Search

Wednesday, August 5, 2020

স্মরণ — ক্ষণজন্মা একজন মাহবুব আলী খান


মুশফিকুল ফজল আনসারী


মানুষের হৃদয় রাজ্যে বাস করার অভিলাষেই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক। কোনো তকমা কিংবা প্রশংসার ফুলঝুরি নয়, সকলের একজন হয়েই বেঁচে থাকতেই হয়তো এমন পণ করেছিলেন রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান। এরকম মানুষ হাতে গুনা। নিরবে নিভৃতে মানুষের তরে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিল এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব। যশ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি তাঁকে তাড়া কারলেও তিনি ফিরেও তাকাননি।
 
মাটি-আর মানুষকে আপন করার ইচ্ছে লালন করার তাগিদেই স্বাধীন ভুখন্ড প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বুনেন আপনমনে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সহ্য করেছেন পাকিস্তান সরকারের গৃহবন্দিত্বের খড়গ। ভাতা ভোগ বা আয়েশি জীবনকে তুচ্ছ করে অটল থেকেছেন স্বাধীন স্বদেশে নি:শ্বাস নেয়ার দীপ্ত শপথে। মাহবুব আলী খানের দেশপ্রেম ছিলো প্রশ্নাতীত।

দেশের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ইঞ্চি পর্যন্ত ছাড় দেননি তিনি। দেশেরসমুদ্রসীমা রক্ষা, সমুদ্রে জেগে ওঠা দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপকে বাংলাদেশের সম্পদ হিসেবে আগলে রাখা তার নিখাঁদ দেশপ্রেমের জ্বলন্ত উদাহরণ। মানুষের দোরগড়ায় প্রশাসনকে নিয়ে যেতে তিনিই প্রথম উপজেলা পদ্ধতির প্রবক্তা ছিলেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ গঠনে মাহবুব আলী খানের শ্রম-ঘামের স্বাক্ষী এই জনপদ।
 
রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান
 নভেম্বর ৩, ১৯৩৪ – আগস্ট ৬, ১৯৮৪ 

মাহবুব আলী খানের রয়েছে অবাক করার মতো পারিবারিক ঐতিহ্য। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের অধিকারী রিয়ার এডমিরাল মাহবুবআলী খানের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৩ নভেম্বর সিলেটের বিরাহীমপুরের সম্ভ্রান্ত ও বিখ্যাত মুসলিম পরিবারে। তৎকালীন ভারতের প্রথম মুসলিম ব্যারিস্টার আহমেদ আলী খান তার পিতা। ১৯০১ সালে বার এ্যাট ‘ল ডিগ্রিধারী আহমেদ আলী খান ছিলেন নিখিল ভারত আইনপরিষদের সদস্য (এম এল এ) ও আসাম কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট । মাহবুব আলী খানের মায়ের নাম জোবায়দা খাতুন দু’ভাই ও এক বোনের মধ্যে মাহবুব আলী খান ছিলেন ছোট। সিলেটের বিরাহীমপুর, কলকাতা ও ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকার ৬৭ পুরানা পল্টন লাইনের বাড়িতে মাহবুব আলী খানের শৈশবও কৈশোর অতিবাহিত হয়। তিনি কলকাতা ও ঢাকাতে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পড়াশোনায় তিনি ছিলেন কৃতীছাত্র। তার কলেজ জীবনের শিক্ষা ঢাকা কলেজে। মায়ের দিক থেকেও মাহবুব আলী খান ছিলেন বর্ণাঢ্য পারিবারিক ঐতিহ্যের এক গর্বিত উত্তরাধিকার। জোবায়দা খাতুনের দাদা সমাজহীতকর কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ তৎকালীন ব্রিটিশদের রাজকীয় খেতাবে ভূষিত হন । মাহবুব আলী খানের চাচা গজনফর আলী খান ১৮৯৭ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আই.সি.এস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ছিলেন বাংলা ও আসামের প্রথম মুসলিম আই.সি.এস। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৩২ সালে গজনফর আলী খান নাগপুর ডিভিশনের কমিশনার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর কর্মদক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘অফিসার অব দি ব্রিটিশ এম্পায়ার’ এবং সি.আই.ই উপাধিতে ভূষিত করে। মাহবুব আলী খানের দাদা ছিলেন ভারতের বিশিষ্ট চিকিৎসক খানবাহাদুর আজদার আলী খান। তিনি বিহার ও আসামের দারভাঙ্গা মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও পাটনা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক। ১৯২৪ সালে তিনি সিলেটে নাফিজাবানু চ্যারিটেবল হাসপাতাল ও ১৯৩০ আরেকটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। মাহবুব আলী খানের পিতা আহমেদ আলীর মামা বিচারপতি আমীর আলী ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি। দ্য স্পিরিট অব ইসলাম ও অ্যা শর্ট হিস্ট্রি অব সারাসেন’ এ দু’টি বই রচনা করে আজও তিনি খ্যাতির শীর্ষে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানী ছিলেন এম এ খানের চাচাতো ভাই। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে মাহবুব আলী খান ছোট। বড়বোন সাজেদা বেগম। মেজভাই চিকিৎসক সেকেন্দার আলী খান। সেকেন্দার আলী খানের মেয়ে আইরিন খান কাজ করেছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব হিসেবে। সম্প্রতি জাতিসংঘের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মতামত সংক্রান্ত বিশেষ রেপুটিয়ারের দায়িত্ব লাভ করেছেন আইরিন খান।
 
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, সিলেটের বিরাহীমপুর, কলকাতা ও পুরান ঢাকার ৬৭ পুরানা পল্টন লেনের বাড়িতে মাহবুব আলী খানের শৈশব ও কৈশোর কাটে। কলকাতা ও ঢাকায় তার প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ হয়। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন শান্ত অথচ চৌকস। অজানাকে জানা আর অসাধ্যকে সাধন করার ব্রত তাঁর বাল্যকাল থেকেই।

১৯৫৫ সালে ২১ বছর বয়সে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর সাথে। দুই কন্যা সন্তানের জনক মাহবুব আলী খান । শাহিনা খান জামান (বিন্দু) এবং ডা. জোবায়দা রহমান (ঝুনু)। শাহিনা খান জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেছেন। কনিষ্ঠা কন্যা জোবায়দা রহমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত সোয়াস থেকে তিনি প্রিভেনটিভ কার্ডিওলজি থেকেএমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। এতে ৫২টি দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অর্জন করেন প্রথম স্থান। বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমডোর সৈয়দ শফিউজ্জামান এম এ খানের জ্যেষ্ঠ জামাতা। আর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বড় পুত্র বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মাহবুব আলী খানের কনিষ্ঠ জামাতা। মাহবুব আলী খানের একমাত্র নাতনী ব্যারিস্টার জায়মা রহমান।
 
১৯৫২ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ দেন মাহবুব আলী খান। ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণ লাভ করেন কোয়েটার সম্মিলিতবাহিনীর স্কুল থেকে। যুক্তরাজ্যের ডার্মউইথ রয়্যাল নেভালকলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। ১৯৫৪ সালে ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর রণতরী ট্রাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৫৬ সালের পহেলা মে স্থায়ী কমিশন লাভ করেন। রয়্যাল কলেজ, গ্রিনিচসহ ইংল্যান্ডের রয়্যাল নেভাল ইনস্টিটিউশনে বিভিন্নকোর্স সমাপ্ত করেন। ১৯৬৩ সালে কৃতী অফিসার হিসেবে যুক্তরাজ্যে রানী এলিজাবেথ কর্তৃক পুরস্কৃত হন। একই বছর যুক্তরাজ্যে ভূমি থেকে টর্পেডো ও অ্যান্টি-সাবমেরিনওয়ারফেয়ার অফিসার হিসেবে উত্তীর্ণ হন এবং পাকিস্তাননেভাল স্টাফ কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। করাচিতে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট থেকে সিনিয়রম্যানেজমেন্ট কোর্স সম্পন্ন করেন। এরআগে ১৯৬০ সালে পিএনএস তুগ্রিলের গানারি অফিসার হন। পরে ১৯৬৪সালে পিএনএস টিপু সুলতানের টর্পেডো ও অ্যান্টি-সাবমেরিন অফিসার হন। ১৯৬৭-৬৮ সালে তিনি রাওয়াল পিন্ডিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে জয়েন্ট চিফ অফসে ক্রেটারিয়েট স্টাফ অফিসার (ট্রেনিং এবং মিলিটারিঅ্যাসিস্ট্যান্স) হিসেবে দায়িত্ব পালন। ১৯৭০ সালে পিএনএস হিমালয়ে টর্পেডো ও অ্যান্টি-সাবমেরিন স্কুলের অফিসার ইনচার্জ ও করাচিতে সি-ওয়ার্ড ডিফেন্স অফিসারের দায়িত্বপালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে স্ত্রী ও দুই কন্যাসহ মাহবুব আলী খান পশ্চিম পাকিস্তানে চাকরিরত ছিলেন। যুদ্ধকালীন সময়ে পরিবারসহ তিনি গৃহবন্দী হন। তিন বছর বন্দী থাকার পর ১৯৭৩ সালে স্ত্রী ও কন্যাসহ আফগানিস্তান ও ভারত হয়ে বাংলাদেশে পৌঁছেন। এরপর ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রাম মার্কেন্টাইলএকাডেমির প্রথম বাংলাদেশী কমান্ড্যান্ট নিযুক্ত হন। ১৯৭৪ সালে নৌ-সদর দপ্তরে পারসোনেল বিভাগের পরিচালক পদে নিয়োগ পান। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি নৌবাহিনীর সহকারি স্টাফ প্রধান (অপারেশন ওপারসোনেল) নিযুক্ত হন। ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে রয়্যালনেভি কর্তৃক হস্তান্তরিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রথম রণতরী বিএনএস ওমর ফারুক (সাবেক এইচএমএম ন্যাভডক) এরঅধিনায়ক হন। রণতরীটি নিয়ে আলজেরিয়া,।। যুগোস্লাভিয়া, মিসর, সৌদি আরব এবং শ্রীলঙ্কার বন্দরগুলোতে শুভেচ্ছা সফর করেন। ১৯৭৯ সালের ৪ঠা নভেম্বর তিনি নৌ-বাহিনীর স্টাফ প্রধান নিযুক্ত হন এবং১৯৮০ সালের পহেলা জানুয়ারি রিয়ার এডমিরাল হন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে বিশ্বমানের আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন। নৌবাহিনীর আইন প্রণয়ন করেছেন তিনি। দেশের সমুদ্রসীমা রক্ষা, সমুদ্রে জেগে ওঠা দ্বীপসহ দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের দখল রক্ষা, জলদস্যু দমন, সুন্দরবনের নিরাপত্তায় নৌবাহিনীকে সচেষ্ট করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তিনি সরকারের তিনিসরকারের সশস্ত্র বাহিনীর বেতন ও পেনশন কমিটিরচেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া দেশের প্রশাসনিক পুনর্গঠনেজাতীয় বাস্তবায়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও ছিলেন। বাংলাদেশে উপজেলা পদ্ধতির প্রবক্তাও তিনি। ১৯৮২ সালে দেশে সামরিক আইন জারি হলে, এডমিরালএমএ খান উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। এ সময় তাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা করা হয়। ১৯৮২ সালের ১০ জুলাই থেকে ১৯৮৪ সালের ১ জুন পর্যন্ততিনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় শাহজালাল সেতু, লামাকারী সেতু, শেওলা সেতুসহ বড় বড় উন্নয়নকাজের সূচনা হয়।
 
১৯৮২ সালে দেশে সামরিক আইন জারি হলে, এডমিরাল এমএ খান উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। এ সময় তাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা করা হয়। ১৯৮২ সালের ১০ জুলাই থেকে ১৯৮৪ সালের ১ জুন পর্যন্ততিনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় শাহজালাল সেতু, লামাকারী সেতু, শেওলা সেতুসহ বড় বড় উন্নয়নকাজের সূচনা হয়।
 
১৯৮২ সালের এপ্রিল মাসে তিনি নৌ, রেল ও সড়কপ্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে চীন সফর করেন এবং চীনের নৌঘাঁটিগুলো পরিদর্শন করেন। জুন মাসে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে তিনি খান বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেন। নভেম্বরে তিনি রাশিয়া যান এবং প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ডিসেম্বরে জ্যামাইকায় অনুষ্ঠিত সমুদ্র আইনবিষয়ক সম্মেলনে তিনিবাংলাদেশের নেতৃত্ব দেন ও কনভেনশন অন অফ-সিকনফারেন্সে স্বাক্ষর দেন। ১৯৮৩ সালের মার্চে ব্যাংককেঅনুষ্ঠিত রেলওয়ে মন্ত্রীদের সভায় তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। জুলাই মাসে তিনি কোরিয়া সফরে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। ১৯৮৪ সালের ৩০মার্চ তিনি গিনির প্রেসিডেন্ট আহমদ সেকুতুরের শেষকৃত্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধি করেন।
 
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সঙ্গে মাহবুব আলী খানের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ট। ১৯৭৫ সালের পরে, জিয়াউর রহমান সরকারের সময় নৌ-বাহিনী প্রধানের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি তৎকালীন সরকারের যোগাযোগ উপদেষ্টা ছিলেন। সৎ ও অভিজ্ঞ মাহবুব আলী খানকে পরবর্তী সরকার বাংলাদেশের যোগাযোগ ও কৃষিমন্ত্রী দায়িত্ব প্রদান করে। মাহবুব আলী খান শহীদ জিয়া সূচিত সবুজ বিপ্লব ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম সহযোগি হিসাবে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভের পর তিনি দেশের রাস্তাঘাট, সেতু নির্মানসহ অবকাঠামো উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখেন । ১৯৮৪ সালের ৬ আগস্ট সকালে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে একটি প্রশিক্ষণ বিমান ভূপাতিত হলে রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান ছুটে যান দূর্ঘটনা স্থলে। সেখানে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাঁকে স্থানান্তর করা হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। এরপরই মাত্র ৪৯ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন নিভৃতচারী এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব। রেখে যান কর্ম, উদ্যোম, সততা, সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের অনন্য নজির ।
 
  • লেখক সাংবাদিক

চামড়াশিল্পের উত্থানের সুযোগ ফের বেহাত হবে?


