালিয়ে গেলে মশার উপদ্রব এমন মাত্রায় বেড়ে ওঠা সম্ভব ছিল না। ডেঙ্গু জ্বর নেই, সমাজে শোরগোল নেই—এই ভেবে দুই সিটি করপোরেশন মশকনিধন কার্যক্রমে শিথিলতা দেখালে অচিরেই আমরা আবারও বড় বিপদের মুখোমুখি হতে পারি। তা ছাড়া, এখন ডেঙ্গুর মৌসুম নয় বলে কেউ কোথাও এই জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে না—এটাও সত্য নয়। কদিন আগেই খবর বেরিয়েছে, ২৫০ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। বিপদের কথা হলো, ঢাকায় মশার উপদ্রব ইতিমধ্যে যা বাড়ছে, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বেড়ে যাবে আগামী সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই। 

ঢাকা মহানগরে মশার ঘনত্ব পর্যবেক্ষণ করে এবং মশার প্রজনন-পরিস্থিতি সম্পর্কে পূর্বাভাস দেয়, এমন একটি গবেষক দলের পক্ষ থেকে কদিন আগে বলা হয়েছে, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা মহানগরে মশার ঘনত্ব রেকর্ড মাত্রায় বেড়ে যাবে। এক সপ্তাহের জরিপ থেকে তারা এই অনুমানে পৌঁছেছে। এ মাসের মাঝামাঝি থেকে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করবে; মশার লার্ভাগুলোর পূর্ণাঙ্গ মশায় পরিণত হওয়ার এটা উপযুক্ত সময়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পরিচালিত ওই গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক কবিরুল বাসার সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, অতি জরুরি ভিত্তিতে ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়ে মশার প্রজননস্থলগুলোতে মশার লার্ভা মারার ওষুধ ছিটাতে হবে, নইলে মার্চে ঢাকায় মশার উৎপাত ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। 

কিন্তু মশকনিধন কার্যক্রমে দুই সিটি করপোরেশনকে যথেষ্ট তৎপর দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে খবর বেরিয়েছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অন্তত ১৮টি ওয়ার্ডে মশার লার্ভা মারার ওষুধ ছিটানোর যন্ত্রগুলোর একটা বড় অংশ অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। অন্যগুলোর অবস্থা যে ভালো নয়, তা বোধগম্য। কারণ, ডেঙ্গুর মৌসুমে অনেকটা দিশেহারা হয়ে তড়িঘড়ি করে প্লাস্টিকের তৈরি ওই যন্ত্রগুলো বিদেশ থেকে কিনে আনা হয়েছিল অনেক টাকা খরচ করে। খুব তাড়াতাড়িই যে সেগুলোর অধিকাংশ অকেজো হয়ে গেছে, এ জন্য কাউকে কোনো জবাবদিহি করতে হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু এরই মধ্যে আবারও অনেক টাকা ব্যয় করে চীন থেকে নতুন যন্ত্র আনা হচ্ছে বলে খবর বেরিয়েছে। সেগুলো যেন গুণগত মানসম্পন্ন হয়, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। 

মশার লার্ভা মারার ওষুধ ও তা ছিটানোর যন্ত্রের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। সারা বছর নিয়মিতভাবে সেগুলো ছিটানোর ব্যবস্থাটাকে স্থায়ী চর্চায় পরিণত করা প্রয়োজন। এটা কোনো মৌসুমি ব্যাপার নয়।

  • কার্টসি - প্রথম আলো/ মার্চ ৫, ২০২০ 

Wednesday, March 4, 2020

বিদ্যুৎ-পানির মূল্যবৃদ্ধি ও ভূলুণ্ঠিত ভোক্তা অধিকার

এস এম নাজের হোসাইন


‘ভোক্তা’ শব্দের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। ভোক্তার ইংরেজি শব্দ কনজ্যুমার, যার অর্থ ভোগকারী। অর্থাৎ কোনো পণ্য, খাদ্য, পানীয় দ্রব্য বা সেবা প্রদানকারীর সেবা গ্রহণ করে যারা, তাদের ভোক্তা বলা হয়।

দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ২০০৯-এর আওতায় ‘ভোক্তা হলেন তিনিই, যিনি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যতীত সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে বা সম্পূর্ণ বাকিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন অথবা কিস্তিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন।’ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কোনো না কোনোভাবে একজন ভোক্তা।

আবার অনেকে বলে থাকেন, মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে যেসব অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্র ও জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত, সেগুলোই ভোক্তা অধিকারের আওতায় থাকে।

জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকারগুলোর মধ্যে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, নিরাপদ পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার, পণ্যের উপাদান, ব্যবহারবিধি, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি তথ্য জানার অধিকার, ন্যায্যমূল্যে সঠিক পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার, কোনো পণ্য বা সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ ও বসবাস করার অধিকার, অভিযোগ করার ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার অন্যতম।

আর সাধারণ মানুষ আশা করে, এ বর্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য, বিদ্যুৎ-পানি ও গ্যাসের মূল্য তাদের নাগালের মধ্যে থাকবে। কিন্তু বছরের শুরুতেই একসঙ্গে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়িয়েছে সরকার।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান সংবাদ সম্মেলন করে এবং ঢাকা ওয়াসা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। বিইআরসি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে অন্তত লোক দেখানো গণশুনানি করেছিল।

ঢাকা ওয়াসা গণমাধ্যমের মুখোমুখি না হয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। ইতিমধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম হু-হু করে বেড়েছে। সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের খরচ আরও বাড়বে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের বিরোধিতার পরও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি ছিল না। বাড়তি দামে বিদ্যুৎ কেনার পাশাপাশি এর প্রভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ও সেবা সার্ভিসের দাম বাড়বে।

প্রতিমাসে ভোক্তাদের বাড়তি টাকা গুনতে হবে। এমনিতে গত কয়েক মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রধান প্রধান ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। চালের দাম বাড়ানো হয়েছে কয়েক দফা। বেড়েছে চিনি, ভোজ্যতেল, ডাল, পেঁয়াজ ও রসুনের দাম। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতিও হঠাৎ লাফ দিয়েছে।

সব মিলিয়ে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষ যখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখনই বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়াল সরকার। অন্যদিকে গত বছরের ২৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে প্রদত্ত সুপারিশের একটিও কার্যকর না করে গণশুনানিকে হাস্যকর করা হয়েছে।

ভোক্তাদের স্বার্থ চিন্তা না করে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে গণশুনানির মাধ্যমে নতুন মূল্য পুনর্নির্ধারণের দাবি উঠেছে। একতরফাভাবে গ্রাহকের মতামত ছাড়া ওয়াসার পানির দাম বাড়ানো ভোক্তা সংরক্ষণ আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মনে করছেন ভোক্তা আন্দোলনের নেতারা।

বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করে এবং এ খাতে বিরাট দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি করে।

সাময়িক সংকট সমাধানের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কথা বলা হলেও এখনও সেগুলো চলছে। উৎপাদন না করেই ভাড়া হিসেবে জনগণের পয়সা নিয়ে হরিলুট করা হচ্ছে। বিদ্যুতের এ দাম বাড়ার প্রভাব কেবল বাসাবাড়িতে পড়বে তা নয়, কৃষি ও শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচও অনেক বাড়বে।

করোনাভাইরাসসহ বৈশ্বিক অনেক কারণে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে। অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকই নিম্নগামী। বিশ্ব অর্থনীতিও মন্দার আশঙ্কায়। কমে যাচ্ছে সামগ্রিক চাহিদা। এ রকম একসময়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কতটা সময়োপযোগী?

এ মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিম্ন ও মধ্যবিত্তের স্বার্থবিরোধী। অর্থ খরচ করে অর্থহীন কাজ হয়েছে। সব ক্ষেত্রে জনগণের খরচ ও পণ্যের দাম বাড়বে। পুরো প্রক্রিয়াটিই জনগণের বিরুদ্ধে চলে গেছে।

এটা খুবই দুঃখজনক, বিইআরসির চেয়ারম্যান সৌজন্যবশত বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পক্ষে গণমাধ্যমে কিছু কথাবার্তা বললেও ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ সেই সৌজন্য দেখানোরও প্রয়োজন বোধ করেনি।

ওয়াসা নামক প্রতিষ্ঠানটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ না করে লোকসানের দায়ভার সব সময় জনগণের ওপর চাপানো হচ্ছে। ওয়াসার সব পর্যায়ে অনিয়ম, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে হরিলুট, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, সিস্টেম লস কমানো গেলে লোকসানের মাত্রা এত হতো না।

অধিকন্তু প্রতিটি সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের পদাধিকারীরা ভোক্তা তথা জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। ঢাকা ওয়াসা আইনের তোয়াক্কা করছে না, বিষয়টি দুঃখজনক। ঢাকা ওয়াসার পানি বিপজ্জনক মাত্রায় দূষিত, যা মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।

ফুটিয়ে বা অন্য উপায়ে বিশুদ্ধ না করলে এ পানি পানযোগ্য হয় না। ওয়াসার পানিতে কাদা-ময়লা, শ্যাওলা তো থাকেই, মাঝে মাঝে কীট-কেঁচোরও দেখা মেলে। তাই পানির দাম বাড়ানোর আগে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের উচিত ভেবে দেখা কী মানের পানি গ্রাহককে দিচ্ছে তারা।

একতরফাভাবে গ্রাহকের মতামত ছাড়া পানির দাম বাড়ানো ভোক্তা সংরক্ষণ আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ভোক্তা অধিকার আইন ২০০৯ অনুসারে, পানির দাম বাড়াতে হলে ওয়াসাকে অবশ্যই ভোক্তাদের মতামত নিতে হবে।

গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে গণশুনানির ব্যবস্থা আছে, কিন্তু ওয়াসা সে বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তাই ওয়াসার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা উচিত।

সরকার এমন একসময়ে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়াল, যখন চাল, চিনি, ভোজ্যতেল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ভোগ্যপণ্য ও সেবা সার্ভিসের দাম বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব ইতিমধ্যে দেশের অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে।

বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়লে সে প্রভাব আরও প্রকট হবে। সরকার বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়িয়ে শিল্প গ্রাহকদের কাছ থেকে যে বাড়তি অর্থ পাবে, তা শিল্পের মালিকরা কি নিজেদের পকেট থেকে দেবে? তারা তাদের উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের পকেট থেকে তা সুদে-আসলে উশুল করবেন।

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে শেষ বিচারে ভোক্তাদের ওপরই সবকিছুর আর্থিক চাপ বাড়বে, বিপুলসংখ্যক সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান আরও কমে যাবে। বিদ্যুৎ ও পানির দাম না বাড়িয়ে ওই দুটি খাতে যে বিপুল অপচয়, অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে হরিলুট চলছে, তা বন্ধ করতে কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে।

জনগণের করের অর্থে পরিচালিত সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের পদাধিকারীদের ব্যর্থতা, অদক্ষতা, অনিয়ম ও অপচয়ের দায় জনগণের ওপর চাপানো ঠিক হবে না। এছাড়া সরকারি দফতরগুলোর কার্যক্রম তদারকির জন্য গণশুনানির পাশাপাশি উন্নয়ন কার্যক্রম ও প্রকল্পের মান যাচাই ও সেবার মান নিশ্চিতে নাগরিক পরিবীক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করা ছাড়া জাতির পিতার নির্দেশিত তৃণমূলে জনসেবা নিশ্চিত যেমন কঠিন হবে, তেমনি সরকারি দফতরের অদক্ষতা, অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করা শুধু কঠিন নয়, স্বপ্ন হয়ে থাকবে।

আর জনগণ শুধু করের বোঝা টানবে না, সবকিছুর দায়ভারও তাদের বহন করতে হবে, যা জাতির পিতার স্বপ্নের পরিপন্থী। তাই আমরা আশা করি, সরকার মুজিববর্ষের চেতনা বাস্তবায়নে ভোক্তা অধিকার সুরক্ষায় পানি, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা থেকে সরে আসবে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ও সেবা জনগণের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখতে কার্যকর উদ্যোগ নেবে।

বিদ্যুৎ ও ওয়াসার মতো সরকারি অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কোনোভাবেই জনমত ও ভোক্তা অধিকার আইনকে উপেক্ষা করতে পারে না। কারণ জনগণের করের টাকায় তাদের বেতন-ভাতা দেয়া হয়।

জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে ‘ঋণ ও ভর্তুকিনির্ভরশীল উন্নয়ন নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ, প্রকল্প বাজেট বারবার সংশোধন করে বিপুল অর্থ লুটপাট করে আবার সেই অর্থের দায় গ্রাহকদের ওপর চাপিয়ে পানির দাম বাড়ানোর খোঁড়া যুক্তি প্রদর্শন কোনোভাবেই কাম্য নয়।

অন্যদিকে অপচয় রোধ, বিতরণ ও সরবরাহ লাইনে ত্রুটি, লিকেজ, চুরি বন্ধ, সিস্টেম লস বন্ধ, বিলিং ব্যবস্থার ত্রুটি দূর করে সেবা সার্ভিসের অব্যবস্থাপনা রোধে গ্রাহকদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি, গ্রাহক সেবার মান বাড়ানো এবং অনিয়ম রোধে ত্রিপাক্ষিক গণশুনানির আয়োজন করা, উন্নয়ন প্রকল্পের নাগরিক পরিবীক্ষণ নিশ্চিত করা, গ্রাহক হয়রানি রোধে তাৎক্ষণিক প্রতিকারের জন্য ডিজিটাল হেল্পলাইন চালু ও হেল্পডেস্ক আধুনিকায়ন, সেবার মানোন্নয়নে নীতিমালা প্রণয়নে ভোক্তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলেই এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

  • এসএম নাজের হোসাইন : ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
  • কার্টসি - যুগান্তর/ মার্চ ৩, ২০২০ 

বিদ্যুৎ-পানির বাড়তি দাম মূল্যস্ফীতি উসকে দেবে

আবদুল লতিফ মন্ডল

চলতি বছরের শুরু থেকেই খাদ্যসহ খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সদ্যসমাপ্ত আমন মৌসুমের শুরুতেই আমাদের প্রধান খাদ্য চালের মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা দেখা দিলেও জানুয়ারি মাসের শেষদিকে সরকার সব ধরনের চাল রফতানির অনুমতি দেয়ায় বাজারে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে।

গত কয়েক মাস ধরে পেঁয়াজের নজিরবিহীন উচ্চমূল্যের কারণে পণ্যটি গরিব ও নিম্নবিত্তের অনেকটা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। বেড়েছে চিনি, আদা, রসুনসহ সব ধরনের মসলার দাম। এর সঙ্গে যোগ হল বিদ্যুৎ ও পানির মূল্যবৃদ্ধি। চলতি মার্চ থেকে বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি ৩৬ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি দাম দিতে হবে গ্রাহকদের।

অন্যদিকে ঢাকা ওয়াসার সরবরাহকৃত প্রতি হাজার লিটার আবাসিক পানির দাম ১১ টাকা ৫৭ পয়সার স্থলে ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রতি হাজার লিটার আবাসিক পানির দাম ৯ টাকা ৯২ পয়সার স্থলে ১২ টাকা ৪০ পয়সা করা হয়েছে। চাল, চিনি, পেঁয়াজ, আদা, রসুনের মূল্যবৃদ্ধি একটি পরিবারের মাসিক সংসার খরচ বাড়ানোয় সীমাবদ্ধ থাকলেও, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি দেশের পুরো উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলবে।

বাড়বে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত সব ধরনের পণ্যের দাম। ফলে বাড়বে সার্বিক মূল্যস্ফীতি, যা বেশ কয়েক মাস পর ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে। মূল্যস্ফীতি সব সময় মানুষের কাছে ভীতিকর, কারণ এতে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, পহেলা মার্চ থেকে কার্যকর বিদ্যুতের নতুন মূল্য অনুযায়ী, আবাসিক খাতে লাইফলাইন ০-৫০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারীদের ইউনিটপ্রতি দাম হবে ৩ দশমিক ৭৫ টাকা।

আগে ছিল ৩ দশমিক ৫০ টাকা। প্রথম ধাপে ০-৭৫ ইউনিট পর্যন্ত নতুন দাম হবে ৪ দশমিক ১৯ টাকা, যা আগে ছিল ৪ টাকা। দ্বিতীয় ধাপে ৭৬-২০০ ইউনিট পর্যন্ত দাম বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫ টাকা ৭২ পয়সা, যা আগে ছিল ৫ টাকা ৪৫ পয়সা। তৃতীয় ধাপে ২০১-৩০০ পর্যন্ত নতুন দর ৬ টাকা।

আগে এ হার ছিল ৫ দশমিক ৭০ টাকা। চতুর্থ ধাপে ৩০১-৪০০ পর্যন্ত ৬ দশমিক ৩৪ টাকা। আগে এ হার ছিল ৬ টাকা ০২ পয়সা। পঞ্চম ধাপে ৪০১-৬০০ ইউনিট পর্যন্ত ৯ দশমিক ৯৪ টাকা। আগের দাম ছিল ৯ টাকা ৩০ পয়সা এবং ষষ্ঠ ধাপে ৬০০ ইউনিটের বেশি ব্যবহারকারীকে ইউনিটপ্রতি ১১ দশমিক ৪৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগে ছিল ১০ টাকা ৭০ পয়সা। এ দামের সঙ্গে যুক্ত হবে ভ্যাট।

আবাসিক খাত ছাড়া অন্যান্য খাতেও বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। সেচ-কৃষিকাজে ব্যবহৃত পাম্পের ক্ষেত্রে সব বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির জন্য ইউনিটপ্রতি দাম ৪ দশমিক ১৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগে এ দাম ছিল ইউনিটপ্রতি চার টাকা। এ ছাড়া মাসিক ডিমান্ড চার্জ ১৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। এরও আগে কৃষিকাজে ব্যবহৃত সেচ পাম্প ব্যবহারকারী পিডিবি, ডিপিডিসি, ডেসকো ও ওজোপাডিকোর এবং আরইবি ও পবিস গ্রাহকরা ৩ টাকা ৮২ পয়সা পরিশোধ করতেন। নতুন মূল্যহার অনুযায়ী কৃষিতে ব্যবহৃত সেচে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ইউনিটপ্রতি ১৬ পয়সা।

ক্ষুদ্র শিল্পে ফ্ল্যাট রেট করা হয়েছে ইউনিটপ্রতি ৮ দশমিক ৫৩ টাকা। অপরদিকে অফ-পিক সময়ে ইউনিটপ্রতি ৭ দশমিক ৬৮ টাকা। আর পিক আওয়ারে এর হার হবে ১০ দশমিক ২৪ টাকা। বাণিজ্যিক ও অফিস গ্রাহকদের জন্য ফ্ল্যাট রেট ইউনিটপ্রতি ৯ টাকা ০২ পয়সা, অফ-পিক সময়ে ৮ টাকা ১২ পয়সা এবং পিক সময়ে ১১ টাকা ২৮ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। ডিমান্ড চার্জ ৬০ টাকা।

