মো: আসাদুজ্জামান
বিখ্যাত মানবাধিকার কর্মী, আমেরিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এর স্মরণীয় উক্তি “We will remember not the words of our enemies, but the silence of our friends.” নিশ্চয়ই পড়েছো? তুমি নিশ্চয়ই অনুভব করতে পারো মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এর উপরিউক্ত উক্তির প্রাসঙ্গিকতা আজকের বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে কতটা যৌক্তিক এবং বাস্তব। উক্ত উক্তির সাথে মিলালে দেখবে একদিকে গুটিকতক লুটেরা, চালচোর, গমচোর, আইনী পোষাকের খুনী, ভোটডাকাত আর করোনার সার্টিফিকেট বিক্রেতাদের অপকর্ম এবং নীতিবাক্য আর অন্যদিকে আমাদের সব মানুষ, সব বাংলাদেশী , সব বাঙালীর সীমাহীন নীরবতা। ব্যাপক মানুষের নীরবতায়, নিত্যদিনের জুলুম-নির্যাতন-নিপীড়ন-অনাচার-অবিচার আর মৃত্যু নিয়ে খেলা করা শোষক গোষ্ঠী আজ জাতির জীবনে জগদ্দল পাথরের মত ভারী পাহাড়ের মত বসে আছে । সময়টা বড়ই নিষ্ঠুর, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য বড় অসময় এটা ।
জানো মাধবী, মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সমীক্ষায় বলছে ২০২০ সালের ২৫ জুন পর্যন্ত ১৩৪জন মানুষ এদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে, সীমান্তে ভারতীয় নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতে এই ছয় মাসে ২৫ জন নীরিহ বাংলাদেশী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এই করোনাকালীন মহামারীতেও শাসকদের কোন মানবিকতা নেই, মানবিক মূল্যবোধ কিংবা বিবেক বোধ নেই । কতটা নিষ্ঠুর , কতটা অমানবিক স্বৈরাচার কিংবা নৈরাজ্যবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা হলে এতটা নিষ্ঠুরতা দেখানো যায় বলো ! মাঝে মাঝে মনে হয়, তুমি এতটা নিষ্ঠুর নও, তুমি মানবিক, তোমার দেওয়া যন্ত্রনা যাপিত জীবনে মৃত্যুসম হলেও মৃত্যু নয় প্রিয়তমা আমার!!
মনটা ইদানীং ভীষন খারাপ থাকে। পরীক্ষা ছাড়া করোনার নেগেটিভ সার্টিফিকেট বিক্রি করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে, যার চেয়ারম্যান জনৈক সাহেদ, যিনি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপকমিটির একজন সদস্য বলে সোস্যাল মিডিয়ায় দেখলাম। একই অভিযোগ উঠেছে এক ডাক্তার দম্পতির বিরুদ্ধে এবং তারাও আওয়ামী রাজনীতির অনুসারী। আমি বলছি না এদের কর্মকাণ্ড আওয়ামীলীগের কোন কমিটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত। তবে, এদের সকল অবৈধ কর্মকাণ্ডের মূল প্রেরণা তাদের রাজনৈতিক চেতনাবোধ। কারণ, যখন তারা দেখে তাদের দল কিংবা দলীয় নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে মধ্যরাতে ভোট ডাকাতি, নির্বচারে খুন-গুম, মিথ্যা মামলা-হামলায় প্রতিপক্ষকে দমন পীড়ন, বিচার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ , প্রশাসন অথবা রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিরঙ্কুশভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা কিংবা ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি বা সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও ‘culture of impunity’তে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, তখন তারা সাহস পায়, অনুপ্রাণিত হয়, এক একটি সাহেদ তৈরী হয়, দেশের মুখে কালিমালিপ্ত হয় । তারা জানে, তাদের জন্য উন্নত দেশে বেগম পাড়ার সুব্যবস্থা আছে, প্রয়োজন মত পালিয়ে যাওয়া যায়, যেমন পালিয়ে গেছে অপহরণ মামলার আসামী সিকদার গ্রুপের পরিচালকদ্বয় । কিন্ত তারা উপলব্ধি করে না তাদের অপকর্মের দায় এবং ভোগান্তি নিতে হয় গোটা জাতিকে। যেমন নিতে হচ্ছে ইতালিতে বাংলাদেশের ফ্লাইট বন্ধ হওয়ার যন্ত্রনা, কুয়েতে রাতের ভোটের এমপি গ্রেফতার হওয়া, বিশ্বের দেশে দেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ম্লান করার ঘটনাসমুহ ।
আমার সবচেয়ে কষ্টের জায়গাটা আজ অন্য একটি খবর দেখে। দেখলাম বিএনপি’র এমপি হারুন সাহেব সংসদে দাঁড়িয়ে করোনার সার্টিফিকেট বিক্রেতা রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদের ক্রসফায়ারে হত্যার দাবী জানিয়েছেন। এই দাবী কখনো বিএনপির দাবী হতে পারে না। আমার জানামতে বিএনপি সাহেদদের অপকর্মের বিচার চায়, দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি চায়, তবে সেটা ক্রসফায়ারে নয়, বিচারিক প্রক্ক্রিয়ায় । কারণ, ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত গত দশ বছরে বিএনপি ক্রসফায়ারে তাদের ২, ৮১৭জন সতীর্থকে হারিয়েছে, ৬০১ জন বিএনপির সহযোদ্ধা গুমের শিকার হয়েছে, ৭৯৫ জন মানুষ পুলিশ হেফাজতে মারা গেছে। বিএনপি উপলব্ধি করেছে ক্রসফায়ার অসাংবিধানিক, বেআইনী, মানবতাবিরোধী! এমপি হারুনের এই দাবী আমাকে ব্যথিত করেছে। আমি এমপি হারুনের এই দাবী প্রত্যাখ্যান করি; আমি শাহেদগংদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করি প্রিয় !
প্রিয়, তুমি আমার আঁধার মানিক, আমি তোমাতে প্রণত, তোমাতেই আমার ভালোবাসার নৈবেদ্য নিবেদন করা, তুমিই আমার শেষের কবিতার লাবণ্য। তোমার সাথে আমার দেখা হয় না, হয়তোবা কোন জন্মেও দেখা হবে না, কথা হবেনা, আর সেটা তুমি দ্ব্যার্থহীন ভাবেই বলেছো। তবে তোমার সাথে আমার প্রতিদিন কথা হয় কল্পনায়-মনেমনে, মনের সবক’টা জানালা খুলে দিয়ে। এখানে তোমার নিয়ন্ত্রণ রেখা কাজ করে না। তারপরও, এই দু:সময়ে আমার সকল শান্তি, সব প্রগতি, তাবৎ প্রেরণার নিরন্তর উৎস তুমি ।
জানো মাধবী, রাষ্ট্রের নিপীড়ন নির্যাতনের সংস্কৃতি আজ ব্যক্তি জীবনে - ভালোবাসার মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে । আজ এক ভদ্রলোক আমাকে ফোন করে তার ভালোবাসার কথা, প্রতারিত হওয়ার রসায়নের কথা বললো, উপদেশ চাইলো। তার সমস্যাটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই রকম —