আহাদ আহমেদ

করোনা-পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক চামড়াবাজার নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে। সুযোগের সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশও। চীনের বাজার এই খারাপ সময়েও চালু ছিল। দুনিয়ার ট্যানারি শিল্প যখন উৎপাদন প্রায় বন্ধ রেখেছে, তখন ইউরোপের এই কেমিক্যাল কোম্পানিগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে চীন। ইতালি-ভারত ইত্যাদি দেশের চামড়াশিল্প সংকটে। তখন বিশ্ববাজারে আমাদের চামড়া পণ্যের বিরাট সুযোগ উপস্থিত হয়েছে করোনা এবং আনুষঙ্গিক আরও কিছু কারণে। সুযোগের সেই ফল হাতে তুলে নেওয়ার আয়োজন তো দেখা যাচ্ছেই না, বরং দেখা যাচ্ছে উল্টো গতি।

২০২০ সালের কোরবানি ঈদের পর আগের বারের মতোই আবহাওয়া চরম গরম। কাঁচা চামড়ার জন্য এটা অত্যন্ত বৈরী পরিবেশ। অতি উচ্চ তাপমাত্রা ও কাঁচা চামড়ার মূল্যপতনের ফলে লবণ লাগানোর খরচ উটকো বলে গণ্য হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে লবণের চেয়ে চামড়ার মূল্য কম। ছাগলের চামড়ার প্রায় শূন্য মূল্যের কারণে লবণ দেওয়া বন্ধ করেছে আড়তদারেরা। সরকারের উচিত ছিল সাভারে জরুরি ভিত্তিতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার ব্যবস্থা করা।

কাঁচা চামড়ার বড় আন্তর্জাতিক উৎস উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং ইউরোপ প্রায় ধরাশায়ী। এসব দেশের পশুসম্পদ ব্যাপক হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। কোভিড-১৯-মুক্ত ‘কাঁচা চামড়া’ সনদ নিয়েও বিতর্ক আছে। ভারতে রাজনৈতিক কারণে চামড়ার বাজার স্থায়ী হুমকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। অন্য কারণেও ভারতের চামড়াশিল্প অভাবনীয় অবস্থার মধ্যে পতিত। গো-সুরক্ষা ও রাজনৈতিক বাগাড়ম্বিতা এই খাতে স্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করে ফেলেছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে শুরু করে রাসায়নিক কাঁচামাল আমদানির বেলায় ‘নন-পেমেন্ট’ প্রথার ফলে এরা অবিশ্বস্ততার অলিখিত ‘সনদপ্রাপ্ত’ হয়েছে। কিছু ভারতীয় কোম্পানি নিম্নমানের দেশীয় রাসায়নিক ব্যবহার করছে। ফলে ,কমপ্লায়েন্স নিয়েও ভারতের সংকট স্থায়ী হতে পারে। চীনের সঙ্গে বিরোধ ভারতীয় বাজারে মন্দা ভাবের সৃষ্টি হবে। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো তাদের জন্য কঠিন। দুনিয়াব্যাপী চামড়াজাত কার সিট, আপহোলস্ট্রি (সাজসজ্জার উপকরণ) বাজারের উঠে দাঁড়ানো এখন প্রায় অসম্ভব। কারণ, গাড়ির বিক্রি প্রায় ৫০ ভাগ কমে এসেছে।

ইতালি করোনায় যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, তাতে ফ্যাশন হাউসের কাজ ছাড়া জুতা ও চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদনে তাদের অংশগ্রহণ কমে যাবে। এদিকে ইউরোপ ও আমেরিকার জুতা ও চামড়াজাত পণ্যের বাজার বড় মাপে চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। পশ্চিমা উৎপাদকেরা চীনে বিনিয়োগ নিয়ে হাজির হচ্ছে। ফলে, ইউরোপ-আমেরিকার ফ্যাশন শিল্প আর চীনের সমন্বয়ে চীনভিত্তিক এক বিশাল চামড়া, ফুটওয়্যার, চামড়াজাত পণ্যের বাজার বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। বাংলাদেশ হতে পারে সেই বিশ্ববাজারের অন্যতম শরিক। উল্লেখ্য, চীনের বাজার বাংলাদেশের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। আট হাজারের ওপর পণ্যের ওপর থেকে ৯৭ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে।


এসব বিষয় মাথায় রেখে বাংলাদেশকে কিছু কাজ করতে হবে। যেমন ১. কাঁচা চামড়ার চোরাচালান বন্ধ করা, ২. চামড়ায় মুল্য সংযোজন করা ও বাজারজাত করার নীতি নেওয়া। এ দুটি কাজ করা গেলে আগামী চার থেকে পাঁচ বছর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে পারবে বাংলাদেশ। অর্থাৎ বর্তমানের প্রায় ১০ গুণ! এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চামড়া পণ্য উৎপাদকদের ‘রপ্তানি গিল্ড’ গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। এরা নিম্নতম মূল্য নির্ধারণ করে দেবে। যেনতেন মূল্যে চামড়া বিক্রয়ের রাস্তা থেকে সরে আসাই হবে এই খাতের মূল লক্ষ্য। কস্ট ম্যানেজমেন্ট করে ৬০ থেকে ৭০ সেন্টে চামড়া বিক্রি করাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

গৌরবের সঙ্গে বলা হয়ে থাকে, চামড়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। কিন্তু বাস্তবে এক দশক ধরেই এই খাত পতনশীল; শুধু সিদ্ধান্তহীনতায় আর দুর্নীতির শিকার হয়ে। ইপিবির তথ্যানুযায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রায় ১৬ শতাংশ বাজার পতন হয়েছে। ২০১৩-১৪ সাল থেকে এ খাতের আয় ১ দশমিক শূন্য ৮ থেকে ১ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করেছে। অন্যদিকে, ভারতের ৩ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের বিপরীতে চীনের আয় ১০ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তান করছে ৯৪৮ মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। বাংলাদেশে ২০১৬-১৭ সালকে চামড়া বর্ষ হিসেবে সরকারিভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চামড়াশিল্পের পতন সেই সময় থেকেই শুরু। শিল্পমন্ত্রীর নেতৃত্বে টাস্কফোর্স গঠনের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে প্রতি সপ্তাহে বৈঠকের কথা! কিন্তু যাঁরা ট্যানারি চালাবেন, তাঁদের এত সময় নেই। আর যাঁরা প্রতি সপ্তাহে মিটিং চালাবেন, তাঁদের শিল্প চালানোর সময় নেই—এটাই বাস্তবতা।

বাংলাদেশ ১৮০ থেকে ২০০ মিলিয়ন বর্গফুট চামড়া উৎপাদন করে। প্রক্রিয়াজাত চামড়া, জুতা, চামড়াজাত পণ্য হিসেবে রপ্তানি হয় ১৪০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন বর্গফুট। শুধু নতুন এলাকা সাভারের সামগ্রিক উৎপাদন ৪০০ থেকে ৪৫০ মিলিয়ন বর্গফুট ধরা হয়েছে। ১৫৫টি ট্যানারির অনুমতি দেওয়া হয়েছে সেখানে, যাদের অধিকাংশের এক প্রজন্মের তো দূরের কথা কস্মিনকালেও চামড়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। শুধু হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পের নিবন্ধন থাকার সুবাদে এখানে জমি বরাদ্দ পেয়েছে অনেকে। তাদের অনেকেই সুযোগটাকে শুধু রিয়েল স্টেট ব্যবসা হিসেবে দেখছে। সাভারে শিল্প স্থানান্তর সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী ছিল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো, ইটিপি স্থাপনা নিয়ে যে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা, তা পিছিয়ে দিয়েছে বাজারকে। বেশ কিছু ক্রেতা ভিয়েতনাম ও এশিয়ার অন্যত্র উৎপাদকের খোঁজ করছে।

তারপরও বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ ভিয়েতনামের সমান দক্ষতা অর্জন করতে পারে। তার জন্য পুরো ট্যানারি খাতকে ৫০ থেকে ৬০টি শিল্পে নামিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। প্রতিযোগিতামূলক দরপতন কমানো সম্ভব এভাবেই। একইভাবে জুতা ও চামড়াজাত পণ্যের জন্য শিল্পের সংখ্যাও ৬০ থেকে ৭০-এ নামিয়ে আনা দরকার। বিশ্ববাজারের ধারা পরিবর্তিত হবে এবং প্রাকৃতিক পণ্যের বাজার বিকশিত হবে। এর আগাম প্রস্তুতি কি আমাদের আছে? কোনো একটি খাতের উন্নতি সেই খাতের পরিচালকদের যৌক্তিক সততার ওপরও নির্ভরশীল। এই খাতের নামে ঋণ নিয়ে লুটে নেওয়াদের তাই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

মনে রাখা দরকার, কাঁচা চামড়া সংগ্রহ থেকে ট্যানারিজাত হয়ে জুতা, জ্যাকেট, ব্যাগ তৈরি পর্যন্ত প্রায় ৫০ লাখ মানুষ এই খাতের সঙ্গে জড়িত। এই খাতে যে অভিজ্ঞতা, দক্ষ শ্রমিক ও কর্মী তৈরি হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে শক্তির জায়গা। বাংলাদেশের ট্যানারি শিল্প মাত্র ৫ বছরেই ১০ বিলিয়ন ডলার আয়ের স্তরে উঠতে পারে, যদি:

১. আধুনিক ও টেকসই প্রযুক্তিনির্ভর খাত হিসেবে একে গড়ে তোলা হয়। টেকসই প্রযুক্তি মানে পানি ও রাসায়নিক ব্যবহারে সচেতন হওয়া। পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা চালু রাখা।
২. ট্যানারি শিল্পের মালিকদের সমন্বয়ে রপ্তানি গিল্ডের ‘প্রাইস সেন্টার’ গঠন করা। তাঁদের প্রধান কাজ হবে চামড়ার ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করা। কোনো ট্যানারি এই মূল্যের নিচে চামড়া বিক্রি করলে তার রপ্তানি ৬ মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা। রপ্তানির ক্ষেত্রে এই ‘রপ্তানি গিল্ডের’ সনদ বাধ্যতামূলক করা।
৩. ক্রমান্বয়ে সব রপ্তানিমুখী ট্যানারির জন্য এলডব্লিউজি (লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ নামে আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থার সনদ) কমপ্লায়েন্স বাধ্যতামূলক করা।
৪. ট্যানারি শিল্পের শ্রমিক ও কর্মচারীদের জন্য ন্যূনতম মজুরি, নিরাপত্তা ও মানবিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করা।
৫. ‘বায়ারস ইনসেনটিভ’ হিসেবে আমদানি মূল্যের ওপর ভিত্তি করে ফ্লাইট কস্ট ও হোটেল ভাড়ার ওপর ১০ থেকে ২৫ শতাংশ ক্যাশব্যাকের ঘোষণা দেওয়া।
৬. কাঁচা চামড়া ও কেমিক্যাল আমদানি ক্ষেত্রে বন্ডেড ওয়্যার হাউসের পাশাপাশি সব বাণিজ্যিক ও শিল্প আমদানিকারকের জন্য কনসলিডেটেড ১০ শতাংশ মোট ট্যাক্স নির্ধারণ করা—যাতে সব ধরনের শিল্প প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে রাসায়নিক কাঁচামাল সংগ্রহ করতে পারে।
৭. ব্যাংকঋণের মধ্যে স্বচ্ছতা আনা।

সর্বোপরি ট্যানারি খাত ও সরকারের যৌথ নীতি গ্রহণ করতে হবে, যার স্লোগান হবে ‘লক্ষ্যমাত্রা ১০ বিলিয়ন’।

  • লেখক চামড়াশিল্পের সঙ্গে যুক্ত উদ্যোক্তা।

প্রতিটি বিচার বহির্ভূত হত্যা রাষ্ট্রের ভিত নাড়িয়ে দেবার অপরাধ


ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা


এই বছর জানুয়ারি মাসের সংসদ অধিবেশনে বসে বিপুল বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম সরকারি এবং বিরোধী দলের বেশ কয়েক জন সংসদ সদস্য ধর্ষণের শাস্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ক্রসফায়ারকেই বেছে নিয়েছেন।