শিল্প গ্রাহকের জন্য ফ্ল্যাট রেট ইউনিটপ্রতি ৮ টাকা ৪৫ পয়সা, অফ-পিক সময়ে ৭ টাকা ৬১ পয়সা এবং পিক সময়ে ১০ টাকা ৫৬ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। ডিমান্ড চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০ টাকা।

নির্মাণ গ্রাহকদের জন্য ফ্ল্যাট রেট ইউনিটপ্রতি ১০ টাকা ৬০, অফ-পিক সময়ে ৯ টাকা ৫৪ এবং পিক সময়ে ১৩ টাকা ২৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। মাসিক ডিমান্ড চার্জ ৬০ টাকা। অতি উচ্চচাপ বা ১৩২ কেভি এবং ২৩০ কেভি লাইন ব্যবহারকারী গ্রাহকদের ক্ষেত্রে সাধারণ-১ (২০ মেগাওয়াট থেকে ১৪০ মেগাওয়াট পর্যন্ত ব্যবহারকারী)-এর ফ্ল্যাট রেট ইউনিটপ্রতি ৮ টাকা ৩৬ পয়সা, অফ-পিকে ৭ টাকা ৫২ পয়সা এবং পিক সময়ে ১০ টাকা ৪৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। সাধারণ-২ (১৪০ মেগাওয়াটের বেশি)-এর ক্ষেত্রে ফ্ল্যাট রেট ইউনিটপ্রতি ৮ টাকা ৩০ পয়সা, অফ-পিকে ৭ টাকা ৪৮ পয়সা এবং পিক সময়ে ১০ টাকা ৩৯ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রে ডিমান্ড চার্জ ৬০ টাকা।

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান নানা ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধিকে কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, আমদানি করা কয়লার ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট ধার্য করা হয়েছে, প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের ওপর ১০ পয়সা করে ডিমান্ড চার্জ আরোপ করা হয়েছে, অবচয় ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ বেড়েছে, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোকে তুলনামূলক কম মূল্যে অধিক পরিমাণ বিদ্যুৎ দেয়া হচ্ছে, অর্থাৎ সাধারণ জনগণের কাছে কম দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে, এক্সপোর্ট ক্রেডিট এজেন্সির অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোয় ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে এই কারণগুলোর ভূমিকা ছিল।

ক্ষমতাসীন সরকারি দল আওয়ামী লাগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিদ্যুৎ ও পানির ‘সামান্য মূল্যবৃদ্ধিতে’ জনগণের ভোগান্তি হবে না। অন্যদিকে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, ভোক্তা সংগঠনসহ অনেকে।

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েছেন মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, বিদ্যুতের এ মূল্যবৃদ্ধিতে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।

জাতীয় সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের বলেছেন, হঠাৎ করে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানো হচ্ছে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। এমনিতেই দেশের মানুষ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে দিশেহারা, তাই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি।

বিদ্যুৎ ও পানির মূল্যবৃদ্ধি না করে বিষয়টি আবার বিবেচনা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বিদ্যুতের দাম বাড়ার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে সিপিবি, বাসদ, গণসংহতি আন্দোলনসহ আটটি বাম দলের সমন্বয়ে গঠিত বাম গণতান্ত্রিক জোট। জোটটি বলেছে, সরকারের ভুল নীতি, দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হচ্ছে। খেলাফত মজলিসও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে।

বিদ্যুতের দাম বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ইতিমধ্যে পোশাক শিল্প খাত ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। দেশের শীর্ষ পণ্য রফতানির পোশাক শিল্প যে কোনো সময়ের চেয়ে চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে ১ হাজার ৯০৬ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করা হয়েছে।

এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ কম। এর মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় খাতটি আরও নাজুক পরিস্থিতিতে পড়বে। বিদ্যুতের দাম বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিকে ‘অযৌক্তিক’ বলে আখ্যা দিয়েছে। সংগঠনটির জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেছেন, আবাসিক বা শিল্প খাতে কোনো পর্যায়ের ভোক্তার জন্যই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই। বিদ্যুৎ খাতে ‘অযৌক্তিক’ ব্যয় না কমিয়ে সরকার জনগণের ব্যয়ভার বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, ভোক্তা যে মানের বিদ্যুৎ পায়, এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মূল্য পুনর্নির্ধারণ হোক।

তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি বলেছে, বিইআরসির গণশুনানিতে যুক্তি ও তথ্যে প্রমাণিত হয়েছে, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নয় বরং কমানো উচিত। দাম বাড়ানোর পেছনে গ্যাস-সংকটের কারণে তেলনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির কথাকে অসত্য বলে আখ্যায়িত করেছে এ কমিটি।

প্রশ্ন উঠতে পারে, বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে দাম অপরিবর্তিত রাখার বিকল্প উপায় ছিল কি না। বিইআরসি অবচয় ব্যয় বৃদ্ধিকে বিদ্যুতের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের নিজস্ব ব্যবহারসহ যন্ত্রপাতির অবচয়, পরিবহন তারের রেজিস্ট্যান্সজনিত অবচয় এবং অন্যান্য কারিগরি-অকারিগরি অবচয়ের কারণে সামগ্রিক বিদ্যুৎ শক্তির অবচয় হয়। এটাকে বলা হয় সিস্টেম লস।

সত্তর ও আশির দশকে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘ সময় কর্মরত থাকাকালে বিদ্যুতের সিস্টেম লসের যে অবস্থা দেখেছি, সে অবস্থার পরিবর্তন হলেও আশাব্যঞ্জক উন্নতি হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৯ থেকে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিতরণ খাতে সিস্টেম লসের পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। আর সঞ্চালন ও বিতরণ মিলে লস ছিল ১২ দশমিক ১৯ শতাংশ।

অনুরূপভাবে ২০১৭-১৮ এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিতরণ খাতে লসের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৬০ এবং ৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আর সঞ্চালন ও বিতরণ মিলে লসের পরিমাণ ছিল ১১ দশমিক ৮৭ ও ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সঞ্চালন ও বিতরণ মিলে লসের যে পরিমাণ ছিল, তার খুব সামান্য পরিমাণ ছিল সঞ্চালনে। বাকি পুরোটাই ছিল বিতরণে।

সহজ ভাষায় এটা ছিল চুরি। বিদ্যুতের বিতরণ বাবদ লস উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমানো গেলে মূল্যবৃদ্ধি পুরোপুরি না হলেও বহুলাংশে কমানো যেত।

প্রশ্ন উঠতে পারে, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে এত প্রতিবাদ হয় কেন? এটি এমন একটি পণ্য, যার মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব অর্থনীতির প্রায় সব খাতের ওপর পড়ে। এ ক্ষেত্রে উৎপাদন ও সেবা খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সার উৎপাদন ও সেচে ব্যবহৃত কৃষি পাম্পের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি সার্বিক কৃষি খাতের শস্য উপখাতে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি করে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে কৃষির অন্যান্য উপখাতে, বিশেষ করে ফিশ ফিড উৎপাদনে ও মৎস্য চাষে ব্যয় বাড়ে।

এতে দেশে প্রোটিনের প্রধান উৎস মাছের দাম বাড়ে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে শিল্প উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। অনেক রুগ্ন শিল্প বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে বেকারের সংখ্যা আরও বাড়বে। এমনিতেই বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের কারণে দেশের বর্ধিষ্ণু সেবা খাত অনেকটা বিপর্যস্ত। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে এ খাতটির পক্ষে টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়বে।

বর্তমান সরকার তার একটানা দীর্ঘ এগারো বছরের শাসনামলে একাধিকবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। সরকারের উচিত হবে দাম না বাড়িয়ে বিদ্যুতের সিস্টেম লস উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনা। এটি সম্ভব। বিশ্বের অনেক দেশ এটি সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। এটি করা গেলে আমাদের উন্নয়ন কার্যক্রম, বিশেষ করে উৎপাদন খাত ও সেবা খাতের উন্নয়নের গতি বেগবান হবে।

  • আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
  • কার্টসি - যুগান্তর/ মার্চ ৪, ২০২০ 

করোনার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি কী

জিয়া হাসান

জিয়া হাসান
প্রাথমিক দিনগুলোতে চায়নার হুবেই প্রদেশে সীমাবদ্ধ থাকলেও, গত কয়েক সপ্তাহে নভেল করোনাভাইরাস কভিড-১৯ বিশ্বের ৫৪টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে। চীনের বাইরে সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি ও ইরানে। ইতালির লম্বারডি প্রশাসনিক এলাকায় ৮২১ জন রোগী আক্রান্ত হয়েছে, যার মধ্যে গত শুক্রবার পর্যন্ত ২১ জন মৃত্যুবরণ করেছে। সরকারের বয়ানে ৩৫ জনের মৃত্যুর কথা বলা হলেও বিবিসি পারসিয়া হসপিটালের তথ্যের ভিত্তিতে ইরানে অন্তত ২১০ জনের মৃত্যুর দাবি করেছে। ইরানের একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট, একজন উপমন্ত্রী এবং দুজন এমপি নভেল করোনায় আক্রান্ত। মঙ্গোলিয়ার প্রেসিডেন্টও আক্রান্ত। জাপানের উপকূলে মার্কিন প্রমোদতরীতে ৫০০ জনেরও বেশি আক্রান্ত হয়েছে। জাপান সরকার এই ক্রুজ শিপে ভাইরাস প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে যথেষ্ট পেশাদারিত্ব দেখাতে পারেনি বলে শিনজো আবের সরকার সমালোচিত হচ্ছে। সিঙ্গাপুরে দুজন বাংলাদেশি শ্রমিক করোনাভাইরাসে আক্রান্তের খবর এসেছে। বিশ্বজুড়ে ৮০ হাজারের ওপরে সংক্রমণের মধ্যে, ২ হাজার ৮০০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। 