সে একটি মেয়েকে গভীরভাবে ভালোবেসেছিলো, মেয়েটিও বেশ কয়েক বছর ছেলেটির সাথে ভালোবাসার অভিনয় করে গেছে। ছেলেটির সাথে অভিনয় করাকালীন সময়ে মেয়েটি তার অন্য ছেলে বন্ধুদের সাথে সারারাত ভিডিও কলে থাকতো, কেউ কেউ তাদের নতুন এ্যাপার্টমেন্ট সাজানোর জন্য ডাকতো, লাল -সবুজ শাক -সবজি কিনে বাসায় আসতো, কেউ বা হাগ করার প্রস্তাব দিতো! মেয়েটি প্রতিরাতে সারারাত অন্য বন্ধুদের সাথে ভিডিও কলে কথা বলায়, সারাদিন চাকরী এবং অন্য বন্ধুদের সাথে ব্যস্ত সময় কাটানোর জন্য তার পর্যাপ্ত ঘুম হতো না, মেজাজ খিটমিটে হয়ে থাকতো এবং এর প্রভাবে প্রতিদিন তার বাঁধা ভালোবাসার মানুষটাকে মানষিক, এমনকি কখনো কখনো শারিরীক নির্যাতনেও অতিষ্ঠ করে তুলতো মেয়েটি। ছেলেটি জানালো, মেয়েটির বয়স্ক এক ডাক্তার অনুরাগী ছিলো, সে পৃথিবীর যেখানেই যেতো না কেন মেয়েটি ছিলো তার মুভমেন্ট রেজিষ্ট্রার, প্রতি মূহুর্তের খবর মেয়েটিকে পাঠাতো। একদিন বয়স্ক অনুরাগী প্রেমের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মেয়েটির জন্য মোমবাতির আলোয় ডিনারের আয়োজন করেছিলো, তখন মেয়েটি যার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করে যাচ্ছিলো সেই ছেলেটিকে নিজের বাসায় কয়েক ঘন্টা বসিয়ে রেখে দিব্যি মাঝরাত অবধি অবলিলায় ডিনার করে এসেছিলো। ছেলেটি কিছুদিন পরে এ ঘটনা জানতে পারে, হ্রদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, প্রতারিত হয়েছে বলে তার মনে হয়। রক্ত মুছে মেয়েটির ভালোবাসায় সে আবারো বুঁদ হয়ে থাকে। এভাবেই চলছিলো, সর্বশেষ ছেলেটি দেখতে পায় মেয়েটি করোনাকালীন সময়ে অন্য নতুন একজনের সাথে গাড়ীতে ঘুরছে, ফিরছে বাজার করছে, লাঞ্চ-ডিনার করছে। বেচারী বাঁধা ভালোবাসার মানুষটি যতবার মেয়েটির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে ততবারই মেয়েটি দূ্র্ব্যবহার করে তাড়িয়ে দিয়েছে। সর্বশেষ মেয়েটি জানিয়ে দেয় যে, তাঁর সাম্প্রতিক বন্ধুটি তাকে অনেক মূল্য দেয়। বাঁধা ছেলেটির মনে হয়েছে সে একটি নিলামের চক্করে আছে, সে এখন জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে, তার ভালোবাসা এখন নিলামে বিক্রি হচ্ছে! ঠিক যেমন করোনার সার্টিফিকেট শোষক গোষ্ঠীর প্রচ্ছন্ন মদদে বিক্রি হয়। ছেলেটি জানতে চায়, সে এখন কি করবে? আমি কোন উত্তর দেইনি, ভেবেছি, তোমাকে জিজ্ঞাসা করবো। এটাও কি সম্ভব মাধবী? প্রেমেরও কি নিলাম হয়? ডাক্তারের করোনার সার্টিফিকেট বিক্রির খবর পড়ে ছেলেটির কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে , তার নিদ্রাহীন নিশীথ রাতের সাথী হতে ইচ্ছে হচ্ছে !!
আজ আর নয়, ভালো থেকো সারাদিন, সারাক্ষণ। আমার কল্পনার সব রঙ তুলিতে তোমাকে সাজানো, তোমাকে কেউ নিলামে উঠাতেই পারবে না মাধবী। তুমি আমার একাকীত্বের দোসর, তুমি আমার জোৎস্না রাতের মাহিন !!
— লেখক আইনজীবি ও রাজনৈতিক কর্মী
১০ জুলাই ২০২০, ঢাকা ।
No comments:
Post a Comment