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সাবেক মন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু ধর্ষণে অভিযুক্তদের ক্রসফায়ারে হত্যার কথা তোলার পর পরই সেটিকে সমর্থন করে দীর্ঘ বক্তব্য দেন আরেক সংসদ সদস্য, যিনি নিজেও মন্ত্রী ছিলেন, কাজী ফিরোজ রশিদ। এই দু’জন যে কেবলমাত্র সাংসদ বা মন্ত্রী ছিলেন তাই নয়, তারা দু’জনই বাংলাদেশের পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ, যাকে বলে সিজনড পলিটিশিয়ান। মজার বিষয় হলো সংসদে ক্রসফায়ারের সমর্থনে সাংসদদের এটাই প্রথম বক্তব্য নয়। অনেকেরই হয়তো মনে থাকবে ২০১৬ এবং ২০১৯ সালেও কাজী ফিরোজ রশিদ ধর্ষণে অভিযুক্তদের ক্রসফায়ারে দেবার দাবি তুলেছিলেন। এ ধরণের বক্তব্য একজন আইন প্রণেতার খোদ সংসদে দাঁড়িয়ে দেবার ইমপ্যাক্ট কী হতে পারে তা না বোঝার কোনো কারণ নেই।

এ তো গেল ‘বিরোধী দল’ এর সাংসদদের কথা। এবার অপার বিষ্ময়ে লক্ষ্য করলাম বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অতি গুরুত্বপূর্ন এক ব্যক্তি সরকার দলীয় সাংসদ জনাব তোফায়েল আহমেদ তাদের দুইজনকে সমর্থন করে বললেন, “এখানে দরকার কঠোর আইন করা।

আর দ্বিতীয়ত হল, যে এই কাজ করেছে তার আর এই পৃথিবীতে থাকার কোনো অধিকার নাই”। এই বিষয়ে সর্বশেষ মুখ খোলেন তরিকত ফেডারেশনের নেতা নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী যিনি তার তরিকা মতোই ক্রসফায়ারের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের বেহেশত নিশ্চিত করে ফতোয়া দেন যে, “আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে বলছি এদের (ধর্ষকদের) ক্রসফায়ার করলে কোনো অসুবিধা নাই”।

আমরা দেখেছি পেয়াজের দাম নিয়ে সিন্ডিকেটের কথা বলতে গিয়ে এই সংসদেই অতীতেও ক্রসফায়ারের দাবি উঠেছিল। সর্বশেষ করোনাকালে বসা বাজেট অধিবেশনে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি দমনের দাওয়াই হিসাবেও ক্রসফায়ারের কথা বলা হয়েছে। যারা সংসদে দাঁড়িয়ে এ ধরণের দাবি তুলেছেন, তারা প্রত্যেকেই সিনিয়র পলিটিশিয়ান, কয়কবারের সাংসদ এবং মন্ত্রীও ছিলেন। সুতরাং মুখ ফসকে এধরণের কথা তারা সংসদে বলেছেন সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই। ৩৫০ জনের এই সংসদে একজন সাংসদ অবশ্য তীব্র ভাষায় এর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, “২০১৯ সালে গড়ে প্রতিদিন একজনের বেশি মানুষ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড খুব সম্ভবত বৈধ হতে যাচ্ছে। কারণ, আমরা গতকাল দেখেছি সরকার ও বিরোধী দল – দুই দলই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে কথা বলছে”। প্রতিবাদি এই সদস্য সংসদে প্রথম বারের মত আসা এবং সবচেয়ে শেষে যোগ দেয়া বিএনপি’র সংরক্ষিত আসনের একমাত্র মহিলা সাংসদ।


সম্প্রতি একটি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। প্রতিটি বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের পরে আইন-শৃংখলা বাহিনীর পক্ষ থেকে যেমন বিবৃতি দেয়া হয়, তেমন একটা বিবৃতি আমরা পেয়েছি তাদের পক্ষ থেকে যেখানে পুলিশকে আক্রমণের কথা ছিল, ছিল সেটা প্রতিহত করতে পাল্টা গুলির কথা। মজার বিষয় এতে বাদ ছিল না হত্যাকাণ্ডের শিকার মানুষটির গাড়ি ও রিসোর্ট থেকে মদ, গাজা, ইয়াবা এবং অস্ত্র উদ্ধারের তথ্যও। এতই গতানুগতিক, এতই ক্লীশে এই ‘গল্প’ যে শিশুরাও আজকাল আর বিশ্বাস করে না এসব, তারাও জানে আসলে কী ঘটেছে। প্রথম আলোর রিপোর্ট অনুযায়ী গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদন বলছে পুলিশের সংকেত পেয়ে মেজর (অবঃ) সিনহা গাড়ি থামান এবং নিজের পরিচয় দিলে প্রথমে তাদের চলে যাওয়ার সংকেত দেয়া হয়। পরে পরিদর্শক লিয়াকত আলি তাদের পুনরায় থামান এবং পিস্তল তাক করে গাড়ি থেকে নামতে বলেন। মেজর সিনহা গাড়ি থেকে হাত উঁচু করে নামার পরপরই লিয়াকত তাকে তিনটি গুলি করেন। তার সঙ্গে থাকা সিফাতের ভাষ্যও তাই। পরিবারের দাবি তাকে স্পষ্টতই হত্যা করা হয়েছে। ময়না তদন্তের পর কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা জানান মেজর সিনহার বুকে ও পিঠে জখমের দাগ ছিল। সিনহার শরীরের ওপরের অংশ করদমাক্ত এবং বুক ও গলা গুলিবিদ্ধ ছিল। হাতে হাতকড়া লাগানোর দাগ ছিল বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন মাঠকর্মী ঘটনার ভিডিও রেকর্ড করতে চাইলে পুলিশ তার মুঠোফোন ও পরিচয়পত্র ছিনিয়ে নেয়। সংস্থাটির প্রতিবেদন আরও বলে ঘটনাস্থল থেকে হাসপাতাল ১ ঘণ্টার পথ। অথচ মেজর সিনহাকে হাসপাতালে নিতে পুলিশের সময় লাগে ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট। অতিরিক্ত ৪৫ মিনিট অতিবাহিত করা পুলিশের একটি অপকৌশল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

রাষ্ট্র বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ওপরে এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব বলছে এই করোনাকালের এই ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ১৫৮ জন মানুষ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় একজন মানুষ। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৩৮৮ আর ২০১৮ তে ছিল ৪৬৬ জন অর্থাৎ গত কয়েক বছরে প্রতিদিন গড়ে একজনের বেশি মানুষ এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। আর গত ১০ বছরের হিসাব টানলে এই সংখ্যা ২০০০ ছাড়িয়ে যাবে। একরামুল বা সিনহার মত দুই/একটি অতি আলোচিত হত্যাকাণ্ড ছাড়া আর কোনোটিই মানুষ কিংবা মিডিয়ার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। এমনকি মানবাধিকার সংস্থাগুলো পর্যন্ত কেবলমাত্র একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেই তাদের দায় সেরেছে।



কোন সুস্থ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলতে পারেনা। অপরাধী যেই হোক, তার অপরাধের মাত্রা যত ব্যাপকই হোক না কেন প্রচলিত বিচার ব্যাবস্থা ছাড়া কারো মৃত্যু ঘটানো কোন সভ্য রাষ্ট্রের কাজ না। প্রতি নিয়ত এই ধরণের ঘটনার কথা শোনার ফলে মানুষের মধ্যে এই বিভৎসতার প্রতি এক ধরণের অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছে, যার সাথে যুক্ত হয়েছে বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা, ফলে বহু ক্ষেত্রেই দেখা গেছে মানুষ এই ধরণের ঘটনায় এক ধরণের উল্লাস প্রকাশ করে সমর্থন দিয়ে থাকে। যেমন কিছু দিন আগেই ধর্ষণের একজন আসামীকে ক্রসফায়ারে হত্যা করে যাবার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ির পাশে বহু মানুষের হাততালি দেয়ার ভিডিও ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়েছিল। আবার একরামুল হত্যার সময় তার কন্যার সাথে তার কথোপকথনের অডিও ছড়িয়ে পরলে তা বহু মানুষকে আঘাত করে। নড়বড়ে রাষ্ট্র কাঠামোতে মানুষের উল্টো পথে যে যাত্রা তাতে মানুষ তার মত করে অপরাধী নির্ধারণ করে এবং সেই মত তার কি ধরণের শাস্তি পাওয়া উচিত সেটিও তারাই ঠিক করে। প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের তীব্র অনাস্থা, নানা সময় অপরাধীদের বিচার না হওয়া, মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, হতাশা মানুষকে প্ররোচিত করে এই ধরণের ঘটনায় সমর্থন জানিয়ে উল্লাস প্রকাশ করতে।

একটি বিষয় খুব স্পষ্ট ভাবে বুঝতে হবে। বিচার বহির্ভূত হত্যা রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়। সেটি হোক একরামুল, সিনহা, বদি বা অন্য কেউ। অপরাধ যাই হোক না কেন সুষ্ঠ তদন্ত সাপেক্ষে আদালতের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কারো শাস্তি নিশ্চিত করা যায়না। যত দিন পর্যন্ত আমরা সকল বিচার বহির্ভূত হত্যার বিচার সমান ভাবে না চাইবো, সকল বিচার বহির্ভূত হত্যাকে সমান অপরাধ বলে গন্য করে সমান ভাবে ঘৃণা করতে না শিখবো, কিছু মৃত্যুতে শোক আর কিছু মৃত্যুতে আনন্দ জারি রাখব, ততদিন পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক ডেমাগগরা জনপ্রিয়তার লোভে সংসদে কিংবা বাইরে বিচার বহির্ভূত হত্যার পক্ষে তাদের অবস্থান জারি রাখবেন। ভেঙ্গে পড়া রাষ্ট্র কাঠামোয় এর চেয়ে বড় অভিশাপ আর কি হতে পারে?

  • লেখক রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী  

 

ডিজিটাল সেবায় ইলেকট্রনিক সিগনেচার


এম এন ইসলাম
 
বিশ্বায়নের নানা কর্মযজ্ঞ আর ডামাডোলে প্রস্তুতি চলছিল চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের। এর মধ্যেই করোনার আঘাতে ব্যবসার নানা কর্মকাণ্ডে প্রযুক্তি আরও বেশি আপন হয়ে উঠছে। তথ্যপ্রযুক্তির নানা ধরনের পরিষেবা বিস্তৃত হচ্ছে। বাংলাদেশেও দ্রুতগতিতে বাড়ছে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য। নতুন ধারণা নিয়ে দেশে নিয়মিত উঠে আসছে স্টার্টআপগুলো। সামাজিক নিরাপত্তা মেনে চলার প্রবণতার কারণে ই-কমার্সের মতো পরিষেবার ব্যবহার ও ডিজিটাল পেমেন্টের ব্যবহার বাড়ছে। কিন্তু ডিজিটাল কর্মকাণ্ডে পরিষেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কিংবা নিয়ন্ত্রকেরা কতটা তৎপর? ব্যবহারকারীর তথ্যের নিরাপত্তা বা আর্থিক নিরাপত্তাব্যবস্থাকে সুরক্ষিত, আধুনিকায়ন করা হলে বিশ্বমানের ডিজিটালাইজেশনের পথে থাকার গতি পাবে বলা যায়। তথ্যের নিরাপত্তাসহ আইনি ব্যাপারগুলোয় পরিষেবা প্রতিষ্ঠান বা সার্ভিস প্রোভাইডারের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রকদেরও ভূমিকা রয়েছে। আধুনিকায়ন বা পর্যাপ্ত ইকোসিস্টেম তৈরির জন্য এগিয়ে আসতে হবে নিয়ন্ত্রণকারীদের। প্রতিটি লেনদেন নিরাপদ বা প্রক্সিমিটি নিশ্চিত রাখার জন্য ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক সিগনেচার বা ডিজিটাল সার্টিফিকেট অপরিহার্য।

ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক সিগনেচার আসলে কী? মোটাদাগে বা সহজ কথায় বলা যায়, ইলেকট্রনিক সিগনেচারের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত করে ইউনিক এনক্রিপশন যুক্ত করে পাঠানো হয়, যাতে প্রেরকের তথ্য সঠিক বলে নিশ্চিত ধরা হয়।

পৃথিবীর অনেক দেশেই ইলেকট্রনিক লেনদেন বা ইন্টারনেট ব্যাংকিং, ই-গভর্নমেন্টের নানা পরিষেবা নিরাপদ, সুরক্ষিত রাখতে ডিজিটাল সিগনেচার ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে ওই সমস্ত দেশের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। ই-গভর্নমেন্ট, ই-কমার্স, ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোয় ডিজিটাল সিগনেচার ব্যবহার না করলে সেবাদানকারী, ব্যবহারকারীসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা বেশ কঠিন। ডিজিটাল পদ্ধতিতে নানা ধরনের নথিপত্রের বিনিময়েও ডিজিটাল সিগনেচার খুবই দরকারি উপাদান হিসেবে উন্নত অনেক দেশেই ব্যবহার হচ্ছে।


ইলেকট্রনিক সিগনেচারকে ডিজিটালাইজেশন ইকোসিস্টেমের একটি বড় উপাদান বলা যেতে পারে। তাই ডিজিটাল পরিষেবার রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বা মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোকে এটা নিয়ে কাজ করা উচিত। দেশে অবশ্য ইতিমধ্যে ইলেকট্রনিক সিগনেচার ব্যবহারের আইন ও অবকাঠামো তৈরি হয়েছে।