প্রতিদিন নিত্যনতুন দেশ ও এলাকায় ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়া এবং মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়েই মনে হচ্ছিল, করোনাভাইরাস চায়না এবং তার পাশের অঞ্চলে সীমিত থাকবে। কিন্তু, ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ নাগাদ সেই আশা সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে এবং এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কবে থামবে ও এর প্রাদুর্ভাবে বর্তমান বিশ্বায়িত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যে ক্ষতি হবে, তা কত গভীর হবে, এর ভবিষ্যদ্বাণী কারও পক্ষেই করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় বিগত সপ্তাহে, বিশ্ব জুড়ে স্টক মার্কেটগুলো ২০০৮ সালের ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিসের পর সবচেয়ে ভয়াবহ পতনের সম্মুখীন হয়েছে। মুডিজ এনালিটিকস ২০২০-এর প্রথমার্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাস দিয়েছে। এমতাবস্থায় কভিড-১৯ নভেল করোনাভাইরাসের আর্থিক প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে বাধ্য।

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাব নিয়ে একটি রিপোর্ট জমা দিয়েছে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত একটি সংবাদ সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি, এই রিপোর্টে চীনের ওপর বাংলাদেশের বাণিজ্যিক নির্ভরশীলতা এবং পোশাকশিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ঝুঁকির বিষয়টি প্রধান ঝুঁকি হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে ব্যবহৃত কাপড়ের ৬০ শতাংশ, নিটওয়্যার-শিল্পের কাঁচামাল ও এক্সেসরিজের ৮৫ শতাংশ, ডাইং কেমিক্যালের ৮৫ শতাংশ কাঁচামাল, প্রিন্টিং প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজের ৪০ শতাংশ কাঁচামাল, পোশাকশিল্পের এক্সেসরিজের ৪০ শতাংশ চীন থেকে আমদানি করা হয়ে। পোশাকশিল্পের স্টেকহোল্ডারদের বয়ানে এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি ঝুঁকির মুখে পড়লে সামগ্রিকভাবে ১৫ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির আশঙ্কা আছে, যা আমাদের মোট রপ্তানির ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ।

অভ্যন্তরীণ শিল্পের প্রভাবের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, চীন থেকে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৭৫০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ২০০ কনটেইনার কসমেটিক ও টয়লেট্রিজ, ২৫ কনটেইনার মেডিকেল ইন্সট্রুমেন্ট, ওষুধের কাঁচামাল ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার প্রিন্টিং প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রির কাঁচামাল, চোখের চিকিৎসার ৯৫ শতাংশ কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আনা হয়। করোনাভাইরাসের কারণে এই আমদানি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি, স্থিতিশীলতা ও সামাজিক নিরাপত্তা বহুমাত্রিক হুমকির মুখে পড়বে। চীনের কাঁচামালের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের টেলিভিশন-রেফ্রিজারেটর-মোবাইল ফোনসহ বেশ কিছু ‘সংযোজন শিল্প’ গড়ে উঠেছে। কাঁচামাল সরবরাহ ব্যাহত হলে এই শিল্পগুলোও হুমকির মুখে পড়বে। এই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের বড় খাত প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রির মোল্ডিং প্রিন্টিং এবং এক্সট্রুশনের যন্ত্রপাতি ও খুচরা সাপ্লাই, সব ধরনের শিল্পের মেশিনারি ও স্পেয়ার পার্টসের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ চীন থেকে আসে। স্পেয়ার পার্টসের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে এই শিল্পগুলো চলমান রাখা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এই আশঙ্কাও ওই রিপোর্টে করা হয়েছে। রপ্তানি ঝুঁকির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পাটশিল্পের স্পিনিং মিলগুলোর উৎপাদিত পণ্যের বড় একটি অংশ চীনে রপ্তানি করা হয়। ওই শিল্পে বর্তমানে নতুন অর্ডার বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশের ফিনিশড লেদার গুডস ও কাঁচা চামড়ার ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ চীনে রপ্তানি করা হয়। ওই সেক্টরে ৩০ বিলিয়ন টাকা ক্ষতির আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে।

করোনাভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কাঁকড়াচাষিরা। খুলনা ও বাগেরহাটে চিংড়ির বদলে কাঁকড়া চাষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠার মূল কারণ চীনের চাহিদা। প্রায় তিন থেকে চার হাজার কাঁকড়াচাষি তাদের পুঁজি হারিয়ে ফেলেছেন। কারণ গত ২৫ জানুয়ারি থেকে এই শিল্পে নতুন কোনো রপ্তানি হয়নি। ট্যারিফ কমিশনের রিপোর্টে শিকার করা হয়েছে, কাঁকড়া ও ইল মাছের শিল্পে ক্ষতির পরিমাণ ৪০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। মাত্র গত সপ্তাহে দেওয়া হলেও, ট্যারিফ কমিশনের এই রিপোর্টটির পূর্ণ ভাবনা চীন ও পাশের এলাকায় সাপ্লাই চেইনের হুমকি এবং চীনের রপ্তানি হুমকিকেন্দ্রিক। এই হুমকিগুলো চিহ্নিত করার জন্য ট্যারিফ কমিশন অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার; কিন্তু এই রিপোর্ট আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকির বিষয়ে আলোকপাত করা হয়নি। তা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বমন্দার ঝুঁকি, যার ফলে বাংলাদেশ বহুমাত্রিক ঝুঁকিতে পড়বে। আমেরিকা-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ, বিভিন্ন দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ পরিমাণ অভ্যন্তরীণ ঋণ এবং বৈদেশিক ঋণ, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পরিবেশ বিপর্যয়, মুক্তবাণিজ্য-বিমুখ অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর দুর্বল প্রবৃদ্ধিসহ বিবিধ কারণে বিশ্ববাণিজ্যের স্থিতিশীলতা ২০০৮-০৯-এর বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পর সবচেয়ে ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। কয়েক বছর ধরেই, জোসেফ স্টিগলিজ, রুচির শর্মাসহ বেশ কিছু অর্থনীতিবিদ একটি মন্দার আশঙ্কা করেছেন। ইউনাইটেড নেশনের ট্রেড ও ডেভেলপমেন্ট সংস্থা আঙ্কটাডের রিপোর্টে বলা হয়েছে ২০১৯ সালে বিশ্ববাণিজ্যে দশকের সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে কয়েক বছর ধরেই বিশ্বব্যাপী স্টক মার্কেট ফুলে-ফেঁপে উঠেছে, যার মধ্যে অনেকেই একটি বুদবুদ দেখতে পেয়েছেন। 

আশঙ্কার কারণ রয়েছে, নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এই আর্থিক বুদবুদ চুপসে যেতে পারে। নভেল করোনাভাইরাসের প্রাথমিক ধাক্কায় সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে বিশ্বজুড়ে ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের ট্রেড শো ইন্ডাস্ট্রি, ট্যুরিজম, এয়ারলাইনস, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, খেলাধুলা, কনসার্ট, মঞ্চনাটক, মিউজিকসহ বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি। বিশ্বজুড়ে রিটেইলাররা জানাচ্ছেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে তাদের ব্যবসা ২০২০ সালে কমে আসবে। এর মধ্যে ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতিটি হবে তৎক্ষণাৎ ও ভয়াবহ। কারণ ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে ট্যুরিস্টরা ভ্রমণ কমিয়ে দেবেন। এর ফলে ট্যুরিজমের ওপর নির্ভরশীল থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়ার অর্থনীতি সংকুচিত হবে। শুধু পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো নয়, দক্ষিণ আমেরিকা, ইতালি, ফ্রান্স, পর্তুগাল, ভূ-মধ্যসাগরের দেশগুলোর অর্থনীতি ট্যুরিজমের ওপর নির্ভরশীল। এমনকি বড় অর্থনীতির দেশ জাপান বা যুক্তরাষ্ট্রের রিটেইল ইন্ডাস্ট্রির বড় একটি অংশ ট্যুরিজম ও ট্যুরিস্টদের দ্বারা কেনাকাটা থেকে আসে। বিশেষত, চায়নার ধনী ট্যুরিস্টদের ওপর এসব অনেক দেশের অর্থনীতির নির্ভরশীলতা আছে। করোনাভাইরাসের কারণে হোটেল, এয়ারলাইনস, বিনোদন, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি নিঃসন্দেহে মন্দার মুখে পড়বে।