অপ্রতিসম (Asymmetrie) ক্রিপ্টোগ্রাফি (Cryptography) বা ক্রিপ্টোগ্রাফিক (cryptographic) প্রটোকলই আসলে ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক সিগনেচারের প্রতিরূপ। যেমন ধরা যাক, ক নামের ইন্টার ব্যাংকিং ব্যবহারকারী খ–কে ৫০ হাজার টাকা পাঠাবে। ক ব্যাংকিং সিস্টেমে লগইন করে, ডিজিটাল সিগনেচার যুক্ত করে লেনদেন সম্পন্ন করবে, যাতে নিশ্চিত হয় ক–ই ওই লেনদেন করেছে। কিংবা ব্যবহারকারী কোনো ই-কমার্স সাইটে লগইন হয়ে কোনো পণ্য কিনতে চাইছে আর পণ্যের দাম পরিশোধের জন্য তার ভার্চ্যুয়াল ওয়ালেট বা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করার জন্য তাকে ডিজিটাল সিগনেচার যুক্ত করে লেনদেন সম্পন্ন করতে হবে। ট্যাক্সে সার্ভিসের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার করা যেতে পারে। ডিজিটাল সিগনেচার ব্যবহারের জন্য পাবলিক কি (Key) আর প্রাইভেট কি (Key) থাকতে হয়। ইলেকট্রনিক সিগনেচারের মেরুদণ্ড হচ্ছে পাবলিক কির (public key) অবকাঠামো। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে বিশ্বস্ত সার্টিফিকেট কর্তৃপক্ষ (Certificate Authority)। সহজ কথায় বলতে গেলে সার্টিফিকেট কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রীয় আইন, বিশ্বমানের সঙ্গে নিয়মনীতি মেনে তার সিস্টেম প্রস্তুত করে।

ব্যবহারকারী সাধারণত তার কম্পিউটার, এক্সটারনাল ড্রাইভ, ক্লাউড ড্রাইভ বা মোবাইলে ডিজিটাল সিগনেচার সংরক্ষিত রাখে। যখন ব্যবহার করার দরকার পড়ে, তখন সংরক্ষিত ড্রাইভ থেকে এনে ব্যবহার করতে পারে। অনেক দেশেই সার্টিফিকেট বা সিগনেচার রেজিস্ট্রেশন কর্তৃপক্ষ ব্যাংক বা আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকে। তবে সার্টিফিকেট অথোরিটি সরকারি নিয়ম মেনে কিছু কোম্পানি, যাদের বিশ্বমানের পাবলিক কি অবকাঠামো ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা আছে, তারা পরিচালনা করে থাকে। এ ধরনের সিগনেচার ব্যবহার করার জন্য ব্যবহারকারী, পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাদের সচেতনতাও জরুরি। প্রযুক্তি নিয়ে নানা সেবা বা পরিষেবা প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের তাদের ব্যবসার তথ্য বা ব্যবহারকারীর তথ্যের সুরক্ষার সঙ্গে স্বচ্ছন্দ ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে ইলেকট্রনিক সিগনেচার প্রচলনে এগিয়ে আসতে হবে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, বিগ ডেটা আর ডেটার ভার্চ্যুয়ালাইজেশনের ব্যাপকতায় নানা ধরনের বাণিজ্যিক পদ্ধতি অচিরেই বহুগুণ বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা হবে নিরাপদ ব্যবসা ব্যবস্থাপনার। কোভিড-১৯–এর ধাক্কা সামলিয়ে প্রযুক্তি ব্যবসার ব্যবস্থাকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে ইলেকট্রনিক সিগনেচার কাজে লাগবে।

  • লেখক প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী প্রধান, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান টিকন সিস্টেম লিমিটেড
  • কার্টসি — https://bit.ly/3kc4WjD 

শুধু মাধবীর জন্য — ৪

মো: আসাদুজ্জামান



মাধবী,
‘তুমি আমার কোমল প্রাণ, মৌমাছি চোখ তোমার মধুর চেয়েও মিষ্টি, কেন তোমাকে লিখতে গেলাম... ?”
 
প্রেম ও দ্রোহের তুর্কি কবি, কবি নাজিম হিকমতের জেলখানার চিঠির অনুবাদ করে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এভাবেই প্রেম নিবেদনের উপাখ্যান তৈরী করেছিলেন! আজ আমি তোমাকে লিখছি কোন কারাগার থেকে নয়, লিখছি কবি নবারুন ভট্রাচার্যের মৃত্যু উপত্যকার দেশ থেকে, জল্লাদের রঙ্গমঞ্চ থেকে! এখন আমার মাঝে প্রচণ্ড রাগ, ক্ষোভ আর দ্রোহ কাজ করছে। লজ্জা করছে, নিজেকে হেলাল হাফিজের উত্তর পুরুষের ভীরু কাপুরুষের উপমা মনে হচ্ছে। একজন স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়া সেনা কর্মকর্তাকে কক্সবাজারে পুলিশ যেভাবে গুলি করে হত্যা করেছে সে বিষয়ে প্রতিবাদ, ঘৃণা, ক্ষোভ, ধিক্কার জানানোর ভাষা কোন বাংলা অভিধানে পেলাম না। সে আমার স্বজন, বন্ধু, পরিচিত কেউ নয়, সে আমার মানব সভ্যতার অংশ, সে একজন মানুষ । বহুবার তোমাকে বলেছি মাধবী, এদেশে বিনাবিচারে হত্যা মানুষের জীবনকে বিভীষিকাময় করবে, কেউ এখানে নিরাপদ নয়! আমার ভবিষ্যতবাণী আজ দেখলে তো? একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, একজন টগবগে যুবক, একজন সৃষ্টিশীল মানুষ মেজর সিনহাকে কিভাবে গুলি করে হত্যা করলো পুলিশের এক সাব ইন্সপেক্টর! থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নির্দেশ ছিলো বলেও তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। কি বর্বর, কি অসভ্যতার উদাহরণ, কতটা নরপশু এরা। খুনীদের ডিফেন্স এ বহুল প্রচলিত ইয়াবাজাতীয় গল্প সাজানো হয়েছে যে গল্প আমার তোমার মত দেশের কেউ বিশ্বাস করছে না। খুনীদের এখনো গ্রেফতার করা হয়নি। পরিবার-স্বজনের অভিযোগ মেজর সিনহা নির্দোষ, তাকে হত্যা করা হয়েছে। অভিযোগ সত্য না মিথ্যা তা প্রমানের জন্য পুলিশের প্রথম এবং প্রধান আইনী দায়িত্ব হলো নিয়মিত মামলা রুজু করে ওসিসহ সংশ্লিষ্ট আসামীদের গ্রেফতার করে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা, তদন্ত করা। যদি তারা নির্দোষ প্রমাণিত হয় তাহলে তারা খালাস পাবে। এটাই নিয়ম, এটাই আইন, এটাই ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসনের বাণী। কিন্ত, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয় ফৌজদারী কার্যবিধির আওতায় গৃহীতব্য পদক্ষেপকে পাশ কাটিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন যার কোন আইনী সংযোগ ফৌজদারী কার্যবিধিতে আমি পেলাম না। এধরনের কমিটি গঠন করা যায় The Commission of Inquiry Act, 1956 এর আওতায়। এই আইনের অধীন কমিশন সিভিল কোর্ট এর ন্যায় ক্ষমতা প্রয়োগ করে সাক্ষি হিসাবে যে কাউকে ডাকতে পারবে। তবে, কমিশনের সামনে প্রদত্ত বক্তব্য সংশ্লিষ্ট স্বাক্ষির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য মূল্যহীন ।


মাধবী, সরকার বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আমি মনেকরি, মেজর সিনহা হত্যার ঘটনায় সরকারের এই মনে করা,  এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ভুল, per in curium!
 
তবে হ্যাঁ, এই ধরনের সিদ্ধান্ত যদি সরকারের পলিসি হয় যার মাধ্যমে বিনা বিচারে এভাবে হত্যা করার সংস্কৃতি তারা চালু রাখতে চায় তাহলে আমার বলার কিছু নেই। সরকার যদি মনেকরে একজন সেনা কর্মকর্তার এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হলে প্যান্ডোরার বক্স ওপেন হয়ে যাবে, অতীত এবং ভবিষ্যতের সব ক্রসফায়ারের ঘটনায় মামলা হতে পারে যা তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য চ্যালেন্জ, তাহলে তদন্ত কমিটি গঠন করে সময় ক্ষেপন করা কোন ভুল নয়, নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘমেয়াদী করার কৌশল মাত্র! সেক্ষেত্রে আমার বলার কিছু নেই।
 
মাধবী, তোমাকে নিয়ে, তোমার প্রতি প্রণত হয়ে, হ্বদয়ের ভালোবাসা ব্যক্ত করার কোন emotion আজ কাজ করছে না! মেজর সিনহাকে এভাবে হত্যা করার যন্ত্রণা আমার ভালো লাগা, ভালোবাসার সব ইমোশনকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে, আমার আমিকে বিমর্ষ করে তুলছে। কি যে যন্ত্রনাময় যাপিত জীবন এটা তোমাকে বোঝানো যাবেনা, তোমার উপেক্ষার থেকেও যন্ত্রনাময়, তোমার জন্য অপেক্ষার থেকেও হৃদয়গ্রাহী কষ্ট এটা, তুমি বুঝবে না। ভালো থেকো মাধবী। 

  • আইনজীবি ও রাজনৈতিক কর্মী

মাধবীর জন্য ৩ — কল্পনার দেশের বিচার ব্যবস্থা

মোঃ আসাদুজ্জামান 


প্রাণেশ্বরী মাধবী আমার,

তুমি তো জানো  —  তুমি আমার স্বপ্ন, কল্পনা আর প্রাণাধিক মানবী! তুমি অস্তিত্বহীন হলেও কল্পনার নিখুঁত আঁচড়ে আমার জীবনে অনবদ্য, অনন্যা, আমার আঁধার কালোসময়ে আঁধার মানিক সম! মনটা আজ ভীষন বিক্ষিপ্ত। ইদানীং তোমার সাথে কথপোকথনের সময় সমসাময়িক সময়ের রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থা, মানুষের অধিকার হরণ, বিচার বিভাগের জীর্ণতা চিন্তার মাঝে ঢুকে পড়ে, তুমি হারিয়ে যাও অনন্ত অতলে। তোমাকে আজ এক মায়াবী রাষ্ট্রের বিচারাঙ্গনের কথা শুনাবো, যে গল্প বাস্তবের চেয়েও বাস্তব, তোমার কল্পনাতেও এই ব্যবস্থার এতো অবনতি আসবে না। আইনজীবি হিসাবে বিচার কর্মক্ষেত্র তথা বিচার বিভাগ নিয়ে আমার আগ্রহটা একটু বেশী! বিচারঙ্গন নিয়ে আমার আগ্রহ থাকলেও আমার কল্পনার সমস্ত জগত জুড়ে শুধু তুমি, অন্য কেহ নয়! কোন ভুল বুঝ না যেন।

মাধবী, তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ, ‘জাস্টিস ইজ ডিভাইন-ন্যায় বিচার স্বর্গীয়’ - এটা অনেক পুরানো একটি প্রবাদ বা তত্ত্ব । অনেক গল্প সিনেমায় এভাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে আমাদের গভীরে তাই ঢুকেছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেটা দেখেছি এবং দেখিও। তবে, যে কল্পনার রাষ্ট্রের কথা বলছি সেখানে এটা ক্রমাবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। নতুন তত্ত্ব হলো - ‘জাস্টিস ইজ ডিভাইডেড - ন্যায় বিচার বিভক্ত’। এই তত্ত্ব আজ সেই দেশের বিচার বিভাগ ক্ষয়িষ্ণু ধারায় প্রবাহিত। যার সুদূরপ্রসারী প্রভাবে সেই দেশ আজ গণতন্ত্রহীন, স্বৈরাচারের চারণক্ষেত্র । সেখানে যারা আইন আদালত নিয়ে একটু কাজ করে শুধু তাঁরাই নয়, সেদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যে কেউ এই তত্ত্বের অস্তিত্ব জানান দিবে। সমবেত কণ্ঠেই তারা বলবে, ন্যায় বিচার রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের vicious cycle এ বন্দি। সরকারি দলের নেতা কিংবা দুর্বৃত্তদের হাতেই অজস্র নাগরিক বিচারহীনতার শিকার হন। সে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেনো। এর প্রথম এবং প্রধান কারণ রাজনৈতিক দূর্বৃত্তায়ন বা criminalisation of politics এবং যার ফলে বিচার বিভাগ কিংবা বিচার বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট যে কোন অফিস কিংবা ব্যক্তিকে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে উন্নত হতে দেওয়া হয়নি বা সঠিক ভাবে Institutionalised করা হয়নি ।

জানো মাধবী, আমার কল্পনার সেই দেশে দুর্বৃত্তদের চৌকি পেরিয়ে বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রাথমিক সিঁড়ি তথা থানা-পুলিশ কিংবা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে পৌঁছানো এখন দুরহ ব্যাপার। সেখানে পৌঁছানোর আগে স্থানীয় রাজনৈতিক দূর্বৃত্তদের বিষাক্ত থাবা পেরোতে হয়। থানা পুলিশ বিচার বিভাগ নয়, তবে ফৌজদারী বিচারব্যবস্থার কিংবা ন্যায় বিচার বা বিচার যাই বলি না কেনো সেটা প্রাপ্তির প্রাথমিক স্তর। সেখানে বিচারপ্রার্থী একা গেলে অনেকটা উপেক্ষিত হয়, বিরোধী দলীয় কারও সাহায্যে গেলে অপমানিত হতে পারে, সরকার দলীয় লোকের মাধ্যমে গেলে সন্মানিত হবে এট নিশ্চিত। এটা এক ধরনের ‘ডিভাইডেড জাস্টিস’! সেদেশের আইনশৃঙ্খলা  রক্ষাকারী বাহিনীসহ অন্যান্য সরকারী সংস্থা অনেক মানবিক কাজ করেন, অনেক জনন্দিত কাজের জন্য তাঁরা সমাদৃতও বটে। কিন্তু বিরোধী দলীয় নেতা কর্মীদের দমনপীড়নে, ভিন্নমত রুখতে, রাতের নিকশ কালো আঁধারে মোমবাতির আলোয় ভোট কাটতে কিংবা গনতন্ত্র হত্যায় তাদের ভূমিকা সর্বগ্রাসী, সর্বনাশা, দেশ ধ্বংসের উন্মত্ত নগ্ননৃত্য। লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতার এমন দেশ, সে দেশের নাগরিকগন চায়নি মাধবী? এটা আমি নিশ্চিত ।

মাধবী, ন্যায় বিচারের ধারণা সম্পর্কে বলা হয়, Justice should not only been done, it should also seen to have been done! কিন্ত ঐ দেশের বিচার ব্যবস্থা উল্টো পথে চলছে। সম্প্রতি, কিছু কিছু মামলাতে সেদেশের জনগন উপলব্ধি করলো Injustice is not only been done, injustice is also seen to have been done!

সে যাইহোক, বিচারের জন্য সেদেশের মানুষ আদালতে যায়, সেখানে মামলার মেরিটের সাথে দেখা হয় আইনজীবি কে? বড় কোন হোমড়া চোমড়া না কি সাধারন কিংবা তরুন কোন আইনজীবি? সরকার দলীয় আইনজীবি নাকি বিরোধী দলীয় আইনজীবি? মামলার মেরিটের আগে উক্ত বিষয়গুলো মামলায় প্রতিকারের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। এই সংস্কৃতি আবহমান কাল থেকে সেখানে প্রচলিত থাকলেও, নীতিনৈতিকতার অবক্ষয়ের ফলে এই যুগে এটা অনেকটা দৃশ্যমান ভাবে প্রতিভাত! এটাও এক ধরনের ‘ডিভাইডেড জাস্টিস’, ‘ডিভাইন’ নয়! একজন বিচারপ্রার্থী আদালতের দ্বারস্থ হলে তাকে পুলিশ-কেরানী-মুহুরীর চক্রে ঘোল খেতে হয়। তারপর উকিল সাহেবরা তো আছেই! সেদেশের উকিল সাহেবদের স্বভাব চরিত্র এবং পয়সার প্রতি হ্যাংলামো তো তোমার জানার কথা! সেখানে উকিল সাহেবদের সম্পর্কে নাগরিকদের ধারনা খুব বেশী উন্নত নয়, সেই আদিকাল থেকেই। তারপর থাকে পেশকার-পিওন-আরদালী। সব পেরিয়ে বিচারকের সামনে গেলে তখন মেরিটের আগে উক্ত বিষয়গুলো আসে! ইদানীং শোনা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক লেনদেন, নেপোটিজম, সরকারের নিয়ন্ত্রন, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিচারকে কলুষিত করছে সেখানে! এটাও এক প্রকার ডিভাইডেড জাস্টিস, ডিভাইন নয় মাধবী!
মাধবী, সেই দেশের সুপ্রিম কোর্ট নিয়ে তোমাকে আর নতুন করে কি কথা বলবো! আমার দেশের এই প্রান্তর নিয়ে আমার প্রতিদিনের দহনের স্বাক্ষী তুমি! কল্পনার ঐ দেশের ন্যায় বিচারের ধারনা বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত ন্যায় বিচারের ধারনার থেকে কিছুটা হলেও distinct and separate। আমার এক কল্পিত বন্ধু তার পেশাগত জীবনের গত আড়াই দশক ধরে দেখেছে কিভাবে সেখানকার অনেক মাননীয় বিচারপতি মহোদয়গন ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা আইনজীবি সহকর্মীদের নির্লজ্জ-পর্দাহীনভাবে উন্মুক্ত আদালতে প্রশংসার জোয়ারে ভাসাতে থাকেন। এই ধরনের আচরনে উনাদের লজ্জা না লাগলেও, যে আইনজীবি বন্ধুকে এভাবে প্রশংসা করা হয় তিনি প্রথমদিকে কুন্ঠিত কিংবা বিব্রত হন। পরবর্তীতে অবশ্য উপভোগ এবং ভোগ করেন। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা প্রশংসা শুনতে ভালোবাসেন, আর আমার বন্ধুর বিজ্ঞ ক্ষমতাধর সহকর্মীবৃন্দতো রক্ত মাংসের মানুষ। যতদিন দল ক্ষমতায় থাকে ততদিনে সেখানে গোটা শহর ছড়িয়ে কারাগার পর্যন্ত পৌঁছে যায় কোন দেবতা কোন ফুলে তুষ্ট, অর্থাৎ, কোন বিচারকের সামনে কোন আইনজীবির নৈবেদ্য নিবেদন গ্রহনযোগ্য! পেশাগত জীবনে এই সংস্কৃতি দেখতে দেখতে আমার বন্ধুটি বড্ড ক্লান্ত মাধবী ।

আমার মনে পড়ে, কোন এক মামলায় আমারও এরকম অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। কোন এক মামলায় আমার প্রতিপক্ষ ছিলেন সাবেক এক মন্ত্রীর পুত্র । মান্যবর প্রিজাইডিং বিচারপতি ফাইল ধরেই আমার বক্তব্য পেশ করার পূর্বে আমাকে একটু বসতে বলে অন্যপক্ষের আইনজীবি, মন্ত্রি পুত্রকে পোডিয়ামে ডাকলেন, তাঁর কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁর বাবার কুশলাদি জানলেন। এরপর প্রায় আধাঘন্টা বিচারপতি মহোদয় মন্ত্রী বাহাদুরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, আমার একবারও মনে হয়নি তিনি এভাবে প্রশংসা করতে বিব্রত বোধ করছেন। পাশে বসা তাঁর ব্রাদার জাজ নির্বাক হয়ে শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে! এক পর্যায়ে, আমি বললাম, মাই লর্ড, মন্ত্রী মহোদয় এখনো বেঁচে আছেন, ফুল কোর্ট সভায় মৃত ব্যক্তিদের যেভাবে গুণকীর্তন করা হয়, সেভাবে না করলেও চলবে, উনার কানে গেলে উনি মাইন্ড করতে পারেন, একটু থামুন, আমার মামলাটি এখানে শুনানী করতে চাই না। মনে হলো, হিজ লর্ডশীপ জগতে ফিরলেন, মামলা দ্রুত শুনে রায় দিলেন, ফলাফল নিশ্চয়ই আপনাদের বলতে হবে না। কয়েকদিন পর তিনি আপীল বিভাগে এলিভেটেড হয়েছিলেন।

মাধবী, তোমাকে যে দেশের বিচার ব্যবস্থার কথা বলছি সেখানে মন্ত্রীর সন্তান, ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতাধর কিংবা পাতি নেতা, বিচারপতির সন্তান কিংবা স্ত্রী উচ্চ আদালতে প্র্যাকটিসে বিশেষ আনুকূল্য পান এটা সর্বজন বিদিত! এটাও এক ধরনের ডিভাইডেড , নট ডিভাইন, জাস্টিস!

জানো মাধবী, ঐ দেশটার সুপ্রীমকোর্ট সংবিধানের অভিভাবক! অভিবাবক দুর্বল হলে, অন্য সদস্যরা বখাটে হয়, চোর , ডাকাত, নৈরাজ্যবাদী কিংবা নষ্টামীর চরম সীমায় পৌঁছায়। যেমনটি হয়েছে ঐদেশের সকল সেক্টরে। সেই দেশের সুপ্রিম কোর্ট তথা সংবিধানের অভিভাবকের দুর্বলতার কারণে সংবিধান আজ পদদলিত, সেদেশ আজ গনতন্ত্রহীন, নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিষ্পেষিত। গণতন্ত্রের অন্যতম মৌল উপাদান ভোট বা ভোটাধিকার আজ সেখানে কাগজে আছে বাস্তবে নেই। বিনা বিচারে হত্যা, গুম, নির্যাতন আজ ফ্রাংকেনস্টাইন সেখানে। এ সবই সেখানকার সুপ্রিমকার্ট এর দুর্বলতা কিংবা নীরবতার ফসল বলে আমি মনে করি। সুপ্রীমকোর্ট এসব ক্ষেত্রে খুবই টেকনিক্যাল হয়ে যায়, পাশকাটানোর কৌশল অবলম্বন করেন। আর এই সুযোগেই গনতন্ত্রের সংগ্রামকে নস্যাৎ করতে নীতি নৈতিকতাহীন রাজনৈতিক দূর্বৃত্বায়ন সচল হয়, খুন-গুম-হেফাজতে মৃত্যু-ভোট ডাকাতির পথ ধরে গণতন্ত্র ধ্বংস হয়,স্বৈরাচারের শিকড় প্রথিত হয়, যা সেখানে হয়েছে।

মাধবী, অনেক অর্জন, অনেক সাহসী রায়, অধিকাংশ মামলায় ন্যায় বিচার করার নিরন্তর প্রচেষ্টা থাকলেও, সেখানকার বিচার বিভাগে আজ লোভ এবং ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যদিয়ে সময় পার করছে। লোভের জায়গা হলো উচ্চতর পদে যাওয়া, ভালো পোস্টিং কিংবা এখতিয়ার পাওয়া কিংবা অবসরের পর সেদেশের আইন কমিশন কিংবা অন্য কোন ট্রাইবুনাল বা আপীল ট্রাইবুনালে চাকরী পাওয়া। আর ভয়ের জায়গাটা হলো , কোন রকম হেনস্তা না হওয়া, জোরপূর্বক অসুস্থ বানিয়ে বাসায় অতন্দ্র প্রহরায় ছুটি না কাটানো কিংবা দেশ ছাড়তে বাধ্য না হওয়া, ঠিক যেমনটি ঘটেছিলো সেদেশের একজন সার্ভিস প্রধান বিচারপতির সাথে। এসবই সেই দেশের বর্তমান বিচারাঙ্গনের চিত্র। বিদ্যমান প্রধান বিচারপতিকে যেভাবে বের করে দেওয়া হয়েছে তা সমসাময়িক বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এই অন্যায়ের প্রতিবাদে সেদেশের কোন ন্যায় বিচারক পদত্যাগ করেন নি, তাদের বিবেক কিছু বলে নি মাধবী। সেদেশে বিচারকগন সহকর্মীর অধিকার লংঘন করে উপরে উঠতে চায়, কুন্ঠিত কিংবা বিব্রত হন না। কেউ না জানুক, তুমি তো জানো মাধবী , আমার বিশেষ সেই বন্ধুটি সেই নিগ্রীহিত প্রধানবিচারপতির ফ্যান ছিলাে না, তার কোন সুবিধাভোগী কিংবা উচ্ছিষ্টভোগী ছিলো না, তার favouratism এর beneficiary ছিলাে না। সে তার ঘোরতর সমালোচক ছিলো। কারন, সেদেশের গণতন্ত্র ধ্বংসের জন্য তার ভূমিকাও কম নয়, সেও বিচার বিভাগের অভিভাবকত্বের এখতিয়ারকে সংকুচিত করেছিলো। আর যখনই যে কোন কারনেই হোক ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছে, তখনই তার পরিণতি সে ভোগ করেছে। আর এটা ছিলো ঐ দেশের সব বিচারপতিদের জন্য একটা বার্তা, ভয়ের বার্তা। স্বাধীন দেশের একজন প্রধান বিচারপতি যখন অন্য কোন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চায়, নিশ্চয়ই তাকে বলতে হয় এদেশে গণতন্ত্র নেই, এখনকার বিচারবিভাগ একজন প্রধান বিচারপতির উপর হয়ে যাওয়া অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে না, ন্যায় বিচার দিতে পারে না। তাহলে সে দেশের সাধারন মানুষের কথা একবার ভাবতো মাধবী!

জানো মাধবী, আমাদের সুপ্রিমকোর্টে নিয়ে গর্ব এবং অহংকার করার মত অনেক কিছু আছে, এটি আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর এক অপূর্ব নিদর্শন, এর ভেতরকার সবুজ মনোরম পরিবেশ, ফুলের বাগান, পাখির ডাক আমাকে টানে, মুগ্ধ করে। তুমিতো জানো, কতটা দুরন্ত ও বিমোহিত হই এই প্রাঙ্গনের জন্য! তুমি ঈর্ষান্বিত হইও না, তোমার সাথে কারও তুলনা করি না। তুমি জেনে আনন্দিত হবে যে, এখানে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি আছে। এখানকার প্রবীণ আইনজীবীগণ নীতি নৈতিকতা আর জ্ঞান গরিমায় বিদগ্ধজন। তরুন আইনজীবিদের প্রানোচ্ছল মেধার প্রয়োগ আর সৃষ্টিশীলতা অনন্য। কিন্ত আমার ভয় হয় এরা হারিয়ে না যায়, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের cycle এ এরা নষ্ট হয়ে না যায়! তাহলে আমাদের, আমার এবং বাংলদেশের মানুষের এই রক্তস্নাত অর্জন-আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের সংবিধান, আমাদের সুপ্রিমকার্ট অরক্ষিত হয়ে পড়বে! বিদগ্ধ জনের অভাবে এখানে বিরানভূমি হবে, সমৃদ্ধ লাইব্রেরীর প্রয়োজনীয়তা হারাবে , আমাদের গর্বের স্বাধীনতা অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের কাছে হারিয়ে যাবে!