বিশ্বখ্যাত ফুটওয়ার কোম্পানি ক্রক ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, করোনা ভাইরাসের কারণে ২০২০ সালের আয় কমে আসবে। অন্যদিকে সাপ্লাই চেইনে প্রতিবন্ধকতার কারণে চীনের রপ্তানি যদি কমে আসে, তবে চীনের অভ্যন্তরীণ ভোগ বা কনজাম্পশনও কমে আসবে। নাইকি, লিভাইস, আইফোনসহ বিশ্বের মেগা সাইজের প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফার বড় একটি অংশ আসে চীন থেকে। বিশ্ব জিডিপিতে চীন ১৬ শতাংশ অবদান রাখে। তাই চীনের উৎপাদন যদি সংকুচিত হয়, তবে তা আবার বৃহৎ কোম্পানির উৎপাদন কমিয়ে আনবে। এর সবকিছু চক্রাকারে বিশ্বের শেয়ারবাজারগুলোকে হুমকির মুখে ফেলবে। ২০০৮-০৯-এর বিশ্বমন্দার প্রভাব কাটাতে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে, এর ফলে বিশ্বের অনেকগুলো দেশের অর্থনীতিতে ফিন্যান্সিয়ালাইজেশন বা আর্থিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। পেনশন ফান্ড, রিটায়ারমেন্ট ফান্ড, তেলের আয় থেকে তৈরি সভেরেইন ফান্ড, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদ্বৃত্ত আয় থেকে তৈরি বিশাল অঙ্কের ফান্ড যেমন নরওয়ে সরকারের পেনশন ফান্ড, চীনা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন, আবুধাবি ইনভেস্টমেন্ট অথরিটি, কুয়েত ইনভেস্টমেন্ট অথরিটিসহ ইত্যাদি ফান্ডের বড় অংশ স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ হয়েছে। ফলে যদি স্টক মার্কেট হুমকির মুখে পড়ে, তবে এই ফান্ডগুলো চক্রাকারে ওই ফান্ডগুলোর মূলধনের জোগানদাতা পেনশনার, বড় পুঁজিপতি, সরকারসহ সবার আয় ও পুঁজি উভয়কেই সংকুচিত করবে। ফলে তাদের খরচ করার প্রবণতা কমে আসবে। এর ফলে নির্দ্বিধায় তাদের দেশে ভোগ ও আমদানি কমে আসবে, যার একটি প্রভাব অবধারিতভাবে আমাদের পোশাকশিল্পে পড়বে। এমনকি ওই দেশগুলোতে আয় কমে যাওয়ার কারণে চাকরি ছাঁটাইসহ বিভিন্ন প্রবণতায় রেমিট্যান্সের পরিমাণও কমে আসতে পারে। 

ট্যারিফ কমিশনের রিপোর্টে পাট, চামড়া ও কাঁকড়াশিল্পে বিপর্যয়ের যে আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে, তা ভবিষ্যতের নয়, সেসব এখনই ঘটছে। খুলনার কাঁকড়াশিল্পের বিপর্যয়ের কারণে ইতিমধ্যেই হাজার হাজার পরিবারে বিপর্যয় নেমে এসেছে, যাদের সুরক্ষার জন্য ন্যূনতম কোনো ব্যবস্থা সরকার নেয় নেই এবং সরকারের নিস্পৃহতা নিয়ে নাগরিকদের মধ্যেও তেমন কোনো আলোড়ন দেখা যায়নি। রাজনীতি নিয়ে আমাদের নিমগ্নতার কারণে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের ইস্যুগুলো আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, করোনাভাইরাসের প্রভাব বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই আঘাত করেছে এবং বিশ্ব যদি একটি মন্দার মুখে পড়ে জটিল বহুমাত্রিক হুমকির মুখে পড়বে, বাংলাদেশের অর্থনীতি, জীবন-জীবিকা এবং সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, এই সম্ভাব্য মন্দা কবে শেষ হবে এবং এর চূড়ান্ত পরিণতি কী হবে, তা কেউ বলতে পারে না। ২০০৮ সালে বিশ্বমন্দা বাংলাদেশ সফলভাবে মোকাবিলা করেছিল। এই সফলতার মূলে ছিল, মন্দার আগের ৩০ বছরে তৈরি আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ। কিন্তু সেই সক্ষমতাগুলো অনেকটুকুই এখন কমে এসেছে এবং বিবিধ কারণে আমাদের ব্যাংকব্যবস্থা ও আর্থিক ব্যবস্থাও ঝুঁকির মুখে।

এ অবস্থায় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা সামাল দিতে বাংলাদেশ সরকারের হাতে দুটি পথ আছে। প্রথমটি হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক সব ধরনের উদ্যোগকে সমন্বিত করে এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া। অথবা খুলনার কাঁকড়াচাষিদের ক্ষতির মতো সম্পূর্ণভাবে বিষয়টি উপেক্ষা করে যাওয়া এবং ধরে নেওয়া যে কিছু না হলেও কোনো না কোনোভাবে সবকিছু ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে এমন ভাবতে থাকা। কোন পথটি সরকার বেছে নেয়, তার ওপর নির্ভর করবে এই দুর্যোগের প্রভাব জনজীবনে কী ধরনের পড়বে।

  • লেখক-প্রাবন্ধিক ও স্বাধীন গবেষক
  • কার্টসি - দেশ রুপান্তর / মার্চ ৪, ২০২০ 

Monday, March 2, 2020

‘ইতিহাসের নতুন অধ্যায়, ভোট থাকবে, ভোটার থাকবে না’

তামান্না মোমিন খান

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ভোট দিতে না পারাটা  যদি ভোটারের ব্যর্থতা হয় তাহলে নির্বাচন কমিশন সফল কিনা- এটাই একটা প্রশ্ন। নির্বাচন কমিশন সেটাই বলুক।

আজ ভোটার দিবস পালনকালে নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম ভোট দিতে না পারাটা ভোটারদের ব্যর্থতা বলে মন্তব্য করেন। এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে ড. তোফায়েল আহমেদ এ কথা বলেন।   
ড. তোফায়েল আহমেদ

তোফায়েল আহমেদ বলেন, ভোটার দিবসের স্বার্থকতা কি? এ দিবসটা কে পালন করছে? নির্বাচন কমিশন পালন করছে, জনগণ তো করছে না। এখানে তো জনগণের কোন অংশগ্রহণ নেই। এটাকে ভোটার দিবস বলা ঠিক হয়নি। নির্বাচন কমিশন দিবস হওয়া উচিৎ ছিলো বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, ভোটার দিবস হলে সেটা ভোটাররা পালন করবে।

এখন যে যার মত চলছে, নির্বাচন কমিশন বলছে তারা সফল, সরকার তার সিদ্ধান্তের কথা বলছে। নির্বাচনে ভোটার আসলো কিনা তা নিয়ে কারো   কনসার্ন নেই। এভাবেই চলছে, এভাবেই চলবে। এটা ইতিহসের একটা নতুন অধ্যায় যেখানে ভোট থাকবে, নির্বাচন কমিশন থাকবে, নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকবে কিন্তু ভোটার থাকবে না।

  • কার্টসি - মানবজমিন/ মার্চ ০২, ২০২০

Sunday, March 1, 2020

চিঁড়েচ্যাপ্টা মধ্যবিত্ত

মরিয়ম চম্পা

রাজধানীর ফার্মগেটের রাজাবাজার এলাকায় এক কক্ষের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন। ব্যবসা থেকে যা আয় হয় তার একটি অংশ দিয়ে নিজের খরচ মেটান। কিছু টাকা বাড়ি পাঠান পরিবারের জন্য। জামাল বলেন, বছরের শুরুতে একবার বাসা ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এখন বিদ্যুৎ এবং পানির দাম বাড়ায় আবার ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দিয়েছে বাড়িওয়ালা। এমনিতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এভাবে সব বাড়তে থাকলে নিজের আয়ে নিজেই চলতে পারব না। পরিবারকে দেখাশোনা করবো কীভাবে? শুধু জামাল উদ্দিনই নন, এমন ত্রাহি অবস্থায় রাজধানীর মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ।

রাত পোহালেই ব্যয় বাড়ে। চাল-পিয়াজের  বাজারে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। এমন অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির দাম বাড়ছে দফায় দফায়। সব মিলিয়ে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের টালি মিলাতে পারছেন না অনেক মানুষ। এতে সাধারণ মানুষের অনেককে ব্যয় কমাতে হচ্ছে। কমাতে হচ্ছে অতি প্রয়োজনীয় চাহিদাও।

রাজধানীর পল্লবীতে দুই সন্তান নিয়ে থাকেন মাহফুজুর রহমান। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মাসে ৩৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। দুই বেড় রুমের বাসা ভাড়া দেন ১২ হাজার টাকা। বাকি টাকায় দুই সন্তানের স্কুলের খচর, মাসের বাজার এবং নিজের মতিঝিলের অফিসে যাতায়াতের খরচ মেটাতে গিয়ে হিমশিম অবস্থা। এই চাকরিজীবী বলেন, এখন যেভাবে চলছি এটা জীবন না। দুই বছর ধরে অফিস কোন বেতন বাড়ায়নি। বলছে ব্যবসার অবস্থা ভাল না। কিন্তু দুই বছরে দুইবার বাসা ভাড়া বেড়েছে। গ্যাসের দাম, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। এবার পানির দামও বাড়লো। চাল, ডাল, পিয়াজসহ নিত্য পন্যের দাম বেড়েই চলছে। বছর শেষে ছেলে-মেয়ের স্কুল থেকে বেতন বাড়ানোর নোটিশ আসে। এতো বৃদ্ধির মধ্যে বেঁচে থাকাই দায়।

পরিস্থিতি আরও জটিল পান্থপথ সিগন্যালে চা বিক্রেতা সবুজের জন্য। তিনি বলেন, বউ বাচ্চা নিয়ে একটি বস্তিতে সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে থাকি। আমরা যারা ছোট ব্যবসা করি তাদের সমস্যা আরো বেশি। আমাদের বেশিরভাগ কাস্টমার রিকশাওয়ালা ও ছোটখাট চাকরিজীবী। পকেটে টাকা না থাকলে তারা কি দোকানে চা খেতে আসবে। পেয়াজ খাওয়াতো ছেড়েছি সেই কবেই। মাছ-মাংস ১৫ দিনে একবার খাওয়া হয়। যেভাবে সব কিছুর দাম বাড়ছে তাতে টিকে থাকাই কষ্টকর।