আজ আর নয় মাধবী! শুধু বলবো, তুমি কেমন যেন হিংসুটে হয়ে গেছো, আমাকে তোমার উপেক্ষা পোড়ায়, নীল বেদনা দেয়। তুমি যখন ভালোবাসবে তখন একবুক সমুদ্র নিয়ে ভালোবাসবে, এক বুক সমুদ্র, ঠিক আমার মতো !

  • লেখক — আইনজীবি ও রাজনৈতিক কর্মী।

Saturday, August 1, 2020

মনে রাখতেই হবে

------------------------------
শায়রুল কবির খান
------------------------------
শফিউল বারী বাবু

মঙ্গলবার, জুলাই ২৮, ২০২১, ভোর ৪টার দিকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পরে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হওয়া শফিউল বারী বাবু।


ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে ভর্তি হবার পর থেকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের রাজনীতিতে যুক্ত হন ছাত্ররাজনীতির প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা শফিউল বারী বাবু। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি দেশ ও জাতির কল্যাণে সচেতনভাবেই ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি। এক পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ও পরে আহ্বায়ক হন। এরপর যথাক্রমে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হন। এবং শেষ পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবক দলের সফল সভাপতি থাকা অবস্থায় ইন্তেকাল করেন তিনি।

বিনয়ী, স্বল্প-ভাষী, সৎ সাহসী এবং সমসাময়িক বয়সের অনেকের চেয়ে বেশি চিন্তাশীল উদীয়মান সম্ভাবনাময়ী নেতা বাবু মাত্র ৪৯ বছর বয়সে মারণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে আমাদের মাঝ থেকে হঠাৎই চলে গেলেন চিরকালের জন্য।

তার এ চলে যাওয়া আমাদের জন্য কত বড় কষ্টের তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। হৃদয় দ্বারা তা উপলব্ধি করছি এবং করে যাবো। আমাদের জন্যই, দেশের জন্যই, সর্বোপরি জাতীয়তাবাদীর শক্তির জন্য। এ প্রজন্মের ছাত্রনেতারা মনে রাখবে আগামী প্রজন্মের জন্য। কিভাবে তিনি শহীদ জিয়ার আর্দশ ধারণ করে, গণতন্ত্রের মা দেশনেত্রী বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার হাত ধরে দীর্ঘ গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আগামীর দেশনায়ক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা পালন করছেন। আমরা থাকে ভুলতে পারি? ভুলবো না- স্মরণে ও কর্মেই বেঁচে থাকবেন তিনি।

 
শফিউল বারী বাবুর সতীর্থ হিসেবে বিপরীত ধারার প্রতিযোগিতামূলক ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক ছাত্রনেতা ফজলুল হক নিজের ফেসবুক পেজের পাতায় এক লেখায় লিখেছেন, ছাত্রদলের রাজনীতির ইতিহাসে বাবু ভাইয়ের কাছাকাছি জনপ্রিয় ও সাংগঠনিক নেতা কখনো দেখেননি, ছিলেন বলেও বিশ্বাস করেননি। বর্তমান ছাত্ররাজনীতিতে ও আগামীর জন্য নিঃসন্দেহে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতে পারে তার এই উপলব্ধি।

বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের বিশ্বাসী এরকম একজন সম্ভবাবনাময় সংগঠকের অকাল মৃত্যু সামগ্রিক রাজনীতির জন্য সুখকর নয়।

বিদায় আমাদের প্রিয় নেতা শফিউল বারী বাবু, যার সাথে দেখা হলে কাছে আসার আগেই বিনয়ীভাবে সালাম বিনিময় করতেন। তিনি আর সেরকম করবেন না। বাবাকে হারিয়ে এতিম হওয়া আপনার দুটি শিশুসন্তান বড় হয়ে গর্বের সাথে সমাজে মাথা উঁচু করে যেন দাঁড়াতে পারে এই দোয়া করি।

ইনশাআল্লাহ আমরা আপনার আদরের সন্তানদেরকে আগলে রাখবো বাকি পথটুকুতে।

  • লেখক সহসভাপতি, জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা-জাসাস 
  • কার্টসি নয়াদিগন্ত/ আগস্ট ১, ২০২০  

Thursday, July 30, 2020

ব্যক্তি নয়, চাই সিস্টেমের পরিবর্তন


সায়ন্থ সাখাওয়াৎ 

এবারের বন্যায় সে চিত্র অনুপস্থিত। করোনা সেই মানবিক উদ্যোগকেও বাধাগ্রস্ত করেছে। অথচ এইবার দেশে বন্যার প্রকোপ গত তিন দশকের মধ্যে ভয়াবহ ও দীর্ঘমেয়াদি বলে ধারণা করা হচ্ছে। বন্যা যত দীর্ঘমেয়াদি হবে, বন্যাদুর্গত এলাকায় খাদ্যাভাব তত প্রকট হবে, পানিবাহিত রোগ তত বেশি হবে। কিন্তু এবার সেই সব বানভাসি মানুষের শুধুই সরকারি সাহায্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। তবে সরকারি সাহায্য কতটুকু তাদের কাছে পৌঁছবে আর কতটা দলীয় নেতাকর্মীরা লোপাট করে দেবে সেটার ধারণা করোনাকালে সরকারি ত্রাণ বিতরণেই পাওয়া গেছে। 

রাজধানী ঢাকা দুই-তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতেই কেন পানির নিচে ঢাকা পড়ে যায় সে নিয়েও আলোচনার সুযোগ মিলছে সামান্যই। গত পাঁচ বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে খরচ দেখিয়েছে ১ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা। আর ওয়াসা এ কাজে তিন বছরে খরচ দেখিয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা (প্রথম আলো, ২৭ জুলাই ২০২০)। তারপরও সামান্য বৃষ্টি হলেই ঢাকায় নৌকার কদর বেড়ে যায়। অনেকেই ঠাট্টা করে বলেন, এটাও সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ। সরকার হয়তো অচিরেই ঢাকায় দেশের চতুর্থ সমুদ্রবন্দর গড়ে তুলতে যাচ্ছে। কিন্তু ফেইসবুকে ট্রল করা ছাড়া এ আলোচনা বেশিদূর এগোতে পারেনি।

এমনকি ২০১৩ সাল থেকে অব্যাহতভাবে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন নিয়ে মেডিকেল ও  ডেন্টাল কলেজে অন্তত ৪ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার মতো ভয়াবহ ঘটনা সিআইডি ও সংবাদমাধ্যম উন্মোচিত করলেও তা নিয়ে আলোচনা ডালপালা মেলতে পারেনি। এই ৪ হাজারের মধ্যে অনেকেই ইতিমধ্যে চিকিৎসক হিসেবে সনদও পেয়ে গেছেন। এমন গুরুতর জালিয়াতির পথ ধরে যারা চিকিৎসকের মতো মহান পেশায় ঢুকে গেছেন বা পাইপলাইনে আছেন, তাদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত হতে যাচ্ছে সে বিষয়েও আমরা অন্ধকারেই রইলাম এখনো। আর সে সময় আমরা কিছু সংখ্যক মানুষ যখন টিভি টকশোতে প্রশ্নফাঁস রোধে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনা করছিলাম, দোষীদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি করছিলাম, তখন সরকারের পক্ষে সাফাই গাওয়ার লোকেরও অভাব ছিল না। তারা অবলীলায় বলে দিতেন, আমরা সরকার বিরোধিতার নামে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার উদ্দেশ্যে সমালোচনা করছি। এখন এই ভয়াবহ জালিয়াতির বাক্স উন্মুক্ত হওয়ার পরে তাদের কাউকে একটু শরমিন্দা হতেও দেখলাম না। হয়তো এ নিয়ে আলোচনা উঠলে তারা সেখানেও সরকারের কৃতিত্বই দেখবেন। সাফ জানিয়ে দেবেন, এ জালিয়াতি তো সরকারই ধরেছে, অন্য কেউ তো ধরেনি। যেমনটি বলছেন সাহেদ-সাবরিনা-শারমিন গ্রেপ্তারের পর। সংবাদমাধ্যমে বিশ^াসযোগ্য প্রমাণ ও ব্যাপক সমালোচনা আসার পরও প্রশ্নফাঁসের জালিয়াতি ধরতে তাদের এতটা সময় লাগল যে ততদিনে অনেকে ডাক্তার হয়ে রোগী দেখা শুরু করে দিয়েছে! এই ব্যর্থতার দায় তারা আড়াল করবেন স্বভাবজাতভাবেই। মেডিকেল-ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার মতো অত্যন্ত সংবেদনশীল পরীক্ষায়ও এই দশা হলে অন্যান্য ভর্তি পরীক্ষা এবং জুনিয়র সমাপনী, মাধ্যমিক সমাপনী, এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষায় যে কী স্তরের জালিয়াতি হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

করোনা সংক্রমণ অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকা অবস্থায় টেস্ট কমিয়ে দিয়েছে, পৃথিবীতে এমন একটা দেশই পাবেন। সেটা এই বাংলাদেশ। অন্য দেশগুলো যখন করোনা টেস্ট করতে আসার জন্য মানুষকে উৎসাহিত করছে, এমনকি আর্থিক সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে করোনা টেস্টের জন্য ফি ধার্য করে হতদরিদ্রদের টেস্টবিমুখ করা হলো। কোরবানির পশুর হাট ব্যবস্থাপনায় সরকারের অব্যবস্থাপনার ধারাবাহিকতাই প্রকট হচ্ছে। রোজার ঈদের সময়ে সরকারি অব্যবস্থাপনার খেসারত যেমন দেশবাসীকে দিতে হচ্ছে মৃত্যুর মিছিলকে দীর্ঘ করে, কোরবানির ঈদেও এই অব্যবস্থাপনার খেসারত সেভাবেই দিতে যাচ্ছি আমরা। অথচ সে বিষয়ে আলোচনাও মৃদু। আমরা পড়ে আছি রাঘব-বোয়াল ডাকাতদের পোষ্য ছিঁচকে চোরদের নিয়ে। এখানেও জালিয়াত চক্রটি বরাবরের মতোই রয়ে গেল অধরাই। 

দেশের প্রতিটা সেক্টরে চলছে চুরি, ডাকাতি, দুর্নীতি, লুটপাট, জালিয়াতির মহোৎসব। তার সঙ্গে কোনো না কোনো ভাবে সংশ্লিষ্ট সরকারি দল বা সরকারের লোকজন। এই দেশে সরকারি কেনাকাটায় ৩২০ টাকার বইয়ের দাম ধরা যায় ৮৩ হাজার টাকা, একটা আইসিইউ’র পর্দার দাম দেখানো যায় সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা, একটা বালিশ বিল্ডিংয়ের ওপরে বাসায় ওঠাতে খরচ দেখানো যায় সাত হাজার টাকা, করোনা মহামারীর কালে একটা ৫০০ টাকার গগলসের দাম ধরা যায় ৫ হাজার টাকা, একটা বঁটি-দায়ের দাম হয় ১০ হাজার টাকা। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বা ভাগবাটোয়ারায় বনিবনা না হলে ভেতরের কোনো সোর্স সংবাদমাধ্যমে জানিয়ে দিলে সেইটুকুই কেবল আমরা জানতে পারি। আমরা যেটুকু জানতে পারি তা আইসবার্গের ওপরের একবিন্দু বরফ মাত্র।

দেশের সব সেক্টরে একই অবস্থা। কিন্তু বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, অনিয়ম, জালিয়াতি নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে করোনার কারণে। সে কারণেই আমরা মেতে আছি সাহেদ-সাবরিনা-শারমিনকে নিয়ে। আমরা উল্লসিত হই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পদত্যাগে। আমরা আবার অশাবাদী হই একজন নতুন ডিজি পেয়ে। কিন্তু চোর-বাটপার-লুটেরা-দুর্নীতিবাাজ-জালিয়াত তৈরির সিস্টেম অক্ষুণ্ণ রেখে দুই-চারজন ছিঁচকে জালিয়াত ধরে, দুয়েকজন ব্যক্তির পরিবর্তন ঘটিয়ে কি কোনো লাভ হয়?

ধরা যাক, একটা পুকুরে মাছের মড়ক লেগেছে। সেই পুকুর থেকে দু’চারটা মাছ তুলে আনলে, সেগুলো ডাঙায় এসে ছটফট করে মরে যেতে পারে। আবার অনুকূল পরিবেশ পেলে বেঁচেও যেতে পারে। কিন্তু ওই পুকুর কি তাতে পরিশুদ্ধ হয়ে যাবে? বাকি মাছের পচন থামবে? বরং বাইরে থেকে এনে সেখানে যে মাছ ছাড়া হবে, সেগুলোও অসুস্থ হয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে।

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে পচন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার, মানবাধিকার, সুশাসন, সুবিচার, আইনের শাসন, রাজনীতি, শিক্ষা কোথায় পচন ধরেনি? বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো বাতাস কোথায় আছে এই দেশে? ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, দরিদ্ররা যাচ্ছে আরও নিচে। কোথায় ভারসাম্য?

কিন্তু কে টেনে তুলবে এই দেশটাকে? সে আশার বিন্দু কি আদৌ আছে এদেশে? হয়তো নেই। নেই বলেই শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে দেশত্যাগের হিড়িক। একটা প্রজন্মের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, এই দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমাদের রাষ্ট্র পরিচালকরা নিজ পরিবারের পরের প্রজন্মকে দেশে রাখার চেয়ে বিদেশে রাখাই শ্রেয় মনে করেন। এই দেশে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না করে লেখাপড়ার জন্য তাদের সন্তানদের পাঠিয়ে দেন বিদেশে। সেখানে গিয়ে তাদের কতজন লেখাপড়া করেন আর কতজন দেশ থেকে পাচার করা অঢেল অর্থ দিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করেন সে হিসাব কতটুকুই-বা জানি আমরা! বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের বড় একটা অংশ যে এদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ সেটা বোঝা যায় তাদের বিদেশে টাকা পাচার ও সেকেন্ড হোম করার প্রবণতা দেখে।

আমাদের সামনে যখন কোনো বড় দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা বা অঘটনের খবর আসে, তখন সেটা নিয়ে কিছুদিন আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে। আরেকটি বড় ঘটনা এসে ঢেকে দেয় পুরনোটাকে। এভাবে ইস্যু দিয়ে ইস্যু ঢেকে দেওয়া হয়। আমরা ইস্যুর পেছনে দৌড়াতে থাকি। ঘটনার মূলে যেতে চাই না। সিস্টেমের গোড়ায় হাত দিতে মানা। কখনো লোকদেখানো টোটকা ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এই টোটকা ব্যবস্থা বা ব্যক্তির পরিবর্তন যে কোনো স্থায়ী সুফল বয়ে আনে না সে বিষয়ে কি আর কোনো সন্দেহ আছে?

কার্টসি — দেশ রূপান্তর/ জুলাই ৩০, ২০২০  
 লিঙ্ক —     https://bit.ly/2BGIz4m   

Wednesday, July 29, 2020

শুধু মাধবীর জন্য — দুই


মো: আসাদুজ্জামান 

শিরোনামহীন মাধবী,


বিখ্যাত মানবাধিকার কর্মী, আমেরিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এর স্মরণীয় উক্তি “We will remember not the words of our enemies, but the silence of our friends.” নিশ্চয়ই পড়েছো? তুমি নিশ্চয়ই অনুভব করতে পারো মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এর উপরিউক্ত উক্তির প্রাসঙ্গিকতা আজকের বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে কতটা যৌক্তিক এবং বাস্তব। উক্ত উক্তির সাথে মিলালে দেখবে একদিকে গুটিকতক লুটেরা, চালচোর, গমচোর, আইনী পোষাকের খুনী, ভোটডাকাত আর করোনার সার্টিফিকেট বিক্রেতাদের অপকর্ম এবং নীতিবাক্য আর অন্যদিকে আমাদের সব মানুষ, সব বাংলাদেশী , সব বাঙালীর সীমাহীন নীরবতা। ব্যাপক মানুষের নীরবতায়, নিত্যদিনের জুলুম-নির্যাতন-নিপীড়ন-অনাচার-অবিচার আর মৃত্যু নিয়ে খেলা করা শোষক গোষ্ঠী আজ জাতির জীবনে জগদ্দল পাথরের মত ভারী পাহাড়ের মত বসে আছে । সময়টা বড়ই নিষ্ঠুর, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য বড় অসময় এটা ।

জানো মাধবী, মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সমীক্ষায় বলছে ২০২০ সালের ২৫ জুন পর্যন্ত ১৩৪জন মানুষ এদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে, সীমান্তে ভারতীয় নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতে এই ছয় মাসে ২৫ জন নীরিহ বাংলাদেশী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এই করোনাকালীন মহামারীতেও শাসকদের কোন মানবিকতা নেই, মানবিক মূল্যবোধ কিংবা বিবেক বোধ নেই । কতটা নিষ্ঠুর , কতটা অমানবিক স্বৈরাচার কিংবা নৈরাজ্যবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা হলে এতটা নিষ্ঠুরতা দেখানো যায় বলো ! মাঝে মাঝে মনে হয়, তুমি এতটা নিষ্ঠুর নও, তুমি মানবিক, তোমার দেওয়া যন্ত্রনা যাপিত জীবনে মৃত্যুসম হলেও মৃত্যু নয় প্রিয়তমা আমার!!

মনটা ইদানীং ভীষন খারাপ থাকে। পরীক্ষা ছাড়া করোনার নেগেটিভ সার্টিফিকেট বিক্রি করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে, যার চেয়ারম্যান জনৈক সাহেদ, যিনি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপকমিটির একজন সদস্য বলে সোস্যাল মিডিয়ায় দেখলাম। একই অভিযোগ উঠেছে এক ডাক্তার দম্পতির বিরুদ্ধে এবং তারাও আওয়ামী রাজনীতির অনুসারী। আমি বলছি না এদের কর্মকাণ্ড আওয়ামীলীগের কোন কমিটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত। তবে, এদের সকল অবৈধ কর্মকাণ্ডের মূল প্রেরণা তাদের রাজনৈতিক চেতনাবোধ। কারণ, যখন তারা দেখে তাদের দল কিংবা দলীয় নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে মধ্যরাতে ভোট ডাকাতি, নির্বচারে খুন-গুম, মিথ্যা মামলা-হামলায় প্রতিপক্ষকে দমন পীড়ন, বিচার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ , প্রশাসন অথবা রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিরঙ্কুশভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা কিংবা ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি বা সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও ‘culture of impunity’তে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, তখন তারা সাহস পায়, অনুপ্রাণিত হয়,  এক একটি সাহেদ তৈরী হয়, দেশের মুখে কালিমালিপ্ত হয় । তারা জানে, তাদের জন্য উন্নত দেশে বেগম পাড়ার সুব্যবস্থা আছে, প্রয়োজন মত পালিয়ে যাওয়া যায়, যেমন পালিয়ে গেছে অপহরণ মামলার আসামী সিকদার গ্রুপের পরিচালকদ্বয় । কিন্ত তারা উপলব্ধি করে না তাদের অপকর্মের দায় এবং ভোগান্তি নিতে হয় গোটা জাতিকে। যেমন নিতে হচ্ছে ইতালিতে বাংলাদেশের ফ্লাইট বন্ধ হওয়ার যন্ত্রনা, কুয়েতে রাতের ভোটের এমপি গ্রেফতার হওয়া, বিশ্বের দেশে দেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ম্লান করার ঘটনাসমুহ ।

আমার সবচেয়ে কষ্টের জায়গাটা আজ অন্য একটি খবর দেখে। দেখলাম বিএনপি’র এমপি হারুন সাহেব সংসদে দাঁড়িয়ে করোনার সার্টিফিকেট বিক্রেতা রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদের ক্রসফায়ারে হত্যার দাবী জানিয়েছেন। এই দাবী কখনো বিএনপির দাবী হতে পারে না। আমার জানামতে বিএনপি সাহেদদের অপকর্মের বিচার চায়, দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি চায়, তবে সেটা ক্রসফায়ারে নয়, বিচারিক প্রক্ক্রিয়ায় । কারণ, ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত গত দশ বছরে বিএনপি ক্রসফায়ারে তাদের ২, ৮১৭জন সতীর্থকে হারিয়েছে, ৬০১ জন বিএনপির সহযোদ্ধা গুমের শিকার হয়েছে, ৭৯৫ জন মানুষ পুলিশ হেফাজতে মারা গেছে। বিএনপি উপলব্ধি করেছে ক্রসফায়ার অসাংবিধানিক, বেআইনী, মানবতাবিরোধী! এমপি হারুনের এই দাবী আমাকে ব্যথিত করেছে। আমি এমপি হারুনের এই দাবী প্রত্যাখ্যান করি; আমি শাহেদগংদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করি প্রিয় !

প্রিয়, তুমি আমার আঁধার মানিক, আমি তোমাতে প্রণত, তোমাতেই আমার ভালোবাসার নৈবেদ্য নিবেদন করা, তুমিই আমার শেষের কবিতার লাবণ্য। তোমার সাথে আমার দেখা হয় না, হয়তোবা কোন জন্মেও দেখা হবে না, কথা হবেনা, আর সেটা তুমি দ্ব্যার্থহীন ভাবেই বলেছো। তবে তোমার সাথে আমার প্রতিদিন কথা হয় কল্পনায়-মনেমনে, মনের সবক’টা জানালা খুলে দিয়ে। এখানে তোমার নিয়ন্ত্রণ রেখা কাজ করে না। তারপরও, এই দু:সময়ে আমার সকল শান্তি, সব প্রগতি, তাবৎ প্রেরণার নিরন্তর উৎস তুমি ।

জানো মাধবী, রাষ্ট্রের নিপীড়ন নির্যাতনের সংস্কৃতি আজ ব্যক্তি জীবনে - ভালোবাসার মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে । আজ এক ভদ্রলোক আমাকে ফোন করে তার ভালোবাসার কথা, প্রতারিত হওয়ার রসায়নের কথা বললো, উপদেশ চাইলো। তার সমস্যাটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই রকম — 

সে একটি মেয়েকে গভীরভাবে ভালোবেসেছিলো, মেয়েটিও বেশ কয়েক বছর ছেলেটির সাথে ভালোবাসার অভিনয় করে গেছে। ছেলেটির সাথে অভিনয় করাকালীন সময়ে মেয়েটি তার অন্য ছেলে বন্ধুদের সাথে সারারাত ভিডিও কলে থাকতো, কেউ কেউ তাদের নতুন এ্যাপার্টমেন্ট সাজানোর জন্য ডাকতো, লাল -সবুজ শাক -সবজি কিনে বাসায় আসতো, কেউ বা হাগ করার প্রস্তাব দিতো! মেয়েটি প্রতিরাতে সারারাত অন্য বন্ধুদের সাথে ভিডিও কলে কথা বলায়, সারাদিন চাকরী এবং অন্য বন্ধুদের সাথে ব্যস্ত সময় কাটানোর জন্য তার পর্যাপ্ত ঘুম হতো না, মেজাজ খিটমিটে হয়ে থাকতো এবং এর প্রভাবে প্রতিদিন তার বাঁধা ভালোবাসার মানুষটাকে মানষিক, এমনকি কখনো কখনো শারিরীক নির্যাতনেও অতিষ্ঠ করে তুলতো মেয়েটি। ছেলেটি জানালো, মেয়েটির বয়স্ক এক ডাক্তার অনুরাগী ছিলো, সে পৃথিবীর যেখানেই যেতো না কেন মেয়েটি ছিলো তার মুভমেন্ট রেজিষ্ট্রার, প্রতি মূহুর্তের খবর মেয়েটিকে পাঠাতো। একদিন বয়স্ক অনুরাগী প্রেমের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মেয়েটির জন্য মোমবাতির আলোয় ডিনারের আয়োজন করেছিলো, তখন মেয়েটি যার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করে যাচ্ছিলো সেই ছেলেটিকে নিজের বাসায় কয়েক ঘন্টা বসিয়ে রেখে দিব্যি মাঝরাত অবধি অবলিলায় ডিনার করে এসেছিলো। ছেলেটি কিছুদিন পরে এ ঘটনা জানতে পারে, হ্রদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, প্রতারিত হয়েছে বলে তার মনে হয়। রক্ত মুছে মেয়েটির ভালোবাসায় সে আবারো বুঁদ হয়ে থাকে। এভাবেই চলছিলো, সর্বশেষ ছেলেটি দেখতে পায় মেয়েটি করোনাকালীন সময়ে অন্য নতুন একজনের সাথে গাড়ীতে ঘুরছে, ফিরছে বাজার করছে, লাঞ্চ-ডিনার করছে। বেচারী বাঁধা ভালোবাসার মানুষটি যতবার মেয়েটির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে ততবারই মেয়েটি দূ্র্ব্যবহার করে তাড়িয়ে দিয়েছে। সর্বশেষ মেয়েটি জানিয়ে দেয় যে, তাঁর সাম্প্রতিক বন্ধুটি তাকে অনেক মূল্য দেয়। বাঁধা ছেলেটির মনে হয়েছে সে একটি নিলামের চক্করে আছে, সে এখন জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে, তার ভালোবাসা এখন নিলামে বিক্রি হচ্ছে! ঠিক যেমন করোনার সার্টিফিকেট শোষক গোষ্ঠীর প্রচ্ছন্ন মদদে বিক্রি হয়। ছেলেটি জানতে চায়, সে এখন কি করবে? আমি কোন উত্তর দেইনি, ভেবেছি, তোমাকে জিজ্ঞাসা করবো। এটাও কি সম্ভব মাধবী? প্রেমেরও কি নিলাম হয়? ডাক্তারের করোনার সার্টিফিকেট বিক্রির খবর পড়ে ছেলেটির কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে , তার নিদ্রাহীন নিশীথ রাতের সাথী হতে ইচ্ছে হচ্ছে !!

আজ আর নয়, ভালো থেকো সারাদিন, সারাক্ষণ। আমার কল্পনার সব রঙ তুলিতে তোমাকে সাজানো, তোমাকে কেউ নিলামে উঠাতেই পারবে না মাধবী। তুমি আমার একাকীত্বের দোসর, তুমি আমার জোৎস্না  রাতের মাহিন !!

— লেখক আইনজীবি ও রাজনৈতিক কর্মী
১০ জুলাই ২০২০, ঢাকা ।

বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও ভোটাধিকার নিয়ে বিএনপির ‘মাথাব্যথা’ কেন

আহাদ আহমেদ

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপি’র মূল পরিচয় তারা সার্বভৌমত্বের পক্ষের রাজনৈতিক দল। সার্বভৌমত্ব কথাটার সঙ্গে একটা দেশের শুধুমাত্র ভৌগোলিক স্বাধীনতা বুঝায় না। বুঝায় তার

 

রাজনৈতিক স্বাধীনতা, নিজের শাসক নির্বাচনের স্বাধীনতা,তার সম্পদের উপর দখল ও ব্যবহারের স্বাধীনতা। এর সবকিছু নিয়েই সার্বভৌমত্ব। তাই বাংলাদেশের বন, বাংলাদেশের নদী, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, বাংলাদেশের খনিজ ইত্যাদির উপরে দখল থাকার এবং জনগনের নিয়ন্ত্রণ থাকার অর্থই হলো সার্বভৌমত্ব। অন্যদিকে রাষ্ট্রে একমাত্র জনগণ হলো সার্বভৌম।
জনগণ তার এই সার্বভৌম ক্ষমতার ব্যবহার করে থাকে ভোটাধিকার প্রয়োগ করার মধ্য দিয়ে। জনগণের ভোটাধিকার হরণ হওয়া আর সার্বভৌমত্বের বিনাশ একই কথা। 

কোন একটি রাষ্ট্রে তার সার্বভৌমত্বের পক্ষে লড়াই করা সেই দেশের জনগণের দেশপ্রেমের মধ্যে পড়ে ও  এটা একান্ত কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে । 

ভারতীয় উপমহাদেশে সত্যাগ্রহ, স্বাধীনতা, স্বদেশী আন্দোলন গুলি আসলে জনগণের সার্বভৌম অধিকার হিসেবে বিবেচিত।এই সব অনেক আন্দোলনে জনগণ জীবন দিয়ে সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে। 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছিল যেটা ছিল তার সার্বভৌম অধিকার।

সার্বভৌমত্ব মানে জীবনের ওপর অধিকার, ভোটাধিকার, নেতা নির্বাচিত করার অধিকার, সম্পদের ওপর অধিকার। আজকের বাংলাদেশে দেশের জনগণের নিজের জীবনের ওপর তার কোন অধিকার নাই। যে কোনো ঠুনকো অজুহাতে আজ বাংলাদেশের মানুষের উপরে নেমে আসে বিভীষিকাময় অত্যাচার। দেশের ‘স্বনির্বাচিত’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়শঃ তার পিতা-মাতা-ভাই-বোনসহ আত্মীয়  পরিজনদের  হত্যা নিয়ে শোকাভিভূত হন ও কান্না করেন। যা অত্যন্ত হৃদয় বিদারক। তিনি তখন বিদেশে ছিলেন। কিন্তু কক্সবাজারের  ইকরাম কে যখন হত্যা করা হয় তখন ‘দৈব দূর্বিপাকে’ পড়ে গুলিতে মৃত্যুপথযাত্রী  পিতার গোঙ্গানি শুনতে হয় তার ‘ভাগ্যবতী’ কন্যাদের ও স্ত্রীর।এমন ঘটনা বিরল। এমন কি  নাজী ক্যাম্পেও এই ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয় না। দেশে গুম খুন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সব চলছে নির্বিচারে। 
ঢালুর দেশ হিসেবে বাংলাদেশ উজানের দেশের পানি প্রত্যাহারের শিকার। কয়লাভিত্তিক  বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের নামে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। জল, জমি, জলাশয় বিষাক্ত বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। সিলেটের নীচু সুনামগঞ্জসহ হাওর বাওর আজ হুমকির শিকার। উত্তরের জনপদে মরুকরণ স্পষ্ট  হচ্ছে। দক্ষিণে লবনাক্ততা গ্রাস করছে। লবন সহিষ্ণু ধান আবিষ্কার এটার সমাধান নয়।
বাংলাদেশের দীর্ঘ সীমান্ত জুড়ে একদিকে ভারত কাটাতারের বেড়া দিচ্ছে। অন্যদিকে মায়ানমার তার দেশের প্রায় ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে এথনিক ক্লিনঞ্জিংয়ের নীতিতে বাংলাদেশের ভুমিতে ঠেলে দিয়েছে। তাই শুধু ভারত নয়, মায়ানমারও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সীমান্তে দাড়িয়েই শুধু  যে সার্বভৌমত্বকে হুমকি দেয়া যায়, তা নয়। আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থায় স্যাটেলাইট রাষ্ট্রও একটা দেশ  বা অন্য একটি দেশের সার্বভৌমত্বকে হুমকিতে ফেলে দিতে পারে। 


বাংলাদেশে যে মুহূর্তে ভারতের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক নির্ধারণের চেষ্টা করে একটি বিশেষ দল তার প্রতিবন্ধক হিসেবে সামনে এসে দাঁড়ায় দলটির নাম আওয়ামী লীগ। আওয়ামীলীগ একটি ধারণা ভারতের জনমানসে ও তাদের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে দেবার চেষ্টা করে। ধারণাটি হলো আওয়ামীলীগ ব্যতীত প্রায় সব রাজনৈতিক দলই ভারতের বিরুদ্ধে। ভারতের বিরুদ্ধে ও ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে এটির মধ্যে সীমারেখা টানা অত্যন্ত জরুরী।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপি যখন ভারতের ব্যাপারে কোন বক্তব্য দেয় তখন সেটাকে ভারতের পক্ষে অথবা ভারতবিরোধী হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভারতের বিরুদ্ধে যে বক্তব্য দেয়া হয় সেটা ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে নয়। অনেক সময় ভারতের শাসক রাজনৈতিক দল গুলি বাংলাদেশের বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। ফলে সেই দলের সাথে সম্পর্ক রক্ষাই হয়ে দাঁড়ায় ভারতের বাংলাদেশ সম্পর্ক নীতি। এটার সাথে দুই দেশের জনগণের বন্ধুত্বের, সহযোগিতার কিংবা সম্পর্ক উন্নয়নের কোন দূরবর্তী সম্পর্কও নেই। ভারত যে কারণে নগ্ন হয়ে গণবিচ্ছিন্ন সেই রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের জনগণ তখন আহত হয়। প্রতিবেশী দেশকে তখন তার বন্ধুপ্রতিম ভাবতে অনেক সমস্যা হয়। ভারত একটি দলের হয়ে যখন তার সকল অপকর্ম হত্যা, নির্যাতন, গুম , বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মেনে নেয় বাংলাদেশের মানুষ তখন ভারতকেই তার সাক্ষাতশত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। প্রতিবেশী যখন একটি ইচ্ছা নিরপেক্ষ বিষয় তখন সেই বৃহৎ প্রতিবেশী দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় তার নামে কোন নিপীড়ন যখন অন্য দেশে চলে সেটাকে প্রতিরোধ করা। এই জায়গায় ভারতের প্রতি বিএনপি'র দৃষ্টিভঙ্গি হল যদি ভারত নিজেকে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয় তবে জনতার পক্ষ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলা তার নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে দাঁড়ায়।

২০০৫ থেকে ভারত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা পালন করছে ইউএসএ'র সেক্রেটারি অফ স্টেট  ২০০৫ সালে ভারতের সঙ্গে এ ধরনের একটা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। একসময় যখন আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ও মুসলমান রাষ্ট্রগুলিকে দেখার জন্য চোখ হিসেবে ব্যবহার করত পাকিস্তানকে। ঠিক একইভাবে ২০০৫ সালের পর থেকে আমেরিকা ভারতকে দক্ষিণ এশিয়া দেখার একটি চোখ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। এর পিছনে মূল যে কারণ সেটা হল ভূমিতে চায়না কে ঘিরে ফেলা। ইতোপূর্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে মধ্য এশিয়ার সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র গুলি ইতোমধ্যেই আমেরিকার সেই লক্ষ্যের সাথে একমত পোষণ করেছে। মোল্দাভিয়া, কিরগিজস্তান, তাজাকিস্তান, উজবেকিস্তানসহ চায়নার সীমান্তবর্তী সব কয়টি সাবেক সোভিয়েতভুক্ত রাষ্ট্রগুলিতে আমেরিকা একটি শক্ত পোক্ত অবস্থান নিয়ে নিয়েছে। একমাত্র চীনের সীমান্ত জুড়ে  ভারতের স্থল সীমান্ত দখলে ছিল আমেরিকার লক্ষ্য।

আমেরিকা চীনের সীমান্ত জুড়ে স্থল বিভাগে অবস্থান নেয়া একটা মাইন্ড গেইম ছাড়া কিছুই নয়।

ভারত নিজে ১৭২১-১৯৪৯  অবধি প্রিন্সলি স্টেট বা করদ রাজ্যের মর্যাদায়  ছিল। অসংখ্য করদ রাজ্যের সমাহার ভারত। এক সময়ে তোপ রাষ্ট্র ( Gun State) বা স্যালুট (Salute State) রাজ্যের দেখা পাওয়া যেত উপমহাদেশে। শুধুমাত্র তোপধ্বনি বা স্যালুট প্রদানের মধ্যদিয়ে রাজ্যের সম্মান দেয়া হতো।

এইরকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া  রাষ্ট্র  ভারত। তাই বিগড্যাডি সুলভ আচরণ তার কাছে কাম্য নয়।
পাকিস্তান তার চেয়ে ৭ গুন বড় দেশ ভারতের সাথে নিউক্লিয়ার ভারসাম্য তৈরি  করেছে। এর অর্থ হলো লড়াইটা  আর অসম থাকে না।পরমাণু সক্ষমতা উভয়ের মধ্যে সমতা এনে দিয়েছে।

কোন নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দুর্বল অনির্বাচিত সরকার গঠন করা ও করতে দেয়াও সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করা। এই কাজ যদি আজ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, নেপাল বা চায়না করে  তবে সেই দেশগুলিও হবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের শত্রু। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে যে কোন পরিসরে চ্যালেঞ্জ করলে সেটা নামে যে দেশই হোক না কেন তার বিরুদ্ধে কথা বলা একটা দলের জন্য দায়িত্ব হয়ে পড়ে।

বিএন পি ও দেশনেত্রী  বেগম খালেদা জিয়া তাই বলেছিলেন বাংলাদেশকে পাকিস্তানী কায়দায় চালাচ্ছে আওয়ামীলীগ। বিএনপি একটি বাংলাদেশপন্থী রাজনৈতিক দল। আজ তাই একটি বৃহৎ  ঐক্যের ওপর জোর দেয়া দরকার। ভবিষ্যতের এই ঐক্যের ভিত্তি  হবে বাংলাদেশপন্থীতা। এই ঐক্য  তাদের সাথেই হবেঃ

 ১.যারা বাংলাদেশের পক্ষে  ও তার জনগণের ভোটাধিকারের পক্ষে
২.যারা আওয়ামীলীগের  আদালত বুভুক্ষার (Court Hungriness) বিপক্ষে 
৩.যারা বিনাবিচার-অবিচার-অতিবিচারের নামে বিচারহীনতার বিপক্ষে
৪.যারা বিচার বহির্ভূত ও গুম খুনের বিরুদ্ধে
৫.যারা বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক জলবায়ু, জমি, জলাশয়,পরিবেশ রক্ষার পক্ষে
৬. সর্বোপরি যারা অন্যায়ভাবে বানোয়াট মামলা দিয়ে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার ও  মিথ্যা মামলায় কারাবন্দী করে রাখার বিরুদ্ধে
অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলির সাথে সার্বভৌমত্ব মানে জীবনের ওপর অধিকার। ভোটাধিকার, নিজের নেতা নির্বাচিত করার অধিকার, সম্পদের ওপর অধিকার নিয়েই এই ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।

সরকার বলতে আওয়ামীলীগের  হাতে এখন কিছু নেই যেটা আছে সেটা সরকারের মমি। যার সব আছে শুধু প্রাণ নেই।

বাংলাদেশ  ও জনগণ সার্বভৌম না হলে এদেশের, রাষ্ট্রের  উন্নয়নের গল্প ফানুসে পরিণত হবে।পাশের বড় ‘বন্ধু প্রতিম’ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে একটা অসফল ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ ফেইল্ড  বা অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে দেখানো। এর মধ্য দিয়ে সে তার  নিজ দেশের অখণ্ডতা বজায় রাখতে চায়। তাই যে কোন দেশপ্রেমিক নাগরিকের  দায়িত্ব বাংলাদেশকে গনতন্ত্রের বহুত্বের পরিমাপে অনেক বেশি স্বাধীন ও সার্বভৌম  রাখা। বিএনপি এই লক্ষ্যে কাজ করে তার নেত্রী চরম প্রতিংসার মুখেও ভেঙ্গে পড়েন না, অবিচল থাকেন। এটাই বিএনপির শক্তির জায়গা। এইসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ  যে কোন সময় গণবিক্ষোভে ফেটে পড়বে তার আলামত স্পষ্ট  হচ্ছে।
  • লেখক কেমিস্ট এবং রাজনীতিবিদ