আয়-ব্যায়ের জটিল এই পরিস্থিতির মধ্যেই পানি ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে চাপে পড়বেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি মানবজমিনকে বলেন, এটার বিরূপ প্রভাবে সব কিছুর দাম বাড়বে। এটাতো নতুন কিছু না। বিদ্যুৎ যে সকল স্থানে ব্যবহৃত হয় সে সকল স্থানে পণ্যের দাম, বাসা ভাড়া, জীবন যাত্রার ব্যয় বাড়বে। বিদ্যুতের জন্য একদিকে যেমন বেশি বিল দিতে হবে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ থেকে উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়বে। যারা বিদ্যুৎ ব্যবহার করে না তাদেরকেও বাড়তি দামে জিনিসপত্র কিনতে হবে। এগুলো হঠাৎ করে হয়নি। আর এটা শুধু নিম্ন আয়ের বা নিন্মমধ্যবিত্তদের জন্য না উদ্যোক্তাদের জন্যও সমস্যা হবে। উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। ফলে তাদের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা কমবে। সরকারের বিদ্যুৎ খাত যে নকশা বা পরিকল্পনা দিয়ে চলছে সে নকশার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে এটা। এবং এটি এখানেই থামবে না। আরো বাড়বে। এবং বিদ্যুতের সঙ্গে দেশি বিদেশি অনেক ব্যবসায়ী জড়িত। তাদের মুনাফা বাড়ানোর জন্য এটি দরকার। পানির ক্ষেত্রেও তাই। দেশি বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যুক্ত হচ্ছে পানির সঙ্গে। তাদের মুনাফা বাড়াতেও এটি দরকার।

তেজতুড়ি বাজার এলাকার বাড়িওয়ালা এখানে আমার দুটি বাড়ি। এরমধ্যে একটিতে ছাত্রী হোস্টেল। যাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। এমনিতেই হোস্টেলগুলোতে ভাড়া আদায়ে নানান ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়। এখন নতুন করে পানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় আগামী মাসের হোস্টেল ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দিয়েছি। গতকাল অনেক ছাত্রী হোস্টেল ছাড়ার আবেদন করেছে। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে পানির দাম বাড়ানো হয়েছে। সরকার তাদের প্রকল্পের চুরি বন্ধ করতে পারে না, এর দায় চাপে আমাদের ওপর। আমরা কোথায় যাব। সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এর ফলে জীবন যাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। কারণ, বিদ্যুৎ ও পানি প্রায় সকল উৎপাদনের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। এগুলোর প্রভাব পরবে দ্রব্যমূল্যে। এর বিরূপ প্রভাবতো সমাজের সাধারণ মানুষের উপর পড়বেই। এগুলো করা হচ্ছে মূলত এরসঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যপক দুর্নীতি ও অনিয়মের দায় সাধারণ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দিতে। যেটা কোনোভাবেই কাঙ্খিত এবং গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে কোনো কথা বলে লাভ নেই। তারপরও আমরা কথা বলছি। অবস্থা এমন হয়ে গেছে যে ক্ষমতাসীনরা কারো প্রতি কর্নপাত করে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এটা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়াবে। কারণ আমাদের দেশের যে প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয় ৮ ভাগেরও বেশি যার সুফল ভোগ করে মাত্র শতকরা চার থেকে পাঁচভাগ লোক। এর নিচে যারা শতকরা ৯৫ ভাগ লোকের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। হলেও খুব সামান্য। কাজেই সাধারণ মানুষ খুব বেশি কষ্টে পড়বে। নিম্নবিত্ত তথা মধ্যেবিত্তদের পক্ষেও এই বাড়তি আয় যোগানো মুশকিল। কারণ তাদের আয় সত্যিকার অর্থে বাড়েনি। কাজেই এটা খুবই দুর্ভোগ বাড়াবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সরকার যে ভর্তুকি দিচ্ছে সেটা কমানোর জন্য দাম বাড়ানো হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হবে যে, ভর্তুকি দেয়া লাগছে কেন? বিদ্যুৎ চুরির জন্য। এই চুরিটা যদি ঠেকানো যায় তাহলে মানুষকে কষ্ট দিয়ে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হয় না। সে জন্য মনে হয় চুরির বিষয়টি দেখা উচিৎ।

  • কার্টসি - মানবজমিন/ মার্চ ১, ২০২০ 

মানুষের নাভিশ্বাস

কাওসার আজম

আবারো বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুৎ ও পানির দাম। সাধারণ চাকরিজীবী ও নিম্ন মধ্যবিত্তের আয় না বাড়লেও সরকার বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধি করায় বড় ধাক্কা লেগেছে নাগরিকদের জীবনযাত্রায়। অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করছেন বিদ্যুৎ-পানির দাম বৃদ্ধির ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে নাগরিক জীবনে।

করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতিতে যে ধাক্কা শুরু হয়েছে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধির ফলে তা বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে। দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি পাবে, মানুষের জীবন যাত্রা আরো ব্যয়বহুল হবে। সাধারণ মানুষ ও গরিব মানুষ আরো বেশি সমস্যার মধ্যে পড়বে। মানুষের নাভিশ্বাস হবে।

ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুৎ ও পানির দাম। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার প্রায় ১২ বছরে এ নিয়ে আটবার বিদ্যুতের দাম এবং ১৩ বার পানির দাম বৃদ্ধি করা হলো। বিদ্যুতের বর্ধিত দাম কার্যকর হচ্ছে চলতি মার্চ মাস থেকেই। গ্রাহকদের এখন থেকে বিদ্যুৎ বিল বাবদ ইউনিটপ্রতি ৩৬ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি দিতে হবে।

অন্য দিকে ঢাকা ওয়াসার পানির বর্ধিত দাম আগামী এপ্রিল মাস থেকে কার্যকর হবে। ওয়াসার সরবরাহকৃত প্রতি হাজার লিটার পানির দাম আবাসিকে ১১ টাকা ৫৭ পয়সার পরিবর্তে ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা, বাণিজ্যিকে প্রতি হাজার লিটার পানির দাম ৩৭ টাকা ৪ পয়সার পরিবর্তে ৪০ টাকা এবং চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রতি হাজার লিটার পানির দাম আবাসিকে ৯ টাকা ৯২ পয়সার পরিবর্তে ১২ টাকা ৪০ পয়সা এবং বাণিজ্যিকে প্রতি হাজার লিটার পানির দাম ২৭ টাকা ৫৬ পয়সার পরিবর্তে ৩০ টাকা ৩০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।

নতুন করে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদ, জ্বালানি ও সমাজ বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এমন একসময় বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানো হলো, যখন করোনাভাইরাসের কারণে এমনিতেই দেশের অর্থনীতি প্রায় স্থবির। চীন থেকে কাঁচামাল না আসায় বেশ কিছু শিল্পোদ্যোক্তা হাত গুটিয়ে আছেন। এ পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ ও পানির মূল্য বৃদ্ধি অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধির ফলে বিপাকে পড়বে সীমিত আয়ের মানুষ। তবে শুধু আবাসিক খাতেই নয়, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে শিল্প খাতেও। শিল্পে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেলে বাড়বে দ্রব্যমূল্যও। এর মাশুলও দিতে হবে সাধারণ ভোক্তাদেরই। এমনিতেই নির্দিষ্ট আয়ের বিভিন্ন পেশার মানুষের কষ্ট ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। এ অবস্থায় আবারো বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় তথা দুর্ভোগের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় বলা হয়, ঢাকা ওয়াসার সেবায় গ্রাহকদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি অসন্তুষ্ট। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে গত প্রায় ১২ বছরে ১৩ বার পানির দাম বেড়েছে। একই সময়ে পানির দাম প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সালে ঢাকায় আবাসিক গ্রাহকদের জন্য পানির দাম ছিল প্রতি ইউনিট (১ হাজার লিটার) ৫ টাকা ৭৫ পয়সা। দাম বাড়ানোর কারণে আগামী এপ্রিল থেকে তা হচ্ছে ২০ টাকা।

গবেষণায় আরো উল্লেখ আছে, ওয়াসার পানির নিম্নমানের কারণে ৯৩ শতাংশ গ্রাহক বিভিন্ন পদ্ধতিতে পানি পানের উপযোগী করে। এর মধ্যে ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে বা সেদ্ধ করে পান করে। অন্য দিকে সাধারণ নাগরিকরা বিভিন্ন সময়ে ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ, ময়লা থাকার অভিযোগ করে আসছে।

জানা যায়, ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এখন পর্যন্ত পাইকারি পর্যায়ে ছয়বার এবং খুচরা বা গ্রাহক পর্যায়ে আটবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের নভেম্বরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়।

সাধারণ গ্রাহকপর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। ফলে গ্রাহককে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য ৭ টাকা ১৩ পয়সা পরিশোধ করতে হবে। আগে প্রতি ইউনিটের দাম ছিল ৬ টাকা ৭৭ পয়সা। পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট গড়ে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। আগে প্রতি ইউনিটের দাম ছিল ৪ টাকা ৭৭ পয়সা। মার্চ থেকে প্রতি ইউনিটের দাম হবে ৫ টাকা ১৭ পয়সা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম নয়া দিগন্তকে বলেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি গণশুনানির মাধ্যমে করা হয়। ফলে বৃদ্ধির যৌক্তিকতা ন্যায্যতা, অসঙ্গতি পাবলিকলি বলা যায়। কিন্তু পানির ক্ষেত্রে সেটা বলা যায় না। কারণ পানির মূল্য বৃদ্ধি অনেকটাই করা হয় একতরফাভাবে। সেটা যৌক্তিক নয়, বরং ভোক্তা অধিকারপরিপন্থী। যে পানি বিক্রি করে (ওয়াসা) সেই যদি নিজে নিজেই দাম বৃদ্ধি করে তা হলে এটি অন্যায় ও অবিচারের শামিল। এতে ভোক্তা অধিকার খর্ব হচ্ছে।

বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অযৌক্তিক ব্যয় ধরে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হয়েছে। কোনোভাবেই এটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সঠিক হয়নি। ভোক্তা সঠিক দামে বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। সে কারণে ভোক্তার অধিকার খর্ব হয়েছে। এতে ভোক্তা ন্যায়বিচার পায়নি।

বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব প্রসঙ্গে এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, এ দু’টির বিল তো বাড়বেই। পাশাপাশি অন্যান্য পণ্যের দাম আরো বেশি বৃদ্ধি পাবে। এতে ১৭ কোটি মানুষের কত ব্যয় বাড়বে সে হিসাব কোথাও নেই। এর ফলে হয়তো সরকারের তিন হাজার কোটি টাকা মিলবে। কিন্তু এর ফলে সরকারের রাজস্ব কমবে, ভ্যাট ও কর কমবে। এতে সরকার কতটা রাজস্ব হারাবে আর ভোক্তার কত ব্যয় বাড়বে তার কোনো হিসাবই আমাদের কাছে নেই। তবে তা তিন হাজার কোটি টাকার চেয়ে অনেক বেশি বাড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধির ফলে মানুষের নাভিশ্বাস সৃষ্টি হবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে, মানুষের জীবনযাত্রা আরো ব্যয়বহুল হবে। সাধারণ মানুষ ও দরিদ্র মানুষ আরো বেশি সমস্যার মধ্যে পড়বে।

তিনি বলেন, বারবার বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। এটা আমরা বলে আসছি কিন্তু সরকার তো কারো কথা শোনে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, বারবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করে সরকার রেন্টাল-কুইক রেন্টালে চার্জ দিচ্ছে। বিদ্যুৎ না কিনেও সরকার সেখানে ভর্তুকি দিচ্ছে। এসব মানুষের ওপর চাপাচ্ছে।

তিনি বলেন, সরকারের উচিত ছিল এসব (রেন্টাল-কুইক রেন্টাল) মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর নবায়ন না করা। সরকারকে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল থেকে সরে এসে বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রে যাওয়া উচিত। যত দিন তাদের ভর্তুকি দেবে, বিদ্যুৎ না কিনলেও দিতে হবে, মুক্তি মিলবে না। আর ছোট বিদ্যুৎ প্ল্যান্টে খরচ বেশি। বড় প্রকল্পে যাওয়া উচিত, যেসব বন্ধ হয়ে পড়ে আছে (সরকারি) সেগুলো চালু করা জরুরি। পানির মিটার এখনো অটোমেটিক না। পানি ফিল্টারে হচ্ছে। অনেক জায়গায় পানির দামই ঠিকমতো দেয় না। ফলে গড়ে পানির খরচ পোষাচ্ছে না।

এ কারণে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধি অযৌক্তিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসবের দাম সরকার বাড়াতে পারে না। বরং সরকারের নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আনা উচিত।

কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে- জানতে চাইলে আবু আহমেদ বলেন, যাদের ইনকাম নেই তাদের বেশি সমস্যায় পড়তে হবে। আর যারা দেশের বড় বড় ধনী হয়ে গেছে, লুটপাটের সাথে জড়িত তাদের তো কিছুই হবে না। হবে তো সাধারণ মানুষের, যাদের আয় নেই।

  • কার্টসি - নয়াদিগন্ত/ মার্চ ১, ২০২০ 

টাকা চলে যাচ্ছে, কোনো অ্যাকশন দেখছি না

আলতাফ হোসাইন

দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা থমকে গেছে। চলমান ধারা থেকে অনেক দূর পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ। দেশীয় সমস্যা ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জগুলো মিলে বাংলাদেশ দোলাচলের মধ্যে আছে। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের জন্য অর্থনীতিতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলো দেশের মানুষের জীবন-মানের উন্নয়ন। কিন্তু সরকারকে মেট্রোরেল, পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্পগুলোর দিকে বেশি নজর দিতে দেখা যায়। তবে এসব উন্নয়ন প্রকল্পের আড়ালে যেমন দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষার সার্বিক উন্নয়ন, সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের প্রতি সরকারের দৃষ্টি কম। তেমনি মানুষের জীবন মানের উন্নয়নের সঙ্গে এসব উন্নয়ন প্রকল্পের সামঞ্জস্যতা নেই।

ফলে মানুষের মধ্যে দিনদিন বৈষম্য বাড়ছে, মানুষের জীবন যাত্রায় হতাশা বাড়ছে, কিন্তু তাদের জীবনমান বাড়ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সালেহউদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, বড় বড় গ্রোথ পার্সেন্ট এসবতো উন্নয়ন নয়। ৮ দশমিক ৪ সরকারের যে হিসেবগুলো করা হচ্ছে, এতে সঠিকভাবে মানুষের জীবন মানের উন্নয়নের বিষয়টি কিন্তু প্রকাশ করে না। মানুষের মধ্যে দিনদিন বৈষম্য বাড়ছে, মানুষের জীবন যাত্রায় হতাশা কাজ করছে, তাদের জীবন মান অপেক্ষাকৃত ভালো বাড়ছে না। কিছু কিছু মানুষ আপনি দেখতে পারছেন যে, ঢাকায় বসে অনেকে পশ্চিমাদের লাইফ লিড করছে, আবার অন্যদের দেখেন তাদের কোন উন্নতি হচ্ছে না। তাদের সন্তানদের স্কুলে দিয়ে ভালো শিক্ষার মান পাচ্ছে না। এরপর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে দেখেন, যেটা দিচ্ছেন সেটা শুধু নামে মাত্র, স্বাস্থ্যে বাংলাদেশের মানুষদের সব চেয়ে বেশি খরচ হয়। এটা অত্যন্ত কষ্টদায়ক ব্যাপার। এভাবে শিক্ষা, কর্মসংস্থান সবখানে একই অবস্থা। সরকার থেকে বলা হচ্ছে, আমরা করছি, কিন্তু কী করা হচ্ছে দৃশ্যমান নয়। আপনি শিক্ষিত তরুণদের জন্য কী করছেন? যারা বেকার, চাকরি পাচ্ছে না তাদের জন্য কী করা হচ্ছে? যারা ব্যবসা করতে চায় তারা ফান্ড পাচ্ছে না। শুধু সামাজিক নিরাপত্তার উদাহরণ দিচ্ছেন কিন্তু সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কোথায়? সেটাতো হচ্ছে না, হবেও না। কারণ, অসমতা বা অসামঞ্জস্যতার যে কারণটা সেটাতো আগে দূর করতে হবে। যেমন ব্যাংকের ঋণ সবার কাছে তো যাচ্ছে না কিছু লোকের কাছে যাচ্ছে। তারপর যারা ব্যবসা করছে কিছু লোক সুযোগ পাচ্ছেন অন্যরা পাচ্ছে না। এরপর স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল এগুলো যাদের রাজনৈতিক প্রভাব আছে তারা করছে। সুতরাং দিনদিন যে অসমতার অবস্থা তৈরি করছেন সেখানে হঠাৎ করে উপর থেকে সমস্যা সমাধান হবে না। স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, যেকোন টেকসই উন্নয়নের পূর্ব শর্ত হলো গণতন্ত্র এবং সুশাসন। এটা ছাড়া কোন উন্নয়ন উন্নয়নই নয়। সেটাকে আমরা টেকসই উন্নয়ন বলতে পারবো না। হতে পারে কিছু উন্নয়ন কিন্তু গণতন্ত্র ও সুশাসন ছাড়া সেটা টেকসই হয় না। যেমন আর্জেন্টিনা, তারা ভালো একটি দেশ ছিলো কিন্তু টিকতে পারেনি, ব্রাজিলেরও একই অবস্থা। এখন অনেকেই চায়নাকে উদাহরণ দেয়। তাদের গণতন্ত্র আবার অন্যরকম। তারা অন্যভাবে জনগনের অংশগ্রহণ নিচ্ছে। সেটাও দেখবেন বেশ সুবিধা হবে না, আল্টিমেটলি তাদের ওপরে প্রভাব আসবে হয়তো সেটা এখন দেখবেন না। এরপর রাশিয়ায় উন্নয়ন হচ্ছিলো তারপর টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। এখন পুতিন ধরে রেখেছে, শক্তিশালী দেশ বলা যায় কিন্তু সেটাকে উন্নত দেশে বলা যাবে না। অর্থাৎ গণতন্ত্র ও টেকসই উন্নয়ন, এবং সমতাভিত্তিক উন্নয়ন হলো সামঞ্জস্যপূর্ণ। একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মানুষের যদি সরকারের প্রতি বিশ্বাস না থাকে, গণতন্ত্র যদি না থাকে তবে যেকোন সরকারের ভালো ইচ্ছাও শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয় না, বিদ্রোহ দেখা যায়। একটা উদাহরণ হয়েছে প্যারিসে, সেখানে সামান্য ফুয়েলের ওপর টেক্স বাড়িয়েছে। এটা সে দেশের জন্য কিন্তু তেমন কিছু না। অথচ এতে সেখানকার মানুষজন ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। একটি দেশে মেট্রোর ভাড়া বাড়িয়েছে, ভালোর জন্য ভাড়া বাড়িয়েছে তবুও সেখানে জনগণ বিদ্রোহ করছে। সে বিদ্রোহ মেট্রোর বিরুদ্ধে নয়, সরকারের বিরুদ্ধে। এরকম হংকংয়ে একটা উদাহরণ আছে। সরকারের ভালো ইচ্ছাও কিন্তু তারা নিতে পারছে না, বিদ্রোহ করছে গণতন্ত্র না থাকার কারণে। মূল বিষয়টা হলো, মানুষের জীবনের মান উন্নয়ন করছেন কি-না। আর এটা গণতন্ত্র ও সুশাসন ছাড়া কোনভাবেই পারবেন না। বলা হচ্ছে গণতন্ত্র আছে। তো কে বলেছে যে গণতান্ত্রিক সরকারের সুশাসন থাকবে না। গণতন্ত্র না থাকলেতো সুশাসন থাকবে কি করে। গনতন্ত্র নেই জন্যই সুশাসন নেই।

তিনি বলেন, এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন তখনই হবে যখন দারিদ্রমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানসহ সব ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। এমনভাবে ডেভেলপমেন্ট করবেন যাতে আপনার পরবর্তী প্রজন্ম সেই ফল ভোগ করতে পারে। কিন্তু এমন কোন আভাস দেখা যাচ্ছে না। আপনি চলে গেলে আপনার ভবিষ্যত প্রজন্ম কী করবে আপনি নিজেও তা জানেন না। কোন সুরক্ষা নেই, শুধু কিছু বিত্তবান লোক ছাড়া। আর এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য প্রচুর অর্থও লাগবে। কিন্তু বাংলাদেশে এতো অর্থ পাবে কি-না। অতএব আমি মনে করি, এসডিজির জন্য সবগুলো গোলের দিকে না গিয়ে বরং সামাজিক কতগুলো বিষয় আছে যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বৈষম্য দূর করা। সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি আয় বাড়ানো। এসব কাজগুলো আগে করতে হবে।

অন্যদিকে, আমাদের শুধু রেমিটেন্স আয় বাদে অন্য সবগুলো সূচক নিম্নমুখী। এখনো সময় আছে আমাদের এই সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আপনাকে সাধারণ মানুষের কনফিডেন্সও নিতে হবে। তাদেরকে বুঝিয়ে সবকিছু করতে হবে। সাধারণ মানুষ যেন বুঝে যে, এটা আমার ভালোর জন্য করা হচ্ছে। তাছাড়া কিন্তু সাধারণ মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। তারা জানেন না যে, তাদের জন্য কী করা হচ্ছে। মানুষ এখন উদাসিন, তারা রাস্তায় হেঁটে আর ব্যানার ফেস্টুনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদের মনের মধ্যে একধরনের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে, যেটা তারা প্রকাশও করতে পারে না। এমন হলেতো হবে না, কারণ মানুষই যদি আপনার সঙ্গে না থাকে যতো বড় সদিচ্ছাই থাকুক সেটা আপনি বাস্তবায়ন করতে পারবেন না।

২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার চিন্তা ছিলো সরকারের। চলতি অর্থবছরের সাড়ে সাত মাসেই সরকার ঋণ নিয়েছে ৫২ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। আর সব মিলিয়ে চলতি বছরের ১৬ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংক খাত থেকে নেয়া সরকারের পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৬০ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। এ বিষয়ে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাজেট বাস্তাবায়নের জন্য সরকার ঋণ নিয়ে থাকে। কিন্তু এবার যেটা হয়েছে যা টার্গেট হয়েছিলো তার চেয়ে অনেক বেশি দাঁড়িয়েছে। এর মূল কারণ হলো, রাজস্ব আয় কমে গেছে। একদিকে, আবার সরকারের খরচ বেড়ে গেছে। বিশেষ করে কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে যে খরচ, সরকারি কর্মকর্তাদের বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা দেয়া। এছাড়া বিভিন্ন কারণে সরকারের খরচ বেড়ে গেছে। এতে বিশেষ করে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে।

এর ফলে প্রাইভেট সেক্টরকে ব্যাংকগুলো যে ঋণ দেয় সেটার ক্ষমতা হ্রাস পাবে। অথচ প্রাইভেট সেক্টরই কিন্তু আমাদের গ্রোথ, প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে মূল চালিকা শক্তি। আর সরকারি বড় বড় মেগা প্রকল্পগুলো থেকে বেনিফিট আসতে অনেক সময়ের ব্যাপার, প্রায় ৫ থেকে ১০ বছররের আগে আসবে না। তো এরইমধ্যে যে ইম্পেক্ট পড়বে তাতে সব বেসরকারি খাতে ঋণ কমবে, কর্মসংস্থান কমে যেতে পারে, এছাড়াও মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ পড়বে। আর ব্যাংকাররাও দেখে যে কোন ঝামেলা ছাড়াই চুপচাপ বসে থেকেই সরকার থেকে সেটা রিটার্ন পাচ্ছে। শিল্প খাতে ঋণ দিতে ব্যাংকারদের তৎপরতা দেখা যায় না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, প্রাইভেট সেক্টরে ঋণের প্রবাহ কমে যাচ্ছে। অপরদিকে, আবার ডিপোজিট অনেক কমে যাচ্ছে। আর সরকারের সুদের হার যেটা এপ্রিল মাসে কার্যকর হবে কিন্তু ব্যাংকগুলো এখন থেকেই এটা প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকারদের ওপর যে চাপ পড়বে সেটা হলো তাদের যে প্রফিট রেট, ঋণ দেয়ার সক্ষমতা সেটা কমে যাবে।

তিনি বলেন, খেলাপি ঋণে ব্যাংকের যেটা হচ্ছে এখন যে পজিশনে আছে সেটা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। বলবো যে, ব্যাংকিং সেক্টরটা চরম দুরাবস্থার মধ্যে আছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া মানেই হলো- ব্যাংকের যে ঋণ আটকে গেছে, এই ঋণগুলো অন্য প্রডাক্টিভ খাতে গেলে আবার রিটার্ন আসতো। ব্যাংকের ইনকাম বাড়তো, যারা শেয়ার হোল্ডার তাদের ইনকাম বাড়তো।

বিদেশে টাকা পাচারের ব্যাপারে তিনি বলেন, কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে এতে বোঝা যাচ্ছে যে, আমাদের ব্যাংককিং সেক্টরে, আর্থিক খাতে সুশানের অভাব। এখানে যে নিয়মনীতিগুলো আছে সেগুলো পরিপালনের অভাবে এগুলো হচ্ছে এবং এখানে সুপারভিশন মনিটরিংয়েরও যথেষ্ট ঘাটতি আছে। না হলে দিনের পর দিন লোকজন নানা ভাবে এই টাকাগুলো নিয়ে যেতে পারতো না। আর টাকাগুলো নিয়ে যাচ্ছে জেনেও কিন্তু আমরা দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখছি না। শুধু দেখছি যে, কিছু লিস্ট বেরিয়েছে, কিছু নাম বেরিয়েছে কিন্তু এখানে বিশেষ করে বাংলাদেশ ফাইন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট আছে, এসিসি আছে, সিআইডিও এটি নিয়ে ডিল করে, এদের জানাও আছে কিছু কিছু যারা টাকা নিয়ে গেছে,  কিন্তু এদের ব্যাপারে কঠোর যে পদক্ষেপ নেয়া তা দৃশ্যমান নয়। এদেরকে ধরে ধরে শাস্তি দিতে হবে, কারণ শাস্তির বিকল্প কিন্তু কোন কিছু হয় না। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় তারা আরও নতুন করে উৎসাহ পায়। আর টাকা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারটা আরও কঠিন। এটা সরকারকে সচেষ্ট হতে হবে। মানি লন্ডারিং, ফাইন্যানন্স ফর টেররিজম, ফাইন্যান্স ফর প্রস্টিটিউশন, বোর্ডার স্মাগলিংসহ অনেক অপরাধ হয়। এগুলোর ব্যাপারে বাংলাদেশকে আমি দেখছি না, যে স্টেট টু স্টেট, এটা একদম ঢালাওভাবে ৫০ টি দেশের সঙ্গে করতে পারে না, ওয়ান টু ওয়ান পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু কোথায় বেশি যাচ্ছে- সিঙ্গাপুর, তখন তাদের সঙ্গে আলাপ, মালয়েশিয়াতে যাচ্ছে ওটা নিয়ে আমরা কোন অ্যাকশনই দেখছি না, আমেরিকাতে যাচ্ছে সেটার ব্যাপারে ব্যবস্থা দেখছি না, ইন্ডিয়াতে বহু টাকা চলে যাচ্ছে সেটার ব্যাপারে কোন অ্যাকশান দেখছি না। তো ওয়ান টু ওয়ান ব্যবস্থা নেয়া উচিত। একবারেই যে হচ্ছে না তা নয়, তবে সেগুলো খুব দুর্বল, একবার নিয়ে বসে থাকে তারপর আর কোন ফলোআপ অ্যাকশান নেয় না। 

তিনি বলেন, এইযে আমাদের নিজস্ব এতগুলো টাকা বিদেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এর বিশাল অংশ যেটা দিয়ে বিনিয়োগ করা যেতো, আর্থিক খাতে বিনিয়োগ করা যেতো সেটা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। একদিক থেকে আমরা অর্থ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি অন্যদিকে এই অর্থ দিয়ে বিনিয়োগ করে যে লাভ হতো, এ থেকে কর্মসংস্থান হতো সেটা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। সুতরাং দু’দিক থেকেই আমরা বড় ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছি। আর যখন বিদেশে টাকা পাচার হয়ে যায় তখন কিন্তু আমাদের গভর্নেন্স ইকোনমিক মনিটরিং সেটা সাধারণত দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন বাইরে থেকে যারা ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে আসতে যাবে তখন তারা সাবধানতা অবলম্বন করবে। আর আমাদের যে ভালো সৎ ব্যবসায়ী তারাও লেবেল প্লেইং ফিল্ডে কাজ করতে পারবে না। যারা স্থিথিশীল ব্যবসা চায়, ইন্ডাস্ট্রি চায় তাদের জন্য কিন্তু ব্যবসার পরিবেশ দিনদিন ডিফিকাল্ট হয়ে পড়ছে।

  • কার্টসি - মানবজমিন/ ